হেনকালে উপনীত ইন্দ্রের নন্দন।
গর্জ্জয়ে বানরধ্বজ শ্বেত অশ্বগণ।।
এক ক্রোশ দূরে দৃষ্টি করিয়া তখন।
বৈরাটীর প্রতি পার্থ বলেন বচন।।
চারিভিতে দেখিতেছি বহু রথিগণ।
দুর্য্যোধনে নাহি দেখি কিসের কারণ।।
পশ্চাতে করিব যুদ্ধ, রাজারে খুঁজিব।
অগ্রে চল তোমার গোধন ছাড়াইব।।
বামভিতে লহ রথ, যথা গবীগণ।
শুনি রথ চালাইল বিরাট-নন্দন।।
দূরে থাকি ভীষ্ম কৃপে করেন প্রণতি।
চারি বাণ মারিলেন আচার্য্যের প্রতি।।
দুই শর দিয়া পড়ে গুরু-পদতলে।
দুই অস্ত্র পরশিল দুই কর্ণমূলে।।
দেখিয়া হইল গুরু আনন্দে বিভোর।
বড়ভাগ্যে, দেখিলাম মুখ আজি তোর।।
সারথি কহিল, দেব কর অবধান।
প্রহারী জনেরে কেন এতেক সম্মান।।
হাসিয়া কহেন গুরু, প্রহারী এ নয়।
অশ্বত্থামাধিক মম পুত্র ধনঞ্জয়।।
এই যে যুগল অস্ত্র চরণে পড়িল।
চরণে ধরিয়া মোরে প্রণাম করিল।।
দুই বাণ পরশিল দুই কর্ণে আর।
এক কর্ণে নিবেদিল শুভ সমাচার।।
আর কর্ণে কহিলেক, আসিলাম আমি।
ত্রয়োদশ বৎসর সময় অনুক্রমি।।
যথোচিত ভাগ দিতে কহ দুর্য্যোধনে।
যুদ্ধ নহে ভাল, ভাল চাহ এইক্ষণে।।
ইহার উত্তর আমি করিব বিধান।
এত বলি প্রহারিল দ্রোণ দুই বাণ।।
এক বাণ শিরে চুম্বি ধরণী পড়িল।
আর বাণ কর্ণমূলে প্রত্যুত্তর দিল।।
উত্তর কহিল, কহ পাণ্ডব-মহান।
কে তোমারে প্রহারিল এই দুই বাণ।।
ভাগ্যে কর্ণমূলে বান না কৈল ঘাতন।
মোর চিত্তে মারিলেক বলহীন জন।।
পার্থ বলে, দ্রোণ গুরু জগতে বিদিত।
সদাকাল হন তিনি মোর প্রতি প্রীত।।
শিরেতে চুম্বন করি পড়িল যে বাণ।
বহুদিন সমাগমে করিল কল্যাণ।।
আর বাণ কর্ণমূলে কহে প্রত্যুত্তর।
শঙ্কা নাহি, যত সাধ্য করহ সমর।।
এতেক বলিয়া পার্থ পায় মহাতাপ।
কোথায় আছয়ে দুষ্ট কুরুকুল-পাপ।।
আজি তারে দিব আমি সমুচিত দণ্ড।
কেবল রাখিব প্রাণ করি লণ্ডভণ্ড।।
কাটিয়া মুকুট স্বর্ণছত্র নবদণ্ড।
রথ গজ কাটিয়া করিব খণ্ড খণ্ড।।
আজি যদি দুষ্টাচার পড়ে মম আগে।
মুহূর্ত্তেকে প্রহারিব সিংহ যেন মৃগে।।
এই যে সমূহ সেনা দেখহ উত্তর।
শীঘ্র রথ লহ মোর ইহার ভিতর।।
দুর্য্যোধন লুকাইয়া আছে রথিমাঝ।
সেই সে আমার শত্রু, অন্যে নাহি কাজ।।
অস্ত্র মারি সমাকুল করি সেনাগণ।
তবে ত দুর্য্যোধনের পাব দরশন।।
অহঙ্কারী মানী মূঢ় অতি দুরাচার।
আজি আমি গর্ব্ব চূর্ণ করিব তাহার।।
এতেক বলিয়া বীর তাহে প্রবেশিয়া।
দুর্য্যোধনে নাহি পান অনেক খুঁজিয়া।।
সৈন্য মধ্যে না পাইয়া রাজা দুর্য্যোধনে।
সিংহ যেন দুঃখচিত্ত নিরামিষ বনে।।
উত্তরে বলেন, এই দেখ বামভাগে।
লুকাইয়া কুরুপতি আছে এই দিকে।।
চালাহ সত্বর রথ যথা দুর্য্যোধন।
আজ্ঞামাত্রে চালাইল বিরাটনন্দন।।
সৈন্যের নিকটে পার্থ হন উপনীত।
দ্বিতীয় প্রহরে যেন আদিত্য উদিত।।
মস্তকে কিরীট ইন্দ্রদত্ত, অতি শোভা।
কর্ণেতে কুণ্ডল ইন্দ্রদত্ত, সূর্য্য আভা।।
গাণ্ডীব ধনুক অগ্নিদত্ত, বামহাতে।
অক্ষয় যুগল তূণ শোভে দুই ভিতে।।
শঙ্খ সিংহনাদ করে, কণ্ঠে মণি হার।
কাঁকালে বন্ধন খড়্গ ছুরি তীক্ষ্ণধার।।
রথের নির্ঘোষ গর্জ্জে বীর হনুমান।
আসিয়া ইন্দ্রের পুত্র ইন্দ্রের সমান।।
দুষ্টিমাত্রে সকলেই মূর্চ্ছিত হইল।
আছুক যুদ্ধের কার্য্য, দেখি পলাইল।।
অর্জ্জুনে দেখিয়া কন গঙ্গার তনয়।
ভাগ্যে আজি দেখিলাম বীর ধনঞ্জয়।।
ধর্ম্মযজ্ঞ বান্ধবপ্রিয় বলে মহাবল।
পাশাকাল দুঃখ স্মরি দিতে এল ফল।।
অন্য হেতু নহে এই দুর্য্যোধনে খুঁজে।
সিংহ যেন মৃগ খুঁজি বুলে বনমাঝ।।
আমো হৈতে দূরে যদি পায় দুর্য্যোধন।
তখনি লইয়া যাবে করিয়া বন্ধন।।
এত চিন্তি দুর্য্যোধনে রক্ষার কারণ।
শীঘ্রগতি ধেয়ে আসে যত রথিগণ।।
দুর্য্যোধন বেড়ি সবে রহে চারি পাশে।
দেখিয়া অর্জ্জুন বীর মনে মনে হাসে।।
হাসিয়া বলেন, শুন বিরাট নন্দন।
প্রাণভয়ে লুকাইয়া আছে দুর্য্যোধন।।
চল চল আগে তব গোধন ছাড়াব।
পাছে কুরুকুল-ক্লীবে খুঁজিয়া মারিব।।
রথ চালাইয়া দিল বিরাট নন্দন।
যথায় বেড়িয়া সৈন্য আছয়ে গোধন।।
পার্থ কহে, ক্ষণকাল রাখ হেথা রথ।
সৈন্য ভাঙ্গি গোধনের করি দিই পথ।।
এত বলি পার্থ বীর কৈল শরজাল।
বিচিত্র বরণ অস্ত্র যেন কালব্যাল।।
মুষলের ধারে যেন বর্ষে জলধর।
চক্ষুর নিমিষে আচ্ছাদিল দিনকর।।
নাহি দেখি অষ্ট দিক্ পৃথিবী আকাশ।
শূন্য পথ রুদ্ধ হৈল, না বহে বাতাস।।
মেঘে অন্ধকার যেন অমাবস্যা রাতি।
সারথিরে দেখিতে না পায় রথে রথী।।
অস্ত্র অগ্নি জ্বলে যেন খদ্যোত আকার।
সৈন্যেতে অক্ষত জন না রহিল আর।।
নাহি দেখি কোন দিক্ পলাইতে পথ।
অপ্রমিত কুরুসৈন্য ভয়ে জড়বৎ।।
চমৎকার হয়ে ডাকি বলে সর্ব্বসৈন্য।
ধন্য মহাবীর, তব জননী যে ধন্য।।
এতাদৃশ কর্ম্ম নাহি করে ত্রিভুবনে।
তোমা বিনা এই কর্ম্ম করে কোন্ জনে।।
শুনি তবে পার্থ বীর পূরে দেবদত্ত।
যাহার শ্রবণে হয় রিপু হীন-সত্ত্ব।।
গাণ্ডীবে টঙ্কার দেন আকর্ণ পূরিয়া।
রথের শ্বেতাশ্ব চারি উঠিল গর্জ্জিয়া।।
ধ্বজে হনূমান করে ভয়ঙ্কার নাদ।
চারি শব্দে তিন লোক গণিল প্রমাদ।।
শূণ্যেতে বিমানস্থিত যত জন ছিল।
ঘোর শব্দে সবে মূর্চ্ছা হইয়া পড়িল।।
অজ্ঞান হইয়া পড়ে যত কুরুবল।
সৈন্যেতে বেড়িয়াছিল গোধন সকল।।
মহাশব্দে ধেনুগণ হইয়া অস্থির।
ভাঙ্গি সৈন্যদল বেগে হইল বাহির।।
প্রলয়-সমুদ্র কিসে রাখিবেক কূলে।
বালিবান্ধে কি করিবে নদীস্রোতজলে।।
পুচ্ছ উচ্চ করি ধায় যত গবী সব।
দক্ষিণে বাহির হৈল করি হাম্বারব।।
চরণে শৃঙ্গেতে মর্দ্দি বহু সৈন্যগণ।
বাহির হইল সব মৎস্যের গোধন।।
গোপগণ প্রতি বলিলেন ধনঞ্জয়।
লয়ে যাহ গুরু, পূর্ব্বে আছিল যথায়।।
উত্তরে চাহিয়া তবে বলেন কিরীটী।
গবী মুক্ত করি তব দিলাম বৈরাটী।।
চিত্তে পাছে কর, জিনিলাম সব কুরু।
গৃহে যাব পাইলাম আপনার গরু।।
ভুবন-বিজয়ী এই কৌরবের সেনা।
ইন্দ্র তুল্য পরাক্রম এক এক জনা।।
শরানলে দহিবারে পারে ভূমণ্ডল।
নাহি জিনি গোধন জীয়ন্তে এ সকল।।
দূরেতে আছয়ে, তেঁই অস্ত্র নাহি মারে।
শীঘ্র রহ লহ মম সৈন্যের ভিতরে।।
ইহা শুনি বেগে রথ চালায় উত্তর।
বহু সৈন্য জিনি গেল সৈন্যের ভিতর।।
যথায় নৃপতি কুরুরাজ দুর্য্যোধন।
তথায় লইলা রথ বিরাট নন্দন।।
দেখিয়া ধাইল সর্ব্ব কুরু-সেনাপতি।
নৃপতির রক্ষা হেতু অতি শীঘ্রগতি।।
সহস্রেক শ্রেষ্ঠ রথী যুদ্ধে দিল মন।
ধাইয়া আসিল বেগে সূর্য্যের নন্দন।।
সহস্রেক রথী লয়ে কুরু-বংশপতি।
দুর্য্যোধন রক্ষা হেতু ভীষ্ম মহামতি।।
এক ভিতে নৃপতির ভাই ঊনশত।
আগুলিল পার্থে আসি সহস্রেক রথ।।
দ্রোণ কৃপ অশ্বত্থামা আদি মহারথী।
এক ভিতে রক্ষা হেতু রহে কুরুপতি।।
ভীষদশন হস্তী পর্ব্বত-আকার।
মুষল মুদগর শুণ্ডে ধরে সবাকার।।
সহস্র সহস্র মত্ত গজ আগে করি।
আপনি রহিল পাছু নানা অস্ত্র ধরি।।
সিংহনাদ শঙ্খনাদ ধনুক টঙ্কার।
চতুর্দ্দিকে প্রপূরিল করি মার মার।।
মহাভারতের কথা পারাবারে তরী।
কাশীরাম দাস রচে কৃষ্ণ-পদে স্মরি।।