৩১৭তম অধ্যায়
যোগসাধনায় সিদ্ধিদশার অবস্থা
“যাজ্ঞবল্ক্য কহিলেন, ‘হে মহারাজ! আমি তোমার নিকট সাঙ্খ্যজ্ঞানের কথা কীৰ্ত্তন করিলাম, এক্ষণে সাধ্যানুসারে যোগজ্ঞানের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। সাঙ্খ্যজ্ঞানের সদৃশ জ্ঞান এবং যোগবলের সদৃশ বল আর কিছুই নাই। এই উভয় মতেই সমুদয় অনুজ্ঞানের [পরস্পর অনুসরণের—একের অন্যের অনুসরণ করার] বিধি আছে এবং এই উভয় মতই মুক্তিসাধক। নির্ব্বোধ ব্যক্তিরাই এই উভয়ের বিভিন্নতা নির্দ্দেশ করে। আমরা এই উভয় মতকেই একরূপ বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছি। যোগী ও সাঙ্খ্যমতাবলম্বী উভয়েরই সিদ্ধিদশাতে এক বস্তুর সহিত সাক্ষাৎকার হইয়া থাকে। অতএব সাঙ্খ্য এবং যোগশাস্ত্রকে যাঁহারা তুল্য বলিয়া জ্ঞান করেন, তাহারাই যথার্থ পণ্ডিত।
‘প্রাণ ও ইন্দ্রিয়সমুদয় বশীভূত করিয়া যোগসিদ্ধ হইতে পারিলে অণিমাদি অষ্টগুণ লাভ করিয়া সমুদয় লোকে পরিভ্রমণ করা যায়। বেদে যমনিয়মাদি অষ্টাঙ্গযুক্ত যোগই প্রশস্ত বলিয়া কীৰ্ত্তিত হইয়াছে। ঐ যমনিয়মাদি অষ্টগুণ সূক্ষ্ম; আর অণিমাদি অষ্টগুণ উহা অপেক্ষা স্থূল। যোগ দুই প্রকার—সগুণ ও নির্গুণ। প্রাণায়ামযুক্ত যোগকে সগুণ এবং চিত্তের একাগ্রতাযুক্ত যোগকে নির্গুণ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। প্রাণায়াম আবার দুই প্রকার— সবীজ ও নিৰ্ব্বীজ। মূলাধারাদি চক্রস্থিত দেবতাসকলের ধ্যান না করিয়া প্রাণায়াম করিলে বাতাধিক্য হয়, অতএব তাহা কদাপি কৰ্ত্তব্য নহে। রজনী উপস্থিত হইলে প্রথম প্রহরে দ্বাদশ এবং নিদ্রাভঙ্গের পর গাত্রোত্থান করিয়া শেষযামে [শেষ প্রহরে] দ্বাদশ এই চতুর্ব্বিংশতি প্রকার বায়ুধারণার বিষয় যোগশাস্ত্রে প্রসিদ্ধ আছে। সেই চতুর্ব্বিংশতি প্রকার বায়ুধারণাদ্বারা দুর্দ্দান্ত মনকে নিগৃহীত করিয়া জীবাত্মাকে পরমাত্মায় সংযোগ করা দমগুণান্বিত শাস্ত্রবিৎ সন্ন্যাসীদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। যোগপরায়ণ মহাত্মারা শ্ৰোত্রাদি পাঁচ ইন্দ্রিয়কে শব্দাদি পাঁচ বিষয় হইতে নিরাকৃত করিয়া মনোমধ্যে, মনকে অহঙ্কারে, অহঙ্কারকে মহত্তত্ত্বে এবং মহত্তত্ত্বকে প্রকৃতিমধ্যে সংস্থাপনপূর্ব্বক কেবল পরব্রহ্মকে চিন্তা করিয়া থাকেন। সেই পরমাত্মা নিস্পাপ, নির্ম্মল, নিত্য, অনন্ত, অক্ষত, স্থির, জরামৃত্যুবিহীন ও অভেদ্য।
“অতঃপর নিত্যসমাধিযুক্ত যোগীর লক্ষণ কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। ঐরূপ যোগী সতত প্রসন্নচিত্ত হইয়া পরিতৃপ্ত সুষুপ্ত ব্যক্তির ন্যায়, নিৰ্ব্বাত প্রদেশস্থিত তৈলপূর্ণ প্রদীপের ন্যায় স্থিরভাবে অবস্থান করেন। পাষাণ যেমন মেঘনিপতিত জলবিন্দুদ্বারা আহত হইয়াও বিকম্পিত হয় না, সেইরূপ ঐ যোগী কিছুতেই যোগ হইতে বিচলিত হইবার নহেন। শঙ্খধ্বনি, দুন্দুভিনির্ঘোষ ও বিবিধ গীতবাদ্যদ্বারা তাঁহার যোগভঙ্গ করা নিতান্ত দুষ্কর। যেমন স্থিরস্বভাব ব্যক্তি তৈলপরিপূর্ণ পাত্র লইয়া, সোপানে আরোহণ করিবার কালে কৃপাণপাণি [অস্ত্রপাণি—হস্তে অস্ত্রযুক্ত] পুরুষকর্ত্তৃক তজ্জিত [আক্রোশিত—‘মারিব ধরিব’ ইত্যাদি উক্তিদ্বারা ভয়গ্রস্ত] ও ভীত হইয়াও বিন্দুমাত্র তৈল নিক্ষেপ করে না, তদ্রূপ ঐ যোগী ইন্দ্রিয়সমুদয়ের স্থৈর্য্যনিবন্ধন কোনক্রমেই যোগ হইতে বিচলিত হয়েন না। যোগে উত্তমরূপে নৈপুণ্য জন্মিলে গাঢ়তর অন্ধকারমধ্যে অবস্থিত জ্বলনতুল্য [উজ্জ্বল অগ্নিসদৃশ] অব্যয় ব্রহ্মের প্রত্যক্ষ হইয়া থাকে। মনুষ্য একমাত্র যোগদ্বারাই এই বিনশ্বর দেহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক মোক্ষলাভ করিতে সমর্থ হয়। এই আমি তোমার নিকট যোগীদিগের যোগের লক্ষণ কীৰ্ত্তন করিলাম, পণ্ডিতেরা ইহা পরিজ্ঞাত হইয়া আপনাদিগকে কৃতকার্য্য বিবেচনা করিয়া থাকেন।’ ”