৩১৪তম অধ্যায়
অজ্ঞাতবাসের নির্ব্বিঘ্নার্থ ঋষিগণসমীপে যুধিষ্ঠিরের প্রার্থনা
বৈশস্পায়ন কহিলেণ, হে রাজন! অনন্তর সত্যবিক্রম পাণ্ডবগণকে ধর্ম্মের অনুজ্ঞানুসারে ত্ৰয়োদশ বর্ষ অজ্ঞাতসারে বাস করিতে হইবে বলিয়া তাঁহাকে বনবাস-সহচর অনুরক্ত তপস্বিগণের সমীপে উপবেশনপূর্ব্বক তাঁহাদিগের অনুজ্ঞাগ্ৰহণাভিলাষে কৃতাঞ্জলিপুটে কহিতে লাগিলেন, “হে মুনিগণ! ধার্ত্তরাষ্ট্রেরা ছলপূর্ব্বক যে প্রকারে আমাদিগের রাজ্যপহরণ ও আমাদিগের সহিত বারংবার অসদব্যবহার করিয়াছেন, তাহা আপনাদিগের অবিদিত নাই, আমরা সেই জন্যই অরণ্যে অতিকষ্টে দ্বাদশ বৎসর অতিবাহিত করিলাম; সম্প্রতি অজ্ঞাতবাসের সময় সমুপস্থিত; এক্ষণে প্রচ্ছন্নবেশে বাস করিতে হইবে; অতএব আপনারা অনুজ্ঞা করুন। দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন, কর্ণ ও শকুনি জানিতে পারিলে বিষম অনৰ্থপাত হইবে; আমাদিগের সহিত তাহাদের বৈরভাব বদ্ধমূল হইয়াছে এবং পৌর ও আত্মীয়জন তাহার পক্ষ অবলম্বন করিয়াছে। হে ব্ৰাহ্মণগণ! আমরা সকলে কি পুনরায় স্বরাজ্যে অধিরোহণ করিয়া আপনাদিগের সহিত একত্র বাস করিব?” এই কথা কহিতে কহিতে রাজা যুধিষ্ঠির অশ্রুপূর্ণলোচনে শোকাভিভূত ও মূর্চ্ছিত হইয়া ধরাতলে নিপতিত হইলেন।
পাণ্ডবদিগের প্রতি ঋষিগণের আশ্বস্তিপ্রয়োগ
অনন্তর ব্রাহ্মণগণ তাঁহার ভ্রাতৃগণসহ রাজা যুধিষ্ঠিরকে আশ্বাস প্রদান করিতে লাগিলেন। পুরোহিত ধৌম্য নৃপতিকে সম্বোধন করিয়া মহাৰ্থপরিপূর্ণ বাক্যপ্রয়োগ করিতে আরম্ভ করিলেন, “হে রাজন! আপনি বিদ্বান, দান্ত, সত্যসন্ধ ও জিতেন্দ্ৰিয়; এবংবিধগুণসম্পন্ন ব্যক্তিরা কখন কোন আপদে মুহ্যমান হয়েন না। দেখুন, দেবগণও শক্রসমূহের নিগ্রহের নিমিত্ত প্রচ্ছন্নবেশে কত শতবার দুর্ব্বিপাকে নিপতিত হইয়াছেন। দেবরাজ অরাতি-বিনিগ্রহের নিমিত্ত প্রচ্ছন্নবেশে নিষধ-দেশে গিরিপ্রস্থাশ্রমে বাস করিয়া স্বকাৰ্য্যসাধন করিয়াছেন। ভগবান বিষ্ণু দৈত্যগণকে বধ করিবার নিমিত্ত অশ্বশিরা হইয়া অদিতি-গর্ভে অজ্ঞাতসারে দীর্ঘকাল বাস করিয়াছেন। তিনি প্রচ্ছন্নরূপে বামন-আকার স্বীকার করিয়া যে প্রকার বিক্রমে বলির রাজ্যপহরণ করিয়াছেন, হুতাশন জলে প্রবিষ্ট হইয়া যে প্রকারে সুরগণের কাৰ্য্যসাধন করিয়াছেন, নারায়ণশত্রুদমনার্থ প্রচ্ছন্নবেশে বজ্রে প্রবিষ্ট হইয়া সুররাজের যে কাৰ্য্যসাধন করিয়াছেন, ব্রহ্মর্ষি ঔর্ব্ব ঊরুতে প্রচ্ছন্নরূপে বাস করিয়া দেবগণের নিমিত্ত যে কাৰ্য্য সম্পন্ন করিয়াছেন, তৎসমুদয় আপনার শ্রবণগোচর হইয়াছে। এইরূপে মহাতেজাঃ দিবাকর ছদ্মবেশে ভূতলে বাস করিয়া শত্ৰুগণকে দগ্ধ করিয়াছেন, ভীমকর্ম্ম বিষ্ণু প্রচ্ছন্নভাবে দশরথ গৃহে বাস করিয়া দশাননকে সমরশায়ী করিয়াছেন এবং সকল মহাত্মাই এইরূপে প্রচ্ছন্নভাবে শক্রগণকে পরাজয় করিয়াছেন, আপনিও তদ্রূপ অরাতিকুল নির্মূল করিবেন, সন্দেহ নাই।”
ধর্ম্মপরায়ণ ধর্ম্মরাজ ধৌম্যবাক্যে পরিতুষ্ট হইয়া শাস্ত্ৰবুদ্ধি ও স্ববুদ্ধিপ্রভাবে প্রকৃতিস্থ হইলে মহাবল ভীমসেন তাঁহার হৰ্ষোৎপাদনের নিমিত্ত কহিলেন, “মহারাজ! গাণ্ডীবধন্বা অর্জ্জুন আপনার ও ধর্ম্মের অনুরোধেই কিঞ্চিম্মাত্র সাহস প্রকাশ করেন নাই, শত্রুদলনসমর্থ ভীমবিক্ৰম নকুল ও সহদেবকে প্রতিদিন আমিই নিবারণ করিয়া রাখিয়াছি। আপনি আমাদিগকে যে বিষয়ে নিয়োগ করবেন, আমরা তাহা কদাচ পরিত্যাগ করিব না। অতএব আপনি উপায় বিধান করুন, শীঘ্রই আরাতিগণকে পরাজয় করিব।”
ভীমসেনের বাক্য অবসান হইলে ব্রাহ্মণগণ পাণ্ডবগণকে আশীৰ্বাদপ্রয়োগ ও আমন্ত্রণপূর্ব্বক স্ব স্ব স্থানে প্ৰস্থান করিলেন। বেদবেত্তা যদি ও মুনিগণ পাণ্ডবগণের পুনঃদর্শন-লালসায় ন্যায়ানুসারে বিহিত স্থানে বাস করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবগণ বিদ্বান ব্রাহ্মণ, ধৌম্য ও পাঞ্চালীকে সমভিব্যাহারে লইয়া কোন কারণবশতঃ সেইস্থান হইতে ক্ৰোশমাত্র গমনপূর্ব্বক পরদিন অবধি অজ্ঞাতবাস করিতে হইবে বলিয়া তাহার উদযোগ করিতে লাগিলেন। তাঁহারা সকলে পৃথক পৃথক শাস্ত্রবেত্তা, মন্ত্রকুশল ও সন্ধিবিগ্ৰহকালজ্ঞ, অতএব মন্ত্রণা করিবার নিমিত্ত তথায় উপবেশন করিলেন।
আরণেয়পর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।
বনপর্ব্ব সম্পূর্ণ