৩১২তম অধ্যায়
মৃত অনুজগণের জন্য যুধিষ্ঠিরের শোক
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নৃপবর! রাজা যুধিষ্ঠির সরোবরতীরে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, ইন্দ্রপ্রতিম ভ্রাতৃগণ যুগান্তকালীন লোকপালের ন্যায় নিশ্চেষ্ট হইয়া নিপতিত হইয়াছেন। ধনুর্ব্বাণসকল ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িয়াছে; তিনি তাহা দৰ্শন করিবামাত্র অতিমাত্ৰ শোকে সমাকুল হইয়া গলদশ্রলোচনে দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক বিলাপ করিতে লাগিলেন, “হে মহাবাহো বৃকোদর! তুমি যে ‘গদাঘাতে দুৰ্য্যোধনের ঊরু ভঙ্গ করিব’ বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, আজি নিপতিত হইয়া সেই সমুদয় বিফল করিলে! হা মহাত্মন! হা মহাবাহো! হা কুরুকুলকীর্ত্তিবৰ্দ্ধন!! মনুষ্যের প্রতিশ্রুত বাক্যই বিফল হইয়া থাকে, কিন্তু তোমাদিগের দিব্য বাক্য কি নিমিত্ত মিথ্যা হইল, বলিতে পারি না।
“হা ধনঞ্জয়, তুমি ভূমিষ্ঠ হইলে দেবগণ জননীকে কহিয়াছিলেন, “হে কুন্তি! তোমার এই পুত্ৰ সহস্রাক্ষ অপেক্ষা কোন অংশেই ন্যূন হইবে না।” আর তৎকালে উত্তর-পরিপাত্র পর্ব্বতে সকলে এই বলিয়া গান করিয়াছিলেন যে, ‘ইনি অপহৃত রাজলক্ষ্মীকে বলপূর্ব্বক পুনর্ব্বার গ্রহণ করিবেন, সমরে ইঁহার জেতা কেহই নাই এবং অজেয়ও কেহই নাই।’ আজি সেই জয়শীল মহাবল ধনঞ্জয় মৃত্যুর বশবর্ত্তী হইলেন! আমরা যাহার শরণাপন্ন হইয়া ঈদৃশ দুঃখপরম্পরা সহ্য করিতেছি, আজি সেই পার্থ আমাদের সমুদয় আশা উন্মলিত করিয়া ধরাশয্যায় শয়ান রহিয়াছেন।
“যে বীরদ্বয়, ভীমসেন ও ধনঞ্জয় সমরাঙ্গনে উন্মত্ত হইয়া শক্ৰগণকে নির্দালন করিতেন, যাঁহাদের বলবীৰ্য্যের ইয়ত্ত ছিল না, কোন অস্ত্রেই যাহাদিগকে প্রতিহত করিতে সমর্থ হইত না, যাঁহারা কুন্তীর গর্ভে জন্মপরিগ্রহ করিয়াছেন, আমি তাঁহারা শত্রুবশতাপন্ন হইলেন। হা নকুল! হা সহদেব! তোমরা দুই সহোদরে ভূমি শয্যা গ্ৰহণ করিয়াছ দেখিয়াও যখন আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইল না, তখন ইহা পাষাণের সারাংশদ্বারা বিনির্ম্মিত হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। হে ভ্রাতৃগণ! তোমরা সকলে শাস্ত্ৰজ্ঞ, দেশকালাভিজ্ঞ, তপশ্চৰ্য্যাপরায়ণ ও সৎকর্ম্মশালী; অতএব তোমরা আপনাদের অনুরূপ কাৰ্য্যানুষ্ঠান না করিয়া কি নিমিত্ত শয়ান রহিয়াছ? তোমাদের শরীর অক্ষত ও শরাসন অপ্ৰমৃষ্ট [অব্যবহৃতপূর্ব্ব-যাহার ব্যবহার হয় নাই—যাহাতে যুদ্ধবাণযোজনা করা হয় নাই] দেখিতেছি, তবে কি নিমিত্ত তোমরা সংজ্ঞা শুন্য হইয়া ধরাশায়ী হইয়াছ?”
মহামতি যুধিষ্ঠির সানুচতুষ্টয়ের ন্যায় ভ্রাতৃগণকে সুখপ্রসুপ্ত দেখিয়া শোকসাগরে নিমগ্ন ও কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া রহিলেন। অনন্তর নানাবিধ বিলাপ করিয়া বহুক্ষণের পর আপনাকে সংস্তম্ভিত [ধৈৰ্য্যসম্পন্ন] করিয়া বুদ্ধিদ্বারা ঐ ব্যাপারের কারণ চিন্তা করিতে লাগিলেন, “ইহাদের শরীরে শস্ত্ৰাঘাত বা এই স্থানে কোন ব্যক্তির পদচিহ্ন দৃষ্টিগোচর হইতেছে না; ইহাতে বোধ হয়, কোন দুষ্ট ভূত আমার এই ভ্রাতৃগণের প্রাণসংহার করিয়াছে। যাহা হউক, একাগ্রচিত্তে চিন্তা অথবা এই জল পরীক্ষা করিয়া দেখি।
“বোধ হয়, কাৰ্য্যাকাৰ্য্যবিবেকাশূন্য, বিশ্বাসঘাতক, কুটিলমতি, দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনের অভিপ্রায়ানুসারে গান্ধাররাজ নির্জ্জনে এই সরোবর নির্ম্মাণ করিয়া ইহার সলিল কোন দ্রব্যে দূষিত করিয়া রাখিয়াছে; অথবা ঐ দুরাত্মা গৃঢ় চর প্রেরণ করিয়া এই জল বিষদূষিত করিয়াছে; এই নিমিত্ত আমার ভ্রাতৃগণের মৃত-শরীর কিছুমাত্র বিকৃত হয় নাই; মুখবর্ণ যেমন প্ৰসন্ন, সেইরূপই রহিয়াছে। আহা! ইহারা এক একজন প্রচুর বলশালী, কালান্তক যম ব্যতীত কে ইহাদিগকে সংহার করিতে সমর্থ!” এই বলিয়া রাজা যুধিষ্ঠির সেই সরোবরে অবতরণ করিলেন। তিনি সরোবরে অবতীর্ণ হইবামাত্র অন্তরীক্ষ হইতে এই বাক্য শ্রবণ করিলেন, “রাজপুত্র! আমি শৈবাল ও মাংসভোজী বক; আমিই তোমার অনুজগণকে শামন-সদনে প্রেরণ করিয়াছি; যদ্যপি আমার প্রশ্নের উত্তর প্রদান না কর, তাহা হইলে তোমাকে ইহাদিগের অনুসরণ করিতে হইবে। বৎস কৌন্তেয়! এরূপ সাহস করিও না, আমি পূর্ব্বে এই সরোবর অধিকার করিয়াছি, অতএব অগ্রে আমার প্রশ্নের প্রত্যুত্তর প্রদান কর, পরিশেষে ইহার জল পান বা গ্ৰহণ করিও ।”
রাজা যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে মহাবল! হিমালয়, পারিপাত্ৰ, বিন্ধ্য ও মলয় এই অবিচলিত পর্ব্বতচতুষ্টয়াকে কে পাতিত করিয়াছে? ইহা পরীক্ষা কর্ম্ম নহে, বোধ হয়, এই মহৎকর্ম্ম আপনিই করিয়াছেন; অতএব জিজ্ঞাসা করি, আপনি কে? আপনি কি রুদ্র, বসু বা মরুদগণের অধিপতি? কি আশ্চৰ্য্য! দেবগণ, গন্ধর্ব্বগণ, অসুরগণ ও রাক্ষসগণ যাঁহাদিগের ঘোরতর সমর সহ্য করিতে পারেন না, আপনি তাঁহাদিগকে ধরাশায়ী করিলেন! ভগবন! আপনি যে কি করিবেন ও আপনার কি অভিলাষ, কিছুই জানি না, অধুনা উহা জানিবার নিমিত্ত আমার অন্তঃকরণে কৌতুহল ও ভয় যুগপৎ [একই কালে] আবির্ভূত হইয়াছে, হৃদয় কম্পিত হইতেছে, শিরোবেদনা সমুৎপন্ন হইয়াছে। এক্ষণে জিজ্ঞাসা করি, আপনি কে?”
যক্ষ কহিলেন, “তোমার মঙ্গল হউক, আমি যক্ষ, জলচর পক্ষী নহি, আমি তোমার মহাতেজাঃ ভ্রাতৃগণকে নিহত করিয়াছি।”
বকরূপী যক্ষের সহিত ধর্ম্মরাজের পরিচয়
রাজা যুধিষ্ঠির যক্ষের মুখে এইরূপ পরুষাক্ষর অকল্যাণকর বাক্য শ্রবণ করিয়া উত্থিত হইবামাত্ৰ দেখিলেন, বিবূপাক্ষ, মহাকায়, তালসমুন্নত, সূৰ্য্যাগ্নিসদৃশ, পর্ব্বতোপম এক যক্ষ ঘনঘটার ন্যায় গভীর গর্জ্জন করিয়া বৃক্ষ অবলম্বনপূর্ব্বক দণ্ডায়মান হইয়া কহিতে লাগিলেন, “রাজন! আমি তোমার এই ভ্রাতৃগণকে বারংবার নিষেধ করিয়াছিলাম, কিন্তু ইহারা আমার বাক্য উপেক্ষা করিয়া বলপূর্ব্বক জলগ্ৰহণ করিতে অভিলাষী হইয়াছিল, এই নিমিত্ত ইহাদিগের প্রাণসংহার করিয়াছি। এক্ষণে তোমাকেও কহিতেছি, যদ্যপি প্রাণ রক্ষা করিবার অভিলাষ থাকে, তবে জলপান করিতে সাহস করিও না, আমি পূর্ব্বেই ইহা অধিকার করিয়াছি, অতএব অগ্রে আমার প্রশ্নের উত্তর প্রদান কর, পরিশেষে সলিল পান ও গ্রহণ করিও।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে যক্ষ! তোমার অধিকৃত বস্তু গ্ৰহণ করিতে আমার অভিলাষ নাই, এক্ষণে তোমার কি জিজ্ঞাস্য আছে, বল, আমি আত্মশ্লাঘা করিতেছি না, কারণ সাধুপুরুষেরা সতত আত্মশ্লাঘা নিন্দা করিয়া থাকেন, অতএব এইমাত্র কহিতেছি, নিজ বুদ্ধিসাধ্যানুসারে তোমার প্রশ্নের প্রত্যুত্তর প্রদান করিব।”
যক্ষ যুধিষ্ঠিরের পরস্পর প্রশ্নোত্তর
যক্ষ কহিলেন, “কে আদিত্যকে উন্নত করেন, কাহারা তাঁহার চতুর্দ্দিকে থাকেন, কে বা তাঁহাকে অস্তমিত করেন এবং তিনি কোথায় প্রতিষ্ঠিত আছেন?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ব্ৰহ্ম আদিত্যকে উন্নমিত করেন, দেবগণ তাঁহার চতুর্দ্দিকে বিচরণ করিয়া থাকেন, ধর্ম্ম তাঁহাকে অস্তমিত করেন এবং তিনি সত্যে প্রতিষ্ঠিত আছেন।”
যক্ষ কহিলেন, “কিসের দ্বারা শ্রোত্রিয় হয়, কিসের দ্বারা মহত্তলাভ হয়, কিসের দ্বারা পুত্রবান হয়, এবং কিসের দ্বারাই বা বুদ্ধিমান হয়?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “শ্রুতিদ্বারা শ্রোত্ৰিয়, তপস্যাদ্বারা মহত্ত্ব, যজ্ঞদ্বারা পুত্রবান এবং বৃদ্ধ সেবায় বুদ্ধিমান হয়।”
যক্ষ কহিলেন, “‘ব্রাহ্মণগণের দেবত্ব কি ও তাঁহাদিগের কোন ধর্ম্ম সাধুধর্ম্ম, তাঁহাদিগের মনুষ্যভাব কি এবং কি প্রকার ভাবই বা অসাধু ভাব?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “বেদপাঠ তাঁহাদিগের দেবভাব, তপস্যা সাধুধর্ম্ম, মৃত্যু মনুষ্যভাব এবং পরীবাদ অসাধুভাব।”
যক্ষ কহিলেন, “ক্ষত্ৰিয়গণের দেবভাব, সাধুভাব, মনুষ্যভাব এবং অসাধুভাবই বা কি?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ক্ষত্ৰিয়গণের অস্ত্রশস্ত্র দেবভাব, যজ্ঞ সাধুভাব, ভয় মনুষ্যভাব এবং পরিত্যাগ অসাধুভাব।”
যক্ষ কহিলেন, “যজ্ঞীয় সাম কি, যজ্ঞীয় যজুঃ, কি, যে যজ্ঞ বরণ করে এবং কাহাকে অতিবর্ত্তন করে না?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “প্ৰাণ যজ্ঞীয় সাম, মন যজ্ঞীয় যজুঃ, ঋক যজ্ঞকে বরণ করে এবং যজ্ঞ তাঁহাকে অতিক্রম করে না।”
যক্ষ কহিলেন, “আবপনকারী [দেবতৰ্পণকারী], নিবপনকারী, প্রতিষ্ঠমান [পিতৃতর্পণকারী] এবং প্রসবকারী, ইহাদিগের কি কি শ্রেষ্ঠ?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “আপবন কারীদের বৃষ্টি নিবপনকারীদিগের [প্রতিষ্ঠালিপ্স] বীজ, প্রতিষ্ঠমান দিগের ধেনু এবং প্রসূতিদিগের পুত্ৰই শ্রেষ্ঠ।”
যক্ষ কহিলেন, “কোন ব্যক্তি ইন্দ্ৰিয়সুখানুভবে সমর্থ বুদ্ধিমান, লোকপূজিত ও সর্ব্বপ্রাণীর সম্মত হইয়া জীবন থাকিতেও জীবিত নহে?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “যে ব্যক্তি দেবতা, অতিথি, ভৃত্য, পিতৃলোক ও আত্মা, ইহাদিগের নিমিত্ত নির্ব্বপণ [শ্ৰাদ্ধঅৰ্চনাদি] না করে, সেই ব্যক্তিই জীবন থাকিতেও জীবিত নহে।”
যক্ষ কহিলেন, “পৃথিবী অপেক্ষাও গুরুতর কে, আকাশ অপেক্ষাও উচ্চতর কে, বায়ু অপেক্ষা শীঘ্ৰগামী কে, আর কাহার সংখ্যা তৃণ অপেক্ষাও বহুতর?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “মাতা পৃথিবী অপেক্ষা গুরুতর, পিতা আকাশ অপেক্ষা উচ্চর, মন বায়ু অপেক্ষা শীঘ্ৰগামী এবং চিন্তা তৃণ অপেক্ষা বহুতর।’
যক্ষ কহিলেন, “কে নিদ্রিত হইলে নয়ন মুদিত করে না, কে জন্মিয়া স্পন্দিত হয় না, কাহার হৃদয় নাই এবং কে বেগে বদ্ধিত হয়?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, ‘মৎস্য নিদ্রিত হইলে নয়ন মুদিত করে না, অণ্ড জন্মিয়া স্পন্দিত হয় না, পাষাণের হৃদয় নাই, এবং নদী বেগে বদ্ধিত হয়।”
যক্ষ কহিলেন, “প্রবাসীর মিত্ৰ কে, গৃহবাসীর মিত্ৰ কে, আতুরের মিত্র কে এবং মুমূর্ষু ব্যক্তির মিত্র কে?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “প্রবাসীর সঙ্গী, গৃহবাসী ভার্য্যা, আতুরের চিকিৎসক এবং মুমূর্ষু ব্যক্তির দানই মিত্র।”
যক্ষ কহিলেন, “কে সর্ব্বভূতের অতিথি, সনাতনধর্ম্ম কি, অমৃত কি এবং সমুদয় জগৎ কি পদাৰ্থ?”
যুধিষ্ঠির কহিলেণ, “অগ্নি সর্ব্বভূতের অতিথি, সলিল ও যজ্ঞশেষ অমৃত, জ্ঞানযোগ সনাতনধর্ম্ম এবং বায়ু সমুদয় জগৎ।”
যক্ষ কহিলেন, “কে একাকী বিচরণ করেন, কে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করেন, হিমের ঔষধ কি এবং কে প্রধান বপনক্ষেত্ৰ?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “সূৰ্য্য একাকী বিচরণ করেন, চন্দ্ৰমা পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করেন, অগ্নি হিমের ঔষধ এবং পৃথিবী প্রধান বপনক্ষেত্র।”
যক্ষ কহিলেন, “ধর্ম্মের একমাত্র আশ্রয় কি, যশের একমাত্র আশ্রয় কি, স্বর্গের একমাত্র আশ্রয় কি এবং সুখের একমাত্র আশ্রয় কি?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “দাক্ষ্য ধর্ম্মের, দান যশের, সত্য স্বর্গের এবং শীল সুখের একমাত্ৰ আশ্রয়।”
যক্ষ কহিলেন, “মনুষ্যের আত্মা কে, দৈবকৃত সখা কে, উপজীবিকা এবং প্রধান আশ্রয়ই বা কি?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পুত্র মনুষ্যের আত্মা, ভার্য্যা দৈবকৃত সখা, মেঘ উপজীবিকা এবং দান প্রধান আশ্রয়।”
যক্ষ কহিলেন, “ধন্যের মধ্যে উত্তম কি, ধনের মধ্যে উত্তম কি, লাভের মধ্যে উত্তম কি এবং সুখের মধ্যে উত্তম কি?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ধন্যের মধ্যে দাক্ষ্য, ধনের মধ্যে শাস্ত্ৰ, লাভের মধ্যে আরোগ্য এবং সুখের মধ্যে সন্তোষই উত্তম।”
যক্ষ কহিলেন, “প্রধান ধর্ম্ম কি, কোন ধর্ম্ম সর্ব্বদা ফলবান, কাহাকে সংযত করিলে শোক থাকে না, এবং কাহার সহিত সন্ধি করিলে সে সন্ধি ভঙ্গ হয় না?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “আনৃশংস্য প্রধান ধর্ম্ম, বৈদিক ধর্ম্ম সর্ব্বদা ফলবান, মনকে সংযত করিলে শোক থাকে না, এবং সাধুর সহিত সন্ধি হইলে ভঙ্গ হয় না।”
যক্ষ কহিলেন, “কি ত্যাগ করিলে প্রিয় হয়, কি ত্যাগ করিলে শোক হয় না, কি ত্যাগ করিলে অর্থবান হয় এবং কি ত্যাগ করিলে সুখী হয়?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “অভিমান ত্যাগ করিলে প্রিয় হয়, ক্রোধ ত্যাগ করিলে শোক থাকে না, কামনা ত্যাগ করিলে অর্থবান হয় এবং লোভ ত্যাগ করিলেই সুখী হয়।”
যক্ষ কহিলেন, “ব্রাহ্মণ, নট ও নর্ত্তক, ভৃত্য এবং রাজা ইহাদিগকে দান করিবার আবশ্যক কি?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ধর্ম্মের নিমিত্ত ব্রাহ্মণকে, যশের নিমিত্ত নট ও নর্ত্তককে, ভরণের নিমিত্ত ভৃত্যকে, এবং ভয়ের নিমিত্ত রাজাকে দান করে।’
যক্ষ কহিলেন, “লোকসকল কিসের দ্বারা আবৃত ও কিসের দ্বারা অপ্রকাশিত থাকে, কি জন্য মিত্ৰগণকে পরিত্যাগ করে এবং কি জন্যই বা স্বৰ্গগমনে অসমর্থ হয়?”
যক্ষ কহিলেন, “লোকসকল কিসের দ্বারা আবৃত ও কিসের দ্বারা অপ্রকাশিত থাকে, কি জন্য মিত্ৰগণকে পরিত্যাগ করে এবং কি জন্যই বা স্বৰ্গগমনে অসমর্থ হয়?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “লোকসকল অজ্ঞানে আবৃত থাকে, তমোদ্বারা অপ্রকাশিত থাকে, লোভ হেতু মিত্ৰগণকে পরিত্যাগ করে এবং সঙ্গ হেতু স্বৰ্গগমনে অসমর্থ হয়।”
যক্ষ কহিলেন, “মৃত পুরুষ কে, মৃত রাষ্ট্র কি, মৃত শ্ৰাদ্ধ কি এবং মৃত যজ্ঞই বা কি?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “দরিদ্র পুরুষই মৃত, অরাজক রাষ্ট্রই মৃত রাষ্ট্র, অশ্রোত্রিয় শ্ৰাদ্ধই মৃত শ্ৰাদ্ধ এবং অদক্ষিণ যজ্ঞই মৃত যজ্ঞ।”
যক্ষ কহিলেন, “দিক কি, জল কি, অন্ন কি, বিষ কি এবং শ্রাদ্ধের কালই বা কি?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “সাধুগণই দিক, আকাশই জল, ধেনুই অন্ন, প্রার্থনাই বিষ এবং ব্রাহ্মণই শ্রাদ্ধের কাল।”
যক্ষ কহিলেন, “তাপ, দম, ক্ষমা ও লজ্জার লক্ষণ কি?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “স্বধর্ম্মানুবর্ত্তিত্বই তপ, মনের নিগ্রহই দম, দ্বন্দ্বসহিষ্ণুতাই ক্ষমা, অকাৰ্য্য হইতে নিবৃত্তিই লজ্জা।”
যক্ষ কহিলেন, “জ্ঞান, শম, দয়া এবং আর্জাব কাহাকে কহে?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “তত্ত্বার্থোপলব্ধিই জ্ঞান, চিত্তের প্রশান্ততাই শম, সকলের সুখ ইচ্ছা করাই দয়া এবং সমচিত্ততাই আর্জ্জব।”
যক্ষ কহিলেন, “পুরুষের কোন শত্রু দুর্জ্জয়, কোন ব্যাধি অনন্ত, কীদৃশ লোক সাধু এবং কীদৃশ লোকই বা অসাধু?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ক্রোধ দুর্জ্জয় শত্ৰু, লোভ অনন্ত ব্যাধি, সকল প্রাণীর হিতকারী ব্যক্তি সাধু এবং নির্দ্দয় ব্যক্তিই অসাধু।”
যক্ষ কহিলেন, “মোহ, মান, আলস্য ও শোকের লক্ষণ কি?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, ‘ধর্ম্মবিষয়ে অনভিজ্ঞতাই মোহ, আত্মাভিমানিতাই মান, ধর্ম্মানুষ্ঠান না করাই আলস্য এবং অজ্ঞানই শোক।”
যক্ষ কহিলেন, “ঋষিগণ স্থৈৰ্য্য, ধৈৰ্য্য, স্নান ও দানের কি লক্ষণ করিয়াছেন?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “স্বধর্ম্মে স্থিরতাই স্থৈৰ্য্য, ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ ধৈৰ্য্য, মনোমালিন্য-পরিত্যাগই স্নান এবং প্রাণীগণকে রক্ষা করাই দান; এই লক্ষণ নির্দ্দিষ্ট আছে।”
যক্ষ কহিলেন, “পণ্ডিত কে, নাস্তিক কে, মূর্খ কে, কাম কি এবং মৎসরই বা কি?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, ‘ধর্ম্মজ্ঞ ব্যক্তি পণ্ডিত, মূর্খই নাস্তিক, নাস্তিকই মূর্খ, সংসারহেতুই কাম ও হৃত্তাপই মৎসর।”
যক্ষ কহিলেন, “অহঙ্কার, দম্ভ, দৈব এবং পৈশুন্য কি?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “অজ্ঞানরাশিই অহঙ্কার, ধর্ম্মধ্বজের উন্নমনই দম্ভ, দানের ফলেই দৈব, এবং পরের প্রতি দোষারোপ করাই পৈশুন্য।”
যক্ষ কহিলেন, ‘ধর্ম্ম, অর্থ ও কাম ইহারা পরস্পরবিরোধী তবে কি প্রকারে ইহাদিগের একত্ৰ সমাবেশ হয়?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “যখন ধর্ম্ম ও ভাৰ্য্যা এই উভয়ে পরস্পর বংশানুগ হয়, তখনই ধর্ম্ম, অর্থ ও কাম এই তিনের একত্র সমাবেশ হইয়া থাকে।”
যক্ষ কহিলেন, “হে রাজন! তুমি শীঘ্ৰ বল, কোন কর্ম্ম করিলে অক্ষয় নরকে গরম করিতে হয়?
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “যে ব্যক্তি যাচমান অকিঞ্চন ব্রাহ্মণকে স্বয়ং আহ্বান করিয়া পরিশেষে ‘নাই’ বলিয়া বিদায় করে, যে ব্যক্তি বেদ, ধর্ম্মশাস্ত্ৰ, দ্বিজাতি, দেবতা ও পৈতৃক ধর্ম্ম মিথ্যা বলিয়া প্ৰতিপন্ন করে এবং যে ব্যক্তি ধন বিদ্যমান থাকিতেও “নাই” বলিয়া দান ও ভোগে পরাঙ্মুখ হইয়া থাকে, তাহাদিগকেই অক্ষয় নরকে গমন করিতে হয়।”
যক্ষ কহিলেন; “হে রাজন! কুল, বৃত্ত, স্বাধ্যায় এবং শ্রুত ইহার মধ্যে কোনটি ব্রাহ্মণত্বের কারণ, তুমি নিশ্চয় করিয়া বল।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে যক্ষ! কুল, স্বাধ্যায় বা শ্রুত ইহার কিছুতেই ব্রাহ্মণত্ব জন্মে না; কেবল একমাত্র বৃত্তই ব্ৰাহ্মণত্বের কারণ; অতএব ব্রাহ্মণ যত্নপূর্ব্বক বিশেষরূপে বৃত্ত রক্ষা করিবেন। অক্ষীণবৃত্ত হইলে ব্রাহ্মণ কদাচ হীন হয়েন না; কিন্তু ক্ষীণবৃত্ত হইলে যথার্থই হীন হইতে হয়। ব্রাহ্মাণের কেবল অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, শাস্ত্রচিন্তা করিলেই হইবে না, তিনি ক্রিয়াবানযোগনিষ্ঠ হইলে তবে যথার্থ পণ্ডিত হইবেন। চতুর্ব্বেদবেত্তা ব্যক্তিও দুর্বৃত্ত হইলে কখন ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিগণিত হয়েন না; কেবল শূদ্র হইতে ভিন্ন, এইমাত্র বিশেষ; কিন্তু যিনি অগ্নিহোত্রপরায়ণ, তিনি যথার্থ ব্ৰাহ্মণ।”
যক্ষ কহিলেন, “প্রিয়বাক্য কহিলে কি লাভ হয়, বিবেচনাপূর্ব্বক কাৰ্য্য করিলে কি লাভ হয়, বহুমিত্র হইলে কি লাভ হয় এবং ধর্ম্মে অনুরক্ত থাকিলেই বা কি লাভ হইয়া থাকে?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “প্রিয়বাদী সকলের প্রিয় হয়, বিমৃষ্যকারী ব্যক্তি অধিকতর জয়লাভ করে, বহুমিত্রশালী ব্যক্তি সতত সুখে বাস করে এবং ধর্ম্মানুগত ব্যক্তি সদগতিলাভ করিয়া থাকে।”
যক্ষ কহিলেন, “সুখী কে, আশ্চৰ্য্য কি, পথ এবং বার্ত্তাই বা কি? এই চারি প্রশ্নের উত্তর প্রদান করিলে তোমার ভ্রাতৃগণ জীবিত হইবেন।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “যিনি ঋণশূন্য ও অপ্রবাসী হইয়া দিবসের পঞ্চম বা ষষ্ঠ ভাগে আপন গৃহে শাক পাক করেন, তিনিই সুখী। প্রাণীগণ প্রতিদিন শমনসদনে গমন করিতেছে দেখিয়াও অবশিষ্ট লোকে যে চিরজীবন ইচ্ছা করে, ইহা অপেক্ষা আশ্চর্য্যের বিষয় আর কি আছে? তর্কের স্থিরতা নাই, বেদসকল ও স্মৃতিসমূহ ভিন্ন ভিন্ন প্রকার, মুনিও একজন নহেন, তাহাদের মতও বিভিন্ন [অথবা] মুনিও একজন নহেন যে, তাহার মতই একমাত্র প্রামাণ্য। আর ধর্ম্মের তত্ত্ব জ্ঞানগুহায় বিলীন হইয়াছে; অতএব মহাজন যে পথে গমন করিয়াছেন, সেই পথই পথ। কাল সূৰ্য্যরূপ অনলে রাত্ৰিন্দিবস্বরূপ [দিন ও রাত্রি] ইন্ধন প্রজ্জ্বলিত করিয়া মহামোহরূপ কটাহে [কড়া] ঋতু ও মাসস্বরূপ দির্বী [হাতা]-পরিঘট্টনদ্বারা প্রাণীগণকে যে পাক করিতেছে, ইহাই বার্ত্তা।”
যক্ষ কহিলেন, “হে রাজন! তুমি যথার্থরুপে আমার সমুদয় প্রশ্নের উত্তর প্রদান করিয়াছ, এক্ষণে পুরুষ কে ও সকলের মধ্যে ধনী কে ইহা নিরূপণ কর।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “মানবের নাম পুণ্যকর্ম্মদ্বারা স্বৰ্গ স্পর্শ করিয়া ভূমণ্ডলে ব্যাপ্ত হয়, সেই নাম যতদিন থাকে, ততদিন সেই পুণ্যকর্ম্ম ব্যক্তি পুরুষ বলিয়া পরিগণিত হয়েন। যে ব্যক্তি অতীত বা অনাগত সুখ-দুঃখ ও প্রিয় অপ্রিয় তুল্য জ্ঞান করেন, তিনি সকলের মধ্যে ধনী।”
যক্ষ কহিলেন, “তুমি পুরুষ ও সর্ব্বধনী শব্দের অর্থকরিলে এই জন্য এক্ষণে তোমার ইচ্ছানুসারে ভ্রাতৃগণের মধ্যে একজনমাত্র জীবিত হইবে।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে যক্ষ! এই শ্যামকলেবর লোহিতলোচন, বিশালবীক্ষাঃ, মহাবাহু নকুল জীবিত হইয়া শালশাখীর ন্যায় সমুখিত হউন।”
যক্ষ কহিলেন, “হে রাজন! তুমি দশসহস্র মাতঙ্গসম বলশালী অতিমাত্ৰ প্রীতিপাত্ৰ ভীমসেন অথবা সমস্ত পাণ্ডবগণের একমাত্র আশ্রয় ধনঞ্জয়কে পরিত্যাগ করিয়া কি নিমিত্ত বিমাতৃপুত্র নকুলের প্রাণদান করিতে ব্যাকুল হইয়াছ?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, ‘ধর্ম্মকে বিনষ্ট করিলে ধর্ম্মও আমাদিগকে বিনষ্ট করিবেন এবং তাহাকে রক্ষা করিলে তিনিও আমাদিগের রক্ষা করিবেন; অতএব আমি কদাচ ধর্ম্ম পরিত্যাগ করিব না এবং ধর্ম্ম যেন আমাকে কখন পরিত্যাগ না করেন। হে যক্ষ! আনৃশংসাই পরম ধর্ম্ম, আমি আনৃশংস্য অবলম্বন করিতে সতত অভিলাষ করি। সকলে আমাকে ধর্ম্মশীল বলিয়া জানেন, অতএব আমি কোনক্রমেই স্বধর্ম্ম পরিত্যাগ করিতে পারি না। কুন্তী ও মাদ্রী ইহারা আমার জননী। উভয়েই পুত্ৰবতী হইয়া থাকুন, এই আমার অভিলাষ। আমার পক্ষে উভয়েই সমান, অতএব আপনি নকুলকে জীবিত করিয়া উভয়কেই পুত্ৰবতী করুন।”
যক্ষ কহিলেন, “হে রাজন! আপনি অৰ্থতঃ ও কামতঃ আনৃশংস্যপরায়ণ, এই নিমিত্ত আপনার ভ্রাতৃগণ পুনর্জীবিত হউক।”