৩১১. মৃগানুসারী পিপাসার্ত্ত পাণ্ডবগণের জলাশয় অন্বেষণ

৩১১তম অধ্যায়

মৃগানুসারী পিপাসার্ত্ত পাণ্ডবগণের জলাশয় অন্বেষণ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, ‘ভ্ৰাতঃ! আপদের সীমা নাই, নিমিত্ত নাই এবং কারণ নাই, কেবল একমাত্র ধর্ম্মই পুণ্য ও পাপের ফল বিভাগ করিয়া দেয়।”

ভীমসেন কহিলেন, “যৎকালে প্ৰাতিকামী দ্রৌপদীকে সভামধ্যে আনয়ন করিয়াছিল, তখন যে আমি তাহাকে সংহার করি নাই, এই নিমিত্তই এইরূপ ক্লেশসমূহ সহ্য করিতেছি।”

অর্জ্জুন কহিলেন, “আমি সূতপুত্রের উচ্চারিত অতি তীব্র অস্থিভেদী বাক্য উপেক্ষা করিয়াছিলাম বলিয়াই ঈদৃশ ক্লেশ প্রাপ্ত হইতেছি।”

সহদেব কহিলেন, “হে ভারত! যৎকালে শকুনি অক্ষত্ৰীড়ায় আপনাকে পরাজয় করিয়াছিল, তখন যে আমি তাহাকে বিনষ্ট করি নাই, এই নিমিত্তই এরূপ অসহ্য ক্লেশভোগ করিতেছি।”

তখন রাজা যুধিষ্ঠির নকুলকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে মান্দ্রেয়! তোমার ভ্রাতৃগণ নিতান্ত পরিশ্রান্ত ও পিপাসিত হইয়াছেন; অতএব এক উচ্চবৃক্ষে আরোহণ করিয়া দশদিক নিরীক্ষণ কর, দেখ, কোন নিকটবর্ত্তী স্থানে উত্তম জল ও জলাশ্রিত পাদপসকল বিদ্যমান আছে?”

নকুল জ্যেষ্ঠভ্রাতার আজ্ঞানুসারে শীঘ্ৰ পাদপারোহণ করিয়া চতুর্দ্দিক অভিবীক্ষণপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! আমি দেখিতেছি, এক স্থানে সলিলমিশ্রিত পাদপসকল বিদ্যমান রহিয়াছে এবং সারসকুল কলরব করিতেছে; অতএব ঐ স্থানেই জলাশয় আছে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”

সত্যপরায়ণ রাজা যুধিষ্ঠির কহিলেন, “তবে শীঘ্ৰ সেই স্থানে গমনপূর্ব্বক এই সকল তূণদ্বারা পানীয় আনয়ন কর।”

জলাহরণার্থ প্রস্থিত ভীমাদির পঞ্চত্বপ্রাপ্তি

নকুল জ্যেষ্ঠভ্রাতার আজ্ঞা অঙ্গীকারপূর্ব্বক জলাশয়ের উদ্দেশে গমন করিলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া সারসকুল-পরিবৃত বিমল সরোবর অবলোকনপূর্ব্বক জলপানকামনায় যেমন অবতীর্ণ হইলেন, অমনি অন্তরীক্ষ হইতে এক যক্ষের বাক্য তাঁহার শ্রুতিগোচর হইল, “বৎস মাদ্রেয়! ঈদৃশ সাহস করিও না, আমি পূর্ব্বে ইহা অধিকার করিয়াছি; অতএব আমার প্রশ্নের উত্তর প্রদান কর; পশ্চাৎ সলিল পান বা গ্ৰহণ করিও।” নকুল অত্যন্ত পিপাসিত ছিলেন, এই নিমিত্ত যক্ষবাক্য উপেক্ষা করিয়া যেমন সুশীতল সলিল পান করিলেন, অমনি প্ৰাণ পরিত্যাগ করিয়া ধরাতালে নিপতিত হইলেন।

এদিকে রাজা যুধিষ্ঠির নকুলের বিলম্ব দেখিয়া মহাবীর সহদেবকে কহিলেন, “সহদেব! তোমার অগ্রজ অতিশয় বিলম্ব করিতেছেন, তুমি তাঁহার অন্বেষণ করিয়া সলিল আনয়ন কর।”

সহদেব “যে আজ্ঞা” বলিয়া সেই দিকে প্রস্থান করিলেন; তথায় জ্যেষ্ঠসহোদরকে ধরাশায়ী নিরীক্ষণ করিয়া নিতান্ত শোকাভিভূত হইলেন। অনন্তর পিপাসায় শুষ্ককণ্ঠ হইয়া সলিল পান করিবার মানসে সরোবরে অবতীর্ণ হইবামাত্র শ্রবণ করিলেন, “বৎস! ঈদৃশ সাহস করিও না; আমি পূর্ব্বে ইহা অধিকার করিয়াছি, অতএব অগ্ৰে আমার প্রশ্নের উত্তর প্রদান কর; পশ্চাৎ জল পান বা গ্ৰহণ করিও।” পিপাসাতুর সহদেব সেই বাক্যে অনাদর করিয়া জল পান করিবামাত্ৰ পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইয়া ধরাতলে নিপতিত হইলেন। এদিকে রাজা যুধিষ্ঠির অর্জ্জুনকে কহিলেন, ভ্রাতঃ! নকুল ও সহদেব বহুক্ষণ গমন করিয়াছেন, অতএব তাঁহাদিগের অনুসন্ধান করিয়া সলিল আহরণ করা। তোমার কল্যাণ হউক, তুমি দুঃখভারাক্রান্ত ভ্রাতৃগণের একমাত্র আশ্রয়।”

ধনঞ্জয় রাজা যুধিষ্ঠিরের বাক্য শ্রবণ করিয়া সশর শরাসন ও খড়গ গ্রহণপূর্ব্বক গমন করিলেন; সরোবর সমীপে সমুপস্থিত হইয়া দেখিলেন, পুরুষশ্রেষ্ঠ ভ্রাতৃদ্বয় সলিল আহরণে আগমন করিয়া যেন নিদ্রিত হইয়া রহিয়াছেন। নরসিংহ শ্বেতবাহন তাঁহাদিগের তাদৃশী দশা-দর্শনে নিতান্ত দুঃখিত হইয়া শরাসন উদ্যত করিয়া চতুর্দ্দিক অবলোকন করিতে লাগিলেন; কিন্তু কোন প্রাণীই তাঁহার দৃষ্টিগোচর হইল না। তখন তিনি শ্রমাপনোদনের নিমিত্ত সরোবরে অবতীর্ণ হইবামাত্র অন্তরীক্ষ হইতে এই বাক্য শ্রবণ করিলেন, “হে কৌন্তেয়! বলপূর্ব্বক জল গ্রহণ করিতে সমর্থ হইবে না; যদি মদুক্ত প্রশ্নের প্রত্যুত্তর প্রদান কর, তাহা হইলেই সলিল পান ও গ্রহণ করিতে পরিবে।”

ধনঞ্জয় এইরূপে নিবারিত হইয়া কহিলেন, “তুমি অন্তর্হিত হইয়া নিবারণ করিতেছ, কিন্তু আমার দৃষ্টিপথে আবির্ভূত হইয়া নিবারণ করিলে আমি তৎক্ষণাৎ বাণ-সমূহদ্বারা তোমাকে খণ্ড খণ্ড করিব, তাহা হইলে পুনরায় আর এরূপ বলিতে পরিবে না।” ধনঞ্জয় এই কথা কহিয়া শব্দভেদী বাণ প্রদর্শনপূর্ব্বক দশদিকে কৰ্ণি, নালীক, নারাচ প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন যক্ষ অন্তরীক্ষ হইতে কহিলেন, “হে পাৰ্থ বৃথা শরবর্ষণ করিতেছ, অগ্রে প্রশ্নের প্রত্যুত্তর প্রদান করিয়া জল পান কর, নতুবা বলপূর্ব্বক জল পান করিলে তৎক্ষণাৎ পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইবে।” ধনঞ্জয় তাঁহার বাক্যে অবজ্ঞা প্রদর্শনপূর্ব্বক জল পান করিবামাত্ৰ ভূতলে নিপতিত ও পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইলেন।

এদিকে রাজা যুধিষ্ঠির ভীমসেনকে কহিলেন, “ভ্রাতঃ! নকুল, সহদেব ও ধনঞ্জয় জল আনয়ন করিতে গমন করিয়াছেন, কিন্তু এখনও প্রত্যাবৃত্ত হইলেন না, তোমার কল্যাণ হউক, তুমি জল আহরণ ও তাঁহাদিগকে আনয়ন কর।”

ভীমসেন তাঁহার বাক্য অঙ্গীকার করিয়া যে স্থানে ভ্রাতৃগণ নিপতিত রহিয়াছেন, সেই প্রদেশে উপস্থিত হইলেন। তথায় তাঁহাদিগের তাদৃশী দশা-দর্শনে নিতান্ত শোকাবিষ্ট হিইয়া মনে মনে বিবেচনা করিলেন, “ইহা কোন যক্ষ বা রক্ষসের কর্ম্ম হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।” পরিশেষে জনপানানন্তর যুদ্ধ করিবেন ইহা স্থির করিয়া সলিলাভিমুখে ধাবমান হইলেন। এমন সময় যক্ষ কহিলেন, “বৎস কৌন্তেয়! এরূপ সাহস করিও না, আমি পূর্ব্বে ইহা অধিকার করিয়াছি অতএব আমার প্রশ্নের প্রত্যুত্তর প্রদান করিয়া পশ্চাৎ জল পান বা আহরণ করিও।” ভীমসেন যক্ষের বাক্য উপেক্ষা করিয়া জলপান করিবামাত্ৰ প্ৰাণপরিত্যাগ করিয়া ভূপৃষ্ঠে নিপতিত হইলেন।

এদিকে রাজা যুধিষ্ঠির নিতান্ত চিন্তাপরায়ণ ও দগ্ধহৃদয় হইয়া গাত্ৰোত্থান করিলেন এবং যে স্থানে মনুষ্যের শব্দ নাই, কেবল রুরু, বরাহ ও পক্ষিগণ বিচরণ করিতেছে, নীলভাস্বর পাদপসকল শোভমান হইতেছে ও ভ্রমরগণ মধুরস্বরে গান করিতেছে, ঈদৃশ এক মহাবনে প্রবেশ করিলেন। অনন্তর গমন করিতে করিতে সিন্ধুবার, বেতস, কেতক, করবীর ও পিপ্পল প্রভৃতি পাদপশ্রেণীতে সুসংবৃত নলিনীদলসনাথ এক সরোবর অবলোকন করিয়া বিস্ময়সাগরে নিমগ্ন হইলেন।