৩১০তম অধ্যায়
ধৰ্ম্মকর্ম্মদ্বারা জ্ঞানপথ প্রস্তুতের উপায়
ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ। একদা জনবিংশীয় মহাত্মা বসুমান্ নির্জ্জনকাননে মৃগয়া করিতে করিতে ভৃগুবংশীয় একজন মহর্ষিকে অবলোকন করিলেন। মহর্ষিকে অবলোকন করিবামাত্র বসুমানের মনে ভক্তিরসের উদ্রেক হইল। তখন তিনি সত্বর মহর্ষি সমীপে গমন ও চরণবন্দনপূর্ব্বক তথায় উপবিষ্ট হইয়া তাঁহার অনুমতি গ্রহণ করিয়া বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভগবন্! কি কর্ম্মদ্বারা কামনার বশবর্ত্তী পুরুষের ইহলোক ও পরলোকে শ্রেয়োলাভ হইতে পারে, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।
“মহারাজ বসুমান এইরূপে পরমসমাদরসহকারে জিজ্ঞাসা করিলে মহর্ষি প্রীত হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, “মহারাজ! যদি তুমি উভয়লোকে আপনার মনের অনুকুল বিষয়সমুদয় প্রাপ্ত হইতে বাসনা কর, তাহা হইলে কদাচ অন্যের প্রতিকূলাচরণে প্রবৃত্ত হইও না। ধৰ্ম্মই সাধুদিগের পরম হিতকর ও আশ্রয়স্বরূপ। ধৰ্ম্ম হইতেই স্থাবরজঙ্গমাত্মক লোকত্রয় সমুৎপন্ন হইয়াছে। তুমি বিষয়কামনায় নিতান্ত মুগ্ধ হইয়া কিছুতেই তৃপ্তিলাভ করিতে সমর্থ হইতেছ না। মধুগ্রাহী যেমন মধু আহরণে কৃতসংকল্প হইয়া বৃক্ষের অগ্রভাগে আরোহণ করে, কিন্তু অচিরাৎ যে ঐ স্থান হইতে তাহাকে নিপতিত হইতে হইবে, তাহা বুঝিতে পারে না, তদ্রূপ তুমি বিষয়তৃষ্ণায় একান্ত আক্রান্ত হইয়া বিষয়ভোগে অনবরত প্রবৃত্ত হইতেছ; কিন্তু ঐ বিষয়ভোগনিবন্ধন তোমাকে যে যারপরনাই কষ্টভোগ করিতে হইবে, তাহা তোমার হৃদয়ঙ্গম হইতেছে না। জ্ঞানফলার্থী ব্যক্তি যেমন সতত জ্ঞানের আলোচনা করেন, তদ্রূপ ধৰ্ম্মফলাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তির নিরন্তর ধৰ্ম্মের আলোচনা করা কর্ত্তব্য। অসদব্যক্তি ধৰ্ম্মাভিলাষী হইয়া বিশুদ্ধ কৰ্ম্মের অনুষ্ঠান করিতে বাসনা করিলে তাহার পক্ষে উহা নিতান্ত দুষ্কর হইয়া উঠে। আর সাধুব্যক্তি ধৰ্ম্মকামনায় বিশুদ্ধ কৰ্ম্মের অনুষ্ঠান করিতে বাসনা করিলে তাঁহার পক্ষে উহা অতিশয় সহজ হয়। যে ব্যক্তি বনে বাস করিয়া গ্রাম্য সুখভোগে নিরত হয়, তাঁহাকে গ্রাম্য বলিয়াই পরিগণিত করা যায়। আর যিনি গ্রামে থাকিয়াও গ্রাম্যসুখে বিরত হয়েন, পণ্ডিত ব্যক্তিরা তাঁহাকে গ্রাম্য না বলিয়া বনচারীর মধ্যেই পরিগণিত করিয়া থাকেন। এক্ষণে তুমি সকাম ও নিষ্কাম ধৰ্ম্মের গুণদোষ বিচার করিয়া সমাহিতচিত্তে কায়িক, মানসিক ও বাচনিক ধৰ্ম্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হও। ব্রতপরায়ণ, শুচি ও অসূয়াশূন্য হইয়া দেশ-কাল বিবেচনা করিয়া সাধুব্যক্তিদিগকে প্রভূত ধন দান কর। সৎপথ অবলম্বনপূৰ্ব্বক অর্থোপার্জ্জন করিয়া অক্ষুব্ধচিত্তে সৎপাত্রে দান করাই কৰ্ত্তব্য। দান করিয়া অনুতাপ বা আপনার মুখে উহা কীৰ্ত্তন করা বিধেয় নহে। অনৃশংস, শুচি, জিতেন্দ্রিয়, সত্যবাদী, সরল, ত্রিবেদবেত্তা, ষটকর্ম্মশালী ও পিতার সবর্ণা বিবাহিতা স্ত্রীর গর্ভে সমুৎপন্ন ব্রাহ্মণই দানের উপযুক্ত পাত্র বলিয়া কীৰ্ত্তিত হইয়া থাকেন। দেশ, কাল ও পাত্রভেদে ধর্ম্ম অধর্ম্মরূপে ও অধৰ্ম্ম ধৰ্ম্মরূপে পরিণত হয়। পাপ শরীরস্থ মলের ন্যায় অল্প প্রয়াসদ্বারা অধিক পরিমাণে নিরাকৃত হইয়া থাকে। লোকে যেমন বিরেচন [মূলনিঃসারক ঔষধ—জোলাপ] দ্বারা শরীর মলশূন্য করিয়া ঘৃত ভক্ষণ করিলে সেই ঘৃত তাহার ঔষধরূপে পরিণত হয়, তদ্রূপ ধর্ম্মার্থী ব্যক্তি দানাদিদ্বারা দোষশূন্য হইয়া যাগাদি ধর্ম্মের অনুষ্ঠান করিলে ঐ ধৰ্ম্ম তাহার পরকালে সুখভোগের কারণ হইয়া থাকে। সকলেরই মন শুভ ও অশুভ এই উভয় কৰ্ম্মেই ধাবমান হয়। বুদ্ধিমান ব্যক্তি মনকে অশুভ কাৰ্য্য হইতে প্রতিনিবৃত্ত করিয়া শুভকার্য্যে নিযুক্ত করিবেন। লোকে আপনার ধর্ম্ম বলিয়া যে কার্য্যের অনুষ্ঠান করে, তাহার নিন্দা করা বিধেয় নহে। তুমি যে ধৰ্ম্মকে স্বধৰ্ম্ম বলিয়া বিবেচনা কর, তাহার অনুষ্ঠান করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। তুমি নিতান্ত ধৈৰ্য্যবিহীন, বুদ্ধিমান, অপ্রশান্ত ও অপ্রাজ্ঞ; এক্ষণে ধৈর্য্যশালী, বুদ্ধিমান প্রশান্ত ও প্রাজ্ঞ হওয়া তোমার নিতান্ত আবশ্যক। ধৰ্ম্মজনিত তেজঃপ্রভাবে ইহলোক ও পরলোকে শ্রেয়োলাভ করা যায়। ধৈর্য্য সেই তেজের মূল কারণ। মহাত্মা মহাভিষ অধীরতানিবন্ধনই স্বর্গ হইতে নিপতিত হইয়াছিলেন; কিন্তু মহানুভব যযাতি ক্ষীণপুণ্য হইয়াও কেবল ধৈৰ্য্যবলে উৎকৃষ্ট লোকসমুদয় লাভ করিয়াছেন। অতঃপর তুমি ধৰ্ম্মানুষ্ঠাননিরত জ্ঞানবান্ তপস্বিগণের শরণাপন্ন হইয়া তাঁহাদের সেবা কর, তাহা হইলেই তোমার বিপুল বুদ্ধি ও শ্ৰেয়োলাভ হইবে, সন্দেহ নাই।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! মহর্ষি এইরূপ উপদেশ প্রদান করিলে মহারাজ বসুমান্ তাঁহার বাক্যানুসারে বিষয়বাসনায় বিরত হইয়া ধৰ্ম্মবুদ্ধি অবলম্বন করিলেন।”