ধর্ম ও দর্শন
যখনই আমরা ঋগ্বেদের ধর্ম ও দর্শনের কথা চিন্তা করি তখন বহুজাতিক সাংস্কৃতিক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত ও অন্তত এক সহস্রাব্দব্যাপী ইতিহাসের বিবর্তনের পরিশীলিত বিচিত্র একটি জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস ও আচার আচরণের জটিল আয়তন সম্বন্ধে সচেতন হই। এই সময়ে বৈদিক সাহিত্য বিবর্তনের পথে সম্পূর্ণ পরিণতরূপে কখনও নির্দিষ্ট বিন্দুতে স্থির থাকে নি। ফলত, প্রত্নপুরাণ ও অধ্যাত্মবিদ্যার ক্ষেত্রে ক্রমোন্নতির বিবিধ পৰ্যায়ের অবশেষ-চিহ্ন এতে খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে ধর্ম বলতে আমরা বুঝি প্রত্নকথা, অনুষ্ঠানচর্যা, ইন্দ্ৰজাল ও নীতিবোধ ; অন্যদিকে দর্শন বলতে বুঝি একটি আধ্যাত্মিক উপগঠন–যাকে হয়ত স্পষ্টভাবে জনসাধারণ ঘোষণা করে নি। কিন্তু তাদের সামূহিক জীবনদৃষ্টি এবং ব্যক্তিগত আচারআচরণে তার নিগুঢ় ও নিয়ন্ত্রক ভূমিকা অনস্বীকার্য। ঋগ্বেদসংহিতা অবশ্য এই সম্পর্কে সরাসরি বেশি কিছু আমাদের জানায় না কেননা অনার্য উপাদানের সঙ্গে নিরন্তর ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া ও সমন্বয়-প্ৰচেষ্টা সত্ত্বেও তা মূলগতভাবে নিরঙ্কুশ আধিপত্যশীল আর্য জনগোষ্ঠীর এক প্রায়-অখণ্ড সংস্কৃতিৰ প্ৰতিনিধি। ঋগ্বেদের মধ্যে আমরা প্রত্নকথাগুলিকে সম্পূর্ণত বা সুশৃঙ্খলভাবে বিবৃত হতে দেখি না ; বরং এমনভাবে সেইগুলি উল্লিখিত এবং মাঝেমাঝে উদ্দেশ্যহীনভাবে বিবৃত হয়েছে যে, আমাদের মনে হয়, তৎকালে প্ৰচলিত প্ৰত্নকথাগুলির সঙ্গে পরিচিত এই আপাত-সরল ভঙ্গির কারণ। সেই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট যে, সামূহিক অনুষ্ঠানগুলির সঙ্গে পরিচিত ও সে সম্বন্ধে প্রয়োগিক জ্ঞান এবং সেই সঙ্গে যজ্ঞে যথোপযুক্ত সূক্তগুলির প্রয়োগ সম্পর্কে অবহিত থাকার ফলে সংহিতা তার প্রচলিত রূপটি ধারণ করতে পেরেছিল।
যজুর্বেদে আমরা যজ্ঞানুষ্ঠানের কিছু কিছু বিবরণ পাই। তবে এইসব বিবরণ শুধু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীচক্রের জন্যেই সংরক্ষিত ছিল ; ফলে এগুলি গৃঢ়াৰ্থবাহী ও সংক্ষিপ্ত, যাতে অনুষ্ঠান-চর্যায় নিষজ্ঞাত ব্যক্তিদের মধ্যেই কেবলমাত্র সীমাবদ্ধ থাকে। যে ব্ৰাহ্মণগ্রন্থসমূহ আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে প্রকৃতপক্ষে যজুর্বোেদরই এক নিরবচ্ছিন্ন রূপান্তর, সর্বপ্রথম তাদের মধ্যেই যথার্থ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে গ্রথিত প্ৰত্নকথাগুলির সংক্ষিপ্ত বিবৃতি পাওয়া যায়। প্রত্নকথাগুলির এইরূপ সারাংশ প্রণয়নের উদ্দেশ্য, অনুষ্ঠান-চর্য সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যাবলীর যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা ও ব্যাখ্যাদান এবং সেই সঙ্গে যজ্ঞের প্রত্বপৌরাণিক তাৎপৰ্য নির্ণয়।
বৈদিক জনসাধারণের চিন্তাধারা, বিশ্বাস ও কার্যাবলীর আধ্যাত্মিক কাঠামোটি যদিও সংহিতা ও ব্রাহ্মাণ থেকে অনুমানলব্ধ সিদ্ধান্তরাপে আবিষ্কার করা সম্ভব, এই ধরনের আনুমানিক সিদ্ধান্তের যোগফল পর্যাপ্ত হয় না। এর একটি কারণ এই যে, প্ৰাচীন গ্রিকদের মতো বৈদিক আৰ্যরাও আরও অনেকদিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত এই সমস্ত বিশ্বাসের একটি স্পষ্ট রাপ দিতে আগ্ৰহ বোধ করেন নি। অন্যভাবে বলা যায়, তখনও তাদের ধমীয় ধ্যানধারণাগুলি নিতান্ত অস্পষ্ট ছিল। সমাজ হয়ত বা কতকটা অজ্ঞাতসারেই সেইসব গ্রহণ করে তার অংশভাক হয়েছিল—যদিও সমস্তই তখনও সামূহিক অবচেতনের স্তরে নিমজ্জিত। কালক্রমে আরও নানা উপাদান এর সঙ্গে যুক্ত হ’ল ; কয়েক শতাব্দী অতিক্রান্ত হওয়ার পরই তা সচেতন স্তরে উন্নীত হয়ে অধ্যাত্মচিন্তার প্রণালীবদ্ধ রূপ পরিগ্রহ করল। বৈদিক যুগের অন্তিম পর্যায়ে অর্থাৎ দশম মণ্ডল ও প্ৰথম মণ্ডলের শেষাংশ রচিত হওয়ার সময়ে দার্শনিক ভাবনার প্ৰথম স্মরণ হয়; নবীনতর ব্রাহ্মণ ও প্রাথমিক উপনিষদগুলিতে আছে তারই পরিণত রূপ পরিগ্রহণ।