প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

৩০. দেবী রহস্য ও উদ্ভিদ জগৎ

দেবী রহস্য ও উদ্ভিদ জগৎ

প্রশ্ন ওঠে, দেবীপ্রাধান্য-মূলক বা নারী-প্রাধান্য-মূলক এই জাতীয় ধ্যানধারণার ব্যাখ্যা কী? আমাদের যুক্তি অনুসারে সে-ব্যাখ্যার মূল-মূত্র পাওয়া যাবে কৃষি আবিষ্কারের দিক থেকেই।

প্রথমত দেখা যায়, দেবী-রহস্যের সঙ্গে উদ্ভিদ-জগতের সম্পর্ক রয়েছে। এ-বিষয়ে ঐযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ(৪১৯) ইতিপূর্বেই কিছুকিছু তথ্য সংগ্ৰহ করেছেন; সেগুলি থেকেই আলোচনা শুরু করা যায়।

মার্কণ্ডেয় পুরাণে(৪২০) দেবী নিজেই বলছেন :

ততোংহমথিলং লোকমাত্মদেহসমূদ্ভবৈ:
ভবিন্যামি স্বরা; শাকৈরাবৃষ্টৈ প্রাণধারকৈঃ।।
শানন্তরীতি বিখ্যাতিং তদা যাস্যাম্যহং ভুবি। ইত্যাদি।
অর্থাৎ, অনন্তর বর্ষাকালে নিজদেহ সমুদ্ভুত প্রাণধারক শাকের সাহায্যে আমি সারা জগতের পুষ্টি সরবরাহ করবো। তখন আমি জগতে শাকম্ভরী নামে বিখ্যাত হবো।

দেবীর ওই শাকম্ভর নামটা নিশ্চয়ই চিত্তাকর্ষক। ঐযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ তর্জমা করেছেন, herb-bearing বা herb-nourishing I কিন্তু তার চেয়েও চিত্তাকর্ষক হলো ‘আত্মদেহসমুদ্ভবৈ: বিশেষণটি। এই বিশেষণের মূলে এক অতি-প্রাচীন বিশ্বাস চাপা পড়ে আছে এবং হরপ্পার ধুলো সরিয়ে সে-বিশ্বাসের এমনকি একটি মূর্ত নিদর্শন পর্যন্ত খুজে পাওয়া গিয়েছে। সে-নিদর্শন সম্পর্কে স্তর জন মার্সাল(৪২২) বলছেন, হরপ্পায় একটি পরমাশ্চর্য সিল(৪২১) আবিষ্কার হয়েছে। তার একপিঠে দেখা যায় একটি নগ্ন নারীমূর্তি। এই নারীর দুটি পা দু’পাশে সরানো এবং তার গর্ভের ভিতর থেকে একটি লতা গজিয়েছে।

হরপ্পার সিল

হরপ্পার হরফের পাঠোদ্ধার সম্ভব হলে মার্কণ্ডেয় পুরাণের ওই ‘আত্মদেহসমুদ্ভবৈ: বিশেষণটির উপর আরো কিছুটা আলোকপাত করা হয়তো সম্ভব হতো, কিন্তু এই সিলটির গায়ে ছ’-অক্ষরে কী লেখা আছে তা আজো কেউই পড়তে পারেননি। তবে ওই দুর্বোধ্য হরফে যাই লেখা থাকুক না কেন, এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, সিলের উপরের নারীচিত্রটির পিছনে লুকিয়ে আছে এক অতি-আদিম বিশ্বাস। রবার্ট ব্রিফন্ট-এর রচনা অনুসরণ করে আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি, পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়া মানুষদের মধ্যে আজো এ-বিশ্বাস টিকে আছে যে, নারী-দেহ থেকেই আদিশস্যের উদ্গম হয়েছে। নারীদেহের সঙ্গে শস্য-উদ্গমের সম্পর্ক-মূলক এই আদিম বিশ্বাসটির বিস্তৃততর আলোচনায় আমরা পরে প্রত্যাবর্তন করবো।

আপাতত দেখা যাক, দেবী-মাহাত্ম্যের ব্যাখ্যায় শ্ৰীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ আরো কী কী তথ্য সংগ্রহ করেছেন।

যাঁর নাম দুর্গা তাঁরই নাম শাকম্ভরী। ফলে দুর্গোৎসবের সঙ্গে ফসলের সময়টার যোগাযোগ থাকাই স্বাভাবিক। এবং তা আছেও। দুর্গোৎসব হলো শারদীয় উৎসব—ডালা যখন পাকা ফসলে ভরে ওঠবার সময় ঘনিয়ে আসে। তাই, ঐযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ(৪২৩) সিদ্ধান্ত করছেন, আদিতে দুর্গা ছিলেন শস্যদেবী,—পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শস্যদেবীদের মতো ফসলের সময়টিতেই দুর্গোৎসবের আয়োজন। অবশ্যই, দুর্গাকে আমরা সাধারণত চিনি মহেশমর্দিনী রণচণ্ডীর রূপে। কিন্তু শ্ৰীযুক্ত চন্দ অনুমান করছেন, এ-রূপটি গৌণ, কেননা অর্বাচীন। এবং এই রণচণ্ডীর রূপটি যে অর্বাচীন শ্ৰীযুক্ত চন্দের মতে তার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় রামায়ণ থেকে। রামায়ণের উপাখ্যান অনুসারে রাবণ-বধের জন্য রামচন্দ্র রণচণ্ডী দুর্গার কাছে বর প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু শ্রীযুক্ত চন্দ বলছেন, এ-উপাখ্যান বাল্মিকীর মূল রামায়ণে নেই। মূল রামায়ণ অনুসারে রামচন্দ্র বর প্রার্থনা করেছিলেন দুর্গার বদলে সূর্যের কাছেই। এবং এর থেকে প্রমাণ হয়, দুর্গার ওই রণচণ্ডী রূপটি পরের যুগে রচিত—অর্থাৎ অর্বাচীন।

দুর্গাপূজার একটি প্রধান অঙ্গ হলো নবপত্রিকার পূজা। এবং শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ অনুমান করছেন, এই অনুষ্ঠানটি দুর্গাপূজার কৃষি-পর্যায়েরই স্মারক(৪২৪)। কেননা, নবপত্রিকার ঘটের উপর রম্ভা, কচ্চি, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মান ও ধান্যের পাতা সাজানো হয়। এবং যেটা বিশেষ করে লক্ষ্য করবার বিষয়, এই ন’টি উদ্ভিদের প্রত্যেকটিরই অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে কল্পনা করা হয় এক-একটি দেবী। এখানেও উদ্ভিদ-জগতের সঙ্গে দেবীমাহাত্ম্যের একটা যোগাযোগ চোখে পড়ে। এবং এখানে আমরা বিশেষ করে ডালিমের অধিষ্ঠাত্রী দেবীটির উল্লেখ করতে পারি। কেননা, আমরা একটু আগেই দেখেছি, পুরুষ হয়েও আমাদের সিদ্ধিদাতা গণেশ যখন কৃষিপর্যায়ের আসর জমাতে চান তখন তাঁকে যে-সব বিসদৃশ ব্যবহার করতে হয়েছে তার মধ্যে একটি হলো এই ডালিম-ফল হাতে নেওয়া। নবপত্রিকার পূজার বেলায় কিন্তু এই অসঙ্গতি নেই। কেননা, এখানে ডালিমের অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে রক্তদন্তিকা বলে একটি দেবীকেই(৪২৫)।

শ্ৰীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ আরো দেখাচ্ছেন, শাকম্ভরী বলেই দুর্গা হলেন অন্নদা বা অন্নদাতা। অন্নপূর্ণা নামটির তাৎপর্যও নিশ্চয়ই এই দিক থেকেই বুঝতে পারা যায় (৪২৬)।

দেবীমাহাত্ম্যের সঙ্গে উদ্ভিদ-জগতের সম্পর্ক যে কতো ঘনিষ্ঠ তার আরো একটি নিদর্শন হিসেবে শ্ৰীযুক্ত চন্দ বলছেন, শাক্তরা সকালে উঠে কুলতরু বা কুলবৃক্ষকে প্রণাম করে (৪২৭)।

 

 

বলাই বাহুল্য, ভারতীয় সংস্কৃতির এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য বোঝবার কাজে শ্ৰীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দের গবেষণার এই ইংগিতগুলি অত্যন্ত মূল্যবান। কেননা ভারতীয় সংস্কৃতি স্পষ্টই দেবীবহুল এবং বিশেষ করে বাংলা দেশের নিজস্ব ঠাকুরদেবতা বলে যাঁদের স্বীকার করা হয় তাঁদের মধ্যে পুরুষ বলতে বোধহয় একমাত্র দক্ষিণ রায়। এবং বাংলার সংস্কৃতি যে প্রায় চোদ্দ আনাই তান্ত্রিক এবং তান্ত্রিক ধ্যানধারণার সবচেয়ে ব্যাপক ও বিশাল প্রসার যে বাংলা দেশের জমিতেই—এ-কথা বহুবার বহু বিদ্বান উল্লেখ করেছেন (৪২৮)। কিন্তু এই ঘটনাটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যে বাংলা দেশের উর্বর জমির মধ্যেই লুকিয়ে আছে,—অর্থাৎ কৃষিবিদ্যার দিক থেকেই যে শেষ পর্যন্ত সে-ব্যাখ্যা পাবার সম্ভাবনা আছে,—এ-বিষয়ে শ্ৰীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দই বোধহয় সর্বপ্রথম আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই মূল্যবান মূলসূত্রটি আবিষ্কার করা সত্ত্বেও তিনি শেষ পর্যন্ত এর বৈজ্ঞানিক তাৎপর্যগুলি বিশ্লেষণ করেননি এবং শাক্ত মতবাদকে উৎপাদন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বোঝবার বদলে প্রধানতই জাতিগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে তিনি এর ব্যাখ্যা খোঁজবার চেষ্টা করেছেন (৪২৯)। ফলে শুধুই যে তাঁর গবেষণা দিকভ্রান্ত হয়েছে তাই নয়; অনেক সময় তার সিদ্ধান্তগুলি অর্ধ-সত্যমাত্রে পর্যবসিত হয়েছে।

একটা দৃষ্টান্ত দেখা যাক। শ্ৰীযুক্ত চন্দ বলছেন(৪৩০), কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বীজবপন-মন্ত্র প্রসঙ্গে কৃষির যে-অধিষ্ঠাত্রী দেবীর উল্লেখ করা হয়েছে তাকেও ওই শস্যদেবী দুর্গারই অনুরূপ মনে করা যেতে পারে :

The Devi named in a sacred formula (mantra) quoted by Kautilya in connection of sowing seeds in his Arthasastra is probably the prototype of Durga as corn spirit.

আমাদের মন্তব্য হলো, শুধুমাত্র এইটুকু বললে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের আলোচ্য ইংগিতটুকুর আংশিক ব্যাখ্যামাত্র দেওয়া হয় এবং যে-কোনো অর্ধ-সত্যের মতোই ওই আংশিক ব্যাখ্যাটুকু অনেকাংশেই তুচ্ছ-মূল্য। শ্ৰীযুক্ত রাধাগোবিন্দ বসাকের(৪৩১) তর্জমা অনুসারে কৌটিল্যের গ্রন্থের ওইখানে লেখা আছে :

সর্বপ্রকার বীজেরই প্রথম বপন সময়ে, ইহার প্রথম বীজমুষ্টি স্বর্ণ-সংযুক্ত জলদ্বারা সিক্ত করিয়া বপন করিতে হয়। নিম্নবর্তী মন্ত্র তৎসঙ্গে পাঠ করিতে হয়, যথা— ‘প্রজাপতি, কাশ্যপ স্বৰ্ষপুত্র ও পর্জন্য দেবকে সর্বদা নমস্কার জানাইতেছি। সীতাদেবী (কৃষির অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম এখানে সীতা বলিয়া ধৃত হইয়াছে) আমার বীজ ও ধনসমূহের বৃদ্ধি সাধন করুন।’

অতএব, এখানে একটি প্রশ্ন ওঠে। এ-বিষয়ে অবশ্যই সন্দেহ নেই যে, কৃষির অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে এখানে একটি দেবীনাম পাওয়া যাচ্ছে এবং সেই দেবীর কাছেই বীজ ও ধনসমূহের বৃদ্ধি-সাধন কামনা করা হচ্ছে। এবং এইদিক থেকে কৌটিল্যের উদ্ধৃতিটি ঐযুক্ত চন্দের আলোচ্য সিদ্ধান্তের সঙ্গে নিশ্চয়ই খাপ খায়। কেননা ঐযুক্ত চন্দের মূল সিদ্ধান্ত হলো অন্যান্য দেশের মতোই আমাদের দেশেও শস্য-উদ্গম ও কৃষি-সাফল্যের অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে দেবীর কল্পনাই করা হয়েছে, দেবতার নয়। কিন্তু তবুও এ-বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে, কৌটিল্যের রচনায় এখানে দেবী ছাড়াও প্রজাপতি, কাশ্বপ প্রমুখ পুরুষদেবতাদের উদ্দেশ্যেও প্ৰণতি জানানো হচ্ছে। অর্থাৎ, এখানে দেখা যাচ্ছে, কৃষি-প্রসঙ্গেই দেবীমাহাত্ম্য অনেকাংশেই দেবমাহাত্ম্য দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। এবং এইদিক থেকে দেখা যায়, শ্ৰীযুক্ত চন্দের আলোচ্য সিদ্ধান্ত অর্থশাস্ত্রের ওই উক্তিটির সঙ্গে স্পষ্টভাবে খাপ খাচ্ছে না।

অতএব সমস্যা ওঠে এবং সে-সমস্যার সমাধান প্রয়োজন হয়।

কৌটিল্যের রচনায়, এইভাবে দেবীমাহাত্ম্য দেবমাহাত্ম্য-দ্বারা আচ্ছন্ন কেন? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে এখানে আরো একটি প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে যে-কৃষি কর্মের উল্লেখ তা ঠিক কোন পর্যায়ের কৃষিকাজ? কেননা, আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি, কৃষিকাজ মেয়েদের আবিষ্কার হলেও,—এবং, অতএব, কৃষিবিদ্যার প্রাথমিক পর্যায়ে মানবসমাজ নারীপ্রধান (ক্ষেত্রপ্রধান) ও তারই প্রতিবিম্ব হিসেবে দেবলোকও দেবীপ্রধান হলেও,—কৃষিকর্মের উন্নততর পর্যায়টি আর মেয়েদের এক্তিয়ারে ছিলো না। ফলে মানবসমাজ পুরুষ-প্রধান (বীজপ্রধান) এবং তারই প্রতিবিম্ব হিসেবে দেবলোকও দেবতা-প্রধান হয়ে দাঁড়ানোই স্বাভাবিক। অতএব, অর্থশাস্ত্রের এই উদ্ধৃতিটিতে বীজবপন-প্রসঙ্গে কৃষিদেবীকে আচ্ছন্ন করে ওই পুরুষ-দেবতাদের আবির্ভাব-রহস্যটুকু বুঝতে হলে প্রশ্ন তোলা দরকার, এখানে কৃষিকর্মের ঠিক কোন পর্যায়ের পরিচয়? কৌটিল্য(৪৩২)বলছেন :

তিনি (সীতাধ্যক্ষ, অর্থাৎ রাজকীয় কৃষিকৰ্মাধ্যক্ষ) বহু হলদ্বারা পরিকৃষ্ট নিজ (বা সরকারী) ভূমিতে (মতান্তরে, সেই সেই বীজের উপযোগপ্রাপ্ত ভূমিতে) উক্ত বীজসমূহ দাস (ক্রীতদাসাদি), কর্মকর (বেতনভোগী কর্মকর) ও দগুনিক্রয়কারী পুরুষগণদ্বারা বপন করাইবেন।

কোন পর্যায়ের কৃষিকাজের পটভূমিতে এখানে বীজবপনের আলোচনা হচ্ছে তা কৌটিল্যের এই নির্দেশটি থেকেই অনুমান করা সম্ভব। ফলে পুরোনো পর্যায়ের কৃষিদেবী এখানে উপস্থিত থাকলেও তার মহিমা অনিবাৰ্যভাবেই পুরুষদেবতাদের পাশে অপেক্ষাকৃত ম্লান হয়েছে।

অবশ্যই, তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার উৎস-সন্ধানে কৃষিবিদ্যার বিশেষ করে ওই প্রাকৃত-পর্যায়টি নিয়েই আমাদের আলোচনা। কেন, তা মনে রাখবার জন্যে আমাদের মূল যুক্তিটির সংক্ষিপ্ত পুনরুল্লেখ প্রয়োজন হতে পারে।

তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার প্রধানতম লক্ষণ হলো শক্তিপ্রাধান্য। তন্ত্রে শক্তিই প্রধান, পুরুষ অপ্রধান। তান্ত্রিকেরা শাক্ত, শক্তির সাধক।

তন্ত্রের শক্তি মানে কি? নিশ্চয়ই আধুনিক পাশ্চাত্য-বিজ্ঞানের এনার্জি নয়। তাই এ-কথা কল্পনা করে আত্মপ্রসাদ লাভ করবার চেষ্টাটা আত্মপ্রবঞ্চনারই সামিল হবে যে, আমাদের দেশের প্রাচীনেরা যোগবলে উনবিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার জানতে পেরেছিলেন। আসলে, এই জাতীয় আধুনিক মতামতের সঙ্গে তন্ত্রের কোনো সম্পর্কই নেই। তন্ত্রে শক্তি মানে হলো মা, কিংবা আরো সরাসরিভাবে বললে বলা যায় স্ত্রীলোক, নারী। তাই তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার মধ্যে উনবিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা অমুসন্ধান না করে কৃষিভিত্তিক সমাজবাস্তবের প্রতিবিম্ব অন্বেষণ করাই বিজ্ঞান-সম্মত প্রচেষ্টা হবে। সে-সমাজ নারীপ্রধান, কেননা কৃষিকাজ মেয়েদের আবিষ্কার। এবং এই নারীপ্রাধান্যের প্রতিবিম্ব হিসেবেই তান্ত্রিক ধ্যানধারণা শক্তি-প্রধান বা নারী-প্রধান।

তন্ত্র-প্রসঙ্গে আধুনিক গবেষক(৪৩৩) বলছেন, এই জাতীয় সমস্ত রচনাতেই নারী-তত্ত্বের উপর এতোটা জোর দেওয়া হয়েছে যে, পুরুষের কথা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই বাদ পড়ে গিয়েছে :

In all these writings the female principle is personified and made prominent, to the almost total exclusion of the male.
এই সমস্ত রচনায় পুরুষতত্ত্বকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে নারীতত্ত্বকে ব্যক্তিত্ববিশিষ্ট করা হয়েছে ও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

এই নারীপ্রাধান্যের ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করতে এগিয়েই আমরা কৃষিবিদ্যার আদি-পর্যায়ের কথা তুলতে বাধ্য হয়েছি। এবং আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি যে, বৈদিক ঐতিহের সঙ্গে তান্ত্রিক ঐতিহের মূল প্রভেদকেও এইদিক থেকেই বোঝবার অবকাশ আছে।

বৈদিক অর্থনীতি পশুপালন-প্রধান। পশুপালন-নির্ভর সমাজ পুরুষপ্রধান। তারই প্রতিবিম্ব হিসেবে বৈদিক সাহিত্য অনিবাৰ্যভাবেই পুরুষপ্রধান। বৈদিক সাহিত্যে শুধুই যে দেবী অপ্রধান ও এমন কি দুর্লভ তাই নয়; পুরুষসূক্ততে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে এক আদি-পুরুষ থেকেই বিশ্বজগতের উৎপত্তি।

অপরপক্ষে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাদের আর্যপূর্ব বলছেন,—বৈদিক সাহিত্যের পরিভাষায় যারা হলো অনার্য, কিংবা আধুনিক আমলাদের পরিভাষায় যাদের বলা হয়েছে এ্যাবরিজিনস্—তাদের অর্থনীতি ছিলো মূলতই কৃষিপ্রধান। তাই তাদের ধ্যানধারণা থেকে দেবীপ্রাধান্য বা শক্তি-প্রাধান্য বা নারীপ্রাধান্যের স্মৃতি বিলুপ্ত হয়নি।

ফলে, আমাদের দেশের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দুটি স্বতন্ত্র ধারাকে পাশাপাশি বয়ে যেতে দেখা যায়। একটি হলো পুরুষপ্রধান বৈদিক ধারা এবং অপরটি হলো নারীপ্রধান তান্ত্রিক ধারা। মনুস্মৃতির ব্যাখ্যায় কুল্লুকভট্ট(৪৩৪) বলছেন, শ্রতিশ্চ দ্বিবিধা বৈদিকী তান্ত্রিকী চ—শ্ৰুতি দু’রকম, বৈদিক ও তান্ত্রিক। যে-কোনো কারণেই হোক না কেন, আমাদের দেশের শাসক-সম্প্রদায় এই দুটি ধারার মধ্যে বৈদিক ধারাটিকেই গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সামগ্রিকভাবে দেশের সংস্কৃতিতে এই বৈদিক ধারাটিই প্রাধান্য পেয়েছে। জনৈক আধুনিক পণ্ডিতের বচন উদ্ধৃত করে ইয়োরোপীয় পণ্ডিত(৪৩৫)বলছেন, হিন্দুধর্মের তিন ভাগই হলো তান্ত্রিক। এবং

In the popular knowledge and belief they have practically superseded the Vedas over a large part of India……
ভারতের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে এই তান্ত্রিক ধ্যানধারণাই জনসাধারণের বিশ্বাস ও জ্ঞান হিসেবে বেদকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।

শুধু তাই নয়(৪৩৬) :

Their influence unquestionably extends far beyond those who profess to accept their authority. Wilson quotes a passage from one of these treatises which claims that ‘many a man who calls himself a Siva or a Vaisnava is secretly a Sakta, and a brother of the left-handed.’ Even the Jains of North India are said to have adopted formulae and ritual from the Tantras, and the Lamaism or corrupt Buddhism of Nepal and Tibet owes much to the same source.
যারা প্রকাণ্ডভাবে তন্ত্রকে প্রামাণ্য মনে করে, তাদের গণ্ডি ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত তন্ত্রের প্রভাব ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে। উইলসন তন্ত্র সাহিত্য থেকে উদ্ধৃতির সাহায্যে দেখাচ্ছেন, যারা নিজেদের শৈব বা বৈষ্ণব বলে তাদের মধ্যে অনেকেই গোপনে গোপনে তান্ত্রিক এবং বামাচারীদেরই সহগোষ্ঠী। এমন কি, দেখা যায় উত্তর ভারতের জৈনরাও তন্ত্র থেকে মন্ত্র ও অনুষ্ঠান গ্রহণ করে এবং নেপাল ও তিব্বত অঞ্চলের লামা-বাদ নামের পতিত বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের কাছে বহুলাংশে ঋণী।

এই জাতীয় উক্তি নিশ্চয়ই অত্যুক্তি নয়। ভারতীয় সংস্কৃতির বাস্তব পরিস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন হলে আমরা অনায়াসেই বুঝতে পারি তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার প্রভাব আমাদের দেশের সংস্কৃতিক ঐতিহ্যে কী বিশাল ও গভীর। অর্থাৎ, শাসক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি ও পৃষ্ঠপোষকতা যতোখানিই হোক না কেন, বৈদিক ঐতিহ্য আমাদের দেশের জনসাধারণের মনকে সত্যিই গভীরভাবে স্পর্শ করতে পারেনি,—তার বদলে সাধারণ মানুষ ওই তান্ত্রিক ধ্যানধারণাকেই আঁকড়ে থাকবার চেষ্টা করেছে।

প্রশ্ন হলো, এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী? এর বাস্তব কারণ ঠিক কী? উত্তরে আমরা বলতে চাইছি, তথাকথিত ‘আর্য-শাসনের অন্তর্ভূক্ত হবার পরও দেশের সাধারণ মানুষ অপেক্ষাকৃত পুরোনো পর্যায়ের কৃষিকাজেই ব্যাপৃত থেকেছে। শ্ৰীযুক্ত রমেশ চন্দ্র দত্তের ভাষায়, এদেশের আদিবাসীদের মধ্যে যারা আর্য আক্রমণের সামনে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলো তারা … remained as they were before, the tillers of the soil(৪৩৭)। উৎপাদন-পদ্ধতির এই বৈশিষ্ট্যটিকে বোঝবার আশাতেই আমরা ট্রাইব্যালসমাজের অসম্পূর্ণ-বিলোপ সংক্রান্ত প্রকল্পের সাহায্য গ্রহণ করেছি এবং আমাদের যুক্তি অনুসারে যেহেতু একমাত্র উৎপাদন-পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেই মানুষের ধ্যানধারণার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব সেইহেতুই তান্ত্রিকাদি, তথা লোকায়তিক, ধ্যানধারণার উৎস-সন্ধানে অগ্রসর হয়েও এই প্রকল্পটির বহিরেখা আলোচনা করবার আশায় নিছক ধ্যানধারণার আলোচনা থেকে অনেকটা দূর পর্যন্ত বিক্ষিপ্ত হতে বাধ্য হয়েছিলাম।

রাষ্ট্রনৈতিক আকাশে বহু ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও, সাম্রাজ্যের বহু উত্থান-পতন সত্ত্বেও, আমাদের দেশে অন্তত ব্যাপকভাবে উৎপাদন-পদ্ধতির মৌলিক উন্নতি সমাজ-বিকাশের পুরোনো পর্যায়কে নিঃশেষে বিলুপ্ত করে নতুন পর্যায়ের সমাজের বাস্তব ভিত্তি স্থাপন করতে পারেনি। আর, অসমাপ্তভাবে বিলুপ্ত ওই পুরোনো পর্যায়ের সমাজ-বাস্তবের প্রতিবিম্ব হিসেবেই আমাদের দেশের বৃহত্তর জনতার চেতনায় পুরোনো পর্যায়ের ধ্যানধারণাগুলিরও অমন বিস্তৃত ও গভীর প্রভাব থেকে গিয়েছে। দেশের শাসক-সম্প্রদায় নিশ্চয়ই মাতৃপ্রধান সমাজ-বাস্তবকে বহুলাংশেই ধ্বংস করতে পেরেছে এবং সতীদাহ-প্রথা প্রভৃতির উৎস-সংক্রান্ত ঐতিহাসিক গবেষণা সমাধা হলে আমরা হয়তো স্পষ্টভাবেই দেখতে পাবে, এই মাতৃপ্রাধান্যকে অবদমন করবার জন্যে কতোখানি পশুবলের প্রয়োজন হয়েছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন কি আমাদের দেশের সমাজবাস্তব থেকেও নারীপ্রাধান্য সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়নি। এ-বিষয়ে ডক্টর এরএনফেলস্ “ভারতবর্ষে মাতৃতন্ত্ৰ” বলে বইতে অজস্র তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এবং ওই মাতৃপ্রধান সমাজ-বাস্তবকে পশুবলে বাইরের থেকে ভাঙবার চেষ্টা হয়েছিলো বলেই সে-ভাঙন বহুলাংশেই কৃত্রিম হতে বাধ্য হয়েছিলো : ফলে দেশের ধ্যানধারণায় খুব মৌলিক পরিবর্তন দেখা দেবার কথা নয়, তা দেখা দেয়ওনি। তাই আমাদের দেশে সতীদাহ-প্রথার পাশাপাশিই শাক্ত মতবাদের ব্যাপক ও গভীর প্রভাব দেখা যায়। যদিও অবশ্যই তান্ত্রিকমতে সতীদাহ-প্রথা নিন্দিত হয়েছে তবুও শাক্তদের দেশে সতীদাহ-প্রথার মতো কৃত্রিম পরিস্থিতি সত্যিই কল্পনা করা কঠিন। কেননা, শাক্ত মতবাদ নারী-প্রধান, মাতৃপ্রধান।

এই মাতৃপ্রধান ধ্যানধারণার দেশে কী ভাবে সতীদাহ-প্রথার প্রচলন সম্ভব হয়েছিলো এখানে তার আলোচনা তোলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তার বদলে আমাদের মূল আলোচ্য-বিষয়টির দিকেই দৃষ্টি রাখা যাক। এবং সেই বিষয় হলো, তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার মাতৃপ্রাধান্য বা নারীপ্রাধান্য।

 

উৎপাদন-পদ্ধতির ইতিহাসের দিক থেকে, অর্থাৎ কৃষিবিদ্যার প্রাথমিক পর্যায়ের দিক থেকেই প্রাচীন সংস্কৃতির নারীপ্রধান ধ্যানধারণাগুলির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। অর্থাৎ, নারীপ্রধান ধ্যানধারণাগুলির উৎসসন্ধানে আমাদের পক্ষে পরীক্ষা করা দরকার উৎপাদন-পদ্ধতির ওই পর্যায়ে আজো যে-সব মানবদল আটকে পড়ে আছে তাদের—তাদের বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত সাধারণভাবে জানতে-পারা বৈজ্ঞানিক তথ্যের বিশ্লেষণ করলে তান্ত্রিকাদি মতবাদকে আমরা বুঝতে পারবো।

বলাই বাহুল্য, অধ্যাপক জর্জ টমসনের গবেষণার উপর নির্ভর করেই এবং মূলত তার গবেষণাদ্ধারা অনুপ্রাণিত হয়েই, আমরা এই মূল যুক্তির অবতারণা করবার প্রয়াস পেয়েছি। এই যুক্তির উপর নির্ভর করেই তিনি প্রাচীন গ্ৰীক সংস্কৃতির নানা দুর্বোধ্য দিক বৈজ্ঞানিক আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন। পক্ষান্তরে, আধুনিক গবেষকদের মধ্যে র্যারা এই যুক্তিকে স্পষ্টভাৰে গ্ৰহণ করেননি তাদের রচনা বিচার করলে দেখা যায়, একটি মৌলিক সত্যের কাছাকাছি এসেও তাদের সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত কী ভাবে অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্ত হয়েছে।

দৃষ্টান্ত হিসেবে এইখানে Encyclopaedia of Religion and Ethics-এ অধ্যাপক স্টারবেক রচিত Female Principle শীর্ষক প্রবন্ধটির উল্লেখ করা যাক।

শুরুতেই লেখক বলছেন, ধর্মবিশ্বাসের আদিমতম পর্যায়ে দেখা যায় দেবলোকে পুরুষ দেবতাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি হয় গৌণ আর না হয় তো একেবারে শূন্য। আদিম ধর্মবিশ্বাস মূলতই দেবীপ্রধান। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসের ক্রমবিকাশ অনুসরণ করলে চোখে পড়ে, এই দেবীমাহাত্ম্য ক্রমশই অপ্রধান হয়ে যাচ্ছে; দেবীদের চেহারা ঝাপসা হতে হতে দৃশ্যপট থেকে হয় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, আর না হয় তো দেবীর গৌণ হয়ে গিয়ে পুরুষ-দেবতাদের পত্নীমাত্রে পরিণত হচ্ছেন। কোথাও বা দেখা যায়, দেবীটি নিজের স্বরূপ বদলে শেষ পর্যন্ত পুরুষদেবতায় পরিণত হচ্ছেন। নজির হিসেবে লেখক এখানে রবার্টস স্মিথের রচনা উদ্ধৃত করছেন : সেমিটকদের ধর্মে আদিতে যারা দেবী ছিলেন তারাই নিজেদের নারীত্ব হারিয়ে শেষ পর্যন্ত পুরুষ দেবতায় পরিণত হয়েছেন।

প্রশ্ন ওঠে, এই ঘটনার ব্যাখ্যা ঠিক কী? সুখের বিষয় অধ্যাপক স্টারবেক খুব একটা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা খোজ করছেন না। এ-বিষয়ে তিনি

স্পষ্টই সচেতন যে, উক্ত পরিবর্তনের পিছনে সমাজ-বিবর্তনমূলক কারণ রয়েছে। তিনি বলেছেন(৪৩৮):

অনেক সময়ই দেখা যায় দেবীরা দেবলোকে উচ্চতম স্থান অধিকার করেছেন। সমাজসংগঠনের বৈশিষ্ট্য এবং সমাজে নারীর মর্যাদার উপর এই ঘটনাটি নির্ভর করে। ক্লান-জীবনে গোষ্ঠীর মধ্যে প্রধানা হলেন জননী; এই পরিস্থিতিতে দেবীমাতার পক্ষেই সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করা সম্ভব।

অধ্যাপক স্টারবেক এমন কি এ-কথাও অস্বীকার করবেন না যে, এই দেবীমাহাত্ম্যের সঙ্গে কৃষিজীবনের যোগাযোগ আছে। কিন্তু সে-যোগাযোগ ঠিক কেন—সে-বিষয়ে তিনি স্পষ্টভাবে সচেতন নন। এবং এই কারণেই তাঁর মন্তব্য একটি মৌলিক সত্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছোনো সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত অস্পষ্ট ও এমন কি অবান্তর হয়ে পড়েছে। তিনি বলছেন(৪৩৯) :

নানা ক্লান ও শহর মিশে যুদ্ধবিগ্রহমূলক জাতিতে পরিণত হবার পর দেবীপুজার পক্ষে উপযুক্ত সুরক্ষিত উপত্যকার শান্ত কৃষিজীবন অপ্রধান হয়ে গেলো। এই নতুন পরিস্থিতিতে শৌর্য-বীর্যের মূল্য গেলো বেড়ে; ফলে অনিবাৰ্যভাবেই প্রধান হয়ে উঠতে লাগলো পুরুষ দেবতারা এবং অপেক্ষাকৃত গৌণ পর্যায়ে নেমে এলো স্বভাব-দুর্বল নারীজাতির প্রতিনিধি ওই দেবীরা—তারা দেবতাদের পত্নীমাত্রে পরিণত হলো, অবদমিত হলো, বিস্তৃত হলো, আর না-হয়-তো আত্মরক্ষার আশায় তারা নিজেদের নারীত্বটুকু বর্জন করতে বাধ্য হলো।

সুরক্ষিত উপত্যকার শান্ত কৃষিজীবন দেবীমাহাত্ম্যের বিকাশের পক্ষে অমুকুল। কিন্তু কেন? দু’রকম উত্তর পাওয়া যেতে পারে—সুরক্ষিত ও শান্ত প্রভৃতি শব্দের উপর জোর দিলে এক রকম উত্তর, আর, কৃষিজীবন বলে কথাটির উপর জোর দিলে অন্য রকম। এর মধ্যে প্রথম উত্তরটি নিশ্চয়ই ভুল, যদিও দুঃখের বিষয় অধ্যাপক স্টারবেক ওই প্রথম উত্তরটিকেই নির্ভুল মনে করেছেন। কেন মনে করেছেন? তার কারণ, কৃষি-আবিষ্কারের ব্যাপারে মেয়েদের ভূমিকার দিক থেকে সমস্যাটিকে বোঝবার বদলে তিনি পুরুষ-প্রধান সমাজের একটি অতিকথার (myth) সাহায্যেই সমস্যাটির ব্যাখ্যা খুঁজেছেন। অতিকথাটি হলো, নারীরা স্বভাব-কোমলা বা স্বভাব-দুর্বলা—weaker sex। তাই শান্ত সুরক্ষিত আবহাওয়ায় নারী-মহিমার যে-বিকাশ সম্ভবপর শৌর্যবীর্যের যুগে তা ম্লান হয়ে যাওয়া অনিবার্য। অথচ, এই যুক্তিটি যে অতিকথা মাত্র তার বহু প্রমাণ আমাদের দেশের সংস্কৃতিতেই দেখতে পাওয়া যায় : মহিষমর্দিণী, রণচণ্ডী, কালি—এঁরা আর যাই হোন না কেন, তথাকথিত স্বভাব-দুর্বল বা স্বভাবকোমলা নন। তাছাড়া, বিদেশী পুরাণেও এ্যামাজনদের কাহিনী রয়েছে। ব্রিফণ্ট(৪৪০) দেখাচ্ছেন,—এবং প্রভূত প্রমাণের উপর নির্ভর করেই দেখাচ্ছেন,—আজকের পিছিয়ে-পড়া অসভ্য মানুষদের মধ্যে স্ত্রীলোকেরা পুরুষদের তুলনায় বেশি শক্তিশালী, সাহসী এবং এমন কি নিষ্ঠুরও; প্রাচীন সমাজে মেয়েরা যুদ্ধবিগ্রহের কাজে রীতিমতো অংশ-গ্রহণ করে। রবার্ট ব্রিফট-এর(৪৪১) সিদ্ধান্ত হলো :

The differentiation of the man as warrior and fighter is certainly not due to any constitutional indisposition or incapacity in primitive woman, but to economic necessities.
অর্থাৎ কিনা, যুদ্ধবিগ্রহের কাজ যে পুরুষদেরই হয়ে দাঁড়ালো তার কারণ আদিম মেয়েদের কোনো স্বভাবগত প্রবৃত্তি বা অসামর্থ নয়,—তার বদলে প্রকৃত কারণটা অর্থনৈতিক।

অর্থনৈতিক কারণের দরুনই মাতৃপ্রধান সমাজের বদলে পিতৃপ্রধান সমাজ দেখা দিয়েছে। এই পুরুষ-প্রধান সমাজে শুধুই যে যুদ্ধবিগ্রহের শক্তি পুরুষদের হাতে এসেছে তাই নয়, মানুষ চিন্তা করতে অভ্যস্ত হয়েছে যে, মেয়েরা স্বাভাবিকভাবেই বা প্রাকৃতিক কারণের দরুনই ভীরু ও দুর্বল। অতএব ওই ‘উইকার-সেক্স’ (weaker sex) সংক্রান্ত অতিকথা। এই অতিকথার উপর নির্ভর করেই অধ্যাপক স্টারবেক দেখাবার চেষ্টা করছেন যে, স্বাভাবিক শান্ত পরিবেশ ছেড়ে মানুষ যতোই যুদ্ধবিগ্রহের আবহাওয়ায় এসে পড়তে লাগলো ততোই বাড়তে লাগলো শৌর্য-বীর্যের সমাদর, অতএব শৌর্য-বীর্যে একচেটিয়া অধিকারী পুরুষদের প্রতিপত্তি এবং তারই প্রতিবিম্ব হিসেবে দেবলোকেও পুরুষদেরই মর্যাদা। কিন্তু এ-ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, কেননা দেবদেবীদের জন্মকথা ওই স্বভাব-দুর্বলা’ সংক্রান্ত অতিকথাটির জন্মের চেয়েও অনেক প্রাচীন।

অধ্যাপক স্টারবেক-এর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদেশী দৃষ্টান্ত তোলবার প্রয়োজন নেই। কেননা, অন্যান্য বিদ্বানের ইতিপূর্বে এর বিরুদ্ধে প্রভূত নজির সংগ্রহ করেছেন। তাছাড়া সমাজে শৌর্য-বীর্যের মর্যাদা বাড়বার দরুনই যে স্বভাব-কোমলা নারীদের প্রতিনিধিরা দেবলোকেও আভিজাত্য হারিয়েছিলেন—এ-হেন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমাদের দেশে চণ্ডী, চামুণ্ড প্রভৃতি অনেকের সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যাবে।

বস্তুত, অধ্যাপক স্টারবেক নিজেই অনুভব করেছেন যে, ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাঁর ওই সিদ্ধান্তটি অতো সরাসরি প্রযোজ্য হতে পারে না। কেননা, তিনি যেমন বলছেন, একমাত্র ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেই এর উল্টো ইতিহাস দেখা যায়। সে-ইতিহাসে দেবীমহাত্ম্যের বিকাশ অনেক পরের যুগে হয়েছে; ভারতবর্ষের প্রাচীনতম সাহিত্যে, অর্থাৎ বৈদিক সাহিত্যে, দেবীপ্রাধান্য তো দূরের কথা এমন কি দেবীদের নিদর্শনই একান্ত দুর্লভ। অথচ উত্তরযুগের হিন্দুধর্ম দেবীমাহাত্ম্য পরিপূর্ণ। এই ঘটনাটির সঙ্গে অধ্যাপক স্টারবেক-এর সিদ্ধান্তের সঙ্গতি নেই, কেননা তাঁর সিদ্ধান্ত অনুসারে আদিযুগে ছিলো দেবীমাহাত্ম্য—উত্তরযুগে তার বদলে দেবমাহাত্ম্যের বিকাশ হয়েছে। অতএব, নিজের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভারতীয় সংস্কৃতির এই বৈশিষ্ট্যটি ব্যাখ্যা করবার জন্য অধ্যাপক স্টারবেককে ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বিকাশের নতুন ধারা উদ্ভাবন করতে হয়েছে : সাধারণভাবে অর্থাৎ অন্যান্য দেশের বেলায়, যদিও মানুষ শান্ত ও নির্বিঘ্ন কৃষিজীবন ছেড়ে যুদ্ধবিগ্রহের দিকে অগ্রসর হয়েছিলো তবুও ভারতবর্ষের ইতিহাসে দেখা যায় যুদ্ধবিগ্রহের যুগের পর মানুষ শান্ত কৃষিজীবন গড়ে তুলেছে—এই হলো অধ্যাপক স্টারবেক-এর বলবার কথা। তিনি(৪৪২)বলছেন, বৈদিক সাহিত্য হলো একটা যুদ্ধবিগ্রহের যুগের সাহিত্য। আর্যরা তখন স্থানীয় অনার্যদের বিরুদ্ধে এবং নিজেদের বিভিন্ন উপজাতির মধ্যেও যুদ্ধবিগ্রহ চালিয়েছে। স্বভাবতই, এ সময়কার সাহিত্য বহু দেববাদে ভরপুর হলেও তার মধ্যে দেবীমাহাত্ম্যের স্থান নেই। পরের যুগে ওই আর্যরা যখন কৃষিজীবনের শান্ত পরিবেশে থিতিয়ে বসতে লাগলো তখন ক্রমশই তাদের চেতনায় দেবীমাহাত্ম্যের বিকাশ ঘটা সম্ভব হলো—প্রমাণ : দুর্গা, কালি, সরস্বতী, শক্তি ইত্যাদি।

ওই তথাকথিত বৈদিক আর্যরা কবে কোথায় কীভাবে কৃষিকাজের শান্ত পরিবেশে থিতিয়ে বসতে লাগলো—সে-কথা অবশ্যই অধ্যাপক স্টারবেক আমাদের বলেননি। তাছাড়া হিন্দুধর্মের এই দেবীগুলি যে সত্যিই আর্যংশোদ্ভূত নয়, সে-কথা সংশয়াতীত। আর অধ্যাপক স্টারবেকের অনুমান যদি ঐতিহাসিকভাবে সত্যও হতো, তাহলেও এই কৃষিপরিবেশে আর্যদের সমাজ অত্যন্ত প্রকটভাবেই পুরুষপ্রধান হতে বাধ্য হতো। আমরা আগেই দেখেছি, বৈদিক মানুষদের পুরুষপ্রধান সমাজ–এবং অতএব পুরুষপ্রধান চিন্তাচেতনার আসল কারণটা—যুদ্ধবিগ্ৰহ-প্রবণতা নয়, তাদের পশুপালনপ্রধান অর্থনীতিই। রবার্ট ব্রিফন্ট(৪৪৩) ও বিস্তারিতভাবেই আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে,

The development of agriculture in its most productive form in those societies which were originally pastoral, instead of raising the economic power and importance of the earthcultivating woman, has accentuated beyond measure the already established supremacy of the owners of the flocks and herds, and given rise to the most pronounced types of patriarchal society.
অর্থাৎ, যে-সব সমাজ আগে পশুপালন-নির্ভর ছিলো সেগুলির ক্ষেত্রে উন্নততর পর্যায়ের কৃষিকাজ ভূমিকৰ্ষণকারিণী নারীদের অর্থনৈতিক শক্তি ও মর্যাদা বাড়াবার বদলে পশুর মালিক পুরুষদের ইতিপূর্বেই ষে-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা প্রায় অসম্ভবভাবে বাড়িয়ে দিলো এবং সবচেয়ে চূড়ান্ত পুরুষপ্রধান সমাজ প্রতিষ্ঠিত করলো।

তাই তথাকথিত আর্যরা পশুপালন-মূলক অর্থনীতির পর যদি কৃষি-ভিত্তিক সমাজ গড়ে থাকে তাহলে ঐতিহাসিকভাবে সে-সমাজ অতি প্রকটভাবেই পুরুষপ্রধান হওয়া স্বাভাবিক। কিংবা, যা একই কথা, ওই আর্যদের পক্ষে কৃষিকাজে থিতিয়ে বসবার পর তাদের ধর্মচেতনায় দেবীমাহীত্ম্যের বিকাশ ঘটা সত্যিই অস্বাভাবিক। অথচ, অধ্যাপক স্টারবেক এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হবার চেষ্টা করছেন।

লেখকের সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত এইভাবে বিভ্রান্ত হলেও, এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না যে, তিনি দেবী রহস্য-প্রসঙ্গে একটি মৌলিক সত্যের অত্যন্ত কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন। মৌলিক সত্যটি হলো, কৃষিজীবনের সঙ্গে এই দেবী-রহস্যের যোগাযোগ। এবং, আমাদের যুক্তি অনুসারে, সে-যোগাযোগের কারণ এই নয় যে, কৃষিকাজের শান্ত পরিস্থিতিতে স্বভাব-কোমলাদের পক্ষে প্রধান হয়ে ওঠা সম্ভব বা স্বাভাবিক; তার বদলে আসল কারণ এই যে, কৃষিকাজ মেয়েদের আবিষ্কার।

এদেশের বেশির ভাগ মানুষ,—তাদের অনার্য বা আর্য-পূর্ব বা যে-কোনো নামেই অভিহিত করা হোক না কেন,—অনেক যুগ ধরে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত পর্যায়ের কৃষিকাজের উপর নির্ভর করেই জীবনযাপন করেছে। তাই তাদের চেতনাতেও দেবীপ্রাধান্য বা শক্তি-প্রাধান্যের স্বাক্ষর থাকাই স্বাভাবিক। অপরপক্ষে, বৈদিক ঐতিহ্য কোনোদিনই নারীপ্রধান হয়নি। সে-ঐতিহ্য অনুসারে শূদ্রের মতোই স্ত্রীলোকদেরও শাস্ত্রে অধিকার নেই। ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে-ধারাটি মাতৃপ্রধান বা নারী-প্রধান তা মূলতই অ-বৈদিক। তারই নাম তান্ত্রিক ধারা। যদিও সাধারণভাবে বলা যায়, দেশের শাসকসম্প্রদায় এই দুটি স্বতন্ত্র ধারার মধ্যে বৈদিক ধারাটিকেই গ্রহণ করেছে তবুও দেশের সাধারণ মানুষের চেতনায় মাতৃপ্রধান অ-বৈদিক ধারাটির প্রভাব অনেক প্রবল। তার কারণ, ওই অ-বৈদিক ধারাটির মধ্যে উৎপাদন-পদ্ধতির যে-পর্যায়ের প্রতিবিম্ব সাধারণ মানুষের জীবন মূলতই তার উপর নির্ভর করেছে। ভারতীয় সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য বোঝবার জন্য ভারতীয় ঐতিহ্যের এই দুটি ধারার স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে সচেতন হওয়া যে কতোখানি প্রয়োজন সে-বিষয়ে ইতিপূর্বে অন্যান্য বিদ্বানেরা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ভারতীয় শিল্পের ইতিহাস আলোচনা করবার আগে ঐযুক্ত আনন্দকুমার কুমারস্বামী(৪৪৪) এই দুটি ধারার স্বাতন্ত্র্যের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন–তাঁর ধারণায়, একমাত্র তারই পটভূমিতে ভারতীয় শিল্পের ইতিহাস বুঝতে পারা সম্ভব। আমাদের মন্তব্য হলো, ভারতীয় ঐতিহের এই ছটি ধারার মধ্যে যে-ধারাটির প্রভাব ব্যাপকতর ও গভীরতর, সেটিকে—অর্থাৎ ওই মাতৃপ্রধান তান্ত্রিক ধারাটিকে,—একমাত্র কৃষিআবিষ্কারের পটভূমিতেই বুঝতে পারা সম্ভবপর।

অবশ্যই, অধ্যাপক স্টারবেক আরো একভাবে দেবলোকের স্ত্রী-পুরুষ ভেদকে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করছেন। তিনি বলছেন, প্রাকৃত পর্যায়ের ধর্মবোধটা ছিলো অনেকাংশেই অসংস্কৃত; নির্লিপ্ত ও উন্নত ধর্মচেতনার মতো নয়। তার মধ্যে অনেকটাই পার্থিব কামনা, এমন কি পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে খাপ-খাইয়ে নেবার চেষ্টা মাত্র–to adjust life to the immediate situations around it : অভাব এবং অভাব-মেটাবার রকমারি চেষ্টাই এই আদিম ধর্মচেতনার মূল কথা। অভাব-মেটানোর তাগিদ বলতে প্রধাণতই দু’রকম। এক : আত্মরক্ষা আর নিরাপত্তা। দুই : শস্য, পশু ও সন্তানের সংখ্যাবৃদ্ধি। পুরুষেরা স্বভাবতই প্রথম উদ্দেশ্যটির পক্ষে উপযুক্ত, নারীরা দ্বিতীয়টির। ফলে, প্রথমটির তাগিদে পুরুষ-দেবতার উপাসনা এবং দ্বিতায়টির তাগিদে দেবীদের উপাসনাই স্বাভাবিক(৪৪৫)।

প্রয়োজন বলতে, রক্ষা ও নিরাপত্তা। সে-উদ্দেশ্যে পুরুষ দেবতারাই বিশেষ উপযোগী। আর এক রকম প্রয়োজন হলো শস্য, পশু ও সন্তানের বৃদ্ধি। দেবীরাই উর্বরাশক্তি ও বংশবৃদ্ধির স্বাভাবিক ও সহজ প্রতীক হয়েছেন।

অথচ, বাস্তব তথ্য একেবারেই অন্য রকমের। রক্ষা ও নিরাপত্তা যে শুধু পুরুষদেবতাদেরই একচেটিয়া ব্যাপার নয় আমাদের দেশের ইতিহাসেই তার প্রচুর নজির দেখতে পাওয়া যায়—দেখা যায় দেবীদের কাছেই রক্ষা, নিরাপত্তা ও এমন কি যুদ্ধ-বিজয়ের কামনা জানানো হচ্ছে। অপরপক্ষে, পশু ও সন্তান-বৃদ্ধির ব্যাপারও দেবীদের একচেটিয়া এক্তিআরে নয়,—বৈদিক সাহিত্যে দেখা যায় প্রধানত পুরুষ দেবতাদের কাছেই মানুষ পশু ও সন্তান-বৃদ্ধির কামনা জানাচ্ছে।

ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই দু’রকম দৃষ্টান্ত থেকেই প্রমাণ হয় যে, দেবলোকের স্ত্রী-পুরুষ ভেদটা মরলোকের নরনারীর কোনো রকম কাল্পনিক নিয়ত-বৃত্তির উপর নির্ভর করে না, তার বদলে নির্ভর করে মানবসমাজের স্ত্রীপ্রাধান্য বা পুরুষ-প্রাধান্যের উপর। এবং মানবসমাজের এই স্ত্রী-প্রাধান্য বা পুরুষ-প্রাধান্য নির্ভর করে উৎপাদন-পদ্ধতির পর্যায়ের উপর।

কিন্তু তার মানে কি এই যে, প্রাচীন পর্যায়ের চেতনায় দেবীমাহাত্ম্যের সঙ্গে মানবীর উর্বর-শক্তির যোগাযোগ সত্যিই নেই? নিশ্চয়ই আছে। কেবল মনে রাখা দরকার, তার মূল কারণ হলো প্রজনন-ব্যাপারটি সম্বন্ধেও মানুষের যে-ধারণা তার একটা ইতিহাস আছে। সে-ইতিহাসের আভাস পাওয়া যায় আমাদের দেশের পুরোনো পরিভাষার মধ্যেই। আমাদের দেশে পুরুষ-প্রাধান্যকে বলা হয়েছে বীজ-প্রাধান্য, নারীপ্রাধান্যকে বলা হয়েছে ক্ষেত্র-প্রাধান্য–পুরুষ-প্রধান সমাজের আবহাওয়ায় মানুষ মনে করেছে প্রজননের প্রধান কারণ হলো পুরুষ-শুক্র, নারীপ্রধান সমাজের আবহাওয়ায় মানুষ মনে করেছে প্রজননের মূল কারণ হলো মারীদেহের বৈশিষ্ট্যই। এই কারণেই দেখা যায়, পুরুষ-প্রধান বৈদিক ঐতিহ্য অনুসারে প্রজনন-কাজে পুরুষের ভূমিকাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়েছে। অথর্ববেদ(৪৪৬) অনুসারে বিবাহের সময় পুরোহিত বরকে বলবে : এই নারীই হলো তোমার ক্ষেত্র, তুমি সেই ক্ষেত্রে বীজ-বপন করে। গুরুত্বটা স্পষ্টই বীজের উপর—বীজ-বপনের উপর। অপরপক্ষে, মাতৃপ্রধান তান্ত্রিক ধারা অনুসারে সন্তান-উৎপাদন ও ধন-উৎপাদন উভয় ব্যাপারেই পুরুষ অপ্রধান : নারীই জগদম্বা, নারী থেকেই সবকিছুর জন্ম।

মাতৃপ্রধান সমাজের প্রভাবে প্রজনন-কাজে নারীর প্রাধান্য স্বীকৃত হবার পরই,—অর্থাৎ কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠবার পরই,— দেবীমাহাত্ম্যের মধ্যে মানবীর উর্বরা শক্তির স্পষ্ট প্রতিবিম্ব দেখা দিলো। এবং এইদিক থেকেই অধ্যাপক স্টারবেক-এর মন্তব্য সত্যিই একটি মূল সত্যের কাছাকাছি পৌঁছেছে—সন্তান-প্ৰসবিনী নারীর প্রতিনিধি হিসেবেই দেবলোকে আদিম দেবীগুলির আবির্ভাব হয়েছিলো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই মূল সত্যটিকে প্রায় স্পর্শ করেও অধ্যাপক স্টারবেক এর তাৎপর্য-বিশ্লেষণে অগ্রসর হলেন না। কয়েকটি দৃষ্টান্তে দেবীমাহাত্ম্যের সঙ্গে উর্বর-শক্তির যোগাযোগ দেখানোর পর তিনি মোটের উপর এই দৃষ্টান্তগুলির মূল্য উপেক্ষা করবারই প্রস্তাব করলেন। কেননা, তার ধারণায় ধর্মচেতনা হিসেবে এই স্তরের ধ্যানধারণা অবিশুদ্ধ ও অসংস্কৃত; তাই এগুলির উপর নির্ভর করে প্রকৃত ধর্মভাবের রহস্য উদঘাটন করবার আশা নেই। কিন্তু শুরুতেই এগুলিকে আধুনিক অর্থে ধর্মবোধের দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরে নিয়ে এবং তারপর এগুলির মধ্যে আধুনিক অর্থে ধর্মবোধের পরিচয় না পেয়ে এগুলিকে অসংস্কৃত, ও অতএব ধর্মবিশ্বাসের দৃষ্টান্ত হিসেবে লঘুমূল্য মনে করাও যুক্তিসঙ্গত নয়। কেননা, এমন হতে পারে যে, এ-জাতীয় ধ্যানধারণা মানবচেতনার প্রাকঅধ্যাত্মবাদী পর্যায়েরই পরিচায়ক। অর্থাৎ, ধর্ম বলতে সত্যিই যা বোঝায় এগুলির মধ্যে তার বিকাশ ঘটেনি—ধর্মবিশ্বাসের বিকাশের জন্য যে-সামাজিক পরিবেশের প্রয়োজন এগুলির উৎস হয়তো সমাজ-বিকাশের তার চেয়েও প্রাচীন পর্যায়ের মধ্যে।

প্রাক-অধ্যাত্মবাদী ধ্যানধারণার আলোচনায় পরে ফেরা যাবে।

——————–

৪১৯. R. P. Chanda IAR ch, iv.
৪২০. মার্কণ্ডেয় পুরাণ ৯২, ৪৩-৪ ।
৪২১. J. Marshall MIC 1:Plate xxii-12.
৪২২. Ibid. 1:52.
৪২৩. R. P. Chanda op. cit. 13lf.
৪২৪. Ibid. 131.
৪২৫. Ibid. 132.
৪২৬. Ibid. 134.
৪২৭. Ibid. 135.
৪২৮. বিশ্বকোষ ৭:৫০৮ “বঙ্গে যেরূপ শাক্তের প্রাধান্য ভারতের আর কোনো স্থলে এরূপ নাই।…এখানে যে-সমস্ত শিবোক্ত তন্ত্র পাণ্ডা যায়, তাহার রচনাপ্রণালী পর্যালোচনা করিলে এই গৌড়দেশে রচিত হইয়াছে বলিয়া সহজেই ধারণা হয়। তন্ত্রে যেরূপ পৃথক বর্ণমালা গৃহীত হইয়াছে, তাহাও সম্পূর্ণ এই গৌড় বা বঙ্গদেশে প্রচলিত”।
৪২৯. RP R. P. Chanda op. cit. 150-61.
৪৩০. Ibid. 133.
৪৩১ অর্থশাস্ত্র ( বসাক ) ১:১৪৬।
৪৩২. ঐ ১:১৪৩।
৪৩৩. ERE 12:193.
৪৩৪. মনু ২.১ । cf. H. H. Wilson EL 1.248.
৪৩৫. ERE 12.193.
৪৩৬. Ibid.
৪৩৭. এই গ্রন্থের পৃ. ২৫৩ দ্রষ্টব্য।
৪৩৮. ERE 5: Female Principle.
৪৩৯. Ibid.
৪৪০. R. Briffault op. cit. 1422-7, 451-60, ইত্যাদি।
৪৪১. Ibid. 1:451.
৪৪২. ERE 5:828.
৪৪৩. R. Briffault op, cit. 1:252.
৪৪৪. A. K. Coomarswamy in EB 12:209ff.
৪৪৫. ERE 5:830.
৪৪৬. অথর্ববেদ ১৪.২.১৪ ।