কুন্তীর কর্ণজন্মবৃত্তান্ত প্রকাশ—কর্ণদর্শনকামনা
বৈশম্পায়ন বলিলেন, তখন ভোজনন্দিনী কুন্তী পূৰ্ব্বকথা প্রকাশ করিবার নিমিত্ত অতিলজ্জিতভাবে বেদব্যাসকে প্রণতিপুরঃসর সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “ভগবন্! আপনি দেবদেব [জ্ঞানে মহাদেব-তুল্য] ও আমার শ্বশুর, অতএব আপনার নিকট আমি আমার পূর্ব্ববৃত্তান্ত যথার্থতঃ প্রকাশ করিয়া অভিপ্রায় ব্যক্ত করিতেছি, শ্রবণ করুন।
“পূর্ব্বে একদা অতি কোপনস্বভাব মহর্ষি দুৰ্ব্বাসা ভিক্ষার্থ আমার পিতার ভবনে সমুপস্থিত হইলে আমি পরিচৰ্য্যাদ্বারা তাঁহাকে পরিতুষ্ট করিয়াছিলাম। তিনি ঐ সময় এমন অনেক কাৰ্য্য করিয়াছিলেন, যাহাতে আমার কোপ হইবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা; কিন্তু আমি স্বীয় বিশুদ্ধচিত্তপ্রভাবে কিছুতেই রোষাবিষ্ট হই নাই। তখন সেই বরদাতা মুনি আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া আমাকে বারংবার বরগ্রহণ করিতে অনুরোধ করিতে লাগিলেন। মহর্ষি বারংবার অনুরোধ করাতে আমি শাপভয়ে তাঁহার বাক্যে সম্মত হইলাম।
“তখন তিনি আমাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘ভদ্রে! তুমি ধৰ্ম্মের জননী হইবে এবং দেবগণের মধ্যে যাঁহাকে আহ্বান করিবে, তিনিই তোমার বশবর্ত্তী হইবেন।’ এই কথা বলিয়া মহর্ষি তৎক্ষণাৎ তথায় অন্তর্হিত হইলেন। আমি তদ্দর্শনে একেবারে বিস্ময়সাগরে নিমগ্ন হইলাম। তদবধি সেই ঋষিবাক্য কখনই আমার মন হইতে অপনীত হয় নাই।
‘অনন্তর একদা আমি প্রাসাদোপরি আরোহণপূৰ্ব্বক নবোদিত ভাস্করকে নিরীক্ষণ করিবামাত্র সেই ঋষিবাক্য আমার স্মৃতিপথে অরূঢ় হইল। তখন আমি বাল্যনিবন্ধন ঐ বাক্য পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত নিতান্ত কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া সূৰ্য্যকে আহ্বান করিলাম। আমি আহ্বান করিবামাত্র ভগবান সহস্ররশ্মি স্বীয় দেহকে দ্বিধাবিভক্ত করিয়া একাৰ্দ্ধদ্বারা স্বর্গ ও মর্ত্যভূমিতে তাপপ্রদান করিতে লাগিলেন এবং অপরাৰ্দ্ধদ্বারা আমার নিকট সমুপস্থিত হইলেন। সেই তেজঃপুঞ্জকলেবর দিবাকরকে দেখিবামাত্র আমরা কলেবর ভয়ে কম্পিত হইতে লাগিল। তখন তিনি আমাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘বরাননে! বর প্রার্থনা কর।’
‘তখন আমি কহিলাম, “ভগবন্৷ আমার এই প্রার্থনা যে, আপনি অচিরাৎ স্বস্থানে প্রস্থান করুন।’
“আমি এই কথা কহিলে, তিনি আমাকে পুনরায় সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘ভদ্রে! তোমাকে অবশ্যই বরগ্রহণ করিতে হইবে। আমার আগমন কখনই নিরর্থক হইবে না। যদি তুমি বরগ্রহণ না কর, তাহা হইলে আমি তোমাকে এবং তোমার বরদাতা ব্রাহ্মণকে নিশ্চয়ই ভস্মসাৎ করিব।’ ভগবান্ ভাস্কর এইরূপে ভয়প্রদর্শন করিলে, আমি সেই নির্দ্দোষ ব্রাহ্মণকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত কহিলাম, ‘ভগবন্! যদি আপনি নিতান্তই আমাকে বর প্রদান করিবেন, তবে এই বর প্রদান করুন যে, আমি যেন আপনার অনুরূপ পুত্রলাভ করিতে পারি।’ আমি এই কথা কহিবামাত্র দিবাকর স্বীয় তেজঃপ্রভাবে আমাকে মুগ্ধ করিয়া আলিঙ্গনপূৰ্ব্বক পরিশেষে ‘শোভনে! তুমি আমার অনুরূপ পুত্রলাভে সমর্থ হইবে’ বলিয়া স্বর্গে গমন করিলেন।
“তিনি স্বর্গে গমন করিবার পর আমার এক সুকুমার নবকুমার জন্মিল। তখন আমি ঐ বৃত্তান্ত গোপন করিবার নিমিত্ত পিতার অন্তঃপুরে আগমন করিয়া সেই গৃঢ়োৎপন্ন পুত্রকে জলে নিক্ষেপ করিলাম এবং অচিরাৎ সূৰ্য্যোদেবের প্রভাবে পুনরায় পূর্ব্বের ন্যায় কন্যকাবস্থা [২] প্রাপ্ত হইলাম। কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধসময়ে আমি সেই বৃত্তান্ত জ্ঞাত থাকিয়াও কেবল স্বীয় মূঢ়তানিবন্ধন সেই গূঢ়োৎপন্ন পুত্রকে উপেক্ষা করিয়াছিলাম। এক্ষণে তাহাকে স্মরণ করিয়া আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে। আমি পূৰ্ব্বে যাহা করিয়াছিলাম, পাপই হউক, আর নিষ্পাপই হউক, এক্ষণে আপনার নিকট উহা ব্যক্ত করিলাম। আপনার অবিদিত কিছুই নাই। আপনি আমার ও নরপতির মনোগত ভাবসমুদয় অবগত আছেন; অতএব আমাদিগের উভয়ের পুত্রদর্শনবাসনা পরিপূর্ণ করুন।”
কুন্তীদেবী এই কথা কহিলে, মহর্ষি বেদব্যাস তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “শোভনে! তুমি যাহা কহিলে, সেসমুদয়ই সত্য। তুমি কন্যকাবস্থায় সূৰ্য্যকে আহ্বান করিয়াছিলে বলিয়া তোমার ঐ বিষয়ে কিছুমাত্র পাপ নাই। দেবতারা অণিমাদি ঐশ্বৰ্য্যসম্পন্ন, উঁহারা সংকল্প, বাক্য, দৃষ্টি, স্পর্শ ও প্রীতি-উৎপাদন এই পাঁচ প্রকারেই পুত্রোৎপাদন করিতে পারেন। তুমি মানুষী, অতএব দেবসম্পর্কে পুত্ৰ উৎপন্ন করাতে তোমার কোন অপরাধ নাই। এক্ষণে তুমি মনোদুঃখ করিও না। বলবান্ ব্যক্তিদিগের পক্ষে সমুদয় দ্রব্যই পথ্য, সমুদয় বস্তুই পবিত্র, সমুদয় কার্য্যই ধৰ্ম্ম এবং সমুদয় দ্রব্যই স্বকীয়।”