ঋচীকঋষির উপদেশে পরশুরামের হিংসাত্যাগ
“ব্রাহ্মণ বলিলেন, তখন সেই ঋচীক প্রভৃতি মহাত্মারা পুনরায় পরশুরামকে কহিলেন, “বৎস! ব্রাহ্মণ হইয়া ক্ষত্রিয় বিনাশ করা তোমার কখনই কর্ত্তব্য নহে। এক্ষণে আমরা তোমার নিকট এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, তুমি উহা শ্রবণ করিয়া তদনুরূপ কার্য্যে প্রবৃত্ত হও।
“পূৰ্ব্বকালে অলর্কনামে এক মহাতপস্বী, পরমধাৰ্ম্মিক, সত্যপরায়ণ রাজর্ষি ছিলেন। তিনি প্রথমতঃ স্বীয় বাহুবলে সসাগরা পৃথিবী পরাজয় করিয়া পরিশেষে বৃক্ষমূলে অবস্থানপূর্ব্বক অতিসূক্ষ্ম পরব্রহ্মে মনঃসমাধান করিতে বাসনা করিয়া চিন্তা করিলেন যে, ইন্দ্রিয়রূপ শত্রুগণ আমাকে পরিবেষ্টিত করিয়া রহিয়াছে; অতএব বাহ্য-শত্ৰু পরিত্যাগ করিয়া উহাদিগের প্রতি শরনিক্ষেপ করাই কৰ্ত্তব্য কৰ্ম্ম। মন চপলতানিবন্ধন মনুষ্যদিগকে বিবিধ কার্য্যে প্রবর্ত্তিত করে, ঐ দুরাত্মাই সৰ্ব্বাপেক্ষা বলবান; অতএব উহাকে জয় করিলেই সমুদয় ইন্দ্রিয়কে জয় করা হইবে। এক্ষণে আমি মনের প্রতি এই সুতীক্ষ্ন শরনিকর নিক্ষেপ করিব।
“অলর্ক এইরূপ অভিসন্ধি করিলে, মন তাহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, অলর্ক! তুমি ঐ নরকলেবরভেদী শরনিকরদ্বারা কখনই আমাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হইবে না। তুমি আমার প্রতি ঐ সমুদয় শর পরিত্যাগ করিলে তোমারই মর্ম্মভেদ ও মৃত্যু হইবে। অতএব যদি আমাকে নিপীড়িত করিতে তোমার বাসনা হইয়া থাকে, তবে তুমি কোন অলৌকিক বাণের অনুসন্ধান কর।”
“তখন অলর্ক ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া পরিশেষে নাসিকাকে পরাজিত করিবার বাসনায় কহিলেন, এই নাসিকা বিবিধ উৎকৃষ্ট গন্ধ আঘ্রাণ করিয়া পুনরায় আমাকে সেই সকল গন্ধ আঘ্রাণে প্রলোভিত করে; অতএব আমি নাসিকার প্রতিই এই নিশিত শরনিকর নিক্ষেপ করিব।
“তখন নাসিকা তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিল, ‘অলর্ক! ঐ নরকলেবরভেদী শরনিকরদ্বারা কখনই আমাকে পরাজিত করিতে পারিবে না। যদি তুমি আমার প্রতি ঐ সমুদয় শর নিক্ষেপ কর, তাহা হইলে তোমারই মর্ম্মভেদ ও মৃত্যু হইবে। অতএব যদি আমাকে পরাজিত করিতে তোমার নিতান্ত অভিলাষ হইয়া থাকে, তবে তুমি কোন অলৌকিক শরের অনুসন্ধান কর।
“তখন অলর্ক ক্ষণকাল উহা চিন্তা করিয়া রসনাকে পরাজিত করিবার বাসনায় কহিলেন, এই রসনাই বিবিধ সুস্বাদু বস্তুর রসাস্বাদন করিয়া পুনরায় সেই সমুদয় বস্তুতে আমাকে প্রলোভিত করে; অতএব আমি ইহার প্রতি এই নিশিত শরনিকর নিক্ষেপ করিব।
“তখন রসনা তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিল, “অলর্ক! তুমি ঐ সকল শরদ্বারা কখনই আমাকে পরাজয় করিতে সমর্থ হইবে না। যদি তুমি ঐ সমুদয় বাণ আমার প্রতি পরিত্যাগ কর, তাহা হইলে তোমারই মৰ্ম্মভেদ ও মৃত্যু হইবে; অতএব যদি তোমার আমাকে পরাজিত করিতে বাসনা হইয়া থাকে, তবে তুমি কোন অলৌকিক শরের অনুসন্ধান কর।
“রসনা এই কথা কহিলে, অলর্ক ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া পরিশেষে স্পর্শেন্দ্রিয়কে পরাজিত করিবার বাসনায় কহিলেন, এই ত্বকই বিবিধ স্পর্শসুখ অনুভব করিয়া পুনরায় সেইসমুদয়ে আমাকে প্রলোভিত করে; অতএব আজ আমি এই কঙ্কপত্রভূষিত শরনিকরে ত্বককেই নিপীড়িত করিব।
‘তখন স্পর্শেন্দ্রিয় কহিল, ‘অলর্ক! তুমি এতাদৃশ ভূরি ভূরি শরনিক্ষেপ করিয়াও আমাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হইবে না; যদি তুমি আমার প্রতি ঐ সমুদয় শরনিক্ষেপ কর, তাহা হইলে তোমারই মর্ম্মভেদ ও মৃত্যু হইবে; অতএব যদি আমাকে পরাজিত করিবার বাসনা থাকে, তবে তুমি অচিরাৎ কোন অলৌকিক শরের অনুসন্ধান কর।’
‘স্পর্শেন্দ্রিয় এই কথা কহিলে, অলর্ক ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া কর্ণকে পরাজিত করিবার বাসনায় কহিলেন, এই কর্ণই বিবিধ শব্দ শ্রবণ করিয়া বারংবার আমাকে তদ্বিষয়ে প্রলোভিত করে; অতএব আজ আমি কর্ণের প্রতিই এই নিশিত শরনিকর নিক্ষেপ করিব।’
“তখন কর্ণ কহিল, ‘অলর্ক! ঐ সমুদয় নরদেহভেদী শরদ্বারা তুমি কখনই আমাকে পরাজয় করিতে সমর্থ হইবে না; যদি তুমি আমার প্রতি ঐ সমুদয় শর নিক্ষেপ কর, তাহা হইলে তোমারই মর্ম্মভেদ ও মৃত্যু হইবে। যদি তুমি আমাকে জয় করিতে অভিলাষী হইয়া থাক, তবে কোন অলৌকিক শরের অনুসন্ধান কর।’
“কর্ণ এই কথা কহিলে, অলর্ক মুহূর্ত্তকাল চিন্তা করিয়া নেত্রকে পরাজিত করিবার মানসে কহিলেন, এই নেত্রই বিবিধ রূপ দর্শন করিয়া বারংবার আমাকে তদ্বিষয়ে প্রলোভিত করে। অতএব আজ আমি এই শাণিত শরনিকরদ্বারা নেত্রকেই নিপীড়িত করিব।’
“তখন নেত্র কহিল, “অলর্ক! এ সমুদয় নরদেহবিদারক শরদ্বারা তুমি কখনই আমাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হইবে না। যদি তুমি আমার প্রতি ঐ সমুদয় বাণ নিক্ষেপ কর, তাহা হইলে তোমারই মর্ম্মভেদ ও মৃত্যু হইবে। অতএব যদি আমাকে পরাজিত করিবার বাসনা থাকে, তবে তুমি অচিরাৎ কোন অলৌকিক বাণের অনুসন্ধান কর।’
‘চক্ষু এই কথা কহিলে, অলর্ক কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া বুদ্ধিকে জয় করিবার মানসে কহিলেন, বুদ্ধি স্বীয় জ্ঞানশক্তিদ্বারা বিবিধ কাৰ্য্য নিশ্চয় করিয়া থাকে; অতএব আমি বুদ্ধির প্রতিই এই নিশিত শরনিকর নিক্ষেপ করিব।’
“তখন বুদ্ধি কহিল, ‘অলর্ক! তুমি ঐ সামান্য শরনিকরদ্বারা কখনই আমাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হইবে না। যদি তুমি আমার প্রতি ঐ সমুদয় বাণ পরিত্যাগ কর, তাহা হইলে তোমারই মর্ম্মভেদ ও মৃত্যু হইবে; অতএব যদি আমাকে নিপীড়িত করিতে তোমার নিতান্ত অভিলাষ হইয়া থাকে, তবে তুমি অচিরাৎ কোন। অলৌকিক শরের অনুসন্ধান কর।’
‘মন, বুদ্ধি ও আম্রাণাদি পঞ্চেন্দ্রিয় এই কথা কহিলে, অলর্ক তাহাদিগের নিপীড়নে নিতান্ত অভিলাষী হইয়া অলৌকিক বাণ লাভ করিবার অভিলাষে সেই বৃক্ষমূলে অবস্থানপূর্ব্বক ঘোরতর তপস্যা করিতে লাগিলেন; কিন্তু কিছুতেই ইন্দ্রিয়নিপীড়ক অলৌকিক শরের অনুসন্ধান পাইলেন না। পরিশেষে তিনি সমাহিতচিত্তে বহুকাল অনুধ্যানপূর্ব্বক যোগকেই সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করিয়া একাগ্রমনে স্তিমিতভাবে যোগানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলেন। যোগবলে ক্রমে ক্রমে তাঁহার সমুদয় ইন্দ্রিয় বশীভূত ও উৎকৃষ্ট সিদ্ধি হস্তগত হইল। তখন তিনি একান্ত বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া কহিলেন যে, এ কাল পর্য্যন্ত আমি বৃথা ভোগসুখে আসক্ত হইয়া রাজ্যশাসন ও বিবিধ বাহ্যাড়ম্বর করিয়াছি। এখন বুঝিতে পরিলাম যে, যোগ অপেক্ষা পরম সুখকর পদার্থ আর কিছুই নাই।”
‘ঋচীক প্রভৃতি মহাত্মারা এইরূপে অলর্কের ইতিহাস সমাপ্ত করিয়া পরশুরামকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “বৎস পরশুরাম! তুমি এক্ষণে এই সমুদয় পর্য্যালোচনাপূৰ্ব্বক ক্ষত্রিয়বধে বিরত হইয়া যোগমার্গ অবলম্বন কর, তাহা হইলেই শ্রেয়োলাভে সমর্থ হইবে।”
‘পিতৃপুরুষগণ এইরূপ উপদেশ প্রদান করিয়া অন্তর্হিত হইলে মহাত্মা ভার্গব যোগমার্গ অবলম্বনপূৰ্ব্বক অচিরাৎ পরমসিদ্ধি লাভ করিলেন।”