৩০. অর্জ্জুনের জীভনার্থ মণি আনায়ণ

শ্রীজনমেজয় বলে শুন মহামুনি।
অর্জ্জুন নিপাত কথা কহিব কাহিনী।।
কিমতে আনিল মণি পাতাল হইতে।
পাণ্ডুর নন্দন প্রাণ পাইল কিমতে।।

বলেন বৈশম্পায়ন শুন নরপতি।
একে একে কহি শুন সে সব ভারতী।।
উলুপী স্মরণ কৈল নাগ পুণ্ডরীকে।
ত্বরায় আইল নাগ উলুপী সম্মূখে।।
স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী বিচারিল মনে।
আইলেন বভ্রুবাহ জননীর স্থানে।।
অধোমুখে আইলেন মায়ের সদনে।
চিত্রাঙ্গদা বলে তারে করুণ বচনে।।
পিতৃ-হত্যা কৈলি তুই পাপিষ্ঠ চণ্ডাল।
মারিলি আমার বুকে এই বড় শাল।।
(মিসিং)
কি বলে উলুপী এবে শুনহ শ্রবণে।
পার্থে জীয়াইতে চাহে মণির মিলনে।।
পাতালে আছয়ে মণি অনন্ত সমীপে।
সত্বরে আনিয়া মণি রাখ মনস্তাপে।।
বভ্রুবাহ বলিলেন শুন গো জননী।
পুণ্ডরীক নাগ যাক আনিবারে মণি।।
পরিচয় নাহি মম মাতামহ সনে।
মণি নাহি দিবে নাগ আমার বচনে।।
পুণ্ডরীক গেলে যদি নাহি দেয় মণি।
সংগ্রাম করিব শেষে শুনগো জননী।।
উলুপী বলিল পুত্র কহিলে প্রমাণ।
সম্প্রীতে না দিলে মণি উচিত সংগ্রাম।।
পুণ্ডরীক নাগে তবে কহিল সুন্দরী।
মণি হেতু নাগ গেল রসাতল পুরী।।
অনন্তের স্থানে গিয়া কহিল সকল।
তাহা শুনি নাগরাজ হইল বিকল।।
সর্পগণ আগে কহে নাগ অধিপতি।
উলুপী মাগিল মণি অর্জ্জুনের প্রতি।।
বভ্রুবাহ সমরে মরিল ধনঞ্জয়।
মণি গিয়া গেলে জীয়ে পাণ্ডুর তনয়।।
পাণ্ডবের সখা কৃষ্ণ সংসারে বিদিত।
বিলম্ব না কর মণি পাঠাও ত্বরিত।।

অনন্তের কথা শুনি ধৃতরাষ্ট্র কহে।
এ সব অগ্রাহ্য কথা আমারে না সহে।।
আপন মঙ্গল রাজা নাহি চিন্ত তুমি।
গরুড়ের ভয়ে সর্প রক্ষা করে মণি।।
হেন মণি পাঠাইতে চাহ নরলোকে।
শুন সর্পরাজ আমি বলিব তোমাকে।।
ভাল হৈল বভ্রুবাহ মারিল অর্জ্জুনে।
আমার আনন্দ বড় উপজিল মনে।।
মিত্র মোর ধৃতরাষ্ট্র কৌরবের পতি।
অর্জ্জুন মারিল তার শতেক সন্ততি।।
একথা শুনিয়া চত্তে দুঃখ উপজিল।
অর্জ্জুন নিধনে মম আনন্দ হইল।।
না দিব অমৃত মণি কহিনু তোমারে।
বভ্রুবাহনের শক্তি কি করিতে পারে।।
মারিল বান্ধব বন্ধু গুরু ধনঞ্জয়।
সেই পাপে নষ্ট হৈল পাণ্ডুর তনয়।।
নরলোকে কদাচিত মণি না রাখিব।
কত জীব জীবে বলি এ মণি রাখিব।।
গরুড়ের ভয়ে মোরা না পাব নিস্তার।
মণি নাহি দিব শুন বচন আমার।।
আমার সম্মতি নহে শুন নাগরায়।
তবে সে তোমার চিত্তে যেমত যুয়ায়।।
আমরা যতেক নাগ না দিব সম্মতি।
সত্য কহিলাম কথা শুন নাগপতি।।

অনন্ত বলেন কথা শুন নাগগণ।
ধর্ম্মপথ আচরিব শুনহ কথন।।
অর্জ্জুন পাইলে প্রাণ মণির মিলনে।
সুখী হবে নারায়ণ একথা শ্রবণে।।
কৃষ্ণপ্রীতে সুখ মোক্ষ চতুর্ব্বর্গ পায়।
মণি দিয়া রক্ষা কর পাণ্ডুর তনয়।।
শুন ধৃতরাষ্ট্র তুমি আমার বচন।
মণি নাহি দিলে পার্থ পাইবে জীবন।।
সখা যার নারায়ণ মৃত্যু নাহি তার।
মণি দিয়া যশ তুমি রাখ আপনার।।
নহে বভ্রুবাহ হোতে পাবে অপমান।
সত্য কহিলাম আমি তোমা বিদ্যমান।।

নাগমন্ত্রী ধৃতরাষ্ট্র নাহি দিল মণি।
পুণ্ডরীক মুখে তাহা বভ্রুবাহ শুনি।।
উলুপী বলিল পুত্র কি হবে উপায়।
মণি আনিবারে তুমি চলহ তথায়।।
বভ্রুবাহ বলিলেন সম্প্রীতে না পাব।
বিক্রম করিয়া মণি শেষেতে আনিব।।

এত বলি বভ্রুবাহ সাজন করিল।
রথ আরোহিয়া বীর পাতালে চলিল।।
বাসুকী না দিল মণি জানিয়া রাজন।
মণি না পাইয়া রাজা অতি ক্রুদ্ধমন।।
প্রবেশিল পাতালেতে যুদ্ধের ‍কারণে।
তাহা দেখি দূত কহে রাজা বিদ্যমানে।।
দূতমুখে অনন্ত পাইল সমাচার।
যুদ্ধ হেতু আসে চিত্রঙ্গদার কুমার।।
অর্জ্জুন নন্দন বীর জানে নানা শিক্ষা।
অপার বিক্রম তার নাহি কার রক্ষা।।
ধৃতরাষ্ট্রে ডাকিয়া বলিল নাগপতি।
বভ্রুবাহ হেথা এল কি করি যুকতি।।
মণি নাহি দিলে তুমি আমার বচনে।
পাতালে আইল সেই যুদ্ধের কারণে।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে মম কি ভয় মানুষে।
বিনাশিব নৃপতিকে চক্ষুর নিমিষে।।
তাহার কারণ তুমি না চিন্তহ মনে।
আমি যুদ্ধ করি রাজা বভ্রুবাহ সনে।।

এত বলি বাসুকীরে দিল সমাচার।
যুদ্ধ করিবারে ‍আজ্ঞা হইল তাহার।।
স্মরণে আনিল যত ছিল নাগগণ।
বভ্রুবাহনের সনে আরম্ভিল রণ।।
সে সব সংগ্রাম কথা কহিতে বিস্তর।
সংক্ষেপে কহিব আমি শুন নরবর।।
গজ বাজী পদাতিক করিয়া সংহতি।
রণে প্রবেশিল বভ্রুবাহ নরপতি।।
অনল সমান বাণ বরিষে রাজন।
আগু হৈতে নাহি পারে ছিল যতজন।।
বিষদন্তে নাগগণ দংশিবে যাহারে।
চক্ষুর নিমিষে সেই যায় যমঘরে।।
ধনুক ধরিয়া করে বাণ বরিষণ।
অগ্নিবাণে পুড়িয়া মরিল ‍নাগগণ।।
সর্প মনুষ্যেতে রণ অপূর্ব্ব কথন।
বড় বড় নাগগণ হারায় জীবন।।
বাসুকী সংগ্রামে এল ক্রোধ করি চিতে।
অনেক যুঝিল বভ্রুবাহন সহিতে।।
নিবারিতে নাহি পারি, অর্জ্জুন নন্দনে।
ধৃতরাষ্ট্র গর্জ্জিলেন দুঃখ পেয়ে মনে।।
দুই পুত্র লয়ে ধৃতরাষ্ট্র করে রণ।
বিংশতি সহস্র সৈন্য বধিল জীবন।।
মহাক্রোধ উপজিল অর্জ্জুন নন্দনে।
যুড়িল গরুড় বাণ ধনুকের গুণে।।
হইল গুরুড় মূর্ত্তি দেখি ভয়ঙ্কর।
প্রাণভয়ে নাগ সব পলায় সত্তর।।
প্রমাদ পড়িল আর না দেখি নরনে।
ভয়েতে গেলেন নাগ অনন্ত সদনে।।

অনন্ত বলেন কেন পলাও এখন।
শুন ধৃতরাষ্ট্র তুমি কর গিয়া রণ।।
মণি নাহি দিলে ‍তুমি আমার বচনে।
এখন করহ যুদ্ধ বভ্রুবাহ সনে।।
বিনাশ হইবে নাগ তোমার বিচারে।
অর্জ্জুন নন্দনে কেবা জিনিবারে পারে।।
অনন্তের বাক্য শুনি বলে নাগগণ।
সে ‍কোপে করিবে তুমি নাগের নিধন।।
আপনি বিদায় কর বভ্রুবাহনেরে।
আর যুদ্ধে কাজ নাই মণির কারণে।।
এত বলি মন্ত্রী দিল অনন্তেরে মণি।
মণি লয়ে নাগরাজ চলিল আপনি।।
অনন্ত বলেন শুন হে বভ্রুবাহন।
মণি লহ যুদ্ধে রাজা নাহি প্রয়োজন।।
এত বলি বভ্রুবাহনেরে মণি দিল।
অর্জ্জুন নন্দন তবে বাণ সম্বরিল।।

মণি পেয়ে চিত্রঙ্গদাসুত তুষ্ট হৈল।
মণির প্রভাবে মৃতসেনা বাঁচাইল।।
তবে ধৃতরাষ্ট্র নাগ মনে বিচারিল।
আপনার দুই পুত্রে ডাকিয়া কহিল।।
তোমরা করহ যদি কলঙ্ক ভঞ্জন।
তবে সে রাখিব আমি ‍আপন জীবন।।
বৃষকেতু অর্জ্জুনের আন গিয়া মাথা।
তবে মোর ‍ হয় যত মনোব্যাথা।।
বাপের বচনে দুই ভাই কুতূহলে।
মণিপরে গেল তবে সংগ্রামের স্থলে।।
বৃষকেতু অর্জ্জুনের যতক লইয়া।
প্রবেশিল পাতালেতে হরষিত হৈয়া।।