৩০৯. দানব্রতধারী কর্ণের নিকট দ্বিজবেশী ইন্দ্রের কবচকুণ্ডল প্রার্থনা

৩০৯তম অধ্যায়

দানব্রতধারী কর্ণের নিকট দ্বিজবেশী ইন্দ্রের কবচকুণ্ডল প্রার্থনা

কবচকুণ্ডল প্রার্থনা বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! বীরবর কর্ণ ব্ৰাহ্মণবেশধারী দেবরাজকে সমাগত দেখিয়া তাঁহার অভিপ্ৰায় বুঝিতে অসমর্থ হইয়া স্বাগত প্রশ্নপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! সুবৰ্ণাভরণবিভূষিতা প্রমদা অথবা গোসমূহপূর্ণ গ্রাম, ইহার মধ্যে কি প্রদান করিব, বলুন।”

ব্রাহ্মণ কহিলেন, “আমি সুবৰ্ণাভরণবিভূষিতা প্রমদা অথবা অন্য কোন প্রীতিজনক বস্তুর অভিলাষ করি না; যাহারা তাহা প্রার্থনা করে, তাহাদিগকে প্ৰদান করুন। যদি আপনি যথার্থই সত্যব্রত হয়েন, তবে আপনার সহজাত বর্ম্ম ও কুণ্ডলদ্বয় উন্মোচনপূর্ব্বক প্রদান করুন; তাহা হইলে আমি পরম লাভ জ্ঞান করিব।”

কৰ্ণ কহিলেন, “হে বিপ্র! আমি পৃথিবী, প্রমদা, ধেনু ও বহুবার্ষিক যাবজ্জীবনবৃত্তিস্বরূপ ধান্যাদি প্ৰদান করিতে পারি; কিন্তু কুণ্ডল ও বর্ম্ম প্ৰদান করিতে সমর্থ নাহি৷” এই কথা বলিয়া কৰ্ণ সেই ব্রাহ্মণকে যথাবিধি পূজা ও অশেষপ্রকার সান্ত্বনা করিলেন এবং গো, সুবর্ণ ও রাজ্য প্রভৃতি মহামূল্য দ্রব্যাদিদ্বারা তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিবার নিমিত্ত নানাপ্রকার যত্ন করিতে লাগিলেন; তথাপি তিনি কবচ ও কুণ্ডল ভিন্ন কিছুই প্রার্থনা করিলেন না। এইরূপে কৰ্ণ যখন দেখিলেন যে বিপ্ৰেন্দ্ৰ অন্য বস্তুর অভিলাষী নহেন, তখন তিনি সহাস্যবদনে পুনরায় কহিলেন, “হে বিপ্ৰ! আমার বর্ম্ম ও কুণ্ডলযুগল সহজাত, ইহা দ্বারা আমি মানবগণের অবধ্য হইয়াছি; অতএব কোনক্রমেই ইহা পরিত্যাগ করিতে পারিব না। আমি আপনাকে অতি বিশাল ক্ষেমাস্পদ নিষ্কণ্টক রাজ্য প্ৰদান করিতেছি, গ্ৰহণ করুন। সহজ বর্ম্ম ও কুণ্ডলযুগলবিহীন হইলে শত্ৰুগণ আমাকে অনায়াসে আক্রমণ করিবে।”

এইরূপে ভগবান পাকশাসন অন্য কোন বর প্রার্থনা না করিলে মহাবীর কর্ণ সহাস্যবদনে পুনরায় কহিলেন, “হে দেবদেবেশ! আমি আপনাকে পূর্ব্বে জানিতে পারিয়াছি, এক্ষণে আপনাকে বৃথা বর প্রদান করা আমার পক্ষে নিতান্ত অনুচিত। আপনি সাক্ষাৎ দেবরাজ, সর্ব্বভূতের অধীশ্বর; অতএব আপনিই আমাকে বর প্রদান করুন। আমি যদি আপনাকে কবচ ও কুণ্ডল প্রদান করি, তাহা হইলে লোকের বধ্য হইব এবং আপনিও সকলের হাস্যাস্পদ হইবেন, অতএব কবচ ও কুণ্ডলের বিনিময়ে আমাকে অন্য কোন অভিলষিত বস্তু প্ৰদান করিতে হইবে, নতুবা আমি আপনাকে বর্ম্ম ও কুণ্ডল প্ৰদান করিব না।”

কবচকুণ্ডল-বিনিময়ে ইন্দ্রের নিকট কর্ণের শক্তি-অন্ত্র যাচ্ঞা

ইন্দ্ৰ কহিলেন, “কৰ্ণ! আমি তোমার নিকট আগমন করিব জানিয়া সূৰ্য্যদেব পূর্ব্বে স্বপ্নে তোমাকে যে পরামর্শ দিয়াছেন, তুমি তদনুসারে সেই সকল কথা বলিতেছ, তাহাতে সেন্দেহ নাই। যাহা হউক, তুমি বজ্র ভিন্ন আর যাহা প্রার্থনা করিবে, তাহাই প্রদান করিব।”

অনন্তর কর্ণ হৃষ্টমনে বাসবকে কহিলেন, “হে সুরিনাথ! আপনি বর্ম্ম ও কুণ্ডলের বিনিময়ে শত্রুবিনাশিনী শক্তি প্রদান করুন।” সুররাজ কর্ণবাক্যশ্রবণে শক্তির নিমিত্ত মুহুর্ত্তকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, “হে সূতজ! তুমি সহজ বর্ম্ম ও কুণ্ডল প্রদানপূর্ব্বক শক্তি গ্ৰহণ কর, তাহাতে ক্ষতি নাই; কিন্তু এই নিয়মে গ্রহণ করিতে হইবে যে, আমি দানবকুল-সংহারে প্রবৃত্ত হইলে এই অমোঘ শক্তি আমার কারচ্যুত হইয়া শত শত শত্রু বিনষ্ট করিয়া পুনরায় আমারই হস্তে প্রত্যাবৃত্ত হইবে; কিন্তু তোমার কারচ্যুত হইয়া কেবল একজন মাত্ৰ মহাবলপরাক্রান্ত শক্ৰ সংহার করিয়া পরিশেষে আমার নিকট উপস্থিত হইবে।”

কৰ্ণ কহিলেন, “হে দেবরাজ! যাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া আমার অন্তঃকরণে ভয়ের সঞ্চার হইবে, আমি সেই শক্রকে সমরে সংহার করিব।” ইন্দ্ৰ কহিলেন, “হে কৰ্ণ৷ তুমি মহাবল পরাক্রান্ত একমাত্র শক্রকে অবশ্যই বিনাশ করিতে পরিবে, কিন্তু যে শত্রুকে সংহার করিবার মানস করিতেছ, তাঁহাকে ভগবান নারায়ণ সতত রক্ষা করিতেছেন, তিনি সামান্য লোক নহেন; পণ্ডিতেরা তাঁহাকে বিজয়শালী অচিন্ত্যনীয় নররূপী নারায়ণস্বরূপ বলিয়া থাকেন।” কর্ণ কহিলেন, “ভগবান! কৃষ্ণ তাঁহাকে রক্ষা করিলেও তাঁহাতে কিছুমাত্র ক্ষতি নাই। এক্ষণে আপনি আমাকে একপুরুষঘাতিনী শক্তি প্ৰদান করুন, তাহা হইলে আমি মহাপ্ৰতাপশালী শক্রসংহারে সমর্থ হইব। আমি এক্ষণে শরীর হইতে কবচ ও কুণ্ডল উন্মোচনপূর্ব্বক আপনাকে প্ৰদান করিতেছি, ইহাতে আমার চর্ম্মচ্ছেদন হইলেও অন্তঃকরণে কিছুমাত্ৰ বীভৎসরসের [রৌদ্রাদি রসের অন্যতম রস-কোনরূপ অপ্রীতিকর কাৰ্যসন্দর্শন বা শব্দ শ্রবণ করিয়া অন্তরে যে ভাবের আবির্ভাব হয়, তাহাকে বীভৎস রস বলে] উদ্রেক হইবে না।”

ইন্দ্ৰ কহিলেন, “হে কর্ণ! তুমি সত্য প্রতিপালনে উদ্যত হইয়াছ; অতএব কদাচ তোমার মনে বীভৎসরসের সঞ্চার বা শরীরে ব্ৰণ উৎপন্ন হইবে না। যাদৃশ তোমার পিতা সূৰ্য্যদেবের বর্ণ ও তেজ, তুমিও সেইরূপ বর্ণ ও তেজ প্রাপ্ত হইবে; কিন্তু যেস্থলে হইয়া এই অমোঘ শক্তি প্রয়োগ কর, তাহা হইলে ইহা তোমারই গাত্রে নিপতিত হইবে, সন্দেহ নাই।” কর্ণ কহিলেন, “ভগবন! আপনি যেরূপ কহিলেন, ইহার কদাচ অন্যথা হইবে না, নিশ্চয়ই কহিতেছি, আমি প্রাণসংশয়কালেই এই শক্তি প্রয়োগ করিব।”

ইন্দ্র-কর্ণের পরস্পর শস্ত্রবিনিময়

অনন্তর কর্ণ দেবরাজ ইন্দ্রের নিকট প্রজ্বলিত শক্তি গ্রহণপূর্ব্বক এক শাণিত অস্ত্ৰদ্বারা আপনার চর্ম্ম উৎকীর্ণ করিয়া কবচ ও কুণ্ডল উন্মোচনপূর্ব্বক আদ্ৰ থাকিতে থাকিতেই ইন্দ্রের হস্তে প্রদান করিলেন। কিন্তু তৎকালে তাঁহার মুখবর্ণ কিছুমাত্র বিবৰ্ণ হইল না, প্ৰত্যুত তিনি হাস্য করিতে লাগিলেন। তদর্শনে দেব ও দানবেরা সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন এবং দিব্যদুন্দুভিধ্বনি ও পুষ্পবৃষ্টি হইতে লাগিল।

তখন দেবরাজ সহাস্য-বদনে কর্ণকে বন্দনা ও যশস্বী করিয়া পাণ্ডবগণের কাৰ্য্যসাধনপূর্ব্বক দেবলোকে প্রস্থান করিলেন। ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ কর্ণ প্রতারিত হইয়াছেন শ্রবণ করিয়া একান্ত বিষণ্ন ও অহঙ্কারপরিশূন্য হইলেন; এদিকে পাণ্ডবেরা এই ব্যাপারসকল অবগত হইয়া কাননমধ্যে একান্ত হৃষ্ট ও পরিতুষ্ট হইলেন। জনমেজয় কহিলেন, ভগবান! তৎকালে পাণ্ডবেরা কোন স্থানে অবস্থান করিতেছিলেন ও কিরূপেই বা এই প্রিয়-বৃত্তান্ত অবগত হইলেন, আর দ্বাদশ বৎসর অতীত হইলেই বা কি করিয়াছিলেন? আপনি এই সমুদয় আদ্যোপান্ত কীর্ত্তন করুন।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পাণ্ডবেরা কৃষ্ণকে লাভ ও জয়দ্রথকে বিদ্রাবিত করিয়া সমগ্ৰবনবাসকাল অতিক্রমণ ও মহর্ষি মার্কণ্ডেয়ের মুখে অতি বিস্তীর্ণ দেবর্ষিগণ-বৃত্তান্ত শ্রবণপূর্ব্বক রথ, অনুযাত্র, সূত ও পৌরবর্গ সমভিব্যাহারে পুনরায় কাম্যাকবনে প্ৰতিগমন করিলেন।

কুণ্ডলাহরণপৰ্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।