৩০৯তম অধ্যায়
অবুদ্ধ-বুদ্ধ বিবরণ—জীব-ব্রহ্মের ঐক্যসাধন
“বশিষ্ঠ কহিলেন, ‘মহারাজ! অতঃপর বুদ্ধ ও অবুদ্ধের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পরমাত্মাকে বুদ্ধ এবং জীবাত্মাকে অবুদ্ধ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। এই উভয়ের মধ্যে জীবাত্মা সত্ত্বাদি-গুণপ্রভাবে স্বয়ং বহুরূপ ধারণ করিয়া ঐ সকল রূপকে, যথার্থ বলিয়া জ্ঞান করেন এবং সৃষ্টাদি কার্য্যে কর্ত্তৃত্বাভিমান করিয়া, পরমাত্মাকে অবগত হইতে অসমর্থ হয়েন। উনি নির্ব্বিকার হইয়াও নিরন্তর প্রকৃতির সহিত ক্রীড়া করিবার নিমিত্ত বিকৃত হইয়া থাকেন। উনি প্রকৃতি ও প্রকৃতির কাৰ্য্যসমুদয় অবগত হইতে পারেন বলিয়া কেহ কেহ ইহাকে বুদ্ধিমান্নামে নির্দ্দেশ করে। নির্গুণ ব্রহ্ম সগুণ হইলেও প্রকৃতিকে জড় বলিয়া থাকে, কিন্তু তাঁহাদের মতেও প্রকৃতি জীবাত্মাকেই আপনার সহিত অভিন্নভাবে অবগত হইতে পারেন, সঙ্গবিহীন পরমাত্মাকে কিছুতেই পরিজ্ঞাত হইতে সমর্থ হয়েন না। এইরূপ প্রকৃতির সঙ্গনিবন্ধন বেদে জীবাত্মাকে সঙ্গী বলিয়া নির্দ্দেশ করে। ইনি অবিকারী ও অতি সূক্ষ্ম হইলেও ঐ সঙ্গদোষনিবন্ধন কেহ কেহ উহাকে মূঢ় বলিয়াও কীৰ্ত্তন করিয়া থাকে। উনি পরমাত্মাকে যথার্থরূপে অবগত হইতে সমর্থ নহেন; কিন্তু অপ্রমেয় সনাতন পরমাত্মা উহাকে ও প্রকৃতিকে অনায়াসে অবগত হইতে সমর্থ হয়েন। জ্ঞানবান্ ব্যক্তিরাই সেই স্থূল-সূক্ষ্ম কাৰ্য্যকারণগত অদ্বিতীয় ব্রহ্মকে জ্ঞাত হইতে পারেন।
‘যখন জীবাত্মার “আমি স্থূল, আমি গৌর ও আমি ব্রাহ্মণ” ইত্যাদি জ্ঞানের উদয় হয়, তখন আর তিনি পরমাত্মা, প্রকৃতি বা আপনাকে অবগত হইতে সমর্থ হয়েন না। আর যখন জীবাত্মা প্রকৃতিকে জড় এবং আপনাকে তাহা হইতে ভিন্ন বলিয়া বিবেচনা করেন, তখনই তিনি বিশুদ্ধ, নির্ম্মল, অত্যুৎকৃষ্ট, মোক্ষোপযোগী বিদ্যাশক্তি লাভ করিয়া থাকেন। ঐ বিদ্যাশক্তির আবির্ভাব হইলেই জীবাত্মা পরমাত্মাকে পরিজ্ঞাত হইতে সমর্থ হয়েন এবং সৃষ্টিপ্রলয়কারিণী প্রকৃতিকে বিশেষরূপে অবগত হইয়া পরিত্যাগ করেন। ঐ সময় তিনি ব্রহ্মসন্দর্শননিবন্ধন উপাধি হইতে বিমুক্ত হইয়া পরমাত্মার সহিত মিলিত হয়েন। পণ্ডিতেরা আত্মাকেই পরম তত্ত্ব, অজর, অমর ও পঞ্চবিংশতিতত্ত্ব হইতে পৃথক বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। উনি চতুর্ব্বিংশতিতত্ত্ব আশ্রয় করিয়া থাকিলেও উহাকে তত্ত্বজ্ঞান বলা যায় না; কারণ, উনি স্বেচ্ছানুসারে ঐ আশ্রিত তত্ত্বকে পরিত্যাগ করিতে পারেন। যখন জীব আপনাকে জরামরণশূন্য পরমাত্মা বলিয়া বোধ করে, তখনই সে জ্ঞানবলপ্রভাবে পরমাত্মার সহিত মিলিত হইয়া থাকে। যে কাল পর্য্যন্ত জীব সৰ্ব্বশক্তিমান্ চৈতন্যস্বরূপ পরমাত্মাকে অবগত হইতে সমর্থ না হয়, তত দিন তাহার নানাত্ব থাকে; কিন্তু তাঁহাকে অবগত হইতে পারিলেই উহার একত্বলাভ হয়। পরমাত্মার সহিত মিলিত হইতে পারিলে জীবের আর পাপপুণ্যের লেশমাত্রও থাকে না এবং সে অনায়াসে প্রকৃতিকে পরিত্যাগ করে।
‘এই আমি শ্রুতিশাস্ত্রানুসারে তোমার নিকট জড়রূপা প্রকৃতি, জীবাত্মা ও পরমাত্মার বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম; শাস্ত্রানুসারে এইরূপেই জীবের নানাত্ব ও একত্ব নিরূপণ করা হইয়া থাকে। উদুম্বরস্থিত মশক ও উদুম্বরে এবং সলিলস্থিত মৎস্য ও সলিলে যেরূপ বিভিন্নতা, পরমাত্মার ও জীবাত্মার সেইরূপ বিভিন্নতা অনুমিত হইয়া থাকে। পরমাত্মার সহিত জীবাত্মার ঐক্যের নামই মোক্ষ। অজ্ঞানপ্রকৃতি হইতে জীবাত্মাকে মুক্ত করা সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। পরমাত্মার সহিত ঐক্য হইলেই জীবের মুক্তি হয়; অন্যরূপে উহার মুক্তিলাভের উপায় নাই। এই জীবাত্মা দেহ হইতে ভিন্ন হইয়াও যখন যেরূপ দেহের সহিত মিলিত হয়েন, তখন তাহারই ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়া থাকেন। ঐ জীবাত্মা বিশুদ্ধধৰ্ম্মা ব্যক্তির সহিত মিলিত হইলে বিশুদ্ধধর্ম্মাবলম্বী, বুদ্ধিমানের সহিত মিলিত হইলে বুদ্ধিমান, সন্ন্যাসীর সহিত মিলিত হইলে সন্ন্যাসী, অনুরাগবিহীনের সহিত মিলিত হইলে বিরাগী, মুমুক্ষুর সহিত মিলিত হইলে মুমুক্ষু, পবিত্রকার সহিত মিলিত হইলে পবিত্ৰকর্ম্মা, নিৰ্ম্মলের সহিত মিলিত হইলে নির্ম্মল, সঙ্গবিহীনের সহিত মিলিত হইলে নিঃসঙ্গ এবং স্বাধীন ব্যক্তির সহিত মিলিত হইলে স্বাধীন হইয়া থাকেন।
‘হে মহারাজ! এই আমি মৎসরশূন্য হইয়া তোমার নিকট সনাতন ব্রহ্মের বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম। যাহাদের বেদজ্ঞান নাই, অথচ ব্ৰহ্মলাভে শ্রদ্ধা আছে, তুমি সেই সমুদয় ব্যক্তিকেই এই ব্রহ্মোপদেশ প্রদান করিবে। মিথ্যাপরায়ণ, শঠ, শাস্ত্ৰতাৎপর্য্যগ্রহে অক্ষম, কুটিলমতি, পরহিংসাপরায়ণ, পণ্ডিতদিগের প্রতি ঈর্ষান্বিত পামরদিগকে কদাচ এই উপদেশ প্রদান করা বিধেয় নহে। শ্রদ্ধান্বিত, গুণবান, ক্ষমাশীল, পরহিতাকাঙ্ক্ষী, বিশুদ্ধস্বভাব, বিধিবিহিত কৰ্ম্মনিষ্ঠ, বিবাদবিহীন, বহুশ্রুত, শমদমাদি গুণান্বিত, শাস্ত্ৰতাৎপর্য্যগ্রহে সমর্থ ও জ্ঞানবান্ ব্যক্তিরাই এই উপদেশ প্রাপ্ত হইবার উপযুক্ত পাত্র। উহাদিগকে এই উপদেশ প্রদান করিলে উপদেষ্টা যারপরনাই শ্রেয়োলাভ করিতে পারে। অপাত্রে উপদেশ প্রদান করিলে কিছুমাত্র মঙ্গললাভের সম্ভাবনা নাই। ব্রহ্মহীন ব্যক্তি যদি রত্নপরিপূর্ণ সমুদয় পৃথিবীও প্রদান করে, তথাপি তাহার পরিবর্তে তাহাকে এই বিশুদ্ধ উপদেশ প্রদান করা কর্ত্তব্য নহে। হে করাল! আজ তুমি আমার নিকট অনাদি, অনন্ত, শোকরহিত, পরমব্রহ্মের কথা শ্রবণ করিলে; অতএব আর তোমার কিছুমাত্র ভয় নাই। সেই মঙ্গলময় পরমাত্মাকে অবগত হইতে পারিলে জম্মমরণের কিছুমাত্র আশঙ্কা থাকে না। এক্ষণে তুমি তাঁহাকে সম্যরূপে অবগত হইয়া মোহ পরিত্যাগ কর। আমি সনাতন হিরণ্যগর্ভকে প্রসন্ন করিয়া তাঁহার নিকট এই তত্ত্ব অবগত হইয়াছি। আজ তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করাতে যেমন আমি তোমার নিকট এই ব্রহ্মতত্ত্ব সবিশেষ কীৰ্ত্তন করিলাম, তদ্রূপ পুৰ্ব্বকালে আমি কমলযোনিকে বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি এই তত্ত্ব আমার নিকট বিস্তারিতরূপে কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন।’ ”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আমি মহর্ষি নারদের মুখে, পরব্রহ্মের বিষয় যেরূপ শ্রবণ করিয়াছিলাম, তাহা তোমার নিকট সবিশেষ কীৰ্ত্তন করিলাম। জীবাত্মা সেই অজর অমর পরব্রহ্মের যথার্থ তত্ত্ব সবিশেষ অবগত হইতে পারেন না বলিয়াই তাঁহাকে বারংবার জন্মগ্রহণ করিতে হয়। পূৰ্ব্বে মহাত্মা বশিষ্ঠ হিরণ্যগর্ভের নিকট ও দেবর্ষি নারদ বশিষ্ঠের নিকট এই উপদেশ প্রাপ্ত হয়েন। তৎপরে আমি দেবর্ষি নারদের মুখে এই তত্ত্ব শ্রবণ করিয়াছি। এক্ষণে তুমি আমার নিকট এই উৎকৃষ্ট উপদেশ শ্রবণ করিলে, অতঃপর আর শোক করিবার প্রয়োজন নাই। যে ব্যক্তি ক্ষর ও অক্ষরের বিষয় সবিশেষ অবগত হইতে পারে, তাহার কিছুমাত্র ভয় থাকে না; আর যে ব্যক্তি উহা অবগত হইতে পারে না, তাহাকে সতত ভীত হইতে হয়। জীব অজ্ঞানসাগরে নিমগ্ন হইয়াই মোহবশতঃ বারংবার দেবলোক, মর্ত্ত্যলোক ও নরকে গমনাগমন এবং সহস্র সহস্র যোনিতে জন্মগ্রহণপূৰ্ব্বক বিবিধ ক্লেশ ভোগ করে। যদি সে সাধুসঙ্গাদিদ্বারা কঞ্চিৎ সেই অজ্ঞানসাগর হইতে উত্তীর্ণ হইতে পারে, তাহা হইলে তাহাকে আর জন্মমরণজনিত যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয় না। অজ্ঞানসাগর অতি ভীষণ, অব্যক্ত ও অগাধ। প্রাণীগণ উহাতে অনবরত নিমগ্ন হইতেছে। তুমি সেই অজ্ঞানসাগর হইতে উত্তীর্ণ হইয়াছ; সুতরাং এক্ষণে তোমার রজ ও তমোগুণের লেশমাত্র নাই।”