৩০৮. বিদ্যা-অবিদ্যা বিবরণ

৩০৮তম অধ্যায়

বিদ্যা-অবিদ্যা বিবরণ

“বশিষ্ঠ কহিলেন, ‘হে মহারাজ! এই আমি তোমার নিকট সাঙ্খ্যমত কীৰ্ত্তন করিলাম। এক্ষণে বিদ্যা ও অবিদ্যার বিষয় আনুপূর্ব্বিক কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পণ্ডিতেরা সৃষ্টিপ্রলয়বিধায়িনী প্রকৃতিকে অবিদ্যা এবং ঐ সৃষ্টিপ্রলয় হইতে অতীতা প্রকৃতিকে বিদ্যা বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। বিদ্যা চতুর্ব্বিংশতিতত্ত্ব হইতে অতীত। সাঙ্খ্যমতাবলম্বী মহর্ষিগণ বুদ্ধীন্দ্রিয় ও কৰ্ম্মেন্দ্রিয়াদির মধ্যে অপেক্ষাকৃত শ্রেষ্ঠকেও বিদ্যাশব্দে নির্দ্দেশ করিয়া গিয়াছেন। এক্ষণে আমি তাহা বিশেষরূপে আনুপূর্ব্বিক কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। বুদ্ধীন্দ্রিয় ও কৰ্ম্মেন্দ্রিয়ের মধ্যে বুদ্ধীন্দ্রিয়, স্থলভূত ও বুদ্ধীন্দ্রিয়ের মধ্যে স্থূলভূত, মন ও স্থূলভূতের মধ্যে মন, সূক্ষ্মপঞ্চভূত ও মনের মধ্যে সূক্ষ্মপঞ্চভূত, অহঙ্কার ও সূক্ষ্মপঞ্চত্তত্ত্বের মধ্যে অহঙ্কার, মহত্তত্ত্ব ও অহঙ্কারের মধ্যে মহত্তত্ত্ব, প্রকৃতি ও মহতত্ত্বের মধ্যে প্রকৃতি এবং পুরুষ ও প্রকৃতির মধ্যে পুরুষ বিদ্যাস্বরূপ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। জ্ঞান ও প্রকৃতির কাৰ্য্য এবং জ্ঞেয় ও বিজ্ঞাতা চতুর্ব্বিংশতি ক্ষর ও অক্ষর-প্রকৃতি ও পুরুষের পরিচয়তত্ত্বাতীত।

‘এই আমি তোমার নিকট বিদ্যা ও অবিদ্যার যথার্থ তত্ত্ব কীৰ্ত্তন করিলাম, এক্ষণে ক্ষর ও অক্ষরের বিষয় যথাসাধ্য কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। প্রকৃতি ও পুরুষ এই উভয়েই ক্ষর ও অক্ষরনামে অভিহিত হইয়া থাকেন। জ্ঞানবান্ ব্যক্তিরা ঐ উভয়কেই জন্মমৃত্যুবিহীন ঈশ্বর বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন এবং ঐ উভয়কেই আবার তত্ত্ব বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। সৃষ্টি ও প্রলয়কাৰ্য্য সম্পাদননিবন্ধন প্রকৃতিকে অক্ষর বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। প্রকৃতি মহদাদিগুণের সৃষ্টি করিবার নিমিত্ত বারংবার বিকৃত হইয়া ঐ সমুদয় গুণের সৃষ্টি করিয়া থাকেন। পুরুষ ক্ষেত্রে অধিষ্ঠান করেন বলিয়া উঁহাকে ক্ষেত্ৰনামেও কীৰ্ত্তন করা যায়। যখন মহাদিগুণসমুদয় প্রকৃতিমধ্যে বিলীন হয়, তখন ঐ সমুদয় গুণের সহিত চতুর্ব্বিংশতিতত্ত্বাতীত পুরুষও উহাতে বিলীন হইয়া থাকেন। গুণসমুদয় বিলীন হইলে একমাত্র প্রকৃতি অবস্থান করেন। যখন জীব প্রকৃতিমধ্যে লীন হয়েন, তখন প্রকৃতি মহাদিগুণ সংযুক্ত হইয়া ক্ষরত্ব এবং সত্ত্বাদিগুণের অবস্থান নিমিত্ত নির্গুণতালাভ করিয়া অক্ষরত্ত্ব প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। ক্ষেত্ৰজ্ঞান ক্ষয় হইলে স্বভাবতঃ নির্গুণ অক্ষর পুরুষও প্রকৃতির ন্যায় ক্ষরত্ব প্রাপ্ত হইয়া থাকেন।

জীবাত্মা-পরমাত্মার পরস্পর মিলন ও বিচ্ছেদ

‘যখন দেহাভিমানী জীবাত্মা প্রকৃতিকে গুণবিশিষ্ট ও আপনাকে প্রকৃতি হইতে পৃথক ও প্রকৃতিকে আপনা হইতে পৃথক্ বলিয়া বোধ করেন, সেই সময়ে তাঁহাকে বিশুদ্ধ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। যখন জীবাত্মা প্রকৃতির সহিত মিশ্রিত না হয়েন, তখন তিনি পরমাত্মা হইতে অভিন্ন এবং যখন প্রকৃতির সহিত মিশ্রিত হয়েন, তখন তিনি পরমাত্মা হইতে ভিন্ন হইয়া থাকেন। যখন জীবাত্মা প্রাকৃত গুণসমুদয়ের নিন্দা করেন এবং পরব্রহ্মকে বিস্মৃত না হয়েন, তখন তিনি পরমাত্মাতে মিলিত হইয়া থাকেন। তত্ত্বজ্ঞান জন্মিলে জীবাত্মা এই বলিয়া আক্ষেপ করেন যে, “মৎস্য যেমন অজ্ঞানবশতঃ জালে নিপতিত হয়, তদ্রূপ আমি মোহবশতঃ এই প্রাকৃত দেহ আশ্রয় করিয়া অতিশয় কুকর্ম্ম করিয়াছি। মৎস যেমন জীবনলাভের নিমিত্ত এক হ্রদ হইতে অন্য হ্রদে গমন করে, তদ্রূপ আমি মুগ্ধ হইয়া দেহ হইতে দেহান্তরে প্রবেশ করিতেছি। মৎস্য যেমন সলিলকেই আপনার জীবন বলিয়া জ্ঞান করে, তদ্রূপ আমি পুত্ৰাদিগকেই আত্মা বলিয়া জ্ঞান করিয়া থাকি। হায়! আমি অজ্ঞানবশতঃ পরমাত্মাকে পরিত্যাগ করিয়া বারংবার প্রাকৃত দেহ আশ্রয় করিতেছি; অতএব আমাকে ধিক! পরমাত্মা আমার পরম বন্ধু। তাঁহাকে আশ্রয় করিলে আমি তাঁহার স্বরূপত্ব লাভ করিয়া তাহা হইতে অভিন্ন হইতে পারি। তাহা হইতে আমার কোন অংশে ন্যূনতা নাই। আমি তাঁহারই ন্যায় নির্ম্মল ও অব্যক্ত সন্দেহ নাই। মোহবশতঃ প্রকৃতির বশীভূত হওয়াতেই আমার এইরূপ দুর্গতি উপস্থিত হইয়াছে। আমি নির্গুণ হইয়াও সগুণ প্রকৃতির সহবাসে এতকাল অতিক্রম করিলাম; অতএব আমার মত নির্ব্বোধ আর কে আছে? প্রকৃতি কখন দেবযোনি, কখন মনুষ্যযোনি ও কখন তির্য্যোগযোনি আশ্রয় করিতেছে; অতএব উহার সহিত একত্র বাস করা আমার কদাপি বিধেয় নহে। অতঃপর আমি স্থিরনিশ্চয়। হইলাম; আর কখনও আমি উহার সহবাসে প্রবৃত্ত হইব না। আমি নির্ব্বিকার হইয়াও এতকাল এই বিকারযুক্ত প্রকৃতিকর্ত্তৃক বঞ্চিত হইলাম। এ বিষয়ে প্রকৃতির কোন অপরাধ নাই; আমারই সম্পূর্ণ অপরাধ। আমি স্বয়ং পরমাত্মা হইতে পরাঙ্মুখ হইয়া উহাতে আসক্ত হইয়াছি। আমি রূপহীন ও মূৰ্ত্তিহীন হইয়াও মমতাবশতঃ রূপবান্ হইয়া বিবিধ মূৰ্ত্তিতে অবস্থান করিতেছি। আমি নির্ম্মম হইয়াও মমতাসহকারে বিবিধ যোনিতে পরিভ্রমণপূৰ্ব্বক কি অসৎকার্য্যের অনুষ্ঠান করিলাম! প্রকৃতি অহঙ্কারদ্বারা আমাকে আবরণ করিয়া রাখিয়াছে এবং স্বয়ং বহু অংশে বিভক্ত হইয়া আমাকে নানা দেহে নিয়োগ করিতেছে। এক্ষণে আমি অহঙ্কার ও মমতাপরিশুন্য হইয়া প্রতিবুদ্ধ [জাগরিত—মোহমুক্ত হইয়াছি, আর আমার প্রকৃতিকে আশ্রয় করিবার প্রয়োজন নাই। এক্ষণে আমি উহাকে এবং অহঙ্কারকৃত মমতাকে পরিত্যাগ করিয়া দ্বন্দ্ববিহীন পরমাত্মাকে আশ্রয় করিব। পরমাত্মার সহিত মিলিত হওয়াই আমার শ্রেয়ঃ। অতএব আমি উহার সহিত মিলিত হইব। প্রকৃতির সহিত মিলিত হওয়া আমার কদাপি বিধেয় নহে।”

জীবাত্মা এইরূপে তত্ত্বজ্ঞাননিবন্ধন পরমাত্মাকে অবগত হইতে, পারিলেই ক্ষরত্ব পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অক্ষরত্ব প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। নির্গুণ জীব দেহরূপে পরিণত প্রকৃতিতে অবস্থান করিলেই সগুণ হয় এবং পরিশেষে তত্ত্বজ্ঞানপ্রভাবে সর্ব্বাদিভূত নির্গুণ পরব্রহ্মের সহিত সাক্ষাৎকার হইলেই পুনরায় নির্গুণত্ব প্রাপ্ত হইয়া থাকে।

‘এই আমি সাধ্যানুসারে তোমার নিকট ক্ষর ও অক্ষরের তত্ত্বনির্দ্দেশ করিলাম, এক্ষণে যেরূপে সন্দেহবিহীন নির্ম্মল সূক্ষ্ম জ্ঞানের উদয় হয়, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। আমি পূর্বে শাস্ত্রের যথার্থতত্ত্ব নিরূপণসময়ে যে সাঙ্খ্য ও যোগশাস্ত্রের কথা কহিয়াছি, সে উভয়ই একরূপ। তন্মধ্যে সাঙ্খ্যশাস্ত্রে শিষ্যদিগের অনায়াসে জ্ঞানলাভ হয়, কিন্তু যোগশাস্ত্র অতি বিস্তীর্ণ বলিয়া উহাতে শীঘ্র জ্ঞান জন্মিবার সম্ভাবনা নাই। যোগশাস্ত্র অতিবিস্তীর্ণ ও দুরবগাহ বটে, কিন্তু বেদে উহার সমধিক সমাদর দৃষ্ট হইয়া থাকে। সাঙ্খ্যমতাবলম্বীরা ষড়বিংশকে পরমতত্ত্ব না বলিয়া পঞ্চবিংশকেই পরমতত্ত্ব বলিয়া নির্দ্দেশ করেন; এই কারণেই বেদশাস্ত্রে সাঙ্খের সম্যক সমাদর নাই। এই আমি তোমার নিকট সাঙ্খ্যমতাবলম্বীদিগের পরমতত্ত্ব কীৰ্ত্তন করিলাম। যোগমতে পরমাত্মা উপাধিযুক্ত হইলেই জীবরূপে পরিণত হয়েন। এই নিমিত্ত যোগমতাবলম্বীরা জীবাত্মা ও পরমাত্মা উভয়কেই স্বীকার করিয়া থাকেন।’ ”