৩০৭. যৌগিক উপায়ে জীবাত্মা-পরমাত্মার ঐক্যসাধন

৩০৭তম অধ্যায়

যৌগিক উপায়ে জীবাত্মা-পরমাত্মার ঐক্যসাধন

‘জনক কহিলেন, “মহর্ষে! আপনি অক্ষরের একত্ব ও ক্ষরের নানাত্ব কীৰ্ত্তন করিলেন; কিন্তু এই উভয় পক্ষের তত্ত্বাবধারণ বিষয়ে আমার সন্দেহ উপস্থিত হইতেছে। অজ্ঞান ব্যক্তিরা আত্মাকে নানারূপে এবং জ্ঞানবান্ ব্যক্তিরা উহাকে একরূপে অবলোকন করিয়া থাকেন; কিন্তু আমি নিতান্ত স্থূলবুদ্ধিবশতঃ ঐ উভয় পক্ষেরই তত্ত্বাবধারণ করিতে সমর্থ হইতেছি না। আর আপনি অক্ষর ও ক্ষরের যে কারণ নির্দ্দেশ করিয়াছেন, আমি চঞ্চলবুদ্ধিপ্রভাবে তাহাও বিস্মৃতপ্রায় হইয়াছি। এক্ষণে নানাত্ব, একত্ব, জ্ঞানবান, অজ্ঞান, জ্ঞাতব্য বিষয়, বিদ্যা, অবিদ্যা, ক্ষর, অক্ষর এবং সাঙ্খ্য ও যোগ এই সমুদয় শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইয়াছে; আপনি কীৰ্ত্তন করুন।’

“বশিষ্ঠ কহিলেন, ‘রাজন! তুমি যে-যে বিষয় জিজ্ঞাসা করিলে, তাহার উত্তর প্রদান, বিশেষতঃ যোগকার্য্য বিশেষরূপে কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। যোগীদিগের ধ্যানই পরম বল। বিদ্বান ব্যক্তিরা ঐ ধ্যানকে চিত্তের একাগ্রতা ও প্রাণায়াম এই দ্বিবিধ বলিয়া থাকেন। তন্মধ্যে প্রাণায়াম দুই প্রকার—সগর্ভ [সগুণ] ও নিগর্ভ। বীজজপঘটিত প্রাণায়ামকে সগর্ভ ও জপবিহীন প্রাণায়ামকে নির্গর্ভ প্রাণায়াম বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। বিষ্ঠামূত্র পরিত্যাগ ও ভোজনসময় ব্যতীত আর সকল সময়েই ধ্যান করা কর্ত্তব্য। বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা চিত্তের একাগ্রতাপ্রভাবে শব্দাদি বিষয় হইতে ইন্দ্রিয়সমুদয়কে নিবৃত্ত করিয়া অঙ্গুষ্ঠ হইতে মস্তক পৰ্য্যন্ত প্রাণবায়ুর স্তম্ভনদ্বারা জীবাত্মাকে চতুর্ব্বিংশতিতত্ত্ব হইতে পৃথক্‌ করিয়া পরমাত্মাতে নীত করিবেন। এইরূপে জীবাত্মার সহিত পরমাত্মার ঐক্যসম্পাদন করিতে পারিলেই জীবন্মুক্ত হওয়া যায়।

পণ্ডিতগণ জীবন্মুক্ত যোগীদিগকে ব্রহ্ম বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। যাঁহাদিগের মন সতত প্রাণায়ামে একান্ত আসক্ত, তাঁহারাই পরমাত্মার সহিত সাক্ষাৎ করিতে সমর্থ হয়েন এবং সেই যোগরূপ ব্রতানুষ্ঠান তাঁহাদিগেরই উপযুক্ত। বিষয়বাসনাবিমুক্ত, অল্পাহারনিরত ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া বুদ্ধিদ্বারা মন ও মনদ্বারা ইন্দ্রিয়গণকে সুস্থির করিয়া পাষাণের ন্যায় অবিচলিতচিত্তে সন্ধ্যাসময়ে ও রাত্রিশেষে আত্মাতে মনঃসমাধান করা যোগী ব্যক্তিদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। পণ্ডিতগণ যখন পৰ্ব্বতের ন্যায় অচল ও স্থাণুর ন্যায় অপ্রকম্প হইয়া উঠেন, তখন তাঁহাদের দর্শন, শ্রবণ, ঘ্রাণ, আস্বাদন ও স্পর্শজ্ঞান একেবারে তিরোহিত হইয়া যায় এবং মনোমধ্যে সঙ্কল্পের লেশমাত্রও থাকে না, সেই সময়ই তাঁহাদিগকে বিশুদ্ধ যোগী বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। ঐ সময়ই তাঁহারা নির্ব্বাত-প্রদেশস্থিত প্রজ্বলিত প্রদীপের ন্যায় প্রকাশিত, অচল ও লিঙ্গশরীরবিহীন হয়েন। তাহা হইলেই তাঁহাদিগকে আর কি ঊৰ্দ্ধতন, কি অধস্তন কোন লোকেই গমন করিতে হয় না। যিনি পরমাত্মার সহিত সাক্ষাৎকার করিয়া তাঁহার স্বরূপকথনে সমর্থ হয়েন, তিনিই যথার্থ আত্মদর্শী। মাদৃশ ব্যক্তিরা কেবল এই পর্য্যন্ত অবগত আছেন যে, পরমাত্মা হৃদয়মধ্যে বিধূম পাবকের ন্যায়, রশ্মিযুক্ত দিবাকরের ন্যায় এবং বিদ্যুৎসম্বন্ধীয় অগ্নির ন্যায় লক্ষিত হইয়া থাকেন। ব্রহ্মাববোধক [ব্রহ্মজ্ঞানপ্রদ] শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন ধৈর্য্যশীল মহাত্মা ব্রাহ্মণগণ যে অনাদি অমৃতময় পরব্রহ্মকে অবলোকন করেন, তিনি সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর ও মহৎ হইতে মহত্ত্বর। তিনি সৰ্ব্বভূতে অবস্থান করিতেছেন, কিন্তু কেহই তাঁহাকে অবলোকন করিতে সমর্থ নহে। কেবল সুক্ষ্ম বুদ্ধিযুক্ত মনদ্বারাই তাঁহাকে অনুমান করা যায়। তিনি স্থূল ব্রহ্মাণ্ড হইতে পৃথক। বেদপারগ মহাত্মারা সেই নির্ম্মল নিরুপাধি ব্ৰহ্মকে সংসারচ্ছেত্তা বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া গিয়াছেন। যোগীরা পূৰ্ব্বোক্ত প্রকারে সাধন করিতে পারিলেই আত্মসাক্ষাৎকার লাভ করিতে পারেন। এই আমি তোমার নিকট যোগের বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম। অতঃপর সাঙ্খ্যজ্ঞান কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

প্রকৃতি-পুরুষ-তত্ত্বনির্ণয়

‘প্রকৃতিবাদী সাঙ্খ্যবিদ পণ্ডিতগণ প্রকৃতিকেই প্রধান বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। তাঁহারা কহিয়া থাকেন যে, প্রধানা প্রকৃতি হইতে মহত্তত্ত্ব, মহত্তত্ত্ব হইতে অহঙ্কার ও অহঙ্কার হইতে শব্দস্পর্শাদি পঞ্চসূক্ষ্মভূত উৎপন্ন হয়। সাঙ্খ্যবাদীরা এই আটটিকেই প্রকৃতি বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচ কৰ্ম্মেন্দ্রিয়, আকাশাদি পঞ্চভূত ও মন এই ষোড়শটি ঐ আট প্রকৃতির বিকার। যে পদার্থ হইতে যে পদার্থের উৎপত্তি হয়, তাহা সেই পদার্থেই লীন হইয়া থাকে। তরঙ্গমালা যেমন ক্রমশঃ সাগরে উৎপন্ন ও সাগরেই বিলীন হয়, তদ্রূপ গুণসমুদয় ক্রমে ক্রমে গুণ হইতে উৎপন্ন ও গুণেতেই বিলীন হইয়া যায়। এই আমি তোমার নিকট সৃষ্টি ও প্রলয়ের বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম। তত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতেরা নিরূপণ করিয়াছেন যে, জগদীশ্বর প্রলয়কালেই একমাত্র থাকেন, সৃষ্টিসময়ে তাঁহাকে বিবিধ রূপ ধারণ করিতে হয়। অব্যক্ত প্রকৃতি যেমন দেহের অধিষ্ঠাতা পুরুষকে সৃষ্টিকালে নানা রূপ ও প্রলয়কালে এক রূপ প্রাপ্ত করায়, তদ্রূপ জীবাত্মাও সৃষ্টিকালে প্রকৃতির বহু রূপ ও প্রলয়কালে এক রূপ উৎপাদন করিয়া থাকে। চতুর্ব্বিংশতিতত্ত্বাতীত আত্মার অধিষ্ঠিত দেহকে ক্ষেত্র এবং অধিষ্ঠাতা পুরুষকে আত্মা বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। জীবাত্মা ক্ষেত্রে অধিষ্ঠিত হইয়া তাহার তত্ত্ব পরিজ্ঞাত হইতে পারেন, এই নিমিত্ত অধিষ্ঠাতা পুরুষও ক্ষেত্রজ্ঞ বলিয়া অভিহিত হয়েন। প্রকৃতি ও পুরুষ পরস্পর ভিন্ন। পণ্ডিতেরা প্রকৃতিকে ক্ষেত্র, চতুর্ব্বিংশতিতত্ত্বাতীত আত্মাকে জ্ঞাতা, জ্ঞানকে জ্ঞাতা হইতে ভিন্ন ও প্রকৃতির কাৰ্য্য এবং জ্ঞেয় বস্তুকে জ্ঞান হইতে পৃথক্ ও চতুৰ্ব্বিংশতিতত্ত্বাতীত বলিয়া নিরূপণ করিয়া গিয়াছেন। প্রকৃতিকে অব্যক্ত, ক্ষেত্র, তত্ত্ব ও ঈশ্বর বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। সাঙ্খ্যবিদ পণ্ডিতেরা প্রকৃতিকেই জগৎসৃষ্টির কারণ বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। যে শাস্ত্রে চতুর্ব্বিংশতিতত্ত্ব নিরূপিত আছে, তাহাকেই সাঙ্খ্যশাস্ত্র বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। জীবাত্মা পরমাত্মাকে পরিজ্ঞাত হইতে পারিলেই তাঁহার স্বরূপত্ব প্রাপ্ত হইতে পারে। এই আমি তোমার নিকট সমুদয় সাঙ্খ্যমত সবিস্তরে কীৰ্ত্তন করিলাম। যাঁহারা এই সাঙ্খ্যমত বিশেষরূপে পরিজ্ঞাত হইতে পারেন, তাঁহারাই শান্তিলাভ করিতে সমর্থ হয়েন।

‘ব্রহ্মসাক্ষাৎকারকেই সম্যক্ দর্শন বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। ভ্রান্ত ব্যক্তিরা যেমন বিষয় দর্শন করে, অভ্রান্ত ব্যক্তিরা তদ্রূপ অলৌকিক ব্রহ্মপদার্থ প্রত্যক্ষ করিয়া থাকেন। ব্রহ্মের স্বরূপত্ব ও নিরুপাধি সুখলাভনিবন্ধন দেহত্যাগী মুক্তপুরুষদিগকে ইহলোকে পুনৰ্ব্বার জন্মগ্রহণ করিতে হয় না। যাহারা ভেদবুদ্ধিবশতঃ ব্রহ্মপদার্থ প্রত্যক্ষ করিতে সমর্থ হয় না, তাহারাই ইহলোকে বারংবার জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে। যাঁহারা এই সমুদয় তত্ত্ব পরিজ্ঞাত হইয়া যোগবলে সমুদয় পদার্থ প্রত্যক্ষ করেন, তাঁহারা কখনই দেহের বশবর্ত্তী হয়েন না। ফলতঃ জগৎপ্রপঞ্চ প্রকৃতির কাৰ্য্য ও আত্মা উহা হইতে পৃথক্‌। যাঁহারা সেই আত্মাকে পরিজ্ঞাত হইতে পারেন, তাঁহাদিগকে কখনই সংসারভয়ে ভীত হইতে হয় না।