৩০৭. কুন্তীর কবচকুণ্ডলধারী পুত্র প্রসব—মঞ্জুষা-নিবন্ধাবস্থায় নদীতে নিক্ষেপ

৩০৭তম অধ্যায়

কুন্তীর কবচকুণ্ডলধারী পুত্র প্রসব—মঞ্জুষা-নিবন্ধাবস্থায় নদীতে নিক্ষেপ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর নৃপদুহিতা কুন্তী নভোমণ্ডলবর্ত্তী প্রতিপাচ্চন্দ্ৰলেখার ন্যায় গৰ্ভধারণ করিলেন, কিন্তু বান্ধবভয়ে সর্ব্বদাই তাহা সংবৃত করিয়া রাখিতেন। ফলতঃ – তৎকালে কেহই এই বৃত্তান্তের বিন্দুবিসর্গও অবগত হইতে পারে নাই; কেবল তাঁহার এক ধাত্রেয়িকা উহা সম্যক্ জ্ঞাত হইয়াছিল।

অনন্তর কুন্তী সমুচিত অবসর লাভ করিয়া সূর্য্যদেবের প্রসাদে কন্যাকাকালে কনকোজ্জ্বল কুণ্ডল ও বর্ম্মধারী, সিংহনেত্র ও বৃষস্কন্ধ এক পুত্র প্রসব করিলেন; ঐ পুত্ৰ তেজঃপ্রভাবে নিজ পিতা দিনমণির ন্যায় নিতান্ত দুনিরীক্ষ্য হইয়া উঠিলেন। পরে কুন্তী ধাত্রীর সহিত মন্ত্রণা করিয়া মধুচ্ছিষ্টবিলিপ্ত [মোম দিয়া ঢাকা], অতি বিস্তীর্ণ ও আচ্ছাদনসম্পন্ন এক মঞ্জুষা [পেটিকা-পেটরা] মধ্যে সেই পুত্রকে সংস্থাপনপূর্ব্বক রোদন করিতে করিতে অশ্বনদীতে নিক্ষেপ করিলেন এবং কন্যাকাকালে গর্ভধারণ অতি গৰ্হিত কর্ম্ম জানিয়াও পুত্র-স্নেহে নিতান্ত কাতর ও একান্ত বিহ্বল হইয়া করুণস্বরে বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিলেন। পরে মঞ্জুষানিহিত পুত্রকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে বৎস! দিব্য, পার্থিব ও অন্তরীক্ষগত ভূত এবং জলচর প্রাণীসকল তোমার মঙ্গলবিধান করুন। পথিমধ্যে অন্য কেহ তোমার বিদ্রোহাচরণ করিবেন না, তুমি নির্ব্বিঘ্নে গমন কর। জলেশ্বর বরুণ সলিলমধ্যে এবং গগনচারী সমীরণ অন্তরীক্ষে তোমাকে রক্ষা করিবেন। যিনি তোমাকে দিব্য বিধানানুসারে আমার গর্ভে উৎপাদন করিয়াছেন, সেই সূৰ্য্যদেব তোমাকে রক্ষা করুন। আদিত্য, বসু, রুদ্র, সাধ্য, বিশ্বদেব, দেবরাজ, মরুৎ ও দিকপালসহ দিকসকল সম ও বিষম প্রদেশে তোমাকে রক্ষা করিবেন। আমি বিদেশেও সহজাত কবচদ্বারা তোমাকে অনায়াসে চিনিতে পারিব। তোমার পিতা সূর্যদেব ধন্য; তিনি দিব্যচক্ষুপ্রভাবে মঞ্জুষা মধ্যেও তোমাকে নিরীক্ষণ করিতেছেন। এক্ষণে যে তোমাকে পুত্ৰত্বে পরিগ্রহ করিবে এবং তুমি পিপাসায় শুষ্ককণ্ঠ হইয়া ব্যগ্রতাসহকারে যাহার স্তন পান করিবে, সে নারীও ধন্য। না জানি, সে কিরূপ স্বপ্ন দেখিয়াছে! আহা! কি সৌভাগ্য! সে এই কমললোচন, সুললাট ও সুকেশসম্পন্ন পুত্রকে লালন-পালন করিবে। তুমি যখন ধূলিধূসরিতকলেবর হইয়া জানু দ্বারা গমনপূর্ব্বক মধুর অস্ফুট বাক্য প্রয়োগ করিবে, তুমি যখন হিমাচলসম্ভূত কেশরিশাবকের ন্যায় যৌবনসম্পন্ন হইবে, না জানি, এই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া সেই রমণীয় অন্তঃকরণে কতই আনন্দসঞ্চার হইবে।”

কুন্তী এইরূপ বহুতর বিলাপ ও পরিতাপপূর্ব্বক সাতিশয় রোদন করিয়া নিশীথসময়ে অশ্বনদীসলিলক্ষিপ্ত মঞ্জুষা পরিত্যাগ করিলেন; পরে পিতার আহ্বানভয়ে ভীত হইয়া শোকাকুলমনে ধাত্রীর সহিত পুনরায় নিজ নিকেতনে প্রবিষ্ট হইলেন। এদিকে মঞ্জুষা অশ্বনদী-প্রবাহে নিক্ষিপ্ত ও পরিত্যক্ত হইবামাত্ৰ তথা হইতে চৰ্ম্মণ্বতী স্রোতস্বতীতে উপস্থিত হইল; পরে সে স্থান হইতে যমুনা ও যমুনা হইতে ভাগীরথীতে গমন করিল। অনন্তর মঞ্জুষামধ্যগত দৈবনির্ম্মিত বর্ম্মধারী বালক প্রবাহবেগে বাহিত হইয়া সূতরাজ্যার্ন্তবর্ত্তী চম্প-নগরীতে উপনীত হইল।