৩০৬. সূৰ্য্যদেবকর্ত্তৃক কুন্তীর গর্ভাধান

৩০৬তম অধ্যায়

সূৰ্য্যদেবকর্ত্তৃক কুন্তীর গর্ভাধান

বৈশম্পায়ন কহিলেন, নৃপবর! কন্যা কুন্তী বহুবিধ মধুরবাক্য বলিয়াও সূৰ্য্যদেবকে সার্ত্বনা করিতে পারিলেন না। যখন তিনি দেখিলেন, ভাস্করকে প্রত্যাখ্যান করা নিতান্ত অসাধ্য, তখন শাপভায়ে নিতান্ত ভীত হইয়া মনে মনে বহুক্ষণ চিন্তা করিলেন, “এখন কি করি, কি উপায়ে নিরপরাধ পিতা ও ব্রাহ্মণ সূৰ্য্যশাপ হইতে পরিত্রাণ পাইবেন? বালক সদ্ব্যবহারসম্পন্ন হইলেও পূর্ব্বাপর পৰ্য্যালোচনা করিয়া কোনক্রমে তেজস্বী বা তপস্বী ব্যক্তির সমীপবর্ত্তী হইবে না। যাহা হউক, আমি এক্ষণে বিপন্ন ও নিতান্ত ভীত হইয়াছি; কিরূপে স্বয়ং আত্মপ্ৰদানস্বরূপ অকাৰ্য্যানুষ্ঠান করি?”

অভিসম্পাতভীতা কুন্তী মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিয়া নিতান্ত মোহপরায়ণা হইয়া লজ্জানম্র মুখে বিনয়বচনে সূৰ্য্যদেবকে কহিতে লাগিলেন, “হে দেব দিবাকর! আমার পিতা, মাতা ও বন্ধুবান্ধব সমুদয় বর্ত্তমান থাকিতে এইরূপ বিধিবিরুদ্ধ কাৰ্য্যানুষ্ঠান করা নিতান্ত অকর্ত্তব্য। দেখুন, যদি আপনার সহিত আমার অবৈধ সঙ্গম হয়, তাহা হইলে লোকমধ্যে আমাদের কুলের কীর্ত্তি নাশ হইবে, অথবা প্রাণীগণের ধর্ম্ম, যশ, কীর্ত্তি ও আয়ু আপনাতেই প্রতিষ্ঠিত আছে; অতএব যদি আপনি এই কাৰ্য্যকে ধর্ম্মানুগত কহেন, তাহা হইলে আমি বন্ধুবর্গের অপেক্ষা না করিয়া স্বয়ং আপনাকে আত্মপ্ৰদান করিতে পারি।”

সূৰ্য্য কহিলেন, “হে চারুহাসিনি! তোমার পিতা, মাতা বা অন্যান্য গুরুজন তোমার প্রভু নহেন, অবিবাহিতা নারীগণ যাহাকে ইচ্ছা হয়, তাহাকেই কামনা করিতে পারে বলিয়া উহাদিগকে কন্যা কহে। হে নিতস্বিনি! কন্যা স্বতন্ত্রা, পরতন্ত্রা নহে, অতএব তুমি এই বিষয়ে প্রবৃত্ত হইলে কদাপি অধর্ম্মাচরণ হইবে না। আর আমি কি নিমিত্তই বা কামপরতন্ত্র হইয়া অধর্ম্মাচরণ করিব? হে ভাবিনি! স্বেচ্ছানুসারে কাৰ্য্য করাই স্বভাবসিদ্ধ, বৈবাহিকাদি নিয়ম কেবল মানবগণের কল্পনামাত্ৰ; অতএব তুমি অবিশঙ্কিতচিত্তে আমার সহিত সঙ্গত হও। আমি কহিতেছি, আমার সহযোগে তোমার গর্ভে এক মহাযশাঃ পুত্ৰ সমুৎপন্ন হইবে; কিন্তু তুমি পুনরায় স্বীয় কন্যাকাবস্থা প্রাপ্ত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”

কুন্তী কহিলেন, “দেব! যদি আপনি আমাকে পুত্র প্রদান করেন, তবে যেন ঐ পুত্ৰ কুণ্ডলদ্বয় ও সহজাত অভেদ্য দিব্যবর্ম্মধারী হয়।”

সূৰ্য্য কহিলেন, “হে নিতস্বিনি! তোমার পুত্ৰ মহাবলপরাক্রান্ত এবং কুণ্ডল ও অভেদ্য সহজাত-বর্ম্মধারী হইবে।”

কুন্তী কহিলেন, “হে দেব! আপনি আমার গর্ভে যে পুত্র উৎপাদন করিবেন, ঐ পুত্ৰ যদি কুণ্ডল ও সহজাতবর্ম্মধারী এবং আপনার ন্যায় তেজস্বী, রূপবান ও ধার্ম্মিক হয়, তাহা হইলে আপনি স্বীয় মনোরথ সম্পূর্ণ করুন।”

সূৰ্য্য কহিলেন, “হে বরারোহে! অদিতি আমাকে যে কুণ্ডলদ্বয় প্রদান করিয়াছেন, তাহা এবং উৎকৃষ্ট বর্ম্ম তোমার পুত্রকে প্রদান করিব।”

কুন্তী কহিলেন, “হে দিবাকর! আপনি যেরূপ কহিলেন, আমার পুত্র যদি তদ্রূপ হয়, তাহা হইলে আমি আপনার বাক্যে সম্মত হইব।”

তখন সূৰ্য্যদেব ‘তাঁহাই হইবে’ বলিয়া কুন্তীর সহিত সহবাস-বাসনায় তাঁহার নাভি স্পর্শ করিবামাত্র তিনি তদীয় তেজঃপ্রভাবে বিচেতনা হইয়া শয্যাতলে নিপতিত হইলেন। অনন্তর সূৰ্য্যদেব কহিলেন, “হে সুশ্রোণি! তবে আমি এক্ষণে তোমার পুত্রোৎপাদনে প্রবৃত্ত হই; সত্য কহিতেছি, তোমার সেই পুত্র সর্ব্বপ্রকার অস্ত্রশস্ত্রকোবিদ হইবে এবং তুমিও পুনরায় স্বীয় কন্যাকাবস্থা প্রাপ্ত হইবে।”

কুক্তিভোজনন্দিনী সূৰ্য্যকে অভীষ্টসাধনে তৎপর দেখিয়া লজ্জানম্রমুখে তাঁহার বাক্যে অনুমোদনপূর্ব্বক লতার ন্যায় সেই পবিত্ৰ শয়নীয়ে শয়ান রহিলেন। তখন ভগবান সহস্ৰকিরণ স্বীয় তেজঃপ্রভাবে কুন্তীকে মোহিত করিয়া যোগবলে তাঁহার গর্ভাধান করিলেন; কিন্তু কুন্তীর কুমারীত্ব অক্ষুন্ন রহিল। অনন্তর সূৰ্য্য তথা হইতে প্ৰস্থান করিলে পর কুন্তী সচেতন হইলেন।