৩০৬. জীবজীবাত্মার উৎপত্তিগত স্থূলসূক্ষ্মকারণ

৩০৬তম অধ্যায়

জীবজীবাত্মার উৎপত্তিগত স্থূলসূক্ষ্মকারণ

“জনক কহিলেন, ‘ভগবন্! প্রকৃতির সহিত পুরুষের যেরূপ সম্বন্ধ কীৰ্ত্তিত হইল, স্ত্রী-পুরুষের সম্বন্ধও তদ্রূপ। পুরুষ ব্যতীত স্ত্রীজাতিরা গর্ভধারণ করিতে পারে না এবং স্ত্রীজাতি ব্যতীত পুরুষেরাও কখন পুত্রোৎপাদন করিতে সমর্থ হয় না। ঋতুকাল্পে স্ত্রী ও পুরুষের পরস্পর সহযোগনিবন্ধন সন্তানসন্ততি সমুৎপন্ন হয়। বেদ এবং স্মৃতি প্রভৃতি শাস্ত্রে নির্দ্দিষ্ট আছে যে, পিতা হইতে অস্থি, স্নায়ু ও মজ্জা এবং মাতা হইতে ত্বক, মাংস ও শোণিত সমুৎপন্ন হইয়া থাকে। বেদ ও স্মৃতি প্রভৃতি শাস্ত্রে যাহা কথিত হইয়াছে, তাহাই সনাতন প্রমাণ, সন্দেহ নাই। যাহা হউক, যদি প্রকৃতি ও পুরুষ ইহারাও স্ত্রীপুরুষের ন্যায় পরস্পর গুণসাপেক্ষ হইয়া নিয়ত পরস্পর বদ্ধ রহিল, তাহা হইলে মোক্ষ কিরূপে বিদ্যমান থাকিবে? হে ভগবন্! আপনি প্রত্যক্ষদর্শী, অতএব যদি মোক্ষের অস্তিত্ব-বিষয়ে কোন বিশেষ প্রমাণ থাকে, তাহা হইলে তাহার যথার্থ তত্ত্ব কীৰ্ত্তন করুন। আমি মোক্ষাভিলাষী; যিনি নির্ব্বিকার, নিরাকার, ইন্দ্রিয়ের অগোচর, অজর, নিত্য ও সর্ব্বশ্রেষ্ঠ, তাঁহাকে লাভ করাই আমার উদ্দেশ্য।’

‘বশিষ্ঠ কহিলেন, মহারাজ! তুমি বেদ ও শাস্ত্রের কথা যাহা কীৰ্ত্তন করিলে, তাহা ঐরূপই বটে, কিন্তু উহার যথার্থ তাৎপর্য্য গ্রহণে সমর্থ হও নাই। তুমি বেদ ও স্মৃতি প্রভৃতি শাস্ত্র অভ্যাস করিয়াছ; কিন্তু উহাতে তোমার কোন ফলোদয় হয় নাই। যাহারা গ্রন্থ অভ্যাস করিতে তৎপর হয়, কিন্তু গ্রন্থের যথার্থ তাৎপৰ্য্য গ্রহণ করিতে পারে না, তাহাদিগের সে অভ্যাস করা পণ্ডশ্রম মাত্র। উহারা কেবল শাস্ত্রের ভার বহন করিয়া থাকে। কিন্তু যাহারা গ্রন্থের যথার্থ তত্ত্ব অবগত হইতে সমর্থ হয় এবং প্রশ্ন করিলে অনুরূপ প্রত্যুত্তর প্রদান করিতে পারে, তাহাদিগেরই পরিশ্রম সার্থক। যে স্থূলবুদ্ধি ব্যক্তি বিদ্বানদিগের সভামধ্যে গ্রন্থের অর্থ কীৰ্ত্তন না করে, সে কখনই গ্রন্থের ফলিতাৰ্থ অবগত হইতে সমর্থ হয় না। জ্ঞানহীন ব্যক্তি জিতেন্দ্রিয় হইলেও তাহাকে সভামধ্যে স্বমতকীৰ্ত্তনসময়ে উপহাসাস্পদ হইতে হয়।

যাহা হউক, এক্ষণে সাঙ্খ্য ও যোগমতে যেরূপ যথার্থ তত্ত্ব, নিরূপিত হইয়াছে, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। যোগীরা যোগবলে যাঁহাকে দর্শন করিয়া থাকেন, সাঙ্খ্যমতাবলম্বীরা তাঁহাকেই প্রাপ্ত হয়েন। অতএব যাঁহারা সাঙ্খ্য ও যোগমতকে একরূপ বলিয়া জ্ঞান করেন, তাঁহারাই যথার্থ বুদ্ধিমান। মনুষ্যদেহে ত্বক, মাংস, রুধির, মেদ, পিত্ত, মজ্জা, স্নায়ু ও ইন্দ্রিয়সমুদয় বিদ্যমান রহিয়াছে। যেমন বীজ হইতে বীজের উৎপত্তি হয়, তদ্রপ ত্বগাদি হইতে ত্বগাদির, ইন্দ্রিয় হইতে ইন্দ্রিয়ের এবং দেহ হইতে দেহের উৎপত্তি হইয়া থাকে। পরমপুরুষের বীজ, ইন্দ্রিয়, দ্রব্য বা দেহ নাই; সুতরাং গুণ থাকিবার সম্ভাবনা কি? আকাশাদি বিষয়সমুদয় যেমন ত্বগাদি গুণ হইতে সমুৎপন্ন হইয়া ঐ সমুদয়ে বিলীন হয়, তদ্রূপ ত্বগাদি-গুণসমুদয় প্রকৃতি হইতে সমুৎপন্ন হইয়া আবার উহাতেই লয় প্রাপ্ত হইয়া থাকে। যেমন কখন কখন কেবল শুক্র হইতেই ত্বক্‌, মাংস, রুধির, মেদ, পিত্ত, মজ্জা, অস্থি ও স্নায়ুযুক্ত দেহ সমুৎপন্ন হয়, তদ্রূপ কেবল প্রকৃতি হইতেই জগতের সৃষ্টি হইয়া থাকে।

‘জীবাত্মা ও জগৎ সত্ত্বাদি-গুণত্রয়ে লিপ্ত হইয়া আছে। পরমাত্মা জীবাত্মাও জগৎ হইতে পৃথক। যেমন ঋতুসমুদয় মূৰ্ত্তিবিহীন হইয়াও ফলপুস্পদ্বারা অনুমিত হয়, তদ্রূপ প্রকৃতি আকৃতিশূন্য হইয়াও আত্মসম্ভূত মহদাদি-গুণদ্বারা অনুমানগোচর হইয়া থাকে; সেইরূপ কেবল দেহস্থ চৈতন্যদ্বারাই হর্ষবিষাদাদি বিকারশূন্য, চতুর্ব্বিংশতিতত্ত্বাতীত, নির্ম্মল পরমাত্মার অনুমান করা যায়। আদ্যন্তশূন্য, সমদর্শী, নিরাময় আত্মা কেবল দেহাদির অভিমানবশতঃই সগুণ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকেন। যাঁহারা সগুণ পদার্থের সহিত গুণের সম্বন্ধ আছে, কিন্তু নির্গুণ পদার্থের সহিত গুণের কোন সম্পর্ক নাই বলিয়া স্বীকার করেন, তাঁহাদিগকেই যথার্থ গুণদশী বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে। জীবাত্মা কামাদি-প্রাকৃতিক গুণসমুদয়কে জয় করিতে পারিলেই দেহাভিমান পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পরমাত্মার দর্শনলাভে সমর্থ হয়। সাঙ্খ্য ও যোগবিদ মহাত্মারা অহঙ্কারাদি পরিত্যাগ করিয়া সেই সর্ব্বান্তর্য্যামী, সৰ্ব্বস্রষ্টা, চতুর্ব্বিংশতিতত্ত্বাতীত পরব্রহ্মকে পরিজ্ঞাত হইয়া থাকেন। জন্মমরণভীরু জ্ঞানিগণ সেই অব্যক্ত পরমাত্মাকে পরিজ্ঞাত হইতে পারিলেই তাঁহাকে জীবাত্মা হইতে অভিন্ন বলিয়া বিবেচনা করিতে পারেন। জ্ঞানবান পণ্ডিতদিগের জীবাত্মা ও পরমাত্মাতে কিছুমাত্র ভেদজ্ঞান থাকে না; অনভিজ্ঞ লোকেরাই জীবাত্মাকে পরমাত্মা হইতে পৃথক বলিয়া বোধ করে। ফলতঃ একরূপে প্রতীয়মান পরমাত্মা অক্ষর ও নানারূপে প্রতীয়মান জগৎ ক্ষর বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে। জ্ঞানবান ব্যক্তি পঞ্চবিংশ জীবতত্ত্বের পর্য্যালোচনায় প্রবৃত্ত হইলেই পঞ্চবিংশতিতত্ত্বাতীত ষড়বিংশ পরমাত্মাকে জীবাত্মা হইতে অভিন্ন বলিয়া তাঁহার বোধ জন্মে। ঐরূপ বোধ জন্মিলেই তিনি পরমাত্মার একরূপে দর্শনকেই শাস্ত্র ও নানারূপে দর্শনকে অশাস্ত্র বলিয়া বিবেচনা করেন। এই আমি তোমার নিকট সমুদয় তত্ত্ব ও পরমাত্মার বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম। পণ্ডিতেরা পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকৰ্ম্মেন্দ্রিয়, পঞ্চভূত, শব্দাদি পঞ্চ বিষয় এবং মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার, প্রকৃতি ও জীবাত্মা এই পঞ্চবিংশতি তত্ত্বকে সৃষ্ট পদার্থ এবং এই সমুদয় হইতে পৃথক্ ষড়বিংশ পদার্থকেই পরমাত্মা বলিয়া নিরূপণ করিয়া গিয়াছেন।”