৩০৪তম অধ্যায়
জীবাত্মার গুণগত দেহধারণ—বিবিধ অবস্থা
“বশিষ্ঠ কহিলেন, ‘হে রাজর্ষে! এইরূপে জীবাত্মা প্রকৃতি সঙ্গবশতঃ মুগ্ধ ও অজ্ঞানের অনুবর্ত্তী হইয়া অসংখ্য দেহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অসংখ্য দেহ আশ্রয় করিতেছেন। তাহার তমোগুণপ্রভাবে তিৰ্য্যগুযোনি, রজোগুণপ্রভাবে মনুষ্যযোনি ও সত্ত্বগুণপ্রভাবে দেবযোনি, লাভ হইয়া থাকে। তিনি কখন পুণ্যবশতঃ মনুষ্যলোক হইতে স্বর্গে আরোহণ, কখন পুণ্যয়নিবন্ধন দেবলোক হইতে মনুষ্যলোকে অবতরণ, কখন বা পাপবশতঃ মনুষ্যলোক হইতে নরকে গমন করেন। কোশকার কীট যেমন মুখলালসম্ভূত তন্তু দ্বারা আপনাকে সমাচ্ছন্ন করিয়া রুদ্ধ হয়, তদ্রূপ গুণাতীত জীব সৰ্ব্বদা গুণোদ্ভূত কাৰ্য্যদ্বারা আপনাকে রুদ্ধ করিয়া রাখে এবং সুখদুঃখহীন হইয়াও বিবিধ যোনিতে জন্মগ্রহণপূৰ্ব্বক সুখদুঃখ ভোগ করিয়া থাকে।
‘মস্তকবোগ, নেত্ররোগ, দন্তশূল, গলগ্রহ [গণ্ডগ্রন্থি—গলার গেরো পড়ার মত রোগ], জলোদর [উদরী], তৃষারোগ, গলগণ্ড, বিসূচিকা, শ্বিত্র [শ্বেতকুষ্ঠ-শ্বেতী], কুষ্ঠ, অগ্নিদাহজনিত ক্ষত ও অপর প্রভৃতি যেসমুদয় রোগ প্রাণীগণের দেহে উৎপন্ন হয়, জীব আপনাকে সেইসমুদয় রোগে আক্রান্ত বলিয়া জ্ঞান করে এবং কখন অধোদেশে, কখন অনাবৃতস্থানে, কখন ইষ্টকময় গৃহে, কখন কণ্টকাকীর্ণ প্রস্তরে, কখন ভস্মাচ্ছাদিত প্রস্তরে, কখন ভূমিতলে, কখন পঙ্কে, কখন ফলকে ও কখন বিচিত্র শয্যায় শয়ন; কখন, শুক্লবস্ত্র, কখন কৌপীন, কখন ক্ষৌমবস্ত্র, কখন কৃষ্ণাজিন, কখন ব্যাঘ্রচর্ম্ম, কখন সিংহচৰ্ম্ম, কখন ভূর্জ্জত্বক [ভূর্জ্জপত্র], কখন কন্টকময় [শিমূলতূলাজাত] বস্ত্র, কখন পট্টবস্ত্র ও কখন চীর পরিধান; কখন রত্নধারণ করিয়া, কখন বা দিগম্বর হইয়া পরিভ্রমণ; কখন একরাত্রির অন্তে, কখন দিবারাত্রির মধ্যে এককালে, কখন দিবসের চতুর্থ, অষ্টম বা ষষ্ঠভাগে, কখন ছয় দিন, সপ্তাহ, অষ্টাহ, দশাহ, দ্বাদশাহ বা এক মাসের অন্তে ভোজন; কখন সিদ্ধিলাভের নিমিত্ত ফল, মূল, বায়ু, জল, তিলক, দধি, গোময়, গোমূত্র, শাকপুষ্প, শৈবাল, ভক্তমণ্ড[ভাতের মণ্ড] বা শীর্ণপত্র ভক্ষণ; কখন বিধিবিহিত চান্দ্রায়ণব্রত, কখন চারি আশ্রমের ধৰ্ম্ম, কখন পাষণ্ডপথ অবলম্বন; কখন পৰ্ব্বতের ছায়াযুক্ত নির্জ্জন প্রদেশে, কখন প্রস্রবণে, কখন গুহায়, কখন জলশূন্য নদীতটে, কখন নির্জ্জনবনে, কখন পবিত্র দেবস্থানে ও কখন সরোবরে অবস্থান, কখন বিবিধ জপ্য মন্ত্র জপ, কখন ব্ৰতানুষ্ঠান, কখন নিয়মানুষ্ঠান, কখন তপানুষ্ঠান ও কখন যজ্ঞানুষ্ঠান; কখন বাণিজ্য, কখন ব্রাহ্মণ-ধৰ্ম্ম, কখন ক্ষাত্ৰধৰ্ম্ম, কখন বৈশ্যধৰ্ম্ম ও কখন শূদ্ৰধৰ্ম্ম আশ্রয়; কখন বা দীন, দরিদ্র ও অন্ধদিগকে দান; কখন সত্ত্বগুণ, কখন রজোগুণ, কখন বা তমোগুণ অবলম্বন; কখন ধৰ্ম্ম, কখন অর্থ, কখন কামের আশ্রয় গ্রহণ; কখন স্বধাকার, কখন বষট্কার, কখন স্বাহাকার, কখন বা নমস্কার সম্পাদন; কখন যজন, কখন যাজন, কখন অধ্যয়ন, কখন অধ্যাপনা, কখন দান ও কখন প্রতিগ্রহ এবং কখন জন্মগ্রহণ; কখন মৃত্যুলাভ, কখন বিবাদ ও কখন সংগ্রামকাৰ্য্য সম্পাদনপূৰ্ব্বক অভিযান করিয়া থাকেন। পণ্ডিতেরা এই সমস্ত শুভাশুভ কার্য্যকলাপকে কৰ্ম্মপথ বলিয়া নিরূপণ করিয়া গিয়াছেন।
‘প্রকৃতি হইতেই সমুদয় জগতের সৃষ্টি ও প্রলয়কাৰ্য্য সম্পাদিত হইতেছে। দিবাকর অস্তগমনকালে স্বীয় কিরণজাল সংহার করিয়া উদয়কালে যেমন পুনরায় উহা প্রসারণ করেন, তদ্রূপ জগদীশ্বর প্রলয়কালে গুণসমুদয় সংহার করিয়া একাকী অবস্থানপূর্ব্বক সৃষ্টিকালে পুনরায় অতি মনোরম বিবিধ গুণের সৃষ্টি করিয়া থাকেন। বারংবার এইরূপ জগতের সৃষ্টি ও সংহার করা তাঁহার ক্রীড়ামাত্র। তিনি ত্রিগুণাতীত হইয়াও সৃষ্টিস্থিতি প্রলয়কারিণী ত্রিগুণা প্রকৃতিকে সৃষ্টি করিয়া তাঁহার সহিত অভিন্নভাবে অবস্থান করেন। প্রকৃতিপ্রভাবেই এই জগৎ মুগ্ধ ও সৰ্ব্বদা সুখদুঃখে সমাচ্ছন্ন রহিয়াছে।
প্রকৃতির প্রভাবে মানুষের কল্পনার উদয়
মনুষ্যগণ নির্বুদ্ধিতাপ্রভাবেই “এই সমুদয় দুঃখ আমার নিমিত্ত হইয়াছে, ঐ সমুদয় আমাকেই লক্ষ্য করিয়া ধাবমান হইতেছে, আমি এই সমুদয় অতিক্রমপূর্ব্বক দেবলোকে গমন করিয়া তত্রত্য সুখভোগ করিব, ইহলোকের এই শুভাশুভ ফলসমুদয় আমাকেই ভোগ করিতে হইবে, যাহাতে সুখোদয় হয়, আমার তাহারই অনুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য, আমি সকল জন্মেই সুখী হইব, আমাকে স্বকাৰ্য্যপ্রভাবেই ইহলোকে অপরিসীম দুঃখভোগ করিতে হইবে, মনুষ্যত্ব মহাদুঃখের কারণ, মনুষ্যত্বনিবন্ধন নরকগামী হইতে হয়, আমি নরক হইতে মনুষ্যত্ব ও মনুষ্যত্ব হইতে দেবত্ব প্রাপ্ত হইব এবং পুনরায় দেবত্ব হইতে মনুষ্যত্ব ও মনুষ্যত্ব হইতে নরক লাভ করিব” বলিয়া বিবেচনা করে।
‘যাহারা দেহকে আত্মস্বরূপ জ্ঞান করে, সেই সকল মমতাপরিপূর্ণ মূঢ়কে বারংবার দেবতা, মনুষ্য ও তির্য্যগযোনিতে জন্মগ্রহণ এবং নিরন্তর সেই সেই যোনিতে পরিভ্রমণ করিতে হয়। এইরূপে জীবগণ অসংখ্যবার জন্মগ্রহণ ও মৃত্যুলাভ করিতেছে। যে যেরূপ পুণ্য ও পাপজনক কার্য্যের অনুষ্ঠান করে, তাহাকে তদনুরূপ দেহধারণপূৰ্ব্বক তৎসমুদয়ের ফলভোগ করিতে হয়। এই ত্রিলোকমধ্যে প্রকৃতিই শুভাশুভ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান ও তাহার ফলভোগ করিতেছে।
‘তিৰ্য্যকলোক, মনুষ্যলোক ও দেবলোক এই তিন লোকই প্রকৃতির কার্য্য। প্রকৃতির যেমন কোন চিহ্ন নাই, কেবল মহদাদি কাৰ্য্যদ্বারা উহার অনুমান করা যায়, তদ্রূপ পুরুষেরও কোন চিহ্ন নাই, কেবল দেহের চৈতন্যদ্বারা উহার সত্তা স্বীকার করা গিয়া থাকে। পুরুষ নির্ব্বিকার ও প্রকৃতি প্রবর্ত্তক হইয়াও শরীর ধারণপূৰ্ব্বক ইন্দ্রিয়কৃত কর্ম্মসমুদয়কে আত্মকৃত বলিয়া জ্ঞান করে। শ্রোত্রাদি জ্ঞানেন্দ্রিয় ও বাগাদি কৰ্ম্মেন্দ্রিয়সমুদয় সত্ত্বাদি গুণসহযোগে বিবিধ বিষয়ে প্রবর্ত্তিত হইয়া থাকে। নির্ব্বোধ ব্যক্তিরা ছিদ্রবিহীন হইয়াও আপনাদিগকে ছিদ্রবান, দেহশূন্য হইয়াও দেহবান, কালের বশীভূত না হইয়াও কালের বশীভূত, বুদ্ধিমান না হইয়াও বুদ্ধিমান, তত্ত্বজ্ঞানহীন হইয়াও মৃত্যুগ্রস্ত, অচল হইয়াও সচল, জন্মবিহীন হইয়াও জন্মযুক্ত, তপোবিহীন হইয়াও তপস্বী, গতিবিহীন হইয়াও গমনযুক্ত, নির্ভীক হইয়াও ভীত এবং অক্ষর হইয়াও ক্ষর বলিয়া বোধ করে।’ ”