গানের আসর
বৃষ্টিটা হঠাৎ থেমে গেল। বাতাসও বন্ধ হল। কিন্তু গাছপালা থেকে টুপটাপ জল পড়ার শব্দ ধারাবাহিক। কখনও কোনো পাখির ডানাঝড়া এবং নড়ে বসার আচমকা ঝরঝর শব্দে চমক ছিল। ব্ৰজহরিই শুধু বলে উঠেছিল, কিসের শব্দ? কেউ জবাব দেয়নি। হয়তো চুল্লুর প্রেতাত্মা! তারপর ধীরে জেগে উঠল পোকামাকড়ের ডাকাডাকির শব্দ।
চাক্কু অন্ধকারে উঠে দাঁড়ালে বংকুবিহারী টের পেলেন। বললেন, কে?
আমি।
বংকুবিহারী ধমক দিলেন, আমি কে?
আজ্ঞে, আমি! চাক্কু মরিয়া হয়ে বলল। শিবপদ!
ঘনশ্যাম, ব্ৰজহরি, প্রদোষ চমকানো স্বরে বলে উঠলেন, কে, কে?
হরিপদ বাউল হাসল। …তাহলে আরেকজন পাওয়া গেল। কী করে এলে গো? কখন এলে? জানতেও তো পারিনি। সাড়াশব্দ দিয়ে আসবে তো?
ক্লারা বলে দিল, নতুন লোক নয়। ও রিকশাচালক।
বংকুবিহারী হ্যা হ্যা করে হাসলেন। …ও! চাক্কু! তা শিবপদ-টদ করচিস কেন বাবা? আর যাচ্ছিসটা কোথায়?
চাক্কু বলল, ঘুম পাচ্ছে। ও ঘরে সতরঞ্জি আছে। ঘুমুতে চললাম দারোগাবাবু!
বংকুবিহারী বললেন, যাসনে ছাদ চাপা পড়তে। চুপচাপ বসে থাক এখানে।
পুঁতি চাপাস্বরে বলল, মরণপাখা উঠেছে! ছটফটিয়ে বেড়াচ্ছে।
চাক্কু গ্রাহ্য করল না। পাশের ঘরটাতে গিয়ে ঢুকল। ঢুকেই চমক-খাওয়া স্বরে বলল, কে, কে?
বারান্দায় সাড়া পড়ে গেল। বংকুবিহারী ব্যস্তভাবে বললেন, কর্নেল! কর্নেল! টর্চ, টর্চ! ব্ৰজহরি, ঘনশ্যাম। প্রদোষ, হরিপদ একগলায় আলো, আলো রব তুললেন। তারপর পাশের ঘর থেকে শাওনির সাড়া পাওয়া গেল। …হাবাতে মিনসেরা! এইটুকুতেই অস্থির! গলায় ইট ঢুকিয়ে দেবে চুল্ল! থামো সব– একটু দাঁড়াও না!
ক্লান্তি, উদ্বেগ, বন্যার জল ওঠার এবং চুল্লুর আতঙ্গ প্রগাঢ়। তাই সবাই চুপ করে গেল। চাক্কু দ্রুত ফিরে এল। এটা পুঁতির ভাল লেগেছে। সে আস্তে বলল, শোবে তো এখানেই লুঙ্গি বিছিয়ে শোও! চাক্কু মেনে নিল।
বংকুবিহারী ডাকলেন, শাওনি!
শাওনির গলা ভেঙে গেছে। বিকৃত শোনাল। …কী?
তুই যে পেত্নী হয়ে গেলি রে! আঁ? আইনরক্ষক হাসলেন। ডোঙা খুঁজে পেলি?
পাবার সময় হলে ঠিকই পাব।
খুলে বল না বাবা!
আপনাকে বলে কী লাভ? শাওনি গলার ভেতর বলল। মিনসেরা আমার খোয়ার করল, তখন তো কই আটকাতে এলেন না? আমি মানুষ তো বটি। আমি যাও বলতাম, মরে গেলেও বলব না!
বংকুবিহারী বললেন, তুই খাওয়ার জলটা নষ্ট করে প্রচণ্ড অন্যায় করেছিস!
ক্লারা বলে উঠল, নিশ্চয় সে ক্রোধবশত বলেছে। সত্যই এ কাজ সে করতে পারে না।
ব্ৰজহরি বললেন, হোয়াই ডু উই ফরগেট ম্যাডাম, সি ইজ এ প্রসটিট্রিট অ্যান্ড সি ক্যান ডু এভরিথিং– এভরিথিং! সি অলওয়েজ ডাজ অল সর্টস অফ ন্যাস্টি থিংস! সি ইজ অ্যান এভিল ম্যাডাম!
ক্লারা রাগ করে বসে রইল। বংকুবিহারী ডাকলেন, কর্নেল!
কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। হরিপদ বলল, তখন যেন উঠে গেলেন মনে হল।
ব্ৰজহরি বললেন, ধুস! উঠে গেলেন অন্ধকারে হাতে টর্চ, জ্বাললেন না? এই তো ঘুমোচ্ছেন।
তার নাড়া খেয়ে ঘনশ্যাম বললেন, আমি, আমি!
প্রদোষ লাইটার জ্বেলে সিগারেট ধরাল। ক্ষণিক আলোয় দেখা গেল, কর্নেল নেই। বংকুবিহারী চড়া গলায় ডাকলেন, কর্নেল! কর্নেলসায়েব। সাড়া না পেয়ে চাপাস্বরে বললেন, এই লোকটির গতিবিধি সন্দেহজনক ঠেকছে। অবশ্য আমি নজর রেখেছি।
ব্ৰজহরি হাসবার চেষ্টা করে বললেন, বাইরে থেকে কিছু বোঝবার যো নেই। কে কী!
হরিপদ বলল, সেটাই তো কথা গো বাবারা, মায়েরা! বাইরে যিনি, ভেতরে তিনি না, অন্যজনা। ভেতরকার জনাই মূলাধার। সেজন্যেই তো গুরু বলেছেন : এই মানুষে সেই মানুষ আছেন বসে/ পেলে দেখা নাইকো রক্ষা ধরবি তাকে কষে/…
বংকুবিহারী বললেন, সুরে গাও হে! গলা ছেড়ে গাও!
সবাই সায় দিলেন। এই অন্ধকার দরগা, কবরখানা, ধ্বংসপ, জঙ্গল, বন্যার গ্রাস এবং প্রেতাত্মা চুল্লু দিয়ে তৈরি ভূখণ্ডে প্রকৃতির মুঠোয় ধরাপড়ার বিপন্নতা এই দুঃসময়! হরিপদ বাউলের গান জরুরি ছিল। একতারাটি পিড়িং পিড়িং করে দেয়ালে ঠেস দিয়ে সে সুর মেলাল– তা না না না রি রি রি গুরু গো, হায় গুরু-উ-উ-উ…
গানের মাঝমাঝি প্রাঙ্গণে টর্চ জ্বলল। সবাই দেখেও দেখল না। কর্নেল ফিরলেন। বারান্দায় এসে একপাশে চুপচাপ বসে পড়লেন। গান থামলে বংকুবিহারী বললেন, কী যে করে বেড়াচ্ছেন কর্নেলসায়েব! কখন চুপ করে বেরিয়ে যাচ্ছেন, কোথায় যাচ্ছেন!
কর্নেল বললেন, তালডোঙাটা খুঁজতে গিয়েছিলাম।
আবার হেঁয়ালি! বংকুবিহারী রাগ করে বললেন। কার তালডোঙা, কোথায় ছিল, তা বলবেন না! খালি তালডোঙা, তালডোঙা! শাওনিও বলছে তালভোঙা। ব্যাপারটা কী? আপনারা কেউ কি দেখেছেন?
ঘনশ্যাম বললেন, ডোঙাটোঙা আমি তো মশাই দেখিনি কোথাও। চক্কর মেরে ঘুরেছি। ডাক্তারবাবু দেখেছেন কি?
ব্ৰজহরি বললেন, নাঃ। প্রদোষ বলল, না। ক্লারা বলল, না। চাক্কু, পুঁতি, হরিপদ বলল, না। তখন কর্নেল বললেন, কিন্তু মনে রাখবেন, তালডোঙাটাই আপনাদের উদ্ধারের জন্য জরুরি।
বংকুবিহারী বললেন, সেটা অস্বীকার করছে কে? যদি সত্যি ওটা থেকে থাকে, সকাল হোক। খুঁজে দেখা যাবে।
ঘনশ্যাম বললেন, স্বপ্ন, স্বপ্ন!
ব্ৰজহরি দুঃখে হাসলেন। ঠিক বলেছেন! পিরবাবা আমাদের পরীক্ষা করছেন। মায়াডোঙা! একটা মায়াডোঙা দেখিয়ে আশার ছলনায় ভোলাচ্ছেন। এর কারণটা কি কেউ বুঝতে পেরেছেন? পারেননি। এই পবিত্র জায়গায় পাপের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আমাদের সাবধান হওয়া উচিত।
ক্লারা প্রশংসা করে বলল, ভারতীয়রা দার্শনিক। আমার প্রকৃত অভিজ্ঞতা হল। আপনি আরও বলুন।
বলল হরিপদ বাউল। একতারার বাজনায় এবং গানে।
‘মায়ারূপি জগৎ-সংসারে-এ-এ/গুরু, ভেল্কি লয়ে দেখাও খেলা আজ আমারে ॥‘
ঝোঁকের মাথায় অথবা আবেগে সে উঠে নাচতে নাচতে গাইতে লাগল। বংকুবিহারী শাবাশ, ভাল!…
.
প্রথম হত্যাকাণ্ড
একটার পর একটা গান গেয়ে-গেয়ে এবং নেচে ক্লান্ত হরিপদ যখন বসে পড়ল, তখন সবাই ঢুলছে এবং আইনরক্ষকের নাক ডাকছেও বটে। ক্লারা জেগে থাকার চেষ্টা করেও পারেনি। প্রদোষ অন্ধকারে তাকে টেনেছিল। সে ঘুমন্ত দেখে প্রদোষও চোখ বুজেছিল। মধ্যরাতে আবার টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে থাকল। হরিপদর গলা ভেঙে গিয়েছিল। ভাঙা গলায় জয়গুরু বলে সে মেঝেয় গড়িয়ে পড়েছে। বৃষ্টিটা এলে টর্চ জ্বেলে দেখে নিলেন প্রাঙ্গণে জল উঠেছে নাকি। ওঠেনি এবং বারান্দায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লোকগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে। অবাক লাগছিল এই ঘুম দেখে। প্রাঙ্গণে আস্তে আস্তে নেমে গেলেন কর্নেল। যেন কেউ ঘুম ভেঙে চমকে না ওঠে।
কর্নেল রেনকোট টুপি পরে আসলে লুল্লুকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। কোথাও তার পাত্তা নেই। নির্বোধ কুকুরটা কি তার তীক্ষ্ণ জৈব বোধের দরুন টের পেয়েছে এই ঢিবিটাও ডুবে যাবে এবং তাই মরিয়া হয়ে জলে সাঁতার কেটে পালাতে গেছে? কিন্তু তাহলে ওর নির্ঘাত মৃত্যু। চারদিকে দূরসুদূর মাঠ এখন সমুদ্র। হতভাগা কুকুরটা।
টর্চের আলো কমে এসেছে। ভাঙা দেউড়ির কাছে গিয়ে একটু দাঁড়ালেন। পেছনে হাত দশেক দূরে দরগাটা। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে কী একটা শব্দ কানে এল। আস্তে বললেন, কে?
অমনি আশেপাশে অন্ধকারে কয়েকটা ঢিল পড়ল। কর্নেল টর্চ জ্বেলে এগিয়ে গেলেন দরগর কাছে। চারপাশে খুঁজে কাউকে দেখতে পেলেন না। গাছের মাথায় একটা শব্দ হল। পাখির ডানা থেকে জল ঝাড়ারই শব্দ। তারপর আবার চড়বড় করে ঢিল পড়ল কয়েকটা। কর্নেল হাসতে হাসতে চাপাস্বরে বললেন, চুল্লু! আমি ভয় পাই না। কাজেই ভয় দেখানোর চেষ্টা কোরো না।
খি খি হাসি শোনা গেল। ঢং করে বেড়ানো হচ্ছে রাতদুপুরে!
শাওনি! কর্নেল চর্চ নিভিয়ে দিলেন।
শাওনি দরগার ওধার থেকে বেরিয়ে এল। বুড়োসায়েব কী খুঁজে বেড়াচ্ছে। তখন থেকে? সে হিসহিস করে বলল। তালডোঙাটা তো? নেই। যে এসেছিল, সে নিয়ে গেছে। নৈলে আম্মো কি পড়ে থাকতাম এই ভাগাড়ে?
কর্নেল বললেন, তুমি কি লুল্লুকে দেখেছ, শাওনি?
কাকে?
লুল্লু কুকুরটা। দেখেছ ওকে?
শাওনি একটু চুপ করে থাকার পর শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, দেখেছি। বটতলায় পড়ে আছে।
পড়ে আছে মানে?
চুল্লুকে বিরক্ত করছিল। চুল্লু ছাড়বে কেন? পেঁচিয়ে গলা কেটেছে মনে হল। বিজলির ছটায় রক্ত দেখলাম।
কর্নেল শক্ত হয়ে বললেন, হুঁ। কখন দেখেছ?
সন্ধেবেলায় যখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল।
চলো, দেখিয়ে দাও।
আবার একটু চুপ করে থাকার পর বারবধূ আস্তে বলল, সকালে দেখবেন। চুল্লু রেগে আছে। শুয়ে পড়ুন গে যদি বাঁচতে চান। বলে ফিসফিস করে উঠল ফের, আপনাকে সতর্ক করতে এসেছিলাম। আর বেরুবেন না এমন করে।
সে দ্রুত চলে গেল আস্তানাঘরের দিকে। কিন্তু ভোলা প্রাঙ্গণ হয়ে নয়, বাঁদিকের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গেল। কর্নেল পকেট থেকে এতক্ষণে রিভলবার বের করলেন। টর্চের আলো ক্রমশ লালচে হয়ে আসছে। জ্বেলে লাভ নেই। বরং অন্ধকারে দৃষ্টি পরিষ্কার হবে। বিদ্যুতের ঝিলিকে জঙ্গলের ভেতরটাও ঝলসে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। ফাঁকা জায়গা বেছে বেছে নজর রেখে বটতলার দিকে দক্ষিণে এগিয়ে গেলেন। জল উঠে এসেছে বটতলায়। সাপটির কথা মনে পড়ায় টর্চ জ্বাললেন সঙ্গে সঙ্গে। তারপর দেখলেন বটের কোটরের নিচের দিকে জলে দুলছে কুকুরটার মৃতদেহ। গলা ফাঁক। রক্ত ধুয়ে গেছে কখন। কর্নেল দেখেই সরে এলেন।…
.
দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ড
কোথাও একটা খুট খুট শব্দ এবং ক্লারা তাকাল। বুঝল সে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। দেখল ভোর হয়ে গেছে। তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে অন্ধ দরবেশ তাঁর ঘরের শেকলে তালা আঁটছেন। ক্লারা বলল, সুপ্রভাত। দরবেশ জবাব দিলেন না। ঘুরে পা বাড়িয়ে লম্বা চিমটেটি দিয়ে সামনের মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে হেঁটে চললেন। বর্গাকৃতি চওড়া বারান্দায় দেয়াল ঘেঁষে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। লোকগুলো ক্লারা দরবেশের ঘরের দরজার পাশে কোণের দিকে এবং প্রদোষ পাশেই পা ছড়িয়ে চিত হয়ে ঘুমোচ্ছে। তার পায়ের কাছে পাশের সেই ঘরটার দরজা। সেখানে চৌকাঠে ব্যাগ রেখে মাথা দিয়েছে হরিপদ বাউল, বুকের ওপর একতারা। তার পাশেই ডাক্তার ব্ৰজহরি কুণ্ডু কাত হয়ে শুয়েছেন। উল্টোদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছেন কর্নেল, গায়ে রেনকোট, মাথাটি বুকের ওপর ঝুলন্ত এবং টুপিতে মুখ ঢাকা। তাঁর পাশে ঘনশ্যাম ওরফে হর্ষনাথ কুঁকড়ে শুয়ে আছেন। বংকুবিহারী ঠিক মাঝখানে। কিন্তু চাক্কু ও পুঁতি নেই। ক্লারা একটু অবাক হল। দরবেশ চিমটে বাড়িয়ে দারোগাবাবুকে ছুঁয়ে পাশ কাটিয়ে প্রাঙ্গণে নামলেন। দারোগাবাবুর প্রচণ্ড নাক ডাকছে। দরবেশ প্রাঙ্গণে চক্ষুষ্মন মানুষের মতো হেঁটে দরগার কাছে গেলে ক্লারা বুঝতে পারল, এখানকার প্রতি ইঞ্চি মাটি ওঁর জানা।
ক্লারা চাক্কু ও পুঁতিকে খুঁজতে বসে থাকা অবস্থায় হরিপদর মাথার পাশ দিয়ে পাশের ঘরটার ভেতর উঁকি দিল। দেখল পুঁতি ঘুরে কাত হয়ে শুয়ে
আছে এবং চাক্কু চিত। শালীনতাবশে ক্লারা সরে এল। তারপর মনে পড়ল। শাওনির কথা। সঙ্গে সঙ্গে কোনায় তার ও প্রদোষের মাথার কাছে রাখা কিটব্যাগ, সুটকেস দেখে নিল। ব্লাউজের ভেতর হাত রেখে তার ছোট্ট পাসটাও আছে দেখে নিশ্চিন্ত হল। কিন্তু শাওনি নেই। সে কোথায় থাকতে পারে বুঝতে পারল না ক্লারা। নাকি সাঁতার কেটে চলে গেছে? দুঃখিত মনে ক্লারা উঠল। শাড়িটা গুছিয়ে পরল। মনে পড়ল, সেবার নভেম্বরে ক্যালিফর্নিয়ার ইওনিসিটি ন্যাশনাল পার্কে পাহাড়ে ট্রেকিং করতে গিয়ে ক্লিভল্যান্ড পাসের ওধারে আটকে গিয়ে চার বন্ধুর জীবনমরণ অবস্থা ঘটেছিল। তবে ওদের সঙ্গে ক্যাম্প এবং স্লিপিং ব্যাগ ছিল। রেডিও-ট্রান্সমিটার ছিল। ফিনিক্স থেকে একটা লোক নিজের হেলিকপ্টারে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। কিন্তু এটা ভারত নামে দেশ। এখানে সবই অন্যরকম, বিরক্তিকর হলেও রহস্যময় সারা রাত যা সব টের পেয়েছে, ফিসফিস কথাবার্তা অথবা জলের শব্দ, বাতাসের শব্দ, পোকামাকড়ের শব্দ মিশে ওইরকম মনে হচ্ছিল। কারা বা কেউ চলাফেরা করে বেড়াচ্ছিল কোথাও। এবং চুল্লু!
ক্লারা প্রাঙ্গণে মেনে চুল্লুর নিদর্শন খোঁজার জন্য এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছিল। দরবেশ দরগার ওপাশে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করছেন চোখে পড়ল। চোখে কালো চশমা। কালো আলখেল্লা। সত্যিই কি চুল্লু নামে কোনো অশরীরী প্রেতাত্মা দরবেশের অনুগত ভৃত্য? ক্লারা কয়েক পা এগিয়ে গেল। প্রাঙ্গণের ওপর আকাশ নির্মেঘ। লাইমকংক্রিটের একটুকরো ভিজে চত্বরে দরবেশ হাঁটু দুমড়ে বসে প্রর্থনা করছিলেন। ক্লারা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। রহস্যময় পুরুষ।
রহস্যময় পুরুষটি বুকে চিমটেটি ঝুনঝুন শব্দে ঠুকতে শুরু করলেন। তারপর বললেন, চুল্লু! ক্লারা চমকে উঠল। কারণ সঙ্গে সঙ্গে বটগাছের ওদিকে কোথাও কী একটা পাখি ডানা ঝটপট করে এসে বসল অথবা উড়ে গেল। ক্লারা একটু ভয় পেল। ভিজে জঙ্গলের ভেতর এখনও প্রচুর অন্ধকার জড়িয়ে আছে। তার চারদিক ঘিরে তাকে ফাঁদে ফেলার জন্য অসংখ্যাসংখ্য চুল্ল বুঝি ওতে পেতে আছে। নিজের অলক্ষে ক্লারা বুকে ক্রশ আঁকার ভঙ্গি করেই টের পেল, অভ্যাস! ননদিনীর শেখানো রামনাম বিড়বিড় করে উচ্চারণ করতে করতে ক্লারা বারান্দায় পৌঁছুল। লোকগুলিকে এবং প্রদোষকে দেখে তার সাহস ফিরে এল। তারপর আইনরক্ষক এবং তার কোমরে খাপে ভরা আগ্নেয়াস্ত্রটি দেখে ক্লারা নিজের ভয়পাওয়াটাকে মনে মনে তিরস্কার করল। এই তো সে দেখতে চেয়েছিল, পৌঁছুতে চেয়েছিল এরকম যথার্থ আদিমতায়, প্রকৃতির অভ্যন্তরে– যেখানে প্রেতাত্মা ও সন্তপুরুষ, সাপ এবং ডাইনি ক্ষিদে এবং মৃত্যুর কারুকার্য। এই তো সেই প্রাচ্যদেশীয় গভীরতা! পাপ-পুণ্য আলো-অন্ধকার জীবন-মৃত্যুর রহস্যলোক।
ক্লারা একটু হাসল। ঘুমন্ত লোকগুলির দিকে তাকাল। বংকুবিহারীর নাক ডাকা দেখে ক্লারা নিঃশব্দে হাসতে লাগল। তারপরই তার চোখ গেল আইনরক্ষকের মাথার দিকে মেঝেয় পোঁতা জলের জালাটির দিকে। জালাটির মাথায় ঢাকনা চাপানো এবং মেঝে থেকে ইঞ্চি চারেক উঁচু জালাটির কিনারা। ঠিক তারই পেছনে দেয়ালের কোনায় কালো কী একটা জড়ানো পেঁচানো জিনিস। দৃষ্টিস্বচ্ছ ক্লারা চিত্রবিচিত্র একটি কুণ্ডলীপাকানো সাপকে আবিষ্কার করল এবং মাতৃভাষায় চেঁচিয়ে উঠল।
প্রথমে টুপি সরিয়ে কর্নেল সাড়া দিলেন, কী হয়েছে ডার্লিং?
সাপ! সাপ! প্রকৃত একটি সাপ।
কোথায়?
পুলিশমহাশয়ের মাথার কাছে। আপনি লক্ষ্য করুন, দেখুন। ওই যে, ওই সাপটি।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে সাপটিকে দেখে বললেন, বিষাক্ত মনে হচ্ছে। তবে কালকের সেই সাপটা নয়। এটার দিশি নাম বাঁকরাজ।
বাউল হরিপদ তড়াক করে উঠে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিল। বলল, কী হয়েছে গুরু?
কর্নেল ঝুঁকে ঘুমন্ত বংকুবিহারীর জুতোসুদ্ধ পাদুটো ধরে হাঁচকা টানে সরিয়ে আনলেন। অমনি বংকুবিহারী তড়াক করে উঠে কোন ব্যাটারে বলে রিভলবার বের করলেন। ওদিকে ক্লারা প্রদোষকেও টেনেছে নিরাপদ দূরত্বে এবং প্রদোষও লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। এসবের ফলে ঘনশ্যাম ও ব্রজহরি জেগে গেলেন। হরিপদ চেঁচিয়ে উঠল, সাপ! সাপ! পাশের ঘর থেকে পুঁতি ও চাক্কু উঠে এসে উঁকি দিল দরজায়।
কুণ্ডলীপাকানো বাঁকরাজ সাপটি এবার লম্বা হওয়ার চেষ্টা করছিল। সে মাটিতে প্রচণ্ড স্পন্দন টের পেয়েছিল। বংকুবিহারী সাপ শুনেই কয়েক পা পিছিয়ে এসেছিলেন। এবার রিভলবার তাক করলেন। প্রাঙ্গণে দরবেশ চেঁচিয়ে উঠলেন, চুল্লু! বংকুবিহারী হিংস্রমূর্তি হয়ে তোর চুল্লুর নিকুচি করেছে ব্যাটা, এইবলে পর পর দুবার গুলি ছুড়লেন। প্রথম গুলিতে জালার মাটির ঢাকনা গুঁড়িয়ে গেল। দ্বিতীয় গুলিটি সাপটির লেজে লাগল। ক্রুদ্ধ সাপটি তেড়ে এল। দুপদাপ শব্দে সবাই তখন প্রাঙ্গণে। আহত সাপটি ছোবল ছুড়ছে, ফণা নেই, চেরা জিভ লক লক করছে। কর্নেল প্রাঙ্গণ থেকে টুকরো ইট তুলে তার মাথায় মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে সাপটি ওলটপালট খেতে খেতে নেতিয়ে পড়ল। কর্নেল আরেক টুকরো ইট তুলে মাথাটা ঘেঁচে দিলেন। তারপর লেজ ধরে তুলে জলে ফেলতে গেলেন। বংকুবিহারী শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে বললেন, এমার্জেন্সির জন্য কিছু বুলেট মজুত রাখা উচিত। নয়তো ওকে– বাপস! একেবারে মাথার কাছে–ওঃ।
দরবেশ বারান্দায় উঠে বললেন, চুল্ল! তারপর চিমটে বাড়িয়ে অভ্যাসমতো এগিয়ে দরজার তালা খুলতে থাকলেন। হরিপদ ভীত মুখে বলল, গুরুর কৃপায় বেঁচে গেছেন দারোগাবাবু?
ব্ৰজহরি বললেন, পিরবাবার দয়ায়! কী বলেন হর্ষবাবু?
ঘনশ্যাম মুখ বাঁকা করে বললেন, দয়াটায় নয় মশাই। ওসব বাজে কথা। বাইচান্স গায়ে হাতটা পড়েনি তাই।
ক্লারা দেখতে গেল, কর্নেল কোথায় সাপটাকে ফেলছেন। প্রদোষ একটু হাসল। বংকুবিহারীর উদ্দেশে বলল, অন্তত এসময় একটু চা পেলে মন্দ হত না। দরবেশসায়েব তো চা খান মনে হচ্ছে। ওই দেখুন কেটলি। কেরোসিন কুকারও।
বংকুবিহারী বারান্দায় উঠে বললেন, দরবেশসায়েব। কাল রাত্তিরে তো দানাপানি বরাতে জোটেনি আমাদের। এখন আমরা কি একটু চা পেতে পারি?
ব্ৰজহরি বললেন, টাকাকড়ি দেওয়া যাবে অবশ্য। ফের চাঁদা তুলব।
দরবেশ তখন ঘরে। একটা তক্তাপোশ দেখা যাচ্ছিল। সেটা আড়াল করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনারা খুব জুলুম করছেন বাবারা মায়েরা। আমি অন্ধ মানুষ। আমি কী খেয়ে বাঁচব? আপনারা সাঁতার কেটে চলে যান দরগা থেকে। আর বর্ষা হবে না। আসমান খালি হয়েছে। চলে যান। এ অন্ধের ওপর আর জুলুম করবেন না।
ব্ৰজহরি জিভ কেটে বললেন, না না। জুলুম করব কেন? আপনি সিদ্ধপুরুষ। আপনি ইচ্ছে করলেই মুখের খাদ্য জুটে যাবে।
ঘনশ্যাম বললেন, রিলিফের নৌকো এসে যাবে দেখবেন। এখন আমাদের প্রাণ বাঁচান।
দরবেশ শুধু বললেন, চুল্লু। তারপর তক্তপোশে পা ঝুলিয়ে বসে বুকে চিমটে ঠুকতে থাকলেন।
ঘনশ্যাম ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, ছেড়ে দিন। কই চলুন দেখি জলের অবস্থা। রিলিফের নৌকোও নিশ্চয় দেখতে পাব। ডাকব চেঁচিয়ে।
ব্ৰজহরি শ্বাস ফেলে বললেন, তাই চলুন। রাস্তার দিকটায় যাওয়া যাক। নিশ্চয় ওখান হয়ে রিলিফের নৌকো যাবে।
হরিপদ জয়গুরু বলতে বলতে একতারা পিড়িং পিড়িং করতে করতে ওঁদের সঙ্গ ধরল। একটু পরে বংকুবিহারীও ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বারান্দা থেকে নামলেন। তিনিও দেউড়ির দিকে ওঁদের অনুগামী হলেন।
চাক্কু বলল, পারবি সাঁতার কাটতে?
পুঁতি বলল, তোমার মাথা খারাপ? জলতল অবস্থা। দরগায় জল উঠল বলে- দেখবে।
চাক্কু গেল দক্ষিণে বটগাছের দিকে। একটু পরে পুঁতি ওকে অনুসরণ করল। চাক্কু ভাঙা মুসাফিরখানার ভেতর ঢুকেই বলল, উরে বাস! দরগায় জল ঢুকল বলে।
পুঁতি বলল, বললাম তোমাকে। আমি ডুবোদেশের মেয়ে। বুঝতে পারি। মানুষের পাপ যেবছর বেশি হয়, সেবার পিথিমি জলতল হয়। পাপ খোঁড়াপিরের দরগায় পর্যন্ত হাজির। আমাকে পর্যন্ত ছুঁতে এল, এত সাহস।
চাক্কু রাগ করে বলল, তোর খালি ওই কথা। ডাক্তারবাবুর মতো।
আমি বানের জলে চান করলে গা ঘিনঘিন যাবে না। পুঁতি নাকের ডগা কুঁচকে বলল। বেশ্যা মাগীর সাহস, আমাকে সার্চ করতে এল।
চাক্কু গম্ভীর হয়ে গেল। আস্তে বলল, ডেগারখানা কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস বল তো?
পুঁতি খাপ্পা হয়ে বলল, আমি তার কী জানি? নিজেই লুকিয়েছে। ভেবেছিলে, যদি মাগীর বুকে বসিয়ে দিই– সেই ভয়ে।
চাক্কু ওর দিকে নিষ্পলক চোখে তাকাল। তারপর সিগারেটের প্যাকেট বের করল। দেশলাই কিছুতেই জ্বালাতে না পেরে সে প্রদোষের কাছে চলে গেল। পুঁতি দাঁড়িয়ে রইল। ঠোঁট কামড়ে ধরে সে ভাঙা ঘরটার ভেতর দিয়ে বিস্তীর্ণ জলের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল।
প্রদোষ প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে ছিল। লাইটার জ্বেলে চাক্কুর সিগারেট ধরিয়ে দিল। নিজেও ধরাল সিগারেট। তারপর বলল, এখানে প্রচণ্ড সাপ! তাই না?
চাক্কু বলল, হ্যাঁ সার। পেচণ্ড। আসলে চারদিক জলতল হলে সাপগুলান ডাঙা মাটিতেই তো ছেণ্টার নেবে। বলুন তাই কি না? তাও তো আগের মতো সাপ আর নাই। ফলিডল-টলের চোটে মারা পড়েছে। এদিকে ধরুন, শেয়াল বলতেও আর নাই। নৈলে দেখতে পেতেন। বাপ-ঠাকুর্দার মুখে শুনেছি বাঘও ছিল। এই দরগায় নমো করতে আসতো। কত লোক দেখেছে। নৈলে বানের সময় বাঘও দেখতে পেতেন। তবে বিপদের সময় তো। বাঘ–
ক্লারা কর্নেলকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে এসেছিল। কথা শুনছিল। চাক্কু থামলে সে ব্যস্তভাবে বলল, বলুন আপনি বলুন। খুব ভাল লাগল শুনতে। আর কী সব হত, বিস্তারিত বলুন।…
.
তৃতীয় হত্যাকাণ্ড
ভাঙা দেউড়ির পর কয়েকপা এগিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন ওঁরা ব্ৰজহরি, ঘনশ্যাম, বংকুবিহারী, হরিপদ। হরিপদর একতারা থেমে গিয়েছিল। সামনে জল। ছত্রখান ঐতিহাসিক পাথরের স্ল্যাবগুলোর তলা ও ওপর দিয়ে বন্যা ছলকে আসছে। ঢালুতে উঁচু গাছপালার গুঁড়ি অব্দি ডুবে গেছে। ঝোপঝাড় তলিয়ে গেছে। গাছপালার আড়ালে কিছুটা দূরে বাঁশবনের ভেতর কচুরিপানার আঁক আটকে আছে দেখে হরিপদ বলে উঠল, ওই গো! পাটুলির বিল ভেসে গেছে। নতুন বাঁধ। টিকবে কেন?
ব্ৰজহরি গুম হয়ে বললেন, তাহলে হোল সাবডিভিসন জলের তলায়।
বংকুবিহারী আনমনে প্রশ্ন করলেন, কেন?
ব্ৰজহরি একুট বিরক্ত হয়ে বললেন, এরিয়ায় আমি নতুন এসেছি। আমার চাইতে আপনারই জানার কথা বেশি।
পাটুলি-আটুলি আমার জুরিশডিকশন নয়। বংকুবিহারী তেমনি আনমনে বললেন। ওদিকটা অন্য থানা।
ব্ৰজহরি আক্ষেপে বললেন, আমরা পরমাণু বোমা ফাটাতে পারি। স্যাটেলাইট পাঠাই স্পেসে। ভাল করে একটা বাঁধ বাঁধতে পারি না। এই তো অবস্থা!
ঘনশ্যাম চুপ করে থাকতে পারলেন না, যাদিও ভেবেছিলেন মুখ খুলবেন না। বললেন, সোস্যাল কন্ট্রাডিকশনটা বুঝতে হবে। ফিউডালিজম যখন ক্যাপিটালিজমের পোশাক পরতে চায় তৃতীয় বিশ্বের কথাই বলছি, যেমন ধরুন
বংকুবিহারী ধমক দিলেন, ধূর মশাই! নেচার। সায়েবদের দেশে ফ্লাড হয় না?
ঘনশ্যাম মরিয়া হয়ে বললেন, নেচারকে অস্বীকার করছি না। কিন্তু স্টালিন বলেছেন, প্রকৃতির নিজস্ব নিয়ম আছে। আমরা নিয়মকে বদলাতে পারি না, কন্ট্রোল করতে পারি। এখন কথা হল, কন্ট্রোলিং সিস্টেমের মধ্যে যদি দ্বন্দ্ব থাকে, তাহলে কী হবে?
বংকুবিহারী রাগ করে হাসলেন। ..স্টালিন-ফালিন করে কোনো লাভ হবে না মশাই! এটা কমিউনিস্টগিরি ফলানোর সময় নয়।
ব্ৰজহরি বললেন, আপনাদের মাথায় আসল ব্যাপারটা ঢুকছে না। দুর্নীতি করাপশান! রন্ধ্রে রন্ধ্রে ওই পাপ ঢুকছে। বাঁধে বলুন, যেখানে বলুন, ওই এভিল অ্যাক্টিভ। দা স্যাটান লেট লুজ!
ঘনশ্যাম বললেন, ওসব মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা। পাপ এভিল-টেভিল বাজে কথা। পাপ করে কেন মানুষ? পাপ করার ঢালাও সুযোগ তো আছেই, উপরন্তু বেঁচে থাকার দায়। ওই মেয়েটির কথাই ধরুন। কী যেন নাম– শাওনি!
ব্রজহরি বললেন, আবার সাত-সকালে ওই নাম! আমনি চুপ করুন তো!
আপনি মহা ধার্মিক! ঘনশ্যাম ব্যঙ্গ করে বললেন। হিন্দু ধর্ম নাকি সর্বজীবে ব্রহ্মদর্শন করতে বলে। আর খ্রিস্টান ধর্ম বলে, পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়!
ব্ৰজহরি তেড়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, বংকুবিহারী বাধা দিলেন। ধূর মশাই! খালি এঁড়ে তক্ক। ছাড়ুন তো ওসব। ওই দেখুন, সূর্য উঠছে। রিলিফের নৌকো খুঁজুন—এবারে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাবে।
হরিপদ একতারায় পিড়িং করলে বংকুবিহারী তাকেও থামিয়ে দিলেন। বললেন, ক্ষিদেয় নাড়ি জ্বলছে আর খালি পিড়িং পিড়িং! মেমসায়েবকে শোনাও গিয়ে। ওদের নাকি ক্যাপসুল চুষে ক্ষিদে মেটে।
অগত্যা ব্ৰজহরি একটু হাসলেন। বিবেকানন্দ বলেছেন, খালি পেটে ধর্ম হয় না। বুঝলেন তো?
ঘনশ্যাম আপন মনে চাপা গলায় বললেন, সর্বত্র একই অবস্থা। একদিকে প্রচুর খাদ্য, অন্যদিকে অনাহার। একদিকে প্রাচুর্য, অন্যদিকে অভাব।
ব্ৰজহরি অনিচ্ছাসত্ত্বেও শুনে ফেললেন।…তা অস্বীকার করা চলে না। যেমন, চোখের সামনেই দেখছি।
বংকুবিহারী সন্দিগ্ধস্বরে বললেন, কী?
ব্ৰজহরি ম্লান হেসে বললেন, দরবেশের ঘরে প্রচুর চাল-ডাল আছে চা-চিনি। আছে। আর আমরা ক্ষিদেয় মরছি। কিন্তু
ঘনশ্যাম ঝটপট বললেন, কিন্তু টা কিসের? কোনো কিন্তু নেই।
আহা, অন্ধ মানুষ! সাধুসন্ত। ব্ৰজহরি গোঁফ চুলকোতে থাকলেন। জোর করলে পাপ হবে। না হলে তো কেড়ে খেতে পরামর্শ দিতাম এতক্ষণ।
ঘনশ্যাম বললেন, কোনো পাপ হবে না। আপনারা আসুন আমার সঙ্গে।
বংকুবিহারী ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ইউ আর রাইট। চলুন, আগে অনুরোধ করব ফের। তারপর
হরিপদ ব্যাকুল হয়ে বলে উঠল, দোহাই বাবুমশাইরা! শাপ লাগবে। বিপদ হবে আরও।
ব্ৰজহরি দ্রুত বদলে বললেন, আহা! টাকা দিয়েই চাইব ফের।
ঘনশ্যাম পা বাড়িয়ে বললেন, সব সহ্য করা যায়, ক্ষিদে সহ্য করা যায় না। চলুন, আমিই লিড নিচ্ছি।
ঘনশ্যাম আগে, তার পেছনে বংকুবিহারী, তার পেছনে দোনামনা করে ব্ৰজহরি, শেষে জয় গুরু, তোমার ইচ্ছা, বলে হরিপদ। প্রাঙ্গণে দরবেশের ঘরের বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে হাত-মুখ নেড়ে চাক্কু কথা বলছিল। সামনে ক্লারা। বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে প্রদোষ। ঘনশ্যাম গিয়েই বললেন, আসুন। আমরা দরবেশের ঘরে ঢুকব। চাল-ডাল বের করব। চলে আসুন সব।
ক্লারা টের পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, না না! ওই কাজ করবেন না। একটু ধৈর্য ধরুন আপনারা।
বংকুবিহারীর ইশারায় চাক্কু একলাফে বারান্দায় উঠল। তারপাশে ঘনশ্যাম। চাক্কু দরজার দিকে এগিয়ে বলল, দরবেশবাবা! চাল-ডাল কী সব আছে বের করে দাও। দারোগাবাবুর হুকুম হয়েছে।
দরবেশ তার আগেই দরজার সামনে দাঁড়িয়েছেন। দুহাতে চিমটে তুলে বললেন, আয়! কে আসবি আয়! কুঁড়ে ফেলব তোদের। চুল্ল! চুল্লু! চুল্লু! চিমটেটা ভারি, লম্বা এবং সূচলো। সামনে খোঁচা মারতে থাকলেন ক্রমাগত। সেই সঙ্গে চিৎকার, চুল্লু! চুল্ল! চুল্লু! ঘনশ্যাম বললেন, চাক্কু! ওর চিমটেটা কেড়ে নাও। চাক্কু সুবিধে করতে পারল না। বন্ধুবিহারী প্রচণ্ড রেগে গিয়ে রিভালবার বের করে। বললেন, গুলি ছুড়ব বলে দিচ্ছি! ঘনশ্যাম চ্যাঁচামেচি করে বলতে থাকলেন, ছুড়ুন! ছুডুন! এ মুহূর্তে লোকটা মানবতার শত্রু! ওকে গুলি করে মারলে আপনার কি হবে না। আপনি পুলিশ। পুলিশকে রাষ্ট্র প্রয়োজনে খুন-খারাপির অধিকার দিয়েছে। ব্ৰজহরি রক্ষার চেষ্টা করছিলেন।…দরবেশবাবা! দরবেশবাবা! টাকা। দেব– আমরা চাদা করে টাকা দেব। আমাদের ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। দরবেশ চিমটেটা নেড়ে এবার কান্নাজড়ানো স্বরে চেঁচালেন, চুল্লু! সেই সময় চাক্কু পাশ থেকে খপ করে চিমটের ডগা ধরে ফেলল। ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল। দরবেশ চৌকাঠে পা আটকে টানতে থাকলেন চাক্কুকে। ঘনশ্যাম বললেন, ইট! ইট মারো! ক্লারা বড়ো চোখে তাকিয়ে দেখছিল। ঘুরে প্রদোষের দিকে তাকাল। প্রদোষ উঠে এসে তাকে সরিয়ে নেবার জন্য হাত ধরল। ক্লারা হাত ছাড়িয়ে নিল। ঘনশ্যাম ইট কুড়োতে প্রাঙ্গণে নেমেছিলেন। ইট কুড়িয়ে বারান্দায় উঠেছেন, এমন সময় চিলাচানি চেঁচাতে চেঁচাতে পুঁতি দৌড়ে এল, খুন! খুন! বেশ্যামাগি খুন হয়ে পড়ে আছে!
সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যের জন্য সংঘর্ষ থেমে গেল। বংকুবিহারী বললেন, কী, কী?
পুঁতি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ওইখানে বানের জলে আটকে আছে। গলা ফাঁক।, আপনারা গিয়ে দেখুন! বুড়োসায়েব দাঁড়িয়ে আছে যান শিগগিরি!–
পুঁতি ধপাস করে বারান্দায় বসল। সে স্নান করেছে। ভিজে শাড়ি। চুলে জল গড়াচ্ছে। সবাই দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন। দরবেশ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।…
.
চতুর্থ হত্যাকাণ্ড
কাল বিকেলে বংকুবিহারী যে চাঙড়টাতে বসে ইউনিফর্ম শুকোচ্ছিলেন, বন্যার জল সেটা ডুবিয়ে নিশ্চিহ্ন করেছে। জল উঠে এসেছে আস্তানা ঘরের পেছন দিকটায়, যেখানে ছোট-বড় ধ্বংসস্তূপ, খালি স্লেট পাথর, ফণিমনসার ঝোপ। শাওনি চিত হয়ে আটকে আছে সেই ঝোপের গায়ে। জল দুলছে, তার মড়াটা দুলছে। গায়ের শাড়ি আটকে আছে কাঁটায়। তা না হলে হয়তো ভেসে চলে যেত।
বংকুবিহারী একটুখানি ঝুঁকে থেকে সোজা হলেন। কর্নেলের দিকে তাকালেন। কর্নেল ফণিমনসার শরীর ছুঁড়ে বেরুনো মোচার মতো ফুলগুলো দেখছিলেন। বংকুবিহারী আস্তে বললেন, এখানেই ছিল?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। সাপটা ছুঁড়ে ফেলার পর চোখে পড়েছিল।
ব্ৰজহরি ডাক্তারের অভ্যাসে মড়াটা দেখতে পা বাড়ালেন। শাওনির মুখটা ওপাশে ঘুরে ছিল। একটা ডাল ভেঙে মুখটা সোজা করে দিলেন। পেছনে ক্লারার চমকে ওঠা কণ্ঠস্বর শোনা গেল। হরিপদ কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে থাকল, হায় গুরু! জয় গুরু! প্রদোষ ক্লারাকে টেনে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করল। পারল না। বংকুবিহারী গাঢ় স্বরে বললেন, কী মনে হল ডাক্তারবাবু?
ব্ৰজহরি চেষ্টা করলেন। কী মনে হবে? মাডার! বিশুদ্ধ হত্যাকাণ্ড।
কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করুন। বংকুবিহারী ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন। স্ট্যাবিং নয়। আচমকা অ্যাটাক নয়। ধীরেসুস্থে গলায় প্যাঁচ। মুসলমানরা যেভাবে হালাল– করে। চাক্কু!
চাক্কু চমকে উঠে বলল, সার।
তোর কাছে একটা ড্যাগার ছিল। বংকুবিহারী সন্দিগ্ধভাবে বললেন। এখনও সত্যি কথাটা বল!
চাক্কু ঝটপট বলল, রেতের বেলা তো সাচ করলেন সার!
চুপ! ধমক দিলেন বংকুবিহারী। তোর বউকে সার্চ করা হয়নি করতে দেয়নি তোর বউ। শাওনি তাকে সার্চ করতে গিয়ে গণ্ডগোল হল। কই, কোথায় সে? তাকে তো দেখছি না!
চাক্কু বলল, দরবেশের বারান্দায় বসে আছে। ডাকতে বলেন তো ডাকি!
বংকুবিহারী পা বাড়াতে গিয়ে ঘুরে বললেন, আপনারা কেউ কোথাও যাবেন না। এখানেই থাকুন। বলে চলে গেলেন দরগার দিকে। চাক্কু সেদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ নিষ্পলক।
কর্নেল ডাকলেন। ডাক্তারবাবু! বডিটা টেনে তোলা দরকার। আসুন।
ব্ৰজহরি ইতস্তত করে বললেন, দারোগাবাবু
আপনি তো ডাক্তার। বডি পরীক্ষা করে অনুমান করতে পারবেন না কতক্ষণ আগে মেয়েটি মারা গেছে?
জলে পড়ে থাকা বডি! ব্ৰজহরি বিরক্ত হয়ে বললেন। মর্গের টেবিলে ছাড়া কিছু বোঝা অসম্ভব।
রাইগর মৰ্টিস শুরু হয়েছে কি না বলেই কর্নেল একটু হাসলেন। ভুল হচ্ছে। আমরা শাওনিকে কখন শেষবার দেখেছি, ঠিক করা দরকার। আমি দেখেছি শেষবার, তখন রাত্তির প্রায় সওয়া দুটো। ডাক্তারবাবু, আপনি?
আমি ঘুমুচ্ছিলাম।
হর্ষনাথবাবু?
ঘনশ্যাম ঠোঁট কামড়ে ধরে দূরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, আমিও ঘুমুচ্ছিলাম।
প্রদোষবাবু?
প্রদোষ সপ্রতিভ ভঙ্গিতে বলল, আমি কাউকে লক্ষ্য করিনি।
ক্লারা!
ক্লারা একটু ইতস্তত করল। তারপর বলল, রাত্রি তিনটার সময় পাশের ঘরে কেউ ঢুকেছিল। ভোরবেলা দেখলাম এই রিকশাওলা ভদ্রলোক আর তার স্ত্রী শুয়ে আছেন ওই ঘরে। ভাবলাম, তারাই হবে। কিন্তু–
কিন্তু কি?
ক্লারা বলল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শাওনি ঢুকেছিল। কারণ একজনকে ঢুকতে দেখেছলাম। চাক্কু, তোমরা কখন শুতে গিয়েছিলে পাশের ঘরে?
চাক্কু, বলল, বৃষ্টি থামলে পরে।
তার মানে চারটের কাছাকাছি। কর্নেল বললেন। তোমরা ও-ঘরে ঢুকে শাওনিকে দেখনি নিশ্চয়?
আজ্ঞে না সার! সে থাকলে বুঝতে পারতাম।
বংকুবিহারীর গজরানি শোনা গেল। চাক্কু! চাক্কু! এদিকে আয়! তোর বৌ পালিয়েছে সাঁতার কেটে। তাকে খুঁজে পেলাম না। তার মানে, তোর বউ মার্ডার করে পালিয়েছে। বলতে বলতে আইনরক্ষক এসে চাক্কুর গেঞ্জির কলার খামচে ধরলেন। হাতে রিভলবার।
কর্নেল হন্তদন্ত উঠে গেলেন তার কাছে।..খুঁজে পেলেন না পুঁতিকে?
না। বংকুবিহারী হুংকার দিলেন। রাত্তিরেই আমার সন্দেহ হয়েছিল চাক্কুর বউ ফেরোশাস টাইপের। শাওনিকে সার্চ করার সময় তার আটিচুড মনে পড়ছে। আপনাদের?
কর্নেল একটু হাসলেন। কিন্তু লুল্লু– মানে কুকুরটাকেও কি গলা পেঁচিয়ে কেটে ভাসিয়ে দিয়েছিল পুঁতি?
হোয়াট? আইনরক্ষক চাক্কুকে ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন। কী বলছেন আপনি?
হ্যাঁ। শাওনির মতো গলাকাটা কুকুরটা ওই বটতলায় পড়ে আছে।
বংকুবিহারীর সঙ্গে সবাই দৌড়ে গেল সেদিকে। শুধু দাঁড়িয়ে রইল চাক্কু। কর্নেল আস্তে বললে, চাক্কু! তুমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে যে? পুঁতিকে খুঁজতে ইচ্ছে করছে না?
চাক্কু ফুঁসে উল। পুঁতি যদি মার্ডার করে থাকে, বেশ করেছে। সে না করলে আমিই কাজটা করতাম। যদি বলেন কেন করতাম, তাহলে খুলে বলি।
বলো।
শাওনি কাল বিকেলে বলছিল, ভাল খদ্দের আছে টাউনে। পাঁচশো টাকা দেবে– মানে, পুঁতির দাম।
আর পুঁতি তোমার বউ। কাজেই এ কথায় তোমার রাগ হওয়া উচিত।
বউ? চাক্কু ভুরু কুঁচকে মুখ নামাল। গলার ভেতর বলল, পুঁতি ঠিক বউ নয়। তবে হ্যাঁ, ওর সিঁথেয় সিঁদুর দিতে হয়েছিল। কেন– কী, আপনারা কী ভাববেন। অবশ্যি–
বলো, বলো!
টাউনে গিয়ে ঠিকই বিয়ে করতাম ওকে। তবে এখনও ও আমার বউ না বউ হত পারে।
পরে শব্দটার ওপর খুব জোর দিল চাক্কু। কর্নেল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, পুঁতি কি সাঁতার কেটে পালাতে পারে বলে তোমার মনে হয়?
চাক্কু একটু ভেবে বলল, তা পারলেও পারে। ডুবোদেশের মেয়ে। সাঁতার জানে। তবে মুখে বলছিল, এত জলে সাঁতার কেটে যেতে পারবে না। দেখছেন না, এত উঁচু দরগার গলা পর্যন্ত জল?
কর্নেল বললেন, আমার সঙ্গে এসো তো!
চাক্কু তাকে অনুসরণ করল। ডাইনে গাছপালার ভেতর দিয়ে দক্ষিণে বট গাছটার তলায় বংকুবিহারীদের দেখা যাচ্ছিল। উত্তেজিতভাবে কথা বলছেন ওঁরা। দরগা পেরিয়ে ডাইনে ঘুরলেন কর্নেল। ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে বললেন, ওই যে ঝোপের ডগাটা দেখতে পাচ্ছ। ওর তলায় একটা তালডোঙা ডোবানো আছে। টেনে নিয়ে এস।
চাক্কু ভীষণ অবাক হল। তারপর গেঞ্জি, প্যান্ট খুলে একটা গাছের শেকড়ে রেখে, কাঁধের ব্যাগটাও, ডোরাকাটা আন্ডার-প্যান্ট পরা অবস্থায় সাবধানে নামল। গলা জলে দাঁড়িয়ে সে পা বাড়িয়ে খুঁজতে থাকল তালডোঙাটা। বলল, কৈ? কিছু নেই।
কর্নেল বললে, নিশ্চয় আছে। খুঁজে দেখ। বাঁধা আছে ঝোপের গোড়ায়। বৈঠাও ঢোকানো আছে দেখবে।
চাক্কু ডুব দিল। জলে বুজকুড়ি উঠতে থাকল। ভেঁস করে মাথা তুলে চোখ-মুখের জল হাত দিয়ে মুছে সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ডোঙা নেই। বৈঠা নেই। মনে হল, দড়ি আছে একটুখানি।
দড়িটা খুলতে পারবে না?
দেখছি। বলে চাক্কু আবার ডুব দিল। ভেঁস করে মাথা তুলে বলল, নাঃ। পারা যাবে না।
ঠিক আছে। উঠে এস।
চাক্কু উঠে এসে ব্যাগ থেকে ছোট্ট তোয়ালে বের করে মাথা ও মুছতে থাকল। কর্নেল বললে, এবার কী মনে হচ্ছে তোমার?
চাক্কু হাঁপধরা গলায় বলল, কী মনে হবে? হারামজাদি বোধ করি ভোঙাটা ডোবানো আছে জানত। ও ডোঙা বাইতে পারে। নিয়ে পালিয়ে গেছে।
কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে বহুদূর খুঁজলেন। বাঁ-দিকে– পূর্বে বাঁশবন তাই দৃষ্টি আটকে গেল। পুঁতি যদি বাঁশবনের দিকে ডোঙাটা নিয়ে যায়, দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। বাঁশবনটার ওধারে কিছু দেখা যাবে না এ টিবি থেকে।
কর্নেল ও চাক্কু দরগার কাছে গিয়ে দেখলেন সবাই দরবেশের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। বংকুবিহারী কর্নেলকে দেখে বললেন, আপনারা কি পুঁতিকে খুঁজতে গিয়েছিলেন? খি খি শব্দে হাসলেন আইনরক্ষক।…কান টানলে মাথা আসে। চাক্কু, তোকে অ্যারেস্ট করলাম। চুপ করে এখান বস্। আয়! বস্ এখানে।
চাক্কু বলল, ডোঙা
কথা কেড়ে বংকুবিহারী বললেন, ভোঙা পরে। কর্নেল সায়েব বলবেন। ডোঙার কথা। বলুন!
কর্নেল বললেন, তার আগে যে তালভোঙা নিয়ে এখানে এসেছিল, তাকে খুঁজে বের করা দরকার। আমার বিশ্বাস কোথাও সে লুকিয়ে আছে। তার মানে, যদি তাকে পাওয়া যায়, তবে বোঝা যাবে পুঁতিই ডোঙাটা নিয়ে পালিয়েছে। তা না হলে, আমার ভয় হচ্ছে—
ভয় পরে। আইনরক্ষক আদেশ জারি করলেন। প্রত্যেকে একেক দিকে খুঁজতে থাকুন। তন্ন তন্ন খুঁজে দেখুন। কিন্তু সাবধান করে দিচ্ছি, কেউ সাঁতার কেটে পালানোর চেষ্টা করবেন না। যে পালাতে যাবেন, তাকেই মার্ডারার বলা হবে। আন্ডারস্ট্যান্ড?
ক্লারা আস্তানাঘরের উত্তর-পশ্চিম কোণে একটা চাঙড়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ বলল, ওটা কী? তারপর দৌড়ে গেল। গিয়েই চিৎকার করে উঠল, হত্যা! হত্যা! সবাই দৌড়ে গেল। চাঙড়ের পেছনে পুঁতি শুয়ে আছে। রক্ত।…
.
কিছু সূত্র এবং থিওরি
টাটকা রক্ত। গলা ফাঁক। এখনও গাড়িয়ে পড়ছে। গাছপালার জটিলতা ছুঁড়ে দিনের প্রথম রোদ্দুর উঁকি দিচ্ছে। আকাশে আলতোভাবে ভেসে চলেছে। টুকরো-টুকরো সাদা মেঘ। ফাঁকা জায়গাগুলো প্রচণ্ড নীল। ঘনশ্যাম আকাশ দেখার ভান করছিলেন। ক্লারা মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রদোষ তার কাঁধে হাত রেখেছে। সেও এই ভয়ংকর বাস্তবতা থেকে উল্টেটাদিকে দাঁড়িয়েছে। চাক্কু পলকহীন চোখে তার প্রেমিকার বুকের পাশে বসে রক্ত দেখছে। বংকুবিহারীর হাতে রিভলবার। চারদিকে ঘুরে-ঘুরে দেখছেন। ডাক্তার ব্রজহরি কুণ্ডু ঠোঁট কামড়ে ধরেছেন, দেখছেন এবং চোখ পিটপিট করছেন। কর্নেল হাঁটু ভাজ করে পুঁতির দেহের চারপাশে ভিজে ঘাম ও মাটি খুঁজছেন। দেখছিলেন, রক্তের ধারা ঢাল গড়িয়ে বন্যার দুলন্ত জলে মিশে যাচ্ছে। পুঁতির দুটো পা জলে ভাসছে। দুলছে। একটা ঝোপের ডগাটুকু জেগে আছে পায়ের নিচে এবং সেই ডগায় বসে আছে একটা ঝলমলে প্রজাপতি। কর্নেল প্রজাপতিটা দেখতে থাকলেন। ভাবলেন, প্রজাপতির জাল হলে সহজে এই অসাধারণ প্রজাপতিটা ধরা যায় অবশ্য। কিন্তু মনস্থির করতে পারলেন না। সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। গাঢ় নৈঃশব্দ্য ভেঙে কিছু বলবেন ভাবলেন। বললেন না।
বংকুবিহারী ফোঁস শব্দে শ্বাস ছাড়লে ব্ৰজহরি ভাঙা গলায় বললেন, আমিই বলেছিলাম
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন, কী?
হঠাৎ ছ্যাৎরানো কণ্ঠস্বরে ব্ৰজহরি চেঁচিয়ে উঠলেন, দা স্যাটান লেট লুজ! আমরা কেউ বাঁচব না। প্রত্যেককে এইরকম চিত হয়ে পড়ে থাকতে হবে– গলা ফক, চাপচাপ রক্ত, মুখে মাছি!
হরিপদ বাউল সবার পেছনে দুহাঁটুর ফাঁকে মাথা গুঁজে নিঃশব্দে কাঁদছিল। মুখ তুলে ভিজে গলায় বলল, হায় গুরু! বলেই ফুঁপিয়ে উঠল।
বংকুবিহারী গর্জন করলেন, এই ব্যাটা! ন্যাকামি করিস নে। আর ডাক্তারবাবু, আপনাকেও বলছি– ওসব পাগলামি ছাড়ুন। ইউ আর অল আন্ডার অ্যারেস্ট! আইনরক্ষক প্রত্যকের দিকে রিভালবারের নল তুলে বললেন, ইউ! ইউ! ইউ! ইউ! চাক্কু, তুই নির্দোষ। কারণ তুই আমার সামনে ছিলিস। তুই খালাস! তারপর কর্নেলের উদ্দেশে বললেন, আপনার গিতিবিধি সন্দেহজনক। কাল থেকে আমি লক্ষ্য করছি। আপনার সঠিক পরিচয়–
কর্নেল তার কথার ওপর বললেন, কোনো ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই। এটাই আশ্চর্য! মেয়েটি সম্ভবত বাধা দেবার এবং চেঁচাবার সুযোগ পর্যন্ত পায়নি। এ থেকে মনে হয় খুনী ওর চেনা লোক।
বংকুবিহারী ক্রুদ্ধভাবে তাকিয়ে থাকলেন ওঁর দিকে। ঘনশ্যাম হাসবার চেষ্টা করে বললেন, এই দুটি ঘটনার–না, তিনটি ঘটনায়, মানে হতভাগা কুকুরটিকেও হিসেবে ধরা উচিত, প্রমাণিত হল আমাদের সমাজব্যবস্থার স্বরূপ। তবে দারোগাবাবু যে বললেন, উই আর আন্ডার অ্যারেস্ট! এতেও এই সমাজব্যবস্থায় আইনের ভূমিকা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
ব্ৰজহরি ক্ষুব্ধ। বললন, এই মেয়েটি সদ্য খুন হয়েছে। ওই দেখুন, এখনও রক্ত বেরুচ্ছে গলগল করে। এবং ওকে যখন খুন করা হচ্ছে, তখন আমরা প্রত্যেকে দারোগাবাবুর সামনে উপস্থিত ছিলাম। এ অবস্থায় প্রমাণিত হচ্ছে, আমরা কেউ ওকে খুন করিনি। সুতরাং হর্ষনাথবাবু ইজ কারেক্ট।
ঘনশ্যাম আরও জোর পেয়ে বললেন, কারেক্ট। কিন্তু একটু ভুল হল ডাক্তারবাবু! আমরা যখন আস্তানাঘরে মেয়েটিকে খুঁজতে এলাম, তখন একজন আমাদের মধ্যে উপস্থিত ছিল না।
বংকুবিহারী বললেন, কে সে?
ঘনশ্যাম ক্লারার দিকে আঙুল তুলে বললেন, ওই মেমসায়েব। মনে করে দেখুন, মেমসায়েবই এখানে দাঁড়িয়ে হত্যা হত্যা করে চেঁচাচ্ছিলেন।
ক্লারা কী বলতে যাচ্ছিল, প্রদোষ ঘুষি তুলে বলল, আর একটা কথা বললে দাঁত ভেঙে দেব।
ঘনশ্যাম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, চেষ্টা করে দেখতে পারো! তোমার মতো বিস্তর বুর্জোয়া-পাতি বুর্জোয়া আমার দেখা আছে। এস, চলে এস!
ব্ৰজহরি মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, হচ্ছেটা কী? দারোগাবাবু, আবার একটা খুনোখুনি হয়ে যাবে যে!
ক্লারা প্রদোষকে টানতে টানতে আস্তানাঘরের দিকে নিয়ে গেল। বংকুবিহারী হাল ছেড়ে দিয়ে বসে পড়লেন একটা চাঙড়ে। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, মরুক। সবাই মরুক। আমার কিছু করার নেই। আমার মাথা ভোঁ-ভোঁ করছে।
ব্ৰজহরি বললেন, নার্ভাস ব্রেকডাউন! চলুন, আপনাকে একটা ট্যাবলেট দিই। আমিও একটা খাব। আমারও মাথাটা কেমন করছে। মনে হচ্ছে চেঁচামেচি করি। সব ভাঙচুর করে ফেলি। চাক্কু, উঠে আয়! তোকেও একটা ট্যাবলেট দেব। চাক্কু! শুনতে পাচ্ছিস কী বলছি? কর্নেল, দেখুন তো ছোকরার কী হল?
চাক্কু এতক্ষণে দুহাতে মুখ ঢেকে হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠল। হরিপদ গিয়ে তাকে ধরল। টানতে টানতে নিয়ে এল উঁচু জায়গায়। চাক্কু নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ভাঙা গলায় বলল, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি জলে ডুবে মরি। আমার আর বেঁচে থাকতে মন চায় না।
ঘনশ্যাম তার কাধ ধরলেন। ..মরবি কেন বাবা? লড়াই করে বরং মরবি। আয়, আমার সঙ্গে আয়। তোকে একটা-একটা করে বুঝিয়ে দিচ্ছি, গণ্ডোগোলটা কোথায়। কেন সবার আগে মেয়েদের গায়েই আঘাতটা পড়ে।
ঘনশ্যাম ও হরিপদ চাক্কুকে টানতে টানতে আস্তানাঘরের দিকে নিয়ে গেলেন। ব্ৰজহরি ভুরু কুঁচকে নাকে রুমাল চেপে বললেন, কর্নেলসায়েব! দারোগাবাবু! এই টাটকা রক্তের কাছে আর কিছুক্ষণ থাকলে আমরা সত্যি পাগল হয়ে যাব। চলুন, দরবেশের ওখানে যাই। সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তা-ভাবনা করি। আসুন!
বংকুবিহারী গুম হয়ে বসে রইলেন। কর্নেল বললেন, ডাক্তারবাবু, কাল আপনি যেন কাকে দেখেছিলেন!
ব্ৰজহরির মনে পড়ল। নড়ে দাঁড়ালেন।…তাই তো! দেখেছিলাম যেন কালোমতো একটা কিছু ওই যে গাছগুলো দেখছেন, ভাঙা দেয়ালটার কাছে।
বংকুবিহারী গলার ভেতর বললেন, তালডোঙাটার কথাও ভাবা উচিত।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ তালডোঙাটা একটা বড় সূত্র। ধরুন, তালডোঙা চেপে যে এখানে এসেছিল তাকে শাওনি চিনত। আমি গিয়ে পড়ায় সে গা ঢাকা দিয়েছিল। তারপর শাওনি অথবা সে আড়াল থেকে দেখেছিল, আমি তালডোঙাটা কোথায় লুকিয়ে রাখছি।
বংকুবিহারী বললেন, আপনি মশাই অদ্ভুত লোক! আমাদের তক্ষুনি সেটা না জানিয়ে অমন করে এটা লুকোতে গেলেন কেন? ঠিক এই পয়েন্টটাতে আপনার অ্যাক্টিভিটি অত্যন্ত ডাউটফুল। তাই না ডাক্তারবাবু?
ব্ৰজহরি বাঁকা হেসে বললেন, উঁহু! ভেবেছিলেন আপনি বাঁচলে বাপের নাম। একা সুড়ুৎ করে কেটে পড়বেন আর কী! সেলফিশ অ্যাটিচ্যুড একেই বলে।
কর্নেল একটু হাসলেন। না ডাক্তারবাবু! লোকটা কে, আমার জানা দরকার ছিল।
বংকুবিহারী বলেন, কেন?
যেহেতু সে গা-ঢাকা দিয়েছিল আমার সাড়া পেয়েই।
ব্ৰজহরি চঞ্চল হয়ে চাপা স্বরে বললেন, একটা থিওরি মাথায় আসছে।
আইনরক্ষক দ্রুত বললেন, বলুন, বলুন!
ব্ৰজহরি চারিদিক দেখে নিয়ে তেমনি চাপা স্বরে বললেন, শাওনিও তালডোঙাটা– কর্নেলসায়েবের কথায় বিশ্বাস রেখেই বলছি, লুকিয়ে রাখা দেখেছিল। ধরুন, সে শেষরাত্তিরে সেটা জল থেকে তুলে এই দ্বীপ থেকে– হ্যাঁ, এটা এখন দ্বীপই বলা যায় কি না বলুন আপনারা?
বলা যায়। বংকুবিহারী সায় দিলেন। দ্বীপ বৈকি। চারদিকে অগাধ জল। সমুদ্র! মাঝখানে একটা দ্বীপ!
ব্ৰজহরি উত্তেজনায় বসে পড়লেন, আরেকটা চাঙড়ে।…ধরুন, ডোঙাটা তুলে জল বের করে শাওনি রেডি হয়েছে, এমন সময় লোকটা টের পেয়ে তাকে–
বংকুবিহারী বললেন, ওয়ান্ডারফুল! তাই বটে!
ব্ৰজহরি উৎসাহ পেয়ে বললেন, এছাড়া অন্য ব্যাখ্যা হয় না।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, কিন্তু ডোঙাটা লুকোনো ছিল দক্ষিণপূর্ব কোণে। শাওনির ডেডবডি পাওয়া গেছে পশ্চিমে অনেক দূরে। আস্তানাঘরের পেছনের ঢালে ফণিমনসার ঝোপে।
ব্ৰজহরি বলেন, কোনো গণ্ডগোল নেই! সোজা হিসেব। ফ্লাডের জল দরগার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে লক্ষ্য করুন। বডিটা ভাসতে ভাসতে ওখানে চলে গেছে। ফণিমনসার কাটায় আটকে গেছে।
কিন্তু তাহলে পুঁতিকে খুন করল কে? কর্নেল বললেন। হত্যার পদ্ধতি– অবিকল এক। শ্বাসনালী কেটে হত্যা।
ব্ৰজহরি দমে গিয়ে শ্বাস ছাড়লেন। বংকুবিহারী বললেন, লোকটা ধরুন, চলে যায়নি। কোনো উদ্দেশ্য ছিল তার। এবং পুঁতি তাকে চিনতে পেরেছিল।
ব্ৰজহরি আবার উৎসাহ পেলেন।…ঠিক তাই। আমরা যখন ওদিকে শাওনির বডির কাছে, তখন সে এখানে তালডোঙাটা লুকিয়ে– ওই ঝোপগুলোর মধ্যে লুকোনো সহজ, এবং
বংকুবিহারী বললেন, ভাসমান অবস্থায় লুকিয়ে, বলুন!
হুঁ, ভাসমান অবস্থায়। ব্ৰজহরি বললেন। তালডোঙায় নেমেই সে পুঁতির মুখোমুখি হল!
বংকুবিহারী বললেন, পুঁতি তাকে চিনত। কাজেই পুঁতিকে সে– মাই গুডনেস! বংকুবিহারী লাফিয়ে উঠলেন। লোকটা নিশ্চয় ইসমাইলড়াকু–যাকে ধরতে ফাঁদ পেতেছিলাম!
ব্ৰজহরি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন। কাঁটায়-কাঁটায় মিলে যাচ্ছে সব! দুয়ে দুয়ে চারই হচ্ছে। পুঁতিকে মেরে রেখে বেগতিক বুঝে ডাকু ব্যাটা ডোঙায় চেপে পালিয়ে গেছে। কারণ ঠিক তখনই মেমসায়েব এদিকে আসছিল।
কর্নেল বললেন, কিন্তু জলটা হঠাৎ বেড়ে যাচ্ছে দেখছেন! পুঁতির কোমরুঅব্দি ভাসছে। ওই দেখুন!
মাই গুডনেস! বংকুবিহারী চমকে উঠে তাকালেন সেদিকে। পুঁতির বডিটা দুলছে। ভয় পাওয়া গলায় বলেন, ফের, কিছু করার নেই। উই আর হেল্পলেস! দা নেচার ইজ বিয়ন্ড দা রিচ অফ এনি হিউম্যান ল।
ব্ৰজহরি উদাত্ত স্বরে বললেন, আস্তানাঘরের ছাদে উঠব বেগতিক দেখলে। যদি দেখি, সেখানেও জল উঠছে, গাছে গিয়ে চাপব। পরস্পরকে হেল্প করব। কোঅপারেশন হল মানুষের টিকে থাকার মূল কথা। দা রুট অফ হিউম্যান একজিটেন্স। চলে আসুন! নেচারকে জয় করার ক্ষমতা মানুষের আছে। ভাববেন না!
বংকুবিহারী পা বাড়িয়ে বললেন, ট্যাবলেট দেবেন বলছিলেন।
দেব। আসুন। কর্নেলসায়েব! কী দেখছেন? ইসমাইলকে পালাতে দেখছেন নাকি?
কর্নেল একটা উঁচু লাইম-কংক্রিটের চাঙড়ে উঠে চোখে বাইনোকুলার রেখে উত্তরে কিছু দেখতে দেখতে বললেন, মৌরীনদীর ব্রিজটা খুঁজে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে, ভেঙেচুরে ভেসে গেছে।
বংকুবিহারী খাপ্পা হয়ে বললেন, যাক! ধ্বংস হয়ে যাক সবকিছু। আর পারা যায় না মশাই।
ব্ৰজহরি তার কাঁধে হাত রেখে পা বাড়ালেন। বললেন, পাপ জমেছিল পৃথিবীতে। ধুয়ে মুছে যাচ্ছে যাক। আবার সব নতুন হয়ে যাবে। সৃষ্টি স্থিতি, তারপর প্রলয়। আবার সৃষ্টি। আবার স্থিতি। আবার প্রলয়। দা ইটারন্যাল প্রসেস!
গমগমে কণ্ঠস্বরে এসব কথা বলতে বলতে চিকিৎসক ও আইনবক্ষক আস্তানাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
কর্নেল চাঙড় থেকে নেমে পুঁতিকে টেনে উঁচুতে এনে রাখলেন। তারপর চোখে পড়ল, ওর ডান হাতের মুঠিতে কী একটা আটকে আছে। দেখলেন, কিন্তু কিছুই করলেন না। একফালি কাপড়ের মতো কিছু পুঁতি খামচে ধরেছিল মরিয়া হয়ে চাপা নিঃশ্বাস ফেলে কর্নেল আস্তানাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। হয়তো ব্রজহরি ও বংকুবিহারীর থিওরিই ঠিক। কোনো এক ইসমাইল ডাকু একটি কুকুর এবং দুটি চেনা মেয়েকে খুন করে পালিয়ে গেছে। কারণ এখানে দারোগাবাবুকে আবিষ্কার করে ভড়কে গিয়েছিল সে, যে-দারোগাবু তাকে ধরার জন্য হানা দিয়েছিলেন দুর্গম এক গ্রামে।
কিন্তু–
কর্নেল থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। চাক্কুর কাছে নাকি একটি স্প্রিংয়ের ড্যাগার ছিল। কাল রাতে সেটা তার ব্যাগ থেকে উধাও হয়েছে। যথেষ্ট অন্ধকার ছিল বারান্দায়। ইসমাইলের পক্ষে তা হাতানো হয়তো অসম্ভব ছিল না। কিন্তু–
আরও একটা কিন্তু আছে। সেটাই মারাত্মক। সব জটিল করে দিচ্ছে সেটা। সমস্যা হল, জল না নামলে আপাতত কিছু করা যাবে না। কর্নেল আবার পা বাড়ালেন। আগে ভাবতে পারেননি বন্যাটা এত বেশি হবে।…
.
খিচুড়ি! খিচুড়ি
ঘনশ্যাম রুদ্র বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। তাঁর পাশে চাক্কু। চাক্কুর কাঁধে তার হাত। ওপাশে বাউল হরিপদ। ঘনশ্যাম চাপা স্বরে চাক্কুকে বোঝাচ্ছিলেন, এই কথাটা তোমার বোঝা উচিত বাবা! যখনই কোনো বিপদ আসে, সেই বিপদের প্রথম ধাক্কাটা তোমাদের মতো গতর-খাঁটিয়ে মানুষের গায়েই লাগে। কেন এমন হয়? স্বীকার করছি ওই শাওনি মেয়েটি বেশ্যা ছিল। কিন্তু কেন সে বেশ্যা হয়েছিল? খুঁজে দেখলেই কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুবে। নিশ্চয়ই কেউ তাকে ঠকিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে একটা সুস্থ সংসার থেকে টেনে এনে মুখ্যত বাগানপাড়ার গলিতে ঢুকিয়েছিল। তারপর আর হতভাগিনী সেখান থেকে বেরুনোর রাস্তা খুঁজে পায়নি। তারপর
হরিপদ বলে উঠল বাবুমশাই, তাহলে একটা কথা বলি?
বলো, বলো, ঘনশ্যাম উৎসাহে সোজা হয়ে বসলেন।
হরিপদ একটু হাসল। …ওই যে মেজিকওলারা টাকার মেজিক দেখিয়ে বলে, বাবাসকল! মা সকল! সব মিথ্যে, পেট সত্যি। পেট! বাবুমশাই, পেট!
অসাধারণ বলেছ তুমি। ঘনশ্যাম সায় দিলেন। পেট– মানে, ক্ষিদে। এই যে তুমি বাউল হয়ে বেড়াচ্ছ হরিপদ, তুমি যে গুরু-গুরু করে স্লোগান দিচ্ছ, হেঁয়ালি আওড়াচ্ছ– আমার গায়ে হাত দিয়ে বলো, ক্ষিদে পেলে তোমার গুরু-টুরু তত্ত্ব-টত্ত্ব কোথায় থাকে? তখন কারুর কারুর কাছে দুমুঠো খাওয়ার জন্য সাধতেই হয়।
হরিপদ বিব্রতভাবে জিভ কেটে বলল, মাধুকরী বাবুমশাই, মাধুকরী!
হঠাৎ রেগে গেলেন ঘনশ্যাম।…চালাকি! পলাতক মনোবৃত্তি! এই চাক্কু রিকশো চালিয়ে খায়। সেও একজন যোদ্ধা। আর তুমি হরিপদ, তুমি কাপুরুষ। ছদ্মবেশী ভিখিরি। অলস, অকর্মণ্য, শ্রমবিমুখ, পরান্নভোজী!
আরও কিছু বলতেন, বংকুবিহারী ও ব্ৰজহরি এসে গেলেন। ব্রজহরি প্রাঙ্গণে। দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আস্তানাঘর-সংলগ্ন ধসে পড়া ঘরটার দিকে একবার তাকালেন। বললেন, গতরাতে ওই ঘরটাই ধসে পড়েছিল কি না দেখুন তো দারোগাবাবু!
বংকুবিহারী বিরক্তমুখে বললেন, আমি কী করে বলব? আমার মাথায় অন্য চিন্তা। আমারই উপস্থিতিতে দু-দুটো খুন করে পালিয়ে গেল ইসমাইল ডাকু। দিস ইজ এ চ্যালেঞ্জ।
হরিপদ তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।…হা ডাক্তারবাবু, ওই সেই ঘর। ওখানেই ডেকচিটা চাপা পড়েছে।
ব্ৰজহরি বললেন, ক্ষিদেয় নাড়ি জ্বলে যাচ্ছে। আপনারা আসুন, হাত লাগান। ইট-ফিট সরিয়ে খিচুড়ির ডেকচিটা উদ্ধার করা যাক। আসুন, আসুন সবাই!
বংকুবিহারী হাত বাড়িয়ে বললেন, ক্যাপসুল! আগে প্রত্যেককে একটা করে ক্যাপসুল দিন–ইউ প্রমিল্ড, মাইন্ড দ্যাট!
হ্যাঁ– ক্যাপসুল। মাল্টিভিটামিন এনার্জি ক্যাপসুল! বলে ব্ৰজহরি ব্যস্তভাবে বারান্দায় উঠলেন। ওষুধের ব্যাগটি যথাস্থানে ছিল বর্ষাতি ঢাকা। একটা কৌটো বের করলেন ব্যাগ থেকে। প্রত্যেককে বিলি করলেন এবং নিজেও একটা গিলতে গেলেন– গিয়েই বললেন, কিন্তু জল? জল ছাড়া ট্যাবলেট গেলা এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। কারণ আমার গলা শুকিয়ে আছে। আপনাদের কী অবস্থা?
সবার আগে ঘনশ্যাম বারান্দায় পুঁতে রাখা জালার ঢাকনা তুলে বললেন, প্রচুর জল! চলে আসুন সব।
ব্ৰজহরি হাঁ হাঁ করে উঠলেন, কী করছেন, কী করছেন মশাই? ওতে এক বেশ্যার নোংরা পদার্থ মেশানো আছে! কী করে সব ভুলে যান বুঝি না! বরং বানের জল শুদ্ধ।
ঘনশ্যাম গ্রাহ্য করলেন না। বারান্দার দেয়ালের তাকে রাখা বাঁশের চুপড়ি থেকে একটি মাটির ভাঁড় নিয়ে সহাস্যে জালার জল তুলে কোঁৎ করে ক্যাপসুলটি গিললেন। বংকুবিহারী সন্দিগ্ধ স্বরে বললেন, কী বুঝলেন হর্ষবাবু?
কী বুঝব? বিশুদ্ধ জল।
কোনো গন্ধ-টন্ধ।
নাঃ! ঘনশ্যাম প্রাঙ্গণে নামলেন। বললেন, চাক্কু! হরিপদ! ওঁরা বাবু। ওঁরা গন্ধ শুঁকে জল পান করেন। তোমরা বাবু নও। যাও, দেরি কোরো না। ক্যাপসুল খেয়ে আমাদের শিগগির কাজে নামা দরকার।
কর্নেল প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখছিলেন। ঘুরে একটু হেসে বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনি আশা করি শিবান্ধু কথাটির সঙ্গে পরিচিত? প্রাচীন ভারতে শিবাম্বুপান প্রচলিত ছিল। এখনও শিবাম্বু চিকিৎসা পদ্ধতি দেশে চালু আছে। বংকুবিহারী লাফিয়ে উঠলেন।…দ্যাটস্ রাইট, দ্যাটস্ রাইট! মনে পড়ে গেছে।
ব্ৰজহরি তেতেমুখে বললেন, ধুর মশাই! সে তো স্ব-মূত্র পান! আপনি যতই বিদ্যে ফলান, আমি ও পথে নেই!
বলে ব্ৰজহরি সোজা ভাঙা দেউড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। বোঝা গেল, শুদ্ধ বানের জলেই কাপসুল গিলবেন। ক্লারা অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। বলল, কর্নেল। বিষয়টি সম্পর্কে আমি জানতে চাই। কারণ আমি প্রাচীন ভারত সম্পর্কে অত্যন্ত কৌতূহলী।
প্রদোষ বাঁকা মুখে বলল, ক্লারা! ইউ আর আ ম্যাড গার্ল! হি ইজ টকিং নসেন্স, ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড?
ক্লারা তাকে অগ্রাহ্য করে কর্নেলের কাছে এল। কর্নেল তাকে শিবায়ু চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে থাকলেন। ততক্ষণে বংকুবিহারী জালার জলে ক্যাপসুল গিলেছেন। তার দেখাদেখি হরিপদ এবং চাক্কুও গিলেছে। ঘনশ্যাম ধসে পড়া ঘরের ইট ও লাইমকংক্রিট সরানোর কাজে হাত দিয়েছেন। বংকুবিহারী চাঙ্গা হয়ে হরিপদ ও চাক্কুকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর পাশে গেলেন। ধুপধাপ ধড়াস শব্দে ধ্বংসপ জড়ো হতে থাকল নিচের প্রাঙ্গণে। প্রদোষ পা বাড়িয়ে বলল, আই মাস্ট ফলো দা ফিজিশিয়ান; এবং দেউড়ির দিকে এগিয়ে গেল ক্লারা মুগ্ধভাবে শিবান্ধুতত্ত্ব শোনার পর জালার জলে ক্যাপসুল গিলল। এই সময়। কর্নেলও জালার কাছে গেলেন। তারপর চাপা স্বরে বললেন, যাই হোক, শেষ কথাটি তোমাকে বলা উচিত ডার্লিং। শাওনি সত্যিই তেমন কিছু করেনি– করতে পারে না। কারণ তার এটুকু বুদ্ধি ছিল যে এই জলবন্দী অবস্থায় জালার জলটা তাকেও খেতে হবে। আসলে ওটা তার ক্ষোভের প্রকাশ ছাড়া কিছু নয়!
ক্লারা বলল, হ্যাঁ– সে বিষয়ে আমিও এখন একমত হলাম।
কর্নেল ক্যাপসুলটি জলের সাহায্যে গিলে বললেন, আরও একটা কথা। এই দরগায় শাওনি এসেছিল মানত দিতে। তুমি জানো না, এদেশে বেশ্যারা ধর্ম মানে। ঠাকুর দেবতা পিরে ভক্তি করে। প্রাণের দায়েই হয়তো করে। কাজেই পিরের দরগার জল নোংরা করার মতো সাহস তার থাকাই সম্ভব নয়।
ক্লারা হাসল। সঠিক কথা। জলে ইউরিনের গন্ধ পেলাম না।
বংকুবিহারী ডাকছিলেন, কৈ– সব আসুন! হাত লাগান! কর্নেল, মেমসাহেব! ডাক্তারবাবু! প্রদোষবাবু!
কর্নেল ও ক্লারা ব্যস্তভাবে এগিয়ে গেলেন। ব্রজহরি ও প্রদোষ এসে পড়লেন। পুরোদমে খিচুড়ি উদ্ধার চলতে থাকল। প্রায় আধ ঘণ্টা পরে ডেকচির একাংশ দেখতে পাওয়া গেল। আরও পনের মিনিট পরে পুরোটা বেরুল। হরিপদ, চাক্কু ও ঘনশ্যাম বিজয়দর্পে সেটি বয়ে এনে বারান্দায় রাখলেন। প্রকাণ্ড ডেকচিটির গায়ে প্রচুর চুণসুরকিকাদা মেখে আছে। ব্ৰজহরি উদ্বোধনের ভঙ্গিতে ঢাকনাটি তুললেন। তারপর আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন, ভেরি গুড! সবাই ঝুঁকে পড়লেন। দেখলেন এবং আনন্দে চঞ্চল হলেন সুঘ্রাণে।
এইসময় দরবেশের ঘরের দরজা খুলে গেল। অন্ধ দরবেশ দরজায় দাঁড়িয়ে একটু কাশলেন। তারপর কাতর স্বরে বললেন, বাবাসকল মা সকল! আমিও ভুখা আছি। দয়া করে আমাকেও দুমুঠো দেবেন।
হবে না! বংকুবিহারী তেড়ে গেলেন। ভেংচি কেটে বললেন, ভুখা আছি! ঘরভর্তি চালডাল একটা কুমড়ো পর্যন্ত!– আবার বলা হচ্ছে ভুখা আছি!
ব্ৰজহরি বললেন, আপনি বড় স্বার্থপর দরবেশসায়েব! সাধুমহাত্মা লোকেদের এমন স্বভাব কখনও দেখিনি– এই প্রথম দেখলাম। তখন আপনাকে কত করে সাধলাম। টাকা দিতে চাইলাম পর্যন্ত।
ঘনশ্যাম বললেন, আহা! অন্ধমানুষ! ছেড়ে দিন।
চাক্কু বাঁকামুখে বলল, ওনার চ্যালা চুল্লু আছে না? চুল্লুকে হুকুম করলেই তো মুখের আহার এনে দেবে।
দরবেশ হাসলেন। চুল্লুকে যে আপনারা বাবাসকল মা সকল খেপিয়ে দিয়েছেন! চুল্প কথা শুনছে না। খুনখারাপি করতে শুরু করেছে। করেনি? দয়া করে আর ওর নাম মুখে আনবেন না। আমিও আনব না। দুমুঠো আমাকেও দেন। তার বদলে থালা-বাসন যা লাগে আমি দিচ্ছি। সিন্দুকে অনেক থালা মজুত আছে। বাবাসকল, মা সকল! এসব থালা কতকালের পুরনো জানেন? সেই যখন বাদশা মুর্গিন খাঁর আমল।
ব্ৰজহরি ব্যস্তভাবে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। থালা দিন। তাহলে আপনাকেও দু মুঠো দেব।
দরবেশ বললেন, আপনার গলা শুনে মনে হয়, আপনার মনে ভক্তি আছে। আসুন বাবা, আপনি আসুন। অন্য কাউকে ঘরে ঢুকতে দেব না। আমি অন্ধ হলেও খোঁড়াবাবার দয়ায় সব দিনবরাবর নজর হয় আমার। আপনি আসুন। কিন্তু হুঁশিয়ার, অন্য কেউ ঘরে ঢুকলে কলজেয় চিমটে বিঁধিয়ে দেব বলে দিচ্ছি।
ব্ৰজহরি ভয়ে-ভয়ে ভেতরে ঢুকলেন। ঘরটি অপ্রশস্ত। ভ্যাপসা গন্ধটা অস্বস্তিকর। একটা তক্তপোশ, তাতে নোংরা বিছানা। একপাশে একটা কাঠের সিন্দুক। আবছা অন্ধকার। কোনো জানালা নেই। শুধু একটি ঘুলঘুলি আছে। পেছন দিকের দেয়ালে– উঁচুতে। দরবেশ দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। চিমটে বাগিয়ে ধরেছেন। বললেন, সিন্দুকে তালা নেই। খুলে থালা বের করুন। আপনারা কজন আছেন?
ব্ৰজহরি আড়ষ্টভাবে বললেন, সাতজন। আপনাকে নিয়ে আটজন।
নখানা বের করুন।
কেন দরবেশবাবা?
চুল্লুর ভাগ। দরবেশ চাপা স্বরে বললেন। চুলুরও ক্ষিদে পেয়েছে। খেতে না পেলে আরও রেগে যাবে।
গুনে-গুনে অগত্যা নখানা থালা বের করলেন ব্ৰজহরি। বারান্দায় গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, থালাগুলো দেউড়ির ওদিক থেকে ধুয়ে আনো হরিপদ। উঁহু, একা যেও না। চাক্কু যাও!
ঘনশ্যাম বললেন, আমিও যাই ওদের সঙ্গে। এখন থেকে পদে-পদে সতর্ক হওয়ার দরকার।
তিনজনে চীনেমাটির সুদৃশ্য থলাগুলো নিয়ে ধুতে গেলেন। দরবেশ দরজার মুখে বসে বুকে চিমটেটি ঠুকতে শুরু করলেন। ঝুনঝুন শব্দ হতে থাকল। ঠোঁট কাঁপতে লাগল। বিড়বিড় করে কিছু আওড়াচ্ছেন। ক্লারা চাপাস্বরে কর্নেলকে বলল, উনি প্রার্থনা করছেন!
কর্নেল কিছু বললেন না। গাছপালার ফাঁক দিয়ে ঝকমকে রোদ এসে বারান্দার কিছু অংশ এবং প্রাঙ্গণে পড়েছে। চোখে বাইনোকুলার রেখে আকাশ দেখতে থাকলেন। বংকুবিহারী বিরক্ত হয়ে বললেন, কী দেখেন খালি, বুঝি না!
কর্নেল আস্তে বললেন, শকুন!
হোয়াট? বংকুবিহারী আকাশের দিকে তাকালেন।
শকুনরা টের পেয়েছ এখানে তিনটে মড়া আছে। ওরা আসছে। ক্লারা দৌড়ে বারান্দার কোনায় রাখা কিটব্যাগ থেকে প্রদোষের বাইনোকুলারটি খুঁজে নিয়ে এল। চোখে রেখে বলল, কৈ? আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, তোমার কাছে ক্যামেরা আছে ক্লারা?
ক্লারা দুঃখিত মুখে বলল, গাড়ির আসনে রেখেছিলাম। ভেসে গেছে গাড়ির সঙ্গে। প্রদোষ এজন্য দায়ী। শীঘ্র. নামতে বলল গাড়ি থেকে। আমিও ভুলে গেলাম। সৌভাগ্যই বলব, এই বাইনোকুলারটি প্রদোষের গলায় আটক থাকায় নিষ্কৃতি লাভ করেছে।
বংকুবিহারী সহাস্যে বললেন, আপনার বাংলাভাষাটা এখনও প্র্যাকটিস হয়নি ম্যাডাম!
ক্লারা জবাব দিতে যাচ্ছিল, থালাসহ দলটি ফিরে আসায় বাধা পড়ল। ব্ৰজহরি বললেন, আগে কথামতো দরবেশবাবা আর তার ইয়ে– অর্থাৎ অশরীরী আত্মাটির জন্য দুটো থালা আমাকে দিন।
খিচুড়ি একেবারে আঠা। তাতে কারুর আপত্তি নেই। দরবেশ থালাদুটি হস্তগত করেই তক্তাপোশে রাখলেন এবং দরজা বন্ধ করে দিলেন। চুল্লুর সঙ্গে আহার করবেন বোঝা গেল। এবং চুল্লু বহিরাগতদের দেখা দেবে না, তাও বোঝা গেল।
বারান্দায় বসে চটাস চটাস হাপুস হুপুস শব্দ করে ক্ষুধার্ত লোকগুলি খেতে শুরু করল। কর্নেল দ্রুত থালা শেষ করে বললেন, দারোগাবাবু! এবার আরেকটা কাজে হাত লাগানো দরকার। শাওনি ও পুঁতির বডি দুটো তুলে এনে পাশের ঘরে রাখতে হবে। ওই শুনুন! গাছের ডগায় শকুন বসল।
বংকুবিহারী ঢেকুর তুলে বললে, ছেড়ে দিন!
কর্নেল এঁটো থালা ধুতে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিলেন। বললেন, ভুলে যাবেন না–এটা মার্ডার। বডি পোস্টমর্টেম করতে হবে। কেসডায়েরি লিখতে হবে। খুনীকে খুঁজে বের করতে হবে। আপনার অনেক দায়িত্ব।
বংকুবিহারী বিরসমুখে বললেন, এখন তো ফ্লাড মশাই! ফ্লাডের জল কি সহজে নামবে ভাবছেন? ততদিনে বডি পচে ভুট হয়ে যাবে। আর খুনী তো ইসমাইলডাকু! তাকে যথাসময়ে অ্যারেস্ট করা যাবে। এখন ওসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।
হরিপদ এঁটো থালা নিয়ে শূন্য ডেকচিতে উঁকি দিচ্ছিল। ব্ৰজহরি বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল নেড়ে বললেন, কী দেখছিস বাবা? সব মুছে-টুছে পরিষ্কার করে সমানভাগে ভাগ করে দিয়েছি।
হরিপদ এঁটো হাত ঢুকিয়ে বলল, গুরুর ইচ্ছে ডাক্তারবাবু! তলায় পোড়াটুকুন আছে। ছাড়ি কেন?
ক্লারা খুশি মুখে খাচ্ছিল। প্রদোষ তেলোমুখে, ক্লারা বলল, সুন্দর! অসাধারণ। খিচুড়ি! সত্যই সুস্বাদু খিচুড়ি!
ব্ৰজহরি শুধরে দিলেন। হল না। ম্যাডাম! খিচুড়ি, খিচুড়ি!…