জয়ন্ত চৌধুরি
অরিজিৎ লাহিড়ি ফ্ল্যাটটার চাবি নিয়ে গিয়েছিলেন। ভেতরে ঢুকে আলো জ্বেলে দিলেন। প্রথমে বসার ঘর। তারপর কিচেন এবং ডাইনিং। তার লাগোয়া বেডরুম। নেহাত দু’ঘরের ছোট্ট ফ্ল্যাট। কর্নেল ডাইনিংয়ে ঢুকলেন। অরিজিৎ বললেন, “আগে বেডরুমটা দেখে নিলে ভাল হত।”
কর্নেল হাসলেন। “তোমার মাথার ভেতর জল পড়ার শব্দ। কাজেই আগে বেসিনটা দেখে নিই।”
বেসিনটার কাছে গিয়ে তিনি ট্যাপ খুলে দিলেন। খুব জোরে জল পড়তে থাকল। জলের শব্দটা অদ্ভুত মনে হল আমার। জল কি কোনও কথা বলছে? কর্নেল যেন সেই কথা শুনছিলেন। কাছে গিয়ে বললাম, “কী বুঝছেন? জল কি কিছু বলছে?”
কর্নেল আমার রসিকতা গ্রাহ্য করলেন না। গম্ভীরমুখে বললেন, “এই দেয়ালের ওধারে একজন মানসিক রোগী থাকলে শব্দটা তার পক্ষে অসহ্য। হতেই পারে। হয়েছেও বটে। অরিজিৎ! তুমি কী বলতে চেয়েছ, বুঝতে পারছি।”
অরিজিৎ একটু অবাক হয়ে বললেন, “আমি কিছু বলতে চেয়েছি কি না আমি এখনও নিজেই জানি না, কর্নেল!”
কর্নেল বললেন, “ডার্লিং! তোমাকে বলেছি, আমরা নিজেরাই জানি না যে আমরা কী জানি!”
“একটু খুলে বললে বুঝতে পারব।”
কর্নেল ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। “কেউ চেয়েছিল মিসেস কাপাড়িয়া উত্তেজিত হয়ে হইচই বাধান এবং বেসিন বন্ধ করতে বলুন। তার মানে, সে চেয়েছিল সমীরবাবুর ডেডবডির কথা জানাজানি হোক। এবং সে জানে, মিসেস কাপাড়িয়া মানসিক রোগী।”
অরিজিৎ আস্তে বললেন, “ঠিক এভাবে কথাটা না ভাবলেও এ ধরনের একটা প্রশ্ন আমার মাথায় ছিল। সম্ভবত কেউ ভোরের দিকে এ ফ্ল্যাটে ঢুকেছিল।”
বললাম, “সে কী করে ঢুকবে? চাবি ছাড়া
আমাকে থামিয়ে কর্নেল বললেন, “ঠিক বলেছ জয়ন্ত! চাবি যদি সমীরবাবুর কাছেই থাকে, কেউ বাইরে থেকে কী করে ফ্ল্যাটে ঢুকবে? অরিজিৎ! এক্ষেত্রে একটা ডুপ্লিকেট চাবি এবং কোনও দ্বিতীয় ব্যক্তির অস্তিত্ব এসে পড়ছে। দ্বিতীয় ব্যক্তি জানে, প্রতিবেশিনী মিসেস কাপাড়িয়া মানসিক রেগী। এবার প্রশ্ন হল, কে সে? কেনই বা সে ভোর ছটায় এই ফ্ল্যাটে ঢুকতে এল? কী কাজ ছিল তার? ধরে নিচ্ছি, পুলিশের পাল্লায় পড়ার ভয়ে সে নিজে ঘটনাটা জানানোর ঝুঁকি নেয়নি। তাছাড়া তার ফ্ল্যাটে ঢোকা নিয়েও প্রশ্ন উঠত। কিন্তু একটা কাজ তো সে সহজেই করতে পারত। বেরিয়ে এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে প্রতিবেশীদের ডাকাডাকি করে সমীরবাবুর আত্মহত্যার ঘটনা জানাজানি হওয়ার ব্যবস্থা করতে পারত। কিন্তু তা হলে বোঝা যাচ্ছে, সে চুপিচুপি এসে ঢুকেছিল। বেসিন খুলে দিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে গিয়েছিল।”
কর্নেল বেডরুমে ঢুকলেন। বেডরুমটা বেশ বড়। অরিজিৎ আলো জ্বেলে তিনটে জানালাই খুলে দিলেন। জানালায় পুরু নস্যি রঙের পর্দা। গোল নিচু টেবিলে হুইস্কির বোতল, একটা গ্লাস, একটা সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার দেখতে পেলাম। কর্নেল হুইস্কির বোতলটা তুলে নিয়ে দেখতে থাকলেন। তারপর বললেন, “জনি ওয়াকার কোম্পানির স্কচ। এয়ারপোর্টের ডিউটি ফ্রি শপ থেকে সদ্য কেনা হয়েছে।
অরিজিৎ দ্রুত বললেন, “আমরা লক্ষ করেছি। এতে কোনও অস্বাভাবিকতা আছে বলে মনে হয়নি। সম্ভবত সমীরবাবুর কোনও বন্ধু বিদেশ থেকে ফেরার সময় এটা এয়ারপোর্টে কিনেছেন এবং উপহার দিয়েছেন। কিংবা সমীরবাবু কোনও পরিচিত লোকের কাছে কিনে নিতেও পারেন।”
কর্নেল ঘরের ভেতরটা চোখ বুলিয়ে দেখার পর একটা জানালার কাছে গেলেন। উঁকি মেরে কিছু দেখে সরে এলেন। মেঝের কার্পেটে শুকনো একটু রক্তের ছোপের দিকে অরিজিৎ তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। কর্নেল শুধু বললেন, “হু!” ..
অরিজিৎ বললেন, “বডির পজিশন ফটোতে দেখলে বুঝতে পারবেন। তবে সরেজমিনে দেখানো যাক। এখানটায় বাঁপাশে কাত হয়ে”
কর্নেল হাত তুলে বললেন, “সে তো বলেছ। কিন্তু অরিজিৎ, আমার মাথার ভেতরও বেসিনে জলপড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।”
কর্নেলের মুখে কোনও কৌতুকের ছাপ দেখলাম না। অরিজিৎ হাসতে হাসতে বললেন, “হ্যাঁ, দ্যাটস্ দা পয়েন্ট।”
বললাম, “সেই দ্বিতীয় ব্যক্তি যদি সমীরবাবুর আত্মহত্যার ঘটনা জানাজানি হওয়ার জন্য বেসিন খুলে দিয়ে থাকে, তার উদ্দেশ্য কিন্তু সফল হয়নি। সমীরবাবুর মা আসার পর জানাজানি হয়েছে। এটা কি কোনও পয়েন্ট নয়?”
অরিজিৎ বললেন, “মিসেস কাপাড়িয়া কোনও কিছুতে হইচই শুরু করলে তার স্বামী তাঁকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেন। এটা আসুরিক চিকিৎসা বলতে পারেন জয়ন্তবাবু! কিন্তু এ ছাড়া ভদ্রলোকের তত আর কিছু করার নেই।”
কর্নেল আবার হুইস্কির বোতলটার কাছে গেলেন। “অরিজিৎ, সমীরবাবু নিশ্চয় স্কচ খাননি। কোথাও সোডাওয়াটারের বোতল দেখলাম না। জলের বোতলও না। ডাইনিং টেবিলেও জলের জগ নেই।” বলে তিনি দাড়ি মুঠো । করে ধরলেন। আপনমনে বিড়বিড় করলেন, “র হুইস্কি? কেন? অন্তত একটা জলের গ্লাসও থাকা দরকার ছিল! নেই! কেন নেই?”
অরিজিৎ তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, “আমাদের অফিসারদের থিওরি হল, এই গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে সমীরবাবু বেসিনে গিয়ে জল মিশিয়েছেন।”
আমি বললাম, “ফ্রিজের ভেতর জলের বোতল ঢুকিয়ে রেখে এসে সুইসাইড করতে পারেন। ফ্রিজ দেখা উচিত ছিল।”
অরিজিৎ একটু হেসে বললেন, “ফ্ল্যাটে কোনও ফ্রিজ নেই। ওনার প্রশান্ত স্যান্যাল কোনও কারণে ফ্রিজ কেনেননি। অনুমান করা চলে, পরে কিনবেন যখন এসে পাকাপাকিভাবে থাকবেন। ফ্ল্যাটের ভেতরটা খুঁটিয়ে লক্ষ করুন জয়ন্তবাবু! বহু দরকারি আসবাব কিংবা গেরস্থালির সরঞ্জাম নেই।”
এতক্ষণে সেটা আমার চোখে পড়ল। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, “জয়ন্তকে আমি বরাবর বলি, দক্ষ রিপোর্টারের থাকা চাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর প্রচণ্ড কৌতূহল। সাংবাদিকের পেশা নিছক কলমবাজির নয়, আ রিয়্যাল জর্নালিস্ট ইজ আ রিয়্যাল অবজার্ভার! জয়ন্তের ব্যাপারটা যাকে বলে ক্রিয়েটিভ জার্নালিজম। তাই না জয়ন্ত? দশ পার্সেন্ট দুধে নব্বই পার্সেন্ট জল মেশানো। জল!”
আমাকে তর্কের সুযোগ না দিয়ে কর্নেল ডাইনিংয়ে ঢুকে গেলেন। আবার বললেন, “জল একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। তবে মরুভূমিতে প্রচণ্ড তৃষ্ণায় জলের মরীচিকা দেখা যায়। আমরা জলকে সেভাবেই দেখছি কি না জানি না। অরিজিৎ! ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখ। হুইস্কির তিনভাগের একভাগ মাত্র পান করা হয়েছে। প্রতিবার হুইস্কি ঢেলে সমীরবাবু বেসিনে এসে জল মিশিয়েছেন– দ্যাটস ইওর অফিসার্স ভার্সান। কিন্তু মদ্যপানে অভ্যস্ত কোনও লোক এই ঝক্কি পোহবে কেন? ওই দেখ, কিচেনের ভেতর দেয়াল আলমারিতে জলের জগ, দুটো গ্লাস–আরও দেখ, তিনটে ছোটবড় দিশি হুইস্কির খালি বোতল আছে।”
কর্নেল গ্লাসদুটো নামিয়ে পরীক্ষা করলেন। তারপর মদের বোতলগুলোও। খুঁটিয়ে দেখলেন। বারবার শুঁকলেন। তারপর মাথা নেড়ে সরে এলেন। বললেন, “ছিটেফোঁটা জলের চিহ্নও নেই। গত রাতে এগুলোতে জল ব্যবহার করা হলে তার চিহ্ন এখনও থাকত। অক্টোবরে আবহাওয়া শুকনো নয়। গ্রীষ্মকাল হলে বরং কথা ছিল।”
অরিজিৎ বললেন, “তা হলে অফিসার্স ভার্সানই ঠিক।”
“নাহ্।” কর্নেল মাথা নাড়লেন। “বলেছি, মদ্যপানে অভ্যস্ত লোকের পক্ষে এটা অস্বাভাবিক। বিশেষ করে বিদেশী মদ বা বিখ্যাত স্কচের ক্ষেত্রে সমীরবাবুর মতো লোকের প্রায় একটা রিচুয়াল পালন করবেন তাতে সন্দেহ নেই। ঘনিষ্ঠ কাউকে তো ডাকবেনই। কলোনিয়াল হ্যাংওভারের জের, ডার্লিং! জনি ওয়াকার স্কচ বলে কথা!”
“কিন্তু যে সুইসাইড করবে, সে–”
“অরিজিৎ! তোমাদের থিওরি, মদ্যপানের পর মাতাল অবস্থায় হঠাৎ বেঁকে, মুখে সমীরবাবু সুইসাইড করে ফেলেছেন?
অরিজিৎ আস্তে বললেন, “দ্যা রাইট। কিন্তু আপনার থিওরি কী দাঁড়াল তা হলে?”
“ওই মদের বোতল আর গ্লাসের সঙ্গে সমীরবাবুর সম্পর্ক নেই। সিগারেট আর লাইটারের সম্পর্ক থাকতে পারে।”
“হোয়াট?”
“আমার ভুল হতেই পারে। তবে দোজ টু থিংস আর পসিবলি প্ল্যান্টেড; সমীরবাবুকে গুলি করে মারার পর–”
অরিজিৎ দ্রুত বললেন, “মার্ডার?”
“আমার তাই মনে হচ্ছে।” কর্নেল এতক্ষণে চুরুট ধরালেন। “বিশেষ করে বডি বাঁপাশে কাত হয়ে পড়ার ব্যাপারটাও গুরুত্বপূর্ণ। নিজের ডানকানের ওপর নিজে গুলি চালালে সমীরবাবুর বডি ডানপাশেই পড়ার চান্স ছিল। অন্য কেউ গুলি করলে তবেই বাঁপাশে বডি কাত হয়ে পড়তে পারে। পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে গুলির ধাক্কায় বডি বাঁপাশেই কাত হয়ে পড়বে। তাছাড়া যে গুলি করছে, সে চায় না ভিকটিমের বডি তার ওপর পড়ুক। সে রিভলভারের নল মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করলে চাপও দেবে–এটা তার সহজাত বোধের প্রক্রিয়া।”
আমি বললাম, “আপনি বলছেন স্কচের বোতল আর গ্লাসটা খুনীই সাজিয়ে রেখেছে। কিন্তু পোস্টমর্টেমে সমীরবাবুর পেটে যদি মদ পাওয়া যায়?”
কর্নেল হাসলেন। “পাওয়া যেতেই পারে। তবে তা জনি ওয়াকার স্কচ কি না পরীক্ষার উপায় এখনও উদ্ভাবিত হয়নি জয়ন্ত! বিশুদ্ধ অ্যালকোহলের কোনও দেশ-বিদেশ নেই। যে-কোনও খাদ্য-পানীয় পাকস্থলীতে গেলেই জাত খুইয়ে বসে। তুমি মার্কিন কপি খেয়েছ না ধাপার কপি খেয়েছ, পাকস্থলী তার প্রমাণ লোপ করে। বিশেষ করে বারোঘণ্টা পরে তো কপি আর কপিই থাকে না। সমীরবাবুর পাকস্থলীর বিলিতি অ্যালকোহল বারো ঘণ্টা পরে পেডিগ্রি খোয়াতে বাধ্য। তবে আমার মতে, ওঁর পাকস্থলীতে বিলিতি অ্যালকোহল ঢোকেনি।”
কর্নেল বসার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। অরিজিৎ বেডরুমের জানালা বন্ধ করতে গেলেন। আমি বললাম, “তা হলে বোতল আর গ্লাসে খুনীর হাতের ছাপ থেকে গেছে।”
কর্নেল বললেন, “খুনী অত বোকা নয়। তা ছাড়া পুলিশ অফিসাররা ও দুটো জিনিস নাড়াচাড়া করেছেন। আমিও করলাম। তবে রিভলভারে সমীরবাবুর আঙুলের ছাপ যাতে পাওয়া যায়, তার ব্যবস্থা খুনী করে রেখেছে। সিওর।”
ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে দেখি এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে পাশের ফ্ল্যাটের দরজায়। অরিজিৎ তাকে চড়া গলায় ইংরেজিতে সম্ভাষণ করলেন, “হ্যালো মিঃ কাপাড়িয়া! আপনার মিসেস কেমন আছেন?”
মিঃ কাপাড়িয়া করুণ হাসলেন। “সারাদিন ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি।”
অরিজিৎ কর্নেলকে বললেন, “ওঁকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন নাকি?”
কর্নেল বললেন, “উনি কানে কম শোনেন।”
অরিজিৎ হেসে ফেললেন। “তবে চোখে ভালই দেখেন।”
কর্নেল মিঃ কাপাড়িয়ার উদ্দেশে গলা চড়িয়ে বললেন, “আপনি কি মর্নিংওয়াক করেন মিঃ কাপাড়িয়া?”
কাপাড়িয়া সায়েব সন্দিগ্ধভাবে অরিজিতের দিকে তাকালেন। অরিজিৎ বললেন, “উনি সি বি আই অফিসার।”
কাপাড়িয়াসায়েব একটু হাসলেন। “তা হলে যা ভেবেছিলাম, তা ঠিক।”
কর্নেল বললেন, “কী ভেবেছিলেন?”
“এ ফ্ল্যাটে সমীরবাবুর আনাগোনা আমার কাছে সন্দেহজনক ঠেকত।”
“কেন?”
কাপাড়িয়াসায়েব একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “জানি না। তবে আমার মনে হত লোকটা ভাল না। কারও সঙ্গে কথা বলত না। কেমন যেন একটা
“কাল ভোরে আপনি কখন মর্নিংওয়াকে বেরিয়েছিলেন?”
“পাঁচটায়। ময়দানে ভিক্টোরিয়ার সামনে কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করি। সাড়ে ছটায় ফিরি।”
“কাল রাত্রে কখন আপনি শুয়ে পড়েছিলেন?”
“সাড়ে নটায়। আমি রাত্রিজাগা পছন্দ করি না।”
“কাল সন্ধ্যায় বা তারপরে আপনার সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছিল?”
“না, না। কেন?”
“নিছক একটা প্রশ্ন, মিঃ কাপাড়িয়া!” বলে কর্নেল সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। কাপাড়িয়াসায়েব তখনই ফ্ল্যাটে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন।
ফুটপাতে পৌঁছে বললাম, “দারোয়ানকে কিছু জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল, কর্নেল।”
অরিজিৎ বললেন, “অফিসাররা ওকে অনেক জেরা করেছেন। বিশেষ কিছু। জানা যায়নি। এ বাড়িতে অনেক রাত পর্যন্ত লোকেরা যাতায়াত করে। চারতলায় বারোটা ফ্ল্যাট। দারোয়ানের পক্ষে মনে রাখা সম্ভব নয়, কতজন লোক যাতায়াত করেছে। তবে সে গেট বন্ধ করে রাত বারোটায়। খুলে দেয় ভোর পাঁচটায়।”
“গতরাতে সমীরবাবু একা গিয়েছিলেন কি না–”।
“একা।” অরিজিৎ হাসলেন। “তবে আড়াইশো টাকা মাইনের দারোয়ানের কাছে ততবেশি দারোয়ানি আশা করা ঠিক নয়, জয়ন্তবাবু?”
কর্নেল বললেন, “জয়ন্তকে বহুবার বলেছি, হালদারমশাইয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে যাও। গোয়েন্দাগিরি বলতে কী বোঝায়, হাড়ে-হাড়ে ট্রেনিং পেয়ে যাবে।”
চটে গিয়ে বললাম, “কী আশ্চর্য! আমি গোয়েন্দাগিরি করতে যাব কোন দুঃখে? আপনি জোর করে আটকে রেখেছেন এবং টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাই থার্ড পার্সন হিসেবে কিছু প্রশ্ন তুলছি মাত্র। ঠিক আছে, মুখ বুজে রইলাম। কোনও সাংঘাতিক পয়েন্ট মাথায় এলেও চেপে যাব।”
কর্নেল আমার কাঁধে হাত রাখলেন। “ডর্লিং! এ বৃদ্ধের ওপর রাগ করার অর্থ হয় না। শোনো, তুমি যে সব প্রশ্ন তুলছ তা কোনও ক্রাইম ডিটেকশনের ক্ষেত্রে অবশ্যই মূল্যবান প্রশ্ন। কাজেই আমি চাই, তুমি প্রশ্ন তুলবে। কিন্তু যদি দেখ যে আমি তোমার প্রশ্নে কোনও সাড়া দিচ্ছি না, তা হলে জেনো, সেই প্রশ্নের জবাব আমার জানা। কিংবা জানা না হলেও একই প্রশ্ন আমার মনেও রয়ে গেছে।”
অরিজিৎ লাহিড়ি তার জিপের দিকে পা বাড়িয়ে সকৌতুকে বললেন, “জয়ন্তবাবু! কর্নেল মাঝেমাঝে আমাকে নিয়েও একই জোক করে থাকেন। থিং ইট! আমি ডিটেকটিভ ডিপার্টের লোক এবং পুলিশমহলে কিছু সুনাম আছে। অথচ আমাকেও হাস্যস্পদ করে ছাড়েন। পরে বুঝতে পারি হি ইজ কারেক্ট। আমিই ভুল করেছি।”…
রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম। কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে যখন ফিরলাম, তখন সাতটা বেজে গেছে। ষষ্ঠী জানাল, একটু আগে রায়সাহেব এসেছিলেন। বলে গেছেন, “ফোন করব।” কর্নেল চোখ কটমটিয়ে হাঁকলেন। কফি!” ষষ্ঠী বেজার মুখে চলে গেল।
অরিজিৎ বললেন, “কফি খেয়েই সোজা বাড়ি ফিরব। আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।”
কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে দাড়িতে হাত বুলোচ্ছিলেন। চোখ বন্ধ। বললেন, “তোমার মাথার ভেতর বেসিনটা আশা করি বন্ধ হয়েছে।”
“হয়েছে। তবে–
“তবে তুমি কফি খাবার জন্য আমার ঘরে আসোনি অরিজিৎ! তোমার মনে একটা প্রশ্ন উঠেছে। কেন খুনী চেয়েছিল শিগগির সমীরবাবুর সুইসাইডের ঘটনা জানাজানি হোক? তাই না?
“আপনি নাকি অন্তর্যামী। অন্তত এ ধরনের একটা প্রবাদ চালু আছে পুলিশ মহলে। আই এগ্রি।”
আমি না বলে থাকতে পারলাম না, “আজ ভোরে যে ওই ফ্ল্যাটে ঢুকেছিল– মানে, যাকে দ্বিতীয় ব্যক্তি বলা হচ্ছে, সে-ই যে খুনী তার প্রমাণ কী?”
কর্নেল চোখ বন্ধ রেখেই দাড়ি নেড়ে বললেন, “রাইট জয়ন্ত! সঙ্গত প্রশ্ন। হুঁ, প্রমাণ আমার হাতে নেই। কিন্তু একটা থিওরি আছে। আর সেই থিওরি ধরে এগোলে একটা ব্যাখ্যা মেলে। ধরা যাক, খুনীর নাম এক্স। এক্স গতরাতে ওই ফ্ল্যাটে যায়। সে সমীরবাবুর চেনা লোক এবং সে এ-ও জানে, পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস কাপাড়িয়া মানসিক রোগী। ওঁর স্বামী কানে কম শোনেন, সকাল-সকাল শুয়ে পড়েন এবং সকাল-সকাল উঠে মর্নিংওয়াকে যান–এ সমস্ত কিছুই সে জানে। বাড়িটা এল’ প্যাটার্ন। দোতলার তিন নম্বর ফ্ল্যাট সিঁড়ির অন্যপাশে। চার এবং পাঁচ পাশাপাশি। চারে থাকেন কাপাড়িয়ারা। পাঁচে গতরাতে সমীর রুদ্র ছিলেন। এক্স সমীরবাবুকে গুলি করে মেরে ফ্ল্যাটের চাবি নিয়ে চলে যায়। কেন চাবি নিয়ে যায় এর জবাব হতে পারে : খুনটা আত্মহত্যা সাব্যস্ত করার একটা উপায় হঠাৎ তার মাথায় এসেছিল। হ্যাঁ, মদের বোতল আর গ্লাস টেবিলে রাখার কথাই সে ভেবেছিল। গ্লাস কিচেনে পাওয়া যাবে। কিন্তু অতরাতে মদ খুঁজে পাওয়ার সমস্যা। আছে। সব দোকান বন্ধ হয়ে গেছে তখন। যদি বা পাওয়া যায়, যোগাড় করে আনতে গেটে তালা পড়ে যাবে। কাজেই তাকে নিজের স্কচের বোতল নিয়ে ভোরবেলা ওই ফ্ল্যাটে যেতে হয়েছিল।”
অরিজিৎ বললেন, “এবার আমার প্রশ্নটা!”
“এক্স চেয়েছিল ঘটনাটা শিগগির জানাজানি হোক। কেন? এই তো তোমার প্রশ্ন?”
“হ্যাঁ।”
“কসবায় সমীরবাবুর ফ্ল্যাটে তার মা ছাড়া আর কে থাকেন?”
“আর কেউ না।”
কর্নেল চোখ তুলে সোজা হয়ে বসলেন। “এক্স চেয়েছিল, সমীরবাবুর মা খবর পেয়েই ছুটে আসবেন এবং সে সেই সুযোগে কসবার ফ্ল্যাটে গিয়ে ঢুকতে পারবে। ধরা যাক, কোনও গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট সমীরবাবুর কাছে আছে।”
বললাম, “আজ দুপুরেও সেই সুযোগ তার ছিল। সমীরবাবুর মা–”
আমাকে থামিয়ে কর্নেল বললেন, “জনি ওয়াকার স্কচ বলে দিচ্ছে এক্স ওটা এয়ারপোর্টে কিনেছিল বিদেশ থেকে ফেরার সময়। আজ সকালের দিকে তার ফ্লাইট ছিল সম্ভবত। অরিজিৎ! এয়ারপোর্টে তোমরা খোঁজ নাও, কোনও বিদেশযাত্রীর মর্নিং ফ্লাইটের টিকিট বাতিল হয়েছে কি না। তার মানে যে নামে টিকিট ছিল, সেই নামে কোনও লোক প্লেনে চাপেনি এবং ওয়েটিং লিস্টের কাউকে সেই আসনটা দেওয়া হয়েছে কি না। একটা টাইমলিমিট ঠিক করা যাক। অন্তত বেলা দশটা পর্যন্ত যে-সব প্লেন এয়ারপোর্ট ছেড়ে গেছে, সেগুলোর ক্ষেত্রেই দেখা যেতে পারে।”
ষষ্ঠী কফি আনল। অরিজিৎ টেলিফোন তুলে ডায়াল করার পর চাপা গলায় কার সঙ্গে কথা বললেন। তারপর ফোন রেখে কফির পেয়ালা তুলে নিলেন। চুমুক দিয়ে বললেন, “খোঁজ নিতে একটু সময় লাগবে। যাই হোক, সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে জানিয়ে দেব।”
বললাম, “প্লেনের বদলে এক্স যদি ট্রেনে যায়, তা হলে কি এ থিওরি টিকবে না?”
কর্নেল হাসলেন। “জনি ওয়াকার, ডার্লিং! কাজেই আমার ফার্স্ট প্রেফারেন্স প্লেন। তারপর ট্রেনের কথা ভাবা যাবে।”
“মোটরগাড়িকেই বা বাদ দেবেন কেন?”
কর্নেল ও অরিজিৎ একইসঙ্গে খুব হাসলেন। গম্ভীর হয়ে ভাবছিলাম, আমার প্রশ্নে কোনও বোকামি তো দেখছি না। তা হলে ওঁদের হাসির কারণ কী? কর্নেলের চোখে চোখ পড়তে বললেন, “মিঃ এক্সের মোটরগাড়িতে কোথায় যাওয়ার কথা ভাবছ তুমি? মোল্লার দৌড় মসজিদ। এয়ারপোর্ট অব্দি যেতে পারে। আর ট্রেনেই বা কোথায় যাবে সে? মিঃ এক্স যদি বোকা হয়, ট্রেনে ধরে দিল্লি বা বোম্বাই যাওয়ার ঝুঁকি নেবে। আমার ধারণা সে অত বোকা নয়। বরং সে বিকেলে বা সন্ধ্যার একটা ফ্লাইটের চেষ্টা করবে।”
“তা হলে এয়ারপোর্টে খোঁজ নেওয়া উচিত, বিকেল বা সন্ধ্যার ফ্লাইটে সকালের ফ্লাইটের সেই যাত্রী গেছে কি না।”
অরিজিৎ বললেন, “তা গিয়ে থাকলে আমাদের পস্তাতে হবে অবশ্য।”
কর্নেল বললেন, “পস্তানোর আগে জানা দরকার সত্যি তেমন কিছু ঘটেছে কি না। এক : সকালের দিকে কেউ ফ্লাইট মিস বা ক্যানসেল করেছে কি না। দুই : সমীরবাবুর কসবার ফ্ল্যাটে কিছু চুরি গেছে কি না।”
“চুরি গেলে আমরা খবর পেতাম।”
“অরিজিৎ! আবার বলছি, আমরা অনেকসময় জানি না যে, আমরা কী জানি। সমীরবাবুর মা না-ও জানতে পারেন, তার ছেলের কিছু হারিয়েছে কি না।”
অরিজিৎ এক চুমুকে কফি শেষ করে বললেন, “সমীরবাবুর মায়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে দেখব নাকি? অবশ্য এ সময় ওঁর মার মানসিক অবস্থা যাই হোক, চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।”
পকেট থেকে খুদে নোটবই বের করে নাম্বার দেখে ডায়াল করলেন অরিজিৎ। কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও লাইন পেলেন না। অন্য একটা নাম্বারে ডায়াল করে চাপা স্বরে কিছু বললেন। তারপর ফোন রেখে দিলেন। “এক্সচেঞ্জ থেকে খোঁজ নিতে বললাম। একচেঞ্জ যোগাযোগ করিয়ে দেবে। আমাদের পুলিশের কিছু বাড়তি সুবিধে আছে। জানেন তো জয়ন্তবাবু?” অরিজিৎ আমাকে সিগারেট দিয়ে বললেন। সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়েছি, ফোন বাজল। অরিজিৎ ফোন তুলে সাড়া দিলেন, “হ্যাঁ ডিসি ডিডি এ লাহিড়ি বলছি।….কী? ..কিন্তু শুধু ওই লাইনটাই–আই মিন, সমীর রুদ্রের…. হ্যাঁ, হ্যাঁ, দ্যাটস দা নাম্বার।…. সামথিং রং?… ওকে, ওকে! থ্যাংকস।” অরিজিৎ ফোন রেখে গম্ভীর মুখে বললেন, “লাইনটা ডেড। অথচ আজ বেলা এগারোটায় সমীরবাবুর মা কোম্পানির অফিসে ফোন করেছিলেন। কর্নেল! আমি উঠি। ব্যাপারটা দেখা দরকার। আপনাকে আর কষ্ট দেব না। আমি নিজেই গিয়ে দেখছি। সমীরবাবুর মায়ের সঙ্গে কথাও বলছি।”
কর্নেল বললেন, “উইশ য়ু গুড লাক!”
অরিজিৎ লাহিড়ি চলে যাওয়ার পর সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুঁজে বললাম, “হালদারমশাইয়ের ভাষায় বলা চলে প্রচুর রহস্য। বাস্য! এবার আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। উঠে পড়া যাক।”
“এ সময় হালদারমশাইয়ের কিছু সাহায্য দরকার। দেখ তো জয়ন্ত, ওঁকে বাড়িতে পাও নাকি।”
টেলিফোনের দিকে হাত বাড়িয়েছি, রিং হল। ফোন তুলে সাড়া দিলাম। কোনও মহিলা কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে চাইছেন। বললাম, “কে বলছেন? নাম বলুন প্লিজ!”
“মিসেস চিত্রা মিত্র। লেকটাউন থেকে বলছি। আপনি কি কর্নেল–”
“না। ধরুন, দিচ্ছি।”
কর্নেল ফোন নিয়ে বললেন, “বলুন!…. হ্যাঁ। বলছি।…. দেখা করবেন? কী ব্যাপার?… আগামীকাল সকালে আটটার পর আসুন। সাড়ে আটটার মধ্যে কিন্তু…. ঠিক আছে।”
কর্নেল ফোন রেখে নিভে যাওয়া চুরুট ধরালেন। বললাম, “আপনাকে বিরক্ত মনে হচ্ছে। মহিলাদের প্রতি আপনার প্রচুর সহানুভূতি দেখতে আমি অভ্যস্ত।”
“বিজ্ঞান প্রচারসমিতির প্রদীপ মিত্রের স্ত্রী।”
“দাম্পত্যকলহের মীমাংসা করে দিতে বলছেন না নিশ্চয়!”
“কতকটা তা-ই।”
“সে কী! আপনি ওঁকে তো আসতে বললেন!”
“না বললেও চিত্রা মিত্র আসতেন।” কর্নেল একটু হাসলেন। “ওঁর স্বামী কাঁটালিয়াঘাটের অবধূতের চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করেছেন। সেই নিয়ে ঝামেলা বেধেছে দুজনে। চিত্রা দেবীর কী একটা গোপন বক্তব্য আছে। আমাকে শুনতে হবে।” কর্নেল ফোন তুলে ডায়াল করলেন। একটু পরে বললেন, “মিঃ কে কে হালদার আছেন?… নেই?… কোথায় গেছেন?… ও! আচ্ছা।”
বললাম, “কোথায় গেছেন হালদারমশাই? কাঁটালিঘাটে নাকি?”
কর্নেল শুধু বললেন, “হুঁ।”.
.
বৈশম্পায়ন রায়
কর্নেল সরকার আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন অলৌকিক শক্তিতে আমি বিশ্বাস করি কি না। করি। খুবই বিশ্বাস করি। সেই বিশ্বাস সমীরের মৃত্যুর পর আরও দৃঢ় হল। কোনও এক অলৌকিক শক্তি অদৃশ্যভাবে থেকে মানুষকে চালাচ্ছে। আমিও তার ক্রীড়নক ছাড়া কিছু নই।
শুধু সমস্যা হল, অনি সেই যে বলেছিল, আমার নাকি বিবেক আছে, সেই বিবেক আমাকে প্রশ্ন করে মাঝেমাঝে। খচ খচ করে কাটার মতো বেঁধে প্রশ্নগুলো।
সমীর মানসিক অবসাদে ভুগছিল। কোম্পানির টাকা তছরুপের অভিযোগ ছিল ওর নামে। ওর বউ ওকে ছেড়ে কার সঙ্গে ভেগে গিয়েছিল। এমন অবস্থায় মানুষ আত্মহত্যা করে বসতেই পারে।
কিন্তু আমি ওকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম। আমার অনেক টাকা আছে। সেই টাকা ওকে দিতে পারতাম। কোম্পানির অভিযোগ থেকে সে নিষ্কৃতি পেত। আমার অফিসে ওকে কাজ দিতে পারতাম। সে বিয়ে করতে চাইলে ঘটকালিও করতে পিছপা ছিলাম না।
এখন মুনলাইট বারে সামনে হুইস্কির গ্লাস রেখে এইসব কথা আমার মনে আসছে। এসব কথা বিবেকের কথা।
অথচ কেন যে সেদিন ওকে এড়িয়ে গেলাম!
অলৌকিক শক্তির কি ইচ্ছা ছিল, আমি ওকে এড়িয়ে যাই? আমি ওর কথা জেনে ওকে সাহায্য না করি? ওর সঙ্গে পুরনো বন্ধুত্বে ফিরে না যাই?
কেন ওকে দেখামাত্র প্রচণ্ড ঘৃণা আমাকে খেপিয়ে দিয়েছিল সেদিন? পঁচিশ বছর খুব কম সময় নয়। তবু আমার মধ্যে ঘৃণা উঠে এসেছিল।
অনির কথা ভেবেই কি ঘৃণা? তা হলে বলতেই হবে, অনি এক সর্বনাশা মেয়ে। স্মৃতির ভেতর থেকে সে আমাকে প্ররোচিত করেছে।
নাকি অনির ছদ্মবেশে সেই অলৌকিক শক্তিই আমাকে দিয়ে নিজের কাজ করিয়ে নিয়েছে। সেই অদৃশ্য শক্তিই সমীরকে মেরে ফেলেছে। সমীরের হাতে সে-ই রিভলভার তুলে দিয়েছিল গতরাত্রে। কেউ ওকে বাঁচাতে পারত না।
হাসপাতালের মর্গে এখনও হয়তো সমীরের অফিসের কলিগ্রা, ওর পাড়ার ছেলেরা আর ওর আত্মীয়স্বজন বডি ফেরতের জন্য অপেক্ষা করছে। সমীর নিছক বডি হয়ে গেছে, ভাবতেই বুকটা কেঁপে উঠছে। আমার নিজেকেও আর বিশ্বাস হচ্ছে না। কোন অমোঘ নির্দেশে আমিও নিছক বডি হয়ে যেতে পারি। আমার শরীর নিঃসাড় হয়ে গেল কথাটা ভাবতে গিয়ে।
চাংকো কাছে এসে আস্তে জিজ্ঞেস করল, “এনিথিং রং স্যার?”
বললাম, “থ্যাংকস্ চাংকো। আই অ্যাম অলরাইট!”
চাংকো আমার দিকে নজর রেখেছে কেন? একটু অস্বস্তি হল। গেলাস শেষ করে ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে সাতটা বাজে। এতক্ষণ কর্নেল সরকার ফিরেছেন হয়তো। ওঁর সঙ্গে দেখা করা খুবই দরকার। এমন একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেল! ওঁর সঙ্গে আলোচনা করা উচিত।
বেরিয়ে গিয়ে একটু ভেবে নিলাম। উত্তেজনা থিতিয়ে যাক। আমার মাথার ভেতরটা কেমন হয়ে আছে। বাড়ি ফিরে কর্নেলসায়েবকে রিং করে তারপর যদি দরকার হয়, যাব। ওঁর বাড়ির লোকটাকে তো বলেই এসেছি রিং করব।
কালো অ্যাম্বাসাডার সাবধানে গড়াচ্ছিল। কসবায় সমীরের মায়ের কাছে আবার যেতে ইচ্ছে করছিল। ইচ্ছেটা দমন করলাম। ওই বোবা চাহনি আমাকে বিব্রত করবে। আমার আশ্চর্য লেগেছে, সমীর আমাকে দেখামাত্র চিনেছিল। তার মা চিনতে পারেননি। ওঁকে যখন প্রশান্ত সান্যালের ফ্ল্যাট থেকে হাসপাতালের মর্গে নিয়ে গেলাম, তখনও ওঁর মনে পড়ছিল না আমি কে। সেখান থেকে কসবায় নিয়ে গেলাম। তারপর শুধু একবার জড়ানো গলায় বললেন, “ও! তুমি বাসু?” কিন্তু কোনও কথা জিজ্ঞেস করলেন না আমার বাবা-মা সম্পর্কেও। হয়ত জিজ্ঞেস করার সময় এটা নয়।
শুধু মাঝেমাঝে বোবার চাহনিতে আমাকে দেখছিলেন। সত্তর বছর বয়সী বৃদ্ধার পুত্রশোকে কাঁদতেও কষ্ট হয়। মনের শোকের হাহাকার জরাগ্রস্ত শরীর দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। এইটে দেখেই আমি বিব্রত বোধ করেছি।
লেকটাউন পৌঁছুতে একঘণ্টার বেশি সময় লাগল। গাড়ি গ্যারেজে ঢুকিয়ে তিনতলার ফ্ল্যাটে উঠতে গিয়ে টের পেলাম হাঁপাচ্ছি। ঘামছি। জিভ শুকনো।
জামাকাপড় বদলে বাথরুমে গেলাম। স্নান করব ভাবলাম। করলাম না। কাজের ছেলেটি দেশে গেছে। তবে আমি নিজের কাজ নিজে করতে ভালবাসি। দেশ থেকে ফিরলে ওকে টাকাকড়ি দিয়ে বিদায় দেব। ছেলেটিও চাংকোর মতো আমার দিকে সবসময় যেন বড্ড বেশি নজর রাখে।
এক কাপ কফির লিকার নিয়ে ব্যালকনিতে বসলাম। তাহলে সমীর রুদ্র মরে গেল? আবার মাথার ভেতর ঠাণ্ডা হিম ঢিল গড়িয়ে গেল।
সেই প্রশ্নটাও আবার ফিরে এল। সমীরের মৃত্যুটা যদি আত্মহত্যা না হয়ে হত্যা হয়?
হত্যা কেন হবে?
যদি হয়?
হত্যার একটা মোটিভ থাকে। ওকে হত্যার মোটিভ কী থাকতে পারে?
ধরা যাক, কউকে ব্ল্যাকমেল করত। সে ওর মুখ বুজিয়ে দিয়েছে চিরকালের মতো। ধরা যাক না, ওয়াশিংটনবাসী প্রশান্ত সান্যাল নামে একটা লোককে সে ব্ল্যাকমেল করত বলে সেই প্রশান্ত সান্যাল তাকে ফ্ল্যাটটা ব্যবহার করতে দিয়েছিল। এও ধরা যেতে পারে, সেই ফ্ল্যাটে সমীর মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করত। তারপর ধরা যাক, অফিসের টাকা তছরুপ করার পর সমীর দায়ে পড়ে প্রশান্ত সান্যালের কাছে অনেক বেশি টাকার দাবি করেছিল। শেষে প্রশান্ত স্যান্যাল এসে তাকে গুলি করে মেরে আজই কলকাতা ছেড়ে চলে গেছে। যাবার সময় ব্ল্যাকমেল-সংক্রান্ত ডকুমেন্ট উদ্ধার করে নিয়ে গেছে। এটা তো হতেই পারে।
তা পারে। কিন্তু সেই ডকুমেন্ট ওই ফ্ল্যাটে রাখার পাত্র সমীর নয়।
কসবায় নিজের ফ্ল্যাটে রেখেছিল।
তা হলে প্রশান্ত সান্যালকে সেখানে যেতে হয়েছিল।
গিয়েছিল।
কিন্তু কখন? তা ছাড়া সবার ফ্ল্যাটে সমীরের মা ছিলেন।
এগারোটা অব্দি ছিলে। তারপর চলে আসেন শেক্সপিয়ার সরণির ফ্ল্যাটে ছেলের খোঁজে। এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে প্রশান্ত কসবার ফ্ল্যাটে ঢোকার সুযোগ পেতে পারে।
সব ঠিক আছে বাসু, যদি শেষমেশ ঘটনাটা সুইসাইড না হয়ে হোমিসাইড হয়।
হ্যাঁ, যদি হোমিসাইড অর্থাৎ হত্যাকাণ্ড হয়।….
কফি শেষ করে ঘরে ঢুকলাম টেলিফোন করতে। কর্নেল সরকারকে করব, নাকি অরিজিৎকে? প্রথমে কর্নেল সরকারকেই করা যাক। দেখি, উনি কী ভাবছেন।
ডোরবেল বাজল। চমকে উঠলাম। আই হোলে চোখ রেখে দেখলাম চিত্রা দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলে বললাম, “কী ব্যাপার চিত্রা?” এমন অসময়ে।”
চিত্রা বলল, “আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে, বাসুদা!”
ব্যালকনিতে বসলাম দুজনে। চিত্রা চাপা গলায় বলল, “আজকের সত্যসেবক পত্রিকা দেখেছেন বাসুদা?”
“না তো! কেন?”
“আপনার গুরুদেব প্রদীপকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। প্রদীপ জেদ ধরেছে, আগামীকালই ওঁর আশ্রমে যাবে। আপনি ওকে বুঝিয়ে বলুন বাসুদা!”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও হেসে ফেললাম। “যে অবিশ্বাসী, তাকে কিছু বুঝিয়ে বলা যায় না চিত্রা!”
চিত্রা একটু চুপ করে থেকে বলল, “মানুষ সাধনার বলে অলৌকিক শক্তির অধিকারী হতে পারে, এটা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু প্রদীপ বিশ্বাস করে না। তবে সেই অবিশ্বাস থেকে প্রদীপ আপনার গুরুদেবের সঙ্গে লড়তে যাচ্ছে না।”
একটু অবাক হয়ে বললাম, “তার মানে?”
চিত্রা ফিসফিস করে বলল, “প্রদীপ নাকি আপনার গুরুদেবকে চিনতে পেরেছে। ওঁর পূর্বাশ্রম সম্পর্কে অনেক ইনফরমেশন যোগাড় করেছে।”
“কী ইনফরমেশন?”
“আমাকে তো বলছে না খুলে। শুধু বলছে, এবার ঢিঢি পড়ে যাবে দেশে।”
লকেটটা বের করে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটু পরে বললাম, “ইনি আমার সে-অর্থে গুরুদেব নন, চিত্রা! আমি এঁর মুখোমুখি কখনও হইনি। এক বন্ধু আমাকে এটা ধারণ করতে দিয়েছিল। ধারণ করে ফল পেয়েছি। এজন্যই এটা আমি সবসময় সঙ্গে রাখি।”
চিত্রা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল। “প্লিজ বাসুদা! ওকে আপনি যেভাবে পারুন, আটকান। আমার মন বলছে, ওর কোনও ক্ষতি হবে।”
“প্রদীপ আছে বাড়িতে?”
“না। ওর ক্লাবে আছে। দলবল নিয়ে যাবে।”
“ওরা কখন যাবে, জানো?”
“দুপুরের দিকে বেরুবে। রাত্রে সেখানে থাকবে।”
একটু ভেবে নিয়ে বললাম, “প্রদীপ আমার কথা শুনবে বলে মনে হয় না, চিত্রা! ওর কাছে কী ইনফরমেশন আছে, তা-ও আমাকে বলবে না। বরং তুমি কোনও প্রাইভেট ডিটেকটিভের সাহায্য নাও। তিনি প্রদীপের সঙ্গে কাল সকালের মধ্যেই যোগাযোগ করে এটা সেট করে ফেলতে পারবেন। কিংবা ধরো, প্রদীপের সেফটির ব্যবস্থাও করতে পারবেন।”
চিত্রা হতাশভঙ্গিতে বলল, “কিন্তু কোনও প্রাইভেট ডিটেকটিভকে আমি তো চিনি না!”
একটু দ্বিধার পর বললাম, “কর্নেল নীলাদ্রি সরকার নামে একজন আছেন। তার ফোন নম্বর দিচ্ছি। কিন্তু দুটো শর্ত। আমার সঙ্গে তোমার পরিচয়ের কথা বলবে না এবং ওঁকে ভুলেও ডিটেকটিভ বলবে না। শুধু বলবে, আপনার পরামর্শ চাই। যদি পাত্তা না দেন, একটা ট্রিকস্ কি তোমার মাথায় আসবে না?”
“আসবে। বলব, গোপন কিছু কথাটথা আছে।”
চিত্রা হাসছিল। আমি একটুও হাসছিলাম না। লকেটের ছবিটা সম্পর্কে আজ সকালে কর্নেল সরকার আমাকে সচেতন করেছেন। সারাদিন ধরে বারবার দেখেছি। এঁকে আমার চেনার দরকার ছিল না এতদিন। সমীরের মৃত্যুর পর দরকার হচ্ছে। আসলে অনির স্মৃতি আমার অস্তিত্বে ঝড় হয়ে ফিরেছে। অনির সঙ্গে এই ছবিটার বা অলৌকিক শক্তিধর মানুষটার একটা গোপন যোগসূত্র আমাকে বারবার তাতিয়ে দিচ্ছে। পুরনো স্মৃতি আঁপিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলছে আমাকে।
চিত্রা ফোন নম্বর পেয়ে আমার টেলিফোনের সামনে বসে পড়ল। ব্যালকনিতে ফিরে গিয়ে বসলাম। চিত্রা ফোন করে এসে উজ্জ্বল মুখে বলল, “আগামীকাল মর্নিংয়ে আটটা থেকে সাড়ে আটটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। থ্যাংকস বাসুদা। চলি।”
চিত্রা চলে গেলে আমি লকেটটা আবার মাথায় ঠেকালাম। প্রভু, অপরাধ ক্ষমা কোরো। আমি শুধু একটা কথাই জানতে চাই। আর কিছু না। অনির আত্মার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কী? তুমি কি তাকেই লড়িয়ে দিয়েছ আমার সঙ্গে? বেশ কিছুক্ষণ পরে টেলিফোনের কাছে গেলাম। কর্নেল সরকারকে এবার রিং করা উচিত। আমার হাত কাঁপছিল। সমীরের আত্মা যেন এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছে। উজ্জ্বল আলোয় ভরা ঘরে আতঙ্ক।
এনগেজড টোন। কয়েকবার চেষ্টার পর লাইন পেলাম। “কর্নেল সরকার! আমি ভি রায় বলছি।”
“বলুন মিঃ রায়!”
“সমীরের শোচনীয় মৃত্যুর পর–
“দ্যাটস আ মার্ডার, মিঃ রায়!”
“মার্ডার? বাট হাউ–”
“সমীরবাবু লেফটহ্যান্ডার ছিলেন। ন্যাটা। ওঁর অফিসের কলিগদের কাছে কিছুক্ষণ আগে পুলিশ জানতে পেরেছে। কাজেই মার্ডার। মার্ডারার–”
“কর্নেল প্রকার! মার্ডারার প্রশান্ত সান্যাল নয় তো?”
“কেন প্রশান্ত সান্যাল?”
“নিছক সন্দেহ। তার ফ্ল্যাটে থাকতে দিয়েছিল সমীরকে। ব্ল্যাকমেল হতে পারে।”
“কিন্তু সান্যাল তো ওয়াশিংটনে।”
“কর্নেল সরকার! এয়ারপোর্টে খোঁজ নেওয়া উচিত। ওই নামের কোনও যাত্রী”।
“ইউ আর ইনটেলিজেন্ট মিঃ রায়। আজ ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের লন্ডন আবুধাবি-কলকাতা-হংকং মর্নিং ফ্লাইটে হংকংয়ের একজন যাত্রীর টিকিট ছিল কলকাতা থেকে। পি সান্যাল নাম। কিন্তু সেই যাত্রী”
“ফ্লাইট মিস করেছে?”
“এগেন–ইউ আর ভেরি ইনটেলিজেন্ট মিঃ রায়! পি সান্যাল সকালের ফ্লাইট, মিস করেছে। ওদিকে সমীরবাবুর কসবার ফ্ল্যাট থেকে একটা হ্যান্ডব্যাগ চুরি গেছে।”
“দেন ইট ওয়াজ আ কেস অব ব্ল্যাকমেলিং!”
“ইট অ্যাপিয়ারস, সো।”
“কর্নেল সরকার! হোয়াই ইট অ্যাপিয়ারস্ সো?”
“আপনি সম্ভব হলে অফিস যাওয়ার পথে একবার আসবেন। কথা হবে। ছাড়ছি।”
ফোন রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। তা হলে আমার থিওরির সঙ্গে কর্নেল সরকারের থিওরি মিলে গেছে। আমি যা-যা ভেবেছি, তা-ই উনিও ভেবেছেন। নিজের বুদ্ধিসুদ্ধি সম্পর্কে আমার কিছু আস্থা ছিল। সেই আস্থা বেড়ে গেল। শুধু ওই কথাটা–ইট অ্যাপিয়ারস্ সো’ একটু কানে বাজল। উনি বলতে চাইছেন, আপাতদৃষ্টে তাই মনে হচ্ছে। কেন আপাতদৃষ্টে?
কিন্তু সমীর যে ন্যাটা ছিল, এ কথাটা আমার মনে ছিল না। আসলে পঁচিশটা বছর কম সময় নয়। কর্নেল সরকার কথাটা বলামাত্র মনে পড়ে গেছে, সমীর ন্যাটা ছিল। বাঁহাতে লিখত। বাঁহাতে খেত। সেই নিয়ে অনি ওকে খুব ঠাট্টা করত। বলত, “তুমি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বাঁহাতে খেলে কিন্তু কেলেঙ্কারি। ডানহাতে খাওয়া প্র্যাকটিস করে নাও।”
সমীর আমার সামনেই বলত, “অনামিকা সেন নামে কাউকে বিয়ে করলে কেলেঙ্কারি হবে না।”
অনি বলত, “অনামিকা সেন কোনও ন্যাটার বউ হবে না।”
অনি ছিল সবসময় স্মার্ট, তেজী, দুঃসাহসী আর অ্যাডভেঞ্চারার টাইপ মেয়ে। দীঘায় আমার সঙ্গে আসলে একটা অ্যাডভেঞ্চার করতেই গিয়েছিল। নিজের সাহসের পরীক্ষা দিতে আর আত্মরক্ষায় নিজের পটুতা বুঝে নিতে। নাহ্, সমুদ্রদর্শন একটা ছুতো মাত্র।
আবার কথাটা ধাক্কা দিল আমাকে, সমীর ন্যাটা ছিল। ন্যাটা লোক বাঁহাতে রিভলভার ধরে নিজের মাথার ডানদিকে গুলি চালাতে পারে না। একটু মদ্যপান। করতে পারলে ভাল হত। কিন্তু বেশি খেয়ে ফেলার ভয়ে ঘরে মদ রাখি না। ঘড়ি দেখলাম। মদের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। কোনও বারে যাব কি?
আর বেরুতে ইচ্ছে করছে না। শরীরের ওজন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। ব্যালকনির আলোটা নিভিয়ে দিয়ে বসে রইলাম। এতক্ষণে মনে হল, সেদিন মুনলাইট বারে সমীরের সঙ্গে দেখা হয়ে না গেলে আমার জীবন যেমন চলছিল, তেমনই চলত।
জড়িয়ে যাওয়া একটা সুতোর খেই হয়ে সমীর আমার সামনে এসেছিল। খেই ধরে টানতে গিয়েই অনিবার্যভাবে অনি এসে পড়েছিল। অমনি আমি বুদ্ধিসুদ্ধি হারিয়ে ফেললাম। কাগজে বিজ্ঞাপন দিলাম। তারপর যা-যা করেছি, অদ্ভুত দুঃস্বপ্নের ঘোরে করে ফেলি।
নাহ্। এসব করতে যাওয়া ঠিক হয়নি। বেশ তো ছিলাম।….
.
জয়ন্ত চৌধুরি
খুনজখম আর রহস্যের মারপ্যাঁচে মাথার ভেতরটা যখন ঘুলিয়ে উঠেছে, সেই সময় প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাইয়ের কাঁটালিয়াঘাট যাত্রার খবর চমৎকার রিলিফ। হালদারমশাই মানুষটা পুলিশজীবনে কেমন ছিলেন বিশেষ জানি না। কিন্তু বেসরকারি গোয়েন্দা জীবনে অদ্ভুত ধরনের খেয়ালি। খেয়ালের চোটে বিপদে-আপদে বহ্বার ওঁকে সাংঘাতিক ভুগতে দেখেছি। অথচ পরে সেই ভোগান্তি চমৎকার ভুলে যান।
রাতে শুয়ে পড়ার সময় হঠাৎ মনে হল, এক রহস্যের পাশাপাশি আরেক রহস্য উঁকি মারছে না তো? বিজ্ঞান প্রচার সমিতির প্রদীপ মিত্রের স্ত্রী সকালে কর্নেলকে কোনও গোপন কথা বলতে আসছেন। তার মানে, কর্নেলের ডাইনে বাঁয়ে দুই রহস্য এসে গেছে।
অবশ্য বহুবার কর্নেলকে ডাইনে বাঁয়ে কেন, সামনে-পেছনেও রহস্যের জটিল বান্ডিলে ফঁদে পড়া প্রাণীর মতো আঁকুপাকু করতে দেখেছি। এই বুড়োবয়সে পারেনও বটে।
রাত দশটায় চোখের পাতা ঘুমে টেনে ধয়েছে, হঠাৎ বিরক্তিকর ফোনের শব্দ। পত্রিকা অফিস থেকে কোনও জরুরি তলব ভেবে ফোন তুলতেই বললাম, ‘রং নাম্বার।”
“রাইট নাম্বায় ডার্লিং! ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য দুঃখিত।”
“সুখী করার মতো সুসমাচার আছে নিশ্চয়? হালদারমশাই আশা করি অবধূত রহস্য ফাঁস করে ফিরে এসেছেন।”
“না জয়ন্ত! সমীরবাবুর মৃত্যু সম্পর্কে আমার থিওরিতে তোমার অবিশ্বাস ঘোচাতে এই খবরটা দেওয়ার ইচ্ছে হল। আমার চোখ এড়ায়নি জয়ন্ত! তোমার মুখে অবিশ্বাস শুধু নয়, বাঁকা হাসিও দেখেছি। বিশেষ করে তুমি–”
“ওঃ হো! ব্যাপারটা বলবেন তো?”
“সমীরবাবুকে সত্যিই খুন করা হয়েছে। তার শক্ত প্রমাণ একটু আগে পাওয়া গেছে।”
“শক্ত প্রমাণ? ইটের না পাথরের?”
“সমীরবাবু ন্যাটা–লেটহ্যান্ডার ছিলেন। কোনও ন্যাটালোক নিজের মাথার ডানদিকে গুলি করে আত্মহত্যা করতে পারে না।”
“বস্! আপনার কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা টের পাচ্ছি।”
“ও কিছু না। তুমি শুনলে অবাক হবে, কসবার ফ্ল্যাট থেকে সমীরবাবুর একটা হ্যান্ডব্যাগ চুরি গেছে–মানে, পাওয়া যাচ্ছে না।”
“আপনার থিওরি সেন্ট পারসেন্ট কারেক্ট প্রমাণিত হল। আনন্দে ঘুমিয়ে পড়ুন।”
“আনন্দ কোথায়? আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, কেউ আমাকে লাল হেরিং মাছের পেছনে ছোটাচ্ছে। ইউ নো দা টার্ম ডর্লিং! ‘চেজিং আফটার আ রেড হেরিং। মরীচিকা, জয়ন্ত! আমি কি মরীচিৎকার পেছনে ছুটছি?”
“এবার আপনার গলায় বিষাদ-সঙ্গীতের সুর, বস্!”
“হু, আর একটা ব্যাপার দেখ। সমীরবাবুর মা প্রতিবেশী এক বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সঙ্গে তাদের গাড়িতে রোজ ভোরে গঙ্গাস্নানে যান। আজও গিয়েছিলেন। সেই দম্পতির কিশোরী নাতনিকে ফ্ল্যাটে রেখে গিয়েছিলেন সমীরবাবুর মা গৌরী দেবী। কারণ গতরাত থেকে সমীরবাবু বাইরে আছেন এবং সকালে ফিরতে পারেন। তো মেয়েটি বলেছে, তিন-চারবার ফোন করে কেউ জানতে চেয়েছিল গৌরীদেবী আছেন কি না। শুনে সে বলেছিল, গৌরীদেবী ফিরলেই যেন ছেলের খোঁজ করেন। গৌরীদেবী আজ গঙ্গাস্নানের পর বালিগঞ্জে তার বোনঝির কাছে নেমে যান। প্রায় সাড়ে দশটা অব্দি সেখানে ছিলেন। বাড়ি ফেরার পর মেয়েটির মুখে ফোনের খবর শুনে ব্যক্তভাবে তার অফিসে ফোন করেন। তারপর
“হালদার মশাইয়ের ভাষায় প্রচুর রহস্য এবার ঘনীভূত রহস্য হল।”
“অবশ্যই ঘনীভূত হল। প্রতিবেশী মৈত্রেয় দম্পতির নাতনির ডাকনাম মিম্মি। গৌরীদেবীর নাকি ভীষণ চোরের বাতিক। তাই কাজের লোক রাখেন না। তবে মিম্মিকে বিশ্বাস করেন। তাই ফ্ল্যাটে ছেড়ে গেলে মিম্মিকে নজর রাখতে বলেন। স্কুলে পুজোর ছুটি। মিম্মি বাড়িতেই ছিল এবং গৌরীদেবীর ফ্ল্যাটে রেকর্ডপ্লেয়ার বাজিয়ে সময় কাটাচ্ছিল। টু মেক ইট শর্ট, জয়ন্ত গৌরীদেবী ছেলের খোঁজে চলে আসার পর কারও ওঁর ফ্ল্যাটে ঢোকার চান্স ছিল না। মিম্মি ওয়জ দেয়ার। কাজেই সমীরবাবুর হ্যান্ডব্যাগ হারানো এবং সেটা আজই হারানো একটা নতুন প্রশ্ন এনেছে। আর একটা ঘটনা ফোনের তার ছেঁড়া নীচের টেলিফোন বক্সে।”
“থাক কর্নেল! আমার মাথায় ভীমরুল ঢুকে গেছে।”
“আমারও…হ্যালো! হ্যালো!”
“বলুন।”
“সকাল আটটার মধ্যে চলে এসো। তোমাকে একটা জরুরি কাজের দায়িত্ব। দেব। হালদারমশাই নেই বলেইনা ডার্লিং, গোয়েন্দাগিরি নয়! তুমি রিপোর্টার হওয়ায় অনেক সুবিধে আছে। এটা তুমি সহজে পারবে।”
“আপনি না বললেও যেতাম। চিত্ৰদর্শনে সরি! চিত্রাদর্শনে?”
“হাঃ হাঃ হাঃ! রাখছি ডার্লিং! হ্যাভ আ নাইস স্লিপ।”
যাক, বৃদ্ধ ঘুঘুপ্রবরকে হাসাতে পেরেছি। হাসি উত্তেজনা দূর করে। কিন্তু নিজের উত্তেজনাটি আমার মাথায় পাচার করে দিলেন দেখছি। জরুরি কাজটা কী ধরনের হতে পারে ভেবে পেলাম না। নাইস স্লিপের’ বারোটা বেজে গেল।
সকালে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছুতে প্রায় সওয়া আটটা বেজে গেল। ড্রয়িং রুমে ঢুকে চোখ জ্বলে গেল বলা চলে। কিন্তু কর্নেল আলাপ করিয়ে দিলেন না চিত্রা মিত্রের সঙ্গে। আমাকে ইশারায় বসতে বলে তাকে বললেন, “ঠিক আছে। আমি দেখছি। তবে কথা দিতে পরছি না। কারণ খবরের কাগজে আপনার স্বামীর যে-সব কীর্তিকলাপ পড়েছি, তাতে আমার ধারণা হয়েছে, উনি জেদী এবং দুঃসাহসী মানুষ। আমার পরামর্শে কান দেবেন না। আর আপনি বলছেন টেলিফোনে হুমকি দেওয়ার কথা। কাগজেই পড়েছি, প্রদীপবাবুকে এধরনের হুমকি বহুবার দেওয়া হয়েছে। এটা তো আপনারও জানার কথা।”
চিত্রা বললেন, “তাহলে ওর সেফটির ব্যবস্থা করুন।”
কর্নেল হাসলেন। “সরি মিসেস মিত্র! আমি বডিগার্ড সাপ্লায়ার নই।”
“না, না! কথাটা ওভাবে নেবেন না কর্নেল সরকার!” চিত্রা একটু বিব্রতভাবে বললেন। “বডিগার্ডের কথা বলছি না। আসলে আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, ওর যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, তেমন কোনও ব্যবস্থা করুন। আমি জানি, আপনি এটা পারেন।”
“আপনি জানেন? তার মানে, কেউ কি আপনাকে বলেছে আমি এধরনের কাজ করি?”
চিত্রা আস্তে বললেন, “শুনেছি।”
কর্নেলের জেরার মুখে সুন্দরীর সৌন্দর্য বেঁকেচুরে গেল। আমার খারাপ লাগছিল। কর্নেলকে মেয়েদের ব্যাপারে এমন কড়া হতে কখনও দেখিনি। চিত্রা ঠোঁট কামড়ে ধরে আঙুল খুঁটতে থাকলেন।
কর্নেল বললেন, “কেউ আপনাকে বলেছে আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ?”
চিত্রা তাকিয়েই মুখ নিচু করলেন। আস্তে বললেন, “হুঁ।”
“প্রদীপবাবু কাঁটালিয়াঘাটের অবধূতের কোনও গোপন তথ্য জানেন বলছিলেন। কী ধরনের গোপন তথ্য বলে আপনার ধারণা?”
“আপনাকে তো বলেছি, আমাকে ও কিছুই খুলে বলেনি। তবে অবধূতজির পূর্বাশ্রম সম্পর্কে নাকি ইনফরমেশন জোগাড় করেছে।”
“আপনি লেকটাউনে ব্লক এ-তে থাকেন?”
“হ্যাঁ। আচার্য রোডে।”
“আপনি তাহলে মিঃ ভি রায়–বৈশম্পায়ন রায়কে চেনেন?”
চিত্রা একটু ইতস্তত করে বললেন, “হুঁ।”
কর্নেল হাসলেন। “কেন বলছেন না তিনিই আপনাকে আমার কথা বলেছেন?”
“আসলে বাসুদা আমাকে নিষেধ করেছিলেন।”
“কী আশ্চর্য! ওঁর কথা বললে এতক্ষণ বাজে সময় নষ্ট হত না। ঠিক আছে। প্রদীপবাবুর সেফটির ব্যবস্থা আমি করব।”
চিত্রা খুশি মুখে উঠে দাঁড়ালেন।
কর্নেল বললেন, “একটা কথা মিসেস মিত্র! আজকের কাগজ পড়েছেন?”
“না। আমি মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়েই আপনার কাছে ছুটে এসেছি। কেন বলুন তো?”
“আপনি কোন্ কাগজ পড়তে ভালবাসেন?”
“সত্যসেবক পত্রিকা পড়তে আমার ভাল লাগে।”
কর্নেল মিষ্টিমিষ্টি হেসে বললেন, “তা হলে আলাপ করিয়ে দিই। দৈনিক সত্যসেবকের সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরি! আর জয়ন্ত, ইনি বিজ্ঞান প্রচার সমিতির মিঃ প্রদীপ মিত্রের স্ত্রী মিসেস চিত্রা মিত্র।”
চিত্রা হাসিমুখে নমস্কার করলেন আমাকে। তারপর বসে পড়লেন। বললেন, “আপনাদের কাগজ আমি খুঁটিয়ে পড়ি। আচ্ছা জয়ন্তবাবু, রূপচর্চার পাতায় আমি কিছু লিখতে চাই। একটু হেল্প করতে পারেন না আমাকে? শুনেছি, চেনা-জানা না থাকলে সত্যসেবকে লেখা ছাপানো যায় না। আপনি যদি
আমি কথা বলতে যাচ্ছি, কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে টেবিল থেকে আজকের সত্যসেবক পত্রিকা তুলে নিয়ে বললেন, “মিসেস মিত্র! আজকের সত্যসেবক পড়ে দেখুন!”
আমি যেমন, তেমনি চিত্রাও যেন একটু অবাক হলেন। তারপর কাগজটা নিয়ে প্রথম পাতায় চোখ রেখেই চমকে উঠলেন। আস্তে বললেন, “সে কী!”
কর্নেলও আস্তে বললেন, “কোনও সেনসেশন্যাল খবর আছে বুঝি?”
চিত্রার মুখে তীব্র উত্তেজনার ছাপ লক্ষ করলাম। বললেন, “আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক সুইসাইড করেছেন।”
“ভদ্রলোককে আপনি চিনতেন নাকি?”
“হ্যাঁ। মানে, একটু-আধটু চিনতাম।”
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, “আজকাল সুইসাইড খুব বেড়ে যাচ্ছে। মানুষের ফ্রাস্ট্রেশন বাড়ছে। ব্যাপারটা হল, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে এমন করে তুলেছে, যার সঙ্গে বাস্তব জীবনকে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে আত্মিক সঙ্কট এসে যাচ্ছে।”
চিত্রা দ্রুত বললেন, “সমীরদার স্ত্রীই এ জন্য দায়ী।”
“আপনি চিনতেন নাকি?”
“একটু-আধটু চিনতাম। কসবায় সমীরদা যে বাড়িতে থাকত, সেই বাড়িতে আমার দিদি থাকেন। স্কুলটিচার। সেই সূত্রে আলাপ হয়েছিল। আচ্ছা, আমি উঠি।” চিত্রা আবার উঠে দাঁড়ালেন।
কর্নেল বললেন, “কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ করেছেন? ভদ্রলোক নিজের ফ্ল্যাটে সুইসাইড না করে শেক্সপিয়ার সরণিতে অন্য একজনের ফ্ল্যাটে গিয়ে সুইসাইড করেছেন। অদ্ভুত ব্যাপার না?”
চিত্রা আস্তে বললেন, “স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্সের পর সমীরদা মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে থাকত। দিদির কাছে শুনেছি। আচ্ছা, চলি!”
“মিসেস মিত্র! বরং এক কাজ করুন। আপনি আপনার স্বামীর সঙ্গে কাঁটালিয়াঘাটে চলে যান। স্বামীর সেফটি স্ত্রীই বেশি দিতে পারেন। আপনি যেভাবেই হোক, ওঁর সঙ্গে চলে যান। আমি তো আছিই। আড়াল থেকে লক্ষ রাখব।”
“আমি যাব? কিন্তু আমার মেয়ে কার কাছে থাকবে?”
“মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যান। আপনার মেয়ে নিশ্চয় ইংলিশ মিডিয়ামে কোনও খ্রিশ্চিয়ান মিশনারি স্কুলের ছাত্রী! না–এটা জানায় ডিটেকটিভের বাহাদুরি নেই। মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন বললেন। অন্যান্য স্কুলে এখন পুজোর ছুটি। কাজেই এটা অনুমান করা খুব সহজ।”
চিত্রার চোখেমুখে যে বিস্ময় ফুটে উঠেছিল, মুছে গেল। কিন্তু বিষণ্ণতার গাঢ় ছাপটা আবার ফিরে এল। বললেন, “আপনি কি লোক পাঠাবেন, না নিজে যাবেন?”
“আমি নিজে যাব।”
“থ্যাংকস কর্নেল সরকার!” বলে চিত্রা মিত্র চলে গেলেন। সত্যসেবক পত্রিকার রূপচর্চার পাতায় লেখার ব্যাপারে আর কোনও কথা তুললেন না এবং আমাকে প্রাপ্য নমস্কারটি পর্যন্ত দিলেন না। আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, “কী বুঝলে জয়ন্ত?”
“আপনার জেরার পদ্ধতিটি অভিনব।”
“তত কিছু অভিনব নয়। আমার বরাবরকার একটি তত্ত্ব হল, সত্য জিনিসটা অসংখ্য ফালতু জিনিসের মধ্যে গাঢাকা দিয়ে থাকে। তাই ফালতু জিনিসগুলো উল্টেপাল্টে দেখা উচিত।”
ষষ্ঠী এসে বলল, “বেকফাস রেডি, বাবামশাই!”
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, “এস জয়ন্ত, আ ষষ্ঠীর বেকফাস শেষ করে নিই। তারপর অন্য কাজ।”
ডাইনিংয়ে ঢুকে বললাম, “আমি কিন্তু বেকফাস সেরে বেরিয়েছি। শুধু এককাপ কফি খাব।”
ষষ্ঠীচরণ গম্ভীরমুখে বলল, “না হয় মুখ ফস্কে বেইরেই গেছে। বেরেকফাস্ট বেরেকফাস্ট! নিন, এবার হল তো?”
বলে সে কিচেনে ঢুকে গেল। কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। “না রে ষষ্ঠী! তুই বেকফাস্ট বল্ কিংবা বেরেকফাস্টই বল্, জিনিসটা তো একই। হালদারমশাই বলেন ব্র্যাকফাস্ট। তাতেও কি এই খাদ্যের স্বাদ বদলে যায়? বসে পড়ো জয়ন্ত! ষষ্ঠীকে বলা ছিল তোমার কথা। কাজেই তুমি না খেলে ষষ্ঠী রাগ করবে।”
কর্নেলের স্বভাব খাওয়া-দাওয়ার সময় ঘোর নীরবতা পালন। ওঁর মতে, খাওয়ার সময় কথা বললে–এক : খাদ্যের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে হয়, দুই : গলায় আটকে যেতে পারে, তিন : কথার ভেজাল মিশলে খাদ্য ঠিকমতো হজম হয় না ইত্যাদি।
কিছুক্ষণ পরে কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে মুখ খুললেন।”সুন্দরীরা যদি নিজের রূপ সম্পর্কে বেশি সচেতন হন, তা হলে তাদের বুদ্ধির উৎকর্ষে ঘাটতি পড়ে। মিসেস মিত্রকে অবশ্য বোকা বলব না, তবে চিন্তাধারায় বেজায় সাদাসিধে। এধরনের মহিলাদের কাছ থেকে সহজে পেটের কথা আদায় করা যায়।”
“কিন্তু সমীরবাবু ওঁর পরিচিত, এটা কি অলৌকিক শক্তির সাহায্যে জানতে পেরেছিলেন?”
“নিছক একট চান্স নিয়েছিলাম। মিঃ রায় ওঁকে পাঠিয়েছেন। তাই অন্ধকারে একটা ঢিল ছুড়লাম। লেগে গেল।” কর্নেল কফিতে চুমুক দিলেন। “যে-কোনও রহস্যের সঙ্গে বহু আকস্মিকতার সম্পর্ক অচ্ছেদ্য, জয়ন্ত!”
“মিঃ রায় ওঁকে বলতে নিষেধ করেছিলেন–”।
“সেটা স্বাভাবিক। এধরনের নাছোড়বান্দা মহিলার চাপে পড়েই আমার নাম ঠিকানা দিয়ে থাকবেন। ওঁর একটা কেস আমি নিয়েছি। এ অবস্থায় আরেকটা কেস আমার ওপর চাপালে আমি বিরক্ত হতেই পারি। তাই নিষেধ করে থাকবেন। তাছাড়া উনি জানেন, ডিটেকটিভ কথাটা সম্পর্কে আমার প্রচণ্ড অ্যালার্জি আছে।”
“কিন্তু আপনি কি সত্যিই কাঁটালিয়াঘাটে যাবেন নাকি?”
“দেখা যাক। তবে মিসেস মিত্রের উদ্বেগ আমাকে টাচ করেছে।” কর্নেল হঠাৎ একটু গম্ভীর হলেন। “প্রদীপ মিত্রের এক লক্ষ টাকা বাজি ধরার ব্যাপারটা আমার ভাল ঠেকছে না। ওঁর স্ত্রীর কাছে শুনলাম, প্রদীপবাবুর তো বটেই, ওঁর বিজ্ঞান প্রচার সমিতিরও লক্ষ টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। এমন বাজি ধরার ঝুঁকিও সাংঘাতিক। যদি অবধূতজির কীর্তিকলাপ ম্যাজিকই হয়, সেই ম্যাজিক কি প্রদীপবাবুরও জানা? তার মানে, তুমি যে ম্যাজিক ফাঁস করতে চাও, সেই ম্যাজিক তোমারও জানা চাই।”
“প্রদীপবাবুর সঙ্গে কথা বলে দেখুন না! নিশ্চয় ম্যাজিকটা জানেন বলেই বাজি ধরেছেন।”
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তার আগে চলো, এক জায়গায় ঘুরে আসি। সাড়ে নটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে।”
“কোথায়? কার সঙ্গে?”
“এন্টালি এলাকায় অজিতপ্ৰসাদ আগরওয়ালের সঙ্গে।”
“কী ব্যপার?”
“চলো তো! ষষ্ঠী, বেরুচ্ছি।”
কিছুক্ষণ পরে কর্নেলের নির্দেশমতো একটা গলিরাস্তায় পৌঁছে গাড়ি দাঁড় করলাম। অন্যদিক থেকে আর একটা গলি এসে এখান থেকে খানিকটা চওড়া হয়ে সি আই টি রোডে মিশেছে। গোড়াবাঁধানো বটগাছের তলায় গাড়ি রাখতে বললেন কর্নেল। সামনে একটা পাঁচতলা বাড়ি। খানিকটা জাহাজের গড়ন। বাড়িটার মধ্যে স্থাপত্যকাঠামোর সৌন্দৰ্য্য আছে, কিন্তু রঙবেরঙে একেবারে কিম্ভূত হয়ে পড়েছে।
বন্ধ গেটের সামনে গেলে দারোয়ান মিলিটারি সেলাম ঠুকল। আমাকে নয়, কর্নেলকেই। দশাসই সায়েবি চেহারা, ঋষিসুলভ দাড়ি এবং মাথায় সায়েবি টুপি; টুপি পরার কারণ অক্টোবরের তেজী রোদে টাক ঝলসে যাবে। আশেপাশে তত উঁচু বাড়ি নেই এবং বোঝাই যায়, এটা এক সময় বস্তি এলাকা ছিল।
কর্নেল কিছু বলার আগেই দারোয়ান বলল, “আপ কর্নিলসাব?”
“হাঁ। আগরওয়ালজি হ্যায়?”
“আইয়ে, আইয়ে! অন্দর আইয়ে!”
আমরা ভেতরে লনে ঢুকলে পোর্টিকোর দিক থেকে একজন রোগা ফো ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। নমস্কার করে বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। বুঝলাম, ইনিই আগরওয়ালজি। চমৎকার বাংলা বলেন। হাবভাবে অত্যন্ত বিনয়ী এবং ভদ্র বলেই মনে হল।
ঘরের ভেতরটাও খুব রঙচঙে। আমাদের বসতে বলে আগরওয়ালজি আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। কর্নেল বললেন, “আমরা এইমাত্র– ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি। আপনি বসুন।”
আগরওয়ালজি তবু দাঁড়িয়ে রইলেন বিনীত ভঙ্গিতে।
কর্নেল বললেন, “আপনি না বসলে তো কথা হবে না আগরওয়ালজি!”
এবার বুঝতে পারলাম, এই মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী ভদ্রলোক কোনও কারণে শঙ্কিত। দ্বিধার সঙ্গে বসে কঁচুমাচু মুখে হাসলেন। “দেখুন কর্নেলসাব! এই জমি আমি ঠিক-ঠিক দাম দিয়ে সাত বছর আগে কিনেছি। সব পেপার দেখে তবে কিনেছি। রেজিস্টার্ড ডিড, কর্পোরেশন পেপার্স–যা কিছু দেখতে চান, দেখাচ্ছি। এত বছর পরে কেন ঝামেলায় পড়তে হবে, আমি তো বুঝতে পারছি না।”
“চারুলতা সেনের কাছে কিনেছিলেন?”
“হ্যাঁ। ডিডের উইটনেস তার ভাই হেমাঙ্গ সেনগুপ্ত। হেমাঙ্গবাবুই দিদির সিগনেচার আইডেন্টিফাই করেছেন?”
“হেমাঙ্গবাবু এখন কোথায় আছেন?”
“তা তো জানি না। আগে থাকতেন ভবানীপুরে।”
“ডিডে ওঁর অ্যাড্রেস থাকার কথা।”
“হ্যাঁ। আমি আপনাকে ডিড এনে দেখাচ্ছি।”
আগরওয়ালজি ভেতরে গেলে চাপাস্বরে বললাম, “রিস্ক নেওয়া হচ্ছে না?”
কর্নেল একটু হেসে আস্তে বললেন, “এন্টালি থানাকে বলে রেখেছি। আগরওয়ালজির পক্ষে থানায় ফোন করে জনৈক কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের আসার ব্যাপারটা পুলিশকে জানানোর চান্স ছিল। ইতিমধ্যে ফোন করেছিলেন সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। আজকাল প্রতারকদের যা কাণ্ডকারখানা, তাতে এমন একজন ঝানু লোকের সতর্ক হয়ে ওঠারই কথা।”
হাসতে গিয়ে সামলে নিলাম। আগরওয়ালজি সম্ভবত কাজগপত্রের ফাইল বের করেই রেখেছিলেন। ব্যস্তভাবে ঘরে ছুটে ফাইল খুলে ডিড বের করলেন। “আপনি দেখুন। ওরিজিন্যাল ডিড আছে। এই দেখুন হেমাঙ্গবাবুর সিগনেচার।”
কর্নেল ঠিকানাটা টুকে নিয়ে বললেন, “চারুলতা দেবীর একটি মেয়ে ছিল। অনামিকা। এই প্রপার্টিতে তার শেয়ার ছিল।”
আগরওয়ালজি চমকে উঠলেন। “সে কী কথা!”
“অনামিকার কথা আপনি জানেন না?”
আগরওয়ালজি একটু হাসলেন। “ঠিক আছে। তাকে নিয়ে আসবেন। যদি সে ঠিক-ঠিক অনামিকা বলে প্রুভ করতে পারে, তার শেয়ার মিটিয়ে দেব।”
“অনামিকার কথা আপনি সত্যিই জানেন না? শোনেননি কিছু তার সম্পর্কে?”
“একটু-একটু শুনেছি। এই জমি কেনার আগেই শুনেছি। কর্নেল সাব! আমি সবকিছু খবর নিয়ে জমি কিনিনি।”
“কী শুনেছেন বলুন!”
কর্নেলের কণ্ঠস্বরে চ্যালেঞ্জ ছিল। আগরওয়ালজি একটু ইতস্তত করে বললেন, “শুনেছি, অনেক বছর আগে বিয়ের আগের রাতে নাকি তাকে কে কিডন্যাপ করেছিল। তারপর আর তার খবর পাওয়া যায়নি। তবে আপনি তার শেয়ারের কথা বলছেন। আমি নিউজপেপারে অ্যাডভার্টাইজ করেই এই প্রপার্টি কিনেছি। এতদিন পর্যন্ত কেউ শেয়ার ক্লেম করেনি। এখন ক্লেম করলে আমি তাকে আপনার খাতিরে টাকা মিটিয়ে দেব। ঠিক আছে কর্নেলসাব?”
“কে কিডন্যাপ করেছিল, শুনেছেন কি?”
আগরওয়ালজি মাথা নেড়ে বললেন, “তা জানি না। তবে মেয়েটা ভাল ছিল না শুনেছি। আমি ওসব ঝামেলায় থাকি না স্যার! আমি বিজনেসম্যান। বিজনেস ছাড়া কিছু বুঝি না। আপনি ওসব খবর জানতে হলে ওই মোড়ে এক ডাক্তারবাবু আছেন, তার সঙ্গে কথা বলুন।”
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ধন্যবাদ আগরওয়ালজি!”
লনে এসে আগরওয়ালজি বললেন, “আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। কর্নেলসাব! এ কিসের কেস আছে?”
“সরি আগরওয়ালজি! সেটা বলা যাবে না। বাট এগেন থ্যাংকস্ ফর ইওর কো-অপারেশন?”
ব্যবসায়ী ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে রাস্তায় এলেন। দারোয়ান আবার মিলিটারি সেলাম ঠুকল। লোকটি সম্ভবত মিলিটারিতে সেপাই-টেপাই ছিল।
আগরওয়ালজি বললেন, “ওই দেখুন ডাক্তারবাবুর বাড়ি। চলুন, আমি আলাপ করিয়ে দিই।”
সাইনবোর্ডে লেখা আছে ডাঃ পি কে দত্ত। তার পাশে ইংরেজি বর্ণমালার মিছিল। কিন্তু ঘরে বসে মাছি তাড়াচ্ছেন ডাক্তারবাবু। খটখটে বুড়োমানুষ। আগরওয়ালজি কর্নেলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সি বি আই অফিসার শুনেই ডাঃ দত্ত কেমন কে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। আগরওয়ালজি সবিনয়ে বললেন, “কর্নেলসাব! আমাকে এবার বেরুতে হবে। আমি চলি। যখন দরকার হবে, আসবেন। নমস্তে।”
ডাঃ দত্ত এবার ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। “আপনারা বসুন। বলুন কী ব্যাপার?”
কর্নেল বললেন, “একটা পুরনো কেসের তদন্তে এসেছি। আপনার সাহায্য চাই ডঃ দত্ত।”
“একশোবার। বলুন, কী সাহায্য করতে পারি?”
“আপনি অনামিকা সেনকে চিনতেন?”
ডাঃ দত্ত চমকে উঠলেন। “অনামিকা সেন?”
“হ্যাঁ, অনামিকা সেন।”
“সে তো অনেকবছর আগের কথা। বাসু নামে পাড়ার একটা ছেলে বিয়ের আগের রাতে তাকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর পুলিশ কেসও হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ছে, পুলিশ খুঁজে পায়নি ওদের। বাসু–”
“বৈশম্পায়ন রায়?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। এই গলিতেই থাকত ওরা। এখন ওদের বাড়িতে একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুল হয়েছে। বাসুর বাবা-মাও কবে মারা গেছেন। তা প্রায় বছর বিশেক হয়ে গেল। বাসু নাকি জামশেদপুরে পালিয়ে গিয়েছিল। তারপর আর তার খবর পাওয়া যায়নি। আর অনিরমানে, অনামিকার কথা বলছেন?” ডাঃ দত্ত স্মরণ করার চেষ্টা করে বললেন, “অনির মায়ের কাছে শুনেছিলাম, অনি একটা চিঠি লিখে জানিয়েছে সে ভাল আছে। তার জন্য চিন্তার কারণ নেই। চিঠিতে ঠিকানা ছিল না।”
“কতদিন আগে, মনে পড়ছে আপনার?”
“এই তো!” ডাঃ দত্ত আবার একটু ভেবে বললেন, “বছর আষ্টেক হবে বলে মনে হচ্ছে। হাতার পরের বছর অনির মামা ওদের বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে অনির মাকে নিয়ে গেল। বোধ করি ভবানীপুরে না কোথায়-”
“ভবানীপুরে অনির মামা থাকতেন, আমরা জানি।”
“তাহলে সেখানেই”।
“অনির মা আপনাকে বলেছিলেন অনি চিঠি লিখেছে?”
“হ্যাঁ।”
“আট বছর আগে?”
“হ্যাঁ। আগরওয়ালজি ওদের বাড়িটা কিনলেন, তার আগের বছর।” ডাঃ দত্ত নড়ে বসলেন। “কী কেসের তদন্ত স্যার?”
“সরি ডঃ দত্ত! বলা যাবে না। তো আপনি সমীর রুদ্রকে চিনতেন?”
ডাঃ দত্ত আবার চমকে উঠলেন। টেবিলে পড়ে থাকা দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা দেখিয়ে বললেন, “আজই কাগজে দেখলাম সমীর সুইসাইড করেছে। কী সাংঘাতিক কাণ্ড! এই দেখুন।”
“দেখেছি। আপনি সমীরবাবুকে চিনতেন?”
“হাঁ। পাড়ারই ছেলে সব। ওই যে গ্যারেজ দেখছেন, তার পাশের বাড়িতে থাকত ওরা। কসবায় ফ্ল্যাট কিনেছে শুনেছিলাম। হঠাৎ আজকের কাগজে এই খবর।”
“আচ্ছা ডঃ দত্ত, বাই এনি চান্স আপনি প্রশান্ত সান্যাল নামে কাকেও চিনতেন?”
ডাঃ দত্ত তাকালেন। “প্রশান্ত সান্যাল?”
“হ্যাঁ। প্রশান্ত সান্যাল।”
“বুঝেছি। পরেশের ছেলে। শুনেছি সে তো এখন বিলেতে না কোথায় থাকে। কোটিপতি হয়েছে নাকি।”
“এই পাড়ার থাকতেন ওঁরা?”
“বলতে পারেন। আগরওয়ালজির বাড়ির পাশের গলিতে থাকত। প্রশান্তর এক ভাই আছে। স্টেশনারি দোকান করেছে। মহাকালী ভাণ্ডার। ডাকনাম তপু। তাপস। ওর দোকানে গেলে প্রশান্তর খবর পাবেন।”
“থ্যাংকস্ ডঃ দত্ত! চলি!”
গলিরাস্তার হাঁটতে হাঁটতে বললাম, “একটা পুরনো নাটকের ব্যাপার মনে হচ্ছে, জমেও উঠেছে। কারণ আট বছর আগে অনামিকা সেন তার মাকে চিঠি লিখেছিল। তার মানে–”
কর্নেল বললেন, “তার মানে আট বছর আগে তার অস্তিত্ব ছিল।”
“এখনও আছে। রায়সায়েবকে লেখা লালচিঠির হুমকি সেটা বলে দিচ্ছে।”
“কিছু বলা যায় না, জয়ন্ত! মিঃ রায়ের সন্দেহ, অনামিকাকে কেউ খুন করেছে এবং সে চাইছে না, অনামিকা সম্পর্কে কেউ খোঁজ নিক। খোঁজ নিতে গেলে তার ধরা পড়ার চান্স আছে।”
একটু চমকে উঠলাম। অস্বস্তিতে শরীর ছমছমিয়ে উঠল। গাড়ির কাছে এসে বললাম, “ওই গলির ভেতর গাড়ি ঢোকানো ঠিক হবে?”
“নাহ্। গাড়ি থাক। ওই দেখ, আগরওয়ালজির দারোয়ান নজর রেখেছে।”
“কর্নেল, বাজি রেখে বলতে পারি লোকটা মিলিটারিতে সেপাই ছিল।”
“বাজি রাখার দরকার নেই।
কর্নেলের সঙ্গে থাকার এটাই মজা। একটু আগের অস্বস্তিটা ঘুচে গেল। হেসে ফেললাম। গলিটা ঘুরে-ঘুরে এগিয়েছে। খানিকটা গিয়ে মহাকালী ভাণ্ডার’ দেখা গেল। আমাদের খদ্দের ভেবে একজন গাদাগোব্দা চেহারার ভদ্রলোক সম্ভাষণ করলেন, “বলুন স্যার!”
কর্নেল বললেন, “আপনি কি তাপসবাবু?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। কী ব্যাপার?”
“আপনার দাদার নাম প্রশান্ত সান্যাল?”
তাপসবাবু একটু অবাক হলেন যেন। “আপনারা কোত্থেকে আসছেন স্যার?”
কর্নেল মিষ্টি হাসলেন। “প্রশান্তবাবু আমার পরিচিত, অ্যামেরিকায় আলাপ হয়েছিল। কলকাতা আসার কথা বলেছিলেন। এসেছেন কি?”
“না তো!”
“এলে আপনার এখানে ওঠেন?”
“না। থিয়েটার রোডে একটা ফ্ল্যাট কিনে রেখেছে। সেখানেই ওঠে। তবে কলকাতা এলে একবার দেখা করে যায়, এইমাত্র।”
“বলেছিলেন, অক্টোবরে একবার আসবেন কলকাতা।”
তাপসবাবু হাসলেন। “দাদা বছরে একবার মাত্র আসে। পুজোর সময়। এবার পুজো চলে গেল। এল না। প্রায় ছ-সাত বছর হল, আমেরিকায় আছে। প্রত্যেকবছর পুজোয় এসেছে। এবার এল না কেন কে জানে? আপনার সঙ্গে কতদিন আগে দেখা হয়েছিল স্যার?”
“গতমাসে। আপনার বউদি–”
“বউদির তাড়াতেই আসে। মেমসায়েব বউদি স্যার, বুঝলেন? ইন্ডিয়ান কালচারের খুব ভক্ত।”
“আপনার বউদির সঙ্গে আলাপ হয়নি অবশ্যি। আমি ভেবেছিলাম আপনার বউদি কলকাতার মেয়ে। প্রশান্তবাবুর কথা শুনে তা-ই মনে হয়েছিল।”
তাপসবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “মেমসায়েব দাদার সেকেন্ড ওয়াইফ স্যার!”
“হ্যাঁ, হা! ফাস্ট ওয়াইফ কলকাতার মেয়ে বলছিলেন। বুঝতে ভুল করেছি।”
“দাদা স্যার বড্ড খেয়ালি লোক।”
“তা-ই বুঝি?” কর্নেল চুরুট ধরালেন। “আপনার কলকাতার বউদি সম্ভবত মারা যান।”
“হ্যাঁ!”
“অসুখ হয়েছিল বুঝি?”
“হ্যাঁ!”
“কলকাতায় মারা যান?”
“তা তো জানি না।” তাপসবাবুর মুখে এতক্ষণে সন্দেহের ছাপ ফুটে উঠল। “আমি স্যার দাদার ফার্স্ট ওয়াইফকে দেখিনি। কাজেই বলতে পারব না।”
“আচ্ছা, চলি তাপসবাবু! নমস্কার!”
আমরা কয়েক পা এগিয়ে আসতেই তাপসবাবু সঙ্গ নিলেন। “একটা কথা স্যার। আপনাদের পরিচয় তো দিলেন না? দাদা আবার কোনও কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েনি তো?”
কর্নেল হাসলেন। “কেন ও কথা মনে হল আপনার?”
“আপনারা আই বি কিংবা সি আই ডি অফিসার। তাই না স্যার?”
“হলেও আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”
তাপসবাবু শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, “আজ কাগজে দেখলাম, দাদার থিয়েটার রোডের ফ্ল্যাটে সমীরদা সুইসাইড করেছে। সেজন্যই জিজ্ঞেস করছি, স্যার!”
কর্নেল আস্তে বললেন, “আপনার কলকাতার বউদির নাম কী ছিল তাপসবাবু?”
তাপসবাবুর মুখ সাদা হয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “শোনা কথা স্যার! আমি বউদিকে কখনও দেখিনি। বড় হয়ে শুনেছি। দাদা আমার চেয়ে একুশবছরের বড় স্যার! আমার বাবার প্রথমপক্ষের ছেলে হল দাদা। আমি স্যার দ্বিতীয় পক্ষের। আমার স্যার”।
“আপনার কলকাতার বউদির নাম ছিল অনামিকা। তাই না?”
“শুনেছি স্যার! দাদা বড় ঝামেলা করে বেড়াত বলে বাবা ওকে ত্যাজ্যপুত্র। করেছিলেন।”
“থ্যাংক, তাপসবাবু! আপনার চিন্তার কারণ নেই। চলি।”
গাড়িতে বসে দেখলাম, তাপসবাবু অপটু হাতে আঁকা ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছেন। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম, “নাহ! তত জমল না। রহস্যের জটগুলো পটাপট ছেড়ে যাচ্ছে।”
কর্নেল বললেন, “একটা থিওরি মাথায় রেখে এগোলে অনেক সুবিধে হয়। বিনা থিওরিতে তথ্য খুঁজে বেড়ানো খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার শামিল, জয়ন্ত! একটা থিওরি যদি তথ্যের ভিত্তি না পায়, যদি নড়বড় করে, তা হলে দ্বিতীয় থিওরি তৈরি করো! আবার এগোও।”
“এবার কোনদিকে এগোব, বলুন?”
“ইলিয়ট রোডে সানি ভিলা।”
“বাড়ি ফিরে কী লাভ? চলুন, লেকটাউনে প্রদীপ মিত্রের বাড়ি ঘুরে আসি।”
“ডার্লিং! তুমি পরস্ত্রীর প্রেমে পড়ে গেছ!”
“কী আশ্চর্য!”
কর্নেল হাসলেন। “আশ্চর্য তো বটেই। চলো, আগে বাড়ি ফিরে কফি খেয়ে ঘিলু চাঙ্গা করা যাক। তারপর তোমাকে একটা ছোট্ট কাজের দায়িত্ব দেব।”
তিনতলায় কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় পৌঁছে বললাম, “মিস্ট্রি ইজ সল, বস্! মিঃ রায়কে তার অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিন, অনামিকা সেনের কিলার প্রশান্ত সান্যাল।”
কর্নেল ডোরবেলের সুইচ টিপে বললেন, “বাই দা বাই, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি, গতকাল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের মর্নিং ফ্লাইটে পি সান্যালের নামে হংকংয়ের কনফার্ম টিকিট ছিল। বাটি হি মি দা ফ্লাইট।”
“তা হলে আর কী? খেলা শেষ।”
কর্নেল বললেন, “খেলা শেষ কোথায় ডার্লিং? এই তো সবে শুরু।
ষষ্ঠী দরজা খুলে মুচকি হেসে চাপাস্বরে বলল, “হালদারমশাই এয়েছেন।”
ড্রয়িং রুমে ঢুকে দেখি, হালদারমশাই সোফায় পা ছড়িয়ে হেলান দিয়েছেন। চেহারা উস্কোখুস্কো। চোখ বন্ধ। নাক ডাকছে। ডাকলাম, “হালদারমশাই!”
হালদারমশাই তড়াক করে লাফ দেওয়ার ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বসলেন। তারপর করুণ হাসলেন।
কর্নেল হাঁকলেন, “ষষ্ঠী! শিগগির কফি।” তারপর হালদারমশাইয়ের দিকে ঘুরলেন। “অবধূতজির মাহাত্মদর্শন করে আপনার চেহারার জ্যোতি আশা করেছিলাম হালদারমশাই!”
হালদারমশাই হাই তুলে বললেন, “খুব টায়ার্ড।”
“কী দেখলেন বলুন?”
হালদারমশাই বুকপকেট থেকে একটা লকেট বের করে কর্নেলকে দিলেন। বললেন, “এইটুকখান লকেট। তার দাম দশ টাকা। আবার কয় কী, সোনার চেন ছাড়া পরন যাইব না।”
“হু! তো মড়ার সিগারেটটানা দেখলেন?”
“মড়া মানে একটা স্কেলিটন! কংকাল।”
“আহা! কংকাল সিগারেট টানল কি না তা-ই বলুন?”
“টানল। তবে–”
“তবে কী?”
“ঠিক বোঝা গেল না কিছু। স্ত্রীলোকের কংকাল। কারণ মা মা বলে ডাকলেন। বললেন, ওঠ তো মা! সিগারেট টানো তো মা! কংকালটা হাত বাড়াইয়া সিগারেট নিল। সাধুবাবা ধরাইয়া দিলেন। কিছু বোঝা গেল না। স্ত্রীলোকের সিগারেট টানা মনঃপূত হইল না।” হালদারমশাই আমার দিকে ঘুরলেন। “আচ্ছা, কন তো। জয়ন্তবাবু! এই কাজটা আমাগো কালচার-ট্রাডিশনের অ্যাগেনস্টে না? একটা গণ্ডগোল আছে কোথাও।”
বললাম, “রাত্রে না দিনে দেখলেন?”
“রাত্রে। তখন প্রায় বারোটা। তারপর কীর্তন শুরু হল। আমি রাত দেড়টার ট্রেন ধরলাম। হাওড়ায় পৌঁছতে সকাল সাড়ে নটা। চাকা গড়ায় না এমন একখান ট্রেন!”
কর্নেল লকেটটা আমাকে দিয়ে বললেন, “চিনতে পারছ জয়ন্ত?”
বললাম, “হ্যাঁ। আর্টিস্ট সুমিতবাবুর ঘরে এঁর ছবি দেখেছি।”
“এবং এই লকেট আছে মিঃ রায়ের গলায়।”
লকেটটা কর্নেল নিলেন আমার হাত থেকে। বললেন, “তো হালদারমশাই, আপনি কি অবধূতজির এই লকেট ধারণ করবেন বলেই কিনে এনেছেন?”
হালদারমশাই প্রচণ্ড হাত নেড়ে বললেন, “না কর্নেলস্যার! এটা আপনাকে দেখানোর জন্য কিনে এনেছি।”
ষষ্ঠী কফি এনে হালদারমশাইয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে হাসি চাপল। হালদারমশাইকে দেখলে ষষ্ঠীর কেন হাসি পায় জানি না। হালদারমশাই কফির পটের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবলেন। তারপর আপনমনে বললেন, “দুই কাপ খাইছি।” বলে নস্যির কৌটো বের করে নস্যি নিলেন।
ষষ্ঠীর দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে কর্নেল বললেন, “হাঁ করে কী দেখছিস তুই?”
সঙ্গে সঙ্গে সে কেটে পড়ল। বললাম, “কর্নেল, বরং লকেটটা ষষ্ঠীকে ধারণ করতে দিন।”
হালদারমশাই হাসলেন। “আমি রামকৃষ্ণঠাকুরের ভক্ত। উনি কইছিলেন, একজন লোক বিশ বৎসর সাধনা কইরা অন ফুট নদী পার হওন শিখল। কথা হইল, এক পয়সায় নদী পার হওন যায়। তার জন্য বিশটা বৎসর নষ্ট! স্কেলিটনের সিগারেট টানা দেখতে দেখতে সেই কথাটা মনে পড়ছিল। হোয়াট ইজ দা মিনিং অব ইট?”
কর্নেল বললেন, “বিজ্ঞান প্রচার সমিতির প্রদীপ মিত্র সদলবলে আজ দুপুরের ট্রেনে কাঁটালিয়াঘাট যাচ্ছেন।”
“আঁ?” হালদারমশাইয়ের চোখ গোল হয়ে গেল।
“আপনার মনে হচ্ছে না প্রদীপ মিত্র একটা সাংঘাতিক ঝুঁকি নিচ্ছেন?”
“হঃ!”
“আমার আশঙ্কা হচ্ছে, প্রদীপবাবু যদি প্রমাণ করতে পারেনও যে ওটা ম্যাজিক, অবধূতজির চেলারা তা মানবে না। প্রদীপবাবুর ওপর হামলা চালাবে।”
“হঃ!”
কর্নেল কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, “এর আগে প্রদীপবাবু অনেক গডম্যানকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, কাগজে পড়েছি। তবে তাদের কলকাতার প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের এবং গণ্যমান্য নাগরিকদের উপস্থিতিতে যুদ্ধে ডেকেছেন। কোনও গডম্যান প্রেস ক্লাবে আসতে রাজি হননি। তাদের কৈফিয়ত অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। তারা অলৌকিক শক্তি যেখানে-সেখানেই বা দেখাতে আসবেন কেন? তাদের সাধনপীঠে বসেই দেখাবেন। কিন্তু প্রদীপ মিত্র তাতে রাজি হননি। হামলার আশঙ্কা করেছেন। প্রদীপ মিত্রের কৈফিয়তও যুক্তিযুক্ত। অথচ এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, উনি এক গডম্যানের সাধনপীঠে গিয়েই লড়বেন। এটা একটা সাংঘাতিক রিস্ক।”
আমি বললাম, “স্থানীয় পুলিশকে নিশ্চয় জানিয়ে রেখেছেন।”
হালদারমশাই মাথা নাড়লেন। “পুলিশ কিছু করবে না জয়ন্তবাবু! কাঁটালিয়াঘাটে থানার ওসি অবধূতজির ভক্ত। আমার স্বভাব তো জানেন। সব খোঁজ নিয়েছি। লোকাল পলিটিক্যাল মাতবররাও ওনার ভক্ত।”
কর্নেল বললেন, “ভোটের রাজনীতির এটাই সাম্প্রতিক হালচাল। যাই হোক, প্রদীপ মিত্র সাংঘাতিক রিস্ক নিচ্ছেন। চিন্তা করুন হালদারমশাই, এক লাখ টাকা বাজি।”
হালদারমশাই সোজা হয়ে বসলেন। “কেউ কোনও কারণে প্রদীপবাবুকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে না তো কর্নেল স্যার? কেউ ওনাকে প্রোভোক করছে না তো?”
“আপনি বুদ্ধিমান, হালদারমশাই! ঠিকই ধরেছেন।”
হালদারমশাই আরেক টিপ নস্যি নিয়ে হাঁচবার চেষ্টা করে বললেন, “হঃ!”
কর্নেল কি তাতিয়ে দিচ্ছেন প্রাইভেট ডিটেকটিভকে? চাপাস্বরে এবার বললেন, “আমার হাতে রিলায়ে সোর্সের খবর আছে, প্রদীপ মিত্র অবধূতজির কিছু গোপন তথ্য জানেন এবং তার পূর্বাশ্রমের কথাও নাকি জানেন। সে সব কথাও তিনি জনসমক্ষে ফাঁস করে দিতে যাচ্ছেন। তাহলেই বুঝুন!”
হালদারমশাই দুই উরুতে দুই হাত রেখে সোজা হয়ে বসে নীচের দিকে দৃষ্টি রাখলেন। এটা ওঁর চিন্তাকুল ভঙ্গি। কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মুখে ওঁর এই ভঙ্গিটি বরাবর দেখে আসছি।
কর্নেল ষড়যন্ত্রসংকুল স্বরে বললেন, “আজ সকালে ওঁর স্ত্রী চিত্রাদেবী এসেছিলেন আমার কাছে। উনিও উদ্বিগ্ন! স্বামীর সেফটির ব্যবস্থা করে দিতে বলছিলেন। আমি ওঁকে বলেছি, স্ত্রীই স্বামীর শক্ত সেফটি। কাজেই চিত্রাদেবীও সম্ভবত স্বামীর সহগামিনী হচ্ছেন।”
হালদারমশাই ঘড়ি দেখে বললেন, “পৌনে বারোটা বাজে। ট্রেন বারোটা কুড়িতে। তবে কাল ছাড়ছিল পৌনে একটায়!”
“গতরাত্রে আপনাকে ফোন করেছিলাম–”
এই পর্যন্ত শুনেই হালদারমশাই উঠে পড়লেন। “আগে এ সব জানলে কাঁটালিয়াঘাটে থেকে যেতাম। ঠিক আছে। কর্নেলস্যার যখন বলছেন, তখন আর কী?” বলে জোরে বেরিয়ে গেলেন।
বললাম, “ভদ্রলোক রাত্রি জেগে ক্লান্ত হয়ে সদ্য ফিরেছেন। আবার ওঁকে তাতিয়ে দিয়ে সেখানে ফেরত পাঠালেন?”
কর্নেল হাসলেন। “কী আশ্চর্য! আমি কি একবারও ওঁকে বলেছি আপনি আবার কাঁটালিয়া ঘাটে চলে যান? আমি ওঁকে নিছক কিছু খবর জানিয়েছি।”
“এটাই তো প্রভভাকেশন!”
“হ্যাঁ। প্রভোকেশন। জয়ন্ত, হালদারমশাই এবং প্রদীপ মিত্রের মধ্যে তা হলে দেখ কী চমৎকার মিল! যে-কোনও রহস্যভেদে দুজনেই প্রচণ্ড আগ্রহী!”
“ভুলে যাচ্ছেন, আপনিও একজন প্রখ্যাত রহস্যভেদী।”
“বলতে পারো। তবে আমাকে কেউ পোভোক করতে পারে না। বিন্দুমাত্র তাতিয়ে দেওয়া চেষ্টা টের পেলে আমি–” কর্নেল হঠাৎ চুপ করলেন। চোখ বুজে হেলান দিয়ে দাড়িতে আঁচড় কাটতে থাকলেন।
বললাম, “আমি চলি, বস্!”
“তোমাকে একটা ছোট্ট কাজের দায়িত্ব দেব বলেছি, জয়ন্ত! পালাতে চাইছ কেন?”
“সরি! ভুলে গিয়েছিলাম।”
কর্নেল পকেট থেকে খুদে নোটবই বের করে পাতা উল্টে বললেন, “হু, ইন্দরজিৎ সিং। শেক্সপিয়ার সরণির ওই বাড়িতে দোতলার তিন নম্বর ফ্ল্যাটের ওনার। সিঁড়িতে উঠে বাঁদিকের ফ্ল্যাট। ওঁর ফ্ল্যাট থেকে পাঁচ নম্বর সোজাসুজি চোখে পড়ে।”
“আমাকে কী করতে হবে তা-ই বলুন না!”
“পুলিশ সূত্রে জেনেছি, মিঃ সিং একজন ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট। অনেক বিদেশি কাগজেও তিনি লেখালিখি করেন। তুমিও একজন জার্নালিস্ট। তুমি একবার ওঁর সঙ্গে দেখা করো।”
“আমার সঙ্গে ওর চেনাজানা নেই। নামটা চেনা-চেনা মনে হচ্ছে যদিও।”
“আহা, কথাটা শোনো! তুমি, ওঁকে মিট করো। ধরো, তুমি তোমাদের বাংলা কাগজের জন্য সমীর রুদ্র সম্পর্কে একটা অন্ততদন্তমূলক স্টোরি করতে মও। তাই ওঁর সাহায্য দরকার। আমার পয়েন্টটা বুঝতে পারছ তো?”
“বুঝতে পারছি। কিন্তু যদি ভদ্রলোক আমাকে পাত্তা না দেন?”
“গিয়ে দেখ না! পুলিশকে যে সব কথা উনি হয়তো বলতে চাননি, তোমাকে বলতে আপত্তি না-ও করতে পারেন। কর্নেল আমাকে তাড়া দিলেন। “দেরি কোরো না। দরকার হলে তোমার আইডেন্টিটি কার্ড দেখাবে। এমন কি এ-ও বলবে, স্টোরিটা বেরুলে ওঁকেই ক্রেডিট এবং দক্ষিণা দেওয়া হবে।”
“ওঁর ফোন নাম্বার জানেন? ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে যাওয়া উচিত। তাছাড়া এখন উনি আছেন কি না, সেটাও তো জানা দরকার। গিয়ে যদি দেখি উনি বেরিয়েছেন?”
“ফোনে ওঁকে পাবে না। কারণ ওঁর ফোন ডেড হয়ে আছে কদিন থেকে।”
কিছুক্ষণ পরে সেক্সপিয়ার সরণিতে সেই বাড়ির সামনে গাড়ি রেখে গেটে গেলাম। দারোয়ান টুলে বসে খৈনি ডলছিল। আমাকে দেখে সে বলে উঠল, “এক মিনিট ঠারিয়ে?” তারপর একটা নতুন এক্সারসাইজ খাতা বগল থেকে বের করে দিল। “কিসিকা সাথ মুলাকাত কারনে যাতা, ইসমে লিখ দিজিয়ে। ডেট, টাইম, আপকা অ্যাড্রেস–সব কুছ লিখনা পড়ে গা।”
বুঝলাম, ফ্ল্যাট-ওনারদের সোসাইটি এবার সতর্ক হয়েছেন। মনেমনে হাসলাম। চোর পালালে গৃহস্থের বুদ্ধি বাড়ে বলে একটা বাংলা প্রবাদ আছে। কিন্তু এভাবে কি নিরাপত্তা বজায় রাখা সম্ভব? ভুল নাম-ঠিকানা লিখে যে-কেউ বাড়িতে ঢুকতে পারে। এ মহানগরে শুধু হাতের লেখা দেখে কোনও দুষ্কৃতাঁকে খুঁজে বের করা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার শামিল।
দারোয়ান আমার লেখার ওপর চোখ বুলিয়ে বলল, “আপ সিং সাবকা সাথ মুলাকাত করনে আয়া?”
ওকে খুশি করার জন্য বললাম, “বাহ! তব তুম তো ইংলিশ ভি জানতা!”
“থোড়াসা।” সে খাতাটি আগের মতো বগলদাবা করল। বলল, “যাইয়ে। সিংসাব অভি বাহারসে আয়া।”
সিঁড়ি বেয়ে উঠে বাঁদিকে সংকীর্ণ করিডর। তিন নম্বর ফ্ল্যাট থেকে প্রশান্ত সান্যালের পাঁচ নম্বর ফ্ল্যাট সোজাসুজি দেখা যায়। ডোরবেলের সুইচ টেপার প্রায় মিনিট দুই পরে দরজা একটু ফাঁক হল। এক শিখ ভদ্রলোকের মুখ দেখতে পেলাম। চোখে সানগ্লাস, মাথায় পাগড়ি, মোমদেওয়া গোঁফ, দাড়িতে কালো সুতোর জাল সাঁটা। বললেন, “ইয়েস?”
খুব ডাঁটিয়াল লোক দেখছি! ঝটপট নিজের পরিচয় দিলাম। আইডেন্টি কার্ড বের করে দেখাতে যাচ্ছি, বললেন, “নাও আইম বিজি! সরি মিস্টার।” তারপর দরজা বন্ধ করে দিলেন।
অপমানিত বোধ করে চলে এলাম। কর্নেলের বাড়ির দিকে যেতে যেতে হঠাৎ মনে হল, ওই মুখটা কোথায় যেন দেখেছি। ঘরের ভেতর চোখে সানগ্লাস পরেছেন। চোখের অসুখ? কিন্তু মুখটা যেন চেনা।
কর্নেল আমাকে দেখে বললেন, “তোমাকে খুব আপসেট দেখাচ্ছে! এনি মিসহ্যাপ, জয়ন্ত?”
ধপাস করে বসে বললাম, “এভাবে যেখানে-সেখানে আমাকে পাঠাবেন না প্লিজ! অপমানের একশেষ। মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল লোকটা।”
কর্নেল হাসলেন। “রিপোর্টার হিসেবে তুমি সত্যিই ব্যর্থ, ডার্লিং! রাগ লজ্জা ভয়, এই তিন থাকতে নয় প্রবচনটা একজন ভাল রিপোর্টারের প্রতি প্রযোজ্য।”
“স্বীকার করছি। কিন্তু একই পেশার লোকেদের মধ্যে ওই প্রবচন খাটে না। লোকটা মন্ত্রী নয়, নেতাটেতা নয়, আমলা নয়। আমি তবু তো ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট। আর ও ব্যাটা ফ্রিল্যান্স করে। তার এই ব্যবহার অদ্ভুত। তা ছাড়া মুখটা চেনা মনে হল।”
“চেনা মনে হল?”
“হ্যাঁ। কোথায় যেন দেখেছি। তাছাড়া ওই অ্যাকসেন্টে শিখরা ইংরেজি বলে না।”
কর্নেল একটু পরে বললেন, “তা হলে তোমার মিশন ব্যর্থ হয়নি জয়ন্ত!”
অবাক হয়ে বললাম, “তার মানে?”
কর্নেল চোখ বুজে দাড়িতে হাত বুলিয়ে আস্তে বললেন, “ফরগেট ইট।”