২.৫ মুক্তির উপায়

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – মুক্তির উপায় 

জয়বন্তের নিকটে এখন রাত্রিদিন সমান হইয়াছে, তিনি যে গৃহে আছেন, তথায় কোনরূপেই কোনদিক হইতে আলো আসিবার উপায় ছিল না। তিনি গহ্বরের প্রাচীরে ঠেস দিয়া বসিয়া নানারূপ চিন্তা করিতে লাগিলেন। তিনি ইচ্ছা করিয়া এই দুর্বৃত্তের হস্তে পতিত হইয়াছেন, এখান হইতে বাহির হইয়া যাইবার কোন উপায় নাই। 

গৃহের উপরে দুইটা ছোট জানালা আছে বটে, কিন্তু তাহা এত উচ্চে যে, সেখানে উঠিবার কোন উপায় নাই; যদিই বা কোনরূপে জানালায় উপস্থিত হইতে পারা যায়, তাহা হইলেও জানালা দুটি এত ছোট যে, তাহার ভিতর দিয়া বাহির হইবার কোন সম্ভাবনা নাই। প্রাচীরে ঠেস দিয়া জয়বন্ত নানা চিন্তা করিতেছিলেন, বিপদে পড়িয়া ভীত বা হতাশ হইবার লোক তিনি ছিলেন না। মনে মনে বলিলেন, “যদি অদৃষ্টে এখন মৃত্যু না থাকে, একটা-না-একটা কোন উপায় হইবেই।” 

এই সময়ে গৃহমধ্যে কি নড়িয়া উঠিল। গৃহমধ্যে কি প্রবেশ করিল, তাহা তিনি প্রথমে স্থির করিতে পারিলেন না; অবশেষে দেখিলেন, গৃদের এক পার্শ্বে একটা ক্ষুদ্র নৰ্দ্দমা আছে, সেই নৰ্দ্দমা দিয়া একটা বিড়াল সেই গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়াছে, তাহার পশ্চাতে তাহার দুইটি শাবকও আসিয়াছে। 

জয়বন্ত বুঝিলেন, এখানটা নিৰ্জ্জন পাইয়া বিড়াল এখানে প্রসব করিয়াছিল। আবার এই নির্জ্জনগৃহে শাবকসহ রাত্রে আসিয়াছে। 

বিড়াল দেখিয়া জয়বন্তের মনে সহসা একটা মৎলব উদয় হইল, তিনি নড়িলেন না—নড়িলে পাছে বিড়ালটা পলাইয়া যায়; মৃদুস্বরে চুমকুড়ি দিয়া ডাকিলেন, “পুস্—পুস্—পুস্—” 

বিড়ালটা লেজ নাড়িতে নাড়িতে তাঁহার নিকটস্থ হইল। তিনি আদরে তাহার পৃষ্ঠে হাত বুলাইতে লাগিলেন। বিড়াল তাঁহার গায়ে পা দিয়া খেলা করিতে লাগিল, লাঙ্গুল দিয়া আঘাত করিতে লাগিল। 

বামহস্তে বিড়ালকে ধরিয়া রাখিয়া জয়বন্ত দক্ষিণ হস্তে পকেট হইতে কাগজ ও পেন্সিল বাহির করিয়া লিখিলেন;- 

“এই পড়ো বাড়ীতে একজন দস্যু আমাকে গৃহতলস্থ একটি গুপ্ত গহ্বরের মধ্যে আটকাইয়া রাখিয়াছে, আমাকে খুন করিতে চেষ্টা পাইতেছে। যাঁহার নজরে এই পত্র পড়িবে, তিনি অনুগ্রহ করিয়া যেন তৎক্ষণাৎ পুলিসে সংবাদ দেন।” 

তিনি নিজের পরিহিত কাপড়ের এক অংশ ছিঁড়িয়া চিঠিখানি বাঁধিয়া সেই চিঠি বিড়ালের গলায় বাঁধিয়া দিলেন। তাহার পর বিড়ালকে তাড়া দেওয়ায় সেশাবকসহ সত্বর সেই গৃহ হইতে নৰ্দ্দমা দিয়া বাহির হইয়া পলাইয়া গেল। জয়বন্ত ভগবানের উপরে আত্মরক্ষার ভার দিয়া আবার প্রাচীরে ঠৈস দিয়া বসিলেন; এখন তাঁহার তন্দ্রা আসিল, তিনি নিদ্রিত হইয়া পড়িলেন। 

কতক্ষণ নিদ্রিত ছিলেন, তাহা তিনি জানেন না। সহসা কাহার কন্ঠস্বর শুনিয়া তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইল, তিনি চমকিত হইয়া চক্ষু মেলিলেন। দেখিলেন, উপর হইতে আলো-গৃহমধ্যে পড়িয়াছে; বুঝিলেন আবার মহাপাপী মেটা আসিয়াছে। 

মেটা উপর হইতে বলিল, “কেমন, বেশ আরামে ঘুম হইতেছে?” 

তাহার কথায় জয়বন্ত ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় হইলেন। বলিলেন, “আমি নিতান্ত আহাম্মুখ, তাহাই তোমার কথায় বিশ্বাস করিয়াছিলাম।” 

“মহাশয় তাহা জানেন, আমি কিরূপে জানিব?” 

ক্রোধে জয়বন্ত কথা কহিতে পারিলেন না। 

মেটা বলিল, “তোমায় কিরূপে এই ঘর হইতে বাহির করিব, ইহাই এখন আমার চিন্তার প্রধান কারণ হইয়াছে।” 

জয়বন্ত সোৎসাহে বলিলেন, “তাহা হইলে তুমি আমাকে এখান হইতে বাহির করিতে চাও এরূপ মত-পরিবর্ত্তন?”

“হাঁ, এই রকম ইচ্ছা।” 

“তবে একটা দড়ী ফেলিয়া দাও—তাহাই ধরিয়া আমি উঠিব।” 

“যখন তোমায় বাহির করিব মনে করিতেছি, তখন তুমি দড়ী ধরিতে পারিবে না।” 

“কেন?” 

“তখন তুমি এই ঘরে অসাড় হইয়া পড়িয়া থাকিবে।” 

“কেন?” 

“কেন আবার কি, মরিলে অসাড় হয়, জান না?” 

“পিশাচ-নারকি! খুনি!” 

“অস্বীকার কেমন করিয়া করি, মহাশয়ের কাছেই একবার স্বীকার করিয়াছি।” 

“তাহা হইলে তুমি আমাকেও খুন করিতে চাও?” 

“বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নাই, খুন হওয়া-না-হওয়া মহাশয়ের হাত।” 

“কিসে?” 

“যাহার কাছে নোটগুলি আছে, তাহাকে একখানা পত্র দিলেই সব গোল চুকিয়া যায়।” 

সহসা এই সময়ে বাড়ীর সদর দরজায় সবলে কে বারংবার আঘাত করিতে লাগিল; সেই শব্দে মেটা চমকিত হইয়া সেইদিকে ফিরিল। 

দ্বারে আরও সবলে আঘাত চলিতে লাগিল। কাহারা চীৎকার করিয়া বলিল, “শীঘ্র দরজা খোল, না হয় দরজা ভাঙিয়া ফেলিব।” 

মেটা কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিতপ্রায় দণ্ডায়মান রহিল। সে জানিত, এখানে যে জনমানব আছে, তাহা কেহ জানে না, তবে এ কাহারা? 

মেটা পর মুহূর্তেই বাড়ীর সদর দরজার দিকে না গিয়া বাড়ীর পশ্চাতের দিকে ছুটিল, সেদিকে একটা ক্ষুদ্র দরজা ছিল, সে সেই দরজা দিয়া তীরবেগে বাহির হইয়া অন্ধকারে অদৃশ্য হইয়া গেল। 

এদিকে যাহারা দ্বারে আঘাত করিতেছিল, তাহারা দ্বার ভাঙিয়া ফেলিয়া বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিল।

তাহারা পুলিস। যাঁহার বিড়ালের গলায় জয়বন্ত পত্র লিখিয়া দিয়াছিলেন, বিড়াল তাঁহার বাড়ী ফিরিয়া যাইবামাত্র তিনি তাহার গলায় কি বাঁধা আছে দেখিয়া পত্ৰ খুলিয়া লইয়া পাঠ করিলেন। প্রথমে তিনি বিশ্বাস করেন নাই, তবে সত্য হইলেও হইতে পারে, এই ভাবিয়া তিনি পুলিসে সংবাদ দিলেন। 

পুলিসও প্রথমে তাঁহার কথা বিশ্বাস করে নাই, তবে সত্য হইলেও হইতে পারে, অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে ক্ষতি কি, এই ভাবিয়া তাহারা সেই বাড়ীর দ্বারে আসিয়া দেখিল, ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ। তখন একটা কিছু হইয়াছে, নিশ্চিত জানিয়া তাহারা দরজা ভাঙিয়া বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিল। 

গৃহমধ্যে অপর লোক প্রবেশ করিয়াছে জানিতে পারিয়া জয়বন্ত প্রাণপণে চীৎকার করিয়া তাহাদের ডাকিতে লাগিলেন। তখন পুলিশ-কৰ্ম্মচারিগণ গহ্বরের মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। 

দড়ী ফেলিয়া দিয়া তাহারা অনেক কষ্টে জয়বন্তকে উপরে তুলিল। 

জয়বন্ত কিন্তু মেটার কথা তাহাদের কিছু বলিলেন না। বলিলেন, একজন বদমাইস লোক তাঁহাকে আটক করিয়া রাখিয়াছিল, তিনি তাহাকে চেনেন না। তাহার কি উদ্দেশ্য তাহাও বলিতে পারেন না। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – আত্মহত্যার চেষ্টা 

জামশেদজী প্রত্যহ ভাবিয়া ভাবিয়া ক্রমশঃ উন্মত্তের মত হইয়া উঠিল। প্রত্যহ সে ডাকের প্রত্যাশায় ব্যাকুল হইয়া বসিয়া থাকিত, কিন্তু প্রত্যহই হতাশ হইত, এ পৰ্য্যন্ত কনিষ্ঠ ভ্রাতার কোন পত্ৰই আসিল না। তবে তাহার কি হইল? জাহাজ হইতে সুবিধামত দেহটা সমুদ্রে ফেলিয়া দিয়া সে পোর-বন্দরে পৌঁছিবে, পৌঁছিয়াই তাহাকে পত্র লিখিবে। সন্দেহ দূর করিবার জন্য সে তথায় দিনকতক থাকিয়া বোম্বাই ফিরিবে, কিন্তু এতদিন হইয়া গেল, সে ফিরিয়া আশা দূরে থাক, তাহার পত্র পৰ্য্যন্ত আসিল না খুবই মুস্কিলের কথা। 

অবশ্যই তাহার কোন বিপদ ঘটিয়াছে, নতুবা সে নিশ্চয়ই ফিরিয়া আসিত, তবে কি ধরা পড়িয়াছে? তাহা যদি হইত, তাহা হইলে পুলিস তাহাকে নিশ্চয়ই বোম্বাই লইয়া আসিত। 

ভয়ে জামসেদজী এ পৰ্য্যন্ত একখানা নোটও ভাঙাইতে পারিল না। ভাবিয়া ভাবিয়া ভয়ে তাহার দেহ অস্থিচর্মসার হইয়া আসিল। আহার গেল, নিদ্রা গেল, তাহাকে দেখিলে এখন আর চেনা যায় না। তাহার পরিচিত লোকগণ তাহার এই পরিবর্তন দেখিয়া বিস্মিত হইল; সকলেই বলাবলি করিতে লাগিল, পাটেল সাহেবের নিশ্চয়ই কোন কঠিন রোগ হইয়াছে, তাহার মৃত্যুর আর বিলম্ব নাই। 

জামশেদজী একদিন বৈকালে আর আফিসে যাইবে না। ভাবিতেছিল, এইরূপ সময়ে তাহার কর্মচারীর এক পৌষ্টকার্ড পাইল; সে লিখিয়াছে যে, একজন ভদ্রলোক বৈকালে দত্ত তুলাইতে আসিবেন, অবশ্য অবশ্য আফিসে আসিবেন। 

এ কয়দিন এক পয়সাও উপার্জ্জন হয় নাই খরচও চলিতেছে না, কর্জ্জ করিয়া কোনগতিকে চলিতেছে; সুতরাং একটা খরিদ্দার যখন আসিয়াছে, তখন শরীর ও মনের অবস্থা মন্দ হইলেও সে খরিদ্দারকে ছাড়া যাইতে পারে না পাটেল সাহেব বেশ-বিন্যাস করিয়া আফিসে চলিল। 

আফিসে আসিয়া সে বলিল, “কে আসিবে বলিয়া গিয়াছে, কখন আসিবে?” 

তাহার লোক বলিল, “নিশ্চয়ই আসিবে।” 

“কই এখন ত আসিল না। আমারই আসিতে দেরী হইয়াছে।” 

“তাঁহার একজন বন্ধু তাঁহাকে আপনার কাছে আসিতে বলিয়াছিলেন—তিনি নিশ্চয়ই আসিবেন।” 

“কে সে বন্ধু?” 

“তাহার নাম জানি না। সেই যে গুজরাটী ভদ্রলোক সেই যাঁহার দাঁত তোলার পরদিনে ডাক্তার সাহেব বিদেশে গিয়াছেন।” 

অতিকষ্টে পাটেল সাহেব আত্মসংযম করিল। তাহার মনে যেরূপ ভাব হইল, তাহার বর্ণনা হয় না। তাহার মুখ পাংশুবর্ণ প্রাপ্ত হইল, মুখ শুকাইয়া এতটুকু হইয়া গেল। সে বিকৃতস্বরে বলিল, “তিনি কি বলিলেন?” 

“বলিলেন যে, তাঁহার সেই গুজরাটী বন্ধু আপনার অনেক প্রশংসা করিয়াছেন।” 

গুজরাটী বন্ধু-হত, খণ্ড-বিখণ্ড গুজরাটী বন্ধু তাহার যথেষ্ট প্রশংসা করিয়াছে। তাহার সর্ব্বাঙ্গে গলদঘর্ম্ম ছুটিল, তাহার হাত পা থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। সে অতিকষ্টে সংযতস্বরে বলিল, “এই ভদ্রলোক তাঁহারই বন্ধু?” 

“হাঁ, তাঁহার বিষয় অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, তাহার পর তাঁহার একখানা ছবি আমাকে দেখাইলেন।” 

এবার জামসেদজীর কন্ঠ রুদ্ধ হইয়া গেল। তাহার আফিসঘরশুদ্ধ সমস্ত পৃথিবীটা যেন তাহার চোখের উপরে সবেগে ঘুরিতে লাগিল। জামসেদজী পড়িয়া যাইবার মত হইল দুই হাতে সম্মুখস্থ টেবিলটা সজোরে চাপিয়া ধরিল। তাহার সর্ব্বাঙ্গ যেন সহসা পাষাণে পরিণত হইয়া গেল। সে অন্যদিকে মুখ ফিরাইল, তাহার চক্ষু ভীতিবিস্ফারিত, মুখে ভীষণ বিভীষিকা! পলাইবার চেষ্টা করা এখন বৃথা। খুব সম্ভব, এখনও সেই বাড়ীতে পাহারা রহিয়াছে। আর পলাইয়া ফল কি? মরুক তাহারা আর এ যন্ত্রণা সহ্য হয় না! ইহাপেক্ষা ফাঁসী দিয়া সকল যন্ত্রণার অবসান করা ভাল। ফাঁসী? ফাসী? চিরকালের জন্য লোকে বলিবে যে, জামসেদজী ফাঁসী গিয়াছে? না-না-না কেন, তাহাপেক্ষা আত্মহত্যা করি না কেন? সে যে ফাঁসী হইতে সহস্র গুণে ভাল। 

সে তাহার কর্ম্মচারীকে বিদায় করিয়া দিয়া বলিল, “সেই ভদ্রলোক আসিলে আমাকে সংবাদ দিয়ো, তুমি এখন বাহিরে গিয়া বস।” 

পাণ্ডুরাং বাহিরে গেলে সে নিজের ঘরের দ্বাররুদ্ধ করিয়া দিল। 

গৃহের এক কোণে একটি ছোট লোহার সিন্দুক ছিল, সে তাহা খুলিল, একতাড়া কি বাহির করিয়া লইয়া টেবিলের সম্মুখে রাখিল, এ সেই লাখ টাকার নোট! 

এ নোট দেখিয়া এখন তাহার হৃদয় আর আনন্দে স্পন্দিত হয় না। এখন এই নোট দেখিয়া তাহার সর্ব্বাঙ্গ শিহরিয়া উঠি। খুন—চুরি—কি ভয়ানক! পাপ করিলে মানুষের এতই অশান্তি জন্মে! 

সকল কথা পুলিসকে লিখিবে বলিয়া সে কাগজ কলম লইল; কিন্তু হাত এতই কাঁপিতে লাগিল যে, একটা পংক্তিও লিখিতে পারিল না; কাগজখানা ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিল। তাহার পর নোটগুলি একটি খামে পুরিয়া উপরে ঠিকানা লিখিল, “পুলিশ কমিশনার-বোম্বাই।”

মৃত্যু—মৃত্যুতে এত ভয় কেন? এ অসহনীয় যন্ত্রণাপেক্ষা মৃত্যু কি শতগুণে শ্রেয় নহে? বাঁচিয়া থাকিয়া ফল কি? যতদিন বাঁচিয়া থাকিতে হইবে, ততদিন এই বিভীষিকা! মৃত্যু শ্রেয়ঃ! এখন পুলিস সকল সন্ধানই পাইয়াছে—তাহার সন্ধানে এখানে আসিয়াছিল, আবার এখনই আসিবে, এখনও হয় ত পাহারায় রহিয়াছে, তাহার পলাইবার কোন উপায় নাই, এখন পুলিসে তাহাকে ধরিবে, তাহার পর—তাহার পর ফাঁসী? না-না তাহাপেক্ষা আত্মহত্যাই ভাল। জামসেদজী পাণ্ডুরাংকে আবার ডাকিল; মনে করিল, তাহাকে বিদায় করিয়া দেওয়াই ভাল। পাণ্ডুরাং আসিলে জামসেদজী তাহাকে বলিল, “আমার জন্য এ কয়টা জিনিষ মোডি কোম্পানীর দোকান হইতে লইয়া এস। এই পত্র দিতেছি।” 

পাণ্ডুরাং পত্র লইয়া বিদায় হইল। জামসেদজী আবার দরজা বন্ধ করিয়া দিল। পরে টেবিলের ভিতর হইতে একখানা শানিত ছুরিকা বাহির করিল; কিন্তু তাহার হাত এতই কাঁপিতে লাগিল যে, ছুরিখানা প্রায় হস্তস্খলিত হইয়া পড়িয়া যাইবার মত হইল। সে টেবিলের উপরে হাত রাখিল। 

আত্মহত্যা বলা যত সহজ, করা তত সহজ নহে। মৃত্যু বাঞ্ছনীয়, শতবার, সহস্রবার বাঞ্ছনীয়, তবুও মৃত্যুতে এত ভয় কেন? কে বলিবে কেন? জামসেদজী পুনঃ পুনঃ সেই ছুরি তুলিয়া কণ্ঠে বসাইবার চেষ্টা পাইল, কিন্তু কিছুতেই পারিল না; তখন বলিল, “হা ভগবান, আমায় বল দাও বল দাও এ যন্ত্রণা আমার আর এক নিমেষের জন্য সহ্য হয় না।” 

এই সময়ে সবলে কে বাহির হইতে তাহার দ্বারে আঘাত করিল। জামসেদজী চমকিত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, সত্বর টেবিলের ভিতরে ছুরিখানা লুকাইয়া ফেলিল, এরূপে আত্মহত্যায় ব্যাঘাত পড়ায় জামসেদজী সন্তুষ্ট ব্যতীত অসন্তুষ্ট হইল না। 

আবার দ্বারে কে পুনঃ পুনঃ আঘাত করিল! পুলিস-পুলিস, তাহার পা এতই কাঁপিতে লাগিল যে, আর দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিল না। আবার ধপাস্ করিয়া বসিয়া পড়িল। 

আবার দ্বারে আঘাত — আবার আঘাত! সে আঘাত ততোধিক বেগে তাহার হৃদয়ে লাগিতেছিল। জামসেদজী অতি কষ্টে হৃদয়ে বল সংগ্রহ করিয়া উঠিল, দরজা খুলিয়া দিল; দেখিল, দ্বারসম্মুখে দাঁড়াইয়া দুইজন কনেষ্টবল। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ – আত্মহত্যা 

পুলিস দেখিয়া জামসেদজী পড়িয়া যাইবার মত হইল, দরজার চৌকাঠ ধরিয়া তাহা সামলাইয়া লইল, নতুবা হয়ত পড়িয়া যাইত, শেষে অদৃষ্টে এই ছিল? কনেষ্টবল তাহাকে সেলাম করিল। সেলাম! গ্রেপ্তার করিতে আসিয়া কেহ কখনও সেলাম করে না, একি—একি স্বপ্ন নাকি? তবে–তবে—ইহারা কিজন্য  আসিয়াছে? জামসেদজী দুই হাতে দুই চক্ষু রগড়াইতে লাগিল। 

তাহাদের মধ্যে একজন বলিল, “আমরা বৎসর বৎসর আপনার নিকট কিছু বক্‌শিস পাইয়া থাকি।”

এই কথায় কি আনন্দের ভাব জামসেদজীর মনে উদিত হইল, তাহা বলা যায় না। সাজসেদজী ব্যগ্রভাবে বলিল, “কাল বৈকালে আসিয়ো, অবশ্যই কিছু দিব।” 

“যো হুকুম হুজুর”, বলিয়া তাহারা প্রস্থান করিল। 

কনেষ্টবলদিগের আগমনে তাহার একটা কাজ হইল। তাহার হৃদয়ে সাহস আসিল, ভাবিল, “আমি নিজের কল্পনায় একটা বিভীষিকা গড়িয়া এত ভীত হইয়া উঠিতেছি কেন? হয় ত আদৌ সে পুলিসের লোক নহে—হয়ত সেই লোকের অনুসন্ধান করিয়াছিল, তাহাতে আসে-যায় কি? আমার ভয়ের কারণ কি? “ এই সময়ে আবার কে দরজায় ঘা দিল, এবার পাটেল সাহেব সাহসে ভর করিয়া গম্ভীরভাবে বলিল, “কে?” 

“সেই কালকের ভদ্রলোকটি এসেছেন।” 

“ডাক, এখানে।” 

জয়বন্ত ধীরে ধীরে গৃহে প্রবেশ করিলেন। জামসেদজী হৃদয়ে বল বাঁধিয়া বসিয়াছিল। কিছুতেই বিচলিত হইবে না, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল। জয়বন্ত গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলে, দন্ত-চিকিৎসক বলিল, “আসুন-আসুন।” 

জয়বন্ত বসিলেন। 

জামসেদজী বলিল, “শুনিলাম, একটি ভদ্রলোক, যাঁহার দাঁত আমি তুলিয়াছিলাম, তিনি আপনাকে আমার নিকটে পাঠাইয়া দিয়াছেন।” 

“হাঁ, তবে আপনি কেবল তাহার দাঁত তুলেন নাই।”

কথাটা এবং বলিবার ধরণটা জামসেদজীর অত্যন্ত খারাপ লাগিল; সংক্ষেপে কহিল, “কেন?”

“আপনার চিকিৎসায় তিনি খণ্ড-বিখণ্ড হইয়াছিলেন।” 

এই কথায় জামসেদজীর মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল—মৃত ব্যক্তির মুখও এত পাংশুবৰ্ণ হয় না। তাহার পা থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। 

জয়বন্তের যেটুকু সন্দেহ ছিল, তাহা দূর হইল। তিনি একেবারে কাজের কথা আরম্ভ করিলেন। বলিলেন, “ডাক্তার, দরজাটা বন্ধ করিয়া দিলে বোধহয়, তোমার কোন আপত্তি নাই।” 

ডাক্তারের মুখে কথা সরিল না। জয়বন্ত নিজে উঠিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন। তৎপরে বসিয়া বলিলেন, “বুঝিতেই পারিতেছ যে, লীলাখেলা ফুরাইয়াছে—মহাশয় ও মহাশয়ের ভাই উভয়ে মিলিয়া হরকিষণ দাসকে লইয়া যে খেলাটুকু খেলিয়াছিলেন, তাহা এতদিনে প্রকাশ পাইয়াছে।” 

জামসেদজী একেবারে নীরব! সে বিস্ফারিত নয়নে যেন জয়বত্তের কথাগুলিই কেবল গিলিতেছে, তাহার বাকরোধ হইয়াছে, কথা কহিবার ক্ষমতা বিলুপ্ত হইয়াছে। 

জয়বন্ত বলিলেন, “আমি পোর-বন্দরের পুলিসে চাকরী করি।”

এবারও জামসেদজী নিরুত্তর। 

সহসা অতি দৃঢ় ও গম্ভীরস্বরে জয়বন্ত বলিলেন, “সে লাখ টাকার নোটগুলি কই?” জামসেদজী নীরবে কম্পিত হস্তে টেবিলের ভিতর হইতে নোটের খামটি জয়বন্তের হাতে দিল। 

অতি কষ্টে জয়বন্ত হৃদয়ের আনন্দ গোপন করিলেন; বলিলেন, “দেখিতেছি, মহাশয় নোটগুলি পুলিস-কমিশনারের কাছে পাঠাইতেছিলেন।” 

জয়বন্ত খামের ভিতর হইতে নোটগুলি বাহির করিলেন, পকেট হইতে নোটবই বাহির করিয়া নোটের নম্বরগুলি মিলাইয়া দেখিলেন, সব ঠিক আছে? নোটগুলি পকেটে পুরিয়া বলিলেন, “এগুলির ভার আপাততঃ আমিই লইলাম।” 

এখন যত শীঘ্র হয়, জয়বন্ত এখান হইতে সরিয়া পড়িবার চেষ্টায় ছিলেন। বলিলেন, “অনেক পরিশ্রম লাঘব হইল? ইহার জন্য আমি তোমার কিছু উপকার করিতে ইচ্ছা করি, কি চাও — বন্ধু-বান্ধবকে চিঠি লেখা।” 

জয়বস্তের কার্য্য উদ্ধার হইয়াছে। তাঁহার ইচ্ছা নহে যে, তিনি এখানে তিলার্দ্ধ বিলম্ব করেন। যত শীঘ্র হয়, এখান হইতে যাইতে পারিলেই ভাল, অথচ তাড়াতাড়ি করিলে পাছে জামসেদজী সন্দেহ করে তাহাই তিনি তাড়াতাড়ি উঠিয়া যাইতেও পারিতেছেন না, বলিলেন, “কেমন—কি উপকার আমি তোমার করিতে পারি?” 

এবার জামসেদজীর মুখ হইতে কথা বাহির হইল, কম্পিত কন্ঠে বলিল, “আধঘন্টা সময় দিন, আমি আমার আত্মীয়-স্বজনকে দুই-একখানা চিঠি লিখিয়া লই।” 

জয়বন্ত গম্ভীরভাবে চারিদিকে চাহিয়া বলিলেন, “ভাল তাহা লিখিতে পার। দেখিতেছি, ইহার পিছনদিক দিয়া পলাইবার উপায় নাই। দেখ, যেন কোন বদমাইসী না হয় আমি বাহিরে আধঘন্টা অপেক্ষা করিব। ঠিক আধঘন্টা পরে ফিরিয়া আসিব।” 

এই বলিয়া জয়বন্ত ধীরে ধীরে সে গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেলেন। জামসেদজী বক্ষে বাহুবিন্যাস করিয়া কক্ষমধ্যে দুই-একবার পরিক্রমণ করিলেন। এদিকে জয়বন্ত ক্রমে দূরে যাইতে লাগিলেন; অবশেষে সহসা একটা গলির ভিতরে প্রবেশ করিয়া দ্রুতপদে চলিলেন। কিয়দ্দূর আসিয়া, একখানা গাড়ী পাইয়া তাহাতে উঠিয়া অন্তর্হিত হইলেন। 

আর পাটেল সাহেব জয়বন্ত চলিয়া গেলে সে বহুক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিল। যেন তাহার দেহ পাষাণে পরিণত হইয়া গিয়াছে। সহসা দূরে একটা ঘড়ি বাজায় সে চমকিত হইয়া উঠিল। তাহার চক্ষু বিস্ফারিত, যেন তাহার সংজ্ঞা নাই; তাহার কর্ণে পৈশাচিক অট্টরোলে সঘনে নিনাদিত হইতেছে, “নরহত্যাকারী, ফাঁসী—ফাঁসী—ফাঁসী—” 

এবার জামসেদজী সাহস করিয়া টেবিলের ভিতর হইতে সেই প্রকাণ্ড ছুরিখানা বাহির করিয়া লইল। সুদৃঢ় হস্তে ছুরিখানা ধরিল, তারপরে নিমেষমধ্যে সেটা গলার একধার হইতে আর একধার পর্য্যন্ত টানিল। তৎক্ষণাৎ মহাশব্দে জামসেদজী ভূপতিত হইল। 

সেই শব্দে চমকিত হইয়া পাণ্ডুরাং ছুটিয়া তথায় আসিল। আসিয়া দেখিল, রক্তাক্ত কলেবরে তাহার মনিবজী সাহেব পড়িয়া আছে। 

***

পর দিবস বোম্বাই এর সকল সংবাদপত্রেই জামসেদজীর আত্মহত্যার কাহিনী বাহির হইল; কিন্তু কি জন্য যে সামসেদজী আত্মহত্যা করিয়াছে, তাহার কোন সংবাদই কেহ পাইল না। 

এ রহস্য কেবল দুই ব্যক্তি জানিতেন, এক উকীল বাইরামজী মেটা, সে নিরুদ্দেশ হইয়াছে; আর এক জয়বন্ত — তিনি কখনই এ কথা প্রকাশ করিবেন না। 

এ রহস্য গোপন রাখাই জয়বন্তের উদ্দেশ্য। মেটাকে দণ্ড দেওয়া তাঁহার ইচ্ছা নহে। তিনি হরকিষণ দাসের লাখ টাকা উদ্ধার করিতে আসিয়াছেন, সে টাকা তিনি হাতে পাইয়াছেন; মেটা যে নোটের নম্বর বন্ধ করিয়াছিল, তাহাকে দিয়াই তাহা বাতিল করিয়াও লইয়াছেন; এ অবস্থায় আর তাঁহার এক মুহূর্ত্তও বোম্বাই থাকিবার ইচ্ছা ছিল না। এই সকল কারণে আত্মহত্যার গূঢ়রহস্য বিন্দুমাত্রও প্রকাশ পাইল না। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ – সমুদ্রবক্ষে 

বাসায় আসিয়া আত্মহত্যার কথা শুনিয়া জয়বন্ত ভাবিলেন, গোপাল দাসের খুনের দণ্ড হইয়াছে। দুই পাটেল মিলিয়া তাহাকে খুন করিয়াছিল, দুইজনেই সেজন্য দণ্ড পাইয়াছে। একজনকে মেটা জাহাজে খুন করিয়াছিল, আর একজন আত্মহত্যা করিয়া মরিয়াছে, সুতরাং গোপাল দাসের সম্বন্ধে একটা সম্পূর্ণ ব্যবস্থাই হইয়া গিয়াছে। তাহার পর টাকা প্রকৃত হরকিষণ দাসের সে টাকা এখন নিজের হস্তগত হইয়াছে, এখন যাঁহার টাকা তাঁহার হাতে পৌঁছাইয়া দিতে পারিলেই হিঙ্গনকেও পাওয়া যায়। 

বোধহয়, জয়বন্ত জীবনে এত আনন্দ আর কখনও উপলব্ধি করেন নাই। ভাবিলেন, “এখনও বিশ্বাস নাই, যতক্ষণ না নোটগুলি হরকিষণ দাসের হাতে দিতে পারিতেছি, ততক্ষণ বিশ্বাস নাই — ততক্ষণ নিশ্চিন্ত হইতে পারিব না।”

“এইরূপ ভাবিয়া তিনি তাঁহার একটা কোট বাহির করিলেন, কোটের অস্তরের একদিক কাঁচি দিয়া কাটিয়া ফেলিলেন, তাহার পর নোটগুলি কোটের দুই কাপড়ের ভিতরে রাখিয়া অস্তরের কাপড় সেলাই করিয়া দিলেন। মনে মনে বলিলেন, “এই কোট এক নিমেষের জন্যও খুলিব না। ইহার উপরে আর একটা কোট পরিব। যতক্ষণ এই নোটগুলি হরকিষণ দাসের হাতে দিতে না পারি, ততক্ষণ এ কোট কিছুতে গা হইতে খুলিব না। নোটগুলি ঠিক আমার বুকের নিকটে থাকিবে।” 

পর দিবস তিনি দেখিলেন যে, একখানি জাহাজ পোর-বন্দরে যাইবে; তিনি তৎক্ষণাৎ টিকিট কিনিলেন। সকালেই জাহাজে গিয়া উঠিলেন। 

যাহার বুকের কাছে লাখ টাকা থাকে, সে কখনই নিশ্চিন্ত থাকিতে পারে না। তাঁহার হৃদয়ে শান্তি হওয়া অসম্ভব – জয়বন্তেরও আহার নিদ্রা গিয়াছে। যতক্ষণ পোর-বন্দরে পৌঁছিয়া হরকিষণ দাসের হস্তে নোটগুলি গণিয়া দিতে না পারিতেছেন, ততক্ষণ তিনি নিশ্চিন্ত হইবেন কিভাবে? 

জাহাজের কেবিনগুলির দরজা বন্ধ করিবার উপায় আছে কিনা, ভাল করিয়া দেখিলেন। ভিতর হইতে বন্ধ করিবার উপায় আছে, ভিতর হইতে বন্ধ করিলে কাহারই আর ভিতরে যাইবার উপায় নাই, যাহাতে কেবল একজনেরই থাকিবার স্থান আছে, তিনি চেষ্টা-চরিত্র করিয়া এমন একটি কেবিন লইলেন। তিনি কাহারও সহিত একত্রে এক কেবিনে নিদ্রিত হওয়া নিরাপদ বিবেচনা করিলেন না। কি জানি, যদি নিদ্রিত অবস্থায় কেহ তাঁহার কোট হইতে নোটগুলি কাটিয়া বাহির করিয়া লয়। 

জাহাজ যতক্ষণ না ছাড়িল, ততক্ষণ সর্ব্বদা বুকে হাত চাপিয়া জয়বন্ত জাহাজের উপরে রহিলেন। জাহাজ ছাড়িলে তবে তিনি কতকটা নিশ্চিন্ত হইলেন। 

তাঁহার একমাত্র ভয় মহাপাষণ্ড বাইরামজী মেটাকে। সে সহজে ছাড়িবার পাত্র নহে। সে তাঁহাকে যেরূপ বিপদে ফেলিয়াছিল, বিড়ালের সাহায্য না পাইলে তাঁহার উদ্ধার হইবার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। সে নিশ্চয়ই তাঁহাকে খুন করিত। এখনও যে, সে টাকার লোভ ছাড়িয়াছে, তাহা বলা যায় না। সে নিশ্চয়ই তাঁহার উপরে নজর রাখিয়াছে, নিশ্চয়ই সে বোম্বাই হইতে পলায় নাই। সে ছদ্মবেশে সিদ্ধহস্ত, তাহাকে চেনাও দুষ্কর। যে একবার এই টাকার লোভে খুন করিয়াছিল, সে আবার যে একটা খুন করিবে, তাহাতে বিস্ময়ের কিছুই নাই। টাকার জন্য সে অনায়াসে তাঁহাকে খুন করিবে, টাকা লইয়া পলাইবে — সে কি যথার্থই এই জাহাজে আসিয়াছে? 

জয়বন্ত তাঁহার সহযাত্রীদিগের প্রত্যেককে বিশেষ করিয়া দেখিলেন; কিন্তু তাহাদের মধ্যে যে মেটা আছে, তাহা তাঁহার বোধ হইল না। অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত জয়বন্ত জাহাজের উপরে রহিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে একজন যাত্রী আসিয়া, তাঁহার পার্শ্বে বসিয়া কথাবাৰ্ত্তা কহিতে লাগিলেন। তিনি একটি চুরুট দিয়া বলিলেন, “খান, খুব ভাল চুরুট।” 

জয়বন্ত চুরুটটি লইয়া টানিতে লাগিলেন। কতকক্ষণ তিনি জাহাজের উপরে ছিলেন, স্থির করিতে পারিলেন না। সকালে দেখিলেন, তিনি কেবিনে শুইয়া আছেন দরজা খোলা। তাঁহার সন্দেহ হইল, সত্বর উঠিয়া বুকে হাত দিয়া দেখিলেন, নোটগুলি আছে। মনে মনে ভাবিলেন, “আশ্চর্য্য, রাত্রের কথা কিছুই মনে নাই। কখন জাহাজের উপর হইতে আসিয়া শুইয়াছিলাম, তাহার কিছুই মনে করিতে পারিতেছি না।” 

নবম পরিচ্ছেদ – ক্রোধের কারণ 

জয়বন্ত বোম্বে হইতে রওনা হইবার পূর্ব্বেই হরকিষণ দাসকে পত্র লিখিয়াছিলেন।

“কার্য্য উদ্ধার হইয়াছে, কাল জাহাজে রওনা হইব। আশা করি, হিঙ্গন বন্দরে আসিবে।”

তাহাই হইয়াছে। হিঙ্গন বন্দরে আসিয়া জাহাজের প্রতীক্ষা করিতেছে। জাহাজ লাগিবামাত্র জয়বন্ত একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ হাতে করিয়া লাফাইয়া তীরে নামিলেন; সত্বর হিঙ্গনের নিকটে আসিলেন। হিঙ্গন বাঈ তাড়াতাড়ি গিয়া জয়বন্তের হাত চাপিয়া ধরিল। তাঁহাদের ন্যায় সুখী আজ কে? জয়বন্ত সত্বর একখানি গাড়ী ভাড়া করিলেন। এবং হিঙ্গনকে গাড়ীতে তুলিয়া নিজে উঠিলেন। উঠিয়া হরকিষণ দাসের বাড়ীর দিকে চলিলেন। 

পথে জয়বন্ত বলিলেন, “হিঙ্গন আমার মত সুখী আজ কে? আমার সঙ্গে সেই সব টাকা, সব কথা কি তোমার বাবা তোমায় বলিয়াছেন?” 

“হাঁ, শুনিয়াছি না কি তুমি বাবার জন্য লাখ টাকা আনিতে গিয়াছিলে সব পাইয়াছ?” 

“সব–সব—এই বুকে কোটের ভিতরে আছে।” 

“সত্য সত্যই লাখ টাকা আছে?” 

“সত্য নয় ত কি মিথ্যা? এই বুকের কাছে হাত দিয়া দেখ।”

হিঙ্গন হাত দিয়া বলিল, “কাগজ?” 

“হাঁ, সব নোট–হাজার টাকার একশতখানা নোট।” 

“লাখ টাকা? ব্যাগে রাখ নাই কেন?” 

“লাখ টাকার স্থান ছেঁড়া ক্যাম্বিসের ব্যাগে নহে –বুক।” 

“তাহা হইলে তুমি লাখ টাকাকে আমার অপেক্ষাও প্রিয় মনে কর, কেমন নয়?” হিঙ্গন পরিহাসের লোভ সম্বরণ করিতে পারিল না। 

“না হিঙ্গন, তুমি ঐখানেই মস্ত ভুল করিয়াছ, তোমার স্থান বুকের উপরে নয়; ভিতরে হৃদয়ের উপরে।” 

হিঙ্গন বাঈ মৃদু হাসিয়া মুখ নত করিল—তাহারই হার হইয়াছে। 

জয়বন্ত সে প্রসঙ্গ ছাড়িয়া দিয়া অন্য সুরে বলিলেন, “হিঙ্গন, এই লাখ টাকারই জন্য আমাকে বোম্বাই যাইতে হইয়াছিল।” 

হিঙ্গন কহিল, “হাঁ, বাবা তাহাই বলিয়াছিলেন।” 

“যাবার আগে তোমার বাবার সঙ্গে আমি একটা বন্দোবস্ত করিয়া গিয়াছিলাম।” 

“কি বন্দোবস্ত?” 

“তিনি কি তোমায় কিছু বলেন নাই?” 

“কই—না?” 

“যদি আমি তাঁহাকে এই লাখ টাকা আনিয়া দিতে পারি, তাহা হইলে তিনি আমার সঙ্গে তোমার বিবাহ দিবেন।” 

হিঙ্গনের মুখ লজ্জায় লাল হইয়া গেল। সে অন্যদিকে মুখ ফিরাইল। 

জয়বন্ত সোৎসাহে বলিলেন, “আর তোমাকে কে পায়, তুমি আজ হইতে আমার—আমার—আমার—” 

হিঙ্গন কথা কহিল না। এইরূপ উন্মত্ততার, আনন্দে, উৎসাহে জয়বন্ত নিজের প্রাণের হিঙ্গনের পার্শ্বে বসিয়া হরকিষণ দাসের বাড়ী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। 

গাড়ীর শব্দ পাইয়া হরকিষণ দাস ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া, দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। লাখ টাকা সহজ ব্যাপার নহে! আর সেই লাখ টাকা যদি সহজেই জুটে, তবে তাহা পাইবার জন্য কাহার প্রাণ না ব্যাকুল হইয়া উঠে, কাহার হৃদয় না সবেগে স্পন্দিত হইতে থাকে? 

জয়বন্ত মহা উৎসাহে গাড়ী হইতে লাফাইয়া নামিলেন। হাত ধরিয়া আদরে হিঙ্গনকে নামাইলেন; বলিলেন, “কৰ্ত্তাদি, আজ হইতে হিঙ্গন আমার।” 

তাহার পর সকলে বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলেন। হরকিষণ দাসও আনন্দে উৎফুল্ল। বলিলেন, “নিশ্চয়—নিশ্চয়, সে টাকা কই?” 

বুকে সবলে দুই-তিনবার চপেটাঘাত করিয়া জয়বন্ত বলিলেন, “এই বুকে—বুকে–বুকে –”

এই বলিয়া জয়বন্ত সেই ক্যাম্বিসের ব্যাগটা এক পাশে ফেলিয়া দিয়া নিজের দেহ হইতে উপরের কোট খুলিয়া তাহা দূরে ঘাসের উপরে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিলেন; তাহার পর নীচের কোটটি খুলিয়া হরকিষণ দাসের হাতর উপর সগর্ব্বে ফেলিয়া দিলেন। বলিলেন, “কাঁচি দিয়া নীচের অস্তরের কাপড়টা কাটিয়া ফেলুন; দেখিবেন, একশতখানা হাজার টাকার নোট কাগজে জড়ান রহিয়াছে, দেরী করিবেন না। 

কম্পিত হস্তে কাঁচি ধরিয়া হরকিষণ দাস অতি সন্তর্পণে কোটের আস্তরের কাপড় কাটিতে লাগিলেন, পাছে নোট কাটিয়া যায়। লাখ টাকা সহজ ব্যাপার নহে! কাপড় কাটিয়া হরকিষণ দাস কাগজ মোড়া একটা তাড়া টানিয়া বাহির করিলেন? কম্পিত হস্তে সত্বর উপরের কাগজখানা খুলিয়া ফেলিলেন। কই, নোট কোথায় কাগজের ভিতরে একখানা পুরাতন সংবাদপত্ৰ! 

এই ব্যাপারে তাঁহাদের কি অবস্থা হইল, তাহা বর্ণনা করা অসম্ভব! সহসা মস্তকে বজ্রাঘাত হইলেও জয়বস্তের এরূপ অবস্থা হইত না। তিনি বিস্ফারিত নয়নে মুখব্যাদান করিয়া কাষ্ঠপুত্তলিকার ন্যায় দণ্ডায়মান রহিলেন। নোট—নোট—লক্ষ টাকার নোট কোথায়? 

কয়েক মুহূর্তে হরকিষণ দাসও স্তম্ভিতপ্রায় দণ্ডায়মান ছিলেন; ক্রোধে তাঁহার মুখ সাদা হইয়া গেল। তিনি গৰ্জ্জিয়া বলিলেন, “এ কি?” 

জয়বন্ত কাগজের দিকে স্থিরনেত্রে চাহিয়াচিলেন, তাঁহার মুখে কথা নাই, নয়নে পলক নাই, এ কি ইন্দ্রজাল! তাঁহার পদনিম্নে যেন সমগ্র পৃথিবী সবেগে ঘুরিতে লাগিল। 

হিঙ্গন বাঈ একবার বিবর্ণমুখে জয়বন্তের মুখের দিকে চাহিল; জয়বন্ত মহা অপরাধীর মত নিরুত্তরে রহিলেন। হরকিষণ দাস ক্রোধভরে বলিলেন, “কেমন পথে চুরি করিয়া লইয়াছে—না?” 

জয়বন্ত জিহ্বা দ্বারা ওষ্ঠ ভিজাইয়া লইলেন—তাঁহার কন্ঠতালু পর্য্যন্ত শুষ্ক হইয়া গিয়াছিল। তিনি কেবলমাত্র বলিলেন, “হাঁ”। 

হরকিষণ দাস ক্রোধব্যঞ্জক উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন। সেরূপ বিকট হাস্য সহজে কেহ হাসিতে পারে না। তিনি দক্ষিণ হস্ত বিস্তৃত করিয়া পথ দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, “দূর হও।” 

হিঙ্গন পিতার নিকটস্থ হইয়া বলিল, “বাবা!” 

হরকিষণ দাস গর্জিয়া বলিলেন, “চুপ—এই বদমাইস, জুয়াচোরের কাছ থেকে সরে আয়।”

জয়বন্ত কেবলমাত্র বলিলেন, “আমি বদমাইস, জুয়াচোর—” খুনী — তোমার এই পরম সৌভাগ্য যে, তোমাকে এখনও পুলিসে দিতেছি না। তোমাকে জেলে দেওয়াই উচিত।” 

“জেলে দেওয়া—” 

“হাঁ, আমার একশত টাকা জুয়াচুরি করিয়া লইয়াছ।” 

হরষিণ দাস আবার তাঁহাকে অঙ্গুলী নিদ্দেশে পথ দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, “এখনই আমার সম্মুখ হইতে দূর হও। আমাকে গাধা স্থির করিয়াছ, আমি যেন এ জুয়াচুরির কিছুই বুঝি না। আমি তোমার একটা কথা বিশ্বাস করি না — ওর কোটের কাপড়ের নীচে থেকে নোট অন্যে চুরি করিয়া লইল, আর উনি কিছুই জানিতে পারিলেন না; কি আশ্চৰ্য্য। সেই চোর আবার কোট সেলাই পর্য্যন্ত করিয়া দিয়া গিয়াছে!” 

“আমি নিজে সেলাই করিয়াছিলাম।” 

হরকিষণ দাস আবার মেঘগর্জনবৎ বিকট হাস্য করিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “এমন চোরকেও বাড়ীতে স্থান দিয়াছিলাম। দূর হও, দূর হও—এখনই আমার চোখের সম্মুখ থেকে দূর হও; নতুবা আমি কিছুতেই ক্ষমা করিব না।”