নৌকাটাকে টেনে উপরে তুলে জহুর চাঁদের আলোতে তীরে উঠে এলো। চাপা গলায় ডাকল, বুলবুল!
নির্জন চরে তার গলার স্বর অনেক দূর পর্যন্ত ভেসে যায়। কোনো উত্তর না পেয়ে সে আবার ডাকল, এবার আরেকটু গলা উঁচিয়ে, বুলবুল!
একটু দূরে বড় একটা ঝাঁপড়া গাছের ওপর কিছু একটা নড়ে ওঠে, সেখান থেকে অতিকায় একটা পাখির মতো ভেসে ভেসে বুলবুল নামতে থাকে, জহুরের মাথার ওপর দুই পাক ঘুরে সে নিচে নেমে আসে। তারপর ছুটে জহুরের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, বাবা! এসেছ?
হ্যাঁ বাবা। এসেছি।
এত দেরি করলে কেন?
দেরি করি নাই বাবা। আমি এর আগে আসতে পারতাম না। তোকে নিয়ে কত হইচই হয়েছে জানিস? শহর থেকে কত সাংবাদিক এসেছে। টেলিভিশন ক্যামেরা এসেছে। সবাই আমাকে চোখে চোখে রাখছে। তাই আমি ঘর থেকে বের হই নাই। বলেছি তুই কোথায় গেছিস আমি জানি না। যখন সবার উত্তেজনা কমেছে, সবাই চলে গেছে তখন এসেছি।
ঐ খারাপ লোকগুলোর কী হয়েছে বাবা?
জহুর একটু হাসার ভঙ্গি করল, বলল, গ্রামের মানুষগুলো ধরে যা পিটুনি দিয়েছে সেটা বলার মতো না। স্পিডবোট জ্বালিয়ে দিয়েছে। লিডার কে ছিল জানিস?
কে বাবা?
তোদের স্কুলের মেয়ে লিপি। এইটুকুন মেয়ে তার কী সাহস! রিভলবার বন্দুক নিয়েও কেউ পালাতে পারে নাই! মনে হয় দুই-চারজনের হাত-পাও ভেঙেছে। জহুর সুর পাল্টে বলল, যাই হোক, তোর কোনো সমস্যা হয় নাই তো?
না বাবা।
আমি তোর জন্যে পানি, শুকনা চিঁড়া আর গুড় রেখে গিয়েছিলাম।
জানি বাবা। আমি খুঁজে খুঁজে বের করেছি।
বুলবুল হেসে যোগ করল, গুড়ের মাঝে পিঁপড়া ধরেছিল, এছাড়া কোনো সমস্যা হয় নাই।
কত দিন তুই ভালো করে খাস নাই। আনোয়ারা বুবু তোর জন্যে রান্না করে দিয়েছে। আয় খাবি। খুব খিদে পেয়েছে তাই না?
না বাবা খিদে পায় নাই। আমি উড়ে উড়ে গাছের ওপর থেকে ফল ফুল খেতে পারি। পেট ভরে যায়।
তাহলে তো ভালো।
হ্যাঁ বাবা, তুমি বলেছিলে মনে নাই? আমার একা একা থাকা অভ্যাস করতে হবে। আমি অভ্যাস করেছি।
জহুর খুব সাবধানে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, অভ্যাস হচ্ছে?
হ্যাঁ বাবা। হচ্ছে।
থাকতে পারবি?
পারব।
জহুর বুলবুলকে গভীর মমতায় নিজের কাছে টেনে আনে। মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলে, বাবা বুলবুল! আমি মানুষকে বিশ্বাস করতে পারি না! তোদের স্কুলের লিপির মতো ছোট মেয়ে আছে যে খুব সহজে তোকে মেনে নেবে। আবার শহরের অনেক বড় বড় অনেক বিখ্যাত, অনেক ক্ষমতাবান মানুষ আছে যারা মেনে নেবে না, যারা তোকে পেলেই ধরে খাঁচায় বন্ধ করবে, কেটে কুটে দেখবে। বিদেশে বিক্রি করে দেবে। সেই জন্যে আমি তোকে মানুষের সামনে নিতে চাই না।
আমি জানি বাবা। তুমি আমাকে বলেছ।
জহুর বুলবুলের মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলল, আমি অনেক চিন্তা করেছি বাবা। তোর পাখাগুলো যদি কেটে ফেলা হতো—
বুলবুল মাথা নাড়ল, বলল, না বাবা! আমি পাখা কেটে মানুষ হতে চাই না বাবা। আমি পাখা নিয়ে পাখি থাকতে চাই।
জহুর মাথা নাড়ল, বলল, আমি সেটা বুঝতে পেরেছি। সেই জন্যেই বলেছি, মানুষের মাঝে তোকে রাখা যাবে না। কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে পাখাগুলো আর কত দিন ঢেকে রাখব?
বাবা, আমার খুব কষ্ট হতো। এখন আমার কোনো কষ্ট হয় না। আমি যখন আকাশে উড়ি আমার কী যে ভালো লাগে!
সত্যি?
হ্যাঁ বাবা। আমার যখন পাখায় আরো জোর হবে, তখন আমি তোমাকে পিঠে নিয়ে একদিন আকাশে উড়ব। তুমি দেখো–
জহুর হাসির মতো এক ধরনের শব্দ করল। বলল, মাথা খারাপ হয়েছে? আমি তাহলে ভয়ে হার্টফেল করেই মরে যাব।
কোনো ভয় নেই বাবা—
তোর কোনো ভয় নেই। তোর পাখা আছে, তুই উড়তে পারিস। আমার অনেক ভয়!
উপর থেকে সবকিছু দেখতে খুব ভালো লাগে। মনে হয় সবকিছু সমান! সবকিছু সুন্দর! আর কী মনে হয় জান?
কী?
মনে হয় আমার কোনো ভয় নাই। কেউ আমাকে কিছু করতে পারবে না।
সেটা তো সত্যি কথা! তুই যদি আকাশে উড়িস তাহলে কে তোকে কী করবে? কে তোকে ছুঁবে? কে তোকে ধরবে?
বুলবুল হাসার মতো একটু শব্দ করল।
নৌকার গলুইয়ে বসে বুলবুল অনেক দিন পরে ভাত খেল। আনোয়ারা অনেক যত্ন করে সবকিছু বেঁধে দিয়েছে, জহুর সেগুলো তুলে তুলে বুলবুলকে খাইয়ে দিল। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আমি এখন যাই?
যাও বাবা।
তুই একলা থাকতে পারবি তো?
আমি একলা একলা আছি না?
কোথায় ঘুমাস?
ঐ যে ঝাঁপড়া গাছটা দেখছ? সেটার উপর?
গাছের উপর?
হ্যাঁ, কোনো অসুবিধে হয় না।
ভয় লাগে রাতের বেলা?
বুলবুল ফিক করে হেসে ফেলল, বলল, কেন বাবা? ভয় কেন লাগবে?
তুই এইটুকুন মানুষ, এই চরের মাঝে একা একা—
আমি একা থাকি না বাবা?
তাহলে তোর সাথে কে থাকে?
ঐ গাছটাতে কত পাখি থাকে তুমি জানো?
পাখি?
হ্যাঁ সত্যিকার পাখি। পাখিরা আমাকে খুব ভালোবাসে।
ভালোবাসে?
হ্যাঁ। আমার সাথে উড়ে বেড়ায়। খেলে।
জহুর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কী আশ্চর্য!
আসলে আশ্চর্য না, এইটাই স্বাভাবিক বাবা।
জহুর অবাক হয়ে বুলবুলের দিকে তাকিয়ে রইল, এইটুকুন ছোট বাচ্চা কী সুন্দর বড় মানুষের মতো কথা বলছে। মনে হচ্ছে কয়েক দিনেই সে বড় হয়ে গেছে।
একটা নিঃশ্বাস ফেলে জহুর বলল, ঠিক আছে বাবা। আমি তাহলে যাই। এই যে পোঁটলাটা রাখ। কাঁথা কম্বল আছে। খাবার আছে—পানি আছে। এক টুকরা সাবান আছে।
বুলবুল পোঁটলাটা হাতে নিয়ে বলল, আমার কিছু লাগবে না বাবা! আমি এমনিতেই ভালো আছি।
না লাগলেও সাথে রাখ।
জহুর নৌকাটা ঠেলে পানিতে নামাতে নামাতে বলল, বাবা বুলবুল।
বলো বাবা।
আমি এর পরের বার যখন আসব তখন তোকে নিয়ে যাব।
ঠিক আছে।
দুই থেকে তিন সপ্তাহ লাগবে যেতে—সুন্দরবন অনেক দূর।
জানি বাবা, তুমি বলেছ।
গহিন অরণ্য, সেখানে তুই আর আমি থাকব।
হ্যাঁ, বাবা। অনেক মজা হবে।
কোনো মানুষ তোকে আর খুঁজে পাবে না।
হ্যাঁ। আমি পাখিদের সাথে পাখি হয়ে থাকব।
জহুর লগি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নৌকাটাকে পানিতে নামিয়ে দেয়। স্রোতের টানে নৌকাটা তরতর করে এগিয়ে যায়। সে পেছনে ফিরে দেখে নদীর তীরে বুলবুল দাঁড়িয়ে আছে। জোছনার আলোতে তাকে কেমন যেন অবাস্তুব স্বপ্নের মতো দেখায়।
ঠিক কী কারণ জানা নেই জহুরের বুকটা গভীর বেদনায় ভরে আসে।