ছোট করিডোর ধরে ওরা চার জন আর্কাইভ ঘরটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মহাকাশযানের একেবারে অন্য মাথায় একটা ছোট এলিভেটরে করে ওরা উপরে উঠে এল। সরু আরেকটা করিডোর ধরে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ওরা আর্কাইভ ঘরটির সামনে এসে দাঁড়ায়। সুইচ স্পর্শ করে দরজা খুলতে গিয়ে শুমান্তি হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।
ইরন জিজ্ঞেস করল, কী হল শুমান্তি?
শুমান্তি ইরনের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ভিতরে কী একটা শব্দ শুনেছি।
ইরন কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, সত্যি ভিতরে একটা শব্দ হচ্ছে। টুক টুক করে এক ধরনের শব্দ।
কীশা কঠিন গলায় বলল, দরজা খোল শুমান্তি।
শুমান্তি দরজা খুলল, এবং সাথে সাথে ভিতরে কী একটা যেন ঘরের এক পাশ থেকে ছুটে অন্য পাশে সরে গেল। শুমান্তি চমকে ওঠে, কে?
আর্কাইভ ঘরে নানা আকারের বাক্স এবং যন্ত্রপাতি ছড়ানো–ছিটানো রয়েছে। ঘরের মাঝামাঝি একটা চতুষ্কোণ বাক্স খোলা এবং তার ভিতরে একটা খোলা ক্যাপসুল। আকার দেখে বোঝা যাচ্ছে এটি একজন মানুষের জন্য তৈরি। মানুষটি এই ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এসেছে, এই মুহূর্তে সে এখানে লুকিয়ে আছে। ইরন একটা বড় ধরনের ধাক্কা খেল–সে মনে মনে আশা করছিল কীশা যে জিনিসটি নিনীষ স্কেলের পঞ্চম মাত্রার প্রাণীদের কাছে নিয়ে যাবে সেটি আর যা–ই হোক, কোন মানুষ যেন না হয়।
কীশা আলগোছে অস্ত্রটি ধরে রেখেছে, তার সামনে অন্য তিন জন হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে থাকে এবং ঠিক তখন আর্কাইভ ঘরের এক কোনায় একটি মাথা উঁকি দিল। কমবয়সী কিশোরী একটি মেয়ে, কুচকুচে কালো রেশমি চুল, কালো বড় ভীত চোখ। কেউ কোনো কথা না বলে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল, এই ফুটফুটে কিশোরী মেয়েটিকে একটি গ্রহে ভিন্ন এক প্রাণীর হাতে তুলে দেওয়া হবে?
মেয়েটি খানিকক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ভীত গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমরা কে? কেন এসেছ?
কেউ কোনো কথা বলল না, সবাই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
কী হল? তোমরা কথা বলছ না কেন?
কীশা এবারে এক পা এগিয়ে যায়, নিশি, তুমি জান আমরা কে। তুমি জান তুমি এখানে কেন এসেছ।
মেয়েটি এবারে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, আমি আসতে চাই নি। আমাকে জোর করে পাঠিয়েছে।
কীশা আরো এক পা এগিয়ে গেল, না নিশি, তোমাকে জোর করে পাঠায় নি, তুমি নিজের ইচ্ছায় এখানে এসেছ।
না! মেয়েটি ভয় পেয়ে একটি আর্তচিৎকার করে উঠল, না। আমি ইচ্ছে করে আসি নি। আমি বুঝতে পারি নি।
তুমি তো বাচ্চা মেয়ে নও যে তুমি বোঝ নি। তোমাকে সবকিছু বলা হয়েছে। বিজ্ঞানের একটা বিশাল পরীক্ষায় তুমি রাজি হয়েছ। তোমার দরিদ্র বাবা–মাকে অনেক সম্পদ দেওয়া হয়েছে। তারা পৃথিবীতে এখন সুখী মানুষ। তোমার ছোট একটা আত্মত্যাগের জন্য
আমি আত্মত্যাগ করতে চাই না। আমি আমার বাবা–মায়ের কাছে যেতে চাই! মেয়েটি হঠাৎ আকুল হয়ে কেঁদে উঠল।
নিশি তুমি তো এখন আর তোমার বাবা–মায়ের কাছে যেতে পারবে না। তোমাকে এখানে পাঠানোর জন্য পৃথিবীর সকল সম্পদ একত্র করে এই মহাকাশ অভিযানটি শুরু হয়েছে। আমরা এখন সৃষ্টি জগতের অন্যপাশে। পৃথিবীর সময়ের সাথে এখানকার সময়ের কোনো মিল নেই।
মেয়েটি আর্কাইভ ঘরের আরো কোনায় সরে যেতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি তবুও পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাই। আমি এখানে থেকে যেতে চাই না।
নিশি! তুমি কী বলছ এসব? কীশার গলার স্বর হঠাৎ কঠোর হয়ে ওঠে। তুমি জিনেটিক পরিমাপে পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ, তোমার চেহারা তোমার শরীর যেরকম নিখুঁত তোমার মস্তিষ্ক তোমার বুদ্ধিমত্তাও সেরকম নিখুঁত। আমি তোমার কাছে এ রকম ব্যবহার আশা করি না।
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ হতে চাই নি। আমি সাধারণ একজন মানুষ হতে চাই–সাধারণ, খুব সাধারণ।
নিশি। তুমি এখন আর সাধারণ মানুষ হতে পারবে না। সাধারণ মানুষের সবকিছু হয় সাধারণ। তাদের আত্মত্যাগ হয় সাধারণ। তাদের অবদানও হয় সাধারণ। তুমি একজন অসাধারণ মানুষ, তোমার আত্মত্যাগ হতে হবে অসাধারণ, সেরকম তোমার অবদানও হবে অসাধারণ।
নিশি নামের কিশোরীটি তবুও আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে।
শান্ত হও নিশি। তুমি জান তোমাকে শান্ত হতেই হবে।
নিশি ধীরে ধীরে মুখ তুলে কীশায় দিকে তাকাল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে ইরনের দিকে তাকাল। ইরন মেয়েটির দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। নিশি এবারে তালুসের দিকে তাকাল, জালুস তার চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে মাথা নিচু করল। নিশির চোখে–মুখে এক ধরনের অসহায় ভাব ফুটে ওঠে। সে অনেক আশা নিয়ে শুমান্তির দিকে তাকাল, শুমান্তি কিছু একটা বলতে চেষ্টা করল কিন্তু কিছু বলতে পারল না। নিশি হঠাৎ করে। হাল ছেড়ে ভাগ্যের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়। খুব ধীরে ধীরে তার চোখ–মুখের ব্যাকুল অসহায় ভাব কেটে গিয়ে সেখানে এক ধরনের বিষণ্ণতা ফুটে ওঠে। সে চোখ মুছে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল, এ রকম করে বিচলিত হওয়ার জন্য আমি দুঃখিত। আমি আর বিচলিত হব না। বল আমাকে কী করতে হবে?
চমৎকার! কীশা মিষ্টি করে হেসে বলল, চল আমার সাথে।
নিশি আড়াল থেকে বের হয়ে আসে। পাতলা এক ধরনের নিও পলিমারের কাপড় তার ছিপছিপে কিশোরী দেহকে ঢেকে রেখেছে। জীবন রক্ষাকারী যন্ত্র থেকে বাতাস বের হচ্ছে, সেই বাতাসে নিশির চুল উড়ছে। দেহের কাপড় উড়ছে, সে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে থাকে এবং হঠাৎ করে এ দৃশ্যটি কেন জানি এক গভীর বেদনায় ইরনের বুক ভেঙে ফেলতে চায়। অনিন্দ্যসুন্দরী এই কিশোরীটি যেন পৃথিবীর কোনো প্রাণী নয় যেন স্বর্গ থেকে কোনো দেবী নেমে এসেছে। ইরন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল, দেখতে পেল কীশা হাত ধরে স্বর্গের এই দেবীকে নিয়ে যাচ্ছে।
কয়েক মিনিট পর তারা স্কাউটশিপের গর্জন শুনতে পায়, মহাকাশযান থেকে একটা স্কাউটশিপে করে কীশা গা ঘিনঘিন করা সবুজ এবং বেগুনি রঙের গ্রহটিতে নেমে যাচ্ছে। গ্রহটি যেন নরক। স্বর্গ থেকে নেমে আসা একটি দেবীকে সেই নরকে বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে। তাদের কারো কিছু করার নেই, পুরো ব্যাপারটি অসহায়ভাবে দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
.
নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ইরন মাথা নিচু করে দুই হাতে তার মাথার চুল আঁকড়ে বসে আছে। তার সামনে কাছাকাছি এলুস এবং শুমান্তি। ইরন একসময় মাথা তুলে তাকাল, একবার ত্রাস এবং শুমান্তির দিকে দৃষ্টি ফেলে বলল, আমরা কী করতে পারি বলবে?
ত্ৰালুস এবং শুমান্তি কিছু বলল না, ইরন আবার বলল, আমাদের কি কিছু করার আছে?
এবারেও ত্রাস আর শুমান্তি চুপ করে রইল। ইরন হাত দিয়ে টেবিলে আঘাত করে বলল, ফুটফুটে বাচ্চা একটা মেয়েকে পৃথিবী থেকে ধরে এনেছে এখানকার প্রাণীদের হাতে তুলে দেবার জন্য; বিশ্বাস করতে পার তোমরা? অথচ পুরো ব্যাপারটি আমাদের দেখতে হল, আমরা একটা কিছু করতে পারলাম না। ইরন ভাঙা গলায় বলল, আমি সারা জীবনে এ রকম অসহায় অনুভব করি নি!
শুমান্তি ইতস্তত করে বলল, আমি তোমাকে একটা কথা বলতে পারি? তুমি যদি কিছু মনে না কর।
ইরন শুমান্তির দিকে তাকিয়ে বলল, বল।
আমি এই কথাটি নিশিকেও বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু পরিবেশটি এত ভয়ঙ্কর ছিল যে তখন কিছু বলতে পারি নি।
তুমি নিশিকে কী বলতে চেয়েছিলে
আমি তাকে বলতে চেয়েছিমান, নিশি তুমি কোনো চিন্তা কোরো না, আমরা তোমাকে উদ্ধার করে আনব।
ইরন চমকে উঠে শুমান্তির দিকে তাকাল, মেয়েটির মুখে কৌতুকের কোনো চিহ্ন নেই। ইরন অবাক হয়ে বলল, তুমি কেমন করে উদ্ধার করে আনবে?
আমি জানি না।
তা হলে?
তা হলে কী?
তা হলে কেন নিশিকে বলবে যে একে উদ্ধার করে আনবে?
শুমান্তি একটু অবাক হয়ে ইরনের দিকে তাকাল, তাকে দেখে মনে হল এত সহজ একটি জিনিস ইরন বুঝতে পারছে না দেখে সে খুব অবাক হয়েছে। সে মাথা নেড়ে বলল, আমাদের কাছে তো নিশি সেটাই শুনতে চেয়েছিল, তাই না?
হ্যাঁ। কিন্তু আমরা তো সেটা করতে পারব না।
আমরা তো চেষ্টা করতে পারি।
চেষ্টা করব? ইরন অবাক হয়ে বলল, তুমি জান চেষ্টা করলে কী হবে? তুমি দেখেছ আমাকে কীভাবে কীশা গুলি করেছিল?
শুমান্তি এবারে একটু লজ্জা পেয়ে গেল, সেটা লুকানোর কোনো চেষ্টা না করে বলল, হ্যাঁ, সেটা অবশ্য সত্যি। চেষ্টা করলে আমরা নিশ্চয়ই মারা পড়ব। কিন্তু আমরা যদি চেষ্টা
করি তা হলে নিশি মেয়েটির মানুষের ওপর বিশ্বাস তো আর কোনোদিন ফিরে আসবে।
ইরন ছটফট করে বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কী বলতে চাইছ শুমান্তি। নিশি মেয়েটি যেন মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখে সে জন্য সবাই মারা পড়বে?
হ্যাঁ। শুমান্তি মাথা নাড়ল, আজ হোক কাল যোক আমরা তো সবাই মারা যাব।
ইরন অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, ত্রানুস তখন একটু এগিয়ে এসে বলল, আসলে আমরা একটু অন্যভাবে চিন্তা করি। আমাদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করা হয় বলে আমরা মারা যেতে একটুও দ্বিধা করি না। যে কারণে মারা যাচ্ছি সেটা যদি গুরুত্বপূর্ণ হয় তা হলে নিজের ভিতরে এক ধরনের আনন্দ পাই।
ইরন দীর্ঘ সময় ত্ৰালুস এবং শুমান্তির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর শান্ত গলায় বলল, তোমরা বলতে চাইছ নিশিকে বাঁচানোর চেষ্টা করে মারা যেতে তোমাদের কোনো ভয় নেই?
শুমান্তি মাথা নাড়ল। বলল, একেবারেই নেই। সত্যি কথা বলতে কী তুমি যদি অনুমতি দাও তা হলে আমি আর ত্রাস নিশিকে উদ্ধার করার জন্য এই গ্রহটাতে যেতে চাই।
ইরন কয়েক মুহূর্ত ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি যদি তোমাদের সাথে যেতে চাই আমাকে নেবে?
শুমান্তি হেসে বলল, কেন নেব না? নিশ্চয়ই নেব।
ত্রালুস বলল, আমি জানতাম তুমিও নিশ্চয়ই আমাদের সাথে যাবে।
ইরন উঠে দাঁড়িয়ে বড় স্ক্রিনটা চালু করে দিয়ে বলল, দেখা যাক স্কাউটশিপটা কোথায়?
খানিকক্ষণ চেষ্টা করতেই স্কাউটশিপটাকে খুঁজে পাওয়া গেল। যোগাযোগ মডিউল স্পর্শ করতেই স্কাউটশিপের ভেতর কীশাকে দেখা গেল, পিছনে জানালায় মাথা রেখে নিশি বসে আছে। তার কিশোরী–মুখে এক অসহায় বিষণ্ণতা।
যোগাযোগ মডিউলের শব্দ শুনে কীশা ঘুরে তাকাল, ইরনের ভুলও হতে পারে কিন্তু মনে হল কীশার চেহারায় এক ধরনের অমানবিক যান্ত্রিক ছাপ চলে এসেছে। সে এক ধরনের নিস্পৃহ গলায় বলল, কে?
ইরন স্ক্রিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আমি। ইরন।
কী চাও ইরন?
আমি নিশির সাথে একটু কথা বলতে চাই।
কী বলবে তাকে?
তুমিও শুনতে পাবে।
ইরন নিশিকে ডাকল, নিশি।
নিশি মাথা তুলে তাকাল, কিছু বলল না।
নিশি, আমরা তোমাকে একটা জিনিস বলতে ভুলে গেছি।
কী জিনিস?
আমরা তোমাকে উদ্ধার করে নিতে আসছি। কীশা তোমাকে সাহায্য করতে পারছে কারণ সে রোবট। আমরা পারব।
সত্যি? নিশির চোখমুখ হঠাৎ আনন্দে ঝলমল করে উঠল।
হ্যাঁ। তুমি চিন্তা কোরো না নিশি। আমরা আসছি।
ইরন আরো কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে ত্রাস এবং শুমান্তির দিকে তাকাল, বলল, এবারে বল আমরা কী করব?
ত্রালুস হেসে বলল, আমরা তো কিছু জানি না। কী করব সেটা আমরা তোমার মুখেই শুনতে চাই।