বিকেল বেলা বাড়ি ফিরে বুলবুল দেখল জহুর উঠানে একটা জলচৌকিতে বসে শরীরে তেল মাখছে। বুলবুল আনন্দে চিৎকার করে জহুরের কোলে আঁপিয়ে পড়ে, গলা জড়িয়ে ধরে বলল, বাবা! তুমি এসেছ।
হ্যাঁ। এসেছি। এত দেরি করেছ কেন?
কে বলেছে দেরি করেছি! মোটেই দেরি করি নাই। বলে গিয়েছিলাম দুই সপ্তাহের জন্যে যাব! ঠিক দুই সপ্তাহ পরে এসেছি।
দুই সপ্তাহ মানে জান? সাত দু গুণে চৌদ্দ দিন।
হ্যাঁ। বজরা নৌকা করে সুন্দরবনে ধানের চালানটা নিতে কত দিন লাগে তুই জানিস?
বুলবুল জানে না এবং তার জানার খুব আগ্রহও নেই। সে জহুরের গলা জড়িয়ে ধরে রেখে বলল, তুমি না থাকলে আমার ভালো লাগে না বাবা।
এই তো আছি আমি। জহুর বুলবুলের মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল, তুই তোর খালাকে জ্বালাসনি তো?
না, বাবা।
ঠিকমতো থেকেছিস?
হ্যাঁ।
লেখাপড়া করেছিস?
হ্যাঁ।
সময়মতো বাড়ি এসেছিস?
হ্যাঁ।
বুলবুল একটু থেমে বলল, কিন্তু বাবা–
কী?
আমার আর ভালো লাগে না।
কী ভালো লাগে না?
সব ছেলেমেয়ে আমাকে কেন কুঁজা ভাকে? আমি কি কুঁজা?
জহুর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বুলবুলকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, তুই কেন কুঁজা হবি?
তাহলে?
তোর পাখাগুলোকে যে ঢেকে রাখতে হয়। ঢেকে না রাখলে যে তোর বিপদ হয়ে যাবে!
কেন বিপদ হবে?
জহুর আবার একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সেটা তুই এখন বুঝবি না। আরেকটু বড় হয়ে নে, তখন তোকে বলব।
বুলবুল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বাবা।
কী?
আমার পাখাগুলো বেঁধে রাখলে এখন ব্যথা করে।
করারই তো কথা—আমাদের হাত-পা বেঁধে রাখলে ব্যথা করত না?
অনেক বড় হয়েছে পাখাগুলো। আমার কী মনে হয় জান?
কী?
আমি যদি ইচ্ছা করি, তাহলে—
তাহলে কী বাবা?
তাহলে আমি এখন উড়তে পারব।
জহুর মাথা ঘুরিয়ে বুলবুলের দিকে তাকালো। বলল, সত্যি?
হ্যাঁ বাবা সত্যি।
ঠিক আছে, আজকে রাতে তাহলে দেখব।
বুলবুল চকচকে চোখে বলল, ঠিক আছে বাবা।
রাতের খাওয়ার পর সবাই ঘুমিয়ে গেলে জহুর বুলবুলের হাত ধরে বের হলো। তখন রাত খুব বেশি হয়নি কিন্তু এই চর এলাকার মানুষ খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, সন্ধ্যের পরই মনে হয় বুঝি নিশুতি রাত!
গ্রামের পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কুকুরগুলো প্রথম একটু ডাকাডাকি করে। যখন মানুষগুলোকে চিনতে পারে তখন আবার শান্ত হয়ে লেজ নেড়ে নেড়ে পেছন পেছন হেঁটে খানিকদূর এগিয়ে দিয়ে আসে।
গ্রামের পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে জহুর বুলবুলকে নিয়ে নদীর ঘাটে এসে তার নৌকাটাতে বসে। লগি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নৌকাটাকে পানিতে ঠেলে দিয়ে সে বৈঠাটা হাতে নেয়। বুলবুল নৌকার মাঝখানে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে, আস্তে আস্তে বলল, অনেক অন্ধকার বাবা!।
জহুর বলল, এক্ষুনি চাঁদ উঠবে, তখন দেখিস আলো হয়ে যাবে।
জহুরের কথা সত্যি প্রমাণ করার জন্যেই কি না কে জানে নদীর তীরে বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে ঠিক তখন একটা বড় চাঁদ ভেসে উঠল। চাঁদের নরম আলোতে চারদিকে একটা কোমল ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে ঝিঁঝি ডাকতে থাকে, একটা রাতজাগা পাখি কর্কশ গলায় ডাকতে ডাকতে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল।
বুলবুল একটু এগিয়ে জহুরের কাছাকাছি এসে বসে জিজ্ঞেস করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি বাবা।
নতুন যে চরটা উঠেছে সেখানে।
সেখানে কেন বাবা?
সেখানে তো কোনো মানুষ নাই সেই জন্যে। তা ছাড়া চরটা তো ধুধু ফাঁকা, তোর জন্যে মনে হয় সুবিধা হবে।
বুলবুল একটু এগিয়ে জহুরের শরীরে হেলান দিয়ে বসে থাকে, বৈঠার নিয়মিত শব্দটার মাঝে মনে হয় একটা জাদুর মতো আছে, ধীরে ধীরে তার চোখে ঘুম নেমে আসছিল, তখন জহুর তাকে ডেকে তুলল, বলল, ওঠ বাবা। আমরা এসে গেছি।
বুলবুল জহুরের হাত ধরে চরে নেমে এল। এতক্ষণে চাদটা অনেক উপরে উঠেছে, বিস্তৃত চরটাতে জোছনায় নীলাভ একটা আলো ছড়িয়ে পড়েছে। বুলবুল তার শরীর থেকে চাদরটা খুলে জহুরের হাতে দিয়ে তার পাখা দুটো একবার খুলে নেয়, আরেকবার বন্ধ করে নেয়। তারপর বড় করে খুলে নিয়ে একবার ঝাঁপটানি দেয়।
জহুর জিজ্ঞেস করল, তুই কি আসলেই উড়তে পারবি?
মনে হয় পারব বাবা।
জোর করে চেষ্টা করিস না। যদি এখন না পারিস তাহলে থাক।
বুলবুল কোনো কথা না বলে তার পাখা দুটো দুই পাশে ছড়িয়ে দেয়, তারপর মাথা নিচু করে সে ছুটতে শুরু করে, দেখে মনে হয় সে বুঝি হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে কিন্তু সে পড়ে না। তার বড় বড় পাখা খুব ধীরে ধীরে ওপর থেকে নিচে নেমে আসতে থাকে এবং দেখতে দেখতে সে মাটি থেকে একটু উপরে উঠে যায়। বুলবুলের শরীরটা ধীরে ধীরে মাটির সাথে সমান্তরাল হয়ে যায়, পাখার ঝাঁপটানিটা দ্রুততর হয়ে ওঠে এবং বুলবুল দেখতে দেখতে উপরে উঠে যায়।
জহুর সবিস্ময়ে বুলবুলের দিকে তাকিয়ে থাকে, অতিকায় একটা পাখির মতো বুলবুল বাতাসে ভেসে উঠছে। জহুর বুলবুলের পেছনে পেছনে ছুটতে ছুটতে বলে, বেশি উপরে উঠিস না বাবা! বেশি উপরে উঠিস না!
জহুরের কথার জন্যেই হোক কিংবা অভ্যাস নেই বলেই হয়তো বুলবুল আবার নিচে নেমে আসতে থাকে।
মাটির কাছাকাছি এসে বুলবুল তাল সামলাতে পারল না, হুঁমড়ি খেয়ে দুই পাখা ছড়িয়ে বালুর মাঝে পড়ে গেল। জহুর ছুটতে ছুটতে বুলবুলের কাছে গিয়ে তাকে ধরে ওঠানোর চেষ্টা করে বলল, বাবা, ঠিক আছিস তুই?
বুলবুল মাথা নাড়ল, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, হ্যাঁ বাবা আমি ঠিক আছি।
কী সুন্দর তুই উড়েছিস দেখলি?
হ্যাঁ বাবা। আমি আসলেই উড়তে পারি। দেখেছ?
হ্যাঁ দেখেছি। বুলবুল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি আবার একটু উড়ি বাবা?
জোছনার আলোতে বুলবুলের মুখের দিকে তাকিয়ে জহুর বলল, উড়বি? উড়।
বুলবুল তখন আবার তার দুটি পাখা দুই পাশে ছড়িয়ে দেয়, তারপর দুটি হাত বুকের কাছে নিয়ে আসে, মাথাটা একটু সামনে ঝুঁকিয়ে সে সামনের দিকে ছুটতে থাকে। ছুটতে ছুটতে তার বিশাল পাখা দুটি ধীরে ধীরে ঝাঁপটাতে থাকে, দেখতে দেখতে বুলবুল উপরে উঠে যেতে থাকে। প্রথমবার বেশি উপরে ওঠেনি কিন্তু এবারে সে উপরে উঠতেই থাকে, জোছনার আলোতে বুলবুল তার পাখা দুটি বিস্তৃত করে অতিকায় একটা পাখির মতো। আকাশে উঠে যেতে থাকে। জহুর কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে, ঠিক কী কারণ জানা নেই সে বুকের ভেতর একটা গভীর ব্যথা অনুভব করে।
বুলবুল অনেক উপরে উঠে একটু ঘুরে যায়, তারপর ডানা দুটি মেলে আকাশে ভাসতে থাকে। মনে হয় পৃথিবীর সাথে তার বুঝি আর কোনো যোগাযোগ নেই, মাটি থেকে অনেক উপরে আকাশের কাছাকাছি মেঘের জগতে বুঝি সে তার নতুন আবাসস্থল খুঁজে পেয়েছে। জহুরের মনে হয় বুকে ধরে বড় করা তার এই খুঁজে পাওয়া সন্তানটি বুঝি আর কোনো দিন মাটির পৃথিবীতে ফিরে আসবে না।
আকাশ থেকে বুলবুল যখন মাটিতে নেমে এল তখন চাঁদটা পশ্চিমে অনেকখানি হেলে পড়েছে। বুলবুল তার পাখা দুটো ভঁজ করে গুটিয়ে নিয়ে জহুরের দিকে এগিয়ে এল। জহুর তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে, বুলবুলের সারা শরীর কুয়াশায় ভিজে গেছে। চাদর দিয়ে মাথাটা মুছিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোর কষ্ট হয়েছে বাবা?
না বাবা, বেশি কষ্ট হয় নাই। উপরে ওঠার সময় একটু পরিশ্রম হয়, কিন্তু ভেসে থাকার সময় একটুও কষ্ট হয় না?
তোর পাখাগুলো ব্যথা করছে?
হ্যাঁ বাবা, পাখাগুলো একটু ব্যথা করছে।
কাল ভোরে আরো অনেক ব্যথা করবে দেখিস।
কেন বাবা?
কখনো কোনো দিন ব্যবহার করিসনি, হঠাৎ একবারে এতক্ষণ উড়ে বেড়ালে ব্যথা করবে না?
করলে করবে।
উড়তে কেমন লাগে বাবা?
খুব অদ্ভুত। তুমি জানো উপরে উঠে গেলে মনে হয় সবকিছু সমান হয়ে গেছে!
জহুর নিঃশব্দে বুলবুলের দিকে তাকিয়ে রইল, কিছু না বুঝেই এই ছোট শিশুটি কত বড় একটা কথা বলে ফেলেছে! জহুর বুলবুলের হাত ধরে বলল, আয় বাড়ি যাই।
চল বাবা।
নৌকায় উঠে লগি দিয়ে নৌকাটাকে নদীর মাঝে ঠেলে দিয়ে জহুর কলল, বুলবুল।
হ্যাঁ বাবা।
তোকে একটা জিনিস বলি।
বল।
যদি তোর কখনো লুকিয়ে থাকতে হয় তাহলে তুই এসে এই চরের মাঝে লুকিয়ে থাকবি। ঠিক আছে?
বুলবুল অবাক হয়ে বলল, লুকিয়ে থাকতে হবে? লুকিয়ে থাকতে হবে কেন?
আমি বলছি না তোর লুকিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু যদি কখনো দরকার হয় তাহলে এই চরে এসে লুকিয়ে থাকবি। আমি পরে এসে তোকে খুঁজে বের করব। ঠিক আছে?
বুলবুল মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে। তারপর সে তার বাবার কোলে মাথা রেখে নৌকার গলুইয়ে শুয়ে পড়ে। চাদটাকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ বুঝি এক পাশে খানিকটা ভেঙে দিয়েছে! কেমন করে চাঁদটা এভাবে ভেঙে যায় সেই কথাটি তার মাথার মাঝে ঘুরপাক খেতে থাকে, বাবাকে জিজ্ঞেস করলে হয়। কিন্তু হঠাৎ করে তার সারা শরীর ক্লান্তিতে অবশ হয়ে যায়। তারা চোখ ভেঙে ঘুম নেমে আসে, কিছু বোঝার আগেই বুলবুল গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল।
ভোরবেলা আনোয়ারা এসে দেখে জহুর উঠানের মাঝখানে জলচৌকিতে চুপচাপ বসে আছে। আনোয়ারাকে দেখে বলল, আস আনোয়ারা বুবু। বস।
আনোয়ারা বলল, বুলবুল আজকে স্কুলে গেল না?
না। জহুর মাথা নাড়ে, ঘুমাচ্ছে।
এখনো ঘুমাচ্ছে?
হ্যাঁ। কাল রাতে ঘুমাতে অনেক দেরি হয়েছে তো।
কেন? দেরি হয়েছে কেন?
নদীর মাঝখানে যে নতুন চরটা উঠেছে সেখানে গিয়েছিলাম।
আনোয়ারা চোখ কপালে তুলে বলল, এত রাত্রে? চরে?
জহুর মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।
কেন?
বুলবুল আকাশে উড়তে চাইছিল তাই নিয়ে গিয়েছিলাম।
উড়তে? আকাশে উড়তে?
হ্যাঁ। উড়েছে?
হ্যাঁ। কী সুন্দর আকাশে উড়ে গেল। বুবু তুমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না।
সত্যি?
হ্যাঁ বুবু। সত্যি।
কী আশ্চর্য!
জহুর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? বুলবুলের তো জন্ম হয়েছে আকাশে উড়ার জন্যে! সে আকাশে উড়বে না?
তাই বলে একজন মানুষ পাখির মতো আকাশে উড়বে?
বুলবুল কি পুরোপুরি মানুষ?
মানুষ না?
না। পুরোপুরি মানুষ না। মানুষের পাখা থাকে না। মানুষের শরীর এত হালকা হয় না! মানুষ আকাশে উড়ে না। বুলবুল হচ্ছে এক সাথে মানুষ আর পাখি। আমি চেষ্টা করেছিলাম সে যখন ছোট ছিল তার পাখা দুটো কেটে ফেলতে পারি নাই। এখন তো আর পারা যাবে না।
আনোয়ারা চিন্তিত মুখে মাথা নাড়ল। জহুর বলল, আনোয়ারা বুবু, আমি তোমার সাথে একটু পরামর্শ করি।
আনোয়ারা বলল, আমার সাথে?
হ্যাঁ। বুলবুল গত রাত্রে আকাশে উড়েছে। এইটা ছিল তার প্রথম উড়া। সে আরো উড়বে। একশবার উড়বে, হাজারবার উড়বে। সে যত সময় মার্টিতে থাকে তার চাইতে বেশি সময় সে আকাশে থাকবে। তার মানে কী জান?
কী?
আগে হোক, পরে হোক তাকে কেউ না কেউ দেখবে। তখন কী হবে?
হ্যাঁ। কী হবে?
তখন তাকে ধরার চেষ্টা করবে। যদি ধরতে পারে তাহলে নিয়ে যাবে। কাটাকুটি করবে, তা না হলে কোথাও বেচে দেবে। খাঁচার মাঝে ভরে রাখবে, মানুষ টিকেট কিনে দেখবে।
আনোয়ারা শুকনো মুখে মাথা নাড়ল, বলল, সর্বনাশ!
হ্যাঁ আনোয়ারা বুবু, ব্যাপারটা চিন্তা করে আমি কাল রাতে ঘুমাতে পারি নাই।
তাহলে কী করবে?
আমি জানি না। খালি চেষ্টা করতে হবে ব্যাপারটা যেন কারো চোখে পড়ে। কেউ যেন জানতে না পারে।
বুলবুল যখন ঘুম থেকে উঠেছে তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। সে আরো ঘুমাত কিন্তু তার ঘুম ভেঙে গেল প্রচণ্ড ব্যথায়। দুই পাখা, পিঠ আর ঘাড়ে অসব ব্যথা। জহুর তাকে তার কোলে উপুড় করে শুইয়ে রসুনে ভেজানো গরম সরিষার তেল দিয়ে সারা শরীরে ডলে দিতে লাগল।
শরীরের ব্যথা নিয়ে সারাটি দিন বুলবুল আহা উঁহু করলেও সন্ধ্যেবেলা সে জহুরের হাত ধরে লাজুক মুখে বলল, বাবা!
কী?
আমার আবার আকাশে উড়ার ইচ্ছে করছে!
জহুর চোখ কপালে তুলে বলল, আকাশে উড়ার ইচ্ছে করছে?
হ্যাঁ বাবা।
তোর না সারা শরীরে ব্যথা!
বুলবুল তার পাখাগুলো একটু ছড়িয়ে আবার গুটিয়ে নিয়ে বলল, ব্যথা কমে গেছে বাবা!
জহুর কিছুক্ষণ বুলবুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে!
রাত যখন গভীর হয়ে এলো জহুর আবার বুলবুলকে নৌকা করে নিয়ে গেল জনমানবহীন সেই চরে। বুলবুল আবার পাখা ঝাঁপটিয়ে আকাশে উড়ে গেল—আগের দিন থেকেও অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসে!
এভাবেই শুরু হলো। প্রতিরাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে গেছে তখন জহুর বুলবুলকে নৌকা করে নিয়ে গেছে চরে। পুবের আকাশ ফর্সা না হওয়া পর্যন্ত বুলবুল আকাশে উড়েছে!
দুই সপ্তাহ পর জহুরের আবার ডাক পড়ল গম বোঝাই বড় একটা নৌকার মাঝি হয়ে সুন্দরবনের গহিনে যাবার জন্যে। জায়গাটা বিপজ্জনক, সবাই যেতে চায় না, তাই কেউ যখন যায় তাকে ভালো মজুরি দেয়া হয়। দুই সপ্তাহ পরিশ্রম করলে চার সপ্তাহ শুয়ে-বসে কাটিয়ে দেয়া যায়।
জহুর যখন বিদায় নিয়ে রওনা দিয়েছে তখন বুলবুল তার পেছনে পেছনে এসেছে। নদীর ঘাটে বুলবুল জহুরের হাত ধরে বলল, বাবা।
বল।
এখন আমাকে চরে কে নিয়ে যাবে?
তোকে নেয়ার এখন কেউ নেই। আমি না আসা পর্যন্ত তোর আকাশে উড়াউড়ি বন্ধ।
কিন্তু বাবা—
কোনো কিন্তু নেই।
আমার যদি খুব উড়ার ইচ্ছে করে?
ইচ্ছে করলেই হবে না। আমি না আসা পর্যন্ত উড়তে পারবি না।
বুলবুল অনিচ্ছার ভঙ্গি করে বলল, ঠিক আছে।