২.২ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের সামনে

নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের সামনে বড় টেবিলটা ঘিরে চার জন বসে আছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই। সামনে বিশাল স্ক্রিনটাতে একটা ছোট বিচিত্র গ্রহ দেখা যাচ্ছে। গ্রহটি প্রায় অস্পষ্ট ছিল, ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়েছে। গত কয়েক ঘণ্টায় এই স্ক্রিনে গ্রহটির আকার বড় হতে শুরু করেছে। গ্রহটির রং সবুজ এবং বেগুনি মেশানো, রংগুলো দ্রুত স্থান পরিবর্তন করছে বলে এটিকে একটি জীবন্ত প্রাণী বলে মনে হয়। সবুজ এবং বেগুনি রং পাশাপাশি খুব বেশি দেখা যায় না, তাই পুরো গ্রহটিকে হঠাৎ দেখে বীভৎস কিছু মনে হয়। এই গ্রহটি থেকে নির্দিষ্ট কিছু কম্পনের বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের সংকেত আসছিল, এই সংকেত লক্ষ্য করে মহাকাশযানটি তার দিক পরিবর্তন করে গ্রহটির দিকে ছুটে যেতে শুরু করেছে।

ইরন তার আঙুল দিয়ে অন্যমনস্কভাবে টেবিলে শব্দ করছিল, হঠাৎ করে থেমে গিয়ে সে নিজের আঙুলের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক গলায় বলল, কীশা, আমরা কি তোমার সাথে খোলাখুলি কথা বলতে পারি?

কীশা একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, পার।

ইরন সোজা হয়ে বসে কীশার দিকে তাকাল, তুমি কি আমাদের বলবে এখানে কী হচ্ছে?

আমি? কীশা একটু অবাক হয়ে বলল, আমি কেমন করে বলব?

কারণ তুমি নিশ্চিতভাবে কিছু জিনিস জান, যেটা আমরা জানি না।

যেমন?

যেমন তুমি জান যে চতুর্দিক থেকে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ আসছে সেটা খুব সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করার যন্ত্রপাতি এই মহাকাশযানে রয়েছে। আমরা কেউ সেটা জানতাম না। যেমন তুমি সেই যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে জান, একই অভিযানের ক্রু হয়েও সেটা আমরা জানি না। যেমন তুমি জান এখানে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের শক্তি পরিমাপ করা হলে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব পাওয়া যাবে। যেমন তুমি–।

কীশা হাত তুলে ইরনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি যেটা বলছ তার বেশিরভাগই তো সাধারণ জ্ঞানের ব্যাপার।

না। ইরন মাথা নেড়ে বলল, সাধারণ না। এর যে কোনো একটি ব্যাপার যদি ঘটত আমি বলতাম সাধারণ ব্যাপার, কাকতালীয় ঘটনা। কিন্তু একটি ঘটে নি। অনেকগুলো ঘটেছে। তুমি সবসময় বলে এসেছ তুমি বিজ্ঞানী নও, তুমি বিজ্ঞানের কিছু জান না। কিন্তু তোমার প্রত্যেকটি কথা প্রত্যেকটি কাজ প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানীর মতো। মনে আছে তুমি আমাকে ওয়ার্মহোল তৈরি করে তার ভিতর দিয়ে বের হয়ে আসার কথা বলেছিলে? তুমি জান পৃথিবীর কতজন মানুষ এটা বলতে পারবে?

কীশা অবাক হয়ে বলল, কিন্তু আমি সেটা একটা ছেলেমানুষি তথ্যকেন্দ্র থেকে শিখেছি! আমি কখনোই এর বেশি কিছু জানি না।

তুমি টাইটানিয়াম রড দিয়ে আঘাত করে বর্গেনের মাথা খুলে দিয়েছিল। তুমি নিশ্চিতভাবে জানতে একটা রবোটের ঠিক কোথায় কত জোরে আঘাত করতে হয়।

না জানতাম না।

ইরন হিংস্র চোখে বলল, জানতে।

না। জানতাম না।

আমি বলব, তুমি কেন জানতে?

কেন?

কারণ তুমি আমাদের দেখাতে চাইছিলে যে বর্গেন এই মহাকাশযানের রোবট। তুমি তাকে শেষ করে দিয়ে এই মহাকাশযান থেকে রোবটদের দূর করেছ। আমাদেরকে নিশ্চিন্ত রাখতে চেয়েছিলে।

কীশা তীক্ষ্ণ চোখে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল। একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?

তুমি খুব ভালো করে জান, আমি কী বলতে চাইছি। ইরন দাতে দাঁত ঘষে হিংস্র গলায় বলল, তুমি এই মহাকাশযানের প্রকৃত রোবট।

আমি? কীশা প্রায় আর্তনাদ করে বলল, আমি?

হ্যাঁ। ইরন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি দেখতে চাও?

কীশা কাতর মুখে বলল, কীভাবে দেখাবে?

আমি টাইটানিয়ামের রডটি নিয়ে তোমার মাথায় আঘাত করব, আর তোমার মাথাটি খুলে ছিটকে গিয়ে পড়বে। তোমার নাক মুখ দিয়ে কপোট্রনের শীতল করার হলুদ রঙের তরল ফিনকি দিয়ে বের হবে, তোমার চোখের ফটোসেল ঘোলা হয়ে যাবে

কী বলছ তুমি?

হ্যাঁ, আমি ঠিকই বলছি। ইরন প্রায় ছুটে গিয়ে দেয়াল থেকে টাইটেনিয়ামের রডটি খুলে নেয়। এবং সাথে ত্ৰালুস আর শুমান্তি ছুটে এসে তাকে ধরে ফেলল। ত্রালুস ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী করছ তুমি ইরন?

ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি না আমি কী করছি। কিন্তু আমি হঠাৎ করে অনেক কিছু বুঝতে পারছি। অনেক কিছু।

কী বুঝতে পারছ?।

সেটি এখন বলে কোনো লাভ নেই ত্রাস। শুধু জেনে রাখ আমাদের নিয়ে একটি খুব ভয়ঙ্কর খেলা শুরু হয়েছে। আমরা সেই খেলার খেলোয়াড় নই। আমরা সেই খেলার গুটি।

শুমান্তি ইরনের হাত থেকে টাইটানিয়ামের রডটি সরিয়ে নিয়ে নরম গলায় বলল, ইরন। আমি খুব সাধারণ একজন ক্লোন, আমি হয়তো কিছু বুঝি না। কিন্তু তবু আমার কেন জানি মনে হয়, আমাদের এখন প্রত্যেকের প্রয়োজন রয়েছে। এখন কাউকে আঘাত করার সময় নয়।

রোবট হলেও?

রোবট যদি মানুষের মতো হয় তাহলে কেন মিছিমিছি তাকে রোবট বলে সরিয়ে রাখবে?

ইরন অদ্ভুত একটি দৃষ্টিতে শুমান্তির দিকে তাকিয়ে রইল। শুমান্তি নরম গলায় বলল, ইরন। তুমি কেমন করে জানো আমরা রোবট নই?

আমি জানি না।

শুমান্তি একটা নিশ্বাস ফেলে ফলল, আমিও জানি না।

কীশা এতক্ষণ পাথরের মূর্তির মতো বসে ছিল। এবারে উঠে এসে বলল, কিন্তু আমি জানি আমি রোবট নই। আমার স্বামী ছিল, দুজন সন্তান ছিল। আমি আমার সন্তানদের পেটে ধরেছিলাম, তাদের জন্ম দিয়েছিলাম। একটা দুর্ঘটনায় তাদের সবাইকে আমি হারিয়েছিলাম– আমার নিজেরও বেঁচে থাকার কথা ছিল না। কীভাবে কীভাবে জানি বেঁচে গেছি।

ইরন শীতল চোখে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। কীশা এক পা এগিয়ে এসে বলল, তুমি সত্যিই দেখতে চাও আমি সত্যিই মানুষ নাকি রোবট?

ইরন কোনো কথা বলল না, হঠাৎ করে দেখল কীশার হাতে একটা ধারালো ছোরা এবং কিছু বোঝার আগেই কীশা তার হাতটা টেবিলে রেখে ধারালো ছোরাটি হাতের তালুতে বসিয়ে দেয়। সাথে সাথে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসে।

শুমান্তি একটা আর্তচিৎকার করে কীশাকে ধরে ফেলল। কীশা নিচু গলায় বলল, এটা সত্যিকার রক্ত। একফোঁটা নিয়ে বায়ো মডিউলে প্রবেশ করিয়ে দেখ। আমার পুরো জিনেটিক কোডও সেখানে পেয়ে যাবে।

ত্রালুস এবং শুমান্তি কীশাকে ধরে মহাকাশযানের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিতে থাকে। কীশা তার কেটে যাওয়া হাতটি ধরে কাতর গলায় বলল, ইরন। আমি আজ তোমার ব্যবহারে খুব দুঃখ পেলাম। খুব দুঃখ পেলাম।

ইরন তবু কোনো কথা বলল না, স্থির চোখে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। কীশা ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর সে টেবিলের কাছে এগিয়ে যায়। টেবিল থেকে সাবধানে একফোঁটা রক্ত তুলে নেয়। সে সত্যি সত্যি এই রক্তকে বায়ো মডিউলে প্রবেশ করিয়ে দেখবে।

বায়ো মডিউলের ভিতরে একটা চাপা গুঞ্জন শোনা গেল, প্রায় সাথে সাথেই বড় স্ক্রিনে কীশার রক্তের বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গেল, ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে, কীশা মিথ্যে কথা বলে নি, সত্যি সত্যি এটি মানুষের রক্ত। তার ডি, এন, এ. বিশ্লেষণ করে জৈবিক গঠনের পুরো তথ্য চলে আসতে থাকে, কীশা একজন তেজস্বী এবং সাহসী মহিলা। আবেগপ্রবণ এবং স্নেহশীল। একাধিক সন্তানের মাতা। বড় দুর্ঘটনায় দীর্ঘ সময় শয্যাশায়ী। ঠিক যেরকম কীশা দাবি করেছিল। ইরন বায়ো মডিউলটি বন্ধ করতে গিয়ে থেমে গেল, রক্তের মাঝে অত্যন্ত স্বল্প পরিমাণের গ্রুপ তিনের ধাতব পদার্থ। মানুষের শরীরে স্বাভাবিক অবস্থায় এটি থাকার কথা নয়, কীশার শরীরে কেন আছে কে জানে।

ইরন খানিকক্ষণ বায়ো মডিউলের সামনে বসে থেকে অন্যমনস্কভাবে উঠে এল। নিয়ন্ত্রণ কক্ষের বড় স্ক্রিনটিতে কুৎসিত গ্রহটি আরো একটু বড় হয়েছে, যার অর্থ মহাকাশযানটি আরো কাছে এগিয়ে গেছে। বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের মনিটরটি থেকে একটা চাপা শব্দ আসছে, নিশ্চয়ই তরঙ্গের পরিমাণ দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। ইরন একটা নিশ্বাস ফেলল, এর আগে সে কখনো এত অসহায় অনুভব করে নি। বুদ্ধিমান প্রাণীর একটা গ্রহের দিকে তাদের মহাকাশযানটি এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তাদের কিছু করার নেই। তারা কেন যাচ্ছে সেটিও তারা। জানে না। প্রাণীদের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কেও তাঁদের কোনো ধারণা নেই। বুদ্ধিমত্তায় তারা কি সেই প্রাণীদের সমান নাকি অনেক নিচে? যদি অনেক নিচে হয়ে থাকে তা হলে কী করবে? কিছু কি করার আছে?

ইরন খানিকক্ষণ স্ক্রিনটার নিচে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। কীশা তার ঘরের মাঝামাঝি বিছানায় নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছে, হঠাৎ দেখলে মনে হয় প্রাণহীন কিন্তু ভালো করে তাকালে দেখা যায় খুব ধীরে ধীরে তার বুক ওঠানামা করছে, কীশা প্রাণহীন নয়, গভীর ঘুমে অচেতন। কীশার মুখের দিকে তাকিয়ে ইরনের নিজের ভিতরে এক ধরনের অপরাধবোধের সৃষ্টি হল। মেয়েটি খুব দুঃখী, তাকে আবার সে নতুন করে আজ দুঃখ। দিয়েছে।

ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে শুমান্তি আর জালুসের ঘরে উঁকি দিল, তারা তাদের ঘরে নেই। নিশ্চয়ই অবজারভেটরিতে বসে আছে। নিজের অজান্তেই ইরনের মুখে হাসি ফুটে ওঠে, এই দুজন একেবারে ছোট শিশুদের মতো। একজনের কাছে আরেকজন হচ্ছে একটা খেলনা, সেই খেলনা যতই দেখছে ততই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে।

ইরন নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। দরজা স্পর্শ করতেই সেটা খুলে গেল। ঘরের মাঝামাঝি তার বিছানাটি ঝুলছে। ইরন পোশাক পাল্টে বিছানার মাঝে ঢুকে গেল। ঘরের আলো কমে আসে, তাপমাত্রা নেমে যেতে থাকে, মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে আসে ঘরে, তার সাথে হালকা এক ধরনের সঙ্গীত। ইরন দুই হাত বুকের কাছে নিয়ে এসে একসময় গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল।

ইরনের ঘুম ভাঙল হঠাৎ করে, কেন ভাঙল সে বুঝতে পারল না, শুধু মনে হল খুব অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটেছে। সে ধড়মড় করে তার বিছানায় উঠে বসে। তার ঘরে কর্কশ এক ধরনের উজ্জ্বল আলো, সেই আলোয় সে স্পষ্ট দেখতে পেল ঘরের মেঝেতে হাঁটুতে মুখ রেখে কীশা বসে আছে। কীশার পাশে একটা ভয়াবহ ধরনের অস্ত্র শক্তিশালী, লেজারচালিত, বিস্ফোরকনির্ভর এবং আধুনিক। এটি ব্যবহার করে প্রয়োজনে সম্ভবত পুরো মহাকাশযানকে ধ্বংস করে দেওয়া যাবে।

ইরন অবাক হয়ে কীশার দিকে তাকাল, বলল, কীশা, তুমি এখানে কী করছ?

কীশা খুব ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল, ইরন দেখতে পেল তার গালে চোখের পানি চিকচিক করছে। হাতের উল্টো পৃষ্ঠা দিয়ে চোখ মুছে সে নিচু গলায় বলল, তুমি ঠিকই বলেছিলে ইরন।

আমি কী ঠিক বলেছিলাম?

আমি আসলে রোবট।

ইরন চমকে উঠে বলল, কী বললে?

হ্যাঁ। একটু আগে আমি জানতে পেরেছি।

কী বলছ তুমি? আমি তোমার রক্ত পরীক্ষা করে দেখেছি–

সেটা কীশার রক্ত। আমার শরীরটা কীশার মস্তিষ্কটা কীশার নয়। অ্যাক্সিডেন্টের পর সেটা পাল্টে দিয়েছে। আমার রক্তে তুমি নিশ্চয়ই গ্রুপ থ্রি ধাতব পদার্থের অবশিষ্ট পেয়েছ। পাও নি?

হ্যাঁ।

আমার কপোট্রনের চিহ্ন, নতুন ধরনের কপোট্রন রক্ত দিয়ে শীতল করতে পারে।

ইরন তার বিছানা থেকে নেমে এল, বিস্ফারিত চোখে খানিকক্ষণ কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ইতস্তত করে বলল, আমি বিশ্বাস করি না কীশা।

তাতে কিছু আসে–যায় না। আমি বিশ্বাস করি। আমার কপোট্রনে সব প্রোগ্রাম করে রাখা ছিল, যখন যেই তথ্যের প্রয়োজন হয়েছে তখন সেই তথ্যটি বের করে দেওয়া হয়েছে। তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলে। এখন আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছি। এখন আর কিছু গোপন রাখার নেই, তাই আমাকে পুরো তথ্য জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি এখন সবকিছু জানি? প্রজেক্ট আপসিলন কী, কেন শুরু হয়েছে, কারা শুরু করেছে, আমি সবকিছু জানি।

কারা শুরু করেছে? কেন শুরু করেছে?

জানতে চেয়ো না, ঘেন্নায় বমি করে দেবে।

ইরন একটু অবাক হয়ে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। কীশা মাথা নিচু করে বলল, এই অভিযানে আমরা সবাই পরিত্যাগযোগ্য তুচ্ছ ব্যবহারিক সামগ্রী। আমাদের নিজেদের কারো কিছু করার নেই। আমাদেরকে অত্যন্ত কৌশলে এখানে ব্যবহার করা হচ্ছে। যখন ব্যবহার শেষ হবে আমাদেরকে আবর্জনায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে। বর্গেনের কথা মনে আছে?

ইরন মাথা নাড়ল।

তার পরিণতিটি কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। পরিকল্পিত ব্যাপার ছিল। আমি তখন জানতাম না, এখন জানি।

আমার ব্যাপারটা?

তোমারটাও। তুমি একমাত্র বিজ্ঞানী যে ওয়ার্মহোল তৈরি করতে পার। তাই তোমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। তোমার জীবনকে ইচ্ছে করে দুর্বিষহ করে দেওয়া হয়েছিল যেন তুমি প্রজেক্ট আপসিলনে যোগ দাও।

ইরন অবাক হয়ে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। তার অবাক হবার ক্ষমতাও শেষ হয়ে গেছে। ইরন খানিকক্ষণ মেঝেতে হাঁটু জড়িয়ে বসে থাকা কীশার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর আরো এক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, এখন কী হবে কীশা?

খুব খারাপ একটা জিনিস হবে ইরন। তুমি জানতে চেয়ো না।

যদি খুব খারাপ একটা জিনিস হবে তা হলে তুমি সেটা বন্ধ করছ না কেন?

কারণ আমার বন্ধ করার ক্ষমতা নেই। কারণ আমি তুচ্ছ একটা রোবট। কারণ আমাকে যেভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে আমাকে ঠিক সেভাবেই কাজ করতে হবে।

ইরনের বুকের ভিতরে হঠাৎ ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে যায়, সে কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল, তোমকে কীভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে?

তুমি দেখতে পাবে ইরন।

ইরন কীশার আরো কাছে এগিয়ে যাবার জন্য এক পা এগুতেই হঠাৎ বিদ্বেগে কীশা তার পাশে শুইয়ে রাখা অস্ত্রটি তুলে ইরনের দিকে তাক করল, মুহূর্তে তার মুখ ভয়ঙ্কর কঠিন হয়ে যায়, তার চোখ ধিকিধিকি করে জ্বলতে শুরু করে। কীশা হিসহিস করে যান্ত্রিক গলায় বলল, আমার কাছে এসো না ইরন। আমাকে আমি নিজে নিয়ন্ত্রণ করি না। আমি খুব ঠাণ্ডা মাথায় তোমাকে খুন করে ফেলতে পারি।

কী বলছ তুমি কীশা? তুমি কেন আমাকে খুন করে ফেলবে– ইরন কীশার দিকে আরো এক পা এগিয়ে গেল। সাথে সাথে কীশা অস্ত্রটির ট্রিগার চেপে ধরে, প্রচণ্ড শব্দে সমস্ত মহাকাশযান কেঁপে ওঠে, বিস্ফোরকের ধোঁয়ায় এবং ঝাঁজালো গন্ধে সমস্ত ঘর মুহূর্তে বিষাক্ত হয়ে ওঠে। কিছু একটার প্রচণ্ড আঘাতে ইরন দেয়ালে ছিটকে গিয়ে পড়ে। দেয়ালে আঁকড়ে কোনোমতে উঠে বসে ইরন বিস্ফারিত চোখে একবার কীশার দিকে এবং আরেকবার নিজের দিকে তাকাল। কাঁধের কাছে খানিকটা অংশ ঝলসে গেছে, কপালে কোথাও কেটে গেছে, রক্তে বাম চোখটা ঢেকে যাচ্ছে।

কীশা হাঁটু গেড়ে এক পা পিছিয়ে গিয়ে কাতর গলায় বলল, ইরন, দোহাই তোমার, তুমি আমার কাছে এসো না। আমি কীশা নই–আমি একটা রোবট। আমার নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

ইরন দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করে বলল, আসব না।

কীশা জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বলল, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ইরন। আমার ভিতরের মানবিক একটা অংশে এখনো তোমাদের সবার জন্য ভালবাসা রয়েছে। আর রবোটের অংশ বলছে প্রয়োজন হলে সবাইকে শেষ করে দিতে। আমি জানি না, আমি তোমাদের রক্ষা করতে পারব কি না– কীশা হঠাৎ হাউমাউ করে কেদেঁ উঠল।

ইরন হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে কপালের ক্ষতস্থান মুছে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল, তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না এটি সত্যি ঘটছে। মনে হচ্ছে পুরোটা বুঝি একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। বিস্ফোরণের শব্দে ত্ৰালুস এবং শুমান্তি ছুটে এসেছে। তারা ইরনের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, কী করবে বুঝতে পারছে না।

কীশা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে ধরে উঠে দাঁড়াল। কাউকে সরাসরি উদ্দেশ্য না করে নিচু গলায় বলল, আমি খুব দুঃখিত যে এটা ঘটছে, আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও।

কেউ কোনো কথা বলল না। কীশা একটা নিশ্বাস ফেলে ত্ৰালুস এবং শুমান্তির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা জরুরি চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে মেডিক্যাল কিটটা নিয়ে এসো। ইরনের রক্ত বন্ধ করা দরকার।

ত্রালুস বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না এখানে কী ঘটছে। আমি–

এই মহাকাশযানে এখন কেউ আর কিছু বুঝতে পারবে না। শুধু জেনে রাখ আমি তোমাদের পরিচিত কীশা নই। আমি একটি রোবট। ইরন যেটা সন্দেহ করেছিল, সেটা সত্যি।

ও।

যাও।

ত্রাস এবং শুমান্তি ছুটতে ছুটতে চলে গেল। ইরন হাত দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে ধরে রেখে বলল, এখন কী হবে কীশা?

তোমরা দেখতে পাবে।

দেখতে পাব?

হ্যাঁ। আমি–আমি এই গ্ৰহটাতে যাব।

ইরন চমকে উঠল, এই গ্ৰহটাতে যাবে?

হ্যাঁ।

তুমি কেন এই গ্ৰহটাতে যাবে?

কারণ সেখানে নিনীষ স্কেলে পঞ্চম মাত্রার বুদ্ধিমান প্রাণী আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

তোমার জন্য অপেক্ষা করছে?

হ্যাঁ।

কেন তোমার জন্য অপেক্ষা করছে?

কারণ তাদের জন্য আমার একটি জিনিস নিয়ে যাবার কথা।

কী জিনিস?

সেটা এখন আর্কাইভ ঘরে আছে।

কী আছে আর্কাইত ঘরে?

কীশা কাতর গলায় বলল, আমাকে তুমি সেটা জিজ্ঞেস কোরো না। দোহাই তোমার। তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার খুব কষ্ট হয়। খুব কষ্ট হয়।

ঠিক আছে জিজ্ঞেস করব না।

ত্রাস এবং শুমান্তি দুই হাতে টেনে মেডিক্যাল কিটটা নিয়ে এসে ইরনের ঘরে ঢুকল। ভিতর থেকে টেনে যন্ত্রপাতি বের করে তারা ইরনের ওপর ঝুঁকে পড়ল। মেডিক্যাল কিটের মনিটরে আঘাতের বর্ণনা বের হয়ে এসেছে। এমন কিছু গুরুতর আঘাত নয়, দ্রুত সেরে উঠবে।

ইরন জানত সে দ্রুত সেরে উঠবে। তাকে ওরা হত্যা করবে না। কিছুতেই হত্যা করবে না। ত্রালুস এবং শুমান্তিকে নিয়ে সে নিশ্চিত নয়, কিন্তু তাকে ওরা এত সহজে হত্যা করবে না।