।।দুই।। একশো তিন বছরের সেই বৃদ্ধ
পলেস্তারা—ছাড়ানো দোতলা বাড়িটা। দোতলার জানলায় জানলায় বিবর্ণ পর্দা। পাঁচিলভাঙা ছাদে ফুলগাছের টব।
বেলা চারটে নাগাদ ডাঃ রুদ্র আর সঞ্জয় সেই বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
দরজা খোলাই ছিল। ডাঃ রুদ্র কয়েকবার কড়া নাড়লেন। কিন্তু কারো সাড়া পাওয়া গেল না।
হতাশ হয়ে সঞ্জয় বলল, শুধু শুধুই আসা হল।
—কেন?
—কারো তো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
—ভেতরে ঢুকে দেখা যাক। দরজা যখন খোলা তখন আশা করি অনধিকার প্রবেশ ঘটবে না।
সঞ্জয়ের ঢোকার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ডাঃ রুদ্র যখন ঢুকে পড়লেন তখন অগত্যা সঞ্জয়কেও ঢুকতে হল। ঘরে ঢুকতেই ধুলোর গন্ধ। সঞ্জয় তাড়াতাড়ি রুমাল বের করে নাকে চাপা দিল। বলল, ঘরে দেখছি ঝাঁটও পড়ে না।
ঘরটা বেশ বড়ো। বৈঠকখানা ঘরের মতো। ঢুকতেই ডান দিকে একটা চৌকি। চৌকির ওপর শতচ্ছিন্ন শতরঞ্জি পাতা। শতরঞ্জির প্রায় সর্বত্র দোয়াত—ওলটানো কালির দাগ। ময়লা ওয়াড়—জড়ানো একটা তাকিয়া দেওয়াল ঘেঁষে পড়ে আছে। ঘরের বাঁ দিকে পাশাপাশি তিনখানা বড়ো আলমারি। মান্ধাতার আমলের, বইতে ঠাসা। আলমারির বেশির ভাগ কাচই ভাঙা। তবে সবগুলোই তালা লাগানো। যদিও সে তালা বড়ো একটা খোলা হয় না বলেই মনে হয়।
এবার? কারো নাম ধরে ডাকতে হয়। কিন্তু কার নাম ধরে ডাকবে? ভট্টাচার্যমশাই আছেন? একশো তিন বছর বয়েসের বৃদ্ধকে হাঁক দিয়ে ডাকা শোভন নয়। ‘বাবু’ বলেও সম্বোধন করা যায় না।
অস্বস্তির ব্যাপার আরো ছিল। কপিলেশ্বরবাবু বলে দিয়েছিলেন ভট্টাচার্যমশাইয়ের মেজাজ খারাপ। হয়তো দেখাই করবেন না। তখন যেন ছবিটা দেখানো হয়। ছবির নীচে প্রেরকের নাম দেখলেই তিনি খুশি হবেন। কিন্তু সে ছবি তো হারিয়ে গেল। তাহলে?
সঞ্জয়ের ইচ্ছে ছিল না। তবু চৌকির ওপর বসতে হল। আর একবার ঘরটা ভালো করে দেখল। দেওয়ালে তিনটে বড়ো বড়ো ছবি। বহু পুরোনো। সম্ভবত শিবানন্দ ভট্টাচার্যের নিকট আত্মীয়দের। ফ্রেমের মধ্যে তিনজনেরই নাম আর জন্ম—মৃত্যুর সাল—তারিখ লেখা আছে। কিন্তু অতি উঁচুতে টাঙানো বলে পড়া গেল না।
ওদিকের দেওয়ালে ঝুলছে পুরোনো কলকাতার একটা ম্যাপ। ডাঃ রুদ্র কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলেন। দেখলেন ম্যাপটি ১৭৯৪ সালে A. Upjohn—এর করা। এতে ১৭৪২ সালের আদি কলকাতা আর ১৭৫৬ সালের বৃহত্তর কলকাতার নকশা করা রয়েছে। এতে উত্তরে বাগবাজারের খাল থেকে দক্ষিণে ‘Governapur’ (গোবিন্দপুর) পর্যন্ত এবং পুবে মারাঠা ডিচ থেকে পশ্চিমে গঙ্গা পর্যন্ত অঞ্চলকে কলকাতা বলে দেখানো হয়েছে।
ডাঃ রুদ্র কৌতূহলী হয়ে দেখলেন ম্যাপে মাত্র একটি রাস্তারই নাম রয়েছে—‘Avenue leading to the Eastward’। রাস্তাটি পশ্চিমে বর্তমান চিৎপুর রোড থেকে আরম্ভ করে পুব দিকে মারাঠা ডিচ পর্যন্ত চলে গেছে। এইটেই নাকি বর্তমানে বৌবাজার স্ট্রিট!
অন্যদিকে একটি তালিকা। কলকাতায় তখনকার দিনে পাকা বাড়ির সংখ্যা। যেমন—১৭০৬ খ্রিঃ—৮টি, ১৭২৬ খ্রিঃ—৪০টি, ১৭৪২ খ্রিঃ—১২১টি, ১৭৫৬ খ্রিঃ—৪৯৮টি।
—কাকে চাইছেন?
ভেতর থেকে গেঞ্জি গায়ে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। বছর পঞ্চাশ বয়েস। সৌম্যদর্শন। মাথার চুল ছোটো করে কাটা।
ডাক্তার রুদ্র নমস্কার করলেন।
—কিছু মনে করবেন না, সাড়া না পেয়ে ঢুকে পড়েছি।
ভদ্রলোক নরম সুরে বললেন, কোথা থেকে আসছেন?
—কপিলেশ্বরবাবুর কাছ থেকে!
—কপিলেশ্বরবাবু! ভদ্রলোক নামটা মনে করবার চেষ্টা করলেন।
ডাক্তার রুদ্র সঞ্জয়ের দিকে তাকালেন। সঞ্জয় তাড়াতাড়ি বলল, বাগুইহাটির কপিলেশ্বরবাবু।
—ও আচ্ছা! দাদামশাই! হ্যাঁ, বসুন। ঠাকুর্দার সঙ্গে দেখা করবেন বোধহয়?
—হাঁ, শিবানন্দ ভট্টাচার্য মশাই—
ভদ্রলোক একটু কী ভাবলেন। তারপর বললেন—ঠাকুর্দার সঙ্গে কি দেখা করার একান্ত দরকার?
ডাক্তার রুদ্র বিনীতভাবে বললেন, একটা বিশেষ দরকারেই আসছি। একটা পুরোনো বাড়ির ইতিহাস জানার জন্য।
মনে হল ভদ্রলোক খুশি হলেন। বললেন, এ কথা শুনলে ঠাকুর্দা খুবই খুশি হবেন। উনি এখনো আমাদের ডেকে ডেকে পুরোনো বাড়ির ইতিহাস শোনানান। কিন্তু মুশকিল কি জানেন? ওঁর বয়েস একশো তিন। বেশি কথা বলা বারণ। তারপর একটুতেই চটে যান। হয়তো আপনাদের দুটো কথা শুনিয়ে দিতেও পারেন।
—তাতে আমাদের কিছু মনে হবে না। বয়োবৃদ্ধ মানুষ—
—ঠিক আছে। একটু বসুন। ওঁকে খবর দিই। তারপর আপনাদের ওপরে নিয়ে যাব।
এই বলে ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকছিলেন, ফিরে দাঁড়ালেন।
—আচ্ছা, কীরকম ইতিহাস জানতে চান? বাড়িটা কোন জায়গায়?
ডাক্তার রুদ্র বললেন, কালিন্দী—বরাটের কাছে। একটা পুরোনো বাড়ি। Haunted house. বাড়িটার বিষয় উনি কিছু জানেন কি না।
—বুঝেছি। বলে ভদ্রলোক ভেতরে চলে গেলেন। একটু পরেই কাশির শব্দ পাওয়া গেল। মাঝে মাঝে কাশতে কাশতে কেউ নেমে আসছেন।
—উনি বোধহয় নিজেই নেমে আসছেন। সঞ্জয় কান খাড়া করে রইল।
—বোধহয়। বলে ডাঃ রুদ্র উঠে দাঁড়ালেন।
মিনিট পাঁচ—সাতের মধ্যে আগের ভদ্রলোকটি একজন বৃদ্ধের হাত ধরে ঢুকলেন। পিছনে পিছনে এল একটি মেয়ে। বছর চোদ্দো বয়েস।
বৃদ্ধ এবার নিজেই চৌকির ওপর বসে তাকিয়াটা টেনে নিলেন। মেয়েটি দাঁড়িয়ে রইল ভদ্রলোকের পাশে।
বৃদ্ধের শরীর শীর্ণ। গাল ঢুকে গেছে। না—কামানো পাকা দাড়ি। কণ্ঠনালী ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। গায়ে ফতুয়া। তার ওপর একটা চাদর। ছোটো ছোটো চোখ দুটো এ বয়েসেও কী তীক্ষ্ন! চোখের দিকে তাকালে মনে হয় বয়েসকালে ভদ্রলোক বোধহয় অনেক নিষ্ঠুর কাজ করেছেন।
বৃদ্ধ একবার কাশলেন। তারপর বিনা ভূমিকায় বললেন, কপিল পাঠিয়েছে?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—হঠাৎ?
বৃদ্ধ আবার কাশতে লাগলেন।
ডাঃ রুদ্র বললেন, তার আগে পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি ডাঃ সঞ্জয় গুপ্ত। ডাক্তারি করা ছাড়াও পুরোনো বাড়ির ইতিহাস সংগ্রহের বাতিক আছে।
—বাতিক! বৃদ্ধ যেন আঘাত পেলেন। রূঢ়স্বরে বললেন—বাতিক বলছেন কেন? ইতিহাস সংগ্রহ করা কি বাতুলের কাজ?
বৃদ্ধের নাতি এই সময়ে ইশারায় ডাঃ রুদ্রকে কিছু মনে না করতে অনুরোধ করলেন। বৃদ্ধ তখন বলে চলেছেন—আজকালকার ছেলেদের এই এক দোষ—কোনো সৎকাজকেও গুরুত্ব দেয় না।
—তা কটা বাড়ির ইতিহাস পেয়েছেন? খাতাপত্র করেছেন?
ডাঃ রুদ্র প্যাঁচে পড়লেন।
সঞ্জয় সসংকোচে বলল, না, সেরকম কিছু করা হয়নি।
—তাহলে আর কি হল? শুধু লোকমুখে গল্প শোনা? না মশাই, ওতে কোনো কাজ হবে না। এসব ছেলেখেলা নয়। চলুন ওপরে। দেখাব আমি কীভাবে কাজ করেছি।
বৃদ্ধের নাতি তাড়াতাড়ি বললেন, দাদু, এঁরা বিশেষ একটা বাড়ি সম্বন্ধে জানতে চান। বলে তিনি সঞ্জয় আর রুদ্রের দিকে তাকালেন।
ডাঃ রুদ্র বললেন, ইনি কালিন্দীর কাছে একটা বাড়িতে ভাড়া এসেছেন—
শিবানন্দ ভুরু তুলে বললেন, কে ভাড়া এসেছেন?
—ডাঃ গুপ্ত। বলে রুদ্র সঞ্জয়কে দেখিয়ে দিলেন।
—কতদিন?
—বছরখানেক হল। এখন অবশ্য ছেড়ে দিয়েছি।
—কেন?
—সেই কথাই বলতে এসেছি।
—কতদিন ছেড়েছেন?
—মাস তিনেক হল।
—কতদিন ও বাড়িতে ছিলেন?
—মাস নয়েক।
—আচ্ছা, তারপর বলুন।
সঞ্জয় তখন কলকাতায় বাসা নেওয়া থেকে শেষদিন পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা বলে গেল।
বৃদ্ধের নাতি আর সম্ভবত নাতির মেয়েটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনল।
শিবানন্দ কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়ে রইলেন। তারপর বললেন—কালিন্দী—বরাট?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—গোলবাড়ি চেনেন?
সঞ্জয় মাথা নাড়ল।—আজ্ঞে না।
—সে কী! কালিন্দী—বরাটে থাকেন গোলবাড়ি চেনেন না? গম্বুজওয়ালা পুরোনো একটা বাড়ি। যুদ্ধের সময়ে আমেরিকান সোলজাররা থাকত। তখন কী অবস্থায় আছে জানি না।
সঞ্জয় বলল, গম্বুজওয়ালা বাড়ি! ওই বাড়িটার কথাই তো বলছি।
—তাই বলুন।
বৃদ্ধ একটু থেমে কাশির দমক সামলে বললেন, তখন মানে, আমাদের ছোটোবেলায় ওই বাড়িটাকে ‘গোলবাড়ি’ বলত। একসময়ে জমিদারবাড়ি ছিল। তারপর এক নীলকর সাহেব ওটা দখল করে। কিন্তু সেও ভোগ করতে পারেনি।
এই পর্যন্ত বলে শিবানন্দ একটু থামলেন। তারপর বললেন, তা শেষ পর্যন্ত বাড়িটা ছাড়তেই হল?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। প্রথমে ছাড়তে চাইনি। কিন্তু সবই তো শুনলেন, না ছেড়ে উপায় ছিল না।
বৃদ্ধ কী ভেবে বললেন, আমি যার কথা ভাবছি তার আত্মার তাহলে আজও সদগতি হয়নি। কিন্তু—
কথা আটকে গেল। বৃদ্ধ কাশতে লাগলেন। কাশি থামতে বললেন, একটা কথাই ভাবছি। সে তো মরেছে তা পঞ্চাশ—ষাট বছর হল। এত বছরের মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক ভাড়াটে এসেছে। তাদের ওপর কি অত্যাচার হয়নি? বলে সঞ্জয়ের দিকে তাঁর সেই অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে তাকালেন।
—ঠিক বলতে পারব না।
—পারব না, বললে তো হয় না। খোঁজখবর নিয়ে আসতে হয়। বৃদ্ধ বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরালেন।
ধমকানি শুনে কিশোরীটি ফিক করে হাসল।
বৃদ্ধ একটু ভেবে বললেন, বোধহয় আর কেউ ভুক্তভোগী নয়। কেননা বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া দুরাত্মারাও চট করে মানুষের পেছনে লাগে না। আত্মারও কষ্ট হয় জানবেন।
ডাঃ রুদ্র আর সঞ্জয় বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
—আমার কথাটা বুঝতে পারলেন কি?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। ডাঃ রুদ্র বললেন।
—না, কিছুই বোঝেননি।
কিশোরীটি মুখ ঢাকা দিয়ে হাসতে লাগল।
—আমি মনে করি, বিশেষ কোনো কারণে কোনো দুষ্ট আত্মা বিশেষ কোনো একজনের ওপর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। এখন দেখতে হবে কার আত্মা, উদ্দেশ্যটাই বা কী?
বৃদ্ধর আবার কাশি উঠল। তিনি বুক চেপে ধরে জোরে জোরে কাশলেন। তারপর বললেন, আচ্ছা, আপনি কি সপরিবারে ও বাড়িতে থাকতেন? বৃদ্ধ ডাঃ রুদ্রের দিকে তাকালেন।
—আমি না, ইনিই সপরিবারে থাকতেন।
বৃদ্ধ তাঁর সেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে এবার সঞ্জয়ের দিকে তাকালেন।
—কী যেন আপনার নাম?
—সঞ্জয় গুপ্ত।
—আপনিই তো ডাক্তার?
—উনিও। বলে সঞ্জয় ডাঃ রুদ্রকে দেখিয়ে দিল।
—একসঙ্গে জোড়া ডাক্তার! বৃদ্ধ ঠোঁট ফাঁক করে বোধহয় একটু হাসবার চেষ্টা করলেন।
—আপনি তাহলে সপরিবারে থাকতেন?
—হ্যাঁ।
—আপনি কোনোদিন কিছু দেখেছিলেন, বা অনুভব করেছিলেন?
—না।
—যে ক’মাস ওই বাড়িতে ছিলেন তার মধ্যে আপনার বাড়িতে আর কেউ রাত কাটিয়েছেন?
—হ্যাঁ।
—কারা তাঁরা? আপনার আত্মীয়?
—না, একজন আমার স্ত্রীর বান্ধবী আর একজন মহিলা—মাদ্রাজ থেকে এসেছিলেন।
—তাঁদের অভিজ্ঞতা কী?
—আমার স্ত্রীর বান্ধবী কিছু দেখেননি বা অনুভব করেননি। তবে মিস থাম্পি করেছিলেন।
বৃদ্ধের দু—চোখ কুঁচকে উঠল। বললেন—তিনি কী অনুভব করেছিলেন?
—তাঁর মতে ও বাড়িতে কিছু আছেই।
—কিছু না দেখেই বললেন?
—উনি একজন থিওজফিস্ট। সারাজীবন প্রেততত্ত্ব নিয়ে চর্চা করেছেন।
বৃদ্ধ শিবানন্দ চুপ করে কী ভাবতে লাগলেন। তারপর বললেন, এবার আমি নিশ্চিত যে ওই বাড়িতে যে আত্মাটি আছে তার লক্ষ্য একমাত্র আপনার স্ত্রী।
সঞ্জয় বলল, লক্ষ্য যে আমার স্ত্রী তা আমরাও বুঝেছি। কিন্তু কেন? সত্যিই কি ও বাড়িতে কোনোদিন তেমন কোনো ঘটনা ঘটেছিল যাতে আমার স্ত্রী কোনো আত্মার প্রতিহিংসার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল?
শিবানন্দ ভট্টাচার্য একটু চুপ করে রইলেন। তারপর চোখ বুজিয়ে বললেন, হ্যাঁ, ঘটেছিল। আর সে ঘটনার সঙ্গে আমারও কিছু যোগ ছিল। কেননা আমিও তখন থাকতাম ‘গোলবাড়ির’ কাছেই। হ্যাঁ, তা প্রায় ষাট বছর আগের কথা। ঘটনাস্থল ওই গোলবাড়ি। সেসময়ে কলকাতায় এক বিখ্যাত জাদুকর ছিল।
—জাদুকর! সঞ্জয় চমকে উঠল।
—হ্যাঁ হ্যাঁ, যাদুকর। আপনারা ইংরিজিতে যাকে বলেন—ম্যাজিশিয়ান।
—লোকটা কি কালো কোট, কালো প্যান্ট, কালো টুপি পরত?
শিবানন্দ ধমকে উঠে বললেন, আপনারা যদি কথার মধ্যে কথা বলেন তা হলে আমি আর একটি কথাও বলব না।
ডাক্তার রুদ্র হাত জোড় করে বললেন, ক্ষমা করুন। আমরা অধৈর্য হয়ে পড়েছিলাম, কেননা ঘটনার শুরুতেই এমন অদ্ভুত মিল—
—আরো মিলবে। ধৈর্য ধরুন। বলে বৃদ্ধ কাশতে লাগলেন।
একটু সামলে নিয়ে বললেন, ম্যাজিশিয়ান কালো কোট, কালো প্যান্ট ছাড়া তো ধুতি— পাঞ্জাবি পরবে না। কাজেই ওটা নতুন কিছু নয়। পরনে কালো পোশাক, স্টেজের পিছনে কঙ্কাল আঁকা কালো পর্দা, টেবিলের ওপর কালো রুমাল ঢাকা মড়ার মাথা, হাতে কালো একটা লাঠি—ম্যাজিশিয়ান সারা কলকাতায় ম্যাজিক দেখিয়ে দু—হাতে পয়সা লুঠত। তার বেশির ভাগ দর্শক ছিল সাহেব—মেম। অবিনাশ বক্সীর খেলা হচ্ছে শুনলে সাহেব—পাড়া থেকে জুড়িগাড়ি ছুটিয়ে ওরা দলে দলে আসত।
কথার মাঝখানে এবার বাধা দিলেন নাতি ভদ্রলোক। তিনি হেসে বললেন, দাদু, রাগ কোরো না। মাঝে একটা কথা বলে নিই। বলেই ডাঃ রুদ্রর দিকে তাকালেন।
—দাদু একটা কথা কিন্তু বাদ দিয়ে যাচ্ছেন। সাহেবরা যেমন অবিনাশ বক্সীর খেলা দেখতে ছুটত তেমনি দাদুর কাছে আসত হাত দেখাতে। দাদু তখন ছিলেন গোটা কলকাতা শহরের মধ্যে নামকরা জ্যোতিষী। শুধু হাতই দেখতেন না—লোকের কপালের দিকে তাকিয়েই তার ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারতেন।
—কিন্তু উনি তো শহরের পুরোনো বাড়ির ইতিহাস সংগ্রহ করতেন বলেই জানি।
—হ্যাঁ, জ্যোতিষ ছিল তাঁর জীবিকা আর ইতিহাস সংগ্রহ ছিল তাঁর জীবন। কি দাদু, তাই তো?
শিবানন্দ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। তাই বটে।
একটু থেমে বললেন, কী জানেন, আপনারা ‘গোলবাড়ি’র কথা জানতে এসেছেন, তার মধ্যে আমার কথা বলা নিষ্প্রয়োজন।
নাতি বললেন, কী যে বল! তোমাকে বাদ দিয়ে কি গোলবাড়ির কথা শেষ হয়? বিশেষ করে অবিনাশ বক্সীর ঘটনা? সে ঘটনা তো এর আগেও তুমি আমাদের বলেছিলে।
শিবানন্দ উদাসীনের মতো চুপ করে বসে পায়ের চেটোয় হাত বোলাতে লাগলেন।
ডাক্তার রুদ্র মিনতি করে বললেন, সব ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করে না বললে আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।
নাতি ভদ্রলোক এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন। এবার চৌকির ওপর এসে বসলেন। কিশোরীটি কিন্তু দাঁড়িয়েই রইল। সে মাঝে মাঝেই গোপনে তাকাচ্ছিল সঞ্জয়ের দিকে। চোখাচোখি হলেই চোখ নামিয়ে নিচ্ছিল।
ভদ্রলোক বললেন, দাদুই সব কথা শোনাবেন। আমি শুধু একদিনের কথা বলি। সেটা দাদুর নিজস্ব ব্যাপার বলে উনি হয়তো বলতে চাইবেন না।
এই বলে ভদ্রলোক একটু থামলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন।
—অবিনাশ বক্সী ছিলেন ম্যাজিশিয়ান। আর দাদু ছিলেন জ্যোতিষী। না, অবিনাশ বক্সীর আরও একটা পরিচয়, তিনি জমিদারপুত্র। বর্ধমান জেলার কোনো গ্রামে তাঁদের জমিদারি ছিল। অবিনাশ বক্সী অবশ্য বেশির ভাগ সময়ই থাকত তাদের পূর্বপুরুষদের এই গোলবাড়িতে। কলকাতা তখন ধনীদের ফুর্তির আখড়া। এই সময়ে নিজেরই পরিবারের একটি কুমারী মেয়েকে নষ্ট করায় অবিনাশের বাবা ওকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। চন্দননগরে একজন ফরাসি ম্যাজিশিয়ান বক্সীর বন্ধু ছিল। তার কাছ থেকে ম্যাজিক দেখানো শিখে বক্সী নিজেই একটা দল খুলে ফেলল। ম্যাজিক দেখানোই হল তখন তার জীবিকা।
যদিও এক পাড়াতে বাস, তবু দাদুর সঙ্গে বক্সীর কোনো সম্পর্ক ছিল না। না থাকারই কথা। কেননা বক্সী করত পাবলিক শো। আর দাদু ঘরে বসে লোকের হাত দেখতেন, কুষ্ঠী বিচার করতেন। কিন্তু দুজনেই দুজনের খ্যাতির কথা জানতেন। দাদুর খ্যাতিটা অবিনাশ যে বিশেষ পছন্দ করত না, তা অবশ্য দাদুর অজানা ছিল না। একদিনের একটা সামান্য ঘটনায় অবিনাশের ঈর্ষা যেন ফেটে পড়ল।
একবার দাদুর কাছে এক মেমকে নিয়ে আসেন দাদুর এক অনুরাগী ব্যক্তি। মেমসাহেব এদেশের অ্যাসট্রোলজারদের নিয়ে একটা বই লিখছে। তাই দাদুর ছবি তুলল। দাদুর জীবনী নিতে চাইল। তার পর হঠাৎ দাদুর সামনে হাত মেলে ধরে বলল, দেখুন তো আমার কনজুগাল লাইফ কেমন যাবে?
নিতান্তই হালকা প্রশ্ন। দাদু কিন্তু সিরিয়াসলি মেমের হাতটা তুলে নিয়ে দেখতে লাগলেন। মিনিট তিনেক পরেই হাতটা ছেড়ে দিলেন।
—কী দেখলেন? মেম হেসে জিজ্ঞেস করল।
দাদু বললেন, বিয়ের পর তোমাদের দাম্পত্য জীবন ভালোই হবে।
মেমসাহেব কিছু বলার আগেই অনুগত ভদ্রলোকটি যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
—বলছেন কী ভট্টাচার্যমশায়! উনি বিবাহিতা বলেই তো দাম্পত্য জীবনের কথা জানতে চাইছেন।
দাদু হেসে মাথা নাড়লেন। বললেন, না, ওঁর কররেখায় এখনো বিবাহযোগ ফোটেনি। কাজেই বিয়ে হতে পারে না। হবে কিছুদিন পরে।
মেমসাহেব কোনো কথা না বলে লজ্জিত মুখে গাড়িতে গিয়ে উঠল।
মেম চলে গেলে অনুগত লোকটি বলল, কিন্তু উনি যে স্বামী—স্ত্রীর মতো একসঙ্গে থাকেন।
দাদু বললেন, স্বামী—স্ত্রীর মতো থাকলেই কি স্বামী—স্ত্রী হয়? বিবাহ অন্য জিনিস।
—তবে ওঁরা বিয়ে করেননি কেন?
দাদু বললেন, তার উত্তর আমি কী দেব? নিশ্চয় কোনো বাধা আছে। আর সে বাধা কাটিয়ে উঠতে আরো কিছু সময় লাগবে।
আড়াই মাস পরে সেই মেমসাহেব একজন সাহেবকে নিয়ে হাসতে হাসতে এসে হাজির। সঙ্গে একবাক্স কেক। কি দাদু, তাই তো? আমি বাবার কাছ থেকে যা শুনেছি তাই বললাম।
বৃদ্ধ একটু হেসে মাথা দোলালেন।
—তারপর এই মেমসাহেবের দৌলতে সাহেব—পাড়ায় দাদুর নাম ছড়িয়ে পড়ল। তারা দলে দলে দাদুর কাছে হাত দেখাতে আসতে লাগল।
অবিনাশ ভেবেছিল সেই—ই একমাত্র বাঙালি যে সাহেবদের কাছে খুব পপুলার। এখন চোখের সামনে দাদুর প্রতিপত্তি দেখে হিংসেয় জ্বলতে লাগল।
একদিন এক সাহেব অবিনাশ বক্সীর বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামল। অবিনাশ ভাবল, বোধহয় ম্যাজিক দেখাবার বায়না করতে এল। সাহেবকে খুব খাতির করে অভ্যর্থনা করল। কিন্তু সাহেব তাকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে দাদুর বাড়ি কোন দিকে জানতে চাইল।
এতেই অবিনাশ একেবারে খাপ্পা হয়ে গেল। বলল, সাহেব, আমি বুঝতে পারি না তোমরা কী করে ওর বুজরুকিতে ভুলে যাও।
সাহেব হেসে বলল, বক্সী, তোমারও যে এত খ্যাতি শুনতে পাই সেটাও কি তোমার বুজরুকির জন্যে নয়?
অবিনাশ তার কী উত্তর দিয়েছিল জানা নেই। কিন্তু তারপর থেকেই দাদুকে পাড়া—ছাড়া করার জন্যে উঠে—পড়ে লাগল। কিন্তু দাদুও খুব নির্জীব মানুষ ছিলেন না। নিজের জেদে জাঁকিয়ে প্র্যাকটিস করতে লাগলেন। কি দাদু, তাই না?
শিবানন্দ সগর্বে মাথা দোলালেন।
—কারো ক্ষতি না করে, এমনকি কারও সাতে—পাঁচে না থেকেও কেমন করে যে নির্বিবাদ মানুষও শত্রু হয়ে পড়ে আমার জীবনে সেই প্রথম অভিজ্ঞতা। বলে শিবানন্দ কাশতে লাগল।
—এইবার বক্সীকে জব্দ করার জন্যে দাদুও উঠে—পড়ে লাগলেন।
বাধা দিয়ে শিবানন্দ বললেন, না, জব্দ করার জন্যে নয়। আসল কথা হচ্ছে, আপনারাও জেনে রাখুন, কেউ শত্রু হয়েছে বুঝতে পারলেই লোকটাকে পুরোপুরি জানবার চেষ্টা করা উচিত। অর্থাৎ লোকটার অর্থবল, লোকবল কীরকম, বে—আইনি কোনো কাজ করে কিনা, তার কোনো দুর্বল দিক আছে কিনা, সর্বোপরি তারও কোনো শত্রু আছে কিনা। কেননা শত্রুর শত্রু মানেই বিরুদ্ধপক্ষের মিত্র। মোটামুটি এই ব্যাপারগুলো জেনে নিতেই হয়।
শিবানন্দ একটু থামলেন। তারপর বলতে লাগলেন, যখন দেখলাম বক্সী আমায় সুনজরে দেখছে না তখনই বুঝলাম ও শত্রুতা করবে। তার পরিণতি কী হবে তাও ভেবে নিলাম। পুলিশকে ঘুষ দিয়ে বা গুন্ডা লাগিয়ে ও আমার ক্ষতি করতে পারে। তাই তার কোথায় উইক পয়েন্ট আছে গোপনে আমি সন্ধান করতে লাগলাম। আর এইভাবে খোঁজ করতে করতেই—
শিবানন্দ কথা শেষ করতে পারলেন না। দমকা কাশিতে স্বর আটকে গেল।
ওঁর নাতি তখন দাদুর কথার জের ধরে বলতে লাগলেন, খোঁজ করতে করতে দাদু জানতে পারলেন ওর ট্রুপে যে সুন্দরী যুবতী মেয়েরা কাজ করে তারা শুধু চাকরিই করে না, বক্সীর সঙ্গে তাদের অন্য সম্পর্কও আছে।
এই সময়ে কিশোরী মেয়েটি হঠাৎ ভেতরে চলে গেল।
—দাদু ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে জানলেন, এই মেয়েরা একসময়ে সকলেই দূর দূর গ্রামের দরিদ্র ভদ্রঘরের ছিল। বক্সী তাদের চাকরির নাম করে নিয়ে এসে তাদের এমন অবস্থা করে দিয়েছে যে তারা আর ফিরে যেতে পারে না।
—না না, সব ক্ষেত্রে চাকরির নাম করেও নয়, জোর করে, বলপ্রয়োগ করে ধরে আনত, যেমন সুনয়নীর কেস। বাধা দিয়ে এইটুকু বলেই শিবানন্দ হাঁপাতে লাগলেন।
ওঁর কষ্ট দেখে ডাঃ রুদ্র বললেন, আজ না হয় থাক। আর একদিন—
—না না, আর একদিন নয়। আজই শুনে যান। সুনয়নীর কথা আপনাদের জানা দরকার। এই বলে শিবানন্দ নাতির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ায় মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লেন।
এরপর শিবানন্দ ভট্টাচার্যর নাতি যা বললেন তা এইরকম—
নাম, যশ, অর্থ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইদানীং নতুন মেয়ে সংগ্রহের পদ্ধতিটা বক্সী বদলেছিল। এখন আর মিথ্যে কথা বলে বা ধাপ্পা দিয়ে মেয়ে জোগাড় করত না। যখনই গ্রামেগঞ্জে খেলা দেখাতে যেত তখনই নিরীহ, গ্রাম্য কোনো সুন্দরী তার ফাঁদে পড়তই। আর ফাঁদটা অবিনাশ পাতত শেষ খেলার দিন।
শিবানন্দ যেদিন থেকে এই খবরটা জানতে পারলেন সেদিন থেকেই অবিনাশ যখনই বাইরে ট্রুপ নিয়ে যেত তখনই তাকে লুকিয়ে অনুসরণ করতেন হাতে—নাতে ধরার জন্যে। কিন্তু ধরতে পারেননি।
সেবার কলকাতা থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে ত্রিবেণীতে খেলা দেখাতে গিয়েছে। সরস্বতী নদীর ধারে অবিনাশের তাঁবু পড়েছে। শিবানন্দও তাকে অনুসরণ করে ত্রিবেণীতে হাজির।
সকাল থেকে ঘোড়ার গাড়িতে বসে ড্রাম বাজাতে বাজাতে ম্যাজিক—পার্টির লোকেরা শহর থেকে গ্রামে হ্যান্ডবিল বিলি করতে লাগল। মুখে টিনের চোঙা লাগিয়ে চেঁচাতে লাগল—আসুন দেখুন—জাদুকর অবিনাশ বক্সীর অসাধারণ খেলা! কাচ ভক্ষণ! ছাগলের কাটা মুন্ডুর ডাক! মুখের মধ্যে জ্বলন্ত আগুন! এর সঙ্গে আছে—কঙ্কালের অট্টহাসি! লাস্যময়ী তরুণীদের নৃত্য! কুমারী বালিকার দ্বিখণ্ডিত লাশ! ইত্যাদি।
যথাসময়ে দলে দলে লোকে ম্যাজিক দেখতে এল। মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। প্রচুর টাকার টিকিট বিক্রি হল। কিন্তু—
অবিনাশ বক্সী শুধু টাকা পেয়েই খুশি নয়। তার শরীরে যে উচ্ছৃঙ্খল জমিদার বংশের রক্ত! নিত্য নতুন মেয়ে চাই তার! একবার কোনোরকমে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে গোলবাড়িতে তুলতে পারলেই হল।
সুযোগের জন্যে প্রতিবারের মতো এবারও বক্সীকে অপেক্ষা করতে হল খেলার শেষ দিনের শেষ শো পর্যন্ত।
আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগের কথা। গ্রামাঞ্চলে সে সময়ে রাত নটা মানে অনেক রাত। শেষ খেলাটি দেখালেন বিখ্যাত জাদুকর অবিনাশ বক্সী। হাততালিতে তাঁবু কেঁপে উঠল। অবিনাশ বক্সীকে লাগছিল সাহেবের মতো। পরণে কালো কোট—প্যান্ট, মাথায় ফেল্টের টুপি। খেলার শেষে তিনি হাত জোড় করে বিদায় চাইলেন।
আবার তুমুল হাততালি।
এবার তাঁবু থেকে বেরোবার পালা। দলে দলে পুরুষরা বেরোচ্ছে পুরুষদের গেট দিয়ে। মেয়েরা বেরোচ্ছে অন্য পথ দিয়ে। হঠাৎ স্টেজের মধ্যে ভৌতিক চিৎকার! আসলে এও একটা খেলা। কিন্তু লোকে তা বুঝতে পারল না। তারা ভয় পেয়ে দৌড়ে পালাতে লাগল। আর ঠিক তখনই মেয়েদের দিকের ডে—লাইটটা কে যেন সরিয়ে নিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার। মেয়েরা চিৎকার করে উঠল—আলো—আলো—
কিন্তু কে কার কথা শোনে! মেয়েরা পড়িমরি করে তাঁবুর বাইরে এসে পড়ল। তখন সেখানে ভিড়ে ভিড়। যে যেদিকে পারছে ছুটছে।
মেয়েদের মধ্যে যারা গ্রাম থেকে এসেছিল তারা ত্রিবেণীর পথঘাট কিছুই চেনে না। বাড়ির পুরুষদেরও অন্ধকারে খুঁজে পাচ্ছে না। দিশেহারা হয়ে এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায় ছোটাছুটি করতে লাগল। মাঝে মাঝে বাড়ির লোকেরা মেয়েদের নাম ধরে ডাকছে। চেঁচামেচির মধ্যেও যে কোনোরকমে শুনতে পাচ্ছে সে সাড়াও দিচ্ছে, কিন্তু তাদের মিহি গলা পুরুষদের কানে পৌঁছচ্ছে না।
এমনি সময়ে টর্চের জোরালো আলো এসে পড়ল মেয়েদের মুখে। কে টর্চ ফেলে কাকে খুঁজছে বোঝা গেল না। শুধু টর্চের আলো এক মুখ থেকে অন্য মুখে সরে সরে যেতে লাগল। যেন কেউ টর্চের আলো ফেলে বিশেষ কাউকে খুঁজছে। শেষে একটি মেয়ের মুখের ওপর আলোটা এসে থেমে গেল।
—এদিকে এসো। তোমার বাড়ির লোকেরা তাঁবুতে তোমার জন্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সরল বিশ্বাসে তরুণী নববধূটি এগোল। সঙ্গে সঙ্গে টর্চের আলোও নিভে গেল।
তারপর?
তারপর আর কেউ কিছু জানতে পারল না। শুধু একটা মোটরের গর্জন। মুহূর্তে হেডলাইটের আলোয় দু—পাশের অন্ধকার ফাঁক করে গাড়ি ছুটল ত্রিবেণী থেকে কলকাতার দিকে।
শিবানন্দ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সবই দেখলেন। পরের দিন সকালে তাঁবু গুটিয়ে অবিনাশ বক্সীর ম্যাজিক পার্টি কলকাতায় ফিরে গেল। এদিকে মহা হইহই কাণ্ড। সকলেই শুনলেন ম্যাজিক দেখতে এসে একটি অল্পবয়সি বউ হারিয়ে গেছে। কেউ কেউ মন্তব্য করলেন, হারাবে আর কোথায়, সুযোগ পেয়ে নাগর জুটিয়ে পালিয়েছে। মেয়েটির স্বামী দু—দিন খোঁজাখুঁজি করল। তারপর হতাশ হয়ে গ্রামে ফিরে গেল।
এই পর্যন্ত বলে ভদ্রলোক একটু থামলেন। তারপর আবার বলতে লাগলেন—দাদু সন্ধান করে করে শেষে মগরায় গেলেন। তারপর যে বাড়ির বউ হারিয়েছিল খোঁজ করে সেই বাড়িতে গিয়ে গৃহকর্তার সঙ্গে দেখা করলেন। কিন্তু দাদু আশ্চর্য হলেন যখন দেখলেন গৃহকর্তা অর্থাৎ মেয়েটির শ্বশুরমশাইটি একেবারে নির্বিকার।
—পুত্রবধূ সম্বন্ধে আপনি কী ভাবছেন? দাদু জিজ্ঞেস করলেন।
—কী আর ভাবব? তার যদি মতিভ্রম হয়ে থাকে তো কে কী করবে?
দাদু বললেন, মতিভ্রম বলছেন কেন? তাকে তো দুর্বৃত্তে ধরে নিয়ে গেছে।
শ্বশুরমশাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তাহলেই বা কি করতে পারি? তাকে কি আর খুঁজে পাব?
—হ্যাঁ, পাবেন। আমি জানি তাকে কে অপহরণ করে কোথায় নিয়ে গেছে।
এ কথা শুনেও গৃহকর্তা কিছুমাত্র উৎসাহ দেখালেন না। চুপ করে রইলেন।
দাদু বললেন, আপনি আমার সঙ্গে চলুন। থানায় ডায়েরি করবেন। আমি নিজে চোখে যা দেখেছি থানায় তা বলব।
গৃহকর্তা অবাক হয়ে দাদুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
—হ্যাঁ, আমি সত্যি কথাই বলছি। এই দেখুন আমি ব্রাহ্মণ। এই পৈতে ছুঁয়ে বলছি—আপনি আমার সঙ্গে থাকুন। আমি আপনার পুত্রবধূকে উদ্ধার করে শয়তানটাকে জেলে পুরব।
গৃহকর্তা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, না মশাই, থানা—পুলিশ আমি করতে পারব না।
দাদু রেগে উঠে বললেন, কেন মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন? আমি তো রয়েছি। তা ছাড়া আপনার একটি পয়সাও খরচ হবে না। সব দায়িত্ব আমার।
এবার গৃহকর্তা বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনি তো উপদেশ বর্ষণ করলেন। কিন্তু আমি স্পষ্ট কথাই বলছি, তাকে আর ঘরে তোলা সম্ভব হবে না।
দাদু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তাহলে আমার আর বলার কিছু নেই। নিরপরাধ একটা মেয়েকে আপনি পাপের পথেই ঠেলে দিচ্ছেন। দেখবেন ধর্মে সইবে না। বলে দাদু তখনই বেরিয়ে এলেন।
মাত্র কিছুদূর গিয়েছেন, পিছন থেকে কে ডাকল—ঠাকুরমশাই!
দাদু ফিরে তাকালেন। দেখলেন একটি যুবক হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে। যুবকটিকে দাদু গৃহকর্তার ঘরেই দেখেছিলেন। গৃহকর্তার সঙ্গে দাদু যখন কথা বলছিলেন, যুবকটি তখন একপাশে দাঁড়িয়ে শুধু শুনছিল।
—আপনি? দাদু জিজ্ঞেস করলেন।
যুবকটি হাত জোড় করে বললেন, আজ্ঞে যে নিখোঁজ হয়েছে সে আমারই স্ত্রী। আমি সব শুনলাম। আপনি যদি ওকে উদ্ধার করে দিতে পারেন তাহলে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
দাদু কাছে এগিয়ে এসে যুবকের কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমি সন্ধান জানি মাত্র। যে দুর্বৃত্ত আপনার স্ত্রীকে ভুলিয়ে নিয়ে গেছে তাকেও আমি চিনি। সে ওই ম্যাজিশিয়ান। থাকে কলকাতায় আমার বাড়ির কাছে। কিন্তু আপনার স্ত্রীকে উদ্ধার করতে হলে থানার সাহায্য চাই। আর তার জন্যে আপনাকে গিয়ে ডায়েরি করতে হবে।
যুবকটি মাথা নিচু করে কী চিন্তা করতে লাগল।
দাদু ক্ষোভের হাসি হেসে বললেন, বুঝেছি, আপনার বাবার মতের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস আপনার নেই। তা ছাড়া উদ্ধার করেই বা কি হবে? তাকে তো আর ঘরে তুলতে পারবেন না।
এবার যুবকটি নীচু গলায় বলল, দেখুন, থানা—পুলিশ করতে পারব না। কিন্তু সুনয়নীকে পেলে আমি তাকে গ্রহণ করবই।
দাদু আবার একটু হাসলেন। বললেন, কী করে?
—দরকার হলে বাড়ি থেকে আমি আলাদা হয়ে যাব।
দাদু খুশি হয়ে যুবকের পিঠ চাপড়ে বললেন, ঠিক আছে। আমি একাই চেষ্টা করে দেখি। তবে মনে রাখবেন তাকে উদ্ধার করতে পারলে আপনি কিন্তু ত্যাগ করতে পারবেন না। কথা দিয়েছেন। দরকার হলে কলকাতায় এসে আমার বাড়িতে থাকবেন।
যুবকটি অঙ্গীকার করে কৃতজ্ঞচিত্তে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল, দাদু ফের ডাকলেন। বললেন, বউমার কোনো ছবি আছে?
যুবকটি একটু ভেবে বলল, বোধহয় আছে।
—তাহলে আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি। আপনি নিয়ে আসুন। থানায় ছবি দেখাতে হবে।
দাদু দাঁড়িয়ে রইলেন। একটু পরে যুবকটি একটা ছবি কাগজে মুড়ে দাদুকে এনে দিল।
নাতি ভদ্রলোক একটু থামলেন।
ডাক্তার রুদ্র ব্যস্ত আগ্রহে বললেন, তারপর?
—দাদু এবার তুমি বলবে?
—না, তুমিই বেশ বলছ। বলে যাও ভুল হলে শুধরে দেব।
—তারপর দাদু একাই ত্রিবেণী থানায় গেলেন। থানা অফিসারকে সব কথা বললেন। থানা অফিসার সব শুনলেন। তারপর বললেন, ঘটনাটা আমার থানায় ঘটলেও সেই ম্যাজিশিয়ানের বাড়ি সার্চ করতে পারে একমাত্র কলকাতার পুলিশ। আপনি ওখানকার থানায় জানান। আমিও তাঁদের রিকোয়েস্ট করছি।
দাদু ভেবে দেখলেন কথাটা ঠিক। তিনি কলকাতায় ফিরে এসে নিজেই থানায় সব জানালেন।
কিন্তু তার ফল যে উল্টো হবে দাদু তা ভাবতে পারেননি।
ঠিক দু’দিন পর।
সকালে দাদু একটা বই পড়ছিলেন। এমনি সময়ে বাড়ির সামনে একটা হুড খোলা গাড়ি এসে দাঁড়ালো।
নিশ্চয় কোনো সাহেবসুবো এসেছে ভেবে তাড়াতাড়ি গায়ে ফতুয়াটা চড়িয়ে নিলেন। ঠিক তখনই দাদুকে হতচকিত করে সদর্পে ঘরে ঢুকল অবিনাশ বক্সী। পকেট থেকে পিস্তল বের করে বলল, তুমি তো অন্যের ভাগ্যগণনা কর—বলো তো আজ তোমার ভাগ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে।
দাদু কোনো উত্তর দিলেন না। একটু হাসলেন।
—হাসছ? শেষ হাসি হেসে নাও। তারপরেই আমার শত্রুতা করার চরম ফল ভোগ করবে। বলে পিস্তলটা উঁচু করে ধরল।
দাদু তখনও অবিনাশের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন।
—তোমার এত বড়ো স্পর্ধা তুমি থানায় জানিয়ে এসেছ ত্রিবেণী থেকে আমি একটি মেয়েকে ধরে নিয়ে এসেছি। হ্যাঁ, এনেছি। সে এখন আমার ঘরে। পুলিশের বাবার সাধ্য নেই তাকে উদ্ধার করে। তারা আমার কেনা। শুধু কেনাই নয়, থানায় যে অফিসারটিকে তুমি জানিয়েছ, সুনয়নীকে প্রথম সেই ভোগ করবে। কিন্তু তুমি যখন জেনেছ তখন তোমার মুখ বন্ধ করতেই হয়। বলতে বলতে দরজার কাছ থেকে দাদুর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
ঠিক সেই সময়ে একটা গাড়ি এসে বাড়ির সামনে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নামল একজন সাহেব আর মেম। অবিনাশ চট করে পিস্তলটা লুকিয়ে ফেলল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল—সাত দিন সময় দিলাম। এর মধ্যে কলকাতা ছেড়ে চলে যাবে। সাত দিন পর আবার আসব। সেদিনও যদি দেখি তুমি রয়েছ তাহলে….
কথা শেষ না করেই অবিনাশ গাড়িতে গিয়ে উঠল।
দাদু এগিয়ে গেলেন দরজা পর্যন্ত। হেসে বললেন, বক্সী সাহেব, সাত দিন কেন আরও অনেক দিন পর্যন্ত এখানেই আমি থাকব। কিন্তু সাত দিন পর তুমি আর থাকবে না। চরম মুহূর্তে চেষ্টা কোরো আমার ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণ করতে।
বক্সী হা হা করে হেসে উঠল। বলল, আচ্ছা দেখা যাবে কে থাকে। বলেই গাড়িতে স্টার্ট দিল।
শিবানন্দ ভট্টাচার্যের নাতি এই পর্যন্ত বলে থামলেন।
—তারপর? সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল।
ভদ্রলোক এবার যেন চাইলেন বাকি ঘটনাটা দাদু বলেন। তিনি শিবানন্দের দিকে তাকালেন।
শিবানন্দ তাকিয়ায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। এবার দুই কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে দেহটাকে কোনোরকমে ঠেলে তুললেন।
—এবার আমিই বলব। যে উদ্দেশ্যে আপনারা এসেছেন এবার তা জানতে পারবেন।
শিবানন্দ কয়েকবার কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলেন। তারপর ভাঙা ভাঙা গলায় বলতে লাগলেন—
—মগরার এই মেয়েটির নাম সুনয়নী তা আপনারা জেনেছেন। সেই সুনয়নী একরাত্রি আমার পরিবারের সঙ্গে ছিল। আমি তাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। ত্রিবেণী থেকে তুলে আনার পর থেকে যা যা ঘটেছিল তা ও আমায় বলেছিল। সেই ঘটনাটা বলি।