২.১ সন্ধান আরম্ভ

দ্বিতীয় খণ্ড – পাপে মৃত্যু / প্রথম পরিচ্ছেদ – সন্ধান আরম্ভ 

সেইদিন জয়বন্ত পোর-বন্দরে আসিলেন। যে দুই মৃতদেহ জাহাজে পাওয়া গিয়াছিল, তাহাদের সম্বন্ধে পুলিস কতদূর কি জানিতে পারিয়াছে, প্রথমে তাহাই সন্ধান লইতে লাগিলেন। দেখিলেন, পোর-বন্দরের পুলিস এ সম্বন্ধে কিছুই সন্ধান করিতে পারে নাই। লোক দুইটি যে কে, তাহারও সন্ধান হয় নাই। তাহারা দুই মৃদদেহের ফটোগ্রাফ তুলিয়া বোম্বাই পুলিসকে পাঠাইয়া দিয়াছে। 

জয়বন্তের ইচ্ছা নহে যে, তিনি কোন কথা পুলিসকে বলেন। একবার একটু গোলযোগ হইলে সমস্তই গোলযোগের দিকে যাইবে—খুনী ও চোরকে আর ধরিতে পারা যাইবে না। তবে দ্বিতীয় মৃতদেহ যথার্থই গোপাল দাসের কিনা জানিবার জন্য তিনি অনেক কষ্টে পুলিস-ইনস্পেক্টরের সহিত আলাপ করিলেন তাঁহার নিকটে নানা অজুহাতে তাহার একখানি ফটো ছবি সংগ্রহ করিলেন। তিনি হরকিষণ দাসের নিকট হইতে একখানি ফটো লইয়াছিলেন। উভয় ছবি মিলাইবামাত্র বুঝিলেন যে, যথার্থই হতভাগ্য গোপাল দাস খুন হইয়াছে। 

এখন তিনি স্পষ্টই বুঝিলেন, কোন লোক টাকার লোভেই গোপাল দাসকে খুন করিয়াছিল; তাহার পর তাহার মৃতদেহ সরাইবার জন্য বাক্স-বন্দী করিয়া আনিতেছিল। ঘটনাচক্রে খুনীও সেই জাহাজে খুন হইয়াছে। বোধহয়, সেই টাকা তাহার নিকট আছে বলিয়া তাহাকে জাহাজেই খুন করিয়া মারভি-বন্দরে নামিয়া গিয়াছে, সম্ভবতঃ সে টাকাও লইয়া গিয়াছে। 

যেদিক দিয়াই হউক, বোম্বে না গেলে ইহার কোন সন্ধানই পাওয়া যাইবে না। যে জাহাজে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, তিনি চেষ্টা করিয়া সেই জাহাজেই রওনা হইলেন; কিন্তু জাহাজে অধিক কিছুই জানিতে পারিলেন না। প্রকৃতপক্ষে জাহাজের লোক বিশেষ কিছুই জানিতে পারে নাই। 

তিনি বোম্বাই উপস্থিত হইয়া প্রথমে আদালতে অনুসন্ধান করিলেন। শীঘ্রই জানিতে পারিলেন যে, সেই বৃদ্ধা মামীর একমাত্র উত্তরাধিকারী হইতেছেন, পোর-বন্দরের হরকিষণ দাস; এবং তাঁহার উকীল হইতেছেন—মেটা। অনুসন্ধানে আরও জানিলেন যে, হরকিষণ দাসের হইয়া মেটা আদালতের অনুমতি লইয়া সমস্ত সম্পত্তি বিক্রয় করিয়াছেন। 

জয়বন্ত ভাবিলেন, “এখন এই উকীল মেটার সঙ্গে দেখা করিয়া সকল কথা জিজ্ঞাসা করা বা বলা ভাল না, কি জানি, এই মেটাই যদি এই ব্যাপারে প্রথম হইতে জড়িত থাকে? কাহাকেও বিশ্বাস নাই। প্রথম হইতেই সাবধান হইয়া কাজ করা ভাল।” 

তিনি বাহির হইতে মেটার আফিস দেখিলেন। তৎপরে তিনি তাহাকে এক পত্র লিখিলেন, ―

“মহাশয়, 

শুনিলাম, আপনি একজন কেরাণী খুঁজিতেছেন। আমি একটু আইনকানুন শিখিতে ইচ্ছা করি, আপনি যদি আমাকে আপনার অফিসে রাখেন, তাহা হইলে আমি বিনা মাহিনায় আপনার কেরাণীর সমস্ত কার্য্য করিয়া দিতে প্রস্তুত আছি, অধিকন্তু মাসে মাসে কিছু কিছু দিতেও স্বীকৃত আছি; ইতি। 

বশম্বদ

জয়বন্ত লালজীভাই।” 

মেটার অবস্থার বিষয় আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি। তাহার কেরাণী রাখিবার ক্ষমতা ছিল না; অথচ একজন কেরাণী না থাকিলে তাহার মান থাকে না। এরূপ সুবিধা আর সে কোথায় পাইবে? বিনা মাহিনার কেরাণী—তাহার উপরে আবার মাসে মাসে কিছু দিতেও চাহে, সে তৎক্ষণাৎ জয়বন্ত লালজী ভাইকে দেখা করিবার জন্য একখানা পত্র লিখিল। 

পত্র পাইবামাত্র জয়বন্ত মেটার আফিসে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মেটাও তাঁহাকে সেইদিনেই কার্য্যে নিযুক্ত করিল। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পরেই বলিল, “আপনি আজ হইতেই থাকিতে পারেন, আমার কোন আপত্তি নাই।” 

সেইদিন হইতে জয়বন্ত মেটা সাহেবের কেরাণী হইলেন। যাহাতে মেটা তাঁহার উপরে কোনরূপ সন্দেহ করিতে না পারে, সে বিষয়ে বিশেষ সাবধান হইয়া চলিতে লাগিলেন। কাজ-কর্ম্ম মেটার কিছুই ছিল না। সুতরাং লালজী ভাই সমস্ত দিন প্রায়ই বসিয়া থাকিতেন। 

তাঁহার উদ্দেশ্য হরকিষণ দাসের মামীর বিষয় সম্বন্ধে সমস্ত কাগজপত্র দেখা; সুবিধামত যখন মেটা আফিসে থাকিত না, তখনই জয়বন্ত সেই সকল কাগজ-পত্র দেখিতেন। 

ক্রমে তিনি সমস্তই জানিতে পারিলেন। হরকিষণ দাসের মামীর মৃত্যু, তাঁহার সম্পত্তির সমস্ত তালিকা, সেই সমস্ত যেরূপে যাহার নিকটে বিক্রয় হইয়াছে, তাহা তিনি সমস্ত অবগত হইলেন। তবে টাকা মেটার নিকটে আছে কি না, তিনি তখনও তাহা জানিতে পারিলেন না। ক্রমে একদিন তিনি হরকিক্ষণ দাসের এক রসিদ পাইলেন। সে রসিদ হরকিষণ দাসের হাতের লেখা নহে, জয়বন্ত বুঝিলেন, গোপালরাম দাস মেটাকে এই রসিদ দিয়াছিল। রসিদ লাখ টাকার। সুতরাং বোঝা যাইতেছে যে, গোপালরাম দাস মেটার নিকট লাখ টাকা পাইয়া তাহাকে রসিদ দিয়াছিল। আরও অনুন্ধানে জয়বন্ত জানিলেন যে, মেটার নিকটে টাকা নাই। তাহার আর্থিক অবস্থা যেরূপ শোচনীয় দেখিলেন, তাহাতে তাহার হাতে লাখ টাকা পড়িলে তাহার কখনই এরূপ অবস্থা হয় না। সুতরাং এটা নিশ্চয় যে, মেটার নিকটে টাকা নাই; তাহা হইলে এখন কথা হইতেছে — টাকা লইল কে? 

এ সম্বন্ধে মেটা কোনরূপে জড়িত আছে কি না, জয়বন্ত তাহা প্রথমে কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না; তবে মেটার ভাব-ভঙ্গিতে গুরুতর সন্দেহ হইল। মেটা যেন সৰ্ব্বদাই ভীত, সৰ্ব্বদাই সশঙ্ক, নিতান্ত গুরুতর কোন ভয়াবহ কাজ না করিলে মানুষের এরূপ ভাব বিলক্ষণ হয় না। এ বিষয়ে বিশেষ সন্ধান লইবার জন্য তিনি ব্যগ্র হইলেন। মেটার আফিসে তাহার তিন-চারিখানি ছবি ছিল, একদিন তিনি মেটার অসাক্ষাতে একখানি ছবি সংগ্রহ করিলেন। তিনি জানিতেন যে, মেটা সহজে জানিতে পারিবে না যে, তাহার ছবি চুরি গিয়াছে। 

ছবিখানি সংগ্রহ করিয়া জয়বন্ত জাহাজের টিকিট আফিসে উপস্থিত হইলেন। যে ভদ্রলোক টিকিট বিক্রয় করেন, তাঁহার সহিত দেখা করিলেন। জয়বন্ত তাঁহাকে বলিলেন, “জাহাজে যে খুন হইয়াছিল, সে সম্বন্ধে আপনার কাছে কিছু জানিতে আসিয়াছি।” 

টিকিট বিক্রেতা তাঁহার দিকে চাহিলেন। বলিলেন, “মহাশয় কি সংবাদপত্রের লোক? নূতন খবর আর কিছু নাই।”

“আমি সংবাদপত্রের লোক নই।” 

“তবে পুলিস। তাহারাও ত হতাশ হইয়া এ অনুসন্ধান ছাড়িয়া দিয়াছে।” 

“এখানকার পুলিস দিয়া থাকিতে পারে; কিন্তু পোর-বন্দরের পুলিসের চেষ্টা এখনও যায় নাই।”

“আপনি কি পোর-বন্দরের পুলিস-কৰ্ম্মচারী?” 

“হাঁ, আমি পোর-বন্দরের পুলিসের লোক — কাল এখানে আসিয়াছি।” 

“নূতন কিছু সন্ধান হইয়াছে?” 

“কিছু যে না হইয়াছে, এমন বলিতে পারি না। আপনি আমাকে একটু সাহায্য করিলে এ বিষয়ে বোধহয়, কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিব।” 

“কি, বলুন।” 

“যে দুইজন লোক সেবার এক কেবিনের টিকিট লইয়াছিলেন, তাহাদের চেহারা কি এক মনে হয়?”

“চেহারা সম্বন্ধে আমার স্মরণশক্তি অতি তীক্ষ্ণ—আমি তাঁহাদের দেখিলেই চিনিতে পারিব।”

“ইহাতেই আমাদের কাজ হইতে পারে।” 

“বোধ হয়, কিছুই কাজ হইবে না। পুলিস এই দুইজন লোকেরই ছবি তুলিয়া এখানে পাঠাইয়াছিল; কিন্তু তাহাদের দুইজনের একজনকেও আমি চিনিতে পারি নাই। তাহারা যদি টিকিট লইত, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই তাহাদের চিনিতে পারিতাম।” 

“আপনি কি নিশ্চিত বলিতে পারেন যে, তাহাদের চিনিতে পারিবেন?”

“নিশ্চয়ই।” 

জয়বন্ত পকেট হইতে একখানা ছবি বাহির করিয়া বলিলেন, “দেখুন দেখি, এখানা চিনিতে পারেন কি না।”

টিকিট বিক্রেতা বলিয়া উঠিলেন, “হাঁ, এই একজন — এই একজন বটে?” 

এই ছবি গোপাল দাসের। 

জয়বন্তের ধমনীর ভিতর রক্ত খরবেগে প্রবাহিত হইতে লাগিল; তিনি অতিকষ্টে আত্মসংযম করিয়া বলিলেন, “তাহা হইলে আপনি এই লোককে ঠিক চিনিতে পারিতেছেন?” 

“নিশ্চয়—নিশ্চয়।” 

“কোন সন্দেহ নাই?” 

“বিন্দুমাত্র নয়।” 

জয়বন্ত আর একখানা ছবি বাহির করিয়া বলিলেন, “তাহা হইলে বোধ হইতেছে, এইখানি অপর লোকের ছবি।” 

টিকিট বিক্রেতা বিস্মিতভাবে বলিয়া উঠিলেন, “আপনি ঠিক বলিয়াছেন, এই সে লোক। যদি এই দুইজন লোককে আপনি খুঁজিয়া পান, তাহা হইলে এ খুনের কিনারাও ঐখানেই হইয়া গেল।” 

এই ছবিখানি উকীল বাইরামজী মেটার। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – কৌশল 

জয়বন্ত বাসায় ফিরিয়া আসিলেন। কি করিবেন, বহুক্ষণ সে চিন্তা করিতে লাগিলেন। অবশেষে মনে মনে একটা স্থির করিয়া বাহির হইলেন। 

তিনি বাজারে আসিয়া একজোড়া হাতকড়ী কিনিয়া পকেটে রাখিলেন। তিনি পোর-বন্দর হইতেই একটা পিস্তল আনিয়াছিলেন, তাহা সর্ব্বদাই তাঁহার সঙ্গে থাকিত। এখন পিস্তলটি বাহির করিয়া বিশেষরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, এবং তাহাতে গুলি ঠিক করিয়া পকেটে রাখিলেন। কোন লোককেই বিশ্বাস নাই। তিনি জানিতেন, এখন ভয়ানক লোকের সহিত তাঁহার কাজ-কৰ্ম্ম। 

তিনি মেটার আফিসে গিয়া মেটার বসিবার গৃহে প্রবেশ করিলেন। তখন মেটা কি কাগজপত্র দেখিতেছিল, তাঁহাকে দেখিয়া বিস্মতভাবে মেটা তাঁহার মুখের দিকে চাহিল। 

জয়বন্ত তৎক্ষণাৎ দ্বাররুদ্ধ করিয়া দিয়া তাহার সম্মুখে বসিলেন। 

মেটা ভ্রুকুটি করিয়া বলিল, “একি! এখানে কেন?” 

জয়বন্ত গম্ভীরভাবে বলিলেন, “মেটা সাহেব, এ বেশি কিছু নয়, কেবল আপনার লীলা-খেলা ফুরাইয়াছে।” 

এই বলিয়া তিনি পকেট হইতে হাতকড়ী বাহির করিলেন। মেটা ইহাতে কিছুমাত্র বুঝিতে না পারিয়া বলিল, “এ কি! এ কি!”

“বিশেষ কিছু নয়; তবে আমি মহাশয়ের কেরাণী নই, পোর-বন্দরের একজন ডিটেকটিভ-ইনস্পেক্টর।”

“পুলিস?” 

“হাঁ, জাহাজের খুনের জন্য মহাশয়ের নামে একখানা ওয়ারেন্ট আছে।” 

মেটার মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গেল। সে কম্পিত কণ্ঠে কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু একটা কথাও বলিতে পারিল না। 

জয়বন্ত গম্ভীরভাবে বলিলেন, “মহাশয়কে ধরিবার জন্য একটু কষ্ট পাইতে হইয়াছে, কিন্তু এখন আর কোন গোল নাই। মহাশয়ের উপরে বিশেষ দৃষ্টি রাখা হইয়াছে।” 

মেটা এবারও কথা কহিতে পারিল না। জয়বন্ত বলিলেন, “তবে মহাশয়কে একটি কথা বলা প্রয়োজন, আমি মহাশয়কে গ্রেপ্তার করিতে আসি নাই। আপনাকে যে গ্রেপ্তার করিবে, সে পোর-বন্দর হইতে রওনা হইয়াছে।” 

“গ্রেপ্তার নয়, তবে কি?” 

“আমি সেই লাখ টাকার সন্ধানে আসিয়াছি।” 

মেটা তাঁহার মুখের দিকে বিস্মিতভাবে চাহিল। 

জয়বন্ত বলিলেন, “আমি জানি, সে টাকা কোথায় আছে; কিন্তু তুমি তাহা আদৌ জান না। তবে মধ্যে একটা বন্দোবস্ত হইতে পারে।” 

মেটা ব্যগ্রভাবে বলিল, “সে কি?” 

“সে এই—এ পৰ্য্যন্ত যাহা হইয়াছে, তাহা যদি আমাকে সত্য করিয়া সমস্ত বল, তবে আমি তোমাকে পলাইতে সময় দিতে পারি। আর ইহাই এখন তোমার পক্ষে সদযুক্তি।” 

“কিরূপে বিশ্বাস করিব?” 

“আমার কথায় বিশ্বাস করিতে হইবে। আমি তোমাকে পলাইতে সময় দিব, ইহার পর যদি তুমি আবার আমার হাতে পড়, তাহা হইলে সে দোষ আমার নয়।” 

“আমি সব বলিতেছি।” 

“সৎ পরামর্শ—তোমার অনেক কথাই আমার নোটবুকে লেখা আছে।” 

“আমি সত্যকথা বলিতেছি।” 

“বল।” 

“আমি তাহাকে লাখ টাকার নোট দিয়াছিলাম। নোটের নম্বর—” 

(বাধা দিয়ে) “আমি জানি।” 

জয়বন্ত মেটার কাগজ-পত্রেই নোটের নম্বর পাইয়াছিলেন। 

“তাহার পর তাহার সঙ্গে আমি জাহাজের টিকিট কিনিতে গিয়াছিলাম।” 

“এ সবই আমি জানি।” 

“তাহার পর টিকিট লইয়া হরকিষণ দাস চলিয়া গেলে আমি সেই কেবিনের অন্য টিকিটখানি কিনি।” 

“হরকিষণ দাস কোথায় যায়?” 

“তাহা আমি জানি না; তবে আগে আমাকে একবার দাঁতের বেদনার কথা বলিয়াছিল।” 

এই বলিয়া মেটা যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, সমস্তই বলিল। তাহার কথা শেষ হইলে জয়বন্ত বলিলেন, “তাহা হইলে অবশ্যই তুমি নোট বন্ধ করিয়াছ।” 

“হাঁ, করিয়াছি।” 

“আমাকে একখানা চিঠী লিখিয়া দাও, ঐ চিঠীতে লিখ যে, নোট আর বন্ধ রাখিবার প্রয়োজন নাই। নোট সম্বন্ধে গোলযোগ মিটিয়া গিয়াছে।” 

“তাহা হইলে নোট তুমি পাইয়াছ?”

“সে কথা এখন থাক — লেখ চিঠী।” 

 নিরুপায় মেটা পত্র লিখিয়া দিল। জয়বন্ত সেই পত্রখানা পকেটস্থ করিয়া বলিলেন, “ইহাতেই আমার কাজ হইবে। তোমাকে গ্রেপ্তার করা বা তোমায় ফাঁসীকাঠে তুলিয়া ধরা আমার কাজ নহে, সে কাজের ভার অন্যের উপরে পড়িয়াছে, তিনি আসিতেছেন, তাঁহার কাজ তিনি করিবেন, তাঁহার সাহায্য করিতে আমি বাধ্য নই।”

এই বলিয়া জয়বন্ত হাতকড়ী পকেটে রাখিলেন, উঠিয়া দ্বার খুলিয়া দিয়া বলিলেন, “এখন যাও, আর বিলম্ব করিয়ো না, ইহার পর যদি ধরা পড়, সে দোষ আমার নয়। অন্য কোন দেশে পলাইয়া গিয়া প্রাণটা রক্ষা করিতে পার।” 

মেটা কোন কথা না কহিয়া সত্বর কতকগুলি কাগজ-পত্র সংগ্রহ করিয়া পকেটে রাখিল। তৎপরে জয়বন্তের দিকে ফিরিয়া বলিল, “বাহিরে আমাকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য কেহ নাই?”

“না, তাহা হইলে আমিই তোমাকে গ্রেপ্তার করিতাম।” 

মেটা আর কোন কথা না কহিয়া সত্বরপদে নিজের আফিস হইতে বাহির হইয়া গেল। জয়বন্ত তথায় প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষা করিয়া সে স্থান পরিত্যাগ করিলেন। 

গোপাল দাস, মেটাকে দাঁতের বেদনার কথা বলিয়াছিল; সুতরাং খুব সম্ভব, সে কোন দন্ত-চিকিৎসকের নিকটে গিয়াছিল, বোম্বাই শহরে যে রাস্তায় চিকিৎসকগণ থাকেন, জয়বন্ত সেইদিকে চলিলেন। বলা বাহুল্য মেটার আফিসে তাঁহার আবশ্যক যে কোন কাগজপত্র পাইলেন, তাহা সমস্তই সঙ্গে লইলেন। 

রাস্তায় আসিয়া তিনি দুইখানা সাইনবোর্ড দেখিয়া তাঁহার মনে সহসা একটা কথা উঠিল। দেখিলেন, প্রায় পাশাপাশি দুইটি বাড়ীতে দুইখানা সাইনবোর্ড রহিয়াছে; একটিতে দন্ত-চিকিৎসক জামসেদজী সৈয়দজী পাটেল। আর একটিতে ডাক্তার পাটেল। 

তিনি পুলিসের নিকট জানিয়াছিলেন যে, গোপালরামের দেহ যেরূপ ভাবে কাটা হইয়াছিল, তাহা কোন চিকিৎসক ব্যতীত অন্য কাহারও কাজ নহে। এখানে এক ডাক্তার দোরাবজী সৈয়দজী পাটেল রহিয়াছে–পাশেই দন্ত-চিকিৎসক পাটেল। জয়বন্ত ভাবিলেন, “ইহারা সম্ভবতঃ দুই ভাই, হয় ত ইহারা ইহার কিছুই জানে না, তবে একবার ইহাদের একটু নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখা উচিত নয় কি? ইহাতে লাভ না হইলেও ক্ষতি কিছু হইবে না।” 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – আশার সঞ্চার 

সেদিন জয়বন্ত আর বাসা হইতে বাহির হইলেন না। কি করিবেন, সমস্ত দিন বাসায় বসিয়া তাহাই ভাবিতে লাগিলেন। পরদিন সেই ডাক্তার ও দন্ত-চিকিৎসকের সহিত দেখা করাই স্থির করিলেন। 

প্রথমে তিনি ডাক্তার দোরাবজীর আফিসে উপস্থিত হইলেন; দেখিলেন, তাহার আফিস বন্ধ। পাশ্ববর্তী লোকের নিকটে অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন যে, ডাক্তার অনেকদিন হইতে বিদেশে গিয়াছে, কোথায় গিয়াছে, তাহারা জানে না। তবে এ সম্বন্ধে তাঁহার যদি আরও কিছু জানিবার থাকে, তাহা হইলে তাহার ভ্রাতা দত্ত-চিকিৎসক জামসেদজীর নিকটে জানিতে পারেন। 

এই সংবাদ পাইয়া জয়বন্তের হৃদয় উৎসাহপূর্ণ হইয়া গেল। তিনি ভাবিলেন যে, তিনি ঠিক পথেই আসিতেছেন, আর অধিক কষ্ট পাইতে হইবে না। তিনি একজনকে বলিলেন, “বহুদিন আগে ডাক্তার পাটেল সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় হইয়াছিল, এই পাটেল আমার সেই পরিচিত বন্ধু কিনা, তাহা বলিতে পারি না। ইঁহার চেহারা কিরূপ?” 

যাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, সে ডাক্তারের চেহারা বর্ণন করিল। যে ব্যক্তি জাহাজে খুন হয়, তাহার ছবি জয়বত্তের নিকটেই ছিল, তিনি তাহা বাহির করিয়া বলিলেন, “আমার বন্ধু পাটেলের ছবি আমার সঙ্গেই আছে, দেখ দেখি, ইনি তিনি কি না?” 

সেই ব্যক্তি বলিয়া উঠিল, “হাঁ, এই ত তাঁহারই চেহারা।” 

“তাহা হইলে আমার ভুল হয় নাই?” 

“না, ঐ যে তাঁহার ভাই যাইতেছেন, উহাকে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। উনি এই সময়ে রোজ বাড়ী যান।” 

“না, উহার সঙ্গে আমার আলাপ নাই”, বলিয়া জয়বন্ত তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। 

অন্যপথে প্রবেশ করিয়া তিনি ভাবিলেন, “ভালই হইয়াছে, দন্ত-চিকিৎসক মহাশয় এখন আফিসে নাই—ভালই হইয়াছে। কেহ-না-কেহ চাকর আছে—কিছু সন্ধান পাওয়া যাইবে, এ একটা চমৎকার সুযোগ বটে।” এইরূপ ভাবিয়া তিনি দত্ত-চিকিৎসকের আফিসে প্রবেশ করিলেন; দেখিলেন, একটি যুবক তথায় বসিয়া আছে। এই যুবকই সেই পাণ্ডুরং। 

জয়বন্ত তাহাকে বলিলেন, “একটা দাঁত দেখাইতে ইচ্ছা করি।” 

পাণ্ডুরাং বলিল, “এইমাত্র ডাক্তার বাড়ী গেলেন, একটু আগে আসিলে দেখা হইত।” 

“কি মুস্কিল! আর একটু আগে আসিলেই হইত। ছুটিয়া আসিয়াছি, একটু বসিয়া বিশ্রাম করিব।”

“বসুন না।” 

“আমার একটি বন্ধু এই ডাক্তারের নিকটে আসিতে আমায় পরামর্শ দিয়াছেন, একটি গুজরাটী বন্ধু — তিনি ডাক্তারকে দিয়া একটা দাঁত তোলাইয়াছিলেন। তিনি বলিলেন, দাঁত তুলিতে তাঁহার কোন কষ্ট হয় নাই।”

“অনেকেই এই রকম দাঁত তুলিয়া থাকেন।” 

“ক্লোরাফর্ম্ম দিয়া?” 

“না, গ্যাস দিয়া।” 

“ইহাতে বিপদের আশঙ্কা আছে?” 

“না—না—সেই সময়ে একজন ডাক্তারও উপস্থিত থাকেন?” 

“বটে, কোন্ ডাক্তার থাকেন?” 

“আমাদের ডাক্তারের ছোট ভাই—একটু আগেই তাঁহার আফিস।” 

“বটে, তিনি এখন এখানে আছেন?” 

“না, তিনি বিদেশে গিয়াছেন।” 

“কতদিন?” 

“ও! ঠিক মনে পড়িয়াছে, সেই গুজরাটী ভদ্রলোকটি যেদিন এসেছিলেন, তারপর দিন থেকেই তিনি বিদেশে গেছেন।” 

“তোমার সেই গুজরাটী ভদ্রলোকটির কথা মনে পড়ে?” 

“বেশ মনে পড়ে, এখানে বড় বেশি খরিদ্দার আসে না।”

“তাহাকে দেখিলে চিনিতে পারিবে?” 

“কেন পারিব না?” 

জয়বন্ত গোপালদাসের ছবিখানি বাহির করিয়া তাহার সম্মুখে ধরিলেন; বলিলেন, “তাহার চেহারা কি এই রকম?” 

“এই রকম? এই ত তাঁহারই ছবি।” 

“বটে, আমার বন্ধু দাঁত তুলিবার সময়ে কি যাতনায় চীৎকার করিয়া উঠিয়াছিলেন?”

“আমি তাহা জানি না।”

“কেন, তুমি কি তখন এখানে ছিলে না?” 

“না, আমি দুই ডাক্তারেরই কাজ করি। তখন ঐ ডাক্তারের আফিসে ছিলাম। আমি তাঁহাকে পাঠাইয়া দিয়া সেইখানে কাজ করিতেছিলাম। যখন ফিরিলাম, তখন আপনার বন্ধু চলিয়া গিয়াছেন।” 

“ওঃ! তাহা হইলে কোথায় দাঁত তোলা হয়?” 

“এইখানেই”, বলিয়া সে পাশ্ববর্তী গৃহের দ্বার খুলিয়া দিল। জয়বন্ত বলিলেন, “কখন ডাক্তার আসিবেন?”

“যদি শরীর ভাল থাকে, বৈকালে আসিবেন।”

“কেন, তাঁহার কি কোন অসুখ হইয়াছে?”

“তাহাই বোধ হইতেছে।” 

“কিছু বলেন নাই?” 

“তাঁহার ভাই বিদেশে যাওয়া পর্য্যন্ত তাঁহার অসুখ হইয়াছে। আপনি যদি বৈকালে আসেন, তাহা হইলে তাঁহাকে খবর দিতে পারি।” 

“হাঁ, তাহাই আসিব।” 

“ক-টার সময়?” 

“এই বৈকালে পাঁচটার সময়।” 

“তাঁহাকে সংবাদ দিব, তাহা হইলে তিনি নিশ্চয়ই আসিবেন।” 

“আমিও নিশ্চয় আসিব, “বলিয়া জয়বস্তু বিদায় লইলেন। তিনি জীবনে এরূপ আনন্দ কখনও উপভোগ করেন নাই। তিনি এখন সমস্ত ব্যাপারই বুঝিতে পারিয়াছেন। পাটেলদ্বয় টাকার লোভে গোপালসাদকে খুন করিয়াছে, তাহার পর একজন গোপাল দাস সাজিয়া তাহার দেহ সরাইবার জন্য জাহাজে গিয়াছিল, তথায় মেটা কর্তৃক হত হয়। আর এক পাটেল এখানে আছে। যখন মেটার নিকটে টাকা নাই, যখন মেটার হস্তে যে হত হইয়াছিল, তাহার নিকটেও টাকা ছিল না, তখন এই মহাত্মা পাটেলের নিকটে যে টাকা আছে, তাহাতে বিন্দুবাত্র সন্দেহ নাই। 

সেই লক্ষ টাকা হস্তগত হইবার আর অধিক বিলম্ব নাই ভাবিয়া, তাঁহার হৃদয় আনন্দে পূর্ণ হইয়া গেল। আনন্দ টাকার জন্য নহে, আনন্দ—তিনি এইবার হিঙ্গনকে লাভ করিতে পারিবেন। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সঙ্কটাপন্ন 

বৈকালে দন্ত চিকিৎসক পাটেল সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য জয়বন্ত বাসা হইতে বাহির হইয়াছিলেন, এই সময়ে ডাকপিয়ন তাঁহার হাতে একখানি পত্র দিল। তিনি সত্বর পত্রখানি খুলিয়া ফেলিয়া পাঠ করিলেন;- 

“গোবিন্দজীর চল্, বান্দোরা। 

আমি আজই বোম্বাই হইতে যাইতেছি; কিন্তু হঠাৎ একটা বিশেষ সংবাদ পাইলাম। আপনি আজ আমার যে উপকার করিয়াছেন, তাহার জন্য এই সংবাদ আপনাকে না দিলে আমার নিতান্ত অকৃতজ্ঞতা হয়। এখনই আসিবেন, না হইলে আমার সঙ্গে আর দেখা হইবে না। 

—বাইরামজী মেটা।” 

জয়বন্ত পত্রখানি দুই-তিনবার পাঠ করিলেন। কি করিবেন, সহসা স্থির করিতে পারিলেন না। যাইবেন, না যাইবেন না? বৈকালে দন্ত-চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করিবার কথা। 

তিনি অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া প্রথমে মেটার সঙ্গে দেখা করাই স্থির করিলেন। ভাবিলেন, “এ লোকটার সঙ্গে আর দেখা করিবার সুবিধা হইবে না, এ নিশ্চয় এখান হইতে আজও পলাইবে, সুতরাং ইহার সঙ্গে দেখা করাই আবশ্যক, কি জানি, যদি কিছু নূতন সংবাদ পাই। পাটেল কিছুই জানে না, কোন সন্দেহ এখনও করে নাই, সুতরাং তাহার সঙ্গে কাল দেখা করিলেও চলিতে পারিবে, সে কোথায়ও যাইবে না; কিন্তু মেটা এখানে থাকিতেছে না, ইহার সঙ্গেই প্রথমে দেখা করা উচিত।” 

এইরূপ ভাবিয়া জয়বন্ত বান্দোরা রওনা হইলেন; কিন্তু মনে মনে তাঁহার সন্দেহ রহিল। এরূপ দুরাত্মা যে কৃতজ্ঞ হইতে পারে, তাহা তাঁহার বিশ্বাস হইল না। তবে ভয় কাহাকে বলে, তিনি জানিতেন না, তাঁহার পকেটে পিস্তল ছিল, শরীরেও অসীম বল, তাঁহার কিসের ভয়? 

তিনি বান্দোরায় উপস্থিত হইয়া গোবিন্দজীর চল অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিলেন। বাড়ীটি দেখিয়া সন্দেহ করিবার কিছুই নাই। দ্বারে মেটা দণ্ডায়মান ছিল। সে তাঁহাকে দেখিয়া অগ্রসর হইয়া বলিল, “আসুন—আসুন—আপনার জন্যই অপেক্ষা করিতেছি, নতুবা এতক্ষণ এখান হইতে চলিয়া যাইতাম।” 

“খবর কি?” 

“আসুন—সব বলিতেছি, অনেক কথা আছে।” 

মেটা বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিল, জয়বন্ত তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। 

বাড়ীতে আর কেহ যে আছে, তাহা বলিয়া বোধ হইল না। কয়েক পদ জয়বন্ত অগ্রসর হইয়াছেন, অমনি সহসা তাঁহার পদনিম্ন হইতে গৃহতলের কিয়দংশ সরিয়া গেল, তখন তিনি দেখিলেন, গৃহতল কাষ্ঠে নির্মিত; কিন্তু তিনি ইহা জানিবার পূর্ব্বেই এক গহ্বরে পতিত হইলেন; কিন্তু সত্বর দুই হাতে একদিককার একখানা তক্তা ধরিয়া আত্মরক্ষা করিলেন, নতুবা তিনি সেই গহ্বর মধ্যে নিক্ষিপ্ত হইতেন। 

মেটা পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিল যে, জয়বন্ত দুই হস্তে তক্তা ধরিয়া ঝুলিতেছেন; সে নিমেষমধ্যে বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে এক লৌহদণ্ড বাহির করিয়া তাঁহার দুই হস্তে প্রহার করিল। জয়বন্ত যাতনায় চীৎকার করিয়া হাত ছাড়িয়া দিলেন, অমনি তিনি সেই গভীর গহ্বরের নিম্নে পতিত হইলেন। 

কিয়ৎক্ষণ পরে মেটা একটা লন্ঠন সেই গহ্বরের মুখে ধরিয়া বলিল, “কি হে, আঘাত পাইয়াছ নাকি?”

নিম্নে মাটি নরম থাকায় জয়বন্ত সৌভাগ্যক্রমে গুরুতর আঘাত পান নাই। তিনি ক্রোধে বলিয়া উঠিলেন, “এই তোমার কৃতজ্ঞতা?” 

মেটা বিকট হাস্য করিয়া বলিল, “হাঁ বন্ধু, আমাকে বাধ্য হইয়া তোমার প্রতি এরূপ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতে হইতেছে; তবে তোমাকে এমন অবস্থায় রাখিতে আমি বিশেষ দুঃখিত হইতেছি—কি করিব, কাজ কাজ কাজ আগে।” 

“আমি ইচ্ছা করিয়া তোমার ফাঁদে পা দিয়াছি।” 

“অনুগ্রহ আপনার।” 

“তোমার মলব কি? কতদিন তুমি আমাকে এখানে এইরূপভাবে আটকাইয়া রাখিতে চাও?” 

“সে সবই তোমার বিবেচনার উপরে নির্ভর করিতেছে।” 

“কি রকম? তোমার কথা বুঝিলাম না।” 

“অতি সহজ কথা এই লাখ টাকার নোট আমার হাতে আসিলেই তুমি মুক্তি পাইবে।” 

“আর যদি নোট আমি তোমায় না দিই?” 

মেটা কেবল হাসিয়া উঠিল। 

জয়বন্ত বলিলেন, “যদি নোট আমার কাছে না থাকে?” 

মেটা আবার হাসিল; হাসিয়া বলিল, “তুমিও নির্ব্বোধ নও—আমিই নই, কাজের লোক দুজনেই–সুতরাং সেই রকম কাজের কথা হোক। যতদিন আমি নোটগুলি না পাইব, ততদিন তোমাকে এখানে থাকিতে হইবে। তবে একটু তাড়াতাড়ির আবশ্যক আমার এখানে অধিক দিন থাকিবার উপায় নাই, তাহার কারণ তুমি ত জানই, বন্ধু।” 

“তাড়াতাড়ি কি করিবে—যন্ত্রণা দিয়া আমার নিকট হইতে নোটের কথা জানিয়া লইবে?”

“সে তোমার অভিরুচি, ইচ্ছা করিলে তুমি কোন যন্ত্রণাই পাইবে না।” 

“অর্থাৎ নোটগুলি তোমায় দিলে।” 

“নিশ্চয়।” 

“যদি নোটগুলি তোমায় না দিই, তুমি আমার কি করিবে?” 

“দেখিতেছ, এখন আমার জিভের খেলা।” 

“যদি আমার কাছে নোট না থাকে?” 

“তা জানি, কাছে নাই—তাহা হইলে ফাঁদটা ভিন্ন রকমে পাতা হইত– তোমাকে অজ্ঞান করিয়া নোট লইতাম।” 

“এখন তুমি আমাকে কি করিতে বল?” 

“তুমি আমার কাছ থেকে চিঠী লিখিয়া লইয়াছিলে, এখন যাহার কাছে নোটগুলি আছে, তাহাকে সেগুলি আমাকে দিবার জন্য একখানা পত্র লিখিয়া দাও।” 

“পত্র দিব কাহাকে?” 

“যাহার কাছে নোটগুলি আছে?” 

“আর যদি না দিই-”

“তাহা হইলে এখানে সুখে স্বচ্ছন্দে বাস কর, যখন শিক্ষা আর জ্ঞান উভয়ই তোমার লাভ হইবে, তখন সহজেই সম্মত হইবে–এখানে আহার নাই—জল নাই—” 

“তুমি আমাকে খুন করিবে?” 

মেটা কেবল উচ্চহাস্য করিল। তৎপরে বলিল, “সে ইচ্ছা আমার নাই–তোমার ইচ্ছার উপরেই তাহা নির্ভর করে; এখন থাক, যে ঘরে তুমি আছ, সেখানে দম বন্ধ হইয়া মরিবে না, উপরে জানালা আছে—তাহার ভিতর দিয়া হাওয়া যাইবে, কিছু আলো পাইবে, এই আলো ও হাওয়া খাইয়া আপাততঃ কিছুদিন পরমানন্দে কাটাও—পলাইবার আশা করিয়ো না, পলাইবার উপায় নাই। এখানে হাজার চীৎকার করিলেও কেহ তোমার কথা শুনিতে পাইবে না। সদ্ধি যতক্ষণ না হয়, ততক্ষণ এই ঘরে বন্ধ থাক।

এই বলিয়া উপরের দরজা বন্ধ করিয়া মেটা চলিয়া গেল। জয়বন্ত ঘোর অন্ধকারে সেই ক্ষুদ্র গহ্বর-গৃহে আবদ্ধ রহিলেন।