দ্বিতীয় পর্ব
।।এক।। ডাঃ রুদ্রের ছবিপ্রীতি
মাস তিনেক পর।
অনেক চেষ্টায় মানিকতলার কাছে ওরা দুখানা ঘর পেয়েছে। মান্তুদের বাড়িতে কিছুদিন থেকে এখন ওরা এই নতুন বাড়িতে এসেছে।
এখানে এসে ওরা নিশ্চিন্ত। রীণা সম্পূর্ণ সুস্থ। ভয়টয় আর পায় না। শুধু তাই নয়, রীণার এখন মনে হয়—যা সব এতদিন ঘটেছে সব যেন স্বপ্ন। সে বিশ্বাসই করতে পারে না কোনোদিন তার ওপর অশরীরী আক্রমণ হত। পুপুও সুস্থ আছে। হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল শিশু।
শুধু সঞ্জয় মাঝে মাঝে ভাবে—শেষ পর্যন্ত অলৌকিক কিছুর কাছে তাকেও আত্মসমর্পণ করতে হল! হ্যাঁ, আত্মসমর্পণ বইকি। বাড়ি তো বদলাতে হল!
তখনই অবশ্য অন্য যুক্তি দাঁড় করায়—পুপুর শরীর ওখানে টিঁকছিল না। অন্তত ওর দিকে তাকিয়েও তাকে বাড়ি বদলাতে হত। তা ছাড়া নীচের তলার ভাড়াটাদের সঙ্গে বেশিদিন আর মানিয়ে চলতে পারত না। কেবল রীণার দুঃখ বন্দনাদের জন্য। বন্দনার মাকে ওর খুব ভালো লেগেছিল। অবশ্য এর মধ্যেই বন্দনারা দুবার ঘুরে গেছে। মান্তু তো প্রায়ই আসে। বলে—এবার অনেকটা কাছে হয়েছে।
রীণা হাসে।—কই আর কাছে? কোথায় মানিকতলা আর কোথায় হাওড়ার ক্ষীরোদতলা!
মান্তু বলে, তবু তো যশোর রোড থেকে কাছে।
ডাক্তার রুদ্র প্রায় আসেন। সব মিলিয়ে রীণা এখন বেশ ভালোই আছে।
জুলাই মাস।
একদিন বিকেলে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। ডাক্তার রুদ্র এসেছেন। সঞ্জয়ও রয়েছে। গরম শিঙাড়া আর কফির পেয়ালা সামনে নিয়ে আসর বেশ জমেছে রীণাদের বসার ঘরে।
ডাক্তার রুদ্র কথায় কথায় বললেন, আচ্ছা, সেই ছবিটার কী হল?
—কোন ছবি?
—সেই যে বুড়ো ভদ্রলোকের—যেটা হারিয়ে গেল।
—ওঃ! শিবানন্দ ভট্টাচার্যর?
ডাক্তার রুদ্র মাথা দোলালেন।
—এখানে আসার পর তাঁর কাছে গিয়েছিলে নাকি?
সঞ্জয় বলল, না। যাওয়া হয়নি।
—একেবারে ছেড়ে দিলে?
সঞ্জয় হাসল—আপনার দেখছি বেশ আগ্রহ রয়েছে।
—তা রয়েছে। রহস্যটা কী জানতে না পারা পর্যন্ত কৌতূহল মিটছে না।
রুদ্র একটু হাসলেন । তারপর বললেন, কয়েকটা ব্যাপার লক্ষ করেছ? প্রথমত আত্মার অবির্ভাব হত শুধু তিনতলার ঘরেই। এতদিন ধরে এত কাণ্ড হয়ে গেল কিন্তু বাড়ির একতলা—দোতলায় সবাই নিশ্চিন্ত। তাদের গায়ে আঁচটুকুও লাগেনি।
দ্বিতীয়, আক্রমণ শুধু রীণার ওপরেই। রীণা ছাড়া আর কাউকে দেখা দিত না।
—দেখা দিত না, না রীণা ছাড়া আর কেউ দেখতে পেত না? কথার মাঝখানে সঞ্জয় মন্তব্য করল।
—That’s also the point. দেখা দেওয়া আর দেখা পাওয়া এই ব্যাপারটার সমাধান হলে আশা করি অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
এই বলে ডাঃ রুদ্র চুপ করে ভাবতে লাগলেন।
সঞ্জয় বলল, কিন্তু আপনি কি মনে করেন শিবানন্দর কাছে গেলেই রহস্যের সমাধান হবে?
ডাক্তার রুদ্র থুতনিতে হাত বুলিয়ে একটু ভেবে বললেন, সমাধান হবেই এ কথা জোর করে বলতে পারি না। অলৌকিকতার রহস্য কখনো ভেদ করা যায় না। তবে তুমি বলছিলে না বৃদ্ধটি কলকাতার অনেক পুরোনো বাড়ির ইতিহাস জানেন?
—হ্যাঁ, আমার সেই পেশেন্টের বাড়িতে তো তাই শুনেছিলাম।
—তবে চলোই—না একদিন বৃদ্ধের সন্দর্শনে যাই।
—আপনি সত্যিই interested দেখছি!
—Yes, I am. ঠিকানাটা তোমার মনে আছে তো?
—একেবারে কণ্ঠস্থ। অশরীরী আত্মাটি এখানেই আমার কাছে হেরে গেছেন।
—তবে একটা দিন ঠিক করে ফেলো। দেরি করা উচিত হবে না। বুঝতেই পারছ বৃদ্ধের বয়েস হয়েছে। যে কোনোদিন পৃথিবীর মায়া কাটাতে পারেন।
সঞ্জয় ক্যালেন্ডারের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, সামনের রবিবার হলে আপনার অসুবিধে হবে?
ডাক্তার রুদ্র ডায়রিটা খুললেন।
—না, কোনো অসুবিধে নেই। একটা মিটিং আছে সকালে। তা আমরা না হয় বিকেলে যাব।
—তুমিও যাবে নাকি? সঞ্জয় হেসে রীণাকে জিজ্ঞেস করল।
—গেলে হত। বৃদ্ধটিকে আমারও দেখবার খুব কৌতূহল হচ্ছে।
ডাক্তার রুদ্র বললেন, তোমার আর গিয়ে কাজ নেই।
দেওয়ালে ঝুলছিল ওদের একটা ছবি। ডাঃ রুদ্র যেন আজই প্রথম ওটা দেখলেন।
—ওটা কি তোমাদের বিয়ের ছবি?
সঞ্জয় হাসল।—হ্যাঁ। এর আগে দেখেননি?
—হয়তো দেখেছি। খেয়াল হয়নি।
তিনি ছবিটার দিকে এগিয়ে গেলেন।
—তোমাদের একটা ছবি রাখতে ইচ্ছে করে।
সঞ্জয় রীণার দিকে তাকিয়ে বলল, বেশ তো নেবেন। আমাদের সম্প্রতি তোলা একটা—
ডাক্তার রুদ্র বাধা দিয়ে বললেন, না না, সম্প্রতি নয়। পুরোনো, যত পুরোনো হয়। বিশেষ করে রীণারটা।
রীণা অবাক হল।
—পুরোনো কেন?
ডাঃ রুদ্র হেসে বললেন, বুঝতে পারছ না কম বয়েসের ছবির আকর্ষণই আলাদা।
সঞ্জয় হো হো করে হেসে উঠল।
—আর এখন বুঝি বুড়ি হয়ে গেছি? রীণা মুখ লাল করে প্রতিবাদ করল।
ডাঃ রুদ্র তাড়াতাড়ি নিজের কথা শুধরে নিয়ে বললেন, না না, সেকথা বলিনি। আমি বলেছি আকর্ষণ—attraction-এর কথা। আমার আজকের ছবির চেয়ে দশ বছর বয়েসের ছবি কি বেশি attractive নয়?
রীণা যেন কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বলল, কিন্তু সেরকম ছবি কি এখানে আছে? আপনি বরং আমাদের বিয়ের ছবিরই এক কপি নিয়ে যান। বলে উঠে ভেতরে চলে গেল।