২.১৫ পুণ্যের জয় হইল

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – পুণ্যের জয় হইল 

বলা নিষ্প্রয়োজন, সেদিন জয়বত্তের প্রস্থানের পর হরকিষণ দাসের বাড়ী নিতান্ত আনন্দহীন হইয়া পড়িয়াছিল। সেই পৰ্য্যন্ত হিঙ্গন ম্রিয়মাণ—বড় একটা পিতার সম্মুখে আসে নাই। হরকিষণ দাসও একদিকে নীরবে বসিয়া আছেন, কাহারও সঙ্গে কথা কহেন না। 

জয়বন্ত চলিয়া গেলে তাঁহার ক্রোধ ক্রমে উপশমিত হইল, তখন তিনি মনে মনে লজ্জিত হইলেন। সহসা এরূপ রাগ করা যে উচিত হয় নাই, তাহা হরকিষণ বুঝিলেন, বিশেষতঃ জয়বন্ত যেরূপ ভাবে প্রকাশ করিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহাকে দোষী বা অপরাধী বলিয়া বোধ হয় না। সে সময়ে ক্রোধভরে তিনি এ সকল কিছুই ভাবিয়া দেখিতে অবসর পান নাই—কথার উপরে কথা কহিয়া তাঁহাকে একটা কথাও বলিতে দেন নাই। 

তিনি ভাবিলেন, “নোট যদি কোনগতিকে চুরি না যাইত, তাহা হইলে জয়বন্ত কখনই এরূপভাবে কেবল মজা করিবার জন্য কোটের নীচে খবরের কাগজ সেলাই করিয়া আনিত না। নিশ্চয়ই নোট চুরি গিয়াছে, আর সে যদি নিজে চুরি করিত, তাহা হইলে মোটেই আর ফিরিয়া আসিত না। আমি নোটের বিষয় কিছুই জানিতাম না, তাঁহার কিছুই করিতে পারিতাম না।” 

রাত্রি হইয়াছে, হরকিষণ দাস গৃহমধ্যে বসিয়া চিন্তা করিতেছিলেন, এই সময়ে এক ব্যক্তি আসিয়া তাঁহার হাতে একখানা পত্র দিল। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, হরকিক্ষণ দাস নামস্বাক্ষর ব্যতীত লিখিতে পড়িতে জানিতেন না। তাঁহার লেখাপড়ার কার্য্য পূর্ব্বে গোপালদাস করিত, তাহার পর জয়বন্ত করিতেন, তিনি বোম্বে গেলে তাঁহার কন্যাই সে কাজ করিতেছিলেন, কন্যা হিঙ্গন বেশ লেখাপড়া জানিত 

পত্র পাইয়া হরকিষণ দাস কন্যাকে ডাকিলেন, “হিঙ্গন!” 

কন্যা বলিল, “বাবা!”

“এদিকে এস।” 

কন্যা আসিলে তাহাকে পত্রখানা দিয়া হরকিষণ দাস বলিলেন, “কে লিখিয়াছে, দেখ।”

হিঙ্গন পত্রখানি খুলিয়া পড়িল;– 

“শ্রদ্ধাস্পদ মহাশয়, 

আনন্দের সহিত আপনাকে জানাইতেছি যে, অদ্য আপনার নামে আমাদের গদীতে নিরনব্বই হাজার টাকার নোট জমা হইয়াছে। জয়বন্ত লালজীভাই আপনার নামে এই টাকা জমা দিয়াছেন। আপনি ইচ্ছামত যখন হয়, এ টাকা গদী হইতে লইয়া যাইবেন, অথবা আজ্ঞা করেন ত আমাদের গদীতেই জমা রাখিতে পারি, আপনি নিয়মিত সুদ মাসে মাসে পাইবেন। 

বশংবদ
লালুভাই চবিলদাস।” 

পত্র শুনিয়া হরকিষণ দাস লম্ফ দিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন। হিঙ্গনের দুই চক্ষু আনন্দাশ্রুতে পূৰ্ণ হইয়া গেল। হিঙ্গন গদগদকণ্ঠে বলিল, “বাবা, আমি বলিয়াছিলাম ত।” 

হরকিষণ দাস সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া বলিলেন, “আমার পাগড়ী দাও, আমি এখনই পোর-বন্দরে যাইব।” 

“কেন বাবা, রাত্রে কি টাকা—” 

(বাধা দিয়া) “টাকার জন্য নয়। আমি জয়বন্তকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া তাঁহার কাছে হাজারবার ক্ষমা চাহিব। তাহার ঠিকানা কি?” 

“তাহা আমি জানি না, বাবা।”

“জানি না!” 

“তিনি যখন টাকা পাইয়াছেন, তখন নিজেই আসিবেন।” 

“না—না–না—তাহাকে আমি চোর বলিয়াছি, সে সেরকম লোক নয় যে, না ডাকিলে আসিবে।”

“বাবা!” 

“আমি সেখানে যাই, তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া এখানে আনিব।” 

এই সময়ে আর একখানি পত্র আসিয়া উপস্থিত হইল। হরকিষণ দাস বলিলেন, “এ আবার কে? কি মুস্কিল! পড়।” 

হিঙ্গন পড়িল; — 

“শ্রদ্ধাস্পদ মহাশয়, 

আপনার যে নোট চুরি গিয়াছিল, তাহারই একখানি নোট একজন চোর এখানকার এক বেনিয়ার নিকটে ভাঙাইতে যায়, আপনার হইয়া জয়বস্তু লালজীভাই অনুরোধ করায় আপাততঃ আমরা সে নোট আটক করিয়াছি। এক্ষণে আপনি এখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেই সে নোট পাইবেন। 

 বশংবদ
শ্যামজী দাস 

পত্র পাঠ করিয়া হিঙ্গন মৃদুস্বরে বলিল, “বাবা, আপনার লাখ টাকাই আপনি পাইবেন।” 

হরকিষণ দাস নিজের মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে কহিলেন, “হিঙ্গন, আর আমাকে লজ্জা দিস না, মা।”

পর দিবস অতি প্রাতে হরকিষণ দাস পোর-বন্দরের দিকে রওনা হইলেন। 

***

আমরা যাহাদের জীবনের একাংশ বর্ণন করিলাম, তাহাদের বিষয় আর কি কিছু বলিতে হইবে?

এই সকল ঘটনার তিন বৎসর পরে কেহ যদি হরকিষণ দাসের বাড়ী যাইতেন, তাহা হইলে দেখিতে পাইতেন, হরকিষণ দাস একটি সুন্দর শিশুকে স্কন্ধে করিয়া তাহার সহিত খেলা করিয়া অপার আনন্দ উপভোগ করিতেছেন। 

ছেলেটি কাহার, তাহাও কি বলিতে হইবে? এমন কি স্বয়ং হিঙ্গন ডাকিলেও তাহার ক্ষুদ্র পুত্র বৃদ্ধ মাতামহের স্কন্ধ হইতে কিছুতেই নামে না। 

হরকিষণ দাস এই পুষ্পকলিকাবৎ শিশুটিকে পাইয়া বিষয় কাৰ্য্য সমস্ত ত্যাগ করিয়াছেন। জামাতা জয়বন্ত এখন সৰ্ব্বেসৰ্ব্বা। 

হরকিষণ দাসের সংসার এখন আনন্দপূর্ণ। আগে কেবল বিষয় কর্ম্মের গোলযোগে চব্বিশঘন্টা কাটিত, এখন তাহার ঠিক মাঝখানে শান্তিদেবী আসন পাতিয়াছেন।