২.১৩ রক্তারক্তির রাত

১৩. রক্তারক্তির রাত

যে-ভয়াবহ অভিজ্ঞতা একটা অতিকায় দুঃস্বপ্নের মতো তাদের আচ্ছন্ন ক’রে রেখেছিলো, তার দরুণ নিজেদের অসীম দুঃখবেদনা ছাড়া আর কিছুই তাদের মনে স্থান পায়নি। জেন আর লুইস রবার্ট ব্লেজন কেমন যেন ঘোরের মধ্যে পরস্পরকে আঁকড়ে ধ’রে দাঁড়িয়েছিলো; কতক্ষণ—তা তারা জানে না। শেষকালে এই বিহ্বল আচ্ছন্নতা ধীরে-ধীরে কেটে গেলো তাদের, গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তারা ক্রমে বহিঃপৃথিবীর বোধ যেন ফিরে পেলো।

তাদের চারপাশে গুমগুম ক’রে যে-বিশৃঙ্খলা আওয়াজ গড়িয়ে যাচ্ছিলো, তারই মাঝে-মাঝে হঠাৎ-হঠাৎ এসে হাজির হচ্ছিলো অস্থির-এক স্তব্ধতা। বিজলি-বাতির আলো এখনও জ্বলছে করিডরে, কিন্তু এই ঢাকাবারান্দায় এখন যেন গোরস্থানের শান্তি। কেমন যেন মনে হচ্ছে পুরো রাজভবনটাই যেন ম’রে গিয়েছে। বাইরে, অথচ, তুলকালাম শোরগোল, গুলিগোলার আওয়াজ, আর এমন-এক উদ্দাম কলরোল যার প্রচণ্ডতা যেন মিনিটে-মিনিটে বেড়ে যাচ্ছে।

এইসব দুর্বোধ্য আওয়াজ তারা একটুক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে শুনলো, আর তারপরেই জেন হঠাৎ এর আসল মানেটা বুঝতে পারলে। ছোড়দার দিকে ফিরে সে বললে : ‘হাঁটতে পারবি তুই?’

‘চেষ্টা করতে পারি।

‘তাহ’লে আয়।’

দৃশ্যটা দেখে যে-কারু কষ্ট হ’তো। এক তরুণী, এখনও-আচ্ছন্ন, কাহিল, ধ’রে- ধ’রে নিয়ে যাচ্ছে এক যুবককে, চার-পাঁচ মাসের লাঞ্ছনা ও নিপীড়নে যার তখন যেন হাঁটবারও শক্তি নেই কোনো। তারা হাজতঘর থেকে বেরিয়ে গেলো, ধীরে- ধীরে পেরিয়ে এলো করিডর, যার শেষমাথায় পাহারা আর নেই।

ধীরে-ধীরে তারা ধাপের পর ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে ওপরে উঠলো, তেতলা অব্দি। উইলিয়াম ফেরুনের কাছ থেকে যে-চাবিটা হাতিয়ে নিয়েছিলো, তাই দিয়েই জেন সবচেয়ে ওপরের ল্যান্ডিঙের দরজাটা খুললো। তারপর, লুইস যখন কাঁপা-কাঁপা পায়ে তাকে অনুসরণ করলে, সে এসে ঢুকলো সেই ঘরে, কিছুক্ষণ-আগে—কতক্ষণ- আগে?—যে-ঘরে নেশায় আচ্ছন্ন হ’য়ে ছিলো এই পৈশাচিক উন্মাদ, যাকে সে তার সৎ-ভাই ব’লে চিনতেও পারেনি।

নিচের করিডরের মতোই, এ-ঘরটাও ফাঁকা, পরিত্যক্ত-তবে লোকজন ছাড়া এ-ঘরটায় আর-কিছুই বদল হয়নি। এখন টেবিলটার ওপাশে আছে ফেরনের বিশাল আরামকেদারা, টেবিলে এখনও থরে থরে সাজানো আছে বোতল আর গেলাশ, আর চাঁদের কলার মতো তাকে ঘিরে ছিলো যে-নটা চেয়ার, সেগুলো তেমনি আছে এখনও, শূন্য।

লুইস রবার্টের পা যেন আর বইতে পারছিলো না, তাকে ধ’রে ধ’রে নিয়ে এসে একটা চেয়ারে বসালে জেন : আর এই-প্রথম যেন আচম্বিতে বুঝতে পারলে তাদের অদ্ভুত দশাটা। কেউ নেই কেন কোথাও? কেন এই গা-শিরশির-করা স্তব্ধতা? তাদের জল্লাদের কী হলো?

হঠাৎ কোন্-এক আবেগের তাড়ায় তার দাদাকে চেয়ারে বসিয়ে রেখেই জেন দুঃসাহসে ভর ক’রে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো, তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখলো চারপাশ। আর খুঁজে দেখতে শুরু করলো সব।

প্রথমে গেলো নিচের তলায়, একতলায়, কোনো কোণাখামচিও খুঁজতে বাকি রাখলো না। বাইরে দরজাটা বন্ধ; তার পাশ দিয়ে যেতে-যেতে সে তাকিয়ে দেখলো চারপাশে, যদি কাউকে কোথাও দেখা যায়। কেউ নেই কোথাও; সবগুলি দরজা হাট ক’রে খোলা, যেন হুড়মুড় ক’রে ঘর থেকে বেরুবার সময় দরজাগুলো বন্ধ ক’রে দেবারও তার সয়নি কারু। ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে তার বিস্ময়; সে অন্য তলাগুলোও খুঁজে দেখলে; কিন্তু কোথাও কেউ নেই, সব শূন্য, পরিত্যক্ত, হা- হা করছে। যতই অবিশ্বাস্য ঠেকুক না কেন, সব দেখে মনে হচ্ছে রাজভবনে এখন যেন তারা ছাড়া আর-কেউই নেই।

সবগুলো তলা খুঁজে দেখবার পর বাকি র’য়ে গেলো শুধু সেই বিশাল মিনার, আর তার চারপাশের অলিন্দ। সিঁড়ির ধাপের কাছে এসে হঠাৎ জেন পইঠায় পা দেবার আগে থমকে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবলে খানিক, তারপর আস্তে-আস্তে ওপরে উঠলো।

না, যা ভেবেছিলো তা নয়, রাজভবন পুরোপুরি পরিত্যক্ত নয়। সিঁড়ির ওপরের পইঠায় পৌঁছুবামাত্র, বাইরে থেকেতার কানে এলো কাদের যেন গলা। খুব-সন্তর্পণে সে সবচেয়ে-ওপরের ধাপটায় পৌঁছে, অন্ধকারে গা মিশিয়ে দিয়ে, অলিন্দের দিকে তাকালে-দূরের কারখানা থেকে আলো এসে পড়েছে অলিন্দে।

রাজভবনের সকল অধিবাসীই এসে জমায়েত হয়েছে এই অলিন্দে। শিউরে উঠে, জেন তারই মধ্যে চিনতে পারলে আটজন কৌশুলি পরিবৃত হ’য়ে দাঁড়িয়ে আছে উইলিয়াম ফেরনে। আরো একটু ওদিকে দুটো দলে ভাগ হ’য়ে জটলা পাকাচ্ছে একদল ব্ল্যাকগার্ড আর কিছু আফ্রিকি ভৃত্য।

রেলিঙের ওপর দিয়ে ঝুঁকে, তারা দূরে কী যেন দেখাচ্ছে পরস্পরকে, আর কথার বদলে যেন গলা ফাটিয়ে শুধু চ্যাঁচাচ্ছেই তারা, আর তারই সঙ্গে চলেছে নানারকম অঙ্গভঙ্গি। কী হ’তে পারে বাইরে, যা তাদের এমন ক’রে ক্রুদ্ধ ও অসন্তুষ্ট ক’রে তুলেছে?

হঠাৎ ফেরনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে কী-একটা হুকুম করলে; তারপর তার আটজন স্যাঙাৎকে নিয়ে এগিয়ে এলো সিঁড়ির দিকে, যার ওপরের ধাপটায় অন্ধকারে গা মিশিয়ে দিয়ে জেন দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকেই সে দেখতে পেলে প্রত্যেকেরই কোমরবন্ধে দুটো ক’রে রিভলবার গোঁজা, হাতে উদ্যত রাইফেল। আরেকটা সেকেন্ড, আর তাহ’লেই এরা তাকে দেখে ফেলবে। এই হিংস্র পশুগুলোর হাতে পড়লে কী হবে তার? জেন প্রমাদ গুনলো।

আশপাশে তাকিয়ে অচেতনভাবেই বোধহয় সে খুঁজলো কোনো অসম্ভব উপায় -পালিয়ে যাবার; আর আচমকা তার চোখ গিয়ে পড়লো সিঁড়ির ওপরের ধাপের কাছেই একটা দরজায়, সেটা আটকে দিলে অলিন্দের পথ বন্ধ ক’রে দেয়া যায়। দেখেই দরজা খুলে সেটা বন্ধ করতে গেলো সে-সশব্দে, কেননা দুম ক’রে একটা আওয়াজ হ’লো কবাটের-জেনের যেন একনিমেষও লাগলো না; জেন নিজেই জানে না সে নিজেই ও-কাজ করেছিলো কি না। যেন কোনো স্বজ্ঞাপ্ররোচিত তীব্র তাড়নাতেই সে মুহূর্তে কাজটা ক’রে ফেলেছে।

বাইরে থেকে খ্যাপাপশুর গর্জন এলো, ভীষণ-সব অভিসম্পাত। শেষ-খিলটা লাগাবার সঙ্গে-সঙ্গেই বাইরে থেকে রাইফেলের কুঁদোর প্রচণ্ড আঘাত পড়ছে দরজার কবাটে, এমন অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের পথ আটকে যাওয়ায় তারা যেন হিতাহিত জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেছে।

এইসব বন্য অভিসম্পাদ আর রাইফেলের কুঁদোর অবিরাম আঘাতের তুলকালাম শোরগোলের মধ্যে জেন, আতঙ্কিত, সন্ত্রস্ত, সেখানে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগলো– তার চলৎশক্তি যেন মন্ত্রবলে অন্তর্হিত হয়েছে। নড়তে না-পেরে, অনিমেষে তাকিয়ে রইলো দরজারটার দিকেই, আচ্ছনের মতো, প্রতি-মুহূর্তেই মনে হচ্ছে এই বুঝি ঐ ভয়াল শত্রুদের রাইফেলের ঘায়ে দরজাটা ভেঙে পড়লো।

কিন্তু দরজা ভাঙলো না আদৌ; এত-ক্ষিপ্ত আঘাত পড়ছে, অথচ তবু কবাটের গায়ে যেন সামান্যতমও প্রভাব পড়ছে না, একটা আঁচড় পর্যন্ত না। আর তা-ই দেখতে-দেখতে জেনের ঘোর কেটে গেলো, নিজের ওপর ফিরে এলো নিয়ন্ত্রণ, সে বুঝতে পারলে কারখানা ও রাজভবনের অন্যান্য দরজার মতোই এটাও বর্মপরানো-সমস্ত আক্রমণ ঠেকাবার কথা ভেবেই তৈরি। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে ফেরনে শুধু-মাত্র এই ক-জন সাগরেদের সাহায্যে কোনোকালে এ-দরজাটা ভাঙতে পারবে!

আশ্বস্ত হ’য়ে সে ফিরে গেলো তার দাদার কাছে, আর যেতে-যেতে লক্ষ করলো, অলিন্দ থেকে একতলা পর্যন্ত রাজভবনে এ-রকম পাঁচ-পাঁচটা বর্মপরানো দরজা আছে –একটা ভাঙলেও অন্যটায় এসে তাদের আটকে পড়তে হবে। ফেরনে কোনো আচম্বিত আক্রমণের মোকাবিলা করবার জন্যে রাজভবনকে একটা লোহার তৈরি দুর্গের মতোই সুরক্ষিত ক’রে রেখেছে। এইসব দরজা দিয়ে গোটা রাজভবনটাই কতগুলো ভিন্ন-ভিন্ন মহলে তৈরি-রাজভবন দখল ক’রে নিতে গেলে কাউকে একের পর এক এই দরজাগুলো ভেঙে ভেতরে ঢুকতে হবে। এখন—নিয়তির নির্মম পরিহাসে তার এতসব হুঁশিয়ারি যেন তারই ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্যে তার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে!

জেন পর-পর পাঁচটা দরজাতেই খিল তুলে দিয়ে একতলায় এসে দাঁড়ালে। রাজভবনের জানলাগুলো বিশাল-সব গরাদ-দেয়া জানলা দিয়ে সুরক্ষিত–আর ধাতুর পর্দার খড়খড়ি নামিয়ে দিলে সেগুলো প্রায় নিরেট দেয়ালই হ’য়ে যায়। একমুহূর্তও অপেক্ষা না-ক’রে সে এক-এক ক’রে সবগুলো জানলার ওপর ঐ ইস্পাতের পর্দা নামিয়ে দিলে।

এ-সব বিশাল পর্দাগুলো নামাবার মতো এত-শক্তি হঠাৎ সে পেলে কোত্থেকে? জ্বরের ঘোরে আছে যেন, কী করছে না-করছে তাতে তার চেতন মনের যেন কোনো ভূমিকাই নেই; আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি ও স্বজ্ঞা তাড়িত, সে যেন স্বপ্নচালিতের মতোই আচ্ছন্ন হাতে সবকিছু ক’রে যাচ্ছে, কিন্তু সুকৌশল ও দক্ষহাতে, এবং ক্ষিপ্রবেগে। এখন সে অভেদ্য-এক দুর্গের মাঝখানে–ইস্পাতেরই এক কেল্লার মাঝখানে।

আর ঠিক-তখনই অবসাদে তার সারা শরীর যেন এলিয়ে পড়তে চাইলো। এতক্ষণে সে টের পেলে দেহে ও মনে কতটা বিপর্যস্ত, কতটা অবসন্ন সে। তার পা দুটো যেন আর কিছুতেই তার ভার সইতে পারছে না। ক্লান্ত, হাতদুটো রক্তাপ্লুত, তার যেন তার দাদার কাছে ফিরে যাবারও শক্তিটুকু আর নেই!

‘কী হ’লো আবার তোর?’ তাকে এমন অবস্থায় দেখে লুইস রবার্ট খুবই উৎকণ্ঠিত হ’য়ে জিগেস করলে।

একটু পরে দম ফিরে পেয়ে জেন সব খুলে বললে-সে কী করছিলো এতক্ষণ। প্রায় বিজয়িনীর ভঙ্গিতে সে বললে : ‘এখন আমরাই এই রাজভবনের প্রভু।’

‘ঐ সিঁড়ি ছাড়া আর কি কোনো রাস্তা নেই ওদের?’ এ-রকম একটা দুর্জয় অবস্থায় যে পড়তে পারে, লুইস রবার্টের তা যেন বিশ্বাসই হ’তে চাচ্ছিলো না। উঁহু, আর-কোনো রাস্তাই নেই,’ জেন ঘোষণা করলে। ‘এটা আমি নিশ্চিত জানি, উইলিয়াম এখন অলিন্দে প’ড়ে গেছে, নিজের খাঁচায় নিজেই বন্দী। দেখি, ও কেমন ক’রে এখান থেকে পালায়!’

‘কিন্তু ওরা সবাই তড়িঘড়ি অলিন্দে উঠে গিয়েছিলো কেন?’ লুইস জানতে চাইলো। ‘কী এমন হ’তে পারে যে ওদের কাণ্ডজ্ঞান এমন ক’রে হারিয়ে গেলো?’

কিন্তু এটা এমন-এক প্রশ্ন, যার উত্তর জেন নিজেও জানে না। কারখানাকে রক্ষা করবার জন্যে কী-কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, সে তা চাক্ষুষ দ্যাখেনি। সেটা হয়তো বাইরে তাকিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে। তারা দুজনে মিলে ওপরতলায় উঠে এলো, তাদের মাথার ওপর এখন শুধু মিনার আর তার অলিন্দ। তারপরে এইমাত্র-বন্ধ-করা খড়খড়ি খুলে তারা দুজনে বাইরে তাকালে।

আর তাকিয়েই বুঝতে পারলে, উইলিয়াম ফেরনে আর তার সাঙ্গোপাঙ্গারা কেন এমন ক’রে মাথায় হাত দিয়ে বসেছে। যদিও তাদের পায়ের নিচে এপ্ল্যানেড প’ড়ে আছে অন্ধকার আর নিশ্চুপ, রাঙানদীর ডানতীরে কিন্তু উজ্জ্বল আলোর মধ্যে তুলকালাম কাণ্ড চলেছে। আফ্রিকিদের বৃষ্টিতে সবগুলো কুঁড়েঘর দাউ-দাউ ক’রে জ্বলছে। শহরের ঠিক মাঝখানটা, নিগ্রোদের বস্তি—সব যেন এক বিকট নরককুণ্ড! আগুন জ্বলছে বেসরকারি নাগরিকদের বাড়িঘরেও, আর ভাঁটির দিকে মেরিফিলো অর্থাৎ হর্ষচরিতদের আস্তানাতেও আগুন ধরতে শুরু করেছে।

হর্ষচরিতদের আবাসের যে-দিকটায় এখনও আগুন ধরেনি সেখান থেকে তুমুল- একটা কোলাহল উঠছে : চীৎকার, গালাগাল, অভিশাপ, ক্ষমা চেয়ে অনুনয়, তুলকালাম হট্টগোল—আর তারই মাঝখানে অবিশ্রাম গ’র্জে উঠছে আগ্নেয়াস্ত্র।

‘এ নিশ্চয়ই তোঙ্গানের কাণ্ড,’ বললে জেন। ‘আফ্রিকিরা সবাই বিদ্রোহ করেছে! ‘আফ্রিকিরা… তোঙ্গানে….?’ লুইস শুধু বোকার মতো কথাগুলো আওড়ালে, কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।

জেন তারপর তাকে বুঝিয়ে বললে পুরো ব্ল্যাকল্যান্ডের বৃত্তান্তটাই –অন্তত সে নিজে তার যতদূর জানে। সংক্ষেপে সে বিবৃত করলে কেমন ক’রে সে নিজে এই শহরে এসে পৌঁছেছিলো, আর তার আগে কোন-কোন ঘটনা ক্রমশ তাদের সফর অতিষ্ঠ ক’রে তুলেছিলো। সে আরো খুলে বললে কেন সে একাই সকলের অগোচরে কারখানা থেকে বেরিয়ে এসেছে—কেমন ক’রেই বা সে প্রমাণ করেছে তাদের দাদা জর্জের নির্দোষিতা –আর কবে সে এটা প্রমাণ করবার জন্যেই বারজাক মিশনের সঙ্গে আফ্রিকায় সফরে বেরিয়েছিলো।

সে আঙুল তুলে দেখালে কারখানাটাকে-এপ্ল্যানেডের ওপাশে, সন্ধানী আলোয় ঝলমল ক’রে উঠেছে। বললে তার সফরসঙ্গীদের কথা, আফ্রিকি অনুচর তোঙ্গানে ছাড়া যারা সবাই এখনও কারখানার ভেতরেই আশ্রয় নিয়ে আছে। আর তোঙ্গানে—সে-ই ব্ল্যাকল্যান্ডের সমস্ত বিক্ষুদ্ধ আফ্রিকিকে চেতিয়ে তোলবার চেষ্টা করছে, আর বিদ্রোহ যে এরই মধ্যে অনেকটাই সফল হয়েছে, তা তো এখন নিজের চোখেই তারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। হায়-রে, তার সবুর করা ধৈর্য ছিলো না, যে- সন্ধেয় এই বিদ্রোহের আগুন জ্বললো –আক্ষকিরভাবেই আগুন – সেই সন্ধেতেই সে কিনা কারখানার সবাইকে উদ্ধার করবার দুরাশা নিয়ে একা এসেছিলো রাজভবনে—সকলের চোখে ধুলো দিয়ে। কিন্তু এসেছিলো ব’লেই তো সে আবিষ্কার করতে পেরেছে তার বেচারি ছোড়দাকে। আর সেই-ফাঁকে নিশ্চয়ই সংকেত দিয়েছে তোঙ্গানে, অস্ত্র পাঠানো হয়েছে তাদের কাছে আগেকার ব্যবস্থামতো, আর, দুর্বার, ফেটে পড়েছে বিদ্রোহ। উইলিয়াম ফেরনে আর তার স্যাঙাত্রা সবে যখন উলটে পালটা-আক্রমণ চালাবার ব্যবস্থা করেছে, ঠিক তখনই সে গিয়ে তাদের মুখের ওপর সশব্দে বন্ধ ক’রে দিয়েছে দরজা।

‘আর আমরা? আমরা তবে এখন কী করবো?’ জিগেস করলে লুইস।

‘সবুর, অত অধীর হোসনে,’ জেন উত্তর দিলে। আফ্রিকিরা কেউ আমাদের জানে না—আর এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে আমাদের তারা আলাদা ক’রে চিনতেও পারবে না। তাছাড়া, আমরা দুজনে আর কী সাহায্যই বা দেবো ওদের? আমাদের কাছে তো কোনো অস্ত্রই নেই!

লুইসকে একটু ঠাণ্ডা ক’রে জেন আরেকবার পুরো রাজভবনটা চক্কর দিয়ে দেখতে বেরিয়ে পড়লো। উইলিয়াম ফেরনেদের আটকে দিয়ে সে একদিক থেকে বিদ্রোহীদের সাহায্য করেছে বটে, কিন্তু তাতে কি কোনো ফল হবে? উইলিয়াম ফেরনেদের সঙ্গে বেশ-কিছু অস্ত্রশস্ত্র আছে, বাকি সবই মজুদ করা আছে অলিন্দে, মিনারের কাছে। অনেক খুঁজে সে শুধু পেলে একটামাত্র রাইফেল, দুটো রিভলবার, আর দু-মুঠো কার্তুজ।

যখন সে তার অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় ক’রে ফিরে এলো, পরিস্থিতি তখন অনেকটাই পালটে গিয়েছে। আফ্রিকিরা দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে পড়েছে, আক্রমণ করেছে এপ্ল্যানেড-এখন তারা এপ্লানেডে, হয়তো হাজারে-হাজারে। মুহূর্তের মধ্যে খ্যাপা ঝড়ের মতো গিয়ে তারা পড়েছে ব্ল্যাকগার্ডদের ব্যারাকে, আর নির্বিচারে হত্যা করেছে তাদের এতদিন যারা তাদের ওপর হিংস্র পশুর মতো অত্যাচার চালিয়েছিলো। ধ্বংস করেছে চল্লিশটা হেলিবিমানের জন্যে যে-মস্ত হ্যাঙারটা তৈরি করা হয়েছিলো—আর তা থেকে দাউ-দাউ আগুন আকাশে মেলে দিয়েছে লেলিহান শিখা। এতদিনকার অত্যাচার, অপমান, লাঞ্ছনার শোধ নিচ্ছে তারা সব ধ্বংস ক’রে দিয়ে, হন্যে, খ্যাপা, উত্তেজিত –আর লক্ষণ দেখে বোঝা যাচ্ছে আস্ত ব্ল্যাকল্যন্ডটাকে গুঁড়িয়ে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে না-দিয়ে তারা কিছুতেই থাকবে না- ব্ল্যাকল্যান্ডের সকল অত্যাচারীকেই শেকড়শুদ্ধু উপড়ে ফেলে, সম্পূর্ণ নির্মূল ক’রে দিয়েই, শুধু থামবে।

আর এই দৃশ্য দেখে উইলিয়াম ফেরনের খ্যাপা মুখের কষ বেয়ে এখন বুঝি ফেনা গড়াচ্ছে। শোনা যাচ্ছে তার রোষ আর চীৎকার, বন্যজন্তুর গর্জনের মতো— কিন্তু কী-সে বলছে, তার একটা কথাও যদি বোঝা যায়! অলিন্দ থেকে অবিশ্রাম গুলিবর্ষণ চলেছে নিচের এপ্ল্যানেড লক্ষ ক’রে-আর সেই হাজার-হাজার আফ্রিকিদের ভিড়ের মধ্যে কিছু-কিছু বলিও খুঁজে পেয়েছে।

কিন্তু তাতে কি আর অন্যরা এখন থামে? ব্ল্যাকগার্ডের ডেরাগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে, হেলিবিমানের হ্যাঙারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সেই অগ্নিকাণ্ডের অতিকায় মশালের আলোয় তারা এখন এসে আক্রমণ করেছে রাজভবনকেই-হাতের কাছে যা পাচ্ছে তা-ই দিয়েই ঘা মারছে দরজায় এখনও অবশ্য দরজা ভাঙতে পারেনি তারা।

যখন তারা দরজার ওপর প্রবল বন্যার মতোই আছড়ে পড়েছে, তখন রাঙানদীর তীর থেকে গুলির শব্দ ভেসে এলো। শেষটায় কোনোরকমে শৃঙ্খলা আনতে পেরেছে মেরিফেলোরা, পেরিয়ে এসেছে সেতু; আর এপ্ল্যানেডের ওপার থেকে এলোমেলো গুলি চালাচ্ছে ভিড়কে লক্ষ ক’রে—আর সেই এলোপাথাড়ি গুলিতে কত শত লোক যে আছড়ে পড়ছে মাটিতে!

আফ্রিকিরা ক্রুদ্ধ গর্জন ক’রে নিজেদের আছড়ে ফেললো এই নবাগত শত্রুদের ওপর। কয়েক মিনিট এক দুর্ধর্ষ লড়াই চললো, কোনো নিয়মকানুন না-মানা, অন্ধ, ক্ষিপ্ত, অকথ্য হানাহানি। তাদের হাতে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নেই ব’লে আফ্রিকিরা ঝাঁপিয়ে পড়লো শত্রুর ওপর, হাতাহাতি লড়াই, বল্লমের ফোঁড়, কুঠারের কোপ, ছুরি, কৃপাণ, খঞ্জর-আর-কিছুই যখন নেই, তখন দাঁত! হর্ষচরিতদের উত্তর এলো সঙিনের ফলায়, বুকের ওপর ঠেকানো রিভলভারের গুলিতে।

এই লড়াইয়ের ফলাফল আর-বেশিক্ষণ সন্দেহের মাঝখানে থাকবে না। সংখ্যার ওপর জয়ী হবে অস্ত্রের বাহাদুর। একটু পরেই একটা ইতস্ততভাব জেগে উঠলো আফ্রিকিদের মধ্যে। তারা পেছিয়ে এলো একটু, ছুটলো নদীর পাড় ধরে, আর এপ্ল্যানেড ফের দখলে চ’লে এলো হর্ষচরিতদের। আর তারাও ছুটলো আফ্রিকিদের পেছন-পেছন, তাদের নিজেদের আস্তানা রক্ষা করতে তাদের আবাসে তখনও গিয়ে আগুন পৌঁছোয়নি।

ঠিক যখন তারা সেতুটা পেরুচ্ছে, একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ফেটে পড়লো। রাজভবনের জানলা থেকে, জেন আর লুইস দেখতে পেলে বিস্ফোরণটা ঘটেছে বেশ-কিছুটা দূরে, বেসরকারি নাগরিকদের আবাসের দূর-কোণায়। চারপাশে আগুন যে অতিকায় মশালের মতো জ্ব’লে উঠেছে, তারই আলোয় তারা দেখতে পেলে বাইরের দেয়ালের একটা লম্বা অংশ এই বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছে।

বিস্ফোরণের উৎস যা-ই হোক না কেন, এর যেটা স্পষ্ট সুফল হলো, তা এই: খোলা মাঠে গিয়ে পড়বার জন্যে আফ্রিকিদের সামনে একটা মস্ত রাস্তা খুলে গিয়েছে। আর উড়ে-যাওয়া সেই দেয়ালের ফাঁক দিয়েই আফ্রিকিরা শত্রুর হাত এড়িয়ে গিয়ে পড়লো চাষের জমিতে, আর তার আশপাশের গাছপালার মাঝখানে।

পনেরো মিনিটের মধ্যে পশ্চাদ্ধাবনকারীরা রাঙানদী পেরিয়ে ফের ফিরে এলো এপ্ল্যানেডে। এখন যে আঘাত হানবার জন্যে কোনো শত্রুই নেই তাদের সামনে, শুধু তা-ই নয়, তারা নিজেরা এখন আতঙ্কে চোখ ছানাবড়া ক’রে তাকিয়ে আছে পর-পর ঘ’টে-যেতে-থাকা বিস্ফোরণগুলির দিকে।

কী হ’তে পারে কারণ—এইসব বিস্ফোরণের? কেউ জানে না। এটা অবশ্য চট ক’রেই বোঝা গেছে যে বিস্ফোরণগুলো এলোপাথাড়ি ঘটছে না, বরং কেউ যেন অনেক ভেবেচিন্তে, ছক ক’যে, সেই অনুযায়ীই এই বিস্ফোরণগুলো ঘটাচ্ছে পর-পর। প্রথমটা ঘটেছে শহরের শেষমাথায়, সীমান্ত-দেয়ালে, বেসরকারি নাগরিকদের যে-আবাস রাজভবন থেকে সবচেয়ে-দূরে। পাঁচমিনিট পরেই তার ডানদিকে আর বামদিকে প্রায় একযোগে ঘটেছে দুটি বিস্ফোরণ। তারপর, আবার, পাঁচমিনিট পরে আরো-দুটো বিস্ফোরণে, নদীর আরো-কাছে, তবে এখনও বেসরকারি নাগরিকদেরই আবাসস্থলে। আর তারপরেই যে-হর্ষচরিতেরা ধাওয়া ক’রে গিয়েছিলো আফ্রিকিদের, তারা ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে ছুটে ফিরে এসেছে এপ্ল্যানেডেই আশ্রয় নিতে।

আর তারপর থেকে সেই দুর্বোধ্য বিস্ফোরণগুলো ফেটেই পড়ছে নিয়মিত, সাময়িক একটু বিরতির পর-পর। তারপর প্রতি আধঘণ্টা অন্তর শোনা গেছে আরো- একটা বিস্ফোরণ, আর বেসরকারি নাগরিকদের আবাসের আরো-একটা অংশ উড়ে গিয়েছে। এপ্ল্যানেডে প্রায়-জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে ব্ল্যাকল্যান্ডের স্তম্ভিত গোরারা প্রায় একটা জাগর দুঃস্বপ্নের মতোই দেখেছে তাদের সাধের ব্ল্যাকল্যান্ড প্রায় শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে, কোনো-প্রচণ্ড ও দুর্ধর্ষ শক্তি ছক কষে একটু- একটু ক’রে উড়িয়ে দিচ্ছে ব্ল্যাকল্যান্ডকে।

নিজেদের চাইতে অস্ত্রবলে যারা দুর্বল, তাদের খুন করবার সময় এই দস্যুদের প্রাণে কোনো মায়াদয়া ছিলো, বরং ছিলো না, দুর্জয় সাহস, দুর্মর আত্মবিশ্বাস : এখন তারা কোনো উচ্চতর শক্তির সামনে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। রাজভবনের দেয়ালের গায়ে এসে ঠেকেছে তারা পিছোতে-পিছোতে, মিথ্যেই চেষ্টা করছে রাজভবনের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকতে, তারা গর্জন ক’রে অভিসম্পাত দিচ্ছে উইলিয়াম ফেনেকে, অকথ্য-সব গালাগাল কেননা তাকে তারা দেখতে পাচ্ছে অলিন্দের ওপর, অথচ বুঝতে পারছে না তাদের এই সর্বেসর্বা প্রভু তাদের হঠাৎ এমনভাবে পরিত্যাগ করেছে কেন। আর উইলিয়াম ফেরনে অনবরত ওপর থেকে অঙ্গভঙ্গি ক’রে ইঙ্গিতে কী যেন বোঝাতে চাচ্ছে, অথচ যার মাথামুণ্ডু কিছুই তারা বুঝতে পারছে না, আর তার সমস্ত চীৎকারই চাপা প’ড়ে যাচ্ছে সব শব্দ-ছাপানো এক তুলকালাম কোলাহলে।

আর এইভাবেই শেষ হ’লো রাত, রক্তারক্তির রাত। দিন ফুটে উঠে উদ্ঘাটন ক’রে দিলে এক ভয়াবহ দৃশ্য। এপ্ল্যানেডে এলোমেলো গড়াগড়ি যাচ্ছে অগুনতি মৃতদেহ; অন্তত কয়েকশো, গোরায়-কালোয় মাখামাখি। গোরারা যদি ভেবে থাকে যে কালোদের তারা হঠিয়ে দিতে পেরেছে, তবে তার জন্যে ধনেপ্রাণে তাদের মূল্য দিতে হয়েছে সুপ্রচুর। কাল অব্দি মেরিফেলো আর বেসরকারি নাগরিকদের আবাসে ছিলো আটশোরও বেশি লোক, এখন তাদের অর্ধেকও বেঁচে আছে কি না সন্দেহ। অন্যরা মারা গেছে বিদ্রোহের প্রথম ধাক্কাতেই, আতঙ্কে আর বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া; আর এসপ্ল্যানেড থেকে যখন বিদ্রোহীদের হঠিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে, তখন মারা গেছে অজস্ৰ জন।

আফ্রিকিরা—ওপরতলা থেকে জেন আর লুইস দেখতে পেলে-ছড়িয়ে পড়েছে ব্ল্যাকল্যান্ডের বাইরের বিশাল-উন্মুক্ত বিস্তারে। অনেকে চ’লে যেতে শুরু করেছে। কেউ যাচ্ছে পশ্চিমে, সোজা নাইজারের দিকে—আর তাদের সামনে ছড়িয়ে আছে ধূ-ধূ বালি। এই মরুভূমি পেরিয়ে ক-জন তবে পৌঁছুতে পারবে নাইজারে যখন তাদের সঙ্গে কোনো জল নেই, খাদ্য নেই, অস্ত্র নেই? অন্যরা বেছে নিয়েছে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ঘুরপথ-তারা চলেছে রাঙানদীর তীর ধরে, আর ক্রমেই উধাও হ’য়ে যাচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিমে।

কিন্তু বেশির ভাগই এখনও মনস্থির ক’রে উঠতে পারেনি, ব্ল্যাকল্যান্ড থেকে চ’লে যাবে কি না। তারা ছোটো-ছোটো দলে ভাগ হ’য়ে ছড়িয়ে আছে খেতে- খামারে চাষের জমিতে-ফ্যালফ্যাল ক’রে হতভম্ব তাকিয়ে আছে শহরটার দিকে, দেখছে কুণ্ডলি পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে ব্ল্যাকল্যান্ডের ওপর, আর পরের পর বিস্ফোরণ শহরটাকে রূপান্তরিত ক’রে ফেলেছে বিশাল এক ধ্বংসস্তূপে।

আর ঠিক তখনই প্রচণ্ড-এক বিস্ফোরণ ফেটে পড়লো সরাসরি রাজভবনেরই অলিন্দে। তারপর আঘাতের পর আঘাত, বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণ, যার শেষটা হ’লো প্রচণ্ড।

জানলার একটু-তোলা খড়খড়ি দিয়ে এতক্ষণ স্তম্ভিতের মতো সব লক্ষ ক’রে যাচ্ছিলো জেন আর লুইস; কিন্তু নাটকের এই শেষতম দৃশ্য দেখে আঁৎকে উঠে লুইস চেপে ধরলে তার বোনের হাত।

‘ও হ’লো উইলিয়াম,’ এই নতুন বিস্ফোরণগুলোর মানে জেন বুঝতে পেরেছে, ‘উইলিয়াম এখন কামান দেগে অলিন্দের দরজা উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছে!’ খুবই শান্ত-গলায় কথাগুলো বললে জেন; সে শান্তভাবে নিরীক্ষণ ক’রে যাচ্ছে পরিস্থিতি, ঠাণ্ডা-মাথায় বোঝবার চেষ্টা করছে তার তাৎপর্য।

‘তার মানে,’ লুইস আতঙ্কিত, ‘তার মানে ওরা তবে এক্ষুনি নেমে আসবে?’ তার বোন যে-রিভলবার দুটো জোগাড় ক’রে এনেছিলো, তার একটা আঁকড়ে ধ’রে সে বললে, ‘বরং নিজের হাতে মরবো, তবু ওদের হাতে ধরা দেবার চাইতে তা অনেক ভালো।’

জেন হাত নেড়ে মানা করলে তাকে। ‘এখনও তো ওরা এখানে আসতে পারেনি। এ-রকম পাঁচ-পাঁচটা দরজা আছে-আর শেষ-তিনটে দরজা এমন যে কোনো কামান দেগেও সেগুলো উড়িয়ে দেয়া যাবে ব’লে মনে হয় না।’

যেন তার কথাগুলোর তলায় লাইন দেগে দিয়েই কামানগুলো থেমে গেলো। অলিন্দে উঠলো ভারি-একটা গড়গড় আওয়াজ, সেইসঙ্গে খ্যাপা চীৎকার : উইলিয়াম ফেরনে আর তার স্যাঙাত্রা কামানটা ঠেলে আনতে চাচ্ছে দ্বিতীয় দরজাটার দিকে, আর অলিন্দ থেকে ওভাবে চাকা গড়গড়িয়ে কামান নামানো খুব- একটা সহজ কাজ নয়।

তাছাড়া, শিগগিরই, সে-কাজটায় আপাতত ইতি টানতে হ’লো তাদের। নতুন- আরেকটা ঘটনা ঘটে গেছে, যেটা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, যেমন তা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে জেন আর লুইসের।

নিয়মিত বিস্ফোরণগুলো এখন তার পূর্ববর্তী বিস্ফোরণগুলোর চাইতেও আরো- অনেক-বেশি বিধ্বংসী রূপ নিয়েছে। যে-প্রচণ্ড ধ্বংসশক্তি বোতলের মধ্যকার জিনের মতো বেরিয়ে এসেছিলো, সেটা এখন বামতীর ধ’রে এগুচ্ছে, এরই মধ্যে আকাশে উড়ে গেছে কারখানার বাগানের পাশের দেয়াল, আকাশে উড়ে যাচ্ছে মাটি-পাথরের এক বৃষ্টি, নিচে না-নেমে মাধ্যাকর্ষণ এড়িয়ে তারা যেন উঠে যেতে চাচ্ছে ওপরের আকাশে। ধোঁয়া সরে যেতেই দেখা গেলো, আগে যেখানটায় বাগান ছিলো এখন সেখানে মস্ত-একটা গর্ত, এমনকী খোদ কারখানাটারও একটা ছোটো অংশ সেই- সাথে উড়ে গিয়েছে।

আকাশে তখনও বিস্ফোরণের পরেকার ধুলোবালি ঝুলে ছিলো, এমন সময় হাট-ক’রে-খোলা কারখানার দরজা দিয়ে দ্রুতপদে বেরিয়ে এলো একটা ভিড়, নদীর ঘাটের দিকে। তক্ষুনি তাদের চিনতে পারলে জেন। তারা তারই বন্দীজীবনের সঙ্গীরা, সঙ্গে আছে কামারের কর্মীরাও, আর তাদের মাঝখানে আছে নারী আর শিশুরা। এই হতভাগারা তাদের আশ্রয় ছেড়ে এপ্ল্যানেডের দিকে এগুচ্ছে কেন? সেখানে তো হর্ষচরিতরা আছে, তারা তো এখনও ক্ষিপ্তভাবে আছড়াচ্ছে রাজভবনের দরজায়! নতুন প্রতিপক্ষকে অবশ্য তখনও এই হর্ষচরিতরা দেখতে পায়নি, এপ্ল্যানেডের দেয়াল আড়াল করে রেখেছে তাদের। কিন্তু উইলিয়াম ফেনে তাদের দেখতে পেয়েছে অলিন্দ থেকে আর আঙুল তুলে দেখাচ্ছে। কিন্তু হর্ষচরিতরা কেউই তার এই মুদ্রার কোনো মানেই বুঝতে পারেনি। নদীর ঘাটের কাছে এপ্ল্যানেডের দেয়ালে যে দরজাটা ছিলো, সেটা খুলে কারখানা থেকে ভিড়টা এপ্ল্যানেডে এসে পৌঁছুলো। আর হর্ষচরিতরা, এতক্ষণে, যে-ই তাদের দেখতে পেলে রুদ্ধআক্রোশে গর্জন ক’রে উঠলো। দরজা ভাঙার কাজ মুলতুবি রেখে হাতের কাছে যে যা অস্ত্র পেলে তাই নিয়েই ছুটে এলো নবাগতদের দিকে।

এখন লড়াইটা ঠিক আগেকার মতো একতরফা হলো না। কারখানার লোকেরাও যে যা অস্ত্র পেয়েছে হাতে ক’রেই এসেছিলো : কামারশালার হাতুড়ি, সাঁড়াশি, লোহার ডাণ্ডা, লাঠি-শোঁটা… তারাও ধেয়ে এলো। ভয়াল সেই লড়াই, আকাশবাতাস অস্ত্রের ঝনঝন আর চীৎকার-কোলাহলে বধির। রক্তের বন্যা ব’য়ে গেলো এপ্ল্যানেডে—আর আগেই, রাতের যুদ্ধের পরিণামে, যত মৃতদেহ পড়েছিলো সেখানে, তার ওপর থুবড়ে পড়লো আরো-কত মৃত ও আহত।

দু-হাতে চোখ ঢেকে জেন চেষ্টা করলে সে-দৃশ্য তাকে যাতে আর দেখতে না-হয়, এই-যারা এই হাতাহাতি লড়াইতে মেতেছে তাদের মধ্যে কতজন আছে তার অন্তরঙ্গ বন্ধু! সে ভয়ে-আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো সাঁৎ-বের্যার কথা ভেবে, আমেদে ফ্লরেঁসের কথা ভেবে, ডাক্তার শাতোনের কথা ভেবে-আর মিশনের নেতা বারজাকের জন্যেও—তবে সাঁৎ-বেরার জন্যেই তার ভয়টা সবচাইতে বেশি!

কিন্তু তার চেয়েও প্রচণ্ড আরো-একটা গর্জন কানে এলো তক্ষুনি।

সংখ্যায় বেশি হর্ষচরিতরা, অস্ত্রবলেও বেশি বলীয়ান তারাই। কারখানার লোকজনদের মাঝখানে ফুঁড়ে গিয়েছে তারা, মাখনের মধ্যে তপ্তচুরির মতো। একদল পিছোচ্ছে নদীর ঘাটের দিকে, পদে-পদে বিপদের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে, অন্যদলটাকে যেন তাড়িয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে রাজভবনের দিকে। ঠিক শিকারের সময় খেদা যেমন করে। আর রাজভবনের দিকে যাদের ঠেলে নিয়ে-আসা হচ্ছে তাদের অন্তত রেহাই পাবার কোনো আশা নেই। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে তাদের শত্রুর সামনে; অলিন্দের ওপর থেকে সপরিষদ উইলিয়াম ফেরনে অনায়াসেই গুলি ছুঁড়তে পারবে এই হতভাগ্যদের ওপর। যাদের এমনকী যোঝবার কোনো শক্তিই নেই…

হঠাৎ তারাই উল্লাসে জয়ধ্বনি ক’রে উঠলো।

যে-দরজাটায় এসে তারা পিঠ ঠেকিয়েছিলো, সেটা আচমকা খুলে গিয়েছে তাদের পেছনে, আর চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছে জেন ব্লেজন। শত্রুরা ধাওয়া ক’রে আসছে… কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তারা আশ্রয় নিয়েছে রাজভবনের মাঝখানে আর জেন আর লুইসের আগ্নেয়াস্ত্রগুলি ঠেকিয়ে রাখছে হর্ষচরিতদের, তাদের নাগাল ধরতে দিচ্ছে না।

হঠাৎ এই অতর্কিত বাধায় বিমূঢ় হয়ে হর্ষচরিতেরা একমুহূর্ত ইতস্তত করেছিলো। রাজভবনের এমনতর ব্যবহারের কোনো মানেই তারা বুঝতে পারছিলো না। যতক্ষণে এই হতভম্ব দশা কেটেছে তাদের, তারা ফের সবেগে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেছে, ততক্ষণে বড্ড-দেরি হয়ে গেছে।

তাদের মুখের ওপর দড়াম ক’রে আবার বন্ধ হ’য়ে গেছে অভেদ্য-বর্ম পরানো সেই দরজা। সম্ভবত মাথা কুটে ম’রে গেলেও এই দরজা ভেঙে ফেলবার সাধ্য তাদের কারুই নেই।