২.১১ বেহেমথ

২.১১ বেহেমথ

সেই প্রচণ্ড শব্দে লেডি মানরো মূৰ্ছিত হয়ে তাঁর স্বামীর গায়ে ঢলে পড়লেন। মুহূর্তমাত্র দেরি না-করে মানরো স্ত্রীর অচেতন দেহ বহন করে ছুটে গেলেন চত্বর পেরিয়ে। হঠাৎ জেগে-ওঠা পাহারাওলাকে কিছু টের পাবার অবসর না-দিয়েই তার বুকে ছুরি বসিয়ে দিলে গৌমি, তারপরে প্রভুর পিছন-পিছন ছুটে চলে গেলো।

কেল্লার পাশের পাকদণ্ডী দিয়ে তারা সবে নেমে পড়েছেন, এমন সময় কেল্লা থেকেপিল-পিল করে ছুটে এলো হঠাৎ জেগে-ওঠা ভ্যাবাচাকা মানুষগুলি। কী হয়েছে, তারা কিছুই বুঝতে পারছিলো না—আর এই ফাঁকে মানরোরা আরো-খানিকটা ছুটে গেলেন পাকদণ্ডী বেয়ে।

নানাসাহেব ক্কচিৎ এই কেল্লায় রাত কাটাতেন। মানরোকে কামানের মুখে বেঁধে তিনি গিয়েছিলেন একটা ছোটো সভায়—যেখানে এদিককার আরো কয়েকজন বিদ্রোহী নেতাদের সঙ্গে তার গোপন শলা-পরামর্শ হবে। দিনের বেলায় বেরুবার উপায় নেই বলে রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে বেরোন তিনি–ফিরে আসেন শেষ রাতে। এটাই তাঁর ফিরে-আসার সময়।

কালোগনি, নাসিম ও তাদের অনুচরেরা—শতাধিক মানুষের একটা বাহিনী-নিশ্চয়ই এক্ষুনি পলাতকদের খোঁজে বেরিয়ে পড়বে। ব্যাপারটা বুঝতে কেবল যে-সময়টুকু লাগবে–তবে পাহারাওলার ছুরিকাবিদ্ধ মৃতদেহ দেখে নিশ্চয়ই পুরো ব্যাপারটা বুঝতে তাদের একটুও দেরি হবে না।

দেরি হলোও না। কালোগনির রোষ মুহূর্তের মধ্যে তীব্র দাঁতচাপা শপথের আকারে বেরিয়ে এলো। নানাসাহেব ফিরে এলে কী জবাবদিহি দেবে সে? এক্ষুনি তাকে বেরিয়ে পড়তে হবে বন্দীর খোঁজে।

কোথায় আর যাবে তারা? বন্দী আর তার সঙ্গীরা? এই পাহাড়ি জায়গায় সব তাদের চেনা। লোকালয়ে পৌঁছুবার আগেই তারা ধরে ফেলবে পলাতকদের।

পাকদণ্ডী বেয়ে-বেয়ে মানরোরা তখন ছুটে নেমে যাচ্ছেন। পাহাড়ের কোলে ঊষার আলো ছড়িয়ে পড়ছে তখন। হঠাৎ উপর থেকে মস্ত কোলাহল ভেসে এলো। কালোগনি দেখতে পেয়েছে তাদের। মানরো! ওই তো মানরো! চীৎকার করে সে বলছে সবাইকে।

পরক্ষণেই এক লাফে কালোগনি নেমে এলো পাকদণ্ডী বেয়ে—পিছনে ছুটে এলো তার অনুচরেরা, প্রচণ্ড কোলাহল করে।

কোথাও লুকোবার উপায় নেই। কেবল সামনে ছুটে যেতে হবে। মানরো মনেমনে সব স্থির করে ফেলেছেন। নানাসাহেবকে আর তিনি জ্যান্ত ধরা দেবেন না বরং গৌমির ছুরিটা আমূল বসিয়ে দেবেন নিজের বুকে, তবু না।

গৌমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, আর-একটু …পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমরা জব্বলপুরের রাস্তায় এসে পড়বে।

কিন্তু গেীমির মুখের কথা শেষ হবার আগেই দেখা গেলো সামনে থেকে দুটি লোক দ্রুতবেগে ছুটে আসছে। ততক্ষণে আলো ফুটেছে, মুখ দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। আর সেইজন্যেই পরস্পরকে চিনতে কারু একফোঁটা দেরি হলো না। দু জনেরই ঘৃণা ও রোষ যেন দুটি নাম হয়ে ফেটে পড়লো সেই পাহাড়ি রাস্তায়।

মানরো!

নানাসাহেব?

কামানের আওয়াজ শুনে নানাসাহেব খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসছিলেন। কেনযে তার ফিরে-আসার আগেই তার আদেশ অমান্য করে কামান গর্জে উঠলো, এটা তার দুর্বোধ্য ঠেকেছিলো। তার সঙ্গে মাত্র একটিই অনুচর। কিন্তু সেই অনুচরটি কোনো সময় পাবার আগেই আর্তনাদ করে গৌমির পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়লো। গৌমির ছুরিটা অকস্মাৎ প্রচণ্ড রক্তপিপাসু হয়ে উঠেছে।

নানাসাহেব অন্যদের ডাক দিলেন, শিগগির এসো এখানে?

হ্যাঁ, এখানে, বলেই গৌমি লাফিয়ে পড়লো নানাসাহেবের উপর। উদ্দেশ্য নানাসাহেবকে ব্যস্ত রাখা—যাতে মানরো এই ফাঁকে পালিয়ে যেতে পারেন।

নানাসাহেব এক ঝটকায় নিজেকে গৌমির হাত থেকে মুক্ত করে নিলেন। কিন্তু গৌমি পরক্ষণে কঠোর হাতে তাকে জড়িয়ে ধরলো, তারপর অবলীলাক্রমে তাকে বহন করে এগিয়ে গেলো খাতের দিকে। তাকে নিয়েই সে ঝাঁপিয়ে পড়বে নিচে-তবু কিছুতেই তাঁকে ছেড়ে দেবে না।

কালোগনিরা ততক্ষণে একেবারে কাছে এসে পড়েছে। কাঁধে একটি মূৰ্ছিত দেহ নিয়ে অবসন্ন রাতজাগা ক্লান্ত বিধ্বস্ত মানরো কোথায় পালাবেন?

হঠাৎ প্রায় কুড়ি গজ দূর থেকে ডাক শোনা গেলো : মানরো! মানরো!

ওই-যে রায়পুরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে ব্যাঙ্কস, ক্যাপ্টেন হুড, মোক্লের, সার্জেন্ট ম্যাক-নীল, ফক্স আর পারাজার-মানরো দেখলেন। পিছনেই বড়ো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ওগরাচ্ছে বেহেমথ—হাওদায় বসে আছে স্টর আর কালু।

স্টীম হাউসের শেষ বগিটা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় ব্যাঙ্কসরা হাওদায় চেপেই লেক পুটুরিয়া থেকে জব্বলপুরের দিকে রওনা হয়ে পড়েছিলো। হঠাৎ এখান দিয়ে যাবার সময় কামানের বিকট আওয়াজ শুনে তারা থেমে পড়েছে। কী-একটা অলুক্ষুণে ভয়ে পরমুহূর্তে তারা লাফিয়ে নেমেছে এখানে—হুড়মুড় করে এগিয়েছে পাহাড়ি রাস্তায়। তারা যে কী দেখবে বলে প্রত্যাশা করেছিলো, তা-ই তারা স্পষ্ট জানে না। অনেক সময় মানুষের ভিতর থেকে কে যেন নির্দেশ দিয়ে মানুষকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নেয়–যার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা হয় না। তারপর মোড় ঘুরেই তারা সামনে দেখতে পেয়েছে মানরোকে!

লেডি মানরোকে বাঁচাও।

লেডি মানরো!

আর সত্যিকার নানাসাহেবকেও ছেড়ে দেবে না! একেবারে শেষ সঞ্চিত শক্তিটুকু দিয়ে গৌমি এই প্রকাণ্ড মানুষটিকে এখানে বহন করে এনেছে।

তক্ষুনি হুড আর ম্যাক-নীল নানাসাহেবকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেললে। কোনো কথা বলার তখন অবসর নেই—সবাই চটপট গিয়ে উঠে পড়লো বেহেমথে। ব্যাঙ্কস চেঁচিয়ে বললে, পুরোদমে চালিয়ে দাও, স্টর! পুরোদমে!

কালোগনিরা ততক্ষণে প্রায় একশো গজ দূরে। তারা এসে পড়ার আগেই যদি জব্বলপুরের সামরিক শিবিরে পৌঁছুনো যায়, আর ভয় নেই। শিবিরটা কাছেই—ঠিক জব্বলপুরে ঢোকার মুখে।

কিন্তু রাস্তা এখানে উবড়োখবড়ো, পর-পর অনেকগুলো তীক্ষ্ণ্ণ বাঁক রয়েছে–পুরোদমে বেহেমথকে চালিয়ে নেবারও কোনো উপায় নেই।

কালোগনিরা আরো-কাছে এসে পড়ছে।

গুলি চালাতেই হবে। হুড বন্দুক তুলে ধরলো!

কিন্তু আর মাত্র যে ডজন খানেক টোটা আছে, ফক্স বললে, এলোমেলো গুলি চালালে চলবে না কিছুতেই!

ম্যাক-নীল বসে আছে বন্দী নানাসাহেবকে চেপে ধরে, কালু আর পারাজার কেবল জ্বালানি দিচ্ছে চুল্লিতে, ব্যাঙ্কস, আর স্টর বেহেমথকে চালিয়ে নিতে ব্যস্ত, মানরো বসে আছেন লরার মূৰ্ছিত দেহ কোলে করে। হুড আর ফক্স বিদ্রোহীদের দিকে মুখ করে বসে টোটাভরা বন্দুক তাগ করে ধরলে।

ইতিমধ্যে ব্যাঙ্কস সামনে খোলা রাস্তা পেয়ে বেহেমথের গতি যতটা পারে বাড়িয়ে দিয়েছে। মাঝখানে দু-দলের ব্যবধান একেবারে কমে গিয়েছিলো-এখন আবার ব্যবধান ক্রমশ বাড়তে লাগলো। কিন্তু হঠাৎ সামনে একটা সরু বাঁক দেখে ব্যাঙ্কসকে যেই আবার গতি কমাতে হলো অমনি ব্যবধান আবার চট করে কমে গেলো।

হুড আর ফক্সের বন্দুক গর্জে উঠলো একসঙ্গে—আর্তনাদ করে পড়ে গেলো দুটি লোক, হুমড়ি খেয়ে। কিন্তু অন্যেরা তবু এগিয়ে আসছে বন্দুক এরা ভয় পায় না–আরো-কোনো তীব্র বারুদে এই ভারতীয়দের বুকভরা। দেশের জন্যে প্রাণ দিতে তারা পেছ-পা হয় না কখনও, বিশেষ করে যেখানে নানাসাহেবের প্রাণ সংশয়, সেখানে তারা নিজেদের জীবন তুচ্ছ জ্ঞান করে ছুটে আসছে। ক-জনকে মারতে পারবে এই শ্বেতাঙ্গ বিদেশীরা? শেষটায় এরা নাগাল ধরে ফেলবেই, আর তখন দেখবে শতাধিক বছর ধরে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারের নির্বিরোধী মানুষদের উপর নির্বিচারে অত্যাচার চালাবার ফল কী! তাছাড়া কালোগনি ভালো করেই জানে যে ক্যাপ্টেন হুডের গোলাবারুদ ফুরিয়ে এসেছে। কতক্ষণ এরা যুঝবে?

আরো কয়েক বার হুড আর ফক্সের বন্দুক গর্জে উঠলো, উত্তরে তাদেরও বন্দুক গর্জালো বেহেমথকে লক্ষ্য করে। আরো কয়েকজন ভারতীয় ছিটকে পড়লো রক্তাপ্লুত দেহে, কিন্তু মরতে-মরতেও তারা রুষ্ট স্বরে ঘৃণাভরে বলে গেলো : বিদেশীরা নিপাত যাক!

আর মাত্র দুটি গুলি রয়েছে ইউ আর ফক্সের। একেবারে শেষ মুহূর্তে খরচ করবে তারা।

ব্যবধান এখন একেবারেই কমে এসেছে।

এতক্ষণ কালোগনি সাবধানে আসছিলো—এবার সে লাফিয়ে এগিয়ে এলো, বন্দুক হাতে, চীৎকার করে।

ওঃ! তুমি? হুড বলে উঠলো, শেষ গুলিটা তাহলে তুমিই নাও। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় তাগ করে ঘোড়া টিপলো হুড।

কালোগনির কপালের ঠিক মাঝখানটায় গুলি লাগলো। আকাশ হাড়ালো তার হাতটা একবার, বাতাস আঁকড়ে ধরতে চাইলো যেন, একবার লাফিয়ে এগিয়ে এলো তিন পা, তারপরেই সে একটা প্রকাণ্ড পাক খেয়ে ঘুরে পড়ে গেলো!

কিন্তু বেহেমথ ততক্ষণে একটা খাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে! তার মুখ ফেরাবার কোনো উপায় নেই–পিছনে ভারতীয়রা একেবারে কাছে এসে পড়েছে!

লাফিয়ে নেমে পড়ো সবাই, এক্ষুনি! বললে ব্যাঙ্কস।

মানরো স্ত্রীর মুর্ছিত দেহ কাঁধে করে নেমে পড়লেন। অন্যরাও একটুও দেরি করলে না। কাছেই সেনানিবাসের ছাউনি দেখা যাচ্ছে।

নানাসাহেবের কী হবে? মানরো ছুটতে-ছুটতে জিগেস করলেন।

তার ভার আমি নিয়েছি। ব্যাঙ্কস বললে। হাওদায় নানাসাহেবের দড়ি বাঁধা শরীর পড়ে আছে। এখানেই পড়ে থাক, বলে ব্যাঙ্কসও লাফিয়ে নেমে পড়লো।

বেহেমথ থামলো না। এঞ্জিন চলছে তার, শুঁড় দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, পুরোদমে সে ছুটে চললো সামনে-খাদের দিকে।

হঠাৎ একটা বিকট আওয়াজ শোনা গেলো।

ছুটতে ছুটতে পিছন ফিরে তাকিয়ে মানরো দেখতে পেলেন বেহেমথের বয়লারটা ফেটে গেলো—নামবার আগে ব্যাঙ্কস পুরোদমে চালিয়ে এসেছিলো বেহেমথকে।

বয়লার ফেটে যেতেই বেহেমথ কী-রকম ঘুরে গেলো একপাক, শুঁড়টা শূন্যে তোলা, ইস্পাতের পাতগুলো ফেটে উড়ে গিয়েছে চারধারে-কেবল হাওদাটা নানাসাহেবকে নিয়ে ছিটকে উড়ে গেলো খাদের দিকে।

বেচারি বেহেমথ! হুড ছুটতে ছুটতে বললে, আমাদের বাঁচাতে গিয়ে মরলি তুই!

সেনানিবাসের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে ব্যাঙ্কস বললে, কে বললে বেহেমথ বেচারি! সে নানাসাহেবকে বধ করে তবে মরেছে!