পাতালঘরে
মিনিটে মিনিটে ঘণ্টা কেটে গেল।
প্রথমে জ্ঞান ফিরে আসে যুবকের। ধুলো বালি রক্তে বীভৎস চেহারা। প্রদীপের আলোয় আবছা আবছা অন্ধকারে পাতালঘরটা থমথম করছে।
প্রদীপের সামান্য তেল ফুরিয়ে এল। আর বেশীক্ষণ জ্বলবে না, এখুনি নিভে যাবে। নিশ্চিদ্র অন্ধকারে ঘরটা ড়ুবে যাবে।
মাথার মধ্যে এখনও ঝিম্ ঝিম্ করছে। স্মৃতিশক্তি ধোঁয়ার মত অস্পষ্ট। যুবক একবার উঠে বসবার চেষ্টা করে, কিন্তু শক্তিতে কুলোয় না। এলিয়ে পড়ে।
শিবনারায়ণের জ্ঞান ফিরে এল। অস্পষ্টযন্ত্রণাকাতর একটা শব্দ করে শিবনারায়ণও নড়েচড়ে ওঠেন।
আরও আধ ঘণ্টা পরে।
প্রদীপের আলো প্রায় নিভুনিভু তখন, ঘরের মধ্যে যেন একটা ভৌতিক আলোছায়ার লুকোচুরি খেলা।
যুবকের কোমরে যে তীক্ষ্ণ ছোরাটা গোঁজা ছিল সেটা সে টেনে বের করে।
রক্তাক্ত মুখের ওপরে মাথার চুলগুলো এসে পড়েছে।
চোখেমুখে একটা দানবীয় জিঘাংসা।
শিবনারায়ণ!
অস্পষ্ট প্রদীপের আলোয় যুবকের হস্তধৃত ধারাল ছোরাটা যেন মৃত্যুক্ষুধায় হিলহিল করছে। ঐদিকে দৃষ্টি পড়ায় শিবনারায়ণ যেন বারেক শিউরে ওঠে; চোখেমুখে একটা আতঙ্ক সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
শিবনারায়ণ!
তুমি কি আমায় খুন করতে চাও?
যদি বলি তাই?
কিন্তু কেন? কেন তুমি আমায় খুন করবে?
খুন তোমাকে আমায় করতেই হবে। যুবক এগিয়ে আসে।
শিবনারায়ণ এক পা দু পা করে দেওয়ালের দিকে পিছিয়ে যায়।
কোথায় পালাবে আজ তুমি শিবনারায়ণ! এই অন্ধকার পাতালঘরের মধ্যে কতটুকু জায়গা তুমি পাবে পালাবার? তোমাকে খুন করব। হ্যাঁ, খুন করব। এই তীক্ষ্ণ ছোরাটার সবটুকুই তোমার বুকে বসিয়ে দেব। ফিকি দিয়ে তাজা লাল রক্ত বের হয়ে আসবে। প্রাণভয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় তুমি চিৎকার করে উঠবে। কেউ সে চিৎকার শুনতে পাবে না। কেউ জানতে পারবে না। দীর্ঘকাল ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে যেমন সুরেন চৌধুরী বন্দী হয়ে ছিল, কেউ জানতে পারে নি, তেমনি তোমার মৃতদেহও এই ধূলিমলিন অন্ধকার পাতালঘরের মধ্যে পড়ে থাকবে।
কেন— কেন তুমি আমাকে অমন নৃশংসভাবে হত্যা করবে? আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি?
মরতে যেন তুমি ভয় পাচ্ছ মনে হচ্ছে শিবনারায়ণ?
ভয়! না, ঠিক তা না।
তবে? ভয় কি শিবনারায়ণ, শুধু যে তোমাকেই মরতে হচ্ছে তা নয়, মরতে আমাকেও হবে। তবে দুদিন আগে আর পরে এই হ্যাঁ। তাছাড়া ভেবে দেখ, ফাঁসীর দড়িতে ঝুলে অসহনীয় শ্বাসকষ্ট পেয়ে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর চাইতে তোমার এ মৃত্যু ঢের ভাল, নয় কি?
ঐ সময় যুবকের সামান্য অসতর্কতায় শিবনারায়ণ যুবকের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, শয়তান!
অতর্কিত আক্রমণে যুবক মেঝের উপর পড়ে যায়।
অসীম শক্তি শিবনারায়ণের দেহে শিবনারায়ণ যুবকের উপর চেপে বসে দুহাতে প্রাণপণ শক্তিতে যুবকের গলাটা চেপে ধরে। জোরে, আরও জোরে চাপ দেয়। যুবকের চোখ দুটো কি এক অস্বাভাবিক আতঙ্কে যেন অক্ষিকোটর হতে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়।
গোঁ গোঁ একটা অস্পষ্ট শব্দ যুবকের গলা দিয়ে বের হয়ে আসে। ক্রমে যুবকের দেহটা শিথিল হয়ে আসে। জোরে আরও জোরে শিবনারায়ণ যুবকের গলায় দশ আঙুলের চাপ দেয়।
তারপরই শিবনারায়ণ পাগলের মত হেসে ওঠেন।
প্রদীপটা শেষবারের মত দপ্ করে একবার জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেল। অন্ধকার! নিচ্ছিদ্র অন্ধকার!
চোখের দৃষ্টি বুঝি অন্ধ হয়ে যাবে।
শিবনারায়ণ হাসছে, পাগলের মতই হাসছে অন্ধকারে, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। অন্ধকার পাতালঘরের মধ্যে সেই উচ্চহাসির শব্দ যেন ঝন্ ঝন্ করে করতালি দিয়ে দিয়ে ফিরছে দেওয়ালে দেওয়ালে।
আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল।
ঘর হতে বেরুতে হবে। অন্ধকারে শিবনারায়ণ হাতড়ে হাতড়ে পাতালঘর থেকে বাইরে বের হবার রাস্তা খুঁজতে শুরু করে এবারে।
এ কি, অন্ধকারে কি শিবনারায়ণ পথ হারিয়ে ফেলল!
অন্ধকারের গোলকধাঁধা।
শিবনারায়ণ পাগলের মতই ঘোরে ঘরের ভিতর।
কিন্তু না, পথ কই! আলল—একটু আলো!
পাগলের মতই শিবনারায়ণ অন্ধকারের মধ্যে চিৎকার করে ওঠে, কে আছ, বাঁচাও, ওগো কে আছ, বাঁচাও!
না, এই তো দরজা! কিন্তু এ কি! এ যে বাইরে থেকে বন্ধ!
উন্মাদের মত শিবনারায়ণ বন্ধ দরজার উপরে কিল চড় লাথি বসাতে থাকে।
শক্ত সেগুন কাঠের দরজা।
কি হবে! তবে কি তাকে এই অন্ধকার পাতালঘরের মধ্যে তিল তিল করে মরতে হবে!
মৃত্যু! কে শুনতে পাবে তার চিৎকার!
সুরেন! সুরেন! কোথায় তুমি! আমাকে বাঁচাও ভাই!
ছাব্বিশ বছর এই পাতালঘরে তোমাকে আমি বন্দী করে রেখেছি। দিনের পর দিন রাতের পর রাত তোমার বুকভাঙা কান্না শুনেছি। এখন বুঝতে পারছি কি যন্ত্রণা তুমি এই ছাব্বিশ বছর ধরে পলে পলে সহ্য করেছ! ক্ষমা কর ভাই, আমাকে ক্ষমা কর আমাকে বেরুতে দাওযা চাও তুমি তাই দেব— সুরেন, সুরেন—
কিন্তু কেউ সাড়া দিল না।
শিবনারায়ণ একবার কাঁদে একবার হাসে।
একটা অস্পষ্ট খস্ আওয়াজ না! যুবকের মৃতদেহ কি আবার প্রাণ পেল! সুরেন! সুরেন! বেঁচে আছ কি?.. কথা বল! সাড়া দাও! অনেক টাকা তোমাকে দেব আমি। রাজা করে দেব—ও কে…রাজা শ্রীক মল্লিক!
ঘুরছে–শিবনারায়ণ পাগলের মতই অন্ধকার পাতালঘরের মধ্যে ঘুরছে! হঠাৎ একসময় যুবকের হীমশিতল মৃতদেহের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
কে? কে?
যুবকের ঠাণ্ডা অসাড় দেহটার ওপর শিবনারায়ণ হাত বুলায়।
সুরেন! আমার অনেক টাকা! রাজাবাহাদুর আমাকে অনেক টাকা দিয়েছে! সিন্দুকভর্তি টাকা আমার! এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট—একশ হাজার দশ বিশ পঁচিশ!
***
দিন দুই বাদে বিকাশ দলবল নিয়ে সুব্রতর নির্দেশমত যখন পাতালঘরে প্রবেশ করল শিবনারায়ণ তখনও টাকার অঙ্ক গুনে চলেছে। মৃতদেহটা ফুলে পচে উঠেছে, একটা উৎকট দুর্গন্ধে ঘরের বদ্ধ বাতাস যেন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে।