১১. দরজার ওপাশে কী আছে
জেন ব্লেজন কিন্তু সবচেয়ে সহজসিধে পথেই চ’লে গিয়েছিলো। কাউকে কিছু না-ব’লে সোজা সে বেরিয়ে গিয়েছিলো দরজা দিয়ে, দরজায় যথারীতি ছিটকিনি ছিলো, খিল ছিলো, এমনকী তালাও লাগানো ছিলো। কিন্তু তাতে কী। সাইক্লোস্কোপ তখন যার পাহারায় থাকার কথা সে তাকে কারখানা ছেড়ে চ’লে যেতে দেখেছে কিন্তু তাকে চিনতে পারেনি। তাকে ব’লে দেয়া ছিলো নেহাৎ একান্ত-জরুরি না- হ’লে সে যেন অহেতুক রক্তক্ষয় না-করে, সেইজন্যেই সে মাত্র একজনের বিরুদ্ধে বোলতা লেলিয়ে দিতে চায়নি—বিশেষ ক’রে সে যখন কারখানায় ঢুকতে চাচ্ছে না, বরং কারখানা ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
পাহারার প্রতিবেদন দেখিয়েছে যে জেন, কারখানা ছেড়ে বেরুবার পর, উজানের দিকে গেছে, নদীর ঘাট ধ’রে। ফলে কোনো বিভ্রমেরই কোনো অবকাশ নেই; সন্দেহ নেই যে অন্যরা যে-পরিকল্পনাটা কাজে খাটাতে পই-পই ক’রে বারণ করেছিলো, সে সেই অবাঞ্ছিত পরিকল্পনাটাকেই কাজে খাটিয়েছে। অনেক বিচার- বিবেচনা ক’রে সে স্থির করেছে অবশেষে সে গিয়ে হ্যারি কিলারের কাছেই ধরা দেবে। পরিহাস এটাই যে যখন সে গেছে তখন আর তার এই আত্মবিসর্জনের কোনোই দরকার ছিলো না।
ভাঁটির দিকের নদীর ঘাট শেষ হয়েছে সার্কুলার রোডে গিয়ে, সেটা বন্ধ ছিলো; উজানের দিকে নদীর ঘাট গিয়ে শেষ এসপ্ল্যানেডের দেয়ালে; তাই নদীর ঘাটের পুরো রাস্তাটাই ছিলো আসলে একটা কানাগলি। এখানে অবশ্য ধাতুর পাতের বর্মপরানো একটা দরজা ছিলো দেয়ালের গায়ে। এই দরজাটা সাধারণত বন্ধই থাকে, আর তার চাবি থাকে মাত্র দুজনের কাছে—মার্সেল কামারে আর হ্যারি কিলার। শত্রুতা শুরু হবার পর থেকেই এ-দরজাটা খোলাই ছিলো। ফলে হর্ষচরিতেরা যদি তাদের হর্ষোল্লাসে তার পথ না-আটকায়, জেন ব্লেজন তবে অনায়াসেই এপ্ল্যানেডে পৌঁছে সোজা রাজভবনে চ’লে যেতে পারবে।
শুধু-একটা মরীয়া হতাশার মুহুর্তেই জেন ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই কাজে। কারণ সবাই যখন এই ধারণাটাকেই আঁকড়ে ব’সে আছে যে তারই জন্যে সবাই এখন মরতে বসেছে, তাদের সব বিপদআপদের মূলে আছে একমাত্র শুধু সে-ই, তখন সে এতটাই বিচলিত হ’য়ে পড়েছিলো যে স্বাভাবিকভাবে কিছু ভেবে দেখবার মতো মনের অবস্থাই তার ছিলো না—এত লোক তাকে ঘৃণা করে! কিন্তু, ধরো, তাদের ধারণাই যদি ঠিক হয়? যদি সে-ই সত্যি দায়ী হয়? যদি সত্যি এই মারামারি কাটাকাটির আসল কারণ সে-ই হয়? যদি তাকে পেলেই হ্যারি কিলার তুষ্ট হ’য়ে যায়? তা যদি হয়, তবে যত-দেরি করবে, ততই সকলের অমঙ্গল—প্রায় একটা অসংশোধনীয় অপরাধই। নিজেকে তার গালাগাল দিতে ইচ্ছে করছিলো- এতজনকে বাঁচাতে পারবে জেনেও সে কি না এই সিদ্ধান্ত নিতে এত-দেরি ক’রে ফেললো! আর কারখানার সবাই যদি ভুলও ভেবে থাকে –যদিও সবাই মিলে একসঙ্গে এমন- একটা ভুল করবে, তা কি হয়?—তাহ’লে তার আত্মসম্মানের বোধ কি এটাই বলে না যে নিজের জীবন দিয়েও তাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে যে তারা ভুল ভেবেছে?
সংকেত দিতে তোঙ্গানের দেরি হওয়ার ফলেই এই দুর্বিপাকের ঘোরের মধ্যে তার মন এ-রকম প্রাঞ্জল একটা সিদ্ধান্তে গিয়ে পৌঁছুবার সময় পেয়েছিলো। কাজেই ৫ই মে সন্ধেবেলায়, হঠাৎ, হঠাৎই তার মাথাটায় কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায় সব, আর তক্ষুনি সে ছুটে বেরিয়ে যায় তার মাথায় যেটা তখন তার একমাত্র কর্তব্য ব’লে চেপে বসেছিলো, তাকেই সম্পাদন করতে।
কিছুই তার খেয়াল ছিলো না তখন। নিজেই সে বুঝতে পারেনি, সে কী করছে। সে শুধু আস্তে আলগোছে দরজাটা খুলেছে আর সকলের অগোচরে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তারপর, নিঃশব্দে, পেছনে ফের বন্ধ ক’রে দিয়েছে দরজাটা, আর রাজভবনের দিকে চলতে শুরু করেছে, কারখানার আলোয় চারপাশ ঝলমল করছিলো ব’লে শুধু সে চেষ্টা করেছে দেয়ালের গায়ে মিশে গিয়েই যেন সে আস্তে-আস্তে এগুতে পারে।
সাইক্লোস্কোপের পাহারার মতো, শহরের বাইরের দেয়ালের কাছে যে-হর্ষচরিতরা পাহারায় ছিলো তারাও তাকে বেরুবামাত্রই চোখে দেখেছে। কিন্তু তাদেরও মনে হয়নি মাত্র একজনের ওপর এভাবে গুলি চালানো উচিত—বিশেষত এমনও হ’তে পারে যে এমনভাবে প্রকাশ্যে যে হেঁটে বেড়াচ্ছে সে হয়তো তাদেরই দলের লোক।
কাজেই জেনের পক্ষে এপ্ল্যানেডে পৌঁছুতে আদৌ কোনোই অসুবিধে হয়নি, সে ঐ খোলা দরজাটা দিয়েই এগিয়ে গেছে। রাঙানদীর তীরের দেয়াল ঘেঁসে, সে দুঃসাহসে ভর ক’রেই সরাসরি চ’লে এসেছে খোলা জায়গাটায়, দৃক্পাতও করেনি হর্ষচরিতদের ক-টা ছোটোখাটো দলের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে। আর তার এই বেপরোয়া স্পর্ধা দেখে হর্ষচরিতরা এতটাই ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে যে সে বেশির ভাগ রাস্তাটাই নিরুপদ্রবে পেরিয়ে আসতে পেরেছে। শুধু যখন রাজভবন থেকে সে মাত্র কুড়ি পা দূরে, তখনই একটা দলের মধ্য থেকে দুজ্বন হর্ষচরিত বেরিয়ে এসে তাকে সাবধান ক’রে দিয়ে থামতে বলেছে।
বন্দীরা পালিয়ে যাবার আগে জেন যে স্বাধীনভাবে ইচ্ছে মতো রাজভবনে ঘুরে বেড়াতো, সেটা এই লোকগুলো দেখেছিলো। তাকে চিনতে পেরে তারা অবাক হ’য়ে অস্ফুট-একটা আওয়াজ করেছে শুধু; তার উদ্দেশ্যটা কী, তারা মোটেই জানে না; তাছাড়া অস্বস্তিও আছে বেদম, কেননা হ্যারি কিলার তাকে কতটা খাতির করেছে সে-তো তারা নিজের চোখেই দেখেছে; কী করবে বুঝতে না- পেরে হতভম্ভভাবে তারা তাকে শুধু চ’লেই যেতে দেয়নি, একেবারে সঙ্গে ক’রে নিয়ে এসেছে রাজভবনে, আর নিজের হাতে রাজভবনের দরজা খুলে দিয়েছে যাতে সে ভেতরে ঢুকে যেতে পারে।
যে-মুহূর্তে সে চৌকাঠ পেরিয়েছে, দরজাটা সশব্দে বন্ধ হ’য়ে গেছে তার পেছনে সে চাক বা না-চাক, এখন থেকে সে হ্যারি ক্লিারেরই কব্জায়—এমন-কোনো আশাও আর নেই যে কেউ কোনোদিন তাকে উদ্ধার করবার জন্যে এখানে ছুটবে।
রাজভবনে তার এই আকস্মিক আবির্ভাব তেমনি বিস্ময়ের সৃষ্টি করলো, যেমন করেছিলো এপ্ল্যানেডে। যে-খাশ পরিচারকটি তাকে ভেতরে ঢুকতে দিয়েছে, সে বিষম হকচকিয়ে গিয়ে তাকে নিয়ে গেছে তার সর্বেসবা প্রভুর কাছে। তারই পেছন-পেছন জেন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠেছে, গেছে গ্যালারির পাশ দিয়ে, অন্ধকার করিডরগুলো দিয়ে, আর সব-শেষে এসে পৌঁছেছে ঝলমলে আলোয় ভরা ঘরটায়, যেটাকে সে এত-ভালো চেনে। এটাই হচ্ছে মসনদকক্ষ, একবার আমেদে ফ্লরেঁস ঠোঁট বেঁকিয়ে যে-নামে এটাকে ডেকেছিলেন, যেখানে একবার ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিলো বন্দীদের, ব্ল্যাকল্যান্ডের সর্বেসর্বার সঙ্গে তাদের একমাত্র সাক্ষাৎকারের জন্যে, যে-ঘরটায় আশবাব বলতে শুধু আছে একটা টেবিল আর একটা বিশাল আরামকেদারা।
আরামকেদারাটা এখনও তেমনি প’ড়ে আছে এখানে, আর আগের মতোই হ্যারি কিলার তার ওপর হাত-পা ছড়িয়ে ব’সে আছে, আর সামনের টেবিলটায় রয়েছে সারি-সারি বোতল আর গেলাশ। কিন্তু এখন আশবাব বলতে শুধু ঐ আরামকেদারা আর টেবিলই নেই ঘরটায়। আরো-নটা চেয়ার আনা হয়েছে ঘরে, আর তাদের একটাই শুধু ফাঁকা, অন্য-আটটায় ব’সে আছে ক্রূর দেখতে আটজন লোক, তারাও চেয়ারে হেলান দিয়ে ব’সে মদ খাচ্ছে। হ্যারি কিলার তার নবরত্নসভার কৌশুলিদের সঙ্গে ব’সে ফূর্তি করছে।
দরজার কাছে দাঁড়ানো তরুণীটিকে দেখে, এই ন-জন আধমাতাল লোক বিস্ময়ে ঘোঁৎ ক’রে একটা আওয়াজ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে। কারখানা থেকে এমন-একজনের আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত আবির্ভাব ছাড়া আর কিছুই বোধহয় তাদের এতটা ভ্যাবাচাকা খাইয়ে দিতো না।
সবাই একসঙ্গে লাফিয়ে উঠে বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলো : ‘মিস মোর্নাস!’
‘একাই?…’ হ্যারি কিলার জিগেস করলে। দরজার ফাঁক দিয়ে একটা চৌকো অন্ধকার দেখে একটু বুঝি অস্বস্তিই হয়েছে তার।
‘একাই।’ জেনের গলা কাঁপছে, কিন্তু তবু তাতে দৃঢ়তার সুর। তার হাঁটুর জোড়গুলো তখন যেন খুলে আসতে চাচ্ছে; সে দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালে।
কয়েক মুহূর্তের জন্যে এই ন-জন লোক বিস্ময়ে-অভিভূত হ’য়ে তার দিকে শুধু হা ক’রে তাকিয়ে রইলো। সে-যে এখানে এসেছে, এটাই চমকপ্রদ তথ্য; তার ওপর এমনভাবে? একা তাদের এই হতভম্ব চাউনির সামনে জেনের মাথাটা আবার কেমন তালগোল পাকিয়ে গেলো, এতক্ষণে সে তার এই হঠকারী দুঃসাহসের তাৎপর্যটা একটু-একটু ক’রে বুঝতে পারছে।
‘তুমি ঐ-ওখান থেকে,’ ব’লে কারখানাটাকে দেখিয়ে জড়ানো গলায় বললে হ্যারি কিলার, ‘আসছো?’
‘হ্যাঁ,’ প্রায়-শোনা-যায়-না এমন গলায় বললে জেন, ফিশফিশ ক’রে।
‘এসেছো কেন এখানে?’
তার গলার সুরে কোনো অমায়িকভাব নেই। জেনের বুঝতে বাকি রইলো না যে কারখানার বুভুক্ষু কর্মীরা তাকেই সব দুর্বিপাকের কারণ ব’লে ভেবে কত- বড়ো ভুল করেছে। আবারও তার গা শিউরে উঠলো, তার এই আত্মত্যাগে পৃথিবীতে কোথাও কারু কোনো উপকারই হবে না!
‘আমি ধরা দিতে এসেছি,’ নিজেকে এতটাই তুচ্ছ ও অবাঞ্ছিত লাগছিলো যে এছাড়া আর-কিছু বলবার কথা তার মনেই হ’লো না।
‘বেশ! বেশ!’ ঠোঁট বেঁকিয়ে বললে হ্যারি কিলার; তারপর, তার ইয়ারবক্সিদের দিকে ফিরে বললে, ‘একলা একটু কথা বলতে দাও আমাকে
আটজন কৌশুলিই টলতে-টলতে উঠে দাঁড়ালে। মুচকি হেসে একজন জড়ানো গলায় টিপ্পনী কাটলে : ‘ঠিক হ্যায়। আকেলাই রেখে যাচ্ছি তোমাকে।’
তারা যেই দরজার কাছে গিয়ে পৌঁছেছে, হ্যারি কিলার হাত নেড়ে তাদের একটু থামতে বললে। তারপর জেনের দিকে ফিরে বললে : ‘শুমুকির কী হয়েছে তা আর জিগেস ক’রে কী হবে? ছিন্নভিন্ন হাত-পা দেখেছি তার! কিন্তু তার সঙ্গে যে অন্য আরেকজন ছিলো, তার কী হয়েছে?’
‘শুমুকিকে আমরা খুন করিনি,’ জেন উত্তর দিলে। ‘হেলিবিমান উড়িয়ে দিতে গিয়ে সে নিজেই বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছে। তার সঙ্গে যে ছিলো, সেও বেশ জখম হয়েছে। কারখানায় ওরা তার সেবাশুশ্রুষা করছে!
‘আহা!’ বললে হ্যারি কিলার, শ্লেষের ভঙ্গিতে। ‘হেলিবিমানের কী হয়েছে?’
‘চুরমার।’
হ্যারি কিলার খুবই আহ্লাদের ভঙ্গিতে হাত কচলালে—আর বাকি-আটজন কৌশুলি টলোমলো-পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। ‘তো, তুমি তাহ’লে এখন ধরা দিতে এসেছো? বটে? তা, এই ধরা দেবার সুমতি হঠাৎ হ’লো কেন?’
অন্যরা যাতে প্রাণে বাঁচে,’ সাহসে ভর ক’রে বললে জেন।
‘অসম্ভব!’ খুক ক’রে একটু হেসে উঠলো হ্যারি কিলার। ‘তাহ’লে সবাই একেবারে নাজেহাল-সহ্যের একেবারে শেষসীমায়? অ্যা?’
‘হ্যাঁ,’ চোখ নামিয়ে প্রায় ফিশফিশ ক’রেই বললে জেন
বিষম আহ্লাদে গেলাশে মাত্রাছাড়ানো পরিমাণে মদ ঢাললে হ্যারি কিলার-আর সবটাই একটোকে গলায় চালান ক’রে দিলে। প্রশ্নের সুরে বললে, ‘তো?’
‘কিছুকাল আগে,’ লজ্জায়-ধিক্কারে জেনের মুখ টুকটুকে-রাঙা হ’য়ে উঠলো, ‘কিছুকাল আগে, তুমি আমায় বিয়ে করতে চেয়েছিলে। বিয়েতে আমি রাজি আছি, তবে একশর্তে-অন্যদের ছেড়ে দিতে হবে।’
‘একশর্তে?…’ হ্যারি কিলার বিস্ময়ে প্রায় চেঁচিয়েই উঠলো : ‘খুকি, চারপাশে কী হচ্ছে ব’লে তুমি ভাবছো? কারখানার লোকেরা যখন বেকায়দায় পড়েছে, তখন আজ না-হোক কাল আমি তাদের সব কটাকে বাগে পাবোই-এবং তোমাকেও পাবো, ফাউ। আজ সন্ধেয় তোমার এভাবে এখানে আসায় কোনো লাভ হয়নি, খুকি—তাতে আমি শুধু হাতে আরেকটা তুরুপের তাশ পেলাম।’
উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে টলতে-টলতে এগুলো সে। ‘তোমার বুকের পাটা আছে –না হ’লে শর্তের কথা বলতে পারো! আমার স্ত্রী হবার জন্যে শর্ত! হুম, তুমি আমার বউ হবে—তবে সেটা হবে আমি যখন ইচ্ছে করবো, তখন। কিন্তু এখন তুমি আমাকে ঠেকাবে কী করে শুনি। সেটা জানবার জন্যে কৌতূহলে আমি ম’রে যাচ্ছি!’
সে যতই জেন ব্লেজনের দিকে এগিয়ে এলো, জেন ব্লেজন ততই কুঁকড়ে গুটিয়ে গেলো। সে প্রায় তাকে ছুঁয়েই ফ্যালে বুঝি। শেষটায়, কোনঠাশা, দেয়ালে-পিঠ- ঠেকানো, জেন ঠিক তার নাকের ডগায় তার মদেভরা নিশ্বাসের ঝাপটা পেলে।
‘আমি ম’রে যেতে পারি, ইচ্ছে করলে!’
‘মরবে?…’ হ্যারি কিলার, টালমাটাল, স্থির হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করলে। তার গলার ঠাণ্ডা দৃঢ়তায় সে কেমন ভড়কে গিয়েছে। দ্বিধার ভঙ্গিতে গাল চুলকে সে আবারও বললে : ‘মরবে?’
একমুহূর্ত চুপ ক’রে থাকার পরই তার মাথায় বুঝি অন্য-কী-একটা ভাবনা খেলে গেলো। ‘ধূস।…আচ্ছা, সে না-হয় কাল দেখা যাবে। বুঝলে, খুকি, শিগগিরই আমরা একটা সমঝোতায় এসে, পড়বো। ততক্ষণ, না-হয় এসো, একটু আমোদ- আহ্লাদ করা যাক।’
তার আরামকেদারায় ফিরে গিয়ে হ্যারি কিলার তার মদের গেলাশটা বাড়িয়ে ধরলে। ‘এসো, দুজনে মিলে একটু পান করা যাক।’
জেন হাত না-বাড়ালে কী হবে, হ্যারি কিলার এক গেলাশের পর আরেক গেলাশ, তারপর আরেক গেলাশ, বেধড়ক মদ গিলে চললো। জেন আসবার আগেই তো অর্ধেক মাতাল হ’য়ে গিয়েছিলো, এখন নেশার ঝোঁকে একটু পরেই তার নাক ডাকতে শুরু করলো।
তাহ’লে এই আরেকটা সুযোগ তার দাদাকে সম্ভবত এই লোকটাই হত্যা করেছে-এবং এখন এই আততায়ীর জীবন আবারও আরেকবার তারই দয়ার ওপর নির্ভর ক’রে আছে। যে-খঞ্জরটা দিয়ে জর্জ ব্লেজন খুন হ’য়েছে, সেই একই খঞ্জর সে এখন অনায়াসেই তার হৃৎপিণ্ডে ঢুকিয়ে দিতে পারে! কিন্তু তাতে ফায়দাটা কী হবে? যাদের বাঁচাবার জন্যে এত কষ্ট ক’রে সে এখানে এসেছে, হ্যারি কিলার মরে গেলে তাদের জীবন কি আরো-বিপন্ন হ’য়ে পড়বে না? কিছুক্ষণ ঐ ঘুমন্ত সর্বেসর্বার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো জেন-চিন্তায় আচ্ছন্ন। তারপরেই তার পেটটা মোচড় দিয়ে উঠলো। খিদে – নিষ্ঠুর, সর্বগ্রাসী, অসহ্য খিদে। আর মুহূর্তের মধ্যে তার বুভুক্ষু অস্তিত্ব যেন তার চারপাশের অবস্থাটাই ভুলে গেলো—ভুলে গেলো সে কোথায় আছে, ভুলে গেলো হ্যারি কিলারের প্রাণ তারই দয়ার ওপর আছে এখন, ভুলে গেলো কারখানার লোকজনের দশা, শুধু খাবার ছাড়া আর-কিছুর কথাই তার মনে রইলো না। খাবার চাই, এক্ষুনি কিছু না-খেতে পেলে সে ম’রেই যাবে!
সন্তর্পণে গিয়ে সে খুললো দরজাটা, যে-দরজা দিয়ে একটু আগেই আটজন কৌশুলি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। আর পাশের একটা ঘরে সে দেখতে পেলে একটা ভোজের অবশিষ্ট, অজস্র খাবার। এরা নিশ্চয়ই পানভোজনে মত্ত ছিলো, পরে মসনদঘরে গিয়ে শুধু মদই গিলেছে!
জেন টেবিলটার দিকে ছুটে গিয়ে হাতের কাছে যা পেলে, তা-ই তুলে নিলে। আর যত সে গোগ্রাসে খেতে লাগলো, ততই যেন প্রাণ ফিরে আসতে লাগলো তার অবসন্ন দেহে, শিরায়-শিরায় ফেনিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো যেন আবার, আর দৈহিক শক্তির সঙ্গে-সঙ্গে আবার তার নৈতিক বল ফিরে এলো।
সতেজ, সে ফিরে গেলো পাশের ঘরে। হ্যারি কিলার তখনও তার আরামকেদারায় চিৎপাত শুয়ে ভোঁস-ভোঁস ক’রে ঘুম লাগাচ্ছে। সে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে তার মুখোমুখি ব’সে অপেক্ষা করতে লাগলো কখন তার ঘুম ভাঙে।
আর এভাবে ব’সে থাকতে-থাকতে স্মৃতিরা ভিড় ক’রে এলো তার মাথায়। তার মনে প’ড়ে গেলো হ্যারি কিলার কীভাবে তাকে বসিয়ে রেখে ঐ বন্ধ দরজাটা খুলে আধঘণ্টার জন্যে অন্তর্হিত হ’য়ে যেতো, আর তখন কতবার কৌতূহল তাকে জ্বালিয়ে মেরেছে, দরজার ওপাশে কী আছে তা জানবার জন্যে। এই দরজার চাবি সবসময় তার সঙ্গে-সঙ্গে থাকে, আর এখন দৈব আবার জেনকে সুযোগ দিয়েছে, তার কৌতূহল চরিতার্থ করবার সুবর্ণযোগ! প্রলোভনটা বিপুল। এই সুযোগটা তাকে নিতেই হবে, হয়তো তার জীবনে আর কখনও এমন সুযোগ আসবে না!
তাড়াহুড়ো ক’রেই, ক্ষিপ্রপায়ে, জেন দরজাটার কাছে গিয়ে পৌঁছুলো, যে-দরজা দিয়ে প্রতিদিন হ্যারি কিলার অন্তর্হিত হ’য়ে যেতো, আর চাবিটা ঢোকানো তালার ফোকরে। নিঃশব্দে খুলে গেলো কবাট। আর তার ওপাশেই একটা ল্যান্ডিং, সেখান থেকে সিঁড়ির ধাপ নেমে গিয়েছে নিচের তলায়। আস্তে, সন্তর্পণে, পাল্লাটা বন্ধ না-ক’রেই, শুধু খুলে রেখে, জেন টিপে-টিপে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো, নিচে থেকে ঝাপসা আলো এসে পড়েছে সিঁড়িতে।
যে-ঘরটা ছেড়ে সে চলে এসেছে সেটা রাজভবনের দোতলায়, অথচ দুটো তলা পেরিয়ে যাবার পরও, সে এসে পৌঁছলো আরেকটা ল্যান্ডিঙে, সেখান থেকে সিঁড়ির ধাপ নিশ্চয়ই মাটির তলার কোনো ঘরে নেমে গিয়েছে। একমুহূর্ত ইতস্তত ক’রে, সে আরো নেমে যাবার জন্যে পা বাড়ালে।
শেষটায় সে এসে পৌঁছুলো একটা লম্বা, আয়ত, কুঠুরিতে, আর চৌকাঠের কাছে এসেই থমকে দাঁড়ালে। একটা সিঁড়ির ধাপে ব’সে একজন ব্ল্যাকগার্ড কুঠুরিটা পাহারা দিচ্ছে। জেনকে আসতে দেখেই সে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালে।
কিন্তু পরক্ষণেই আশ্বস্ত বোধ করলে সে। পাহারার কোনো বিরূপ মলব নেই। বরং সে এমনভাবে দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়িয়েছে, তার এই রাতের অতিথি যাতে সহজে পাশ দিয়ে যেতে পারে। এই অপ্রত্যাশিত সম্মান দেখে জেন তাকিয়ে দেখলে এই ব্ল্যাকগার্ডটিকে যে আগে তাদের ঘরে পাহারা দিতে দেখেছে। যে-হর্ষচরিতেরা সসম্মানে তাকে রাজভবনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছিলো তাদের মতোই এও জেনকে আগে স্বাধীনভাবে ইচ্ছেমতো সবখানে চলাফেরা করতে দেখেছে—সে হয়তো জানে যে তার প্রভু একে বিয়ে করতে চেয়েছেন। আর দোনোমনা না- ক’রে সে তাকে পাশ কাটিয়ে চ’লে গেলো। কিন্তু ঝামেলা তখনও মেটেনি। লোকটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার পরেই আছে একটা বন্ধদুয়ার।
বাইরে একটা বেজায় আত্মবিশ্বাসের ভাব দেখিয়ে জেন হ্যারি কিলারের চাবিটা তালায় ঢোকালে, অমনি আগের দরজাটার মতোই এটাও নিঃশব্দে খুলে গেলো। জেন নিজেকে দেখতে পেলে বেশ-লম্বা একটা করিডরের মধ্যে : দু-পাশে ডাইনে- বাঁয়ে দশ-বারোটা দরজা, পর-পর।
একটা ছাড়া সবগুলো দরজাই খোলা। যেতে-যেতে খোলা দরজাগুলো দিয়ে তাকালে জেন! ছোট্ট-সব কুঠুরি, হাজতঘর, অন্ধকার, আলো-হাওয়া ঢোকে না- স্যাঁৎসেঁতে, ঘরগুলোয় শুধু একটা ক’রে টেবিল আর নামকাওয়াস্তে একটা ক’রে বিছানা। তা বাদ দিলে ঘরগুলো ফাঁকাই প’ড়ে আছে-দেখে মনে হয় না অনেকদিন এখানে কেউ ছিলো।
এবার শুধু বন্ধ দরজাটাই বাকি। পর-পর তৃতীয়বার জেনের এই সবখোল চাবি ভেলকি দেখালে। অন্য-দুটো দরজার মতো, এটাও সহজেই খুলে গেলো।
ঘরের মধ্যেটায় গা-ছমছম করা অন্ধকার। গোড়ায় সে তাকিয়েও বুঝতে পারলে না এ ঘরের মধ্যে কী আছে। তারপর আস্তে-আস্তে সেই আবছায়া তার চোখে স’য়ে এলো, অন্ধকারের মধ্যেই সে দেখতে পেলে কে যেন কুণ্ডুলি পাকিয়ে আছে, বড়ো-বড়ো নিশ্বাসের শব্দ আসছে ঐ কুণ্ডলি থেকে।
যেন কোন অতিপ্রাকৃত শক্তিই তাকে ব’লে দিয়েছে, এখন সে দারুণ গুরুতর- কিছু আবিষ্কার করবে। জেনের বুক ঢিপঢিপ করছে, পা-দুটো কেমন যেন অবশ হ’য়ে আসছে, তার গায়ে যেন কোনো শক্তিই আর নেই; সে শুধু চুপচাপ কোনো ঘোরের মধ্যে চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে রইলো—তার চোখ আর কান যেন এই দুর্ভেদ্য অন্ধকারকে অবিরাম হাড়ে যাচ্ছে।
শেষটায় তার মনে প’ড়ে গেলো দরজার বাইরেই সে একটা বিজলিবাতির বোতাম দেখেছে। অন্ধকার থেকে চোখ না সরিয়েই হাত বাড়িয়ে সে বোতামটা টিপে দিলে।
কী তুলকালাম বিস্ময় অপেক্ষা করছে তার জন্যে? না কি কোনো অকথ্য বিভীষিকাই?
যে-প্রচণ্ড মনোবল তাকে কারখানা থেকে একটু-আগে এই রাজভবনে এনে হাজির করেছে, তাতে হয়তো এমনি আঁৎকে আঁৎকে উঠতোও না যদি এখন এই ঘরে দেখতে পেতো তার দাদা জর্জ ব্লেজনকে, সবাই যাকে জানে দশ বছর আগেই মারা গেছে ব’লে।
কেননা যে-অপ্রত্যাশিত দৃশ্য সে এখন দেখতে পেলে, তার কথা সে স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবেনি।
হঠাৎ-আলোর-ঝলকানিতে কুঠুরির এককোণে যে-লোকটা কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে ছিলো সে ধড়মড় ক’রে উঠে বসলো। গায়ে ছেঁড়া-কাঁথাই যেন তার, আর ছেঁড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে তার সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত, দেহটা কঙ্কালসার, চোখদুটো কোটরে, লোকটা দু-চোখে সাতরাজ্যের আতঙ্ক নিয়ে কোনোরকমে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলো।
দীর্ঘ নিপীড়নের সব চিহ্ন সত্ত্বেও, তার শুকিয়ে-যাওয়া মুখে ঝোপের মতো দাড়িগোঁফ সত্ত্বেও, মাথার জটপাকানো চুলের রুক্ষ গুচ্ছ সত্ত্বেও—জেন-এর একমুহূর্তও দেরি হয়নি বন্দীকে চিনতে।
অবিশ্বাস্য! আশ্চর্য! ব্ল্যাকল্যান্ডের এই মাটির তলার হাজতঘরে বন্দীকে চিনতে পেরে জেনের মাথায় যেন সব তালগোল পাকিয়ে গেলো। একে তো ছ-মাস আগে সে ইংলন্ডে দিব্বি নিশ্চিন্তে কাল কাটাতে দেখে এসেছে। মানুষের এই ধ্বংসাবশেষ, হ্যারি কিলারের নির্যাতনের এই শিকার-এ-যে লুইট্স রবার্ট ব্লেজন, তার আরেক দাদা!
খাবি খেলো যেন জেন। তার মুখ থেকে একটাও কথা সরছে না। শেষটায় ছুটে গেলো সে তার ছোড়দার কাছে, ‘লুইস!’ আর ততক্ষণে লুইস- বিমূঢ়, হতভম্ব, ভ্যাবাচাকা –তার মুখেও বিস্ময়ের স্বর ফুটেছে : ‘জেন!… তুই …. তুই এখানে!
পরস্পরের বুকে যেন ঝাঁপিয়েই পড়লো তারা, আর দুজনেই ভেঙে পড়লো কান্নায়, প্রথমে কিছুক্ষণ কারু মুখে কোনো কথা ফুটলো না।
তারপর অস্ফুট স্বরে লুইস শেষটায় বললে : ‘জেন! তুই! তুই কেমন ক’রে আমায় উদ্ধার করতে এলি!’
‘তোকে পরে বলবো সব,’ জেন বললে, ‘গোড়ায় তুই তোর কথাই বল। বল, তুই কী ক’রে এখানে এলি?
‘কী বলবো বল?’ হতাশায়, ধরাগলায়, বললে লুইস। ‘আমি নিজেই কি ছাই তার কিছু বুঝতে পেরেছি! পাঁচমাস আগে, ৩০শে নভেম্বর, আমার নিজের আপিশে, পেছন থেকে কেউ আমার ঘাড়ে এমন সজোরে ঘা মেরেছিলো যে আমি জ্ঞান হারিয়ে মেঝেয় লুটিয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরতে দেখি আষ্টেপৃষ্ঠে সারা গা বাঁধা, মুখে কাপড় গুঁজে দেয়া, একটা সিন্দুকে প’ড়ে আছি। কতভাবেই যে আমায় নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে ওরা-ঠিক একটা পার্সেলের মতো, মালের বোঁচকার মতো। এ কোথায় আছি, আমি? জানি না। চারমাসেরও বেশি হবে, এ-ঘর ছেড়ে মুহূর্তের জন্যেও আমি কোথাও বেরুইনি, আর প্রত্যেকদিন এরা আমায় অকথ্য যন্ত্রণা দিয়েছে- সাঁড়াশি দিয়ে গায়ের চামড়া ছিঁড়েছে, প্রচণ্ড-জোরে চাবকেছে…
‘ওঃ!… লুইস!… লুইস!’ জেন তখনও ফোঁপাচ্ছে। ‘কিন্তু কে তোকে অমনভাবে মারে?’
‘সেটাই সবচেয়ে অধম!’ লুইসের গলাটা কেমন ভেঙে গেলো। ‘এ-সব নৃশংস কাজ যে কে করে, তা তুই স্বপ্নেও ভাবতে পারবি না। সে হ’লো…’
হঠাৎ লুইস থেমে গেলো, কথা শেষ না-ক’রেই। তার বাড়ানো হাতটা দেখালো, করিডরে কার যেন ছায়া, আর তার চোখমুখে ফুটে উঠলো অবর্ণনীয় আতঙ্কের ছাপ।
জেন পেছন ফিরে তাকিয়েই ভয়ে কেঁপে উঠলো, মুখচোখ বিবর্ণ হ’য়ে উঠেছে তার, নিজের অজান্তেই তার হাত চ’লে গিয়েছে তার জামার ভেতর, চেপে ধরেছে সেই তীক্ষ্ণধার খঞ্জর, যেটা সে কুড়িয়ে পেয়েছিলো কুবোর গোরস্থানে। তার চোখ রক্তরাঙা, তার মুখের কষ বেয়ে ফেনা গড়াচ্ছে, সারা মুখচোখেই যেন কোনো বন্যজন্তুর হিংস্র উল্লাসে বিকৃত, কিম্ভূত, ভয়াল, ভয়ংকর, করাল-দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর কে?-হ্যারি কিলার!