১০. আমেদে ফ্লরেঁসের রণকৌশল
আগের দিনের সঙ্গে কী-যে উৎকট একটা তফাৎ এই ১৩ই এপ্রিয় সকালবেলার! আগের দিন সব ঝক্কিঝামেলা বাধাবিপত্তির অবসান হ’য়ে যাবে বলে ভেবেছিলেন সবাই, বন্দীদের মনে একটা উল্লাসের ছোঁয়া লেগেছিলো। অথচ আজ সব আশা উধাও, এবং সকলেই হতাশ এবং বিমর্ষ।
বাকি-রাতটা প্রায় কেউই ঘুমুতে পারেননি। প্রায় সকলেই নানাদিক থেকে আগাপাশতলা তন্নতন্ন ক’রে খুঁটিয়ে দেখেছেন পুরো বৃত্তান্তটা, অথচ এত-ভেবেও কোনো কুলকিনারা পাননি—এ-সব বাধাবিপত্তিকে অতিক্রম ক’রে যাবার কোনো উপায়ই দেখতে পাননি সামনে।
এমনকী মার্সেল কামারেও বুঝি কী-যে করবেন, ভেবে উঠতে পারছিলেন না। আরেকটা হেলিবিমান বানিয়ে নেয়া ছাড়া এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার আর- কোনো সম্ভাবনা আছে ব’লেই তাঁর মনে হয়নি। কিন্তু সমস্ত আশাভরসা শুধুমাত্র একটা যন্ত্রের ওপরই নির্ভর ক’রে থাকবে, এবং সেটা বানাতে দু-দু মাস লেগে যাবে, অথচ খাবারদাবার আছে মাত্র পনেরো দিনের উপযোগী-এ-অবস্থায় আত্মপ্রতারণারও কোনো অবকাশ নেই।
একটু খোঁজখবর নিয়ে আরো-যেটা জানা গেছে সেটাও মর্মান্তিক : আগে যতটা সহজে পালিয়ে যাওয়া যাবে ব’লে ভাবা হয়েছিলো, এখন সেটা আর কিছুতেই সম্ভব ব’লে মনে হচ্ছে না। ভাঁড়ারে কী আছে তার একটা হিশেব নেবার পর, ফলমূল শাকসব্জি যতটা পাওয়া যেতে পারে খতিয়ে দেখার পর, বোঝা গেছে এমনকী পনেরো দিনের খাবারও আর নেই—যা আছে তাতে বড়োজোর ন-দশ দিন চলতে পারে! দু-মাস তো দূরের কথা, এই এপ্রিলমাসটা কেটে যাবার আগেই অনাহারে ধুঁকতে শুরু করবেন তাঁরা!
সেই অনিবার্য বিপর্যয় যতদূর সম্ভব ঠেকিয়ে-রাখা যায়, সেই উদ্দেশ্যে এখন থেকেই সব খাবার র্যাশন ক’রে দেয়া হ’লো। পালানো যাক বা না-যাক, এই চারপাশের ঘেরাও যে-দুর্বিপাক ডেকে আনবে, অন্তত তাকে একটু বিলম্বিত করা যাবে এতে।
১৩ই এপ্রিলের গোটা সকালটাই কেটে গেলো ভাঁড়ারের হিশেব নিতে; আর অন্য-একটা দল তড়িঘড়ি লেগে গেলো হেলিবিমানের নির্মাণে—এই হেলিবিমান তৈরি করার পরে সে-বিমান যে তাঁদের উদ্ধার করবে, সে-আশা সুদূরপরাহত, তবু মার্সেল কামারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে-ক’রেই হোক যত-তাড়াতাড়ি-সম্ভব হেলিবিমানটা বানিয়ে ফেলতে হবে। ফলে কারখানার লোকজন শুধু বিকেলবেলাতেই আহত বন্দীর দিকে নজর দিতে পারলে।
এই-প্রথম এমন-একটা মধ্যাহ্নভোজ হ’লো, যেখানে খাবার বলতে বিশেষ- কিছুই ছিলো না। এই অতিথিদের আকস্মিক আবির্ভাবে এখন মার্সেল কামারের নিজের জীবনটাই বিপন্ন হ’তে বসেছে : তাঁর নিজের ভবিষ্যৎ আর তাঁর অতিথিদের ভবিষ্যৎ এখন একই সুতোয় বাঁধা প’ড়ে গেছে। খাবারটেবিলে ডাক্তার শাতোনে জানালেন, কাল রাতের সেই আহত বন্দী এখন অন্তত কথা বলার মতো অবস্থায় আছে। যে-ঘরটায় এই আহত গোরা-লোকটাকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো, মার্সেল কামারে অতিথিদের নিয়ে সে-ঘরে গিয়ে হাজির হলেন।
‘কেতুমি? কী তোমার পরিচয়?’ কামারে তাকে জিগেস করলেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হ’তে পারে এ-প্রশ্নটা শুধু-যে নিরীহ এবং অর্থহীন, তা নয়-একান্তই অবান্তর। কিন্তু কামারে মনে-মনে খুব ভেবেচিন্তে একটা ছক তৈরি ক’রে রেখেছিলেন।
বন্দী কোনো উত্তর দিলে না। কামারে আবারও ঠাণ্ডাগলায় সেই একই প্রশ্ন করলেন—কিন্তু তাতে কোনোই লাভ হ’লো না।
কামারে খুব মোলায়েমভাবে বললেন, ‘তোমাকে আমার হুঁশিয়ার ক’রে দেয়া উচিত—আমি তোমাকে দিয়ে কথা বলাবোই।’
এই হুমকিতে গোরা-লোকটার মুখ অবশ্য খুললো, তবে তার খোলা ঠোঁটের ফাঁকে একটা শ্লেষের হাসি ফুটে উঠলো—একটা মস্ত তাচ্ছিল্যের ভাব। তাকে দিয়ে কথা বলাবে? লোকটার কাছে এটা একেবারে অবিশ্বাস্য-একটা প্রস্তাব ব’লে মনে হয়েছে। আর সত্যি, অন্তত এই গোরা লোকটার চেহারাছিরি দেখে মনে হয়েছে তাঁরা এমন-একজন লোকের মুখোমুখি হয়েছেন যার শুধু-যে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস আছে তা নয়, সে-আত্মবিশ্বাস অটুট রাখার জন্যে গভীর মনোবলও আছে।
কামারে শুধু তাঁর কাঁধ ঝাঁকালেন। তারপর, কথা বলাবার জন্যে আর-কোনো চাপ না-দিয়ে, তার দুই বুড়োআঙুলে ও পায়ের তলায় চারটে ধাতুর পাত লাগিয়ে দিয়ে অনেক বোতাম লাগানো কী-একটা বৈদ্যুতিক যন্ত্রের সঙ্গে জুড়ে দিলেন, আর তারপরেই হঠাৎ একটা বোতাম টিপে দিলেন। কোনো কথা না ব’লেই, নীরবে।
তৎক্ষণাৎ লোকটার সারা শরীর কিম্ভূতকিমাকারভাবে খিঁচিয়ে উঠলো। ভয়াবহ সব অঙ্গবিক্ষেপ, তার ঘাড়ের শিরাগুলো এমন উৎকটভাবে ফুলে উঠেছে যেন এক্ষুনি ফেটে পড়বে, তার নীল-হ’য়ে-যাওয়া মুখটায় অসহ্য যন্ত্রণার ছাপ।
শুধু-কয়েকটা মুহূর্ত, তারপরেই কামারে বোতাম টিপে বিদ্যুৎপ্রবাহ থামিয়ে দিলেন। তেমনি মোলায়েমসুরে জিগেস করলেন : ‘কী? এখন কথা বলবে?’ তারপর, লোকটা যখন তবু চুপ ক’রে রইলো, তিনি বললেন, ‘বেশ। তবে আবার শুরু করা যাক।’
আবারও বিদ্যুৎচক্রের আবর্ত লোকটার সার শরীরে যেন আরো তীব্র যন্ত্রটা ছিটিয়ে দিলে। খিচুঁনি দিচ্ছে সারা শরীর, মুখটা যন্ত্রণায় বিকৃত। সারা কপালে ঘাম, চোখের তারা-দুটো বুঝি ঠিকরে বেরুবে, আর যেন কামারশালায় হাঁপর, এমনিভাবে তার বুকের খাঁচাটা উঠছে-নামছে।
আবারও বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ ক’রে দিয়ে কামারে নিচুগলায় জিগেস করলেন : ‘এবার কথা বলবে?’
‘হ্যাঁ…হ্যাঁ!’ লোকটা যেন তার সহ্যশক্তির শেষসীমায় গিয়ে পৌঁছেছে।
‘চমৎকার!… তাহ’লে বলো, তোমার নাম কী?’
‘ফার্গাস ডেভিড।’
‘এ তো কোনো নামই নয়,’ কামারে আপত্তি করলেন, ‘পদবি কী?’
‘ব্ল্যাকল্যান্ডে সবাই আমাকে ঐ নামেই ডাকে। আমার আসল নাম এখানে কেউই জানে না।’
তাতে কিছুই এসে যায় না। নাম কী তোমার?’
‘ড্যানিয়েল ফ্রাস্নে!’
‘দেশ?’
‘ইংলন্ড।’
ড্যানিয়েল ফ্রাস্নে—সেটাই তার আসল নাম—ঠিক করেছে কথা যদি বলতেই হয় তবে ছোটোখাটো দু-একটা কথাতেই সারবে। একটা-একটা ক’রে প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে সে, সংক্ষেপে
‘এবার আমি গোটাকতক খবর চাই। যদি গাঁইগুই করো, তো আবার এই মজার খেলাটা শুরু হ’য়ে যাবে। কী, যা জিগেস করবো, ঠিকঠাক জবাব দেবে তো?’
‘হ্যাঁ।’
‘প্রথমে বলো, ব্ল্যাকল্যান্ডে তুমি কী কাজ করো। এই শহরটার কোন রাজকার্য সামলাও তুমি?’
‘কৌশুলি।’
‘কৌশুলি?’ প্রশ্নের সুরে কথাটা আওড়ালেন কামারে।
ফ্রাস্নে একটু অবাকই হ’লো, বৈজ্ঞানিক এই কথাটা আগে কখনো শোনেননি ব’লে। সে ব্যাখ্যা ক’রে বললে : ‘হ্যারি কিলারের সরকারে যারা মন্ত্রণাসভায় বসতে পায়, তাদের ঐ নামেই ডাকা হয়। ‘
‘তাহ’লে আমি যদি তোমার কথার মর্ম বুঝে থাকি, তুমি ব্ল্যাকল্যান্ডের সরকারের সমস্ত কাজকর্মের শরিক?’
‘হ্যাঁ।’
‘এখানে কবে থেকে আছো তুমি?’
যবে থেকে ব্ল্যাকল্যান্ডের পত্তন হয়েছে।’
তুমি তার আগে থেকেই তবে হ্যারি কিলারকে চিনতে?’
‘হ্যাঁ।’
‘যখন তোমার সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় হয়, তখন তুমি কোথায় ছিলে?’
‘ব্রেজনের বাহিনীতে। ‘
এ-কথাটা শুনেই জেন ব্লেজন কেঁপে উঠলো। ভবিতব্য তার কাছে আরো- একজন সাক্ষী এনে দিয়েছে।
কিন্তু কামারে আবারও প্রশ্ন করেছেন : ‘রেজনের বাহিনীতে? তবে তোমাকে আমি চিনতে পারিনি কেন?’
‘নিশ্চয়ই অ্যাদ্দিনে আমার চেহারাটা পালটে গিয়েছে।’ ফ্রাস্নে প্রায় দার্শনিকের ভঙ্গিতে বললে : ‘তবে এটা ঠিক, মঁসিয় কামারে, আমি আপনাদের সঙ্গেই ছিলাম।’
আর ধৈর্য ধ’রে থাকতে না-পেরে, জেন রেজন এবার কথা বললে। ‘মাফ করবেন, মঁসিয় কামারে, কিন্তু আপনি কি দয়া ক’রে এর সঙ্গে দু-একটা কথা বলতে অনুমতি দেবেন আমায়।
কামারে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালে, জেন রেজন জিগেস করলে : ‘তুমি যখন ব্লেজনের বাহিনীতে ছিলে, তখন হ্যারি কিলার যখন হঠাৎ এসে আবির্ভূত হয়েছিলো, সেটা তুমি দেখেছিলে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কাপ্তেন ব্লেজন তাকে অমন সমাদর ক’রে অভ্যর্থনা করেছিলেন কেন?’
‘সে-সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না।’
‘এটা বলা কি সংগত হবে যে যেদিন থেকে হ্যারি কিলার বাহিনীতে এসে যোগ দিয়েছিলো, সেদিন থেকে সে-ই বাহিনীর সর্বেসর্বা হ’য়ে উঠেছিলো, তার সত্যিকার দলপতি?’
‘হ্যাঁ, ঠিক তা-ই হয়েছিলে,’ এতদিন-আগে কোন জঙ্গলে কী-সব ঘটেছে, সে- বিষয়ে এই প্রশ্ন শুনেই ফ্রাসনকে বেশ-একটু অবাকই দেখালো।
‘তাহ’লে হ্যারি কিলারের হুকুমেই রেজনের বাহিনী গ্রামের পর গ্রাম তছনছ ক’রে লুঠতরাজ চালিয়েছিলো? যেজন্যে পরে সরকারের বাহিনী এসে তাকে আক্রমণ করে?’
‘হ্যাঁ।’ ফ্রাস্নে সায় দিলে।
‘এইসব লুঠতরাজ অত্যাচারের সঙ্গে কাপ্তেন রেজনের কোনো যোগ ছিলো না?’
‘না।’
‘আপনারা সবাই শুনলেন তো?’ যেন তার সঙ্গীদের দিকে ফিরে বললে। তারপর আবার ফ্রাস্নেকে শুধোলে, : ‘কাপ্তেন ব্লেজন কেন সব কর্তৃত্ব হ্যারি কিলারের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন?’
ফ্রাস্নে একটু অধীরভাবেই : ‘তা আমি জানবো কী ক’রে?’
মনে হ’লো, ফ্রান্সে সত্যিকথাই বলছে। অন্তত জেনের মনে হ’লো আর জোরাজুরি ক’রে কোনো লাভ নেই। ‘আচ্ছা, তুমি কি এটা জানো কাপ্তেন ব্লেজন কেমন করে মারা গিয়েছিলেন?’
‘ওই…লড়াইতে!’ ফ্রাস্নে এমনভাবে জবাব দিলে যে এ নিয়ে প্রশ্ন করারই কোনো মানে হয় না। আরো অনেকেই ঐ লড়াইতে মারা গিয়েছিলো।’
জেন একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে। কাপ্তেন ব্লেজনের হত্যারহস্যের ওপর থেকে পর্দা সরাতে হ’লে ঠিক এমন উত্তর পেলে চলবে না। এখনও অনেক-কিছু ধোঁয়াটে থেকে গেছে। সে কামারের দিকে ফিরে বললে, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, মঁসিয় কামারে। আমার প্রশ্ন শেষ হ’য়ে গেছে।
কামারে যেখানে তাঁর জেরা বন্ধ করেছিলেন, সেখান থেকেই ফের শুরু করলে। ‘প্রথমে বলো, এই শহর যারা বানিয়েছে সেই আফ্রিকিদের তোমরা পেলে কী ক’রে?’
ফ্রাস্নের চোখটা গোল-গোল হ’য়ে গেলো। এমন হবার মতো প্রশ্ন আবার কেউ কখনও করে নাকি? হায়-কপাল, এ-ধরনের আজগুবি প্রশ্নের জবাব দেবার জন্যেই তাকে এমনভাবে নিপীড়ন করা হ’লো নাকি?
‘কোত্থেকে আবার? গাঁ থেকে। সেটা জানবার জন্যে কাউকে পণ্ডিত হ’তে হয় না।’
‘গাঁ থেকে তো বটেই, কিন্তু কীভাবে পেলে তাদের?’
ফ্রাস্নে তার যে-কাঁধটা ভেঙে যায়নি, সেটাই ঝাঁকালে। ‘সেই একই কৌশলে! যেন আপনি জানেন না! আমরা তাদের শুধু ঘেটি ধ’রে পাকড়ে নিয়ে এসেছি।’
‘আহ্!’…মার্সেল কামারের মাথাটা একটু নিচু হ’য়ে গেলো।
‘গোড়ায় তোমাদের অনেক কলকব্জা যন্ত্রপাতি দরকার হয়েছিলো। সে-সব এলো কোত্থেকে?’
‘এটা ঠিক যে, চাঁদ থেকে নয়!’ ফ্রাস্নে একটু টিটকিরির সুরেই বললে।
‘ইওরোপ থেকে এনেছো?’
‘সম্ভবত!’
‘এখানে সে-সব এলো কী ক’রে?’
‘এখানে সে-সব নিশ্চয়ই উড়ে এসে জুড়ে বসেনি…শুনুন, মঁসিয় কামারে, এ- সব ভারি-আজগুবি প্রশ্ন, অদ্ভুত! এখানে এ-সব যন্ত্র কী ক’রে আবার আসবে? জাহাজে ক’রে, সাগর পেরিয়ে, তা নিশ্চয়ই না-বললেও চলে।’
‘জাহাজ থেকে মাল খালাশ করা হয়েছিলো কোথায়?’
‘কোতোনুতে। ‘
‘কিন্তু কোতোনু থেকে ব্ল্যাকল্যান্ডের দূরত্বও তো কম নয়। এখানে সে-সব আনা হ’লো কী ক’রে?’
‘উটের বহরে ক’রে, ঘোড়ায়, নিগ্রোদের পিঠে,’ ফ্রাস্নে মুখ বেঁকিয়ে বললে, তার ধৈর্য বুঝি এবার ফুরিয়ে যাবে।
‘এত-লম্বাপথ পাড়ি দেবার সময় আফ্রিকিদের অনেকে নিশ্চয়ই পথেই মারা গিয়েছিলো?’
‘যত ক-টা জন্মেছে, তার চেয়েও ঢের-বেশি নিগ্রো ঢেঁশে গিয়েছে! ক-জন ঢেঁশে গেলো, গোনার ব্যাপারে আমার অন্তত আমোদ হয়নি।’
কামারে এবার অন্য প্রসঙ্গে গেলেন। ‘এই-সব যন্ত্রপাতি—তাদের জন্যে দাম দিতে হয়েছে নিশ্চয়? ‘
‘এ-যে কোন্ জাহান্নামে এসে পড়লাম!’ ফ্রাস্নের কাছে প্রশ্নগুলো ক্রমেই আবোলতাবোল আর অর্থহীন ব’লে মনে হচ্ছিলো।
‘তাহ’লে ব্ল্যাকল্যান্ডে টাকা আছে?’
‘ঐ একটা ব্যাপারে আমানের কোনো টানাটানি নেই।’
‘এ-টাকা এলো কোত্থেকে?’
এবার ফ্রাস্নে তার সব ধৈর্য হারিয়ে ফেললো। ‘আমার সঙ্গে ইঁদুর-বেড়াল খেলা আপনি কখন থামাবেন, মঁসিয় কামারে? এমন-সব অদ্ভুত প্রশ্ন করছেন যার উত্তর আপনিই আমার চাইতে অনেক ভালোই জানেন। এই হেলিবিমানগুলো নিশ্চয়ই আপনি কেবল আহ্লাদ করার জন্যে বানাননি? আপনি খুব ভালো ক’রেই জানেন যে হ্যারি কিলার আর তার সাগরেদরা প্রায়ই ঐ হেলিবিমানে ক’রে বিসাগো দ্বীপপুঞ্জে যায়, তারপর সেখান থেকে স্টীমারে ক’রে তারা ইওরোপে–বেশির ভাগ সময়েই ইংলন্ডে-যায়, ক-দিন ঘুরে-টুরে আবার ফিরে আসে। অন্তত আপনাকে নিশ্চয়ই ব’লে বোঝাতে হবে না যে ইওরোপে কতগুলো প্রতিষ্ঠান আছে তাদের লোকে ব্যাঙ্ক বলে, তাছাড়া বংশানুক্রমিকভাবে কঞ্জুষ-সব লোকজন যারা টাকা শুধু জমিয়েই রাখে, আর কত লোক আছে, যাদের সঙ্গে মাঝে-মাঝে এক-আধবার দেখা ক’রে আসা ভালো…কোনো আমন্ত্রণ বা অভ্যর্থনা বিনাই। তারপর দেখাসাক্ষাৎ শেষ হ’য়ে গেলে, তারা ফের এখানে ফিরে আসে—ইওরোপে কেউই তাদের চোখে দ্যাখেনি, কেউই তাদের কানে শোনেনি-কেউই জানে না এরা কে বা কারা?’
‘এ-রকম দেখাসাক্ষাৎ বুঝি প্রায়ই ঘটে?’ লজ্জায় কামারের মুখটা লাল হ’য়ে উঠেছে।
ফ্রাস্নে হাত উলটে একটা হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করলে। ‘বেশ… এতেই যদি আপনার মজা লাগে! যার যা রুচি…হ্যাঁ, ঐ ইওরোপ-সফর বছরে তিন-চার বার তো হয়ই!’
‘শেষ-সফরটা কখন হয়েছিলো?’
‘শেষটা?’ ফ্রাস্নে তার স্মৃতি হাতড়ালে। ‘দাঁড়ান, দাঁড়ান…মনে পড়েছে!…
চার মাস, কি সাড়ে-চার মাস আগে।’
‘আর এবার তারা কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলো?’
‘সেটা আমার ভালো জানা নেই। এ-যাত্রায় আমি তাদের সঙ্গে ছিলাম না। একটা ব্যাঙ্ক বোধহয়। তবে একটা কথা জানি যে আগে কখনও এত-বড়ো দাঁও আমরা মারিনি।’
একমুহূর্ত চুপ ক’রে রইলেন মার্সেল কামারে। বিবর্ণ দেখাচ্ছে তাঁকে, যেন নিমেষের মধ্যে তাঁর বয়স একলাফে দশ বছর বেড়ে গেছে। ‘আরেকটা কথা, ফ্রাস্নে। সবশুদ্ধু কত জন আফ্রিকি এই ব্ল্যাকল্যান্ডে কাজ করে?
‘তা, চার হাজার হবে। হয়তো আরো-বেশি।’
‘আর স্ত্রীলোক?’
তা প্রায় দেড় হাজার।’
‘আর এদের সবাইকেই নিশ্চয়ই ঐ একইভাবে ধ’রে আনা হয়েছে?’
‘না,’ ফ্রাস্নে তার শ্লেষটা বুঝতে না-দেবার চেষ্টা করেছে। এখন হেলিবিমানে করে তাদের ধ’রে-আনা যায়!’
‘হুঁ।…’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কামারে। তারপর একটু চুপ ক’রে থেকে জিগেস করলেন, ‘এখানে তুমি ঢুকলে কী ক’রে?’
উত্তর দেবার আগেই এই-প্রথম ফ্রাস্নে একটু ইতস্তত করলে। অবশেষে সরাসরি একটা গুরুতর বিষয়ে প্রশ্ন! এতক্ষণ উত্তর দিতে তাকে কোনো বিষয়েই দু-বার ভাবতে হয়নি, এবার সে একটু অপ্রস্তুত বোধ করলে। তবু উত্তর তো তাকে দিতেই হবে। মুখ বিকৃত ক’রে বললে : ‘জলাগারের মধ্য দিয়ে!’
‘জলাগারের মধ্য দিয়ে?’ কামারে অবাক হ’য়ে জিগ্যেস করলেন।
‘হ্যাঁ। পরশুদিন নদীর সব জলকপাট আটকে দেয়া হয়েছিলো যাতে আপনারা পাম্প ক’রে জল তুলতে না-পারেন। রাজভবনের জলাগারও শূন্য হ’য়ে গিয়েছিলো। কারখানায় যে-জলাগারটা জলশূন্য হ’য়ে যায়, এপ্ল্যানেডের তলা দিয়ে সেটায় যাবার জন্যে রাজভবন থেকে মাটির তলা দিয়ে মস্ত নল গেছে। ৎশুমুকি আর আমি ঐ নল দিয়ে এখানে আসি।’
কয়েক ঘণ্টা আগেই কামারে জেনেছিলেন যে পাম্পটা আবার বসানো হ’য়ে গেছে, আর সেটা বেশ ভালোভাবেই কাজ করছে। খবরটায় তখন তিনি কোনো গুরুত্ব দেননি। এখন তিনি বুঝতে পারলেন, ৎশুমুকির ও-রকম বীভৎস মৃত্যুর পর তার কাজটা হাঁসিল হ’য়ে গেছে দেখে ফের জলকপাটগুলো খুলে ফেলবার নির্দেশ দিয়েছে হ্যারি কিলার আর তাইতেই এখন পাম্প আবার জল তুলতে পারছে।
‘বেশ। ধন্যবাদ।’ আর-কোনো প্রশ্ন না-ক’রেই কামারে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। যা তিনি জানতে চেয়েছিলেন, সব এখন জেনে গিয়েছেন।
কাজেই খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে চললো তেরো তারিখ, চোদ্দই এপ্রিলেও নতুন-কোনো ঘটনা ঘটলো না। তেমনি কঠোরভাবে ঘিরে আছে চারপাশ থেকে হর্ষচরিতেরা। নদীর ঘাটে আর এস্প্ল্যানেডে হর্ষচরিতেরা সশস্ত্র দাঁড়িয়ে আছে, আর তাদের দৃষ্টি যেহেতু সার্কুলার রোদ অব্দি যায়, কারখানার সবদিকেই যেহেতু এই দুই জায়গা থেকে নজর রাখা যায়, কারু পক্ষেই কারখানা ছেড়ে বেরুবার কোনো উপায় নেই। এ-কথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে অদূর-ভবিষ্যতে এই অবস্থার কোনো বদল হবে—ফলে অচিরেই এমন-একদিন আসবে, অনাহারে ধুঁকতে ধুঁকতে কারখানাকে বিনা-শর্তে রাজভবনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
এই অনস্বীকার্য অস্বস্তিকর তথ্যটাই আমাদে ফ্লরেঁসকে একটানা ভাবিয়ে চলেছিলো। হেলিবিমান ধ্বংস হ’য়ে যাবার পর থেকেই তিনি এই বেড়াজাল থেকে কী ক’রে বেরুনো যায়, তারই কথা ভেবে আসছিলেন। কিন্তু কোনো উপায় বার করতে না-পেরে নিজের ওপরেই বিষম রাগ হচ্ছিলো তাঁর। অবশেষে, সারাক্ষণ মাথা খাটিয়ে, চোদ্দ তারিখ সন্ধেবেলায় কুটুশ ক’রে এক ভাবনার পোকা তাঁর মগজে কামড়ে দিলে। সবদিক থেকে খুঁটিয়ে দেখে ফন্দিটা তাঁর কাছে বেশ প্ৰতিশ্ৰুতিমূলকই মনে হ’লো। পরদিন সকালে তোঙ্গানের সঙ্গে কী নিয়ে যেন অনেকক্ষণ ধ’রে আলোচনা করলেন তিনি; তারপর তাঁর সঙ্গীদের বললেন তাঁর সঙ্গে কামারের কাছে আসতে; কামারেকে নাকি কী-একটা অত্যন্ত জরুরি কথা বাৎলাবার আছে তাঁর।
ফ্রান্সকে সেই জেরা করার পর থেকে বৈজ্ঞানিককে আর কখনও চোখেই দ্যাখেননি কেউ। সেই-যে তিনি গিয়ে তাঁর নিজের ডেরায় ঢুকেছেন, সেখান থেকে আর-একবারও বেরোননি। আর সেখানে, একেবারে-একা, তিনি নিজে-নিজেই যুঝেছেন নিজের বিবেকের সঙ্গে, সান্ত্বনাহীন, উপশমহীন, আর যেন মাথাঘোরানো কোনো শিখর থেকে তাকিয়ে আছেন চেতন-অবচেতনের পরপারে!
এতদিনে পুরো সত্যটা তাঁর হৃদয়ঙ্গম হয়েছে। এতদিনে তিনি তর্কাতীতভাবে জেনেছেন যে ব্ল্যাকল্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছে খুনজখমরাহাজানি ও দস্যুবৃত্তির ওপর নির্ভর ক’রেই। জেনেছেন যে, ইওরোপ ও আফ্রিকা দুটো মহাদেশই হ্যারি কিলারের ও তার স্যাঙাৎদের হিংসাহিংস্রতার লীলাভূমি হয়ে উঠেছে—ভিন্ন-দুই ধরনে। শহরে যে সোনার এত ছড়াছড়ি, সে-সম্বন্ধে এখন আর চোখ বুঝে থাকার কোনো উপায়ই নেই। আর সেই সোনার দৌলতেই কি না এতদিন অবাধে তিনি নিজের সমস্ত পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে এসেছেন! ব্রেজনের বাহিনীর লুঠতরাজরাহাজানি ও নৃশংস অত্যাচার, কাপ্তেন ব্লেজনের নির্মম ও বিবেকহীন হত্যা, অসহায় আফ্রিকিদের ওপর অবিরাম শোষণ ও নিপীড়ন, গ্রাম থেকে গ্রাম উজাড় ক’রে শ্রমিকদের ধ’রে নিয়ে- আসা, আফ্রিকা ও ইওরোপ দস্যুতা ও খুনজখম, এবং বারজাক মিশনের ওপর এই বর্বর হামলা—সবকিছুর মানে এখন তিনি জানেন।
আর এইসব অগুনতি দুষ্ক্রিয়ার সঙ্গেই তিনি কি না আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছেন! নিজে প্রত্যক্ষভাবে কিছু করেননি বটে, কিন্তু তাঁরই আবিষ্কার কি এইসব দুষ্কর্মের পথ সুগম ক’রে দেয়নি? গত দশ বছর ধ’রে সত্যিকার-এক বিভীষিকার মধ্যে সারাক্ষণ কাটিয়েছেন তিনি, অথচ কিছুই জানবার চেষ্টা করেননি কত ধানে কত চাল। অন্ধ হ’লে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? চিরকালই প্রতিভা ও মত্ততার মাঝখানে সংকীর্ণ রজ্জুর ওপর দিয়ে হেঁটেছেন তিনি, অস্থির, নিয়ন্ত্রণবিহীন; আর এখন আচমকা এই বিপুল ঘা পড়েছে তাঁর চৈতন্যের ওপর, বিবেকের ওপর। এখন এই ব্ল্যাকল্যান্ডের কথা ভাবলেই তাঁর বমি পাচ্ছে, সারা গাটা রী-রি করে উঠছে, অথচ এই ব্ল্যাকল্যান্ড কি না তাঁরই নিজের প্রতিভার সৃষ্টি! এই আশ্চর্যের পিরামিড কি না গ’ড়ে উঠেছে তাঁরই ধ্যানে-অনুধ্যানে, তাঁরই কাজের প্রেরণার। সেটাকে যারা এভাবে কলুষিত ক’রে দিয়েছে, তারা কি কোনো সাজাই পাবে না? এত অপকর্মের জন্মস্থল, এই ব্ল্যাকল্যান্ড কি গোড়া থেকেই অভিশপ্ত নয়?
আমেদে ফ্লরেঁস এবং তাঁর সঙ্গীরা এসে দেখতে পেলেন মার্সেল কামারে এ- সব চিন্তাতেই কাতর ও মোহ্যমান। হাত-পা ছড়িয়ে এলিয়ে আছেন তাঁর আরামকেদারায়, নিশ্চল, অনড়, চোখদুটোর দীপ্তি উধাও, যেন তাঁর সমস্ত জীবনশক্তিই কেউ নিংড়ে মুচড়ে বার ক’রে দিয়েছে। এই-যে দু-দিন কারু সঙ্গে তাঁর একবারও দেখা হয়নি, এই দু-দিনে তিনি একদানা খাদ্যও গ্রহণ করেছেন কি না সন্দেহ!
এমন লোক আমেদে ফ্লরেঁসের কোন্ কাজে লাগবে? তিনি চান অতীতের সেই উদ্বুদ্ধ উদ্দীপ্ত প্রতিভাকে, সৃষ্টিকর্তাকে! ফ্লরেঁসের নির্দেশে তোঙ্গানে কিছু খাবার নিয়ে আসতে গেলো। কামারে বাধ্য অনুগত ছেলের মতো সব খাবার খেলেন বটে, কিন্তু খেয়ে তাঁর যে কোনো তৃপ্তি হয়েছে এমন কখনও মনে হ’লো না। খাওয়া শেষ হ’লে অবশ্য তাঁর বিবর্ণ মুখটায় যেন একটু রক্ত ফিরে এলো।
‘আপনাদের সবাইকেই যে আমি এখানে ডেকে এনেছি,’ ফ্লরেঁস ব্যাখ্যা ক’রে বোঝালেন, ‘তার কারণ হ’লো আমি এই বেড়াজাল থেকে বেরুবার একটা উপায় বার ক’রে ফেলেছি। পুরো ব্যাপারটা খুঁটিয়ে দেখে আমি এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে আমাদের নিরাশ হবার কোনোই কারণ নেই–অজস্র লোক আছে আমাদের দলে, আমাদের বন্ধু—যাদের সাহায্য আমরা অনায়াসেই পেতে পারি, কারণ তারা আমাদের নাগালের মধ্যেই আছে।’
‘কোন্ বন্ধু?’ বারজাক আর ডাক্তার শাতোনে প্রায়-একসঙ্গেই একই প্রশ্ন ক’রে বসলেন।
‘গোলামখানার ঐ আফ্রিকিরা, দাসত্ব ছাড়া যাদের হারাবার আর-কিছু নেই, ‘ ফ্লরেঁস বললেন, ‘অন্তত চার হাজার আফ্রিকি আছে এখানে, মেয়েদের কথা না- হয় আমরা ছেড়েই দিলুম—আর একবার ছাড়া পেলে তারা প্রত্যেকেই একেকজনের দুজনের সমান হয়ে উঠবে। এই একটা প্রকাণ্ড শক্তি আছে আমাদের চারপাশে, আমার মনে হয় তাদের আদৌ হেলাফেলা করা আমাদের উচিত হবে না।’
‘সেটা না-হয় বুঝলুম,’ বারজাক সায় দিয়ে বললেন, ‘কিন্তু তাদের তো কোনো অস্ত্রশস্ত্র নেই, আর তারা হয়তো জানেও না যে আমরা এই ব্ল্যাকল্যান্ডে আছি।’
‘সেইজন্যেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ক’রে এক্ষুনি তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে হবে আমাদের,’ আমেদে ফ্লরেঁসের গলার স্বরে কোনো দ্বিধা নেই।
‘এ-কথা বলা ভারি সহজ,’ বারজাক দ্বিধার সুরে বললেন।
‘বলাও সহজ, এবং সম্ভবত করাও সহজ, ফ্লরেঁস বললেন।
‘তাই নাকি? অস্ত্রশস্ত্রের কথা না-হয় বাদই দিচ্ছি, ঐ আফ্রিকিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে কে যাবে, শুনি?’
‘তাদেরই মতো আরেকজন আফ্রিকি : তোঙ্গানে।’
‘কিন্তু গোলামখানায় সে যাবে কী ক’রে? আপনি ভালোই জানেন, কারখানাকে ওরা চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে। তাকে দেখতে পেলেই একঝাঁক বুলেট তাকে অভ্যর্থনা জানাবে।’
‘সেইজন্যেই সে কারখানার দরজা খুলে কারখানা থেকে বেরুবে না। তাছাড়া তাতে আমাদের কোনো কাজও হ’তো না। কারখানার বাইরেই গোরাদের আস্তানা। আর তোঙ্গানেকে গিয়ে পৌঁছুতে হবে কালোদের মধ্যে। ফলে তাকে যা করতে হবে, তা সে আগেই একবার করেছে। রাতের অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে তাকে চাষের জায়গায় চ’লে যেতে হবে, সেখানে গিয়ে অন্য আফ্রিকিদের মধ্যে তাকে মিশে যেতে হবে, আর তারপর তাদেরই সঙ্গে তাকে শহরে এসে ঢুকতে হবে।’
‘তাহ’লে তো তাকে দেয়ালটা টপকে সার্কুলার রোডটা দিয়ে যেতে হবে?’
‘কিংবা মাটির ওপর দিয়ে না-গিয়ে, তার তলা দিয়ে যেতে-হবে,’ এতক্ষণে ফ্লঁরেস সরাসরি কামারের দিকে তাকালেন।
কিন্তু চিন্তায় যেন আগাগোড়া মুড়ি দিয়ে আছেন কামারে, এই-যে আলোচনা হচ্ছে তার কিছুই যেন তাঁর কানে ঢোকেনি
‘মঁসিয় কামারে,’ ফ্লঁরেস তাঁকে জিগেস করলেন, ‘কারখানার দেয়ালের তলা দিয়ে কি কোনো সুড়ঙ্গ খোঁড়া সম্ভব হবে—যেটা সার্কুলার রোড পেরিয়ে গিয়ে সোজা চাষের জমিতে পৌঁছুবে?’
মাথা না-তুলেই কামারে বললেন : ‘সম্ভব।’
কতদিন লাগবে কাজটায়?’
কামারে একটুক্ষণ চুপ ক’রে কী ভাবলেন। ‘সাধারণ অবস্থায় যদি কোনো সুড়ঙ্গ খুঁড়তে হ’তো তাতে তবে অনেকদিন লেগে যেতো। কিন্তু পুরো ঝামেলাটাই এড়ানো যাবে একটা যন্ত্রের সাহায্যে যার কথা আমি এক্ষুনি ভেবে ফেলেছি। বেলেজমিতে এ-যন্ত্রটা চমৎকার কাজ দেবে। যন্ত্রটা তৈরি ক’রে সুড়ঙ্গ খুঁড়তে-খুঁড়তেই যদি এগুতে হয়, তবে পনেরো দিনের মধ্যেই কাজটা সেরে ফেলা যাবে।’
‘তাহ’লে এপ্ৰিলমাস শেষ হবার আগেই কাজটা আপনি ক’রে ফেলতে পারবেন?’
‘নিশ্চয়ই।’
যে-মুহূর্তে কেউ তাঁর কাছে একটা সমস্যা এনে হাজির করেন, অমনি কামারে যেন নতুন ক’রে আবার প্রাণ ফিরে পান, উদ্দীপ্ত হ’য়ে ওঠেন। তাঁর মাথা যেই এ-সমস্যাটায় খেলতে শুরু করেছে অমনি তাঁর বয়েস যেন আবার অনেকটাই ক’মে গিয়েছে।
‘আরেকটা কথা, মঁসিয় কামারে। সুড়ঙ্গটা বানাতে কি কারখানার সব কর্মীকেই হাত লাগাতে হবে? ‘
‘হ্যাঁ, আমার বেশ-কিছু লোক লাগবে।’
‘যারা সুড়ঙ্গ বানাবার কাজে লাগবে না-তারা কি ঐ সময়ের মধ্যে তিন-চার হাজার অস্ত্র বানাতে পারবে?’
‘কী ধরনের অস্ত্র? বন্দুক-পিস্তল বানানো যাবে না।’
‘বর্শাবল্লম, ছুরিকৃপাণখঞ্জর, কুড়ুল, মুগুর – যা খুশি—কাটতে, বেঁধাতে, গায়ের জোরে কষাতে যা-যা লাগবে, তা-ই।’
হ্যাঁ, সেক্ষেত্রে—বানানো যাবে বৈ কি! ‘
‘আর এই অস্ত্রশস্ত্র—সেগুলো কি হ্যারি কিলারের লোকজনের চোখে ধুলো দিয়ে গোলামখানায় পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে? ‘
‘সেটা একটু কঠিন কাজ,’ কামারে শান্তগলায় বললেন। একটু থেমে, কী ভেবে, আবার বললেন : ‘হ্যাঁ, তাও করা যাবে, যদি রাতটা ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকে।’
আমাদে ফ্লরেঁস অমনি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেন। ‘তাহ’লে এ-যাত্রায় আমরা বেঁচে গেলুম। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, মঁসিয় কামারে, তোঙ্গানে সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে যাবে, বাইরে চাষের জমির কাছে অপেক্ষা করবে, কখন কালো শ্রমিকরা এসে হাজির হবে, তারপর তাদের সঙ্গে মিশে যাবে, আর সে-দিন সন্ধেয় সে তাদের সঙ্গে শহরে ফিরে আসবে। রাত্রিবেলায় সে বিদ্রোহের ডাক দেবে এই দুর্ভাগা লোকগুলো সবাই এত অসুখী এখানে, সাধ ক’রে কি কেউ দাসের জীবন কাটাতে চায়, সে শুধু তাদের বলবে কাঁধের জোয়াল খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে, শৃঙ্খল ছাড়া তাদের হারাবার কিছু নেই, অস্ত্র হাতে পাবামাত্র তারা সংগঠন করবে বিদ্রোহ। আপনি যখনই তাদের অস্ত্র জোগাবেন, তারা আর একমুহূর্তও সময় নষ্ট করবে না। আপনাকে কিন্তু এক্ষুনি কাজে লেগে পড়তে হবে, মঁসিয় কামারে!’
‘আমি এর মধ্যেই কাজে লেগে গিয়েছি,’ কামারের কাছ থেকে শুধু এই উত্তরটাই এলো। বাস্তবিকই, ততক্ষণে তিনি একটা নকশা তৈরি করতে লেগে গিয়েছেন।
আমেদে ফ্লরেঁস সকলের চোখের সামনে বিদ্রোহের যে-ছবি তুলে ধরেছিলেন, তাতে গোটা কারখানা যেন উদ্দীপ্ত হ’য়ে উঠেছে। হ্যাঁ, এটাই একমাত্র রাস্তা। এই এত হাজার লোকের সাহায্য না-চাওয়া তাদের পক্ষে বোকামিই হ’তো। কী ক’রে যে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে, কামারে আশ্বাস দেবার পর, সে-সম্বন্ধে কারু মনেই কোনোই সন্দেহ থাকেনি।
পরের দিন থেকেই হেলিবিমান নির্মাণের কাজ বন্ধ ক’রে দেয়া হ’লো। সব কর্মীই কাজে ব্যস্ত, কেউ অস্ত্র বানাচ্ছে, কেউ-বা কামারের সেই যন্ত্র বানাচ্ছে যেটা মাটির তলা দিয়ে যাবে। বাকিরা সারাক্ষণ বাইরের দেয়ালের পাশে মাটি খুঁড়ছে, দেয়ালের আড়ালে, যাতে রাজভবন থেকে এই বিপুল উদ্দীপনার কিছুই চোখে না-পড়ে। যে-মস্ত কূপটা খোঁড়া শুরু হয়েছিলো, একুশে এপ্রিলের মধ্যেই তা তিরিশ ফিট গভীর হ’য়ে গেছে। কামারের মনে হ’লো সেটাই যথেষ্ট, সেখানে এবার শুরু হ’লো মাটির উপরিতলের সমান্তর একটা রাস্তা বানানো। আর সেটা সহজে করবার জন্যে পনেরো ফিট লম্বা আর চার ফিট চওড়া একটা শঙ্কু তৈরি করেছেন, খোন্তার মতো; একটা মস্ত চাকার মতো তাতে খাঁজ কাটা। একটা বিদ্যুতে-চলা মোটর এই খোন্তা ও বেলচার সংমিশ্রণকে চালায়, বেলেমাটির মধ্যে গন্ধগোকুলের মতো পথ খুঁড়ে-খুঁড়ে সে এগোয়, প্রায় যেন একটা স্ক্রুর মতো ঐ মাটিতে ডেবে যায়, আর ঐ বেলচা ভেতর থেকে মাটি তুলে আনে। এই মস্ত চাকার মতো দেখতে শঙ্কুল বেলচা/খোন্তার পেছন-পেছন মাটিতে ঢুকেছে মস্ত-একটা সিলিন্ডার, ঐ একই মাপের, ভেতরটা ফাঁপা, অর্থাৎ সুড়ঙ্গটা খোঁড়া হ’য়ে গেলে তার মধ্যে থাকবে ধাতুর একটা নল, প্রায় দেড়শো ফিট লম্বা।
এত-সব নানাধরনের কাজে কারুই যখন আর দম ফেলবার কোনো সময় নেই, কামারেকে কাজের জায়গায় মাত্র ক্বচিৎ-কখনও দেখা গেছে। যখনই এসেছেন তখনই তাঁকে দেখিয়েছে বিমর্ষ, কোনো মুশকিল আসানের সময় ছাড়া তিনি যেন কিছুতেই কাজের জায়গায় দেখা দিতেই চান না। সমস্যার সমাধান ক’রেই আবার অন্তর্ধান করেন কামারে, নিজের ডেরায় দরজা বন্ধ ক’রে রাখেন, তাঁর খাশ পরিচারক জ্যাকো তাঁর খাবার এনে দেয়, সেখানে একাই ব’সে-ব’সে দু-এক কুটো খাবার দাঁতে কাটেন।
সুড়ঙ্গটা কিন্তু তাঁর ছক-মতোই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ হ’য়ে গেলো। তিরিশে এপ্রিল ভোরবেলাতেই দেড়শো ফিট লম্বা নলটা পাতা হ’য়ে গেলো মাটির তলায়, আর, তা না-হ’লে বিষম মুশকিলই হ’তো; সাতাশে থেকেই খাবারে টান প’ড়ে গিয়েছিলো, র্যাশনে এমনিতেই কম খাবার দেয়া হচ্ছিলো, এবার যা খাবার দেয়া হ’লো, তা নেহাৎই নামেমাত্ৰ।
অনাহারে থাকলে এমনিতেই মেজাজটা খিটখিটে হ’য়ে ওঠে। কারখানাতেও এর কোনো ব্যত্যয় হয়নি। যদিও সবাই ভূতের মতো খাটছে, কেননা এই কাজের ওপরই তাদের জীবনমরণ নির্ভর ক’রে আছে, তবু মুখগুলো শুকিয়ে গেছে সবার, কথায়-কথায় খিটমিটি বেঁধে যাচ্ছে। যে-পরিচালককে এতদিন তারা প্রায় দেবতার আসনে বসিয়েছিলো তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার ভাব এবার হয়তো একটু যেন কমেছে— সেই অন্ধভক্তি আর নেই। কেননা যাঁকে তারা ভাবতো জাদুগরের মতো সবকিছুতেই ভেলকি দেখাতে পারেন, সেই-তিনি যখন তাদের ক্ষুধার অন্ন জোগাতে পারছেন না, তখন তাঁর প্রতি এদের ভক্তি একটু চ’টে যাবে বৈ-কি!
তাছাড়া একটা কিংবদন্তিও রচিত হচ্ছিলো ধীরে-ধীরে, রাজভবনের সঙ্গে শত্রুতা শুরু হবার আগে কামারে যখন জেন ব্লেজনের সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন, সেই কথা থেকেই তার উৎপত্তি। গোড়ায় হ্যারি কিলার যে তাকে পছন্দ করেছে এই ব্যাপারটায় কেউই তেমন গুরুত্ব আরোপ করেনি, বরং ভেবেছে তার স্বৈরাচারী খামখেয়ালিপনারই বুঝি আরেকটা দৃষ্টান্ত। কিন্তু এখন যখন অবস্থা ক্রমেই আয়ত্তের বাইরে চ’লে যাচ্ছে, বিশেষ ক’রে খিদে যখন মাথার মধ্যেটাই ঘুলিয়ে দিচ্ছে, তখন হ্যারি কিলারের খামখেয়ালটাকেই ভীষণ-গুরুত্বপূর্ণ ব’লে মনে হ’লো— যদিও হ্যারি কিলার নিজে বোধহয় সে-কথা অ্যাদ্দিনে বেমালুম ভুলে গিয়েছে। ভাবনাটা একবার কর্মীদের মাথায় হানা দেবার পর সেটাকে আর-কিছুতেই তাড়ানো যাচ্ছিলো না। এ যেন প্রায়-প্রতিষ্ঠিত সত্য-তর্কাতীত। তাদের যে এত বাধাবিপত্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে, তাদের যে এখন অনাহারে দিন কাটছে, তার কারণ মিস জেন ব্লেজনের ঐ চমকপ্রদ দেহসৌষ্ঠব। যদি সে হ্যারি কিলারকে বিয়ে করতে রাজি হ’য়ে যায়, তাহ’লেই সব ঝামেলা মিটে যাবে। মাত্র একজনের জন্যে এত লোককে ভুগতে হচ্ছে! তার আত্মবিসর্জনেই যদি সব সমস্যার সমাধান হ’য়ে যায়, তবে তাতে আর আপত্তি কেন!
কর্মীদের মধ্যে যে-এরকম একটা ধারণা ক্রমেই শেকড় চাড়িয়ে দিচ্ছে এটা জেনের মোটেই অগোচর থাকেনি। দু-একটা টিপ্পনী যা কানে গেছে, দু-একবার এমন-বিশ্রীভাবে লোকে তার দিকে তাকিয়েছে যে জেনের বুঝতে মোটেই বাকি থাকেনি সবাই তার ওপর কেমন অসন্তুষ্ট হ’য়ে আছে। নিজে সে তাদের ধারণাকে কোনোই গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু এতজন লোক যে এককাট্টা হ’য়ে একই জিনিশ ভাবছে, এটা তার ওপর খানিকটা ছাপ ফেলেছে বৈ-কি! কাজেই আস্তে-আস্তে তারও মনে হয়েছে সে যদি হ্যারি কিলারের কাছে ধরা দেয়-সেটা তার পক্ষে আত্মহত্যারই শামিল হবে–তবু তো এতগুলো নিরীহ লোক রক্ষা পাবে! কী ক’রে সে তার দাদার হত্যাকারীর সঙ্গে থাকবে! সে বরং ম’রে যাবে, তাও সই, তবু ককখনো তা হ’তে দেবে না। কিন্তু তবু এতগুলো লোককে বাঁচানো তার কর্তব্য—সে না- হয় এদের বাঁচিয়ে দিয়ে তারপরই আত্মহত্যা করবে!
ক্রমেই এই ব্যাপারটা তার মধ্যে এমন দানা পাকিয়ে গেলো যে একদিন সে তার বন্ধুদের কাছে কথাটা খুলে বললে। নিজের ভীরুতাকে ধিক্কার দিলে সে, বললে যে হ্যারি কিলারের কাছে গিয়ে সে আত্মসমর্পণ করবে, শুধু একটা শর্তে, যে, বাকি সবাই ছাড়া পাবে। শুনে, সাঁৎ-বেরার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। আমেদে ফ্লরেঁস তো খেপে-আগুন। ‘আপনি আমাদের সকলের অসম্মান করতে চাচ্ছেন। আর তাও আবার অকারণে, যা থেকে কারুই কোনো লাভ হবে না! হ্যারি কিলার নিজের ক্ষমতায় এতটাই আস্থা রাখে যে সে ধ’রেই নিয়েছে একদিন- না-একদিন সে আপনাকে বাগে পাবেই—এবং তার জন্যে তাকে কোনো দামই দিতে হবে না! তাছাড়া, এটাও জেনে রাখুন, হ্যারি কিলার কোনোদিনই তার কোনো প্রতিশ্রুতি রাখবে না! তার কোনো কথায় যে বিশ্বাস করে সে একটা আকাট বোকা।’
বারজাক, ডাক্তার শাতোনে, এমনকী মঁসিয় পসাঁও—যিনি সাত চড়েও রা কাড়েন না—সবাই ফ্লরেঁসের কথাতে এমন জোর দিলেন যে জেনকে আপাতত এই শহিদ হবার আজগুবি আশঙ্কা থেকে স’রে আসতে হ’লো। তাছাড়া এবার যখন সুড়ঙ্গ টা তৈরি হ’য়ে গেছে, তাতে এমন প্রস্তাব একেবারেই অর্থহীন। আর তো কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তোঙ্গানে ঐ সুড়ঙ্গপথে পালাবে, আর পরদিনই সে নিশ্চয়ই বিদ্রোহের সংকেত দিয়ে, কারখানার সবাইকে মুক্তি দেবে।
যদি ব্ল্যাকল্যান্ডের নগরপরিকল্পনার সময় ছকটা ঠিকঠাক অনুসরণ ক’রে হয়ে থাকে, তাহ’লে নদীর উজানের দিকটায় কারখানায় দেয়ালের মুখোমুখি দুটো দেয়ালের কোণা দাঁড়িয়ে আছে, একটা শাদাদের আস্তানার দেয়াল, অন্যটা কালোদের বস্তির দেয়াল। ঐ কোণাটা থেকেই, তোঙ্গানে সংকেত করবে—যদি অবস্থা ভালো বোঝে—অস্ত্র পাঠাতে। সেইজন্যেই পয়লা মে সন্ধেবেলায় কারখানার সকলেই ঐ কোণাটার দিকে উদ্গ্রীব হ’য়ে তাকিয়েছিলো। রাঙানদীর কাছে, কর্মীদের কোয়ার্টারের পাশে, কামারে একটা মাচা তৈরি ক’রেছিলেন। সেটার ওপর উঠেই সকলে দলে- দলে এই গোরা-কালো মহল্লার সন্ধিস্থলের দেয়ালটার দিকে অনিমেষ লোচনে তাকিয়েছিলো।
প্রথম চেষ্টাগুলো যে মাঠেই মারা যাবে, এটা মোটামুটি আন্দাজ করাই ছিলো। তোঙ্গানের সব উদ্যম যদি সফলও হয়, তবে সে-তো সদ্য এসে পৌঁছুবে কালোদের বস্তিতে। সবকিছু বুঝিয়ে ব’লে বিদ্রোহের ডাক দিতেও তো তার খানিকটা সময় লাগবে।
কিন্তু পরদিনও যখন কোনো সংকেত এলো না, কারখানা তখন একটু অস্বস্তিতে প’ড়ে গেলো। তবে নিজেদের সবাই এই ব’লে বোঝালে যে পূর্ণিমার রাতে এমনিতেই অস্ত্র পাচার করা মুশকিল হ’তো। কিন্তু তেসরা মে কারখানার উদ্বেগ যেন প্রায় অসীমে পৌঁছুলো, কারণ সেদিন সারাদিনই আকাশে মেঘের আনাগোনা ছিলো, মেঘ ছিঁড়ে সন্ধের সময় একবারও চাঁদ বেরুতে পারেনি। তোঙ্গানের এই ব্যর্থতা আরো-উৎকণ্ঠা জাগালে এইজন্যেই যে সেদিনই সবাই শেষকণা খাবার শেষ ক’রে ফেলেছে। দু-দিন, বড়ো-জোর তিনদিন, তারপরেই হয় তারা সফল হবে, নয়তো আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে, আর নয়তো সবাই উপোস ক’রেই মরবে।
কারখানার কাছে মনে হ’লো চৌঠা মের দিনটা যেন আর শেষ হবে না। অধীরভাবে সবাই অপেক্ষা ক’রে আছে কখন সন্ধে নামে, কখন অন্ধকার হয়। কিন্তু সেদিনও কালোদের বস্তি থেকে কোনো সংকেতই এলো না।
পাঁচই মে শুরু হ’লো ধুঁকতে ধুঁকতে। গত দু-দিন উপোস ক’রে কেটেছে সবার হৃদয় যদি-বা মানে, জঠর মানে না। ওয়ার্কশপগুলোয় কেউ নেই। কর্মীরা, তাদের স্ত্রী এবং বাচ্চারা, একই সঙ্গে কেমন করুণ কিন্তু খ্যাপাভাবে কারখানার এদিক- ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে কিছু যদি না-হয় তবে সবাই গিয়ে হ্যারি কিলারের পায়ে পড়বে, তাও সই, তবু এভাবে অনাহারে মরার কোনো মানে হয় না। ছোটো-ছোটো দলে ভাগ হ’য়ে তর্কাতর্কি হচ্ছে। কটুকাটব্য, তিক্ত মন্তব্য তো বটেই—কেউ-কেউ আবার বলতে শুরু করেছে নিজে ছাড়ান পেয়ে গিয়ে তোঙ্গানে অন্যদের কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছে। ঐ কালো লোকটা নিশ্চয়ই এত হাবা নয় যে নিজের জীবন বিপন্ন ক’রেও সে সকলের উদ্ধারের চেষ্টা করবে!
এমনি একটা দলের পাশ দিয়ে যাবার সময় জেন ব্লেজন হঠাৎ নিজের নামটা শুনতে পেলে। একটি কর্মী আর তার স্ত্রী ফাটাফাটি ঝগড়া ক’রে চলেছে, আর তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তাদের কয়েকজন সাথী। এতটাই তারা খেপে গিয়েছে যে কে কোথায় আছে তা পর্যন্ত তারা খেয়াল করছে না। জেন থমকে দাঁড়িয়ে প’ড়ে শোনবার চেষ্টা করলে তারা কী বলছে।
স্বামীটি চীৎকার ক’রে বললে : ‘ওরা যা-খুশি বলে বলুক; কিন্তু এই খুদে রাজকন্যাটির জন্যে আমরা যে সবাই এখন মরতে চলেছি, এটা বড্ড-বাড়াবাড়ি হ’য়ে যাচ্ছে!’
স্ত্রী বললে : ‘তোমার লজ্জা করে না এমনভাবে কথা বলতে?’
‘লজ্জা!… তুমি নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছো, মা জননী!… আমার বাড়িতে একটা বাচ্চা আছে-আর সে এখন না-খেতে পেয়ে ধুঁকছে, কাঁদতেও পারছে না—’
‘তোমার কি মনে হয় আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই?’
‘তোমার ছেলেপুলে না-খেতে পেয়ে মারা গেলে তোমার যদি কোনো আপত্তি না-থাকে, তবে আমি সেখানে নাক গলাবার কে? সহানুভূতি উথলে উঠলে আমার তো আর প্রাণ বাঁচবে না! কালও যদি হালটা এ-রকম থাকে, তাহ’লে সোজা আমরা কত্তার কাছে গিয়ে মনের কথা খুলে বলবো। ঐ-রাজকন্যার জন্যে তো আর আমরা সবাই এমন ক’রে মরতে পারি না!’
‘তোমার মতো ডরপোক আমি দুটি দেখিনি!’ ঘৃণায় মুখ বেঁকিয়ে স্ত্রী বললে। আমার ছেলেমেয়ে নিয়ে আমায় যদি কবরেও যেতে হয় তাও সই, তবু অমন বেআক্কেলে কেলেঙ্কারি কাজ আমাকে দিয়ে হবে না! কী ঘেন্না, ছী-ছি!
‘যার যেমন রুচি,’ লোকটা আলোচনা থামিয়ে দিলে। ‘কালকেই বোঝা যাবে কার কতটা মুরোদ!’
জেন ব্লেজনের মনে হ’লো সে বুঝি পারলে মাটিতে মিশে যেতো! এখন ওরা খোলাখুলিভাবে তাকে নিয়ে এ-সব কথা বলতে শুরু করেছে। তাদের মতে, তাদের এই নাজেহাল দশার জন্যে সেই একাই দায়ী! অসহ্য-অসহ্য—এই ভাবনা। কিন্তু ওরা যে সব ভুল ভাবছে, এটা বোঝাবার জন্যে কী করতে পারে সে?
ঘণ্টার পর ঘণ্টা, মিনিটের পর মিনিট, ৫ই মে, শেষটায় যেন বুকে হেঁটেই তার সমাপ্তিতে গিয়ে পৌঁছুলো। সূর্য ডুবে গেলো একসময়। নেমে এলো রাত্রি। আজও আবার, পর-পর তৃতীয় দিন, ঘন-কালো মেঘে চাঁদ ঢাকা প’ড়ে আছে। অন্ধকার যেন থমথম করছে। তোঙ্গানে কি এই পরিবেশের সুযোগ নেবে আজ? সেই দীর্ঘপ্রতীক্ষিত সংকেত কি আসবে এই অন্ধকারের মধ্যে? কারু চোখে কোনো আশা নেই, তবু সবগুলো চোখ সেদিকেই ফেরানো—যেখান থেকে ঐ সংকেত আসার কথা। কারখানার ঘড়ি ঢং-ঢং ক’রে ঘোষণা করলে সাতটা, আটটা, সাড়ে- আটটা। না, মিথ্যেই তাদের এই অধীর প্রতীক্ষা!
কিন্তু সাড়ে-আটটার কয়েক মিনিট বাদেই গোটা জমায়েটার মধ্যে হঠাৎ যেন দমকা-একটা শিহরণ খেলে গেলো। না, তোঙ্গানে তাদের কথা ভুলে যায়নি। ঐ- যে, কালোদের বস্তির মধ্য থেকে, দেয়ালের ওপর অবশেষে দেখা দিয়েছে সংকেত!
একমুহূর্তও সময় নষ্ট না-ক’রে কাজে লেগে গেলো সবাই। কামারের নির্দেশে তক্ষুনি মাচার কাছে এসে হাজির অদ্ভুত দেখতে একটা জিনিশ,–অ্যাঁ, একটা কামান যে! সত্যিকার কামান! তার কোনো চাকা নেই, আর সেটা বানানো হয়েছে কাঠে! সেই কাঠের তৈরি নলচের মধ্যে বসানো হ’লো অস্ত্রভরা সিন্দুক—তারপর জমাট গ্যাসের চাপে সেটা নিঃশব্দে ছুটলো লক্ষ্যের দিকে। সঙ্গে গেলো ইস্পাতের দুই দাঁড়া, সিন্দুকের গায়ে আটকানো সবকিছু ঠিকঠাক চললে সেটা গিয়ে কালোদের বস্তির দেয়ালে আঁকশির মতো আটকে যাবে। সিন্দুকের ওজন, দাঁড়গুলোর দৈর্ঘ্য জমানো গ্যাসের পরিমাণ, লক্ষ্যের দিকে মুখ-করা কামান—সব অঙ্ক ক’ষে নির্ভুল স্থির করেছেন কামারে। এবং এই অদ্ভুত কামান দাগবার দায় কামারে আর-কারু হাতেই ছেড়ে দিতে রাজি নন
নিঃশব্দে, ক্ষেপণসিন্দুক ছুটলো নদীর ঘাটের ওপর দিয়ে, পেরিয়ে গেলো রাঙা- নদী, হর্ষচরিতদের আস্তানা, আর কালোদের বস্তিতে গিয়ে পড়লো। তাহ’লে কি সফল হয়েছেন তাঁরা? আঁকশির মতো ঠিকঠাক দেয়ালটাকে কি আঁকড়েছে দাঁড়াগুলো, আর তাদের মুখে লাগানো আংটা?
কামারে একবার তাকিয়ে দেখলেন তাঁর অদ্ভুত কামানটাকে–হয়তো তাঁর প্রতিভার এটাই শ্রেষ্ঠকীর্তি। হ্যাঁ, এবার আকাশে একটা পথ তৈরি হ’য়ে গেছে, ঐ দাঁড়াদুটোয়, তাছাড়া সিন্দুকটা গিয়ে পড়েছে কালোদের বস্তিতে। দাঁড়াদুটো এমনভাবে টান-টান হ’য়ে আছে যে বোঝাই যায় তারা আঁকড়ে ধ’রে আছে দেয়ালের কানা।
আর সেই আশমানি রাস্তাতেই মুহুমূহু পাঠানো হ’তে লাগলো অস্ত্রশস্ত্র। প্রথমেই বিস্ফোরকের একটা প্যাকেট, তারপর চার হাজার ছুরি-কৃপাণ, কুড়ুল-বল্লম। এগারোটার মধ্যেই সব কাজ সারা। সবাই মাচা থেকে স’রে এবার সদরদরজার কাছে এসে দাঁড়ালে। যে যা হাতের কাছে পেয়েছে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। মেয়েরা শুদ্ধু, অপেক্ষাকৃত-বড়ো ছেলেমেয়েরা শুদ্ধ। গাদাগাদি ঠাশাঠাশি দাঁড়িয়ে সবাই। এবার উপযুক্ত মুহূর্তে নিজেরাই গিয়ে আসরে নামবে তারা।
কিন্তু কে-একজন যেন নেই এই দলটায়। নেই, একটি তরুণী নেই : জেন ব্লেজন!
সাঁৎ-বেরা, আমেদে ফ্লরেঁস, বারজাক, ডাক্তার শাতোনে মিথ্যেই গলা ফাটিয়ে তার নাম ধ’রে ডাকলেন, আর প্রতিধ্বনি গমগম ক’রে নামটা চারপাশে ছড়িয়ে দিতে লাগলো। মিথ্যেই তাকে খোঁজা হ’লো সারা কারখানায়। তাকে কোত্থাও পাওয়া গেলো না। সে যেন মন্ত্রবলে, না কি খোলা হাওয়ায় কপূরের মতো, উবে গিয়েছে।
এবার কারখানার অনেক কর্মীও খোঁজাখুঁজিতে লেগে গেলো। মিথ্যে চেষ্টা চাক্ষুষ অনুপস্থিতির প্রমাণটাকেই বাধ্য হ’য়ে মেনে নিতে হ’লো সবাইকে। সে- যে কোথাও নেই, এটাই চাক্ষুষ দেখা যাচ্ছে।
জেন ব্লেজন কোন ফাঁকে কোথায় যেন উধাও হ’য়ে গিয়েছে!