২.০৯ মুখোমুখি

২.০৯ মুখোমুখি

বন্দীকে নিয়ে চলেছে কালোগনি। সদলবলে। এতকাল সে তাকে নিজের জীবন পদেপদে বিপন্ন করেও বাঁচিয়েছে নানা বিপদ থেকে, সাপ-বাঘ-হাতির পাল সব-কিছুর হাত থেকে নিজের জীবন বারেবারে বিপন্ন করে কর্নেল মানরোকে সে বাঁচিয়েছিলো কেবল এই মুহূর্তটির জন্যেই; নানাসাহেবের পরম শত্রুকে বন্দী করে নিয়ে গিয়ে প্রভুর কাছে তুলে-দেয়া—এতদিন এই ছিলো তার ধ্যান, জ্ঞান আর স্বপ্ন। সেইজন্যেই তরাইয়ের সেই গভীর জঙ্গলে ওলন্দাজ প্রাণিতাত্ত্বিক মাতিয়াস ফান খোইতের কাছে সে চাকরি নিয়েছিলো; এইজন্যেই নানাভাবে সে উপার্জন করছিলো আস্ত স্টীম-হাউসের বিশ্বাস–সেই-যে মহরমের দিন ভোপালে নানাসাহেব তার কাঁধে দায়িত্ব তুলে দিলেন, তারপর থেকে কায়মনোবাক্যে সে কেবল এই পরিকল্পনাই চরিতার্থ করবার জন্যেই নিজের জীবনটাকে নিয়ে বারেবারে ছিনিমিনি খেলেছে। কেউ বুঝতে পারেনি তার উদ্দেশ্য কী, স্বপ্ন কী, সাধ কী—নিজের সব অনুভূতিকে সে এতদিন চাপা দিয়ে রেখে এসেছে।

কেবল যখন লেক পুটুরিয়া সারে পেরুবার সময় গৌমি তার সঙ্গে এলো, তখন মুহূর্তের জন্যে তার চোখটা ধ্বক করে জ্বলে উঠেছিলো। অনেক কষ্টে সে তখন নিজেকে সংবরণ করে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে তীরে পৌঁছে নানাসাহেবের আরেকজন অনুচর নাসিম ও তার দলের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তার একটুও দেরি হয়নি, কারণ এ-সব জায়গার পথঘাট সব তার নখদর্পণে। কেবল যখন অন্ধকারে নাসিমের সঙ্গে সে কথা বলছিলো তখন গৌমি সব বুঝতে পেরে বিদ্যুৎবেগে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে সরে পড়েছে—এইটুকুই যা খুঁত থেকে গেলো কাজটায়। কোথায় যে সে কেটে পড়লো, তা আর বোঝাই গেলো না। কিন্তু যাক—সে একা এতজনের হাত থেকে নিশ্চয়ই মানরোকে উদ্ধার করে নিতে পারবে না। তাছাড়া অহেতুক রক্তপাতে কালোগনির বিষম বিরাগ—সেইজন্যেই হুড, ব্যাঙ্কস বা মোক্লেরদেরও সে কিছুক্ষণ আটকে রেখে পরে ছেড়ে দেবার নির্দেশ দিয়েছিলো। যে জটিল গোপন রাস্তা দিয়ে তারা এখন নানাসাহেবের আস্তানায় চলেছে, সাধ্য কি এরা, এই বিদেশীরা, তা খুঁজে বার করে?

কেবল একবার সে ধরা পড়ে যাচ্ছিলো স্টীম হাউসে থাকার সময়–যখন ব্যাঙ্কস তাকে নানাসাহেবের মৃত্যুসংবাদ দিয়েছিলো। আরেকটু হলেই গুজবটায় সে বিশ্বাস করে বসতো। কিন্তু কে জানে, আসল ব্যাপারটা কী হয়েছিলো। গোরা সেপাইদের

তো ভুল হতেই পারে। হামেশাই হয়ে এসেছে এতকাল।

আপন মনে এ-সব ভাবতে-ভাবতে একটু মুচকি হাসলে কালোগনি।

রাত হয়ে এসেছে। রায়পুরের কেল্লা দেখা যাচ্ছে, দূরে। নাসিম বলেছে নানাসাহেব এখন সেখানে আছেন। পঁচিশ মাইল রাস্তা একটানা হন্তদন্ত এসেছে তারা, ঘিরে রেখেছে মানরোকে, একবারও তার উপর থেকে নজর সরায়নি।

কেল্লার কাছে যেতেই কে-একজন এগিয়ে এলো আস্তে, দর্পিত পদক্ষেপে।

কে? কালোগনি তার সামনে গিয়ে নুয়ে অভিবাদন করলে, সসম্রমে চুম্বন করলে তার বাড়িয়ে-দেয়া হাত–লোকটি আস্তে কালোগনির পিঠ চাপড়ে এগিয়ে এলো বন্দীর দিকে। চোখ দুটো তার বাঘের চোখের মতো জ্বলছে, সর্বাঙ্গ কী-একটা চাপা রাগে টান-টান।

লোকটি কাছে আসতেই মানরো চিনতে পারলেন।ওঃ! বালাজি রাও! মানরোর গলায় প্রচণ্ড ঘৃণা ফুটে উঠলো।

ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখো, চাপা স্বরে লোকটি আদেশ করলে।

নানাসাহেব? মানরো চিনতে পেরে এক-পা পেছিয়ে গেলেন।নানাসাহেব বেঁচে আছে?

সন্দেহ কী! আগুনের শিখার মতো তেজিয়ান মানুষটিকে দেখে চিনতে ভুল হবার কথা নয়। কিন্তু সাতপুরা পর্বতে তাহলে কে মরেছিলো?

মরেছিলেন ধুন্ধুপন্থের ভাই, বালাজি রাও।

দুই ভাইকেই দেখতে এতই-একরকম যে বাইরের লোকের ভুল-হওয়া বিচিত্র ছিলো। দুজনেরই মুখে ছিলো বসন্তের দাগ, একই হাতের একই আঙুল হারিয়ে ছিলেন দুজনে, একই কঠোর প্রতিজ্ঞায় দুজনেরই চিবুক ছিলো তীক্ষ্ণ্ণ ও সুদৃঢ়; আর তাতেই লক্ষ্ণৌ ও কানপুরের গোরা সেপাই ভুল করে বসেছিলো।

আর এই ভুলেরই সুযোগ নিয়েছিলেন নানাসাহেব। মৃত্যুর সংবাদ সরকারিভাবে সমর্থিত হয়েছিলো বলে নিরাপত্তা হয়েছিলো অটুট, কারণ এটা তিনি জানতেন যে সরকার নানাসাহেবের মতো তন্নতন্ন করে তার ভাই বালাজি রাওকে খুঁজবে না—কারণ বালাজি রাও কখনোই বিদ্রোহীদের প্রকাশ্য নেতৃত্বে অবতীর্ণ হননি। সেইজন্যেই নানাসাহেব এই মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়তে দিতে কোনো বাধা দেননি—বিদ্রোহের আগুন নতুন করে জ্বালাবার আগে তার নিজের একান্ত ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাকে চরিতার্থ করার এটাই সুবর্ণ-সুযোগ বলে ভেবেছিলেন তিনি। আর দৈবও ছিলো তার সহায়। কর্নেল মানবোও এই সময় কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়েছেন বম্বাই আসবেন বলে-পথে কোনোরকমে একবার যদি তাকে বুন্দেলখণ্ডে বিন্ধ্যপর্বতের অরণ্যদেশে নিয়ে আসা যায়, তাহলে তিনি দেখে নেবেন তার চিরশত্রুকে। বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য কালোগনির হাতে সব ভার তুলে দিয়ে সেইজন্যেই নিশ্চিন্তে কেবল এই মুহূর্তটিরই প্রতীক্ষ্ণ করছিলেন নানাসাহেব।

অবশেষে এতদিনে সব প্রতীক্ষ্ণর অবসান হলো। এখন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কর্নেল মানরো-বন্দী, নিরস্ত্র, নিঃসহায়, একাকী। জ্বলজ্বলে ক্ষুধিত চোখে নানাসাহেব তাকিয়ে রইলেন। মানরোও মুখ ফিরিয়ে নিলেন না। দশ বছর আগে যখন দেশজোড়া আগুন জ্বলেছিলো তখন এঁরা একবার পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলেন। এখন, রাতের অন্ধকারে, রায়পুরের কেল্লার পাশে, বিদ্রোহী ভারতীয়দের মধ্যে, আবার এঁরা দাঁড়িয়েছেন পরস্পরের মুখোমুখি।

অবশেষে নানাসাহেবের গম্ভীর গলা স্তব্ধতা ভেঙে গমগম করে উঠলো।মানরো, তোমার মনে আছে–তোমারই আদেশে পেশওয়ারে একশো কুড়ি জন বন্দীকে কামানের মুখে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো? তারপর থেকে এতদিনে আরো অন্তত বারোশো সেপাই ওইভাবে মারা গিয়েছে। লাহোরে তোমরা পলাতক মানুষদের নির্বিচারে বধ করেছে, আবালবৃদ্ধবনিতা কাউকে বাদ দাওনি, দিল্লি দখল করে বাদশাভবনের মানুষদের তোমরা একফোঁটা দয়া দেখাওনি; লক্ষ্ণৌতে মারা গেছে ছশোরও বেশি ভারতীয়; পঞ্জাবে তিন হাজারেরও বেশি ভারতীয়কে তোমরা কোনো বাছবিচার না-করে নৃশংসভাবে হত্যা করেছো। কেন? না, আমার দেশবাসী আজাদি চেয়েছিলো, স্বাধীনতা চেয়েছিলোআর স্বাধীনতার বদলে তোমরা তাদের রক্ত ঝরিয়েছে অবিশ্রাম…

মৃত্যু! মৃত্যু চাই, নানাসাহেবের অনুচরেরা গর্জন করে উঠলো।

নানাসাহেব হাত নেড়ে তাদের চুপ করতে নির্দেশ দিলেন। মানরো চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন নিরুত্তর।

মানরো, মনে আছে ঝান্সির রানী তোমার হাতেই মরেছিলেন?

মানবরা তবু চুপ করে রইলেন।

চার মাস আগে, চাপা দীপ্ত স্বরে নানাসাহেব বললেন, আমি বলে ভুল করে আমার ভাইকে তোমরা মেরেছে

মৃত্যু চাই! মৃত্যু! ক্রুদ্ধ কোলাহল উঠলো।

মানরো, আবার নানাসাহেবের গলা গমগম করে উঠলো অন্ধকারে, তোমারই পূর্বপুরুষ জনৈক হেকটর মানরোর শাস্তি দেবার বর্বর পদ্ধতি ১৮৫৭ সালের যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়, এ-কথা জানো? জ্যান্ত মানুষদের কামানের গোলায় বেঁধে উড়িয়ে দেবার নৃশংস পথটা সে-ই প্রথম দেখায়—

এই কথায় আবার চাপা রাগে, অন্ধকারে, কালো মানুষগুলো গর্জন করে উঠলো। আবার তাদের শান্ত করে সেই গম্ভীর মরাঠা গলা শোনা গেলো, এইসব ভারতীয় যেভাবে মৃত্যুবরণ করেছে, তোমাকেও ঠিক সেইভাবে মরতে হবে মানরো–তোমারই পূর্বপুরুষের দেখানো উপায়ে। দেখেছো এই কামান? আঙুল তুলে নানাসাহেব কেল্লার পাশের মস্ত কামানটি দেখালেন।গোলা ভরা আছে এই কামানে। এর মুখে তোমায় বেঁধে দেয়া হবে, তারপর কাল যখন সূর্য উঠবে তখন কামানের গর্জন শুনে বিন্ধ্যপর্বতের দিক-দিগন্তে এই বার্তা ছড়িয়ে যাবে যে অবশেষে মানরোর উপর নানাসাহেবের প্রতিশোধ নেয়া হলো।

এই কথা বলে গম্ভীর পায়ে নানাসাহেব কেল্লায় গিয়ে ঢুকলেন। মানরোকে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো কামানের পাশে। সেইখানেই তাঁর দড়িবাঁধা দেহটা ফেলে রেখে অন্যরাও চলে গেলো কেল্লায়।

স্যার এডওয়ার্ড একা পড়ে রইলেন তাঁর মৃত্যু ও তাঁর ভগবানের মুখোমুখি। এবং সম্ভবত হেকটর মানরোর বর্বর প্রথারও।