২.০৮ লেক পুটুরিয়া
বেহেমথ যখন লেক-পুটুরিয়ার মাঝখানে ভাসছে, তখন এক-এক করে আমরা খতিয়ে দেখছি ক্ষতির পরিমাণ। সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছিলো মঁসিয় পারাজারের জন্যে; রান্নাঘরটা হারিয়ে বেচারি ভারি মনমরা হয়ে গেছে। এদিকে আমাদেরও এতক্ষণে ক্ষুধার উদ্রেক হচ্ছে, সকালবেলায় সেই কখন তাড়াহুড়ো করে ছোটোহাজরি সেরেছিলুম—তারপরে মার-কিছু খাওয়া হয়নি। এখন যতক্ষণ-না জব্বলপুর পৌঁছুনো যাচ্ছে, খাওয়া-দাওয়ার কোনো উপায় নেই। ওদিকে বেহেমথের জ্বালানিও শেষ হয়ে গিয়েছে, স্টীম কমে আসছে, কমে এসেছে গতিবেগ; তার উপর সন্ধে হতে-না হতেই সব কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেলো। সকলেরই মুখ খুব গম্ভীর-এ অবস্থায় কী-যে করণীয়, কিছুই স্থির করে ওঠা যাচ্ছে না। স্রোত আর হাওয়া যতক্ষণ-না আমাদের তীরে পৌঁছে দিচ্ছে, ততক্ষণ এই হ্রদের মাঝখানে হাত-পা গুটিয়ে বসে-থাকা ছাড়া আর-কিছু করার নেই।
শোনো, কালোগনি, হ্রদটা কত বড়ো, তোমার জানা আছে?
আছে সাহেব, কিন্তু এই কুয়াশায় ঠিক বোঝা কঠিন—
আন্দাজ করেও বলতে পারবে না আমরা তীর থেকে কত দূরে আছি?
একটু ভেবে কালোগনি বললে, দেড় মাইলের বেশি হবে না।
পুব তীর থেকে?
হ্যাঁ। অথাৎ ওই তীরে গিয়ে পৌঁছুলে আমরা জব্বলপুরের রাস্তায় গিয়ে পড়বো?
হ্যাঁ।
তাহলে জব্বলপুরেই আমাদের সব রশদপত্তর জোগাড় করতে হবে। বললে ব্যাঙ্কস, কিন্তু তীরে পৌঁছুতে কতক্ষণ লাগবে, কে জানে? জ্বালানি নেই বলে হাওয়ার উপর নির্ভর করে বসে থাকতে হবে আমাদের। কয়েক ঘণ্টাও লাগতে পারে, আবার পুরো দু-দিনও কেটে যেতে পারে। অথচ খাবারদাবারও কিছু নেই!
কিন্তু, কালোগনি বললে, আমাদের মধ্যে কেউ-একজন আজ রাতেই ডাঙায় পৌঁছুবার চেষ্টা করলে হয় না?
কেমন করে পৌঁছুবে—উপায় কই?
কেন? সাঁৎরে।
এই কুয়াশায় দেড় মাইল সাঁৎরে যাবে? এ-তো মরতে যাওয়া—
বিপদ আছে বলেই কোনো চেষ্টা করবো না, তা কী হয়? কালোগনি বললে।
তুমি যেতে চাও সাঁৎরে? কর্নেল মানরো জিগেস করলেন।
হ্যাঁ, কর্নেল। আমি এই কুয়াশাতেও তীরে পৌঁছুতে পারবো?
একবার তীরে পৌঁছুতে পারলে, ব্যাঙ্কস বললে, অবশ্য কোনো ভয় নেই। জব্বলপুর থেকে তাহলে চটপট সাহায্য নিয়ে আসতে পারবে।
আমি এক্ষুনি রওনা হয়ে পড়তে রাজি আছি, কালোগনি বললে।
ভেবেছিলুম এ-কাজে রাজি হবার জন্যে কালোগনিকে ধন্যবাদ জানাবেন কর্নেল মানরো। কিন্তু তার মুখের দিকে স্থির চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে মানরো শেষে হাঁক পাড়লেন, গৌমি।…তুমি ভালো সাঁতার কাটতে পারে?
হ্যাঁ, সাহেব। গৌমি ঘাড় নেড়ে সায় দিলে।
এ-রকম কুয়াশার মধ্যে মাইল দেড়েক সৎরে যেতে পারবে তুমি?
তা পারবো।
বেশ। কালোগনি বলছে সে সৎরে তীরে চলে যাবে-তীর থেকে জব্বলপুর বেশি দূরে নয়। এখন বুন্দেলখণ্ডের এদিকটায়-কি জলে, কি ডাঙায়–একজনের চেয়ে দুজন বুদ্ধিমান ও সাহসী লোকের সফল হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি! তুমি কালোগনির সঙ্গে যাবে?
নিশ্চয়ই সাহেব! গৌমি বললে।
আর-কারু অবিশ্যি দরকার ছিলো না, বললে কালোগনি, তবে কর্নেল মানরো যখন বলছেন, তাহলে গৌমিও না-হয় সঙ্গে চলুক।
তাহলে আর দেরি কোরো না, ব্যাঙ্কস বললে, আর সাবধানে যেয়ো-সাহসের চেয়েও সতর্কতা অনেক সময় বেশি কাজে লাগে।
কর্নেল মানরো গৌমিকে একপাশে ডেকে নিয়ে সংক্ষেপে দু-এক কথায় কী-সব নির্দেশ দিলেন। পাঁচ মিনিট পরেই গৌমি আর কালোগনিংমাথায় দুটি কাপড়ের পুটুলি বেঁধে নিয়ে জলে নেমে পড়লো। একটু পরেই ঘন কুয়াশায় তারা মিলিয়ে গেলো–তাদের আর দেখা গেলো না।
কালোগনিকে একা পাঠাতে কর্নেল মানরো কেন রাজি হচ্ছিলেন না, তা আমার দুর্বোধ্য ঠেকছিলো। আমার ধন্ধের কথাটা জিগেস করতেই মানরো বললেন, মঁসিয় মোক্লের, কালোগনিকে কখনও অবিশ্বাস করার কোনো কারণ আমি পাইনি-তবু এখন তার কথাবার্তার সুর আমার কেন যেন ভালো ঠেকছিলো না।
মানে? ব্যাঙ্কস জিগেস করলে।
এভাবে সাঁৎরে যাবার পিছনে ওর নিশ্চয় আয়ো-কোনো মৎলব আছে। আমার মনে হয় না ও জব্বলপুরে সাহায্য আনতে যেতো।
কিন্তু, কর্নেল, কালোগনি আমাদের অনেকবার বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে বিশেষ করে আপনাকে তো সবচেয়ে বেশি! অথচ আপনিই এখন ওকে অবিশ্বাস করছেন। কেন, বলুন তো? আর তাছাড়া আমাদের হঠাৎ বিপদে ফেলে ওর কী-ই বা লাভ হবে?
তা জানি না। হয়তো সব যখন বুঝতে পারবো, তখন আমাদের কিছুই করার থাকবে না। তবে গৌমিকে আমি বিশেষভাবে সাবধান করে দিয়েছি-বলেছি কালোগনিকে যেন সবসময় চোখে-চোখে রাখে। কর্নেল মানবরা এর চেয়ে বেশি আর কিছুই ভেঙে বলতে রাজি হলেন না।
রাতটা কেটে গেলো স্তব্ধ, কুয়াশাঢাকা, প্রলম্বিত। পাঁচটার সময় পর্যন্ত কুয়াশা সরলো না, আলো ফুটলো না একফোঁটা। অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর-কিছু করার নেই। কর্নেল মানরো, ম্যাক-নীল আর আমি বসে আছি সামনে, ফক্স আর মঁসিয় পারাজার পিছনে, ব্যাঙ্কস আর স্টর হাওদায়, আর ক্যাপ্টেন হুড বেহেমথের কাঁধে, শুঁড়ের কাছে—যেন মাস্তুলে টঙের উপর বসে আছে কোনো নাবিক।
বেলা দুটো নাগাদ হাওয়া উঠলো। সূর্যের প্রথম রশ্মি ফুটলো কুয়াশা ছিড়ে, আস্তে আস্তে কুয়াশা সরে গেলো, দিগন্ত পর্দা তুলে দিলে।
ডাঙা! ঠিক নাবিকদের মতোই চেঁচিয়ে বললে ক্যাপ্টেন হুড।
দক্ষিণ-পুব দিকে ডাঙা পড়ে আছে, গাছপালা ঢাকা! আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে মেঘের কোলে পাহাড়।
হাওয়া আস্তে-আস্তে আমাদের তীরে পৌঁছে দিয়ে গেলো।
ফাঁকা তীর-শুধু কতগুলো গাছপালা ছাড়া আর কিছু নেই। বেহেমথ তীরে এসে ঠেকলো। কিন্তু স্টীম ছাড়া তাকে ডাঙায় তোলা মুশকিল।
আমরা সবাই ডাঙায় নেমে পড়লুম। ব্যাঙ্কস তাড়াতাড়ি জ্বালানির জোগাড়ে শশব্যস্ত হয়ে উঠলো। যাতে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জব্বলপুর রওনা হওয়া যায়, সেদিকে নজর রেখেই সে এমন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
সবাই মিলে হাত লাগিয়ে কাঠকুটো ডালপালা জড়ো করছি, যাতে এক-ফোঁটা সময় নষ্ট না-হয়। কেবল কালু বসে বসে চুল্লিতে কাঠ গুঁজে দিচ্ছে আর গরম করে নিচ্ছে এঞ্জিন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই স্টীম বেশ চাপ দিতে লাগলো। তাহলে এবার জব্বলপুর রওনা হওয়া যাক, বললে ব্যাঙ্কস।
কিন্তু স্টর রেগুলেটরে হাত দেবার আগেই গাছপালার আড়াল থেকে আচমকা একটা প্রচণ্ড কোলাহল উঠলো। পরক্ষণেই প্রায় দেড়শোজন ভারতীয় বনের মধ্যে থেকে ছুটে এলো স্টীম হাউসের দিকে-মুহূর্তের মধ্যে আক্রান্ত হলো হাওদা ও গাড়ি-কিছু বুঝে ওঠবার আগেই আমাদের কয়েদ করে তারা স্টীম হাউস থেকে নামিয়ে নিলে। মুক্তির চেষ্টা করা বৃথা, কারণ শক্ত করে তারা ধরে রেখেছে আমাদের, চোখে মুখে দয়া বা মমতার লেশমাত্র নেই।
তাদের পুঞ্জীভূত ক্রোধ মুহূর্তের মধ্যে গোটা স্টীম হাউসটাই লণ্ডভণ্ড করে দিলে —আশবাবপত্তর কিছুই রইলো না আস্ত, মুহূর্তের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো আমাদের স্টীম হাউসে!
বেহেমথকেও তারা ধ্বংস করতে চেষ্টা করলে, কিন্তু আগুন বা কুঠার কিছুই বেহেমথের গায়ে আঁচড়টি কাটতে পারলে না। ক্যাপ্টেন হুড রাগে চাচাতে লাগলো। কি কেউ তার দিকে দৃকপাতও করলে না।
স্টীম হাউস পুড়ে ছাই হয়ে গেলে পর ভিড়ের মধ্য থেকে দৃপ্ত পদক্ষেপে একজন এগিয়ে এলো আমাদের দিকে। নিশ্চয়ই দলের সর্দার। অন্য লোকেরা তৎক্ষণাৎ তার পাশে মাথা নত করে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আদেশের অপেক্ষা করতে লাগলো। এমন সময় ভিড়ের মধ্যে থেকে আরেকটা লোক এগিয়ে গেল সর্দারের দিকে। এবং তক্ষুনি সব রহস্যের অবসান হয়ে গেলো। দ্বিতীয় লোকটি আর-কেউ নয়—কালোগনি।
আশপাশে গৌমির কোনো চিহ্ন নেই।
কালোগনি সোজা এগিয়ে গেলো মানরোর দিকে, আঙুল তুলে দেখালো সে কর্নেলকে, এই-যে সেই! সে বললে।
তক্ষুনি কোনো কথা না-বলে মানরোকে তারা টেনে নিয়ে গেলো—কোনো কথা বলবারও অবসর দেয়নি। হুড, ব্যাঙ্কস ও আমরা বাকি সবাই খামকাই নিজেদের মুক্ত করার চেষ্টা করতে লাগলুম, কিন্তু তারা আমাদের ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলে।
মানরোকে নিয়ে দলটা দক্ষিণ দিকে বনের আড়ালে চলে গেছে। মিনিট পনেরো পরে রক্ষীরাও আমাদের ফেলে রেখে ছুটে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়লো।
অনুসরণ করে কোনো লাভ নেই, জানি। কারণ তাতে সার এডওয়ার্ডকেই অযথা আরো বিপন্ন করা হবে। বুঝতে বাকি ছিলো না যে কালোগনির আক্রমণের লক্ষ্য কেবল সার এডওয়ার্ডই।
কিন্তু কেন? নিশ্চয়ই তার নিজের কোনো স্বার্থ তাতে সিদ্ধ হবে না। তবে কার আদেশ সে পালন করছে? নানাসাহেব নামটা যেন কোনো একটা অতিকায় অলুক্ষুণে শক্তির মতো আমার মনের মধ্যে ভিড় করে এলো।
+
মঁসিয় মোক্লের-এর পাণ্ডুলিপি এখানে এসেই শেষ হয়েছে। ভারত ভ্রমণে আসা এই ফরাশি যুবাপুরুষ এর পরেকার ঘটনাগুলো আর স্বচক্ষে দ্যাখেননি—কীভাবে এই গ্রন্থিল কাহিনীর সবগুলো জট এরপর হুড়মুড় করে খুলে গিয়েছিলো, তিনি অবশ্য তার প্রত্যক্ষ দর্শক ছিলেন না। কিন্তু পরে যখন সব জানা গেলো, তখন তাদের গল্পের মতো করে একজায়গায় করে দেয়া হলো, যাতে মঁসিয় মোক্লের-এর ভ্রমণবৃত্তান্ত একটা মোটামুটি সম্পূর্ণ চেহারা নিতে পারে।