৮. উদ্ধারের আহ্বান
অত্যন্ত দুঃখিত চিত্তেই কাপ্তেন মার্সেনে বারজাক মিশনকে ছেড়ে এসেছিলেন, বিশেষত জেন মোর্নাস বলে যে-তরুণীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিলো তাকে ছেড়ে আসতে তাঁরা আরো অনেক-বেশি কষ্ট হচ্ছিলো। তবু বিন্দুমাত্র দ্বিধা না-ক’রেই তিনি সদলবলে চলে এসেছিলেন, আর যেমন নির্দেশ ছিলো, সেগু-সিকোরো অব্দি দ্রুতবেগেই পড়িমড়ি ক’রে এসেছিলেন। আদ্যোপান্ত এক সামরিক অফিসার তিনি, কায়মনোবাক্যেই ফরাশি বাহিনীর কাছে সমর্পিতপ্রাণ, তার জন্যে যদি ব্যক্তিগত স্বার্থ বিসর্জন দিতেও হয়, সে নিয়ে তিনি দু-বার ভাবেন না।
কিন্তু যত দ্রুতই আসবার চেষ্টা ক’রে থাকুন না কেন, ঐ তিনশো মাইল দূরত্ব পেরুতে তাঁর পুরো ন-দিন লেগেছিলো, ২২শে ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে তিনি অবশেষে সদলবলে এসে পৌঁছেছিলেন সেগু-সিকোরোতে। ফলে পরদিন সকালের আগে ছাড়া কর্নেল সের্জন-এর সঙ্গে তিনি দেখা করতে পারেননি। সকালবেলায়• সেগু-সিকোরোর শিবিরের অধ্যক্ষ কর্নেল সের্জনকে এসে তিনি কর্নেল সাঁৎ ওবানের নির্দেশটা দেখিয়েছিলেন।
কর্নেল সের্জন ক্রমবর্ধমান বিস্ময়ের সঙ্গে তিন-তিনবার আদ্যোপান্ত পড়েছিলেন নির্দেশটা। পুরো ব্যাপারটাই কিছুতেই তাঁর মাথায় ঢুকছিলো না। ‘ভারি আশ্চর্য তো!’ বলেছিলেন তিনি সবিস্ময়ে। ‘টিম্বাকটু পাঠাবার জন্যে সিকাসোতে লোক ডেকে পাঠানো! এ যে কল্পনাতীত!’
‘তাহ’লে, আমরা যে আসবো, এ-খবর আপনি পাননি? ‘
‘মোটেই না!’
‘যে-লিউটেনান্ট আমাকে এই নির্দেশটা পৌঁছে দিয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন যে টিম্বাকটুতে বিক্ষোভ ফেটে পড়েছে-আর তুয়ারেগ আউয়েলিমেদেন প্রচণ্ড উত্তেজিত হ’য়ে আছে!’
‘এই-প্রথম এমনতর কথা শুনলুম,’ কর্নেল তাঁকে বলেছিলেন, ‘বস্তুত, কালকেই, কাপ্তেন পেইরোইয়েস… আপনি হয়তো তাঁর কথা শুনেছেন?
‘দু-বছর আগে আমরা একই রেজিমেন্টে ছিলুম।’
‘হুম, কালকেই তিনি এখান দিয়ে গেছেন, এই কাপ্তেন পেইরোইয়েস। টিম্বাকটু থেকে ডাকার যাবার রাস্তায় এখানে থেমেছিলেন তিনি। কালকেই তিনি গেলেন এখান দিয়ে, কিন্তু, কই, এই বিক্ষোভ সম্বন্ধে তো ঘুণাক্ষরেও কিছু বলেননি!’ কাপ্তেন মার্সেনে এ-কথা শুনে অসহায়ভাবে শুধু কাঁধ ঝাঁকিয়েছিলেন।
‘হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন, কাপ্তেন,’ কর্নেল সের্জন বলেছিলেন, ‘এ নিয়ে তর্ক করার কিছু নেই। এ-রকমই যখন নির্দেশ, তখন তা আমাদের পালন করতে হবে বৈ কি। তবে কখন যে আপনি রওনা হ’তে পারবেন, তা শুধু শয়তানই জানে!’
সেই অদৃষ্টপূর্ব-অভিযানের জন্যে তৈরি হ’তে গিয়ে বিষম মুশকিলে পড়তে হয়েছিলো কাপ্তেন মার্সেনকে। ঘোড়াগুলো রাখবার জন্যে আস্তাবল খুঁজে বার করতেই আটদিনেরও বেশি সময় লেগে গিয়েছিলো, কারণ নির্দেশ ছিলো ঘোড়াগুলো যেন সেগুসিকোরোতেই রেখে আসা হয়। তাছাড়া রাস্তার জন্যে যথেষ্ট খাবারদাবারও চাই আর চাই যানবাহন। শেষটায় দোসরা মার্চেই কাপ্তেন মার্সেনে টিম্বাকটুর পথে রওনা হ’তে পেরেছিলেন।
শুখার মরশুম ব’লে জায়গায় জায়গায় জল এত-কম ছিলো যে তাঁকে মাঝপথে বেশ কয়েকবার থেমে জোয়ারের জলের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছে। ফলে ১৭ই মার্চের আগে বারজাক মিশনের প্রাক্তন রক্ষিদলের অধ্যক্ষ কাবারায় পৌঁছুতে পারেননি। কাবারা টিম্বাকটুরই বন্দর, টিম্বাকটু থেকে তার দূরত্ব দশমাইল।
যখন কাপ্তেন মার্সেনে স্থানীয় বাহিনীর অধ্যক্ষ কাপ্তেন আলেজ-এর কাছে গিয়ে সেলাম ঠুকে দাঁড়ালেন, তিনিও সেগু-সিকোরোয় তাঁর সহযোগী যেমন তাজ্জব হ’য়ে গিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন। জোরগলায় বললেন, এ- অঞ্চলে কোত্থাও কোনো গণ্ডগোলই নেই, তিনি নিজে কস্মিনকালেও কোনো বাড়তি সেনাদল চেয়ে আবেদন পাঠাননি, তিনি বুঝতেই পারছেন না আগে থেকে না- জানিয়ে কর্নেল সাঁ-ওবান হঠাৎ কেন বাড়তি একশোজন সৈন্য পাঠিয়েছেন, তাঁর এখানে যাদের কোনো দরকার নেই।
ব্যাপারটা ভারি-আশ্চর্য ঠেকলো কাপ্তেন মার্সেনের কাছে। এই প্রথম তিনি সন্দেহে ভ’রে গেলেন : কোনো ওস্তাদ জালিয়াতের পাল্লায় পড়েননি তো? কিন্তু কেন? খামকা কীসের জন্যে ঐ জালিয়াৎ তাঁকে এমন নাকাল ক’রে ঘোড়দৌড় ছোটাচ্ছে? উত্তরটা অবশ্যি স্পষ্ট। মলবটাকে যতই দুর্বোধ্য আর জটপাকানো ঠেকুক, এই ফেরেব্বাজির মানে একটাই হয়—তাঁকে সরিয়ে দিয়ে বারজাক মিশনকে উৎখাত ক’রে দেয়া। যুক্তি তাঁকে যখন এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিয়েছে, কাপ্তেন মার্সেনে তখন একেবারে মর্মযন্ত্রণায় ভ’রে গেছেন : কী হাঁদার মতো এই গুরুদায়িত্ব থেকে তিনি স’রে এসেছেন! আর মাদমোয়াজেল মোরনাসেরই বা কী হবে? শয়নে- স্বপনে-জাগরণে, সবসময় যেন মাদমোয়াজেল মোরনাসের কথাই তাঁর মনে-প্রাণে তখন হানা দিচ্ছিলো।
তাঁর সব ভয় যে আদপেই অমূলক নয়, তার আরো-একটা প্রমাণ পাওয়া গেলো, যখন না-টিম্বাকটুতে না-সেগু-সিকোরোতে কেউ লিউটেনান্ট ল্যকুরের কোনো হদিশ দিতে পারলে। শুধু-যে কেউ কোনোদিন ল্যকুরের নামই শোনেনি, তা নয়— কেউ কোনোদিন সুদানি স্বেচ্ছাসেবকদের কথাও শোনেনি—অথচ কর্নেল সাঁৎ- ওবায়ানের চিঠিতে তাদের কথা লেখা ছিলো
তথাচ, কর্নেল সাঁৎ-ওবানের চিঠি তন্নতন্ন ক’রে খুঁটিয়ে দেখেও মনে হচ্ছিলো না সে-চিঠি জাল; যতক্ষণ-না হাতে-নাতে তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ সেটাকে কর্নেলের নির্দেশ ব’লেই মেনে নিতে হবে। তাই কাপ্তেন মার্সেনে আর তাঁর লোকজনের থাকার ব্যবস্থা ক’রে দিতে হ’লো : আর ঠিক হ’লো প্রথম- সুযোগেই কর্নেল সাঁৎ-ওবানের চিঠি তাঁর কাছেই পাঠিয়ে দেয়া হবে, কেননা একমাত্র তিনিই বলতে পারবেন এ-চিঠি অপ্রামাণিক কি না।
কিন্তু টিম্বাকটু থেকে বামাকোর দূরত্ব ছশো মাইলেরও ওপর। চড়াই-উৎরাইয়ে ভরা। কর্নেলের কাছ থেকে সন্দেহভঞ্জনের চিঠি আসতে তাই অনেকটাই সময় লেগে যাবে।
এদিকে কাপ্তেন মার্সেনে যে এখন কী করবেন, তা-ই কেউ জানে না। তাঁর ওপর নির্দিষ্ট কোনো কাজের ভার নেই। তিনি সারাক্ষণই অস্থির হ’য়ে আছেন। সময়কে মনে হচ্ছে অহেতুক-দীর্ঘ—যেন কাউ তাকে টেনে লম্বা ক’রে দিয়েছে। সুখের বিষয় যে মার্চের শেষে, জনৈক কাপ্তেন পেরিনি-সাঁৎ সির্-এ তাঁর পুরোনো সাথী ছিলেন—যাঁর সঙ্গে তাঁর বন্ধুতা এখনও অটুট ছিলো—সেই কাপ্তেন পেরিনি এসে হাজির হলেন; দুই বন্ধু হঠাৎ পরস্পরকে দেখে খুব খুশি হলেন, জমাট আড্ডা হ’লো দুজনে, এখন অন্তত সময়টা একটু-দ্রুত কাটতে লাগলো কাপ্তেন মার্সেনের।
বন্ধুর অস্বস্তির কারণ শুনে, পেরিনি তাঁকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করলেন। এই জাল ফরমান এমনই সুকৌশলে তৈরি করা হয়েছে যে যে-কেউ এই ধাপ্পায় ভড়কি খেয়ে যেতো। অত নিখুঁতভাবে কেউ স্বাক্ষর বা সীলমোহর নকল করতে পারে না ব’লেই তাঁর ধারণা। বরং তাঁর মনে হয়েছে, লিউটেনান্ট ল্যকুর হয়তো কর্নেলের সিদ্ধান্তের আসল উদ্দেশ্যটা ধরতে পারেননি, ও-রকম ভুলভাবে বর্ণনা করেছেন। আর কর্নেল আলেজ-এর বিস্ময়টাও বোঝা যায় : যে-অঞ্চলে এখনও পুরোপুরি শান্তি ও শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি, সেখানে এ-রকম এক-আধটা ফরমানের ভুলবোঝাবুঝি থেকেই অনেকরকম গণ্ডগোলের উদ্ভব হ’তে পারে।
কাপ্তেন পেরিনিকে অন্তত দু-বছর টিম্বাকটুতে থাকতে হবে বলে তিনি সঙ্গে বিস্তর মালপত্তর নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর পুরোনো বন্ধু সব বাক্সপ্যাঁটরা খুলে সেগুলো গুছিয়ে রাখার ব্যাপারে হাত লাগিয়েছিলেন। মালপত্তরের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলো গবেষণাগারের সরঞ্জাম : প্রায় একটা আস্ত ল্যাবরেটরিই, পেরিনি যদি একদিন সমরবাহিনীর উর্দি গায়ে না-চাপাতেন, তবে এতদিনে তিনি মস্ত-একজন বিজ্ঞানী হয়ে উঠতেন। বিজ্ঞানের অনুরক্ত ছাত্র হিশেবে তিনি সর্বাধুনিক গবেষণার খবর রাখেন—বিশেষত বিদ্যুত্তরঙ্গ সম্বন্ধে যে-সব গবেষণা হচ্ছে, তাতে তাঁর কৌতূহল অসীম। তাঁদের যখন বন্ধুতা হয়েছিলো তখন দুই বন্ধুর একজন ছিলেন কাজের লোক, আরেকজন ভাবুক। এই বিপরীত স্বভাবের দরুণ দুই বন্ধুর মধ্যে মাঝে-মাজে কথাকাটাকুটি হ’তো বটে, কিন্তু তখনও কোনো মনোমালিন্য হয়নি। একবন্ধু গ্রন্থকীট, অন্যজন রংবাজ ডাকাবুকো–পরস্পরকে এই ব’লেই সম্বোধন করতেন তাঁরা—কিন্তু এটাও সবাই জানতো যে মার্সেনের এই সারাক্ষণ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার মানে এই নয় যে তিনি মোটেই পরিশীলিত ও মার্জিত রুচির মানুষ নন, বরং অনেক সাধারণ লোকের চাইতে জ্ঞানবিজ্ঞানের খবর তিনি অনেক বেশিই রাখতেন। আর পেরিনির পাণ্ডিত্য আর বিজ্ঞানানুরাগও তাঁকে দক্ষ ও সাহসী সামরিক অফিসার হ’য়ে ওঠবার ব্যাপারে কোনো বাধার সৃষ্টি করেনি।
বন্ধুর আসার কয়েকদিন পরে, কাপ্তেন মার্সেনে একদিন বন্ধুর আস্তানায় এসে দেখতে পেলেন, সেখানে তাঁর কোয়ার্টারের সামনে উঠোনে কাপ্তেন পেরিনি কী- একটা অদ্ভুত যন্ত্র বসিয়েছেন।
তুই একেবারে ঠিক সময়ে এসেই হাজির হয়েছিস,’ পেরিনি বন্ধুকে দেখেই সোল্লাসে ব’লে উঠলেন। ‘তোকে আমি আজ দারুণ কৌতূহলোদ্দীপক একটা জিনিশ দেখাবো।’
‘ঐ ওটা?’ কাপ্তেন মার্সেনে আঙুল দিয়ে একটা যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে দেখালেন : দুটো তড়িৎকোষ, কিন্তু বৈদ্যুতিক চুম্বক, আর একটা কাচের নল-তার মধ্যে কী- একটা অচেনাধাতু ভরা : আর তাদের ওপর কয়েকগজ লম্বা একটা তামার খুঁটি বসানো।
‘হ্যাঁ, ঐ ওটাই,’ পেরিনি বললেন। ‘তুই যাকে তাচ্ছিল্য ক’রে, ‘ঐ ওটা’ বলছিস সেটাই হ’লো আধুনিক জাদুবিদ্যার চমৎকার-একটা দৃষ্টান্ত। এটা মূলত নেহাৎই একটা টেলিগ্রাফের খবরপাবার কেন্দ্র, রীসিভিং কেন্দ্র, তবে—ভালো ক’রে শুনে রাখ আমার কথা—বেতারটেলিগ্রাফি ‘
‘ওরা অবশ্য ক-বছর ধরেই বেতার টেলিগ্রাফের কথা বলছিলো,’ মার্সেনের তৎক্ষণাৎ কৌতূহল চেতিয়ে উঠলো, ‘সমস্যাটার তাহ’লে সমাধান হ’য়ে গেছে?
‘নিশ্চয়ই! হ্যাঁ, ইতিহাসের এ এক আজব খেলা—পৃথিবীতে একই সঙ্গে এমন দুজন বিজ্ঞানীর আবির্ভাব হয়েছে তাতে গোড়ায় একে কোনো কাকতাল ব’লেই মনে হ’তে পারে। একজন ইতালির লোক, মার্কোনি, হাসীয় বিদ্যুৎ তরঙ্গকে মহাকাশে ছড়িয়ে দেবার একটি উপায় তিনি বার ক’রে ফেলেছেন।…তুই জানিস, ওরে বেআক্কেলে কাজের লোক, ব্যাপারটা কী?’
‘হ্যাঁ, জানি। আমি যখন ফ্রাসে ছিলুম, তখন ওরা মার্কোনির আবিষ্কার নিয়ে কথা বলছিলো। কিন্তু অন্য কার কথা বলছিলি তুই?’
‘উনি একজন ফরাশি, ডক্টর বাঁলি। উনিই আবিষ্কার করেছেন গ্রাহকযন্ত্র, রীসিভার, উদ্ভাবনীবিদ্যার একটি খুদেবিস্ময়।’
‘আর এই-যে যন্ত্র—এটা?’
‘এটাই সেই রীসিভার। চক্ষের পলকে এর মূল কথাটা তুই বুঝে ফেলতে পারবি, এত-সহজ। মঁসিয় বাঁলি লক্ষ ক’রে দেখেছিলেন যদিও লোহাচুর সাধারণত ভালো পরিবাহী হয় না, তারা কিন্তু হাসীয় তড়িৎপ্রবাহের বেলায় চমৎকার পরিবাহী হ’য়ে ওঠে –অর্থাৎ বিদ্যুৎ কোনো বাধা না-পেয়ে তাদের মধ্য দিয়ে সাবলীলভাবে চ’লে যেতে পারে। তার কাজই হচ্ছে এলোমেলোছড়ানো তড়িৎকণাকে একজায়গায় জড়ো ক’রে তাদের মধ্যে সাযুজ্য ঘটিয়ে দেয়া। এবার এই ছোট্ট নলটাকে দ্যাখ।’
‘হ্যাঁ, দেখছি বটে।
‘এটাই ঐ সাযুজ্য ঘটায়। বলতে পারিস, তড়িৎকণা খুঁজে বার করবার কাজে পোক্ত এক গোয়েন্দা। এই-যে নলটা এর মধ্যে ঐগুলো হ’লো লোহাচুর-এবার লোহাচুর সমেত এই নলটাকে কোনো তড়িৎকোষের বিদ্যুৎপ্রবাহের সার্কিটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে, এই নল, ভালো পরিবাহী নয় ব’লে, সার্কিটটায় ঝামেলা পাকায়, তার মধ্য দিয়ে কোনো বিদ্যুৎই আর যায় না। কী, বুঝতে পারছিস তো?
‘হ্যাঁ, কিন্তু তারপর? ‘
‘যদি তখন কোনো হাসীয় বিদ্যুত্তরঙ্গ এসে পৌঁছোয়—ঐ তামার শিকটা তাকে পাকড়ায়—ওকে বলে শোষকশুঁড়, অ্যাটেনা,-আর তৎক্ষণাৎ, এই নলটা তার গায়ে আটকানো ব’লে, এই নলটা দারুণ-একটা পরিবাহী হ’য়ে ওঠে, তখন তড়িৎকোষের সার্কিট বন্ধ বটে, তবু হাসীয় তরঙ্গের বিদ্যুৎ তার মধ্য দিয়ে ছুটে চলে যায়। ওরে রক্তবাদল-ঝরানো-সৈনিক, এটা তোর মাথায় ঢুকেছে তো?’
‘হ্যাঁ, ওরে বুড়োজবুথবু বিজ্ঞানী। এবার কী? ‘
‘আর এবার অকুস্থলে এই অধম বক্তার প্রবেশ। এই-যে কলটা আমি নিজে বানিয়ে নিয়েছি, মঁসিয় ব্রালির আবিষ্কারের সঙ্গে তাল রেখেই, তাতে ঐ হাসীয় বিদ্যুত্তরঙ্গ মর্সের রীসিভারটাকে চালু ক’রে দেয়, যার মধ্যে সাধারণ ধরনেই একটা কাগজের ফিতে খুলে যেতে থাকে। কিন্তু সেইসঙ্গে এই ছোট্ট হাতুড়িটা-ঐ যেটাকে তুই দেখছিস—সেটা ঠুকে ঠুকে সাযুজ্য তৈরি ক’রে দেয়; এটার ঘা খেলে, লোহাচুরগুলো একটু ছিটকে যায়, অমনি হ’য়ে ওঠে অপরিবাহী, তড়িৎকোষ থেকে আর বিদ্যুৎ খেলে না তাদের মধ্যে, আর মর্স রীসিভারও অমনি বর্ণলিপি ছাপা বন্ধ ক’রে দেয়।
‘সে শুধু কাগজের ওপর একটা সংকেতে ছাপে, তা-ই তো বলবি? হ্যাঁ, তা ছাপে, কিন্তু যদি পর-পর একটার পর একটা সংকেত আসতে থাকে, আর শোষকশুঁড় অর্থাৎ অ্যানটেনা সে-সব শুষে নেয়, তাহ’লে থেমে-থেমে পর-পর ঐ সংকেতগুলো কাগজে সারি-সারি ছাপ মেরে থাকে। যখন এটা থেমে যায়, অর্থাৎ আর হাসীয় তরঙ্গ আসে না, তখন এও ছাপা বন্ধ ক’রে দিয়ে পরবর্তী তরঙ্গের আগমনের জন্যে হা-পিত্যেশ ক’রে ব’সে থাকে। অর্থাৎ আমরা একটুক্ষণের মধ্যেই টরে-টক্কার হ্রস্বদীর্ঘ পেয়ে যাই পর-পর। কোনো টেলিগ্রাফকর্মীর কাছে সেটা সাধারণ-কোনো লেখার মতোই সহজপাঠ্য তখন।’
‘যেমন, তোর মতো কোনো ওস্তাদ টেলিগ্রাফকর্মী?’
হ্যাঁ, যেমন, ধর, আমার মতো কেউ।’
‘তা এই অসাধারণ যন্ত্রটা হঠাৎ এই আফ্রিকায় জঙ্গলের মধ্যে তুই নিয়ে এসেছিস কেন?’
‘এটা এবং এরই সহোদর-ভাই, এই বিদ্যুত্তরঙ্গউৎপাদক, অর্থাৎ এই ট্র্যান্সমিটার, যাকে আমি কালকেই এখানে বসাবো। তুই জানিস কি না জানি না, আমি আজকাল এই বেতারটেলিগ্রাফি নিয়ে একেবারে খেপে উঠেছি। শাহারায় আমিই সব আগে এটাকে বসাতে চাই। সেইজন্যেই আমি এই দুই সেট যন্ত্র নিয়ে এসেছি। এ-সব জিনিশ পৃথিবীর যে-কোনো জায়গাতেই ভারি-দুর্লভ, আর আফ্রিকায় সে এর জুড়ি একটাও নেই, সেটা আমি তোকে বাজি ধ’রেই বলতে পারি। একবার ভেবে দ্যাখ ব্যাপারটা! আমরা যদি এখন সরাসরি বামাকোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতুম…কিংবা ধর যদি সাঁৎ-লুইসের সঙ্গেই কথা বলা যেতো!’
‘সাঁৎ-লুইয়ের সঙ্গে?… সেটা বড্ড-দূরে হ’য়ে যাবে না?’
‘মোটেই না,’ আপত্তি করেছেন পেরিনি। ‘দূর-দূরান্তরের সঙ্গে যোগাযোগ কবেই ক’রে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরা-লং-ডিস্ট্যান্স ব’লে আর কিছুই নেই!
‘অসম্ভব!’
‘খুব-সম্ভব, ওরে মাথা-মোটা গর্দভ! আমার তো ধারণা আমি তার চেয়েও ভালো কিছু করবো। সারা নাইজারের তীর ধরে আমি কতগুলো পরীক্ষা চালাবো…’ কাপ্তেন পেরিনি তারপরেই হঠাৎ কথা শেষ না-ক’রেই ফ্যালফ্যাল ক’রে হা ক’রে তাকিয়ে থেকেছেন, যাতে বোঝা গেছে কতটা বিস্মিত আর হতভম্ব হ’য়ে গেছেন তিনি। বাঁলি যন্ত্রটা থেকে ক্ষীণ-একটা খটখটে আওয়াজ বেরুচ্ছে, যেটা তাঁর অভ্যস্ত কান চিনতে মোটেই ভুল করেনি।
মার্সেনে অবাক হ’য়ে জিগেস করেছেন, ‘তোর আবার হঠাৎ কী হ’লো? তাঁর বন্ধু একটা উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাঁর বিস্ময় যেন কথাগুলো তাঁর মুখ থেকে কেড়ে নিয়েছে,। ‘চলছে, যন্ত্রটা চলছে!’ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলেছেন তিনি।
‘কী? যন্ত্রটা চলছে?’ কাপ্তেন মার্সেনে একটু বুঝি-বা ঠাট্টাই করেছেন। ‘তুই স্বপ্ন দেখছিস, তোর ভাবী ইনস্টিটিউটের হ’য়ে তুই এর মধ্যেই জেগে-জেগেই খোয়াব দেখতে শুরু ক’রে দিয়েছিস। তোর যন্ত্রটা গোটা আফ্রিকায় একমাত্র যন্ত্র, ফলে তার পক্ষে চলা আদপেই সম্ভব নয়—যতই নাটুকেভাবে তুই কথাটা বলবার চেষ্টা করিস না কেন। আসলে তোর ঐ যন্ত্র বিগড়ে গিয়েছে, কোথাও কোনো গণ্ডগোল হয়েছে- ‘
কোনো উত্তর না-দিয়েই কাপ্তেন পেরিনি যন্ত্রটার কাছে গিয়ে হাজির হয়েছেন। ‘বিগড়ে গিয়েছে।’ ভীষণ উত্তেজিত হ’য়ে তিনি ব’লে উঠেছেন। ‘এটা এতটাই বিগড়ে গিয়েছে যে আমি কাগজের ফিতেটায় পড়তে পারছি ‘কাপ্…তেন…কাপ্…তেন…মার… কাপ্তেন মার্সেনে’
‘আমার নাম?’ তাঁর বন্ধু হেসে উঠেছেন। ‘উঁহু, দোস্ত, বিলকূল বৃথা চেষ্টা! আমাকে তুই ওভাবে ছেলেভোলাতে পারবি না!’
‘তোরই নাম!’ এতটাই উত্তেজিত হ’য়ে পেরিনি কথাটা বলেছেন যে শেষটায় তাঁরই উত্তেজনায় ছোঁয়াচ লেগেছে কাপ্তেন মার্সেনের মধ্যে।
যন্ত্রটা এখন থেমে গিয়ে, দুই বন্ধুর ফ্যালফ্যাল চোখের সামনে চুপ ক’রেই থেকেছে। একটু পরেই কিন্তু ঐ আশ্চর্য টরে-টক্কার খটখট আবার শুরু হ’য়ে গেছে।
‘দ্যাখ-দ্যাখ! আবার শুরু করেছে!’ পেরিনি ততক্ষণে কাগজের ফিতেটার ওপর ঝুঁকে পড়েছেন। ‘হুম! এখন দেখি তোর ঠিকানা ফুটে উঠেছে : টিম্বাকট!
‘টিম্বাকটু!’ মার্সেনে হুবহু এক কলের পুতুলের মতো কথাটা আবার আউড়েছেন। এবার উত্তেজনায় নিজেই কাঁপতে শুরু করে দিয়েছেন, কী-এক অজানা আশঙ্কায়!
যন্ত্রটা দ্বিতীয়বারের মতো আবার থেমে গিয়েছে। তারপর, একটু বিরতি দিয়েই কাগজের ছাপা ফিতে আবার ভাঁজের পর ভাঁজ খুলে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে —কিন্তু তারপরেও আবারও থেমে গিয়েছে।
‘জেন ব্লেজন!’ পেরিনি জোরে-জোরে পড়েছেন!
‘উঁহু, এমন-কাউকে আমি চিনি না!’ মার্সেনে জানিয়েছেন, নিজেই জানেন না কেন কথাটা বলবার সময় তাঁর এমন স্বস্তির নিশ্বাস পড়লো। ‘হয়তো আমাদের সঙ্গে কেউ মজা করবার চেষ্টা করছে!’
‘মজা করবার চেষ্টা করছে!’ পেরিনি বিষম ভাবনায় প’ড়ে গেছেন। ‘কিন্তু তারা কেউ জানবে কী ক’রে আমার কাছে বেতারটেলিগ্রাফের যন্ত্র আছে?…দ্যাখ- দ্যাখ, আবার টরে-টক্কা শুরু হ’য়ে গেছে।’
ফিতেটার ওপর ঝুঁকে প’ড়ে, বানান ক’রে-ক’রে, যখনই কোনো কথা এসেছে, পড়েছেন পেরিনি : ‘জেন…মোর্….নাসের…উদ্ধারের…জন্যে…আ….সুন!’
‘জেন মোর্নাস!’ মার্সেনের মনে হয়েছে তাঁর বুঝি দম বন্ধ হয়ে যাবে। তাঁর উর্দির গলার বোতামটা খুলে দিয়েছেন তিনি।
‘চুপ!’ পেরিনি তখনও পড়ছেন : ‘ব্ল্যাক….ল্যাণ্ডে …বন….দিনী…’
চতুর্থবারের জন্যে টরেটক্কা আবার বন্ধ হ’য়ে গেছে। পেরিনি সোজা হ’য়ে দাঁড়িয়ে বন্ধুর দিকে তাকিয়েছেন। তাঁর বন্ধুর তখন কাহিল দশা! চোখদুটো গোল- গোল, মুখটা রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে। ‘তোর আবার কী হলো?’
‘তোকে পরে বলবো, মার্সেনের মুখ দিয়ে যেন কোনো আওয়াজই বেরুতে চায়নি। ‘কিন্তু ব্ল্যাকল্যান্ড?…এই ব্ল্যাকল্যান্ডের মানে কী হ’তে পারে ব’লে তোর মনে হয়?’
পেরিনির আর উত্তর দেবার কোনো অবসর আসেনি। যন্ত্রটা আবার টরে-টক্কা শুরু ক’রে দিয়েছে, আর তিনি থেমে-থেমে পড়েছেন : ‘অক্ষাংশ…পনেরো…ডিগ্রি… পঞ্চাশ… মিনিট… উত্তর…দ্রা-ঘিমাংশ… ‘
যন্ত্রটার ওপর ঝুঁকে প’ড়ে দুই বন্ধু বেশ কিছুক্ষণ উদ্গ্রীবভাবে অপেক্ষা করেছেন আবার কখন টরে-টক্কা-টক শুরু হয়, কিন্তু যন্ত্র আর-কোনো কথা বলেনি-এবার সে একেবারেই চুপ ক’রে গেছে—মর্স-গ্রাহকযন্ত্র সম্পূর্ণ মৌন।
কাপ্তেন পেরিনি চিন্তার সুরে আপন মনেই বলেছেন : ‘এ-যে দেখছি ভারি- কড়া একপেয়ালা চা! এই বনে-জঙ্গলে আর-কোনো শখের বেতারপাগল আছে নাকি? এমন-কেউ, যে আবার তোকে চেনে!’ তারপরেই বন্ধুর দিকে ফিরে তাকিয়ে তিনি আঁৎকে উঠেছেন। ‘এ-কী রে, তোর আবার কিছু হ’লো নাকি? তোকে যে অমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে!’
চট ক’রে, সংক্ষিপ্ত দু-চারটে কথায়, কাপ্তেন মার্সেনে তাঁর এমন বিচলিত হ’য়ে পড়ার কারণ খুলে বলেছেন বন্ধুকে। যদি কাগজের ফিতেয় নিজের নাম দেখে তাঁর শুধুই বিস্ময় হ’য়ে থাকে, পরক্ষণেই তা বদলে গেছে তীব্র আবেগের আলোড়নে, ঠিক যে-মুহূর্তে পেরিনি জেন মোরনাসের নামটা উচ্চারণ করেছেন। হ্যাঁ, জেন মোর্নাসকে তিনি চেনেন, তাকে তিনি ভালোবাসেন, আর যদিও এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কোনোই কথা হয়নি, তবু তাঁর দৃঢ় ধারণা-না কি আশা?— যে একদিন তাঁর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হবে।
কর্নেল সাঁৎ-ওবানের ফরমানটার রহস্য তাঁকে কতখানি বিচলিত ক’রে তুলেছে, সেটা তাঁর এক্ষুনি মনে প’ড়ে গেছে। মহাশূন্য থেকে এই-যে রহস্যময় বার্তা অপ্রত্যাশিতভাবে এসে হাজির, সেটা তাঁর সব আশঙ্কাকেই সত্য ব’লে প্রমাণিত করেছে। জেন মোর্নাস এখন ভয়ংকর বিপদের মধ্যে!
‘আর আমার কাছেই কি না উদ্ধারের জন্যে আকৃতি জানিয়েছে!’ তাঁর এই বিচলিত অবস্থাতেও কোথাও-বুঝি একটু উল্লাসও চাপা প’ড়ে ছিলো।
‘আরে, এ-তো খুবই সহজ কাজ! মেয়েটিকে সাহায্য করবার জন্যে এক্ষুনি বেরিয়ে পড়। হয়তো নতুন-কোনো সেন্ট জর্জ আর ড্রাগনের গল্পই ‘
‘সাহায্য করতে যে যাবো, তা ঢাক পিটিয়ে না-বললেও চলে!’ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার সম্ভাবনায় চনমনে বোধ করেছেন মার্সেনে। কিন্তু কেমন ক’রে?’
‘সেটা আমাদের ভেবে দেখতে হবে,’ পেরিনি তাঁকে বলেছেন। ‘কিন্তু গোড়ায় তথ্যগুলো সব সাজিয়ে নিয়ে দেখতে হবে আমরা কদ্দুর কী জানি। কোনো যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারলে আমার ভারি-আশ্বস্ত লাগে—সব অস্বস্তি কেটে যায়।’
‘তাহ’লে ঐ সিদ্ধান্তে গিয়ে তুইই পৌঁছুবার চেষ্টা কর!’ তেতোসুরে বলেছেন মার্সেনে।
হ্যাঁ, আমিই পৌঁছুবো… প্রিমো মাদমোয়াজেল মোর্নাস নিশ্চয়ই কোথাও একাকিনী আকুল হ’য়ে ব’সে নেই, কেননা তাঁর কাছে কস্মিনকালেও কোনো বৈতারযন্ত্র ছিলো না। আর তাঁর সঙ্গী ছিলো, অন্তত তুই যাঁদের সঙ্গে তাঁকে রেখে এসেছিলি, তাঁদেরও কারু কাছে কোনো বেতারে খবর পাঠাবার যন্ত্র ছিলো না। অতএব তাঁর এখন নতুন-একজন রক্ষাকর্তা আছেন, যাঁর কাছে অমন-একটা যন্ত্র আছে। আর তিনি বিশেষজ্ঞ, ওস্তাদ লোক, এটা আমি বাজি ধ’রে বলতে পারি।’
মার্সেনে ঘাড় হেলিয়ে সায় দেয়ায়, পেরিনি আবার বলেছেন :
‘সেকুন্দো, মাদমোয়াজেল মোরনাসের আপাতত, অন্তত সাময়িকভাবে হ’লেও, কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই। তিনি তোকে টিম্বাকটুতে বেতারে খবর পাঠিয়েছেন। তাঁর ধারণা, তুই এখন টিম্বাকটুতেই আছিস, কাজেই এটাও তিনি জানেন যে তুই এখন তাঁর ঠিক দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নেই, কোনো সদুত্তর দিতে তোর একটু সময়ই লেগে যাবে। অথচ তবু যখন বেতারে এই বার্তা পাঠিয়েছেন, তাঁর নিশ্চয়ই ধারণা হয়েছে যে এই আবেদন নেহাৎই বিফলে যাবে না। কাজেই, বিপদ যদি মাথার ওপর ঝুলেও থাকে, তবে তক্ষুনি চট ক’রে কোনো গণ্ডগোল পাকাবে না।’
একটু ঘাবড়ে গিয়েই মার্সেনে জিগেস করেছেন : ‘তুই তাহ’লে কী বলতে চাচ্ছিস?’
’যে, আপাতত তুই একটু মাথা ঠাণ্ডা ক’রে থাক—অন্তত এ-ভরসা রাখ যে এ-গল্পটা ককখনো শোচনীয়ভাবে শেষ হবে না…এক্ষুনি গিয়ে কর্নেলকে বল মসিয় ল্য দেপুতেকে উদ্ধার করবার জন্যে একফোঁটাও সময় নষ্ট না-ক’রে একটা বাহিনী পাঠিয়ে দিতে অভিযানে তাতে তুই ফাউ পেয়ে যাবি মাদমোয়াজেল মোর্নাসকেও!’
দুজন কাপ্তেনই তক্ষুনি বেরিয়ে পড়েছেন কর্নেল আলেজ-এর খোঁজে, তারপর তাঁকে বিশদভাবে পুরো বৃত্তান্তটাই খুলে বলেছেন, জানিয়েছেন এইমাত্র অপ্রত্যাশিতভাবে বেতারে কী খবর এসেছে। তাঁরা তাঁকে কাগজের ফিতেয় ছাপা টরে-টক্কা দেখিয়েছেন, আর পেরিনি সে-খবর সহজ ফরাশিতে তর্জমা করে শুনিয়েছেন।
‘এখানে তো মঁসিয় বারজাক সম্বন্ধে কোনো খবর নেই,’ কর্নেল বলেছেন।
‘না, তা নেই,’ পেরিনি বলেছেন, ‘তবে মাদমোয়াজেল মোর্নাস তো তাঁর সঙ্গেই ছিলেন—’
তিনি যে বারজাক মিশর ত্যাগ ক’রে নিজের পথে চ’লে যাননি, তা-ই বা কে জানে?’ কর্নেল আপত্তি তুলেছেন। ‘বারজাক মিশন কোন-কোন রাস্তা দিয়ে যাবে, সে-খবর আমি জানি। এটা বলতে পারি যে অত উঁচু অক্ষরেখায় এ-সফর গিয়ে পৌঁছুতেই পারে না। মিশনের যাবার কথা ছিলো উয়াগাদাদুসু দিয়ে, সেটা তো বারো ডিগ্রি অক্ষরেখায়, সায়ীর পরেই, আর সায়ী তেরো ডিগ্রিতে। এই রহস্যময় বার্তা বলছে পনেরো ডিগ্রি পঞ্চাশ মিনিট ধরা যাক ষোলো ডিগ্রিই।’
এই মন্তব্যটা কিন্তু মার্সেনের স্মৃতিকে উশকে দিয়েছে।
‘আপনি ঠিকই বলেছেন, মাদমোয়াজেল মোর্নাস হয়তো বারজাক মিশনের সঙ্গে না-গিয়ে অন্য পথে গিয়েছেন। আমার মনে পড়ছে, তিনি বলেছিলেন সিকাসোর শো-খানেক মাইল পরে একাই উত্তরমুখো যাবেন, তাঁর ইচ্ছে ছিলো গাওতে গিয়ে নাইজারে পড়বেন।’
‘সেটা অবিশ্যি সবকিছুর ছাক পালটে দিচ্ছে,’ কর্নেল গম্ভীরসুরে বলেছেন। মঁসিয় বারজাককে উদ্ধার করবার জন্যে সৈন্য পাঠানো এককথা, কেননা তিনি সংসদের একজন মাননীয় সদস্য, ফরাশি সরকারের পাঠানো কোনো প্রতিনিধি দলের নেতা। কিন্তু মাদমোয়াজেল মোর্নাস তো নিছকই সাধারণ-একজন নাগরিক— বেসরকারি-’
‘তবু,’ একটু জোর দিয়েই বলেছেন মার্সেনে, ‘আমি যে ফরমানটা নিয়ে এখানে এসেছি সেটা যদি জাল হয়, সবকিছু দেখেশুনে এখন তো তা-ই মনে হচ্ছে, তাহ’লে যে-রাস্কেলটা এসে আমার জায়গা নিয়েছিল, মসিয় বারজাক নিশ্চয়ই তারই কোনো চক্রান্তের বলি হয়েছেন!’
‘হ্যাঁ, তা হ’তে পারে, খুবই সম্ভব সেটা,’ কর্নেলের খুঁতখুঁতুনি কিন্তু এ-কথাতে কাটেনি, ‘কিন্তু গোটা ব্যাপারটার মীমাংসা করবার জন্যে আমাদের তো বামাকো থেকে কোনো-একটা উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।’
‘কিন্তু এটাও তো বিষম-জরুরি,’ কেমন বিহুলভাবে বলেছেন মার্সেনে। ‘যখন সাহায্যের জন্যে এমন-ব্যাকুলভাবে আবেদন জানিয়েছেন, তখন এই তরুণীকেও তো আমরা বিপদের মুখে ফেলে রাখতে পারি না।’
‘বিপদ ঠিকই, কেননা তিনি বলেছেন তিনি কোথাও বন্দী হ’য়ে আছেন,’ কর্নেল শান্তভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, ‘কিন্তু এটা বলেননি যে এক্ষুনি না-গেলে তাঁর মৃত্যুর আশঙ্কা আছে।…তাছাড়া উদ্ধার করতে যাওয়া যাবেই বা কোথায়? এ-কোন্ ব্ল্যাকল্যান্ডের কথা তিনি বলছেন?’
‘তিনি আমাদের অক্ষরেখা জানিয়েছেন।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু দ্রাঘিমাংশটা কী? মাদমোয়াজেল মোর্নাসকে সিকাসোর ওদিকটায় রেখে আসা হয়েছিলো। তিনি নিশ্চয়ই ফের পশ্চিমদিকে ফিরে যাননি। ষোলো ডিগ্রি অক্ষরেখা প্রথমে যায় মাসিনা দিয়ে, তারপর নাইজার পেরিয়ে সোজা গিয়ে উধাও হয়, মরুভূমির মধ্যে – যে-মরুভূমির কথা কারুই কিছু জানা নেই। ব্ল্যাকল্যাড নিশ্চয়ই মাসিনায় নেই, তাহ’লে তার কথা আমরা জানতুম, তাহ’লে তো এই ব্ল্যাকল্যান্ডকে খুঁজতে সোজা মরুভূমিতে গিয়ে পৌঁছুতে হয় আমাদের।’
‘কিন্তু…’
‘না, কাপ্তেন, আমি তো বুঝতে পারছি না ঐ মরুভূমির মধ্যে একদল সৈন্য আমি পাঠাবো কী ক’রে? সে-তো মাত্র একজন বেসরকারি নাগরিককে উদ্ধার করবার জন্যে একশো-দুশো সৈন্যের জীবন বিপন্ন করা হবে!’
দুশো লোক লাগবে কেন?’ মার্সেনের মনে হচ্ছিলো তাঁর সব আশা বুঝি উধাও হ’য়ে যাচ্ছে। ‘অনেক-কম লোক হ’লেই চলবে।’
আমার তা মনে হয় না, কাপ্তেন! নাইজারের তীর ধ’রে যে-সব গুজব ছড়াচ্ছে, তার কথা আমরা সবাই জানি। কালোদের মধ্যে রব উঠেছে যে কোন্খানে নাকি- কেউ জানে না কোন-চুলোয়-একটা সাম্রাজ্য গ’ড়ে উঠেছে, যার সম্বন্ধে খুব-একটা ভালো ধারণা পোষণ কবরার কোনো কারণ নেই। ব্ল্যাকল্যান্ড নামটা যেহেতু চেনা নয়, সেইজন্যে এমনও হ’তে পারে যে এটা সেই সাম্রাজ্যের রাজধানী কিংবা কোনো বড়োশহর। যে-অক্ষাংশটা পাওয়া গেছে, তাতে মনে হয় ও-রকম কোনো সাম্রাজ্য ওখানেই প্রতিষ্ঠিত হ’য়ে থাকতে পারে—কেননা শুধু ওখানেই থাকলে তার সম্বন্ধে কোনো কথা জানবার উপায় কারু থাকে না। তাছাড়া, ব্ল্যাকল্যান্ড নামটা তো ইংরেজি—সেটা একটু অদ্ভুত নয়? ঐ অনুমতি অবস্থান থেকে ইংরেজদের উপনিবেশ সোকোটো খুব-একটা দূরে নয়…সেটা হয়তো আরেকটা ঝামেলা পাকাবে, একেবারে মৌচাকে ঢিল মারবার শামিল হবে…আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কথাও ভেবে দেখতে হয়…অর্থাৎ, এত-সবকিছু বিবেচনা ক’রে, আমার মনে হয়, ও-রকম কোথাও কোনো অভিযানে বেরুবার ঝুঁকি অনেক-তাতে অল্প লোক নিয়ে কিছুতেই যাওয়া চলে না।’
‘তাহ’লে, কর্নেল, আপনি সাহায্য পাঠাতে রাজি নন?’
‘অত্যন্ত দুঃখ হ’লেও, এ-কথা আমি বলতে বাধ্য যে এই ঝুঁকি আমি কিছুতেই নিতে পারি না।’
কাপ্তেন মার্সেনে তারপরেও একগুঁয়ের মতো লেগে থেকেছেন। বন্ধুকে যেমন বলেছিলেন, তেমনিভাবেই কর্নেলকেও তিনি বলেছেন মাদমোয়াজেল মোরনাসের সঙ্গে তাঁর কী-রকম হার্দ্য সম্পর্ক গ’ড়ে উঠেছে। কিন্তু এই হৃদয়ঘটিত স্বীকারোক্তিতেও কোনো কাজ হয়নি। পরে তিনি আরো বলেছেন, তিনি নিজেই তো একশো সৈন্য নিয়ে এসেছেন –এবং এখানে কেউই তাদের আসার প্রত্যাশা করেনি, ফলে শুধু তাদের নিয়েই তো তিনি চ’লে যেতে পারেন—কিন্তু এত আবেদন- নিবেদনে কোনো ফল হয়নি। কর্নেল আলেজ কিছুতেই তাঁর সংকল্প থেকে নড়েননি।
‘আমি দুঃখিত, কাপ্তেন, গভীরভাবেই দুঃখিত। কিন্তু এই প্রস্তাবটা নাকচ ক’রে দেয়া আমার কর্তব্য। আপনি যে-সৈন্যবাহিনী সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তাদের হয়তো এখানে কোনোই দরকার নেই, কিন্তু তবু, তারাও তো মানুষ, আমি তাদের জীবন- মরণ নিয়ে এমন হালকাচালে ছিনিমিনি খেলতে পারি না। তাছাড়া অত তাড়াই বা কীসের? আমরা বরং মোদমোয়াজেল মোরনাসের কাছ থেকে আরেকটা খবর আসার জন্যে সবুর ক’রে দেখি। একবার যখন তিনি টেলিগ্রাফ করতে পেরেছেন, তখন হয়তো আবার তিনি টেলিগ্রাফ করার চেষ্টা করবেন।
‘আর যদি না-করেন,’ হতাশায় তলিয়ে যেতে-যেতে বলেছেন কাপ্তেন মার্সেনে। তাঁর এই অসমাপ্ত বার্তা থেকে কোন্ সিদ্ধান্তে গিয়ে তবে আমরা পৌঁছুবো?’ কর্নেল শুধু দুঃখিত ভঙ্গি করেছেন, কিছুতেই তিনি তাঁর মত পালটাতে রাজি হননি।
‘তাহ’লে আমি একাই যাবো,’ এতক্ষণে দৃঢ়স্বরে ঘোষণা ক’রে উঠেছেন মার্সেনে।
‘একা?’
‘হ্যাঁ, কর্নেল। আমি ছুটির দরখাস্ত করবো, আপনি সেটা নামঞ্জুর করতে পারবেন না—’
‘উঁহু, ঠিক তার উলটোই, আমি এ-ছুটি কিছুতেই মঞ্জুর করতে পারবো না।’ কর্নেল শান্ত গলায় বলেছেন : ‘আপনি কি ভেবেছেন আপনাকে আমি এমন- একটা অ্যাডভেনচারে ঝাঁপ খেয়ে পড়তে দেবো, যেখান থেকে আপনি হয়তো সশরীরে আর ফিরতেই পারবেন না।’
‘সে-ক্ষেত্রে, কর্নেল, আমি অপনাকে অনুরোধ করবো অনুগ্রহ ক’রে আমার ইস্তফাপত্র গ্রহণ করতে।’
‘আপনার ইস্তফা?’
‘হ্যাঁ, কর্নেল।’
কর্নেল আলেজ গোড়ায় কোনো কথাই খুঁজে পাননি। তাঁর অধীনস্থ এই সাহসী ও বেপরোয়া মানুষটির দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছেন, মার্সেনে এখন ঠিক স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। প্রায় অভিভাবকের সুরেই তিনি বলেছেন : ‘আপনি নিশ্চয়ই জানেন, কাপ্তেন, যে আপনার ইস্তফাপত্র কতগুলো সরকারি দফতর দিয়ে যাবে— আমার হাতে এই ইস্তফা গ্রহণ করবার কোনো ক্ষমতাই নেই। তাছাড়া, এত-বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নেবার আগে একটু পুনর্বিবেচনা ক’রে দেখারও প্রয়োজন আছে। আজ রাতটা বরং এ নিয়ে আমরা ভাবি-কাল এসে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। এ নিয়ে বিশেষভাবে আলাচনা ক’রে দেখা দরকার।’
পোশাকি-একটা সেলাম ঠুকে, দুই বন্ধু তখন কর্নেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। পেরিনি বন্ধুকে বোঝাতে-বোঝাতে সঙ্গে গেছেন, তাঁকে আশ্বাস দেবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বেচারা মার্সেনের কানে বুঝি তাঁর একটা কথাও পৌঁছোয়নি। নিজের কোয়ার্টারের কাছে এসেই মার্সেনে বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে সোজা আছড়ে পড়েছেন তাঁর বিছানায়। অভিভূত, হতাশ, বিমর্ষ মার্সেনে তারপর ফুঁপিয়ে উঠেছেন অঝোর কান্নায়।