২.০৬ হুড বনাম ব্যাঙ্কস
২৯শে সেপ্টেম্বর বেহেমথ আস্তে-আস্তে বিন্ধ্যপর্বতের উত্তরের ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করলে। শ্রীগড়ের গিরিসংকটে যাবার এটাই রাস্তা।
এ-পর্যন্ত আমাদের রাস্তায় কোনো অসুবিধেই হয়নি। পেরিয়ে এসেছি ত্রিবেণী ও যমুনা, গোয়ালিয়র ও ঝান্সি, বেতোয়া—অর্থাৎ এটোয়া থেকে ৬২ মাইল দূরে চলে এসেছি আমরা।
গোয়ালিয়র ও ঝান্সি পেরুবার সময় আমরা সাবধান ছিলুম। কিছুতেই শহরের মধ্যে ঢুকিনি। কারণ এখানেই নানাসাহেবের বান্ধবী ঝান্সির রানী লক্ষ্মীবাঈ প্রবল পরাক্রমের সঙ্গে ইংরেজবাহিনীকে প্রতিরোধ করেছিলেন। এখানেই সার্জেন্ট ম্যাকনীলের সঙ্গে সার এডওয়ার্ডের ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। এখানেই সার হিউ রোজ দু-দিন ব্যাপী একটানা লড়াইয়ে লক্ষ্মীবাঈয়ের বাহিনীর দ্বারা বিষম ক্ষতিগ্রস্ত হন। তান্তিয়া টোপি, বালাজি রাও ও রানী লক্ষ্মীবাঈ অবশেষে পিছু হঠতে বাধ্য হলেও সমগ্র বুন্দেলখণ্ডের মধ্যে এখানেই প্রথম বিদ্রোহের আগুন দাউদাউ জ্বলে উঠেছিলো। সেইজন্যেই সার এডওয়ার্ডের তিক্ত ও বিষণ্ণ স্মৃতিকে একটুও উশকে দিতে চাইলুম না আমরা—বরং একটু ঘুরে এ-সব শহরের পাশ কাটিয়ে চলে এসেছি বিন্ধ্যপর্বতের সানুদেশে। জব্বলপুর এখান থেকে মাত্র ষাট মাইল দূরে—কিন্তু এখানে তাড়াতাড়ি চলবার উপায় নেই— উঁচুনিচু উবড়োখবড়ো পার্বত্যভূমি, সেইজন্যেই অপেক্ষাকৃত বেশি সময় লাগবে জব্বলপুর পৌঁছুতে খাড়া উৎরাই, খারাপ রাস্তা, পাথুরে জমি, হঠাৎ একেকটা ধারালো মোড় আর সরু গিরিপথ—এই সবকিছু মিলে বেহেমথের গতি অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে।
তাছাড়া এখানে সবসময় সাবধানে থাকতে হচ্ছে, ব্যবস্থা রাখতে হচ্ছে কড়া পাহারার। কালোগনিই বিশেষ করে পাহারার ব্যবস্থা করার জন্যে তাড়া দিয়েছে। কারণ এদিকটায় নাকি ভীষণ দস্যুর ভয়। দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল বলে এখানটায় নাকি বহু দস্যুদল আশ্রয় নিয়েছে-ফলে এখান দিয়ে যাবার সময় অত্যন্ত সাবধান হতে হয়। হয়তো কিছুই হবে না, কোনো ডাকাতদলই বেহেমথকে আক্রমণ করবে না; কিন্তু তবু সাবধানের মার নেই।
অবশ্য আমাদের ভয়ের কিছু ছিলো না। প্রথমত আমরা সংখ্যায় নেহাৎ কম নই, অস্ত্রশস্ত্রও রয়েছে যথেষ্ট, তার উপর আস্ত একটা চলন্ত কেল্লায় করে যাচ্ছি। কাজেই বুন্দেলখণ্ডের এদিকটায় যদি খুনে ডাকাত বা ভীষণ ঠগিরা ঘাপটি মেরে লুকিয়েও থাকে তবু আমাদের আক্রমণ করতে সাহস পাবে না।
শ্রীগড়ের গিরিপথ অব্দি অনায়াসেই পৌঁছুনো গেলো—একটু সময় লাগলো বটে, কিন্তু কোনো বিপদ-আপদ বা অসুবিধে হলো না আমাদের। তাছাড়া দেখে মনে হলো এই সব ঘোরানো ও জটিল পাহাড়ি রাস্তা কালোগনির একেবারে নখদর্পণে। কাজেই তার উপরেই সব ভার ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো; সে-ই আমাদের এইসব পাইন বন, গভীর খাত ও উঁচু পাকদণ্ডী দিয়ে অনায়াসেই বেহেমথকে চালনা করে নিয়ে এলো।
কখনও-কখনও অবশ্য সে বেহেমথকে থামিয়ে দিয়ে নিজে গিয়ে চারপাশটা দেখে আসছিলো, তবে তা কিন্তু পথ চেনে না বলে নয়,-বর্ষার পর এখানকার রাস্তা অনেক সময় থাকে প্লবিত ও পিছল, সে-রকম অবস্থায় হয়তো বেহেমথকে ও-পথ দিয়ে নিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক।
আবহাওয়াও চমৎকার যাচ্ছে। বৃষ্টি-বাদল নেই; জলন্ত আকাশ হালকা কুয়াশার পর্দায় ঢাকা, সেইজন্যে গরমও কম লাগছে। চাই কি সময়-সময় হুড শিকারের মৎলব এঁটে সফরিতে বেরুচ্ছে। তবে ফক্স আর সে, দুজনেই তরাইয়ের জঙ্গলের জন্য হাহুতাশ করে প্রায়ই; সেখানে যেন বন্যজন্তুর মেলা বসে গিয়েছিলো—কিন্তু এখানে বাঘসিংহের কোনো পাত্তাই নেই।
তবে সেইসব আমিষখোর জন্তুর বদলে আমরা এখানে মাঝে-মাঝে বুনো হাতির দেখা পাচ্ছি, যে-দৃশ্য এমনকী, ভারতবর্ষের অন্য-অনেক অঞ্চলেও দুর্লভ। ৩০শে সেপ্টেম্বর দুপুরবেলায় এমনকী একজোড়া হাতিকে বেহেমথের সামনে দেখা গেলো। বাঁশি বাজিয়ে বেহেমথকে সবেগে অগ্রসর হতে দেখে, তারা রাস্তা থেকে সরে দাঁড়িয়ে আমাদের যেতে দিলে ৷ বোধহয় বেহেমথের মতো প্রকাণ্ড অতিকায় হাতিকে দেখে তারা কিঞ্চিৎ বিস্মিত ও বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলো।
এমনকী ক্যাপ্টেন হুড শুদ্বু–কোনো বুনো জন্তু দেখলেই যার হাত বন্দুকের ঘোড়া টেপবার জন্যে নিশপিশ করতে থাকে-অপ্রয়োজনে এই প্রকাণ্ড সুন্দর জন্তুদের তাগ করে গুলি চালাবার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা কেবল তাদের চলার ভঙ্গির প্রশংসা করতে লাগলুম।
ফান খোইত থাকলে নিশ্চয়ই এই সুযোগে প্রাণিতত্ত্ব সম্বন্ধে মস্ত একটা বক্তৃতা দিয়ে বসতেন, ক্যাপ্টেন হুড মন্তব্য করলে।
এটা নিশ্চয়ই সবাই জানে যে ভারতবর্ষই আসলে মাতঙ্গ রাজ্য–যদিও এটা ঠিক যে আফ্রিকার হাতির চেয়ে ভারতের হাতি আকারে অনেক ছোটো—তবে ভারতের নানা অঞ্চলেই এদের পাওয়া যায়—ব্রহ্মদেশ, শ্যাম, বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলেও হাতি ঘুরে বেড়ায়। সাধারণত খেদা-র সাহায্যেই হাতি ধরা হয়ে থাকে; পোষা হাতিরা ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে আসে তাদের—কখনও বহু শিকারি একত্রে হাতিদের তিনদিক থেকে ঘিরে তাড়া লাগায়। বাংলাদেশে ও নেপালে এখনও ল্যাসো ব্যবহার করা হয় হাতি ধরার সময়ে। শুনে মনে হতে পারে হাতি ধরা বুঝি খুব সহজ ব্যাপার, কিন্তু বুনো খ্যাপা হাতির পাল্লায় পড়লে একেক সময় একেকটা তল্লাট তছনছ হয়ে যায়—আর বর্ষার পর অনেক সময়েই ভারতের বনজঙ্গলে খ্যাপা হাতির সন্ধান মেলে—এমনকী জনপদ পর্যন্ত নেমে আসে তারা, বাড়িঘর ভেঙেচুরে তাণ্ডব শুরু করে দেয়। কে বেশি মারাত্মক–মানুষখেকো বাঘ, না খ্যাপা হাতি-এ-তর্কের হয়তো কোনো শেষ নেই।
হাতি দুটো সরে দাঁড়িয়ে বেহেমথের পথ করে দিলে, আমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে হস্তিপুঙ্গবদের প্রশংসা করতে লাগলুম, স্টর আর কালু নির্বিঘ্নে হাতি দুটোকে পেরিয়ে বেহেমথকে চালিয়ে নিয়ে গেলো। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি হাতি দুটিও আমাদের পিছনপিছন আসছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে আরো-কয়েকটি হাতির দেখা পাওয়া গেলো; একটু দ্রুত হেঁটে তারাও আগেকার দুটো হাতির সঙ্গ নিলে। মিনিট পনেরোর মধ্যেই দেখা গেলো বেহেমথের পিছন পিছন প্রায় ডজন খানেক হস্তিশাবকের শোভাযাত্রা আসছে। স্পষ্ট বোঝা গেলো বেহেমথকে দেখে তারা বিস্মিত হয়েছে, প্রায় পঞ্চাশ গজ পিছনে সেই জন্যেই তারা মিছিল করে তাকে দেখতে আসছে। আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাবার কোনো লক্ষণ বা তাড়া তাদের নেই, এবং আমাদের সঙ্গ ত্যাগ করারও কোনো মৎসব তাদের দেখা গেলো না। ইচ্ছে করলে পবনবেগে ছুটতে পারে হাতিরা; বিন্ধ্যপর্বতের উবড়োখবড়ো রাস্তায় দ্রুত চলাই তাদের অভ্যেস। কিন্তু হাবভাব দেখে বোঝা গেলো আরো একপাল হাতিকে ডেকে এনে বেহেমথকে দেখানো ছাড়া তাদের আর-কোনো মৎলব নেই, কারণ চলতে-চলতে তারা অনবরত অদ্ভুত আওয়াজ করে-করে ডাকছিলো। সেই ডাক যে আসলে অন্য হাতিদের হাঁক পেড়ে নিয়ে-আসা, তা বুঝতে আমাদের দেরি হলো না, কারণ দূর থেকে ঠিক তেমনিভাবে তৎক্ষণাৎ অন্য হাতিদের সাড়া পাওয়া যাচ্ছিলো।
একটা নাগাদ দেখা গেলো প্রায় তিরিশটা হাতি পায়ে-পায়ে আমাদের অনুসরণ করে আসছে; সংখ্যাটা যে অচিরেই আরো বৃদ্ধি পাবে, সেই সম্ভাবনাটাও ছিলো তখনও। মাঝে-মাঝে এ-রকম যুথবদ্ধ হাতির পালের মুখোমুখি পড়া ভারতের জঙ্গলে নতুন ব্যাপার নয়—এবং সেই সাক্ষাৎকার পথিকদের পক্ষে সাধারণত বিশেষ উপভোগ্য ঠেকে না।
আমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিঞ্চিৎ উৎকণ্ঠার সঙ্গেই এই অদ্ভুত মিছিলটি তাকিয়েতাকিয়ে দেখতে লাগলুম।
সংখ্যা যে ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে, বললে ব্যাঙ্কস, এদিককার সব হাতিকেই দেখছি একজায়গায় জড়ো করতে চায় এরা।
কিন্তু, আমি বললুম, তারা নিশ্চয়ই অনেক দূর-দূর থেকে সব হাতিকে ডেকে আনতে পারবে না।
ডাকতে পারবে না, এ-কথা ঠিক, ব্যাঙ্কস সায় দিলে, কিন্তু এদের ঘ্রাণশক্তি খুব প্রখর-কারণ পোষা হাতিরা অনেক সময় তিন-চার মাইল দূরের বুনো হাতির গন্ধ পায়।
এরা তো দেখছি মহাপ্রস্থানে বেরিয়েছে। বললেন কর্নেল মানরো, ব্যাঙ্কস, আমাদের বোধহয় বেহেমথের গতি বাড়ানো উচিত।
বেহেমথ তার যথাসাধ্য করছে, সার এডওয়ার্ড। এই উবড়োখবড়ো উৎরাই বেয়ে চলা খুব-একটা সহজ কাজ নয়।
তাড়াহুড়ো করার কী দরকার? নতুন অ্যাডভেনচারের গন্ধে হুড উল্লসিত হয়ে উঠলো, আসুক না এরা, যতখুশি। এরা যদি আমাদের শোভাযাত্রা করে পোঁছে দিতে চায়, তাহলে ক্ষতি কী? জায়গাটা এমনিতেই উষর আর পরিত্যক্ত—এদের জন্যেই এখন ক্রমশ চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠছে। রাজাবাদশারাও কখনও এ-রকম সংবর্ধনা পায় না।
এদের উপস্থিতিকে না-মেনে আর উপায় কী? বললে ব্যাঙ্কস, এদের হাত এড়াবার কোনো পথ তো দেখছি না।
আরে, এত ভয় পাচ্ছো কেন? জিগেস করলে ক্যাপ্টেন হুড। এটা নিশ্চয়ই জানো একটা খ্যাপা হাতি যত ভীষণ, একটা আস্ত হাতির পাল তত নয়। বেশতো শান্তশিষ্ট জীব-শুঁড়ওলা কতগুলো ভেড়া, এই আর-কী।
হুডের উৎসাহ দেখছি ক্রমশই উশকে উঠছে, বললেন কর্নেল মানরো, আমি এ-কথা মানতে রাজি আছি যে হাতির পাল যদি এমনিভাবে পিছন পিছন আসে আমাদের, তাহলে আমাদের ভয়ের কিছুই নেই; কিন্তু যদি হঠাৎ এ-কথা তাদের মাথায় ঢোকে যে এই সরু রাস্তায় আমাদের পাশ কাটিয়ে তাদের এগিয়ে যেতে হবে, তাহলে ব্যাপারটা খুবই সঙিন হয়ে উঠবে।
তাছাড়া, আমি বললুম, বেহেমথের মুখোমুখি পড়লে তাকে যে কী-রকম সংবর্ধনা জানাবে, তা-ই বা কে জানে।
যত বাজে কথা! ওরা হাঁটু গেড়ে বসে শুঁড় তুলে বেহেমথকে সেলাম ঠুকবে। বললে হুড, মনে নেই, কুমার গুরু সিং-এর হাতিরা কী-রকম সেলাম জানিয়েছিলো?
কিন্তু তারা ছিলো পোয্য হাতি, শেখানো।
ওই বুনো হাতিগুলোও পোষ মানবে। বেহেমথের সামনে পড়লে এতই চমকে যাবে যে গভীর শ্রদ্ধা জেগে উঠবে এদের মনে।
কৃত্রিম যান্ত্রিক হাতির জন্যে হুডের প্রশংসা ক্রমেই গগনচুম্বী হয়ে উঠলো। আরো বললে, তাছাড়া হাতিরা বেশ বুদ্ধিমান হয়। তারা যুক্তি দেবে, তুলনা করবে, বিচার করে দেখবে। মানুষের মতো তারাও দুটো ভাবনাকে যোগ করে দেখতে পারে।
আমি এ-কথা মানি না, বললে ব্যাঙ্কস!
এ-কথা মানো না? তুমি? হুড বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলো, তোমার কথা শুনে মনে হয় তুমি বুঝি কস্মিনকালেও ভারতে বাস করোনি। কেন, পোষা হাতিদের যে সবরকম ঘরোয়া কাজেই লাগানো হয়, তা তুমি জানো না? এ-কথা কি কখনও শোনননি, মোক্লের, বড়ো-বড়ো লেখকরা হাতি সম্বন্ধে কী বলে গেছেন? তাদের মতে, হাতি অত্যন্ত প্রভুভক্ত—মোট বয়, ফুল তুলে নিয়ে আসে প্রভুদের জন্যে, বাজার করে, নিজের জন্যে আখ, কলা, আম কিনতে পারে, নিজেই দম চুকিয়ে দেয় জিনিশপত্রের, পাহারা দেয়, গোটা ইংল্যাণ্ডের সবচেয়ে শিক্ষিত ধাত্রীর চেয়েও যত্ন করে ছোটোদের নিয়ে বেড়াতে বেরোয়। দয়া আছে তার, কৃতজ্ঞ জীব, স্মৃতিশক্তি অদ্ভুত, কোনো উপকার কি আঘাত পেলে ভোলে না কখনও। তাছাড়া কী নরম তার মন! পারলে একটা মশামাছি পর্যন্ত মারে না। আমার এক বন্ধু নিজের মুখে বলেছে এ-কথা : একটা পাখি নাকি বসেছিলো একটা পাথরের উপর, হাতিকে বলা হলো পাখিটা পায়ের তলায় চেপ্টে মারতে! কে কার কথা শোনে! মাহুতের হুমকি, ধমক কি ডাঙশের ঘা কিছুই হাতিটাকে ওই দুষ্কর্মে লিপ্ত করাতে পারেনি। তখন তাকে বলা হলো পাখিটাকে তুলে আনতে, অমনি সে আস্তে সন্তর্পণে আলগোছে গুড় দিয়ে পাখিটাকে তুলে আনলে—এবং তাকে উড়ে যেতে দিলে। আমার বন্ধু এ-দৃশ্য নিজের চোখে দেখেছে। বুঝলে, ব্যাঙ্কস, এটা তোমাকে মানতেই হবে যে হাতি এমনিতে খুব ভালো জীব, দয়া আছে, অন্যান্য জীবজন্তুর চেয়ে নানাদিক দিয়ে ভালো-বাঁদর কি কুকুরের চেয়েও বুদ্ধিমান ও প্রভুভক্ত! শোনননি ভারতীয়দের মতে হাতিদের নাকি মানুষের মতোই বুদ্ধিশুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞান রয়েছে? বলে হুড তার টুপি খুলে হাতিদের দিকে ঝুঁকে অভিবাদন জানালে।
ভালো বলেছে, হুড! কর্নেল মানরো মুচকি হাসলেন। হাতিরা তোমার মধ্যে একজন সত্যিকার ভালো উকিল পেয়েছে।
আপনার কি মনে হয় না আমি ঠিক বলেছি?
হুড হয়তো ঠিক কথাই বলেছে, বললে ব্যাঙ্কস, কিন্তু তবু আমি স্যাণ্ডারসনের মতেই সায় দেবো-স্যাণ্ডারসন কেবল মস্ত শিকারিই নন, এ-সব বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞও বটে।
বটে? তা শুনি তোমার স্যাণ্ডারসন মহোদয় কী বলেছেন?
তার মতে হাতিদের তেমন-কিছু অসাধারণ বুদ্ধি নেই। হাতিদের নিয়ে যে-সব গালগল্প প্রচলিত, তা আসলে মাহুতদের আদেশ পালন করারই ফল—তারা খুবই
প্রভুভক্ত, খুব কথা শোনে, এই আরকি!
বটে!
তিনি আরো বলেছেন, ব্যাঙ্কস বললে, হিন্দুরা কেন হাতিকে জ্ঞানের প্রতীক বলে মান্য করেনি, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। স্থাপত্যে কি ভাস্কর্যে সর্বত্র বুদ্ধির জন্য শ্রদ্ধা পেয়েছে শেয়াল, ভুশুণ্ডি কাক কি বাঁদর!
ভুল! ভুল! আমি এ-কথার প্রতিবাদ করি, তীব্র স্বরে বললে হুড।
প্রতিবাদ তুমি যত পারো করো, কিন্তু তার আগে আমার কথা শুনে নাও। স্যাণ্ডারসন বলেছেন যে মগজের মধ্যে আদেশ পালন করার কোষটা হাতিদের অস্বাভাবিক বর্ধিত-হাতির মাথার খুলি ব্যবচ্ছেদ করে কোষগ্রন্থিটা পরীক্ষা করেছেন তিনি। তাছাড়া হাতিরা এত নির্বোধ যে সহজেই ফাঁদে পড়ে যায়—তাকে ভুলিয়েভালিয়ে খেদায় নিয়ে আসা যায়। যদি কখনও পালিয়েও যায়, তবু এমনই অনায়াসে তাকে আবার ধরে ফেলা হয় যে তাতে তার কাণ্ডজ্ঞানের বিশেষ প্রশংসা করা যায় না। এমনকী অভিজ্ঞতাও তাকে বিশেষ-কিছু শেখাতে পারে না।
হায়রে হস্তিশাবক! শোন, ব্যাঙ্কস তোদের কী প্রশংসাপত্র দিচ্ছেন।
আরো বলবো? ব্যাঙ্কস বললে, স্ত্রী-হাতি কিংবা হস্তীশাবককে পোষ মানানো একটা প্রাণান্তকর ব্যাপার! এরা কিছুতেই কিছু শিখতে চায় না
তাতে তো আরো-বেশি প্রমাণিত হয় যে হাতিরা আসলে মানুষেরই মতো, হুড হেসে বললে, ছেলেছোকরা কি স্ত্রীলোকের চাইতে বয়স্ক মানুষদের শেখানো বা বোঝানো অনেক সোজা নয় কি?
বন্ধু-হে, আমি আর তুমি যেহেতু বিয়ে করিনি, সেই জন্যে আমাদের কি এ-রকম একটা মন্তব্য করে ফেলা ভালো?
হা-হা-হা, এটা তুমি ঠিক বলেছো।
এককথায়, ব্যাঙ্কস বললে, হাতিদের সুবুদ্ধি কি কাণ্ডজ্ঞানের উপর বেশি নির্ভর করতে আমি আদৌ রাজি নই। যদি কোনোকিছুতে এরা একবার খেপে যায়, তাহলে এদের প্রতিরোধ করা অসম্ভব হবে। যারা আমাদের এখন দক্ষিণমুখো পৌঁছে দিতে চাচ্ছে, আমি চাই যে শিগগির তারা যেন অন্যকোনো কাজে উলটো দিকে ছুট লাগায়!
তুমি আর হুড যতক্ষণ এদের নিয়ে তর্ক করলে, ততক্ষণে কিন্তু সংখ্যায় এরা ভীষণ রকম বেড়ে উঠেছে, ব্যাঙ্কস, আস্তে, ধীর গলায় মন্তব্য কবলেন কর্নেল মানরো।