২.০৫ বেতোয়ার পথে
১৮ই সেপ্টেম্বর বেহেমথ ঠিক কোন জায়গায় রয়েছে, তা বোঝাতে গেলে একটা ছোট্ট হিশেব দাখিল করা যেতে পারে।
কলকাতা থেকে দূরত্ব ৮১২ মাইল
হিমালয়ের শিবির থেকে দূরত্ব ২৩৬ মাইল
বম্বাই থেকে ব্যবধান ১০০০ মাইল
কত-কত মাইল ভ্রমণ করেছি, সেই হিশেব করলে অবশ্য আমাদের ভারতদর্শনের অর্ধেকও এখনও হয়নি, কিন্তু হিমালয়ের গায়ে যে-সাত হপ্তা কাটিয়ে এসেছি, সে-কথা মনে থাকলে বলতে হয় যে আমরা অর্ধেকেরও বেশি সময় ইতিমধ্যেই অতিবাহিত করে ফেলেছি। কলকাতা ছেড়েছিলুম ৬ই মার্চ—আর দু-মাসের মধ্যেই আশা করা যায় হিন্দুস্থানের পশ্চিম তীরে পৌঁছুতে পারা যাবে।
১৮৫৭র বিদ্রোহে যে-সব নগর প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলো, স্থির হলো তাদের সন্তর্পণে এড়িয়ে আমরা কেবল দক্ষিণমুখো অগ্রসর হবো। মধ্যভারতের পার্বত্য এলাকায় পৌঁছুনো পর্যন্ত কোনো ঝামেলা নেই—সে-পর্যন্ত রাস্তাঘাট খুবই ভালো। তাছাড়া কালোগনি তো সঙ্গে আছেই; তার মতো একজন অভিজ্ঞ ও ওস্তাদ লোক থাকতে কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়-হিন্দুস্থানের এদিকটা তার যে ভালোই জানা আছে, এটা তার হাবভাব দেখে আমরা বুঝতে পারলুম।
কর্নেল মানরো তখন মধ্যাহ্নভোজের পর দিবানিদ্রায় ঢুলে পড়েছেন, এমন সময় ব্যাঙ্কস একদিন কালোগনিকে ডেকে পাঠালে।
ব্যাঙ্কস প্রথমে তাকে জিগেস করলে এদিকটাকে সে কেন এত ভালো করে চেনে। উত্তরে কালোগনি বললে যে সে আসলে যাযাবর বেদুইনদের লোক—এ-সব জায়গায় বেদেদের সঙ্গে বহুবার তাকে যাতায়াত করতে হয়েছে, সেই জন্যেই এখানকার পথঘাট তার এত চেনা হয়ে গেছে।
এখনও এ-সব অঞ্চলে বেদেরা ঘুরে বেড়ায়?
আজ্ঞে হ্যাঁ–বছরের এ-রকম সময়ে তারা উত্তরে ফিরে আসে—হয়তো রাস্তায় ও-রকম কোনো দলের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে যেতে পারে।
তা, কালোগনি, তোমাকে পেয়ে আমাদের খুব ভালো হলো। তুমি আমাদের অনেক কাজে লাগবে। আমরা আসলে বড়ো-বড়ো শহরগুলো এড়িয়ে গিয়ে খোলা জায়গা দিয়ে যেতে চাই–তুমিই তাহলে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।
নিশ্চয়ই, হুজুর, ঠাণ্ডা গলায় বললে কালোগনি। তার এই হিম ঠাণ্ডা আবেগহীন গলা শুনলেই আমার কেমন যেন অস্বস্তি হতে থাকে। সে আরো বললে, কীভাবে আমরা যেতে পারি তার একটা মোটামুটি খশড়া তৈরি করে দেবো কী?
তাহলে তো খুব ভালো হয়। ব্যাঙ্কস টেবিলের উপর একটা মানচিত্র বিছিয়ে ধরলে-কালোগনির কথার সঙ্গে সে মানচিত্র দেখে মিলিয়ে নিতে চায়।
সে আর এমন বেশি কথা কী? একটা সোজা পথ গেছে—দিল্লি রেলপথ থেকে বম্বাই রেলপথ অব্দি—দুটো রাস্তা এসে মিলেছে এলাহাবাদে। এটোয়া আর বুন্দেলখণ্ডের সীমান্তের মধ্যে একটাই বড়ো নদী আমাদের পেরুতে হবে—সেটা যমুনা। ওটা আর বিন্ধ্যপর্বতের মাঝখানে বেতোয়া বলে আরেকটা নদী আছে। বেশি বৃষ্টি হলে মাঝেমাঝে পথঘাট জলে ড়ুবে যায়—তবে মনে হয় আপনাদের এই কলের হাতি তাকে অনায়াসেই পেরিয়ে যেতে পারবে।
সেজন্যে খুব-একটা ভাবনা নেই, ব্যাঙ্কস তাকে জানালে।তারপর? বিন্ধ্যপর্বতে পৌঁছে–
আমরা একটু দক্ষিণ-পূব মুখো যাবো-একটা ভালো গিরিপথ আছে। সেখানেও কোনো অসুবিধে হবে না—গাড়ি-টাড়ি হলে এই গিরিপথ দিয়েই যায়—রাস্তাটা চেনা। এটাকে বলে শ্রীগড়ের গিরিপথ।
তাতে আমাদের কোনো অসুবিধে নেই, কিন্তু এখানে মানচিত্রে দেখছি শ্রীগড়ের গিরিপথের পর জায়গাটা কেমন উঁচুনিচু। তার চেয়ে ভোপাল দিয়ে গেলে ভালো হয় না?
কিন্তু সেদিকে অনেক বড়ো-বড়ো শহর রয়েছে। তাদের এড়িয়ে-যাওয়া তাহলে মোটেই সম্ভব হবে না। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় সেপাইরা সেখানে বড়ো-বড়ো লড়াই। করেছিলো।
স্বাধীনতা সংগ্রাম কথাটা আমার অদ্ভুত ঠেকাে-ইংরেজরা যাকে বলে বিদ্রোহ ভারতীয়রা নিশ্চয়ই এটাকে বিদ্রোহ বলে দ্যাখে না। তাদের কাছে গোটা বিক্ষোভটাই নিশ্চয়ই স্বাধীনতার লড়াই হয়ে উঠেছিলো।
বেশ, তাহলে ভোপালের আশপাশ দিয়ে না-গিয়ে শ্রীগড় দিয়েই আমরা যাবো, বললে ব্যাঙ্কস, কিন্তু তুমি ঠিক জানো তারপর ঐ অসমতল উঁচুনিচু পথ পেরিয়ে আমরা শেষটায় ভালো রাস্তায় গিয়ে পড়বো?
একটু ঘুরে গেলে জব্বলপুরের কাছ দিয়ে আমরা বৰাই যাবার রেলপথ ধরে ফেলতে পারবো।
মানচিত্র দেখে ব্যাঙ্কস বললে, এবার বুঝলুম। আর তারপর–
তারপরে রাস্তাটা আবার দক্ষিণ-পশ্চিমমুখো এগিয়েছে-বম্বাইয়ের রেলপথের একেবারে সমান্তরালভাবে।
হুঁ, ঠিক বলেছো। তাহলে এদিকে তো বিশেষ কোনো অসুবিধে দেখছি না। আমরা তাহলে এদিক দিয়েই যাবো।
কালোগনি সেলাম ঠুকে চলে যাচ্ছিলো, হঠাৎ কী ভেবে ফিরে দাঁড়ালে।
কিছু বলবে? ব্যাঙ্কস জিগেস করলে।
একটা কথা জিগেস করবো? বুন্দেলখণ্ডের ঐ শহরগুলো আপনারা এড়িয়ে যেতে চান কেন?
ব্যাঙ্কস আমার দিকে তাকালে একবার। এই লোকটার কাছ থেকে কিছুই লুকোবার নেই আসলে। অল্প দু-চার কথায় ব্যাঙ্কস তাকে কর্নেল মানরোর মনের অবস্থাটা বুঝিয়ে দিলে।
সব শুনে সে একটু অবাকভাবেই বললে, কিন্তু নানাসাহেবের কাছ থেকে তো কর্নেল মানরোর ভয়ের কোনো কারণ নেই—বিশেষ করে এই অঞ্চলে।
এখানেও না, অন্য-কোথাও নয়। ভয় পাবার কথা মোটেই হচ্ছে না। কিন্তু তুমি বিশেষ করে এখানকার কথা বলছো কেন? জিগেস করলে ব্যাঙ্কস।
কারণ শুনেছি কয়েক মাস আগে নানাসাহেবকে নাকি বম্বাই প্রেসিডেন্সিতে দেখা গিয়েছে, কিন্তু অনেক খোঁজ-খবর করেও পরে তার আর-কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি। যদি কখনও তিনি ওদিকটায় গিয়েও থাকেন, এতদিনে তিনি যে আবার ফিরে এসে ভারত-চিন সীমান্ত অতিক্রম করেছেন, তাতে বোধহয় কোনো সন্দেহ নেই।
তার কথা শুনে বোঝা গেলো যে সাতপুরা পর্বতে মে মাসে কী ঘটেছিলো, সেখবর তার মোটেই জানা নেই।
মনে হচ্ছে হিমালয়ের জঙ্গলে খবর পৌঁছুতে অনেক সময় নেয়। ব্যাঙ্কস বলে উঠলো।
কালোগনি বিমূঢ়ভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার ধাঁধায়-পড়া ভঙ্গি দেখে মনে হলো না ব্যাঙ্কসের কথার কোনো মর্মোদ্ধার সে করতে পেরেছে।
নানাসাহেব যে মারা গেছেন, তা মনে হচ্ছে তুমি জানো না?
নানাসাহেব মারা গেছেন! কালোগনি অস্ফুট স্বরে চীৎকার করে উঠলো।
নিশ্চয়ই, বললে ব্যাঙ্কস, সরকার বাহাদুর সমস্ত খুঁটিনাটি সমেত তার মৃত্যুর খবর প্রকাশ করেছেন। নানাসাহেব নিহত হয়েছেন—
নিহত হয়েছেন? নানাসাহেব? কালোগনি মাথা নাড়লে। শুনি, কোথায় নানাসাহেব নিহত হয়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে।
সাতপুরা পাহাড়ে।
কবে? মাস ছয়েক আগে। ২৫শে মে।
কলোগনির কালো মুখটা মুহুর্তের জন্য ঝলসে উঠলো। কোনো কথা না বলে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো একটুক্ষণ। কী যেন ভাবছে।
আমি জিগেস করলুম, নানাসাহেবের মৃত্যুর সংবাদ মিথ্যে বলে মনে হয় তোমার? মিথ্যে মনে হবার কোনো বিশেষ কারণ আছে?
না, সাহেব। আপনারা যা বললেন, তাই আমি বিশ্বাস করেছি। বলে সেলাম করে, কালোগনি সেখান থেকে চলে গেলো।
সে চলে যেতেই ব্যাঙ্কস বললে, দেখলে, মোক্লের? এরা কেমন লোক! সিপাহী বিদ্রোহের নেতাকে এরা মর-মানুষ বলেই মনে করে না। যেহেতু এরা তাঁকে ফাসিতে ঝুলতে দ্যাখেনি, সেইজন্য কোনোদিনই এরা বিশ্বেস করবে না যে তার মৃত্যু হয়েছে।
এ-রকম হয়, আমি বললুম, নাপোলিয়র মৃত্যুর কুড়ি বছর পরেও তার সেনাদল মেনে নিতে পারেনি যে তার মৃত্যু হয়েছে।