৫. নতুন বন্দীশালা
তাহ’লে তোঙ্গানে শুধু বেঁচেই নেই, পরে তার কথা থেকে জানা যাবে, কুবোর ঐ আচমকা হানার সময় তার গায়ে একটা আঁচড় অব্দি লাগেনি। হানাদারদের সন্ধানীআলোগুলো তার গায়ে পড়েনি; সে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে চটপট গাছপালার আড়ালে মিলিয়ে যেতে পেরেছে; হানাদাররা অন্যদের নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলো যে তাকে নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি।
তবে তার মাথায় কিন্তু তার প্রভুদের ছেড়ে যাবার কথা একবারও স্থান পায়নি, তাছাড়া মলিকও তো তাঁদেরই সঙ্গে থেকে গেছে। সে এমনকী মনে-মনে ভেবেছিলো তাঁদের কাছে এসে তাঁদের সাহায্য করবে, কিন্তু পরক্ষণেই সে ভেবে দেখেছে সে তাঁদের সবচেয়ে কাজে লাগতে পারবে যদি সে তার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখে।
পালিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাবার বদলে, সে কিন্তু আগাগোড়া হানাদারদের অনুসরণ ক’রে এসেছে। মরুভূমি পেরুবার সময় তাকে যে কত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, তা সে কোনোদিনই ভাষায় ব’লে বোঝাতে পারবে না, সে-এক অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা, সে শুধু সারাক্ষণ ফেউয়ের মতো তাদেরই পেছনে লেপটে থেকেছে যারা মলিককে নিয়ে ব্ল্যাকল্যাণ্ড আসছিলো। তারা যেখানে-যেখানে থেমে খাওয়াদাওয়া করেছে পরে সেখানে এসেই তাদের পাতের ফেলে-দেয়া খাবার কুড়িয়ে-বাড়িয়েই নিজেকে কোনোরকমে টিকিয়ে রেখেছে সে। পায়দলে এসেছে বটে, তবু তাদের ঘোড়ার সঙ্গে সে তাল রেখেছে –দিনে অন্তত কুড়িমাইল পথ পেরিয়েছে সে ঐ ধূ-ধূ তপ্ত বালির ওপর
একেবারে ব্ল্যাকল্যাণ্ডের কাছে না-এসে সে কখনও তাদের নাগাল ছাড়েনি। যেই তারা চাষের জমির কাছে এসে পড়েছে, সে থমকে গিয়েছে, অপেক্ষা করেছে কখন রাত নামে প্রকাশ্য দিবালোকে এই অজানা দেশে পা দেবার ঝুঁকি নেবার সাহস তার হয়নি। তারপর ভোরবেলার দিকে লুকিয়ে পড়েছে গাছপালার আড়ালে ঘন ঝোপের মধ্যে, তারপর সকালে যখন ব্ল্যাকল্যান্ডের কালো গোলামরা খেতে কাজ করতে এসেছে, সে মিশে গিয়েছে তাদের মধ্যে, সারাদিন তাদেরই সঙ্গে হাতে হাত লাগিয়ে সে কাজ করেছে, তাদেরই সঙ্গে পাহারার ছড়ির ঘা খেয়েছে- আর পাহারারা আর-কিছু পারুক না-পারুক দু-হাতে ছড়ি চালাতে ওস্তাদ, আর তার পর ঐ আফ্রিকিদের সঙ্গেই ফিরে এসেছে শহরের কেন্দ্রীয় অংশে, সন্ধেবেলায়, কেউ তার দিকে একবার দৃপাতও করেনি।
একদিন একটা পরিত্যক্ত ভাঙাচোরা কুঁড়েবাড়ির মধ্যে এই রশির বাণ্ডিলটা কুড়িয়ে পেয়েছে। তারই সাহায্যে সে তথাকথিত বেসরকারি নাগরিকদের পেছন- পেছন আসতে পেরছে, শেষ অব্দি এসে পৌঁছেছে নদীর পাড়ে, যেখানে পুরো দুটো দিন সে লুকিয়ে থেকেছে একটা পয়ঃপ্রণালীর মুখে, তাকে-তাকে অপেক্ষা ক’রে থেকেছে কখন সুযোগ আসে।
আর তারই মধ্যে সে দেখেছে বন্দীরা সবাই রোজ সন্ধেয় বুরুজের ওপরে এই প্ল্যাটফর্মের ওপরে এসে ওঠেন, কতবার সে তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাঁরা একবারও তার দিকে তাকাননি। যে-সুযোগটার সে অপেক্ষা করছিলো, সেটা ৮ই এপ্রিল অর্থাৎ তৃতীয় দিনের আগে আসেনি। সেদিন সন্ধে থেকেই আকাশে ঝুলেছিলো ভারি ভারি বাদলমেঘ, আর অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিলো, তারই সুযোগ নিয়ে সে বেরিয়ে এসেছে ঐ নর্দমার মুখ থেকে, আর ওপরে এই রাশিটা ছুঁড়ে দিয়েছে তার প্রভুদের কাছে, যার সাহায্যে শেষটায় এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিতে পেরেছে।
এত-সব কথা অবশ্য সে তখন বলেনি, এই বৃত্তান্তটা জানা গেছে অনেক পরে। আপাতত সে শুধু এই কথাই বলেছে যে সে যেভাবে রশিটা ধ’রে ঝুলতে ঝুলতে এখানে এসে পৌঁছেছে, সেই একই উপায়ে তো তাঁরাও এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারেন। নিচে তাঁরা দেখতে পাবেন একটা নৌকো, অনেক কষ্টে এই ছোট্ট ডিঙিটা সে বাগাতে পেরেছে, তাঁদের শুধু রাঙানদী ধ’রে এই নৌকো বেয়ে কেটে পড়তে হবে।
বলাই বাহুল্য, কোনো আলোচনা না-ক’রেই তক্ষুনি এই ফন্দিটা কাজে খাটানো হয়েছে। চারজনে বৈঠা হাতে নিয়েছেন, তরতর ক’রে খরস্রোতও ব’য়ে যাচ্ছিলো, ঘণ্টায় অন্তত ছ-মাইল পথ তাঁরা চ’লে যেতে পারবেন। তাঁরা যদি এগারোটার মধ্যে বেরিয়ে পড়তে পারেন, তাহ’লে সকাল হবার আগেই একটানা নৌকো বেয়ে অন্তত পঁয়তাল্লিশ মাইল চ’লে যেতে পারবেন। তাতে তাঁরা যে সাইক্লোস্কোপের যান্ত্রিক নজরটাই এড়াতে পারবেন তা নয়, তাঁরা তীরের গাছপালাগুলোর ছায়ায়- ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে চাষের জমি ছড়িয়ে মরুভূমিতে বসানো শেষ পাহারারও নজর এড়িয়ে যেতে পারবেন। পরে হেলিবিমানের নজর এড়াবার জন্যে নদীর কোনো- কোনো খাঁড়িতে লুকিয়ে কাটিয়ে দেবেন, আর রাতে ফের নৌকো বেয়ে চলতে পারেন—যতক্ষণ-না গিয়ে নাইজারের জলে পড়েন। সায়ীর ঠিক উত্তরেই বিকিনি ব’লে একটা গ্রাম আছে, রাঙানদী নিশ্চয়ই সেখানে গিয়ে নাইজারের সঙ্গে মিশেছে। কেননা রাঙানদী প্রধানত পুরোনো, শুকিয়ে যাওয়া উয়েদ তাফাসেৎ-এর খাত ধ’রেই এগিয়েছে। অর্থাৎ পুরোটাই সবশুদ্ধু ২৮০ মাইল জলপথ পাড়ি দেবার প্রশ্ন, তার মানে দাঁড়াবে চার বা পাঁচরাতের মামলা।
চট ক’রে দু-চার কথায় পরিকল্পনাটা ভেঙে বলবামাত্র তক্ষুনি সেটা কাজে খাটাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু প্রথমে, অবশ্য, ৎশুমুকির হাত থেকে ছাড়ান পেতে হবে –সে প্রায়ই সন্ধেবেলায় গ্যালারি বা প্ল্যাটফর্মের আশপাশেই ঘুরঘুর করে। তার কখন মর্জি হবে, সে কখন বিদায় নেবে, তার জন্যে সবুর করার সময় নেই, যা করবার এক্ষুনি ক’রে ফেলতে হবে তাঁদের।
জেন ব্লেজন, অকম্মার ধাড়ি মঁসিয় পঁসা আর তোঙ্গানেকে বুরুজটার ওপরে রেখে, অন্য বন্দীরা তখন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছেন। সিঁড়ির ওপরের পইঠা থেকে ৎশুমুকিকে নিচের তলায় দেখা গেছে; সে তার ঢিলেঢালা অলস ভঙ্গি তে দিনের কাজ শেষ করেছে। তাঁদের দিকে একবারও তাকায়নি সে, কেননা হঠাৎ তাঁদের সন্দেহ করবার কোনো কারণই তার ছিলো না; আর তাই তাঁরা চারপাশ থেকে তাকে ঘিরে ধরতে পেরেছেন—কিন্তু সে তাঁদের মলব ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।
যেমন ঠিক ক’রে রাখা হয়েছিলো, সাঁৎ-বেরা গিয়েই আক্রমণটা প্রথমে শুরু করেছেন; তাঁর পেশীবহুল হাত আচমকা তার গলা জড়িয়ে ধরেছে, অন্য হাতটা থাবার মতো পড়েছে তার মুখে এতই অতর্কিতে যে সে টু শব্দটিও করবার সুযোগ পায়নি। অন্য তিনজনে তারপর চেপে ধরেছেন তাঁর হাত-পা, আষ্টেপৃষ্ঠে পিঠমোড়া ক’রে শক্ত ক’রে বেঁধে দিয়েছেন, মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে বেঁধে দিয়েছেন যাতে সে কোনো আওয়াজ করবারও সুযোগ না-পায়। তারপর তাকে ঐ কুঠুরিগুলোর একটায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, বাইরে থেকে দরজায় তালা আটকে চাবিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন রাঙানদীর জলে। এতে অন্তত তাঁদের পালাবার খবরটা যতটা সম্ভব বাড়তি কিছুক্ষণ চেপে রাখা যাবে।
এ-কাজটা সেরে প্ল্যাটফর্মে ফিরতে-না-ফিরতেই এতক্ষণ শাসাবার পর সারা আকাশ ফেটে পড়েছে, মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে, প্রায়-একটা খ্যাপা-ঝড়েরই তাণ্ডব, আর তাঁরা ভিজে জবজবে হয়ে গেছেন। এই ঝড়তুফানও তাঁদের উপকারেই আসবে। কুড়ি গজ দূরেই নজর যায় না এখন, সব যেন এই অবিশ্রাম তরল পর্দায় ঢাকা, আর নদীর ওপারে মেরিফেলোদের আস্তানার আলো এত দূর থেকে কাউকেই এই বৃষ্টির মধ্যে ফুটিয়ে তুলবে না।
তারপর এক-এক ক’রে নির্বিঘ্নেহ ঐ রাশি ধ’রে ধ’রে নিচে নেমে এসেছে তাঁরা, সব-আগে গিয়ে নেমেছেন আমেদে ফ্লরেঁস আর সব শেষে তোঙ্গানে, রশির নিচের দিকটা শক্ত ক’রে নৌকোর নোঙরের সঙ্গে বাঁধা, রশিটা টলোমলো করেছে বটে কিন্তু অসুবিধে হয়নি। জেন ব্লেজন শুদ্ধ সরসর ক’রে রশিটা ধ’রে নেমে এসেছে, যেন এ-কাজে সে কতই অভ্যস্ত।
প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে নেমে পড়বার আগে তোঙ্গানে রশিটা রেলিঙ থেকে খুলে নিয়েছিলো, তারপর রেলিঙের অন্যপাশ দিয়ে রশির প্রান্তটা ঝুলিয়ে দিয়েছিলো, দুইহাতে এই দু-পাল্লার দড়ি ধ’রে সে নেমেছে তারপর, নেমেই দড়ির একটা প্রান্ত ধরে টান দিতেই দড়িটা খুলে এসেছে—কীভাবে বন্দীরা পালিয়েছে তা বোঝবার কোনো উপায়ই এখন নেই।
দশটার একটু বাদে নোঙর তোলা হয়েছে নৌকোর, আর প্রবল স্রোত তাকে ভাঁটির দিকে টেনে নিয়ে গেছে। পলাতকেরা গুঁড়ি মেরে নৌকোর পাটাতনের সঙ্গে প্রায় মিশে গিয়েই লুকিয়েছিলেন; যখন স্রোতের টানে নৌকো শহরের বাইরে চ’লে এসেছে, প্রায় ছশো গজ দূরে, তখনই তাঁরা উঠে ব’সে চেপে ধরেছেন দাঁড়, আর নৌকোর গতিও আরো অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছে। এতক্ষণ, বৃষ্টি যদিও একটা আবছায়া পর্দার আড়ালে তাঁদের ঢেকে রেখেছিলো, তবু তারা ভেবেছেন যতটা- সম্ভব গুঁড়ি মেরে থাকা যায় ততই ভালো—কোথায় যে তাঁরা চলেছেন, সেটা আপতত না-দেখলেও চলবে।
কিছুক্ষণ পরে ঠিক যখন তাঁরা ভেবেছেন তাঁরা শহরের বাইরে চ’লে এসেছেন, তখন আচমকা নৌকো গিয়ে কিসের গায়ে যেন ধাক্কা খেয়ে আটকে গিয়েছে। হাড়ে-হাড়ে তারপর তাঁরা কারণটা আবিষ্কার ক’রেই হতাশায় ভ’রে গিয়েছেন : ওপর থেকে সারি-সারি লম্বা-লম্বা শিক নেমে এসেছে, ঠিক কোনো জানলার গরাদের মতো—তার ওপর দিকটা নিরেট ধাতুর পাতে মোড়া, আর শিকগুলো সোজা নেমে গিয়েছে নিচে, জলের তলায়। তাঁরা এ-পাশ থেকে ও-পাশ গেছেন—নদীর পুরো চওড়া প্রসারটাই, কিন্তু খামকাই —দুটো প্রান্তই দুই তীরে বাঁধা—এক তীরে বেসরকারি নাগরিকদের বসতি, আর মেরিফেলোদের আস্তানা – অন্য তীরটায় কারখানা ঘিরে গেছে সেই বৃত্তাকার রাস্তা।
আর ততক্ষণে মর্মান্তিক বাস্তবটা মাথায় ঢুকেছে তাঁদের : পালাবার কোনো রাস্তাই নেই তাঁদের সামনে!
হ্যারি কিলার ঠিকই বলেছিলো : তার হুঁশিয়ারি একেবারে নিখুঁতভাবে পলাতকদের সব পথই আটকে দিয়েছে। দিনের বেলায় শিকগুলো ওপরে তুলে দেয়া হয়, রাতের বেলায় শিকগুলো নামিয়ে দিয়ে রাঙানদী দিয়ে যাবার পথ আটকে দেয়া হয়।
এতটাই তাঁরা মুষড়ে পড়েছিলেন যে, কতক্ষণ মোহ্যমান বসেছিলেন তার কোনো হিশেব ছিলো না। এতটাই হাল ছেড়ে দিয়েছেন ঐ তুমুল বর্ষার প্রচণ্ড ঝাপটাও যেন আর গায়ে লাগছিলো না—অথচ বৃষ্টির ছাঁট যেন প্রায় মাংস ফুঁড়ে, হাড়ে-হাড়ে গিয়ে বিঁধছিলো। ফিরে-যাওয়া মানেই নিজের থুতু গেলা, এবার রাজভবনে তাঁদের হাতে-পায়ে বেড়ি পড়বে। না, সেটা কিছুতেই সম্ভব নয়। কিন্তু এছাড়া করবেনই বা কী তবে? শিক বেয়ে, ওপরে যদি-বা উঠতে পারেন ঐ নিরেট মসৃণ ধাতুর পাত বেয়ে উঠবেন কী ক’রে—ওপরে না-উঠে তো আর তা টপকানো যাবে না! নৌকোটাও টেনে-হিঁচড়ে ওপরে তুলে ও-পাশে নিয়ে যাওয়া যাবে না। আর ডাঙায়? বাম পাশে কারখানার জগৎ, আর ডানতীরে মেরিফেলোদের আস্তানা। সবদিক থেকেই রাস্তা বন্ধ।
‘এখানে আশা করি আমাদের ঘুমুতে হবে না,’ শেষটায় স্তব্ধতা ভেঙে বলেছেন আমেদে ফ্লরেঁস।
‘তাহ’লে এখন আপনি আমাদের কোথায় যেতে বলেন,’ মঁসিয় বারজাক এখনও তাঁর হতাশার ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারেননি।
‘কোথায়, তাতে কিছুই এসে যায় না—তবে মহামহিম পরমপ্রতাপাদিত্য হ্যারি কিলারের সকাশে ফিরে-যাওয়া চলবে না,’ সাংবাদিকটি উত্তর দিয়েছেন। ‘আমাদের যখন বাছাই ক’রে নেবার খুব-একটা সুযোগ নেই, তখন আমরা কেন নতুন-কোথাও গিয়ে ঘর ভাড়া করি না—এই যাকে ওরা কারখানা বলে। হয়তো তপ্ত তাওয়া থেকে আগুনে গিয়ে পড়বো—কিন্তু তবু তো তাতে একটা নতুনত্ব থাকবে!’
কিন্তু তাছাড়া আর করারই বা কী আছে? হয়তো, শহরের বাকি সব অংশের চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন এই অণুবিশ্বটায় কোনো সাহায্য মিলে গেলেও যেতে পারে। আর যা-ই ঘটুক, হ্যারি কিলারের কাছে ফিরে যাওয়ার চাইতে তো অধম-কিছু হবে না—তবে চেষ্টা ক’রে দেখতে দোষ কী?
তাঁরা তারপর এক-এক ক’রে বামতীরেই উঠে পড়েছেন, আর একটু উজানে এগিয়ে তাঁরা এসে পড়েছেন একটা রাস্তার মোড়ে, সেটা প্রায় পঞ্চাশগজ চওড়া, সেটাই চারদিক থেকে কারখানাকে পেঁচিয়ে আছে। বৃষ্টি এমনই মুষলধারে পড়ছে যে রাস্তার এ-পাশ থেকে ও-পাশেও নজর চলে না।
যদিও প্রকৃতির এই তর্জনগর্জন অন্যসব আওয়াজকেই ঢেকে ফেলেছে, তবু যতটা সম্ভব সন্তর্পণে, চুপিসাড়েই, তাঁরা এগিয়েছেন। আর আদ্ধেকটা রাস্তা পেরিয়েই থমকে থেমে পড়েছেন।
একটু-একটু দেখা যাচ্ছে, এই বৃষ্টির পর্দার মধ্যেও, বড়ো-জোর কুড়ি গজ দূরে, কারখানার পশ্চিম আর উত্তর দেয়াল জুড়ে গিয়ে যে-কোণটা তৈরি করেছে–উত্তরের যে-দেয়ালটা শহরের সীমার বাইরের সমান্তরালভাবে এসেছে, আর অন্য দেয়ালটা গেছে উজানে, নদীর পাড় ধ’রে। রাজভবনের সেদিকটার দেয়ালটা যেমন, এই দেয়াল কিন্তু সরাসরি নদীর জলে গিয়ে নেমে পড়েনি, বরং জল থেকে আলাদা হ’য়ে গিয়ে সেখানে একটা চওড়া ঘাট তৈরি ক’রে দিয়েছে।
এবার পলাতকরা ধাঁধায় প’ড়ে গেছেন : কোন্দিকে যাবেন? তারা বরং একটুখানিই দেখতে পেয়েছেন কারখানার ঠিক মোড়টাতেই, ভারি-বিপজ্জনক জিনিশ শাস্ত্রীর পাহারার ছোট্ট কুঠুরি-বৃষ্টির মধ্যে দিয়েও যার ধ্রুপদী বহিঃরেখা আবছাভাবে চেনা যাচ্ছে। শাস্ত্রীর পাহারাকুঠুরির মর্মার্থ : ওখানে শাস্ত্রী আছে। যদি সে বাইরে না-দাঁড়িয়ে থাকে, কারণ তাকে সেখানে দেখা যাচ্ছে না, তাহ’লে নিশ্চয়ই সে বৃষ্টির জন্যে কুঠুরিটার মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
কিন্তু তাই ব’লে তাঁরা তো সারারাত সেখানে বৃষ্টির মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। এ-বৃষ্টি যদি হঠাৎ থেমে যায়, আর শাস্ত্রী যদি ফের তার কুঠুরি থেকে বেরিয়ে আসে, তাহলে তাঁরা চট ক’রেই ধরা প’ড়ে যাবেন।
সঙ্গীদের, ইঙ্গিতে, তাঁকে অনুসরণ করতে জানিয়ে আমেদে ফ্লরেঁস রাঙানদী থেকে কয়েক পা স’রে এলেন, তারপর রাস্তাটা পেরিয়ে চ’লে এলেন অন্যপাশে সবসময়েই কারখানার দেয়ালের গা ঘেঁসে। এবার তাহ’লে তাঁরা শাস্ত্রীর পাহারাকুঠির পেছন দিয়ে যেতে পারবেন, কেননা তার দরজাটা নিশ্চয়ই নদীর দিকেই।
মোড়টায় এসে, তাঁরা থমকে দাঁড়িয়ে পরবর্তী পদক্ষেপটা ভেবে নেবার জন্যে দাঁড়িয়ে পড়েছেন আবার; তারপর আমেদে ফ্লরেঁস, সাঁৎ-বেরা, আর তোঙ্গানে মোড় ঘুরে গিয়ে পৌঁছেছেন ঘাটে, আর সেখান থেকে হুড়মুড় ক’রে ছুটে গিয়ে ঢুকেছেন শান্ত্রীকুঠিতে।
মেরিফেলোদের একজন, অর্থাৎ জনৈক হর্ষচরিত, সেখানে ছিলো বটে। অতর্কিত হামলায় এতটাই বোমকে গিয়েছিলো যে সে তার অস্ত্রে হাত দেবারই কোনো সুযোগ পায়নি, আর তার চীৎকারটা ঝড়ের দাপটের মধ্যে চাপা প’ড়ে হারিয়ে গেছে রাতের হাওয়ায়। সাঁৎ-বেরা শুধু তাঁর ঘাড়টা ধ’রে তাকে তুলে ধ’রে আছাড়া মেরেছেন মেঝেয়, ঠিক যেমনভাবে তিনি খানিক আগেই আছাড় মেরেছিলেন ৎশুমুকিকে—আর এই গোরাও আগেকার কালাআদমির মতো তেমনি অসাড় লুটিয়ে প’ড়ে থাকলো।
তোঙ্গানে ছুটে গেলো নৌকোয় নিয়ে এলো সেই রশির কুণ্ডলি, আর সেটা দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হ’লো এই তথাকথিত হুল্লোড়বাজ হর্ষচরিতকে। তারপর আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না-ক’রে, পলাতকরা উজান ধ’রে এগুলেন রাজভবনের দিকে, কারখানার দেয়াল ঘেঁসে সার বেঁধে পর-পর তাঁরা চলেছেন।
কারখানার অন্যতম অদ্ভুত বৈশিষ্ট ছিলো এটাই যে বাইরের দিক থেকে খোলবার কোনো দরজাই নেই। এপ্ল্যানেডের দিকে একটাও দরজা ছিলো না, সেটা তাঁরা বুরুজ থেকেই লক্ষ করেছেন। উলটো দিকটাতেও কিছু দেখা যাচ্ছিলো না—অন্তত বৃষ্টির পর্দার মধ্য দিয়ে তাকিয়ে তা-ই মনে হয়েছে। আর, এখন মনে হচ্ছে উত্তরদিকটায় ঠিক নদীর গায়ে এসে শেষ হয়েছে কারখানা—কিন্তু এখানেও কোনো দেয়াল নেই।
তবে, একটা ঘাট যখন আছে, সেটা নিশ্চয়ই কোনোকিছুর জন্যে ব্যবহার করা হয়। নৌকো ক’রে মালপত্র এলে এই ঘাটে এনেই নিশ্চয়ই মাল খালাশ করা হয়, তা ছাড়া আর-কোন রাজকার্যের জন্যে এই ঘাট এত যত্ন ক’রে বানানো হয়েছে? অতএব মালগুলো কারখানার ভেতরে নিয়ে যাবার জন্যে অবশ্যই কোনো ব্যবস্থা আছে এখানে।
এবং তাঁদের যুক্তিতর্কে ভুল ছিলো না। প্রায় দেড়শো গজ এগিয়ে এসে পলাতকেরা একটা মস্ত দরজা দেখতে পেয়েছেন দেয়ালের গায়ে, সেটা পুরু ধাতুর পাত দিয়ে বানানো, গোটাটাই ইস্পাতের, বর্মের মতো দুর্ভেদ্য। বাইরে থেকে তার কড়া, বা ছিটকিনি, বা কোনো খিল নেই। কী ক’রে খুলবেন তাঁরা, তাহ’লে এই দরজা? কেমন ক’রেই বা এটাকে ভেঙে ফেলবেন? ভেতরের কাউকে ডেকে যে নিজেদের দুরবস্থার কথা জানাবেন, তারও কোনো জো নেই—কেননা অন্যসব শাস্ত্রীরা নিশ্চয়ই পাহারায় মোতায়েন আছে আশপাশেই, ডাকাডাকি শুনলে তারাই প্রথমে ছুটে আসবে।
এই মস্ত দরজাটার পাশেই, আরো কয়েক পা উজিয়েই, আরো-একটা দরজা, অমনি ইস্পাতে তৈরি, আগেরটার চাইতে অনেক-ছোটো, আর প্রকাণ্ড-একটা তালা দিয়ে আটকানো। চাবি নেই, তালাটা যে খুলবেন এমন-কোনো যন্ত্রপাতিও নেই, ফলে ওতেই বা কোন্ ফায়দা হবে?
অনেকক্ষণ ভেবে, পলাতকেরা যখন ঠিক করেছেন দরজাটার গায়ে দুমদুম ক’রে গুষি কষাবেন, কিংবা দরকার হ’লে লাথি-এমন সময়ে এপ্ল্যানেড থেকে উজান ধরে একটা ছায়ামূর্তি তাঁদের দিকে এগিয়ে এলো। মুষলধারের বৃষ্টির মধ্যে, আবছায়ার মতো ছায়ামূর্তিটা ক্রমেই তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে। যেহেতু ঘাট থেকে বৃত্তাকার রাস্তায় যাবার আর-কোনো উপায়ই নেই, এই নিশাচর নিশ্চয়ই ঘাটের কোনো-একটা দরজার দিকেও এগুচ্ছে।
এখন আর চট ক’রে আশপাশে কোথাও স’রে যাবার উপায় নেই দেখে পলাতকেরা বড়ো দরজাটার ছাঁইচটার তলায় যতটা সম্ভব কুঁকড়িমুকড়ি দিয়ে দেয়াল ঘেঁসেই দাঁড়িয়ে রইলেন। খানিকটা গুঁড়ি মেরে থাকার ভঙ্গি, যাতে প্রথম সুযোগেই আগন্তুকের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়।
আগন্তুকটি কিন্তু দিব্বি নিশ্চিন্তভাবে, কোনো সন্দেহ না-ক’রেই, এগিয়ে আসছে। এতটাই কাছে এসে পড়েছে, হাত বাড়ালেই বুঝি তাকে ছোঁয়া যাবে। তার ভাবেভঙ্গি তে এমন-কোনো লক্ষণই নেই যে সে তাদের দেখতে পেয়েছে। দেখাই যাক্ কী হয়-খামকা কারু ওপর হামলা চালাবার কোনো মানে হয় না, পলাতকেরা ততক্ষণে এমনি একটা সিদ্ধান্ত ক’রে নিয়েছে।
আগন্তুকের এই বিস্ময়কর দৃপাতবিহীন চালচলন দেখে, বুকে সাহস সঞ্চয় ক’রে, একজন-একজন ক’রে পলাতকেরা তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিন পায়ে – পায়ে। তারপর তাঁরা আগেই যা ভেবেছিলেন তা-ই হ’লো : আগন্তুক এসে ছোটো দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর চাবিটা ঢুকিয়েছেন তালায়, পেছনে তাঁরা পর-পর দাঁড়িয়ে, একটু বোধহয় উপবৃত্তাকারেই, আটজন দর্শক, হুঁশিয়ার, উৎকর্ণ—যাদের অস্তিত্বটাই যেন আগন্তুকের নজরে আসেনি।
দরজা খুলে গেলো। আগন্তুক ভেতরে গিয়ে ঢুকতেই প্রায় তাকে ধাক্কা দিয়েই, পলাতকেরাও ভেতরে গিয়ে ঢুকেছেন। শেষে যে ঢুকেছিলো, সেই ভেতর থেকে টেনে পাল্লাটা বন্ধ ক’রে দিয়েছে।
কিন্তু গভীর অন্ধকার এই ভেতরে। আর সেই অন্ধকারের মধ্য থেকেই একটা নরম স্বর ভেসে এ’লো, একটু যেন বিস্ময়মাখানো : ‘আরে! এর মানে কী? কী চান আপনারা? … হচ্ছেটা কী?’
মিটমিটে একটা আলো জ্ব’লে উঠলো তারপরেই, ক্ষীণ হ’লেও এই ঘন অন্ধকারে তাকেই মনে হ’লো চোখ-ধাঁধিয়ে দেয়। জেন ব্লেজন তাঁর বিজলি মশালটা জালিয়েছে, যেটা কোকোরাতে একবার দারুণ কাজে লেগেছিলো। আর এই টর্চের আলো তক্ষুনি আলোর পাল্লায় পেয়েছে তোঙ্গানেকে, আর তাঁর মুখোমুখি, হালকাদীঘল একজন মানুষ, হালকা-সোনালি চুল, গায়ের জামাকাপড় থেকে অঝোরে জল ঝরছে, আর দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো।
পরস্পরকে ঐ টর্চের আলোয় দেখেই একসঙ্গেই দুজনে বিস্ময় চেঁচিয়ে উঠলো, যদিও দুজনের বিস্ময়ের স্বর আলাদা :
‘সার্জেন্ট তোঙ্গানে!’ হালকাপলকা মানুষটি অস্ফুট বিস্ময়ে বলে উঠলো। ‘মাসা কামারে!’ ব’লে উঠলো তোঙ্গানে, তার চোখদুটো ভীত, সন্ত্রস্ত, বিস্ফোরিত!
কামারে….নামটা শুনেই জেন ব্লেজন শিউরে উঠেছে; এ-নামটা তার চেনা, তার দাদার পুরোনো বন্ধুদের একজনের নাম!
আমেদে ফ্লরেঁসের মনে হয়েছে এবার তাঁর গায়ে প’ড়ে কিছু-একটা বলা উচিত। যে-লোকেরা একে-অন্যকে আগে থেকেই চেনে, তাদের পরস্পরেরর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার দরকার পড়ে না। আমেদে ফ্লরেঁস সামনে এগিয়ে এসে আলোর পাল্লার মধ্যে দাঁড়ালেন।
‘মঁসিয় কামারে, আমি আর আমার বন্ধুরা আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’
‘এ আর বেশি কথা কী,’ শান্তগলাতেই বললেন মঁসিয় কামারে।
তিনি একটা বোতাম টিপতেই ছাত থেকে বিজলি বাতি ঝলমল ক’রে উঠলো পলাতকেরা অমনি দেখতে পেলেন তাঁরা একটা কোঠায় এসে পড়েছেন, মাথার ওপর ছাদ আছে, কিন্তু ঘরে কোনো আশবাব পত্র নেই—অনেকটা কোনো হলওয়ের মতো।
মার্সেল কামারে একটা দরজা খুলে দিতেই সিঁড়ির ধাপ দেখা গেলো। তারপর, একপাশে স’রে দাঁড়িয়ে, ভদ্রতা ক’রে শিষ্টাচারসম্মতভাবে বললেন : ‘আপনারা যদি অনুগ্রহ ক’রে ভেতরে আসেন।’
সহজসরল কথা, তাতে কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই।