২.০৪ মাতিয়াস ফান খোইতের বিদায়

২.০৪ মাতিয়াস ফান খোইতের বিদায়

সার এডওয়ার্ডের অপ্রত্যাশিত প্রস্থান আমাদের সবিশেষ ভাবিয়ে তুললো। এখানে আসার পর থেকেই লক্ষ করছিলুম, তিনি কেমন যেন গম্ভীর হয়ে আছেন। যখনই পাহাড়িরা আমাদের শিবিরে আসতো, তখনই তিনি তাদের নানারকম প্রশ্ন করতেন, খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে জিগেস করে নানাসাহেবের হদিশ জানবার চেষ্টা করতেন। স্পষ্ট বোঝা যেতো, অতীতের ঘটনা তিনি মন থেকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে পারেননি।

কিন্তু এখন, এ-রকম অবস্থায়, আমরা কী করবো? অনুসরণ করবো তাকে? কিন্তু তিনি যে কোন দিকে গেছেন, তা-ই তো জানি না। নেপালের সীমান্তের কোন জায়গাটাই বা তিনি খুঁজে দেখতে চান, তাও আমাদের জানা নেই। তাছাড়া আগে থেকে যেহেতু তিনি এ-সম্বন্ধে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি, তার কারণই হলো তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে তিনি অন্যকে বিরক্ত করতে চান না—এ ছাড়া ব্যাঙ্কস আগে থেকে এ-কথা শুনলে হয়তো তাকে বাধা দেবার চেষ্টা করতো, যেটা তার ঠিক মনোমতো হতো না। এখন আমরা কেবল তার ফিরে-আসার জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না। নিশ্চয়ই অগস্ট মাস শেষ হবার আগেই তিনি ফিরে আসবেন, কেননা ঠিক ছিলো বেহেমথ অগস্টের শেষাশেষি কি সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে বম্বাই প্রেসিডেন্সির দিকে রওনা হবে।

কালোগনি মাত্র একদিনই ছিলো স্টীম হাউসে; ব্যাঙ্কসের চিকিৎসায় যখন তার আশু উন্নতি দেখা দিলো, তখন সে ক্রাল-এ নিজের কাজে যোগ দেবার জন্যে ফিরে গেলো। ক্ষতটা শিগগিরই শুকিয়ে যাবে—তা থেকে ভয়ের কোনোই কারণ নেই।

অগস্ট মাস এলো ভয়ানক ঝড়বৃষ্টির মধ্যে–আবহাওয়া এতটাই খারাপ হয়ে গেলো যে ব্যাঙেরও সর্দি হবার আশঙ্কা দেখা দিলে। তবু শুকনো দিনগুলো হয়তো সংখ্যায় জুলাই মাসের চেয়ে বেশি। সেইজন্যেই তরাইয়ের জঙ্গলে মাঝে-মাঝে শিকারে বেরুনো গেলো। ক্রাল-এর সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হলো। মাতিয়াস ফান খোইত আর-কিছুতেই তুষ্ট নন-তাকেও সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে চলে যেতে হবে, কিন্তু এখনও সেই একটি সিংহ, দুটো বাঘ আর দুটো চিতা তিনি পাকড়াও করে উঠতে পারেননি।

সিংহটা অবশেষে ধরা পড়লো। ৬ই অগস্ট—ফান খোইতের পাতা ফাসে। এতদিন ধরে সিংহের দেখা না-পেয়ে-পেয়ে তিনি শেষটায় ভাবতে বসেছিলেন যে ভারতের জঙ্গলে বোধ হয় সিংহ পাওয়াই যায় না। যেই তিনি সিংহের আশা ছেড়ে দিলেন, অমনি তারই পাতা দড়ির ফাসে সিংহটা ধরা পড়লো। শুধু তা-ই নয়, ফাসটা লক্ষ–করলে ক্যাপ্টেন হুড হয়তো সিংহটাকে গুলিই করে বসতো, কিন্তু ভাগ্যিশ ফান খোইত সঙ্গেই ছিলেন, সেইজন্যে আগে থেকেই হুডকে বারণ করতে পারলেন।

আর সিংহটাই বুঝি তার কপাল খুলে দিলে। ১১ই অগস্ট সেই ফাঁদে-যে-ফঁদে ফান খোইত নিজেই আটকা পড়েছিলেন একদা—পড়লো দুটো চিতাবাঘ-রোহিলখণ্ডে যে-রকম একটি চিতা উদ্ধতভাবে বেহেমথকে আক্রমণ করেছিলো না-বুঝে, চিতা দুটো ছিলো সেই জাতের।

এর পরে কেবল বাকি রইলো দুটো বাঘ-তাহলেই ফান খোইতের তালিকা সম্পূর্ণ হয়।

ইতিমধ্যে হুড আর ফক্সের তালিকাও স্থির হয়ে বসে নেই—তাও ক্রমশ কেঁপেই চলেছে; হুডের সংগ্রহ হয়েছে আটচল্লিশ নম্বর, ফক্স তার উনচল্লিশ নম্বরটিকে ঘায়েল করতে একটুও দ্বিধা করেনি; কালো নেকড়ে বাঘটিকে হিশেবে ধরলে ফক্সের তহবিল অবশ্য চল্লিশেই পূর্ণ হতো।

২০শে অগস্ট ফান খোইত একটি বাঘ পেলেন গর্তের মধ্যে : গভীর গর্ত খুঁড়ে তার উপর ডালপালা বিছিয়ে রাখা পাহাড়িদের বন্য জন্তু শিকারের প্রাচীন পদ্ধতি। সেইজন্যেই হয়তো সব জন্তুই এতদিন সন্তর্পণে ওই সন্দেহজনক গর্তটি এড়িয়ে চলছিলো। যে-বাঘটি গর্তে পড়েছিলো, সে এত উঁচু থেকে অতর্কিতে পড়ে যাওয়ার ফলে বেশ আহত হয়েছিলো, কিন্তু আঘাতটা মোটেই সীরিয়াস ছিলো না। কয়েকদিন খাঁচার মধ্যে বিশ্রাম করলেই সেটা সেরে যাবে। ফান খোইত যখন হামবুর্গের হের হাগেনবেককে বাঘটা সমঝে দেবেন, তখন আঘাতের কোনো চিহ্নই থাকবে না।

এখন কেবল আর-একটা মাত্র বাঘ পেলেই ফান খোইতের চাহিদা মেটে। তাহলেই তিনি বম্বাই গিয়ে জাহাজ ধরতে পারেন।

সেই শেষ বাঘটিকে সংগ্রহ করতে অবশ্য বেশি দেরি হলো না, কিন্তু তার জন্যে যে দাম দিতে হলো সেটা নেহাৎ কম নয়। আগে জানলে ফান খোইত হয়তো আর শেষ শার্দুলটির জন্য অপেক্ষা করতেন না।

২৬শে অগস্ট রাত্রে শিকারে বেরুবার পরিকল্পনা ছিলো ক্যাপ্টেন হুডের। নিমেঘ শান্ত আকাশ, স্তব্ধ ক্ষীণ চাঁদ-সমস্ত-কিছুই শিকারের পক্ষে খুব অনুকূল। একেবারে ঘন কালো অন্ধকার রাতে জন্তুরা অনেক সময়েই ডেরা ছেড়ে বেরোয় না; তার চেয়ে অর্ধ-আলোকই তাদের আকর্ষণ করে বেশি। আলোছায়ার মধ্যেই গভীর রাতে এই নিশাচরেরা শিকারের সন্ধানে গুঁড়ি মেরে মেরে এগোয় বনের মধ্যে। মাঝরাতের পর যখন চাঁদ উঠবে—হুড ঠিক করেছিলো—তখনই সে শিকারে বেরুবে।

হুড, ফক্স, স্টর আর আমি—ঠিক ছিলো স্টীম হাউস থেকে এই চারজনে বেরুবো–আর কাল থেকে ফান খোইত স্বয়ং কালোগনি ও আরো কয়েকজন অনুচরকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দেবেন।

সেইজন্যেই সান্ধ্যভোজ শেষ হতেই আমরা চারজনে স্টীম হাউস থেকে বেরিয়ে পড়লুম; প্রথমে ক্রাল-এ যাবো; সেখান থেকে ফান খোইতদের নিয়ে একেবারে বনের মধ্যে ঢুকবো।

ক্রাল-এ যাবার পর ফান খোইত আমাদের সব পরিকল্পনা শুনে বললেন, যেহেতু মাঝরাতের আগে আমরা শিকারে বেরুচ্ছি না, সেইজন্যে তিনি এই সুযোগে দু-এক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে চান। জ্বম্ভন সহযোগে এই তথ্যটি জানিয়ে তিনি শোবার ঘরে চলে গেলেন, বলে গেলেন ইচ্ছে করলে আমরাও খানিকটা ঘুমিয়ে নিতে পারি, আর ঘুম-টুম যদি একান্তই আমাদের না-আসে তাহলে গোটা ক্রালটাই রইলো আমাদের তত্ত্বাবধানে–আমরা যা খুশি তা-ই করতে পারি।

কাঁচা ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে শিকারে যাবার কথাটা আমার মোটেই পছন্দ হলো না; তার চেয়ে একটুও না-ঘুমুনোই ভালো; সেইজন্যে আমি হডের সঙ্গে ক্রাল-এর মধ্যেই গল্প করে-করে ঘুরতে লাগলুম। ফান খোইতের বহুমূল্য ও হিংস্র সম্পত্তিগুলোকে টহল দিয়ে দেখে এলুম একবার, বাঘ-সিংহ, নেকড়ের খাঁচায় জন্তুগুলো বসে-বসে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঝিমুচ্ছে। গল্প করতে-করতে আমরা তাদের একবার দেখে এলুম। ঘণ্টাখানেক সময় এইভাবেই কাটিয়ে দেয়া গেলো। তারপর আর-কিছু করার না-পেয়ে বসে-বসে ঢুলতে লাগলুম দুজনে। চারপাশ কী-রকম স্তব্ধ হয়ে আছে, বেশ অস্বাভাবিক রকম। কোথাও কোনো নিশাচরের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না—সব কেমন অদ্ভুত চুপচাপ। এত চুপ, যে সেই স্তব্ধতা যেন বুকের উপর চেপে বসে যায়। জঙ্গলের মধ্যে এ-রকম ছমছমে ভুতুড়ে স্তব্ধতা কেন যেন মানায় না।

স্তব্ধতা কেমন যেন আমাদেরও আক্রান্ত করেছিলো। সেইজন্যেই হড স্তব্ধতা নাভেঙেই ফিশফিশ করে আমাকে বললে, মোক্লের, এই চুপচাপ ভাবটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না। জঙ্গলের চেয়ে শোরগোলভরা জায়গা খুব কমই আছে। বাঘ-সিংহের গর্জন না-শুনলেও শেয়ালের ডাক তো সারা রাতই শোনা যায়। আর এই ক্রাল-এ এত জীবজন্তু ও মানুষ আছে যে সহজেই তারা এর দ্বারা আকৃষ্ট হতো। অথচ দ্যাখো, কিছু শোনা যাচ্ছে না—শুকনো পাতার শব্দ পর্যন্ত না। ফান খোইত জেগে থাকলে তারও নিশ্চয়ই এটা খুব অদ্ভুত ঠেকতো।

ঠিকই বলেছে, হুড, আমি বললুম, নিশাচরদের এই স্তব্ধতার কোনো কারণ আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। যা-ই হোক—একটু সাবধানে থেকো, না-হলে শেষটায় দেখো, ঘুম পেয়ে যাবে।

না, না, ঘুমিয়ো না। আড়মোড়া ভেঙে হুড বললে, আরেকটু পরেই আমাদের রওনা হতে হবে।

মাঝে-মাঝে দু-একটা কথা বলছি, কিন্তু ক্রমশই কথাগুলো জড়িয়ে আসছে। বসেবসে চুলছি কেবল : চেতনাটা কেমন শিথিল হয়ে আসছে। হঠাৎ একটা রুষ্ট চাপা গর্জনে আমার ঝিমুনি ভেঙে গেলো। গর্জনটা যে বুনো জন্তুদের খাঁচা থেকে এলো সে-বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ রইলো না। কারণ পরমুহূর্তে বাঘ-সিংহের চাপা-চাপা রাগি গরগর আওয়াজ ভেসে এলো। খাঁচার মধ্যে উত্তেজিতভাবে তারা পায়চারি করছে–মাঝে-মাঝে খাঁচার শিকের কাছে দাঁড়িয়ে হাওয়ার মধ্য থেকে কীসের গন্ধ শুকছে, বোধহয় দূরের কোনো-কিছুর গন্ধ পাচ্ছে তারা।

কী ব্যাপার, বলো তো হুড, আমি জিগেস করলুম।

কিছুই তো বুঝতে পারছি না। ভয় হচ্ছে ওরা বুঝি দূরের কিছুর গন্ধ…

হুডের কথা শেষ হবার আগেই ক্রাল-এর বেড়ার বাইরে বুনো জন্তুদের ভীষণ গর্জন উঠলো।

কী সর্বনাশ! বাঘ! বলেই হুড ফান খোইতের ঘরের দিকে হুড়মুড় দৌড় দিলে।

হুডের অবশ্য ছুটে-যাবার কোনোই দরকার ছিলো না। কারণ সেই বিকট গর্জন শুনে ততক্ষণে ক্রাল-এর সবাই ধড়মড় করে জেগে উঠেই বাইরে বেরিয়ে এসেছে।

চড়াও হয়েছে না-কি এসে? চেঁচিয়ে জিগেস করলেন ফান খোইত, ঘর থেকে তিনি ছুটে বেরিয়ে আসছেন।

তা-ই তো মনে হয়, হুড জানালে।

দাঁড়ান, একবার দেখে নিই। বলে একটা মই নিয়ে বেড়ার গায়ে ঠেশ দিয়ে ফান খোইত তরতর করে উপরে উঠে গেলেন। উঠেই চীৎকার করে জানালেন, দশটা বাঘ আর ডজন খানেক নেকড়ে!

ব্যাপারটা তো ঘোরালো ঠেকছে খুব, বললে হড, আমরাই তাদের শিকার করছিলুম এতকাল—এবার দেখছি তারাই আমাদের শিকার করতে এসেছে!

বন্দুক—আপনাদের বন্দুক নিন! ফান খোইত চেঁচিয়ে জানালেন।

আদেশ পালন করতে আমরা একটুও দেরি করলুম না : তক্ষুনি যে যার বন্দুক বাগিয়ে তৈরি হয়ে দাঁড়ালাম।

দল বেঁধে বন্য হিংস্র জন্তু এসে চড়াও হচ্ছে, দাঁত-নখ বেঁধাচ্ছে, এই ব্যাপারটা ভারতবর্ষে খুব দুর্লভ নয়। বিশেষ করে যেসব জায়গায় বাঘ ঘুরে বেড়ায়, সে-সব জায়গায় এটা হামেশা হয়; সুন্দরবন অঞ্চলে বাংলাদেশের রাজা-বাঘ কতবার যে এমনি সদলে দিগ্বিজয়ে বেরোয়, তার ইয়ত্তা নেই। ব্যাপারটা যে ভয়ংকর, তা তর্কাতীতকারণ প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় আক্রমণকারীরা বিজয়গর্বে সবকিছু বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত করে চলে গিয়েছে।

ততক্ষণে বাইরের দুরন্ত দমকা গর্জনের সঙ্গে খাঁচার মধ্যেকার জন্তুদের চাপা, রাগি, ক্ষুব্ধ চীৎকার মিশে গিয়েছে। বনের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে ক্রাল-জন্তুদের এই কথোপকথনের মধ্যে আমাদের কথা সব চাপা পড়ে যাচ্ছিলো।

মোষগুলো তখন আতঙ্কে ও বিভীষিকায় একেবারে যেন খেপে গিয়েছে-ছুটে পালাবার চেষ্টা করছে তাদের খোঁয়াড় থেকে—খামকাই ফান খোইতের অনুচরেরা তাদের সামলাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু মোষদের তীব্র সন্ত্রস্ত ভাবগতিকে মনে হচ্ছে না যে তাদের সামলানো যাবে।

এমন সময় ক্রাল-এর দরজা সশব্দে খুলে গেলো—সম্ভবত দরজাটা তেমন শক্ত করে আটকানো হয়নি সন্ধেবেলায়—এবং হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে পড়লো একদঙ্গল বুনো জন্তু।

সবাই ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ুন, ঘরের মধ্যে, ফান খোইত ছুটতে ছুটতেই চাচালেন। আত্মরক্ষার আশ্রয় বলতে সত্যি ঘরের মধ্যে ঢুকে-পড়া ছাড়া আমাদের তখন আর-কিছু করার ছিলো না। কিন্তু ঘর পর্যন্ত পৌঁছুনো যাবে কিনা, তা-ই সন্দেহ। এর মধ্যেই ফান খোইতের দুটি অনুচরের ছিন্নভিন্ন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। অন্যরা পাগলের মতো যে-কোনো-একটা আশ্রয়ের জন্যে এলোমেলো উদভ্রান্ত ছুটছে।

ফান খোইত, স্টর আর ছ-জন অনুচর ততক্ষণে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে—দুটো বাঘ লাফাবার উদ্যোগ করেছিলো, কিন্তু তার আগেই তারা ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।

কালোগনি, ফক্স আর অন্যরা প্রাণপণে আশপাশের গাছগুলোর মগডালে উঠে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কেবল আমি আর ক্যাপ্টেন হুডই ফান খোইতের সঙ্গে যোগ দেবার একফোঁটাও সুযোগ পাইনি।

মোক্লের! মোক্লের! ইডের ডান হাতটায় তক্ষুনি একটা চোট লেগেছে, তা সত্ত্বেও সে আমাকে সাবধান করে দেবার চেষ্টা করলে। কিন্তু আমি ততক্ষণে একটা মস্ত বাঘের ল্যাজের ঘায়ে মাটিতে ছিটকে পড়েছি। বাঘটা আমাকে কক্সা করার আগেই লাফিয়ে উঠে আমি হুডের সাহায্যের জন্যে ছুটে গেলুম।

তখনও আমাদের একটা আশ্রয় ছিলো। জানোয়ারদের খাঁচায় তখনও একটা কামরা ছিলো ফাঁকা-যে-বাঘটা ধরা হয়নি তারই জন্যে ওই কামরাটা নির্দিষ্ট ছিলো। আমরা হুড়মুড় করে সেই খাঁচাটার মধ্যে গিয়ে ঢুকেই খাঁচার দরজা বন্ধ করে দিলুম। আপাতত কিছুক্ষণের জন্যে অন্তত নিরাপদ। জন্তুগুলো তখন খাঁচার লোহার গরাদের উপর ঝাঁপিয়ে গরগর করে চাপা রাগে ভীষণ গর্জাচ্ছে। আর তাদের ধাক্কায় আস্ত খাঁচাটাই বুঝি উলটে ডিগবাজি খেয়ে যায়। কিন্তু বাঘেরা—তারাই সবচেয়ে সাংঘাতিক–তক্ষুনি অন্য শিকারের খোঁজে সেখান থেকে চলে গেলো-লোহার গরাদ ভেঙে আমাদের পাকড়াবার চেষ্টা সম্ভবত স্থগিত রাখলো কিছুক্ষণের জন্য।

সে কী দৃশ্য! গরাদের ফাঁক দিয়ে দেখলুম বলেই কোনো খুঁটিনাটিই আমাদের চোখ এড়ালো না।

গোটা পৃথিবীটাই যেন ভিরমি খেয়ে চিৎপাত উলটে পড়ছে, হুড তখন রাগে প্রায় কাপছে। ব্যাপারটা একবার ভাবো, মোক্লের! কী পরিহাস! জন্তুগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে বাইরে, স্বাধীন ভাবে-আর আমরা কিনা বন্দী হয়ে আছি খাঁচায়?

তোমার যে-চোট লেগেছিলো, সেটা কেমন— আমি জিগেস করলুম।

ও-কিছু না— সামান্য।

এমন সময় পর-পর পাঁচ ছটা গুলির আওয়াজ শোনা গেলো। ঘরের মধ্যে থেকে ফান খোইতরা গুলি চালাতে শুরু করেছেন—আর ঘরের চারপাশে রক্তের স্বাদে খেপে গিয়ে গজাচ্ছে দুটো বাঘ আর তিনটে নেকড়ে।

স্টরের বুলেটে একটা জন্তু পড়ে গেলো নিম্পন্দ। বাকিগুলো তখন পেছিয়ে গিয়ে শেষটায় একযোগে মোষের খোঁয়াড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

ফক্স, কালোগনি ও অন্যরা তাড়াহুড়োয় বন্দুক-টলুক ফেলেই গাছে উঠে পড়েছিলো—তারা এই অবস্থায় কোনো সাহায্যই করতে পারছে না।

ক্যাপ্টেন হুডের ডান হাতটা আবার চোট পেয়ে প্রায় অবশ হয়ে আছে। তবু, সেই অবস্থাতেই, গরাদের ফাঁক দিয়ে কোনো-রকমে বন্দুক তাগ করে ধরে সে তার উনপঞ্চাশ নম্বরটিকে দখল করে নিলে।

মোষগুলো তখন লাফিয়ে বেরিয়ে পড়েছে খোঁয়াড় থেকে। খ্যাপার মতো দাপাদাপি করছে-আতঙ্কে ডাকতে-ডাকতে ক্রালের এপাশ-ওপাশ ছুটে বেরুচ্ছে—মাঝে-মাঝে চেষ্টা করছে মাথার শিঙ দিয়ে বাঘদের এফাঁড়-ওফোঁড় করে ফেলতে-কিন্তু বাঘগুলো সাবধানে তাদের শিঙের নাগাল থেকে দূরে পাক খেয়ে-খেয়ে তাদের তাড়া লাগাচ্ছে। একটা মোষের কাঁধে লাফিয়ে উঠেছে কালো একটি নেকড়ে-দাঁত-নখ বসিয়েছে তার ঘাড়ে, শেষটা ঐ অবস্থাতেই মোযটা ক্রাল-এর খোলা দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে ছুটে চলে গেলো বাইরে, জঙ্গলের অন্ধকারে।

আরো পাঁচ-ছটা মোষ বাঘের তাড়ায় তারই মতো ওই খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো—দু-তিনটি বাঘও তক্ষুনি তাদের পিছু পিছু ছুটলো। কেবল যে-মোষগুলো বাঘনেকড়ের থাবা এড়াতে পারেনি, তাদের রক্তাপ্লত দেহ গড়াগড়ি যেতে লাগলো মাটিতে।

ফান খোইতের ঘরের জানলা দিয়ে অবিরাম বন্দুক গর্জাচ্ছে। আমি আর হড যথাসাধ্য করবার চেষ্টা করছি খাঁচার মধ্য থেকে। আর ইতিমধ্যে একটা নতুন বিপদ দেখা দেবার উপক্রম করছে। খাঁচার মধ্যেকার জন্তুগুলো রক্তের গন্ধে ও এই শোরগোলে ভীষণ দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছে—খাঁচা ভেঙে বেরুবার চেষ্টা করছে প্রাণপণে। থরথর করে কাঁপছে চাকা-লাগানো খাঁচাগুলো, একটা বাঘের খাঁচা উলটে পড়লো, একটা চাকা শূন্যে ঘুরে গেলো একবার। ভয় হলো, জন্তুগুলো শেষটায় হয়তো খাঁচা ভেঙে বেরিয়েই পড়ে বুঝি-বা।

সৌভাগ্যই বলতে হবে যে তেমনতর কিছুই ঘটলো না। হুড তার বন্দুকে টোটা ভরতে-ভরতে বললে, এ-যে দেখছি কিছুতেই ফুরোয় না! এতগুলো এসেছিলো!

এমন সময় একটা বাঘ ফান খোইতের অনুচরেরা যে-গাছে আশ্রয় নিয়েছিলো তার ডাল লক্ষ্য করে এমন একটা লম্ফ দিলে যে আঁৎকে উঠলুম। বিশ্বরেকর্ড ভঙ্গ করে বাঘটা শেষটায় একটি পাহাড়ির পা কামড়ে তাকে সবেগে টেনে নিয়ে এলো মাটিতে। কিন্তু তখন সেই মৃতদেহটির স্বত্ব নিয়ে কোত্থেকে একটি নেকড়ে এসে সেই বাঘটির সঙ্গে লড়াই শুরু করে দিলে। রক্তে মাখামাখি থাবা তাদের-হাড়ের শব্দ হচ্ছে মড়মড়, কষ বেয়ে তাদের রক্ত গড়াচ্ছে।

আমাদের গোলাগুলি ততক্ষণে ফুরিয়ে গেছে। অসহায় দর্শক বলে সমস্ত দৃশ্যটা বিস্ফারিত চক্ষে অবলোকন করা ছাড়া আমাদের আর-কোনো উপায় নেই।

কিন্তু সেই বীভৎস দৃশ্য অবশ্য আর আমাদের দেখতে হলো না। আমাদের পাশের খাঁচায় একটা বাঘ এত হুটোপাটি করছিলো যে তার ধাক্কায় আমাদের খাঁচাটা উলটে গেলো। ভিতরে আমরা ডিগবাজি খেলুম বার-দুই, কিন্তু খাঁচাটা এমনভাবে উলটেছিলো যে বাইরে কী হচ্ছে না-হচ্ছে আর দেখা গেলো না।

দেখা গেলো না সত্যি, কিন্তু শোনা গেলো। সে কী কানে-তালা লাগানো গর্জন ও দাপাদাপি! তাজা রক্তের গন্ধ ভাসছে হাওয়ায়। বাইরে যেন তাণ্ডব চলছে একটা–ভারতীয় ধরনে বলা যায়। খাঁচাগুলো ভেঙে অন্য জন্তুগুলো বেরিয়ে পড়েছে নাকি? ফান খোইতের ঘরটা কি একযোগে চড়াও হয়ে তারা ভেঙে ফেলেছে? না কি লাফ দিয়ে-দিয়ে গাছগুলো থেকে একজন-একজন করে মানুষ পাকড়াও করছে তারা?

কী হচ্ছে কিছুই বুঝছি না—আর আমরা কিনা এই নোংরা সিন্দুকটায় বন্দী হয়ে পড়ে আছি, রাগে ক্ষোভে ক্যাপ্টেন হুড আর-কিছু বলতে পারলে না।

প্রায় পনেরো-বিশ মিনিট কেটে গেলো এইভাবে—কিন্তু এই সময়টুকুকেই মনে হলো অনন্তকাল। আর তারপরেই বাইরের সেই বীভৎস গর্জন ক্রমে শান্ত হয়ে আসতে লাগলো। বাঘের ডাক আর শোনা যাচ্ছে না, পাশের খাঁচাগুলোতেও জন্তুদের দাপাদাপি বন্ধ হয়ে এলো। তাহলে কি রক্তারক্তি কাণ্ড শেষ হলো অবশেষে? তক্ষুনি শুনতে পেলুম সশব্দে বন্ধ করা হলো ক্রাল-এর দরজা। বাইরে কালোগনি চেঁচিয়ে আমাদের নাম ধরে হাঁক পাড়ছে : ক্যাপ্টেন! ক্যাপ্টেন!

এই-যে, এদিকে! হুড চেঁচিয়ে জানালে।

তার কথা নিশ্চয়ই বাইরে শোনা গেলো, কারণ পরক্ষণেই খাঁচাটাকে ধরাধরি করে ঠিকমতো বসানো হলো চাকার উপর-আমরা জন্তুদের খাঁচা থেকে মুক্তি পেলুম।

ফক্স। স্টর! বেরিয়ে এসেই হুড প্রথমেই নিজের সঙ্গীদের খোঁজ করলে।

এই-যে, আমরা এখানে আছি! সাড়া পাওয়া গেলো তাদের।

আশ্চর্য! তারা একটুও আহত হয়নি। ফান খোইত আর কালোগনির দেহেও কোনো আঁচড় লাগেনি। মাটিতে মরে পড়ে আছে একটা নেকড়ে ও দুটি প্রকাণ্ড বাঘ। অন্যগুলো ক্রাল ছেড়ে পালিয়েছে—আর-কোনো ভয় নেই আমাদের। খাঁচা ভেঙেও কোনো জানোয়ার আর পালাতে পারেনি-মাঝখান থেকে ফান খোইত দেখতে পেলেন দুটি খাঁচার মাঝখানে একটা বাঘ আটকে পড়ে গিয়েছে-পালাতে পারেনি-ফলে তার শেষ বাঘটাকেও পাওয়া গেলো।

কিন্তু এই বাঘটার জন্যে তাকে যে-দাম দিতে হলো, তা অনেক। পাঁচটা মোষ মরেছে তাঁর, আর তিনটি ছিন্নভিন্ন পড়ে আছে মাটিতে : রক্তে-রক্তে জায়গাটা মাখামাখি! সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে বাঘটা সত্যি খুব দামি।

+

বাকি রাতটুকু কালের ভিতরে কি বাইরে আর কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটলো না। এবার ক্রালের দরজা বেশ শক্ত করে লাগানো হয়েছিলো। তখন যে কেমন করে হঠাৎ জন্তুগুলোর ধাক্কায় দরজা খুলে গিয়েছিলো, সেটাই অবাক লাগলো—কারণ খিলগুলো বেশ পোক্ত ছিলো।

হুড যেখানটায় চোট পেয়েছিলো, এখন, সব উত্তেজনা প্রশমিত হলে, সেখানটায় বেশ ব্যথা করতে লাগলো, অথচ আঘাতটা তেমন জোরালো হয়নি—আরেকটু হলেই তার ডান হাতটা আস্ত কেটে বাদ দিতে হতো হয়তো আমার অবশ্য কোথাও কোনো চোট লাগেনি।

সকাল হলেই, ঠিক করে ফেললুম, স্টীম হাউসে ফিরে যাবো–আপাতত আর শিকারে যাবার বাসনা আমার নেই।

মাতিয়াস ফান খোইত অবশ্য তার অনুচরদের দশা দেখে বেশ মর্মাহত হয়ে পড়েছিলেন—ফালতু বাঘটিকে পেয়ে অবশ্য তার শোক কিঞ্চিৎ প্রশমিত হলো। সারা রাতটা তার শশব্যস্ত কেটে গেলো। লোক তিনটিকে সমাহিত করা হলো ক্রালের মধ্যেই গভীর কবর খুঁড়ে-যাতে বুনো জানোয়ারদের খপ্পরে কিছুতেই না-পড়ে। কিন্তু মড়ার আবার দেহের ভয়!

কিছুক্ষণ পরেই তরাইয়ের ছায়া-ঢাকা কালো পথগুলো আলো হয়ে উঠতে লাগলো। ফান খোইতের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা স্টীম হাউসের উদ্দেশে রওনা হয়ে পড়লুম! জঙ্গলের রাস্তায় আমাদের যাতে আবার কোনো বিপদে পড়তে না-হয়, সেইজন্য ফান খোইত আমাদের সঙ্গে কালোগনি ও আরো দুজন অনুচর দিয়ে দিলেন।

পথে আর-কোনো বিষম ব্যাপার ঘটলো না। বাঘ কি নেকড়ে-কারু ল্যাজটুকুও আর দেখা গেলো না। বোধহয়, আলো ফুটতে দেখে, রাত্তিরের ওই অভিযানের পর তারা ক্লান্ত বোধ করে, যে যার গোপন ডেরায় ফিরে গেছে। এখন হাঁক পেড়ে তাদের কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে জাগিয়ে তোলার কোনো মানে হয় না। যে-মোষগুলো ক্রাল থেকে প্রাণভয়ে ছুটে পালিয়েছিলো, সেগুলো হয় বাঘ-নেকড়ের খাদ্যে পর্যবসিত হয়েছে, নয়তো এই তল্লাট ছেড়ে বহু দূরে পালিয়ে গেছে। মোষগুলো ফান খোইতের একেবারে সমূহ লোকশান হলো।

জঙ্গল পেরিয়ে এসে কালোগনি তার সঙ্গীদের নিয়ে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলে। আমরা স্টীম হাউসে ফিরে গেলুম ফ্যান আর নাইজারের উল্লসিত ডাকাডাকির মধ্যে।

ব্যাঙ্কসকে আমরা রাত্তিরের সেই রগরগে ও শিহরন ভরা অভিজ্ঞতার কথা খুলে বললুম। এত সহজে আমরা নিষ্কৃতি পেয়েছি শুনে সে আমাদের অভিনন্দন জানালে আর ভাগ্যকে কৃতজ্ঞতা। প্রায় ক্ষেত্রেই এ-রকমভাবে আক্রান্ত হবার পর বন্ধুদের গল্প শোনাবার জন্যে কেউই নাকি বেঁচে থাকে না।

হুড অত্যন্ত অপছন্দ করলেও ব্যাঙ্কস কিন্তু হুডের হাতটা পট্টি বেঁধে স্লিং-এ ঝুলিয়ে রাখলে। তবে ক্ষতস্থানটা পরীক্ষা করে ব্যাঙ্কস এটা বললে যে আঘাত মোটেই গুরুতর নয়—কয়েক দিনের মধ্যেই সেরে যাবে। ভিতরে ভিতরে হুড একেবারে অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছিলো : সে কোনো প্রতিশোধ নিতে পারলে না, মাঝখান থেকে বাঘের থাবার চোট পেয়ে গেলো। অথচ ওই প্রায়-অবশ হাত নিয়েই সে কিনা ৪৯ নম্বরটি ঘায়েল করেছে।

২৭ তারিখ বিকেলে গোটা স্টীম হাউস ফ্যান আর নাইজারের আহ্লাদি ডাকাডাকিতে জেগে উঠলো। বাইরে এসে দেখি সার্জেন্ট ম্যাক-নীল আর গৌমিকে নিয়ে কর্নেল মানরো ফিরে এসেছেন। দেখে আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলুম। সার এডওয়ার্ডের অভিযান সফল হয়েছে কি না, তা অবশ্য তখনও জানি না—কিন্তু তিনি যে সুস্থ দেহে ফিরে এসেছেন, এটাই যথেষ্ট।

পরে অবিশ্যি জানা গেলো নেপাল-সীমান্তে তার অন্বেষণের কোনো ফল হয়নি–এটুকু ছাড়া মানরো আর বিশেষ কিছু বলতে চাইলেন না। ব্যাঙ্কস অবিশ্যি হাল ছেড়ে দিলে না—আড়ালে ডেকে ম্যাক-নীলকে জিগেস করে যা জানা গেলো, তার সারমর্ম হলো এই : বই প্রেসিডেন্সিতে আবির্ভূত হবার আগে নানাসাহেব হিন্দুস্থানের যে-অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিলেন, মানরোর ইচ্ছে ছিলো পুরো জায়গাটা সরেজমিন তদন্ত করে দ্যাখেন; নানাসাহেব ও তার সঙ্গী-সাথীদের কী হলো, তা জানবার জন্যে অত্যন্ত উদগ্রীব ছিলেন তিনি, জানতে চাচ্ছিলেন বম্বাইতে গিয়ে কে আশ্রয় নিয়েছে—নানাসাহেব, বালাজি রাও।

খোঁজখবর নিয়ে যা জানা গেছে, তাতে আর সন্দেহ নেই যে বিদ্রোহীরা ভারত ছেড়ে চলে গিয়েছে। বালাজি রাও-এর কোনো খবরই নেই; নানাসাহেব তো একেবারে উবে গিয়েছেন হাওয়ায়। সাতপুরা পর্বতের অধিত্যকাতেই নিশ্চয়ই নানাসাহেবের মৃত্যু হয়েছে–আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা নিশ্চয়ই নেতার মৃত্যুতে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে। বেহেমথের এখন আর হিমালয়ে থেকে লাভ নেই। বরং বম্বাই অব্দি ঘুরে দেখা ভালো।

সব শুনে ঠিক হলো সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখে আমরা ধবলগিরি ছেড়ে রওনা হবো। হুডের ক্ষতটা শুকিয়ে যেতে এই কটা দিন লেগে যাবে। তাছাড়া কর্নেল মানরোও এত জায়গা ঘুরে এসে বেশ ক্লান্ত-ভারও বিশ্রাম চাই।

ব্যাঙ্কস ইতিমধ্যে হিমালয় থেকে বম্বাই যাবার প্রস্তুতিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ঠিক হলো, উত্তর-পশ্চিম ভারতের যে-সব অংশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছিলো, সেসব অংশ দিয়ে কিছুতেই যাওয়া চলবে না—অর্থাৎ মীরাট, দিল্লি, আগ্রা, গোয়ালিয়র, ঝান্সি—এইসব জায়গা বেহেমথ বিষবৎ পরিত্যাগ করে চলবে। মানরোর তিক্ত ও বিষণ্ণ স্মৃতিকে খামকা উশকে দিয়ে কোনো লাভ নেই। আমরা যাবো সিন্ধিয়ার মধ্য দিয়ে–এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ওইসব নগরের চেয়ে একদিক থেকে অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক।

ইতিমধ্যে অগস্টের মধ্যে মৌশুমি ঋতুর অবসান হয়ে গেলো। সেপ্টেম্বর এলো শুকনো, স্বচ্ছ ও ঝলমলে দিন নিয়ে। তাপমাত্রাও কম, আমাদের যাত্রার দ্বিতীয় পর্যায় অনেক বেশি ভালো কাটবে, সন্দেহ নেই।

ইতিমধ্যে আমরা দু-তিনবার ক্রাল-এ গিয়েছিলুম। মাতিয়াস ফান খোইতও বম্বাই রওনা হবার উদ্যোগ করছিলেন যে কটা জন্তু তার সংগ্রহ করার ছিলো, সবই করেছেন—কিন্তু এখন আবার গাড়ি-টানা মোষ জোগাড় করতে হবে তাঁকে। সে-রাত্রে যে-মোষগুলো পালিয়ে গিয়েছিলো, তার একটাকেও ফিরে পাওয়া যায়নি। সেই জন্যেই ফান খোইত অনেক ভেবে কালোগনিকে পাঠিয়েছেন আশপাশের গ্রামে-যদি কয়েকটা মোষ জোগাড় করা যায় গাড়ি টানবার জন্য।

হুডের ক্ষতটা ক্রমশ শুকিয়ে আসছিলো। একটু সেরে উঠতেই সে ফের শিকারে বেরুবার জন্যে উশখুশ করতে লাগলো। কিন্তু কড়া ফতোয়া জারি করে দিলে ব্যাঙ্কস : রাস্তায় অনেক শিকার পাওয়া যাবে—এখন দুর্বল হাত নিয়ে শিকারে যাবার কোনো দরকার নেই।

কিন্তু আমি যে অন্তত পঞ্চাশটা বাঘ মারতে চেয়েছিলুম, হুড কাতরভাবে বললে, মাত্র উনপঞ্চাশটা হয়েছে।

বাস, ওই ঢের। পঞ্চাশ নম্বরটি না-হয় পরে মেরো।

সেপ্টেম্বরের দুই তারিখ বিকেলবেলায় ফান খোইত আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন যাবার আগে। কেবল বিদায় জানানোই অবশ্য তার উদ্দেশ্য ছিলো না। গাড়িটানা মোষ নাকি তার জোগাড় হয়নি, কালোগনির সব চেষ্টা ও তদন্তই নাকি ব্যর্থ হয়েছে।–অজস্র অর্থের বিনিময়েও সে একটিও মোষ কিনতে পারেনি। এখন এই ওলন্দাজ ভদ্রলোক মহা ফাঁপরে পড়েছেন—কেমন করে যে ওই জানোয়ারগুলোকে নিয়ে বন্দর অব্দি যাবেন, এ-কথা ভেবেই কূল পাচ্ছেন না।

তাহলে কী করবেন আপনি এখন? ব্যাঙ্কস জিগেস করলে।

কী-যে করবো, কিছুই ভেবে পাচ্ছি না, ফান খাইত বিমর্ষভাবে জানালেন, অথচ কথা ছিলো সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখে জন্তুগুলো বম্বাইতে গিয়ে ডেলিভারি দিতে হবে-–আর মাত্র আঠারো দিন হাতে আছে আমার।

আঠারো দিন মাত্র! তাহলে তো আপনার আর একমুহূর্তও নষ্ট করলে চলবে না! বম্বাই কি এখান থেকে কম দুর?

তা জানি। কিন্তু এখন আর একটাই মাত্র উপায় আছে আমার–তাছাড়া আঠারো দিনে বম্বাই পৌঁছুনো অসম্ভব।

কী উপায়, শুনি?

কর্নেল যদি দয়া করে আমার একটা উপকার করেন, তাহলে–

বলুন, মিস্টার ফান খোইত। সার এডওয়ার্ড বললেন, আমাকে দিয়ে যদি আপনার কোনো উপকার হয়, তো আমি সানন্দে তা-ই করবো।

মাতিয়াস ফান খোইত ঝুঁকে অভিবাদন করে এমন-একটা ভঙ্গি করলেন যেন কর্নেল মানরোর এই অনুগ্রহে তিনি শুধু আপ্লুত নয়, একেবারে প্লাবিতই হয়ে গেছেন। তারপর কিছুক্ষণ ধরে তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে তিনি বললেন যে, তিনি শুনেছেন বেহেমথের ক্ষমতা নাকি অসীম-যদি বেহেমথের সঙ্গে তার চাকাওলা-খাঁচাগুলো জুতে দেয়া যায়, এবং এটোয়া পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে সেখান থেকে তিনি ট্রেন ধরতে পারেন। কর্নেল মানরো ব্যাঙ্কসের দিকে তাকালেন। মিস্টার ফান খোইত যা চাচ্ছেন, তা কি সম্ভব হবে?

সম্ভব না-হবার তো কোনো কারণ দেখছি না, ব্যাঙ্কস বললে, কত ওজন নিয়ে চলেছে, তা বেহেমথ টেরই পাবে না।

তাহলে তা-ই হবে, মিস্টার ফান খোইত, বললেন কর্নেল মানরো, আপনাকে আমরা এটোয়ায় পৌঁছে দেবো। হিমালয়ে একে-অন্যকে না-দেখলে মানুষ আর কোথায় পরস্পরকে দেখবে বলুন?

সেই অনুযায়ীই বন্দোবস্ত হলো। ওলন্দাজ প্রাণিতাত্ত্বিকটি ক্রল-এ ফিরে গেলেন। লোকজনের মাইনে চুকিয়ে দিতে হবে—সঙ্গে মাত্র চারজন পাহাড়িকে নেবেন তিনি, তারা জন্তুদের দেখাশুনো করবে, বাকিদের চাকরি এখানেই শেষ। তাছাড়া যাবার ব্যবস্থাও করতে হবে।

তাহলে এই কথাই রইলো–কাল আমাদের দেখা হবে, মানরো বললেন।

আমি তৈরিই থাকবো–ক্রাল-এ গিয়ে আপনাদের ওই বাষ্পীয় দানবকে মোটেই সময় নষ্ট করতে হবে না।

এই বলে সানন্দ চিত্তে ফান খোইত ক্রাল-এ ফিরে গেলেন।

পরের দিন সকাল সাতটার সময় বেহেমথের চুল্লিতে আগুন দেয়া হলো–আবার কয়েক সপ্তাহ পরে প্রচণ্ড বাষ্পবেগে বেহেমথ কেঁপে উঠলো থরথর করে, শুরু হলো আমাদের ভারতদর্শনের দ্বিতীয় পর্যায়।

ঘণ্টা দুই পরে শুঁড় দিয়ে কুণ্ডলী-পাকানো কালো ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে বেহেমথ ক্রাল-এ গিয়ে হাজির হলো। বেহেমথকে দেখেই ফান খোইত ছুটতে-ছুটতে বাইরে বেরিয়ে এলেন, সাধু ভাষায় বিরাট যত বাক্য আউড়ে আবার অবিশ্রাম ধন্যবাদ দিলেন আমাদের, তারপর খাঁচাগুলো বেহেমথের পিছনে জুড়ে দেয়া হলো—এছাড়াও রইলো চাকালাগানো একটা অতিরিক্ত কামরা, সেটাতে থাকবেন ফান খোইত, তাঁর অনুচরদের নিয়ে।

ব্যাঙ্কস সংকেত করতেই বেহেমথের তীক্ষ্ণ্ণ ধাতব বাঁশিটি বেজে উঠলো, তারপর রাজকীয় চালে বেহেমথ আস্তে-আস্তে অগ্রসর হলো দক্ষিণের পথ ধরে। ফান খোইত ও তার বহর জুড়ে দেয়া সত্ত্বেও বেহেমথের চালচলনে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না।

কী, ফান খোইত? কেমন লাগছে আমাদের বেহেমথকে, ক্যাপ্টেন হুড জিগেস করলে তাকে।

আমার কি মনে হয়, জানেন ক্যাপ্টেন, মাতিয়াস ফান খোইত বললেন, হাতিটা যদি রক্তমাংসের হতো, তাহলে আরো ভালো হতো।

আমরা যে-পথ দিয়ে হিমালয়ে এসেছিলুম, ফেরার সময় আর সেই পথ না-ধরে দক্ষিণ-পশ্চিম পথ দিয়ে যেতে লাগলুম। বেহেমথ বেশ স্বচ্ছন্দভাবেই এই পাহাড়ি পথ দিয়ে ঘুরে-ঘুরে নেমে চললো-কোনো বাধা বা অসুবিধে হলো না পথে। ওলন্দাজ প্রাণিতাত্ত্বিকটি রোজ সকালবেলায় ছোটোহাজরির সময় আমাদের সঙ্গে এসে বসেন খানা খেতে, এবং মঁসিয় পারাজারের রন্ধনপ্রতিভার প্রতি সুবিচার করেন সবেগে ও সহাস্যে। পারাজারের রকমারি রান্না একবার যে চেখে দেখেছে, সে আর কখনও তা ভুলতে পারবে না।

রাস্তায় যখনই কোনো পাহাড়ি গ্রাম পড়লো দলে-দলে গ্রামবাসীরা এলো আমাদের বহর দেখতে। ফান খোইতের বাঘ-সিংহের খাঁচার দিকে তারা একবারও নজর দিলে না, ঘুরে-ঘুরে কেবল লক্ষ করলে বেহেমথকে আর তড়বড় করে নিজেদের ভাষায় সম্ভবত তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসাই করলে। এর ফলে ফান খোইতের মনে যে-শোক দেখা দিতে, তার উপশম করতেন তিনি খাবার-টেবিলে।

অবশেষে দিন দশেক পরে রেলস্টেশন যখন এলো তখন ফান খোইত ট্রেন ধরার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এবং যে-সব অনুচর এখন আর তার লাগবে না, তাদের তিনি বিদায় দিলেন এখানেই–বাকি দু-তিনজন তার সঙ্গে যাবে বম্বাই অব্দি—সেখানে তাকে জাহাজে উঠিয়ে দিয়ে তবে তাদের ছুটি। যাদের মাইনে তিনি চুকিয়ে দিলেন, তাদের একজন হলো দুধর্ষ শিকারি কালোগনি।

কর্নেল মানরো ও ক্যাপ্টেন হুডের প্রাণ বাঁচিয়েছিলো বলে কালোগনির উপর আমাদের প্রতি জন্মে গিয়েছিলো। চাকরি চলে-যাওয়ায় তাকে বিমর্ষ হয়ে পড়তে দেখে ব্যাঙ্কস তাকে জিগেস করলে যে সে আমাদের সঙ্গে বম্বাই অব্দি যেতে রাজি আছে কিনা। কিছুক্ষণ কী ভেবে কালোগনি প্রস্তাবটা গ্রহণ করলে—আর কালোগনি সঙ্গে যাবে শুনে কর্নেল মানরো খুব খুশি হয়ে উঠলেন। সে এদিককার সবকিছু ভালো চেনে —সে স্টীম হাউসে কাজ নিলে আমাদেরই সুবিধে হবে সবচেয়ে বেশি।

ফান খোইতের কাছ থেকে আমরা বিদায় নিলুম অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই—কিন্তু ফান খোইতের ভাবভঙ্গিতে রইলো বিপুল নাটুকেপনা—যেন মঞ্চের ওপর কৌতুকনাট্যের দৃশ্য একটা; কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভঙ্গি তাঁর আতিশয্যে ভরপুর। বিশেষ করে যখন স্টীম হাউস তাকে রেলস্টেশনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো, তখন তিনি অনেকক্ষণ পর্যন্ত অপস্রিয়মাণ বেহেমথকে মূকাভিনয় করে দেখাতে লাগলেন যে কস্মিনকালেও—কবরে, কি চিড়িয়াখানায়—কোথাও আমাদের দয়া তার স্মৃতি থেকে মুছে যাবে না। তার সেই হাত-পা নাড়া দেখতে-দেখতে আমরা এটোয়া পেরিয়ে এলুম।