২.০৪ পুরাতন প্রাসাদ

পুরাতন প্রাসাদ

বাবু!

কে? সুব্রত চোখ চেয়ে দেখলে দুঃখীরাম কখন একসময় ঘরে এসে প্রবেশ করেছে।

চা আনব বাবু?

চা! আচ্ছা নিয়ে এস।

দুঃখীরাম ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। এবং একটু পরেই ধূমায়িত চা-ভর্তি একটি কাপ হাতে ঘরে এসে প্রবেশ করল।

দুঃখীরাম!

আজ্ঞে?

তুমি বুঝি অনেকদিন এখানে কাজ করছ?

আজ্ঞে তা প্রায় পনের-ষোল বৎসর তো হবেই—

তোমার বাড়ি কোথায় দুঃখী?

ঢাকা জিলায় বাবু।

তাহলে নিশ্চয়ই তুমি তোমাদের ছোট কুমারকে দেখেছ?

তা আর দেখিনি! আহা বড় সদাশয় লোক ছিলেন তিনি। এমন করে বেঘোরে প্রাণটা গেল! দুঃখীরামের চোখ দুটি ছলছল করে এল, প্রায়ই তো তিনি এখানে এসে এক মাস দু মাস থাকতেন। আমাদের সকলকে তিনি কি স্নেহটাই করতেন বাবু। অমন হাসিখুশি, আত্মভোলা লোক আর আমি দেখিনি। তিনিও এসে এই ঘরেই থাকতেন, বলতেন এই ঘরেই তো আমার ঠাকুরদামশাই খুন হয়েছিলেন!

হ্যাঁ, শুনেছি বটে, শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিক মশাই এই বাড়িতেই খুন হয়েছিলেন—তা এই ঘরেই নাকি?

হ্যাঁ বাবু, শুনেছি এই ঘরেই। আমাদের সুধীনবাবুর বাবাও তো এই ঘরেই খুন হন। তিনিও লোক বড় ভাল ছিলেন বাবু।

সুব্রত স্তম্ভিত হয়ে যায়, তাহলে সেই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড পর পর দুবার এই কক্ষেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল! কি বিচিত্র ঘটনা-সংযোগ! সেও এসে এই ঘরেই আজ আস্তানা নিয়েছে। হত্যাকারীর রক্ততৃষ্ণা কি মিটেছে? না আবার সে-রক্ততৃষ্ণায় তারও প্রাণ নিতে রাত্রির অন্ধকারে আবির্ভূত হবে কোনও এক সময়! বিচিত্র একটা শিহরণ সুব্রত তার রক্তের মধ্যে অনুভব করে যেন, মনে হয় সে আসবে! নিশ্চয়ই আবার সে এই ঘরে আবির্ভূত হবে! যখন চারিদিক নিঝুম হয়ে যাবে, ঘন নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে বিশ্বচরাচর অবলুপ্ত হয়ে যাবে, তখন সে আসবে এই ঘরে। আসুকতাই তো চায় সুব্রত।

সুব্রত সোজা হয়ে বসে, আজ এখানে হাটবার না দুঃখীরাম?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

মাছ পাওয়া যায় এখানে?

আজ্ঞে না, তবে মাংস পাওয়া যায়, ভাল হরিণের মাংস।

হরিণের মাংস! চমৎকার হবে, তাই নিয়ে এস। শুধু মাংসের ঝোল আর ভাত বেঁধে এবেলা। হ্যাঁ শোন, আমাকে আর এক পেয়ালা চা দিয়ে যেও।

যে আজ্ঞে বাবু।

দুঃখীরাম চলে গেল।

***

অনেকক্ষণ থেকে সুব্রত একা একা সমস্ত বাড়িটার মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়িটার বয়স অনেক হয়েছে, ভাঙন ধরেছে এর চার পাশে, অথচ সংস্কারের কোন প্রচেষ্টাই নেই, দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। প্রথমেই সুব্রত তিনতলাটা দেখে এল। প্রকাণ্ড ছাদ, ছাদের এক কোণে পাশাপাশি নাতিপ্ৰশস্ত দুটি ঘর, কিন্তু দুটি ঘরেই দরজার বাইরে থেকে ভারী হবসের তালা লাগানো।

দোতলায় সর্বসমেত পাঁচখানা ঘর, একটি চৌধুরী ব্যবহার করেন, সেটাও বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগানো, এবং সুব্রত যেটি অধিকার করেছে সেটি ছাড়া বাকি তিনটিতে কেবল শিকল-তোলা বাইরে থেকে, কোনো তালা লাগানো নেই। সুব্রত দেখল ঘর তিনটি খালিই পড়ে আছে। দুটি ঘরেই একটি করে আলমারি ছাড়া অন্য কোন দ্বিতীয় আসবাব নেই। নীচে আটটি ঘর। সেটি দুটি মহলে বিভক্ত; অন্দর ও সদর। সদরে মহলেই কাছাড়ীবাড়ি। জন দু-তিন কর্মচারী, দারোয়ান, ভৃত্য সব সদর মহলেই থাকে। অন্দরমহলে একমাত্র পাকের ঘর ছাড়া অন্য কোন ঘর ব্যবহার হয় না। নীচের অন্দরমহলে কোণের দক্ষিণ দিকে একটি মাত্র ঘর ছাড়া বাকিগুলোতে কোন তালা দেওয়া নেই। অন্যান্য তালাবন্ধ ঘরগুলোর মত সুব্রত ঐ ঘরের তালাটা ধরেও নাড়তে গিয়ে একটু যেন বিস্মিত হল। ঐ ঘরের তালাটা বেশ পরিষ্কার, এতে প্রায়ই মানুষের হাতের ছোঁয়া পড়ে–তা দেখলে বুঝতে তেমন কষ্ট হয় না।

সুব্রত দরজার কপাট দুটো ঠেলতেই সামান্য একটু ফাঁক হয়ে গেল, তালা লাগানো থাকা সত্ত্বেও। ঘরের মধ্যে অন্ধকার। কিছু দেখবার উপায় নেই। সুব্রত উপরে নিজের ঘরে গিয়ে হান্টিং টচটা নিয়ে এল। দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে আলো ফেলতে নজরে পড়ল, ঘরের মধ্যে পুরু হয়ে ধুলো জমে আছে। কিন্তু আশ্চর্য হল যখন দেখলে সেই ঘরের ধুলোর ওপরে অনেকগুলো সুস্পষ্ট পায়ের ছাপ। পায়ের ছাপ ছাড়া আর বিশেষ কিছুই সুব্রতর নজরে পড়ে না। তালাটা খোলা যায় না। ভারী মোটা জামান তালা। সুব্রত টর্চ আনবার সময়ই তালাচাবি খোলবার যন্ত্রগুলো নিয়ে এসেছিল এবং কিছুক্ষণ চেষ্টা করতেই তালাটা খুলে গেল। ছোট্ট একটা ঘর। এবং ঘরটা একেবারে খালি, কেবলমাত্র একটা গা-আলমারী দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে গা-আলমারির কপাটটা খুলে ফেলে। আলমারিটা শূন্য, তার মধ্যে কিছু নেই। কতকগুলো আরশুলা এদিক ওদিক ফরফর করে উড়ে গেল। ঘরের কোন কোণায় একটা ছুঁচো চিকচিক করে ডেকে উঠল। একটা বিশ্রী ধুলোর গন্ধ। মেঝেতে ধুলো জমে আছে। তার ওপর অসংখ্য পদচিহ্ন। কোনটা ঘরের মধ্যে এসে ঢুকেছে, কোনটা বাইরের দিকে চলে গেছে। সুব্রত টর্চের আলো ফেলে ধুলোর ওপরে পদচিহ্নগুলো দেখতে গিল। সবই একই ধরনের এবং একই আকারের পদচিহ্ন বলেই যেন মনে হয়। সুব্রত আবার ঘরের চতুষ্পর্শ্বে আলো ফেলে দেখলে—না, কিছু নেই। এ ঘরে যে দীর্ঘকাল ধরে কোন লোক বাস করে না, তাতে কোন ভুলই নেই, অথচ ঘরের মেঝের ধুলোতে পদচিহ্ন ছড়ানো। একটি মাত্র দরজা ছাড়া ঘরের মধ্যে দ্বিতীয় জানালা পর্যন্ত নেই। এই অপরিসর আলোবাতাসহীন অন্ধকার ঘরটা কিসের জন্য ব্যবহার হত তাই বা কে বলতে পারে! এবং এখন বর্তমানে কেউ না এ ঘরে বাস করলেও ঘরের মেঝেতে পদচিহ্ন।

সুব্রত হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, বেলা প্রায় এগারোটা। এখুনি হয়ত দুঃখীরাম হাট থেকে ফিরে আসবে। সুব্রত ঘর থেকে বের হয়ে তালার মুখটা কোনমতে টিপে লাগিয়ে রাখল মাত্র। সামান্য টানলেই যাতে করে খুলে যায় এবং তখনি জানাজানি হয়ে যাবে—তাতে করে মনে হয় নিশ্চয়ই তালাই ভেঙে রেখে গেছে। কিন্তু উত্তেজনার বশে তালা ভাঙার মুহূর্তে সুব্রতর একটিবারও সে কথাটা মনে হয়নি। কিন্তু এখন আর উপায়ই বা কি? সুব্রত উপরে নিজের ঘরে চলে এল। একটু পরেই সে বুঝতে পারলে দুঃখীরামের গলার স্বরে যে দুঃখীরাম হাট থেকে ফিরে এসেছে।

দ্বিপ্রহরে আহারাদির পর সুব্রত প্রাসাদের আশপাশ চারিদিক ভাল করে পরীক্ষা করে দেখবার জন্য আবার বের হয়ে পড়ল। কাছারীবাড়ির পিছনদিকে টিনের ও খোলার শেড় তোলা অনেকগুলো চালাঘরের মত; সেগুলোর মধ্যে নানা সাইজের কাঠ ও তক্তা সাজানো, বামদিকে একটি প্রশস্ত চত্বর। চত্বরের একদিকে হাতি ও ঘোড়াশালা। দুটি ঘোড়া ও তিনটি হাতি আস্তাবলে আছে—এখন মাত্র একটি ঘোড়াই রয়েছে; অন্যটিতে চেপে চৌধুরী কারখানায় গেছে। একজন মাহুত ও চারজন সহিস তারা সপরিবারেই আস্তাবলের পাশের চালাঘরে থাকে। কাছারীবাড়ির ডানদিকে একটি ফুলের বাগান।

ছোট একটা চালাঘর, সপরিবারে মালী সেখানে থাকে। পিছনদিকে কিছুদূর এগিয়ে গেলে অনুর্বর রুক্ষ মাঠ, মাঠের মধ্যে দিয়ে একটা সরু পায়ে-চলা পথ। আর দূরে দেখা যায় পাশাপাশি দুটি পাহাড়। প্রাসাদ ছেড়ে ঐ পথেই এগিয়ে গেলে, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে কিছু সাঁওতালদের বাস। তাদের প্রত্যেকেই প্রায় এদের কাঠের কারখানায় কাজ করে। ঘুরে ঘুরে সুব্রত অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, পিপাসাও পেয়েছে খুব; মনে হয় এক কাপ চা পেলে নেহাৎ মন্দ হত না। সূর্য আকাশের পশ্চিম প্রান্তে হেলে পড়েছে। মাঠের একপাশে একটা বাঁশঝাড়। সেই ঝোপের মধ্য হতে শ্রান্ত ঘুঘু ও হরিয়ালের একটানা কৃজনধ্বনি প্রান্তরের তপ্ত হাওয়ায় ভাসিয়ে আনে।

উদাস বিধুর চৈত্র-মধ্যাহ্নের নীল আকাশটা যেন সূর্যালোকে আরও উজ্জ্বল নীল দেখায়। ওই দূরে অনন্তনীলিমায় যেন মহাশূন্যে কালির বিন্দুর মত কয়েকটা চিল উড়ছে।

সুব্রত আবার কাছারীবাড়িতে ফিরে এল।

দুঃখীরামকে ডেকে চা আনতে বললে।