৩. স্বৈরাচারী/একনায়ক
(আমেদে ফ্লরেঁসের নোটবই থেকে)
২৬শে মার্চ। তাহ’লে এখন এই কয়েদখানায়! মাজেপ্পার ভূমিকায় অভিনয় করার পর, এখন কিনা সিলভিও পেলিকোর ভূমিকায় অভিনয় করছি, যে সিলভিও পেলিকো ছিলেন বায়রনের বন্ধু, দশ-দশ বছর বন্দীজীবন কাটাবার মর্মন্তুদ কাহিনী যিনি লিখে গেছেন।
যেমন বলেছি, পরশুদিন, দিবা দ্বিপ্রহরের একটু আগেই, আমাদের বন্দী করা হয়েছিলো। আমাকে পাকড়ে ধরেছিলো তিন-তিনজন মুলাটো, যারা কিঞ্চিৎ জানোয়ার-সুলভ ব্যবহারের পরে, আমাকে জোর ক’রে নিয়ে গিয়েছে কতগুলো পইঠা পেরিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে, তারপর একটা অন্ধকার ঢাকাবারান্দা দিয়ে লম্বা-একটা গ্যালারিতে, আর তার মধ্যে ছিলো কয়েকটা ছোটো কুঠুরি। এই আস্ত গ্যালারিটার ওপরই নজর রাখা সহজ, আর দু-প্রান্তে দাঁড়িয়েছিলো শাস্ত্রীরা। আমার ঘোরতর সন্দেহ, অন্তত এই গ্যালারি পেরিয়ে আমরা হয়তো কোনোদিনই পালাতে পারবো না।
আমাকে এমন-একটা কুঠুরির মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যার মধ্যে আলো ঢোকে আমার মাথার প্রায় বারোফিট ওপরে গরাদ-দেয়া একটা জানলা দিয়ে, তারপর দরজাটা বন্ধ ক’রে দিয়ে তিন-তিনটে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। কেবল আমার নিজস্ব দুর্ভাবনাগুলোর সঙ্গেই এখন আমার সহবাস–এবং দুর্ভাবনাগুলো ঠিক গোলাপসুন্দরী নয়।
একার পক্ষে এই কুঠুরিতেই চ’লে যায়—এতে হাওয়াও ঢোকে। ঘরের মধ্যে আছে একটা টেবিল, তাতে কিছু লেখার সরঞ্জাম, একটা চেয়ার, একটা বিছানা- সেটাকে বেশ পরিচ্ছন্নই লেগেছে, আর-কিছু শাবান ইত্যাদি। ছাদ থেকে ঝুলছে একটা বিজলিবাতির আলো। এই কয়েদখানার তথাকথিত ‘খড়ের শয্যা’ বেশ আরামপ্রদই। লেখার ঘর হিশেবে এটাকে হয়তো আমার পছন্দই হ’তো, যদি-অবশ্য আমার স্বাধীনতা থাকতো।
ব’সে প’ড়ে আমি একটা সিগারেট ধরালুম। আমি অপেক্ষা ক’রে আছি—কিন্তু কীসের? একটা-কিছু ঘটে যাক, হেস্তনেস্ত হ’য়ে যাক—এইই আমি চাই। অন্তত যতক্ষণ কিছু না-ঘটে, ততক্ষণ দিব্বি এই চমকপ্রদ ভ্রমণের উপায়টা নিয়েই ভাবা যাবে।
দু-ঘণ্টা পরে আমার এই ধ্যানভঙ্গ হ’লো আমার কুঠুরির দরজা খোলার আওয়াজে। খিল খোলা হ’লো, তালাগুলোয় চাবি ঘোরাবার আওয়াজ হ’লো, এবং দরজা হট ক’রে খুলে গেলো, এবং আমি দেখতে পেলুম… হাজারটা অনুমান করার সুযোগ দিচ্ছি আপনাদের।
আমি দেখতে পেলুম ৎশুমুকিকে, হ্যাঁ, ৎশুমুকিকে, হ্যাঁ, ৎশুমুকিকেই, যে উধাও হ’য়ে গিয়েছিলো, তৃতীয়বার-যেদিন আবার আমি এই রহস্যময় গুমগুম শুনতে পেয়েছিলুম, তৃতীয়বারের মতো, যে হাজারো ভোমরার গুঞ্জনের অর্থ এখন বেশ বুঝতেই পারছি আমি। যেভাবে আমার লেখাগুলোকে তাচ্ছিল্য করেছে, তারপরেও কি না আমার সামনে এসে উদয় হবার তার সাহস হয়!
সে নিজেই নিশ্চয়ই শীতল-এক অভ্যর্থনাই প্রত্যাশা করেছিলো। তাই কুঠুরির মধ্যে ঢোকবার আগে একবার সরেজমিন নিরীক্ষণ ক’রে হতচ্ছাড়া আন্দাজ করবার চেষ্টা করছিলো কী-রকম অভ্যর্থনা তার কপালে আছে।
‘ও-হো! তুমি শ্রীমান, দু-চোখো খলনায়ক!’ ব’লেই আমি ছুটে গিয়েছি তার দিকে, ইচ্ছেটা হতভাগাকে হাতের সুখে দু-ঘা কষিয়ে দিই!
কিন্তু আমি এসে প্রায় ধাক্কাই খেলুম দরজার পাল্লার গায়ে-বেইমানটা আমার ভাবভঙ্গি দেখেই তৎক্ষণাৎ দরজাটা বন্ধ ক’রে দিয়েছে। সেটা হয়তো ভালোই হ’লো! তার কানটা মূলে দিলে আমার হাতের সুখ হ’তো বটে, তাতে শেষ অব্দি কী-ই বা লাভ হ’তো আমার? বরং এমনিতেই নিরানন্দ দশাটা হয়তো আরো- জটিল হ’য়ে পড়তো!
সে বোধহয় আন্দাজই করতে পেরেছিলো আমার ইচ্ছার এই ডিগবাজি। কারণ দ্বিতীয়বার দরজাটা খুলে নচ্ছার দিব্বি-মুখটা বাড়িয়ে দিয়েছিলো ঘরের মধ্যে। হ্যাঁ- হ্যাঁ, এবার সে অনায়াসেই ঘরে ঢুকতে পারে। কেননা ততক্ষণে আমি ফের আমার চেয়ারটায় এসে বসেছি… সেই সঙ্গে চেষ্টা করেছি মাথাটাও ঠাণ্ডা রাখতে।
আমি ফের একই সম্ভাষণ জানাই তাকে, তবে এবার গলার স্বরে কোনো ধমকের ভাব নেই : ‘ও-হো! তুমি শ্রীমান, দু-চোখো খলনায়ক! কিন্তু হতচ্ছাড়া, তুই এখানে কী করছিস?’
আমি এখানে চাকরি করি,’ দরজার পাল্লা আরো খুলে ধ’রে একটু সংকোচের সুরেই বলে ৎশুমুকি।
ঢাকাবারান্দাটা দিয়ে আরো-দুজন আফ্রিকি খাবারের থালা নিয়ে এগিয়ে আসে। ৎশুমুকি নিজের হাতে সব খাবার সাজিয়ে রাখে আমার টেবিলে। খাবার দেখে আমার জিভে জল এসে যায়, এতক্ষণে বুঝতে পারি যে খিদেয় আমার নাড়িভুঁড়ি চোঁ-চো করছে। সেটা অবশ্য বিস্ময়কর কিছু নয়। কারণ আমি সারাদিন কিছু খাইনি, এবং এখন বেলা দুটো বাজে।
সব দুর্ভাবনাকে ঝেড়ে ফেলে আমি এই খাদ্যের প্রতি সুবিচার করবার চেষ্টা করি, আর ৎশুমুকি বেশ সসম্ভ্রমেই খাবার পরিবেষণ করে আমাকে। আমি তাকে প্রশ্ন জিগেস করি আর সে চেপে-ঢেকে রাখে না কিছু—যখন উত্তর দেয়। তার মতে আমি নাকি এক রাজার অতিথি-অনিচ্ছাসত্ত্বেও-বড়ো-এক রাজা, হ্যারি কিলার-নামটা অবশ্য তেমন-মনোরম নয়-আর ইনিই নাকি আমাকে এই আশ্চর্য শহরে নিয়ে এসেছেন, যেখানে নাকি ‘বিস্তর বড়ো-বড়ো কুঠি আছে,’ আর আছে অজস্র ‘তুবাব জিনিশ,’ যার মানে ইওরোপের অনেক জিনিশপত্রই মেলে এখানে। সেটা অবশ্য আমার বিশ্বাস করতে কোনোই অসুবিধে হয় না, বিশেষত ঐ উড়ালযানগুলোর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার পর। সত্যি বলতে, ঐ আকাশযানগুলো এখনও আমাকে কী-রকম যেন অভিভূত ক’রে রেখেছে।
আমি আমার জিজ্ঞাসা চালিয়েই যাই। নিশ্চয়ই এই তথাকথিত রাজাবাহাদুরই তাকে—অর্থাৎ ৎশুমুকিকে-মাদ্মোয়াজেল মোরনাসের পথে এনে হাজির করেছিলো, এবং তখন তিনি তাকে তাঁর গাইড হিশেবে নিযুক্ত করেছিলেন, যেমন ক’রে লোকে নিজের যাবতীয় অনিচ্ছা সত্ত্বেও ম্যাজিশিয়ানের হাতসাফাই-ক’রে চালানো তাশটাই তুলে নেয়। ৎশুমুকি অবশ্য আপত্তি জানায়, বলে যে সে আগে থেকে কোনো পরিকল্পনা না-ক’রেই নাকি চাকরিটা নিয়েছিলো। তার আরো আব্দার এটাই যে সে নাকি ককখনো কথার খেলাপ করেনি, মাদ্মোয়াজেল মোর্নাস আর সাঁৎ- বেরা যতদিন আফ্রিকায় থাকবেন, ততদিনই সে নাকি তাঁদেরই চাকরিতে বাহাল থাকবে। এ কি আমাকে ঠাট্টা করছে নাকি? আমি তার দিকে তাকাই। না, সে তো বেশ সিরিয়াসভাবেই কথাটা বলছে, কিন্তু সবমিলিয়ে ব্যাপারটা কেমন যেন হাসিরই শোনায়।
সে বলে মোরিলিরেই নাকি তার মাথাটা খেয়েছে—সে-ই বরং এই রাজাসাহেবের অনুচর। মোরিলিরে যে তাকে বিস্তর ফরাশি সোনা দিয়েছিলো তা-ই নয়, কী- রকম কাব্যি ক’রেই নাকি হ্যারি কিলারের প্রতাপ এবং বদান্যতার কাহন শুনিয়েছিলো : না, ৎশুমুকি এখনও হ্যারি কিলারকে চোখেও দ্যাখেনি। মোরিলিরেই তাকে বলে, তার সঙ্গে কাজ করলে ৎশুমুকির বাকি জীবনটা নাকি স্বচ্ছন্দে হেসে-খেলেই কেটে যাবে—আর এই প্রতিশ্রুতি পেয়েই তার আনুগত্য একটা ডিগবাজি খেয়েছিলো।
আমি যখন তাকে জিগেস করেছি তার পুরোনো বন্ধু তোঙ্গানের কী হয়েছে, তা সে কিছু জানে কি না, ৎশুমুকির বিশ্রী মুখটা যেন আরো-বিশ্রী হ’য়ে উঠেছে, গলার কাছ দিয়ে ছুরি চালাবার ভঙ্গিতে সে হাতটা চালায় একবার আর মুখ দিয়ে আওয়াজ করে, ‘কউয়িক।
তাহ’লে ঠিকই ভেবেছি আমি। বেচারা তোঙ্গানে তবে ম’রে ভূত হ’য়ে গেছে!
ৎশুমুকি তার গোপন কথা শুনিয়ে চলে। যেদিও সে উধাও হ’য়ে গিয়েছিলো সেদিন। যে-গুমগুম গর্জনটা আমি শুনেছিলুম তা ছিলো আকাশযানেরই আওয়াজ, তাতে ক’রেই আমাদের কাছে এসে নেমেছিলো লিউটেনান্ট ল্যকুর, ওরফে কাপ্তেন এডওয়ার্ড রুফাস। তার অনুচরেরা অবশ্য এসেছিলো ঘোড়ায় ক’রেই, দুই গোরা সার্জেন্টের সঙ্গে, আর রাস্তায় গ্রামের পর গ্রাম লুঠপাট ক’রে তারা নাকি একটু মজা করেছে। উড়ালযানের রণপায়ের দাগই মাটিতে অমন চারইঞ্চি গভীর ক’রে খাঁজ কেটে দিতো।
তাতে বেশ সহজেই বোঝা যায় লিউটেনান্ট ল্যকুরকে অমন ফিটফাট আর তার অনুচরদেরই বা অমন ধূলিধূসর দেখিয়েছে কেন। আর এও বোঝা যায় বিস্ফোরক গুলিতে জখম হওয়া ঐ বুড়ো আফ্রিকি গোরা সার্জেন্টকে দেখে অমন আতঙ্কে গুটিয়ে গিয়েছিলো কেন। ঐ একই উড়ালযান ৎশুমুকিকে পরে এখানে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে…
একটা নামও শোনায় সে এ-জায়গাটার, একটু তালগোল পাকিয়েই সে উচ্চারণ করে নামটা। অনেক কষ্টে আমি বুঝতে পারি সে ব্ল্যাকল্যাণ্ড কথাটা উচ্চারণ করবার চেষ্টা করছে—ইংরেজি বলতে সে অভ্যস্ত নয় ব’লেই সে উচ্চারণটা অমন গুলিয়ে ফেলেছে। হ্যাঁ, তা তো হ’তেই পারে। তাহ’লে এখন আমরা এই ব্ল্যাকল্যাণ্ডেই আছি, ৎশুমুকির মতে যেটা নাকি আশ্চর্য শহর, যেটার কোনো হদিশ সবচেয়ে- ওয়াকিবহাল ভূগোলবিদও জানেন না।
শুমুকির মুখ থেকে সব খবর শুনতে-শুনতে আমি ভাবতে থাকি। ৎশুমুকি যদি টাকা কামাবে ব’লেই আমাদের সঙ্গে নেমকহারামি ক’রে থাকে, তাহ’লে আরো-বেশি টাকার লোভে সে তার নতুন প্রভুদের সঙ্গেই বা নেমকহারামি করবে না কেন। এ-কথা ভেবেই আমি তাকে একটু বাজিয়ে দেখি : এমন-একটা টাকার অঙ্কের প্রলোভন যাতে তা তিন পুরুষ পায়ের ওপর পা তুলে স্বচ্ছন্দে জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। হতভাগার কাছে এমন প্রস্তাবটা খুবই স্বাভাবিক শুনিয়েছে, কিন্তু তবু সে ঘন-ঘন মাথা নেড়ে না করেছে, যেন এমন লোভনীয় অঙ্ক হাতে পাবার কোনো সুযোগই তার নেই।
‘এখান থেকে যাবার কোনো উপায়ই নেই,’ সে আমাকে জানায়। ‘এখানে অনেক সেপাইশাস্ত্রী আছে, বিস্তর তুবাব জিনিশ আছে, আর আছে উঁচু-উঁচু সব দেয়াল।’ সে আরো জানায় যে শহরটার চারপাশেই না কি ধূ-ধূ করছে মরুভূমি; আর কিছু না-ই হোক ঐ মরুভূমি পেরুনো আমাদের সাধ্যে নেই। সেটা অবশ্য সত্যি, আকাশ দিয়ে আসার সময় আমি নিজের চোখেই ঐ বিশাল মরুভূমি দেখেছি। তাহলে কি এখানেই আমাদের বাকি জীবনটা কাটাতে হবে নাকি?
আমার খাওয়া শেষ হ’তেই ৎশুমুকি সব থালা-বাসন নিয়ে চ’লে যায়, বাকি দিনটা আমি একাই কাটিয়ে দিই।
রাতের বেলায় ৎশুমুকি ফের খাবার নিয়ে আসে। রান্না বেশ চমৎকার এবং খাবারের বেশ তরিবৎ আছে। তারপর যেই আমার ঘড়িতে ন-টা বেজে কয়েক মিনিট, অমনি হঠাৎ মাথার ওপরকার বিজলিবাতি নিভে গেছে, আমি অন্ধকারে হাড়ে হাড়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছি।
তোফা কেটেছে রাতটা। তারপর ২৫শে মার্চ সকালবেলায় উঠে আমি আমার নোটবই নিয়ে পড়েছি, লিখেছি কেমন ক’রে আমাদের পাকড়ে উড়ালযানে ক’রে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। দিনটা শান্তিতেই কেটেছে। ৎশুমুকি ছাড়া আর কারু সঙ্গেই আমার দেখা হয়নি। সে-ই শুধু নিয়মিত আমার খাবার নিয়ে এসেছে। রাত্তিরে, আগের দিনের অভিজ্ঞতার পর, আমি বাতি নেভার আগেই শুতে চ’লে গেছি—ঠিক আগের রাতের মতোই ন-টা বেজে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আলো নিভে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে, এটাই এখানকার দস্তুর।
আরেকটা রাত কেটেছে আরামেই, তারপর এই-তো আমি, ২৬শে মার্চ সকালে বেশ তরতাজা, তবে—হায়রে!—এখনও কয়েদ হ’য়েই আছি ঘরটায়। অবস্থাটা ক্রমেই আজব ঠেকতে শুরু করেছে : এরা আমাদের নিয়ে কী করতে চায়? জিগেস করতে পারি, এমন-কাউকে কখন দেখতে পাবো?
সন্ধেবেলায়। আমার ইচ্ছাই পূর্ণ হয়েছে। আমরা মহামহিম পরমপ্রতাপাদিত্য হ্যারি কিলারের সকাশে গমন করেছি, এবং সেই সাক্ষাৎকারের পরই আমাদের অবস্থা আদ্যোপান্ত বদলে গিয়েছে। এখনও সে-কথা ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।
তখন বেলা তিনটে হবে, হঠাৎ আমার কুঠুরির দরজাটা শব্দ ক’রে খুলে গিয়েছে। এবার আর এই খোলা দরজায় ৎশুমুকি এসে দেখা দেয়নি, বরং এসেছে আমাদেরই আরেক পুরোনো ইয়ার মোরিলিরে। তার সঙ্গে এসেছে একদঙ্গল আফ্রিকি, বোঝাই যায় সে-ই তাদের সর্দার। এই আফ্রিকিদের মধ্যেই আমি আমার সাথীদের দেখতে পেয়েছি। মিস ব্লেজন-মোর্নাসকে শুদ্ধু, কিন্তু সাঁৎ-বেরাকে নয়- তাঁর তরুণী মাসি জানিয়েছেন, তিনি নাকি এখনও নড়াচড়া করতে পারছেন না। আমি গিয়ে তাঁদের সঙ্গেই যোগ দিই। নিশ্চয়ই আমার জীবনের শেষপ্রহর এসে উপস্থিত হয়েছে, বিনা নোটিসেই—এখন নিশ্চয়ই আমাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জল্লাদের কাছে।
না, সে-রকম কিছু হয়নি আদপেই। সারি-সারি করিডর পেরিয়ে আমরা অবশেষে গিয়ে পৌঁছেছি একটা মস্ত ঘরে : আমরা ঘরটায় ঢুকে পড়েছি, আমাদের পাহারা বাইরে চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে থেকেছে।
ঘরে শুধু একটাই আরামকেদারা, তালপাতায় ছাওয়া, সামনে একটা টেবিলের ওপর একটা গেলাশ, আর আদ্ধেক-খালি বোতল, যার মধ্য থেকে কোহলের গন্ধ বেরুচ্ছে। টেবিলের ওপাশের আরামকেদারাটার ওপর ব’সে আছে একটা লোক। আমরা সবাই একযোগে তার দিকে তাকিয়েছি। হ্যাঁ, লোকটার এলেম আছে বটে।
মহামহিম পরমপ্রতাপাদিত্য হ্যারি কিলারের বয়েস হবে আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ বছর –আরো-কিছু বড়োও হ’তে পারে হয়তো। দেখে যদ্দুর বুঝতে পেরেছি, তাতে মনে হয়েছে মানুষটা সে লম্বা, হট্টাকট্টা গড়ন, বিশাল-দুই হাতের থাবা, মাংসপেশীগুলো ফুটে বেরুচ্ছে বাহুতে, দেখেই বোঝা যায় দেহে বুঝি সে হারকিউলিসের শক্তি ধরে।
কিন্তু যেটা প্রথমেই চোখে পড়ে সেটা তার মাথা। শ্মশ্রুগুম্ফহীন মুখ, মাথায় উশকোখুশকো কাঁচা-পাকা চুল, ঝাঁকড়া, কতকাল যে চিরুনির সঙ্গে এই চুলের মুখদেখাদেখি নেই কে জানে। চওড়া কপাল থেকে এই কেশর—হ্যাঁ, চুল নয়, কেশরই—একটু পেছিয়ে এসেছে, তাতে ক্ষুরধার বুদ্ধির ছাপ, কিন্তু, উগ্রভাবে-ফুটে- বেরুনো চোয়াল দেখে মনে হয় যে-কোনো মুহূর্তে সে রুষ্ট হ’য়ে উঠতে পারে। গাল দুটো ব্রজের মতো, তাতে দুটো-চারটে রক্তরাঙা ফুশকুড়ি বেরিয়েছে। পুরু ওষ্ঠাধর, তাতে নিচের ঠোঁটটা একটু ঝুলেই এসেছে, আর সেই আধখোলা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দেখা গেছে শক্ত দু-পাটি দাঁত, হলদেটে। চোখদুটো গভীরভাবে কোটরে বসানো, তাদের ওপর ঝোপের মতো ভুরু। মানুষটিকে দেখেই মনে হয় নেহাৎ হেজিপেঁজি সাধারণ লোক নয়, বরং দুর্ধর্ষ, প্রচণ্ড, বলীয়ান।
মহামহিমের পরনে ছাইরঙের শিকারের পোশাক, যোধপুরী, হাঁটু অব্দি ওঠা বুটজুতো, আঁটো উর্দি-সব নোংরা, কতরকম যে দাগে ভর্তি। টেবিলের ওপর একটা মস্ত পশমের টুপি, তার পাশে প’ড়ে আছে তার ডানহাতটি, সবসময়েই কাঁপছে।
আড়চোখে একবার তাকিয়ে ডাক্তার শাতোনে সেই কাঁপা হাতটার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। আমি বুঝতে পেরেছি তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন : এ হাত নেশাখোরের হাত, মোদোমাতালের হাত।
কিছুক্ষণ ধ’রে এই পরাক্রম ব্যক্তিত্ব কেবল চুপচাপ আমাদের দিকে তাকিয়েই থেকেছে। একজনের পর একজনের ওপর সে বুলিয়ে গেছে নজর, যেন আমাদের ভেতরটাকে সে প’ড়ে ফেলতে চেয়েছে। আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার নেকনজর কাকে কী করে, তা-ই দেখবার জন্যে অপেক্ষা ক’রে থেকেছি।
‘ওরা যে আমাকে বললে সবশুদ্ধু ছ-জন আছেন আপনারা,’ অবশেষে সে ফরাশিতেই বলেছে, তবে তাতে জোরালো ইংরেজি ঝোঁক, গলার স্বর রুক্ষ গমগমে। ‘আমি তো মাত্র পাঁচজনকেই দেখতে পাচ্ছি। কেন?’
আমাদের একজন বেশ-অসুস্থ,’ ডাক্তার শাতোনে উত্তর দিয়েছেন, ‘আপনার লোকজনের হামলাতেই ঘায়েল হ’য়ে গেছে বেচারা!’
আবারও একটুক্ষণের জন্যে স্তব্ধতা নেমে এসেছে ঘরে, তারপরেই আমাদের প্রশ্নকর্তা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দুম ক’রে জিগেস করেছে : ‘আপনারা আমার দেশে এসেছেন কেন?’
প্রশ্নটা এমন অপ্রত্যাশিত যে অবস্থার গাম্ভীর্য সত্ত্বেও আমাদের হাসি পেয়ে গিয়েছে। হুম! তার দেশে এসেছি আমরা! সে তো আমাদের প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেই।
সে কঠোর চোখে তাকিয়ে বলেছে : ‘গোয়েন্দাগিরি করতে নিশ্চয়ই!’
‘ক্ষমা করবেন…’ বলবার চেষ্টা করেছেন মঁসিয় বারজাক
কিন্তু অন্যজন তাঁকে বাধা দিয়েছে। প্রচণ্ড জোরে টেবিলে একটা চাপড় মেরে সে ব’লে উঠেছে, বজ্রের মতো সুরে : ‘লোকে আমাকে প্রভু বলে, সর্বেসর্বা!
মর্সিয় বারজাক তারপর চমৎকার কীর্তি স্থাপন করেছেন। এমন বেকায়দায় প’ড়ে-যাওয়া সত্ত্বেও তিনি তো বক্তৃতাবাজই আসলে। তিনি সটান খাড়া হ’য়ে দাঁড়িয়েছেন, বাঁ-হাতটা বুকে চেপে ধরে ডান-হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘সতেরোশো ঊননব্বুই-এর পর থেকে ফরাশিদের কোনো প্রভু নেই কোথাও!’ অন্য-কোথাও কেউ এ-রকম কোনো কথা বললে হো-হো হাসির রোল উঠতো কিন্তু এখানে এই বন্য খ্যাপা মানুষটার সামনে এই কথার তাৎপর্যটা অন্যরকম হ’য়ে উঠেছিলো, নিছক অতিনাটুকেপনা আর থাকেনি।
শুনে, হ্যারি কিলার তার কাঁধ ঝাঁকিয়েছে শুধু, পরম তাচ্ছিল্যে। তারপর আবার সে পর-পর আমাদের ওপর পা থেকে মাথা পর্যন্ত তার চোখ বুলিয়েছে, যেন হঠাৎ এই-প্রথম আমাদের সে চোখে দেখছে। তারপর মঁসিয় বারজাকের ওপর থমকে থেকেছে তার চোখ। তার ঐ জ্বলন্ত রুষ্টদৃষ্টির সামনে মঁসিয় বারজাক কিন্তু একটুও কুঁকড়ে যাননি। মিদির এই সাংসদ নিছক বক্তৃতাবাজই শুধু নন, মানুষটির বেশ সাহসও আছে। আমাদের এই মিশনের নেতার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে।
হ্যারি কিলার অনেক কষ্টে দমন করেছে নিজেকে : হররোজ নিশ্চয়ই এমন ক’রে সে আত্মসংবরণ করে না। তারপর যেমন ক্রুদ্ধস্বরে সে আচমকা গ’র্জে উঠেছিলো, তেমনি আচমকা গলার স্বর নামিয়ে এসে শান্ত গলায় জিগেস করেছে : ‘আপনি ইংরেজি জানেন?’
‘হ্যাঁ,’ উত্তর দিয়েছেন মঁসিয় বারজাক।
‘আর আপনার সহচররা?’
‘তাঁরাও জানেন।’
‘বেশ,’ তারপর একটু জড়ানো নিচুগলায় সে ইংরেজিতেই আবার পুরোনো প্রশ্নটা তুলেছে। ‘আপনারা আমার এ-দেশে এসেছেন কেন?’
উত্তরটা তো স্বতঃসিদ্ধই! ‘এ-প্রশ্নটা ঘুরিয়ে আপনাকেই আমাদের করবার কথা, বলেছেন মঁসিয় বারজাক, ‘আমরাই উলটে জানতে চাচ্ছি, আপনি আমাদের জোর ক’রে এ-রকমভাবে আটকে রেখেছেন কেন?’
‘কেননা আমি আপনাদের বাগে পেয়েছি,’ চড়াগলায় প্রায় ধমকেই উঠেছে হ্যারি কিলার, আবার যেন পারা চ’ড়ে গিয়েছে তার মেজাজের, ‘আমি যতদিন বেঁচে আছি, আমার সাম্রাজ্যের ধারে-কাছে কারু আসার কোনো অধিকার নেই!’
তার সাম্রাজ্য?… কী বলতে চাচ্ছে এই উন্মাদ?
হ্যারি কিলার প্রায় লাফিয়ে উঠেছে এবার। টেবিলে প্রচণ্ড-জোরে একটা ঘুষি মেরে মঁসিয় বারজাককে লক্ষ্য ক’রেই সে ব’লে উঠেছে : ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, আমি ভালো ক’রেই জানি আপনার দেশের লোকেরা টিমবাটু অব্দি পৌঁছেছে, আর নাইজারের তীর ধ’রে ক্রমেই আরো-ভেতরে ঢুকে পড়বার চেষ্টা করছে, কিন্তু তারা যদি এখনও থেমে যায়, তবেই তাদের মঙ্গল। যদি না-থামে… আর এখন কিনা তাদের ধৃষ্টতা এতটাই বেড়ে গিয়েছে ডাঙা দিয়েও লোক পাঠিয়েছে গোয়েন্দাগিরি করবার জন্যে!.. আমি চুরমার ক’রে দেবো এদের, এই গোয়েন্দাদের-ঠিক যেমন ক’রে এই গেলাশটা আমি চুরমার ক’রে ভাঙছি!’
যেমন কথা, তেমন কাজ! ব’লেই সে ছুঁড়ে মেরেছে গেলাশটা মেঝেয়-আর সেটা চুরমার হ’য়ে ভেঙে গেছে মেঝেয়।
তারপরেই সে দরজার দিকে ফিরে গর্জন ক’রে উঠেছে : ‘আরেকটা গেলাশ! প্রচণ্ড-রোষে ক্ষিপ্ত, আক্ষরিকভাবেই খেপে-উন্মাদ, তার মুখের কষ বেয়ে ফেনা বেরিয়ে এসেছে। উঁহু, মোটেই তাকে ভালো দেখাচ্ছে না এখন। তার উগ্র-বেরিয়ে- আসা চোয়ালটার জন্য তাকে এখন একটা বুনোজন্তুর মতোই দেখাচ্ছে।
ব্ল্যাকগার্ডদের একজন তক্ষুনি এসে তার হুকুম তামিল করেছে। তার দিকে দৃপাত না-ক’রেই এই ভূতে পাওয়া মানুষটা টেবিলের গায়ে হেলান দিয়ে, দাঁড়িয়ে মঁসিয় বারজাকের দিকে তাকিয়ে চীৎকার ক’রে উঠেছে :
আর আমি কি আপনাদের অনেকবারই সাবধান ক’রে দিইনি?… সেই দুংকোনোর গল্পটা, আপনাদেরই সুবিধের জন্যে আমি সেটা ছড়িয়েছিলাম-সেটাই ছিলো প্রথম ইঙ্গিত। আমি আপনাদের পথে সেই গণৎকারকে রেখেছিলাম—তার সব ভবিষ্যদ্বাণী যে ফ’লে গিয়েছে সে জন্যে আপনারা নিজেরাই দায়ী। আমিই পাঠিয়েছিলুম আমার গোলাম মোরিলিরেকে, যাতে সিকাসোতে আপনাদের থামিয়ে দেবার জন্যে একটা শেষচেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হয়নি। মিথ্যেই আমি আপনাদের রক্ষিদলকে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছি, মিথ্যেই আমি আপনাদের অনাহারে মারবার চেষ্টা করেছি…উঁহু, কিছুতেই কোনো ফল হয়নি, গোঁয়ার্তুমি ক’রে আপনারা তবু নাইজারের দিকে এগিয়েছেন….বেশ, নাইজারে এখন তো পৌঁছে গেছেন আপনারা, এমনকী নাইজার আপনারা পেরিয়েও গিয়েছেন। যা জানতে চেয়েছিলেন, সব জেনে-ফেলেছেন তো এবার…আর তার সঙ্গে ফাউ পেয়েছেন আরো-অনেককিছু, না-চাইতেও! তা এবার এ-সব খবর আপনাদের কর্তাদের কাছে জানাবেন কী ক’রে আপনারা?’
তার খ্যাপা রোষে প্রায় জ্ঞানশূন্য হ’য়েই হ্যারি কিলার পায়চারি করতে শুরু ক’রে দিয়েছে ঘরে। লোকটা উম্মাদ, সে-বিষয়ে আমার অন্তত কোনো সন্দেহ নেই। তারপর আবার হঠাৎ সে থমকে দাঁড়িয়েছে, সম্ভবত নতুন-কোনো কথা তার মাথায় খেলে গিয়েছে; ঠাণ্ডাগলায় মঁসিয় বারজাককে জিগেস করেছে : ‘কিন্তু আপনারা কি আসলে সায়ীর দিকে যেতে চাননি? ‘
‘হ্যাঁ, উত্তর দিয়েছেন মঁসিয় বারজাক।
‘তাহ’লে হঠাৎ অন্যদিকে গিয়েছিলেন কেন? কুবোতে গিয়ে কী করবেন ব’লে ভেবেছিলেন?’
হ্যারি কিলার প্রশ্নটা ক’রেই তার ঐ মর্মভেদী দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়েছে। আমরা একটু আড়ষ্টভাবে গুটিয়ে গিয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়েছি। এ-প্রশ্নটা ভারি- বিপজ্জনক, যেহেতু আমরা আগেই ঠিক ক’রে নিয়েছিলুম যে মিস রেজনের সত্যিকার পরিচয় আমরা কাউকে দেবো না। সৌভাগ্যবশত মঁসিয় বারজাক একটা সম্ভাব্য কৈফিয়ৎ খাড়া করতে পেরেছেন। ‘আমাদের রক্ষীরা আমাদের ছেড়ে চ’লে যাবার পর আমরা টিমবাকটুর দিকেই যেতে চাচ্ছিলুম।’
‘কেন? সিকাসোতে নয় কেন? সেটা তো খুব-দূরে ছিলো না?’
‘আমরা শুধু ভেবেছিলুম টিমবাকটু গেলেই আমাদের বেশি সুবিধে হবে।’
‘হুম!’ হ্যারি কিলারের স্বরে দ্বিধা আর সন্দেহ। ‘তাহ’লে আপনারা পুবদিক ধ’রে নাইজারে যেতে চাননি?’
‘না,’ মঁসিয় বারজাক তাকে আশ্বস্ত করেছেন।
‘সেটা যদি আমি অনুমান করতে পারতাম,’ হ্যারি কিলার আমাদের জানিয়েছে, ‘তাহ’লে এখন আর এখানে আপনাদের টেনে আনতে হ’তো না!’
কী নির্মম ঠাট্টা! যেন সে কোনোদিন আমাদের কাছে কথাটা জানতে চেয়েছিলো! এই পরিহাসবিজল্পনার পর যে-স্তব্ধতাটা নেমে এসেছিলো, তার মধ্যেই আমি আমার কৌতূহল মেটাবার জন্যে কতগুলো প্রশ্ন করবার সাহস সঞ্চয় ক’রে নিয়েছিলুম। আমি মানুষটা আবার একটু যুক্তিটুক্তির পক্ষপাতী—যা-ই আমার যুক্তিসংগত মনে হয় না, তা-ই কেমন যেন অগোছালো লাগে আমার। আর একটা তথ্য আমার ভারি বেখাপ্পা লাগছিলো, কেমন যেন বেমানান। তাই আমি একটু সাহস সঞ্চয় ক’রে জিগেস করেছি :
‘মাফ করবেন,’ খুব নরমসুরে মোলায়েম ক’রে বলেছি, ‘আপনি তো আমাদের খতম ক’রে দিতেই পারতেন—তার বদলে হঠাৎ এমন ক’রে আমাদের ধ’রে এনেছেন কেন এখানে? আপনার কাপ্তেন এডওয়ার্ড রুফাস ও তার সহচরদের তো যথেষ্ট সুযোগ ছিলো-আমরা তো তাদের অবিশ্বাস করবার কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। সেটাই তো আমাদের-ধরাধাম থেকে মুছে দেবার পক্ষে ভালো হ’তো!’
হ্যারি কিলার ভুরু কুঁচকে অপরিসীম তাচ্ছিল্যভরে আমার দিকে তাকিয়েছে। কে বটে এই পিগমি, যে তার সঙ্গে কথা বলবার স্পর্ধা রাখে! তবু সে কৃপা ক’রে আমায় বলেছে : ‘ফরাশি কর্তৃপক্ষ যাতে অহেতুক তদন্ত করতে সেনাবাহিনী না-পাঠায়। তারা নিশ্চয়ই বেজায় অস্থির হ’য়ে পড়তো, যদি হঠাৎ তাদের কোনো মিশন অমনভাবে কোনো চিহ্ন না-রেখেই মুছে যেতো!’
অংশত মেনে নিয়েছি উত্তরটা, কিন্তু পুরোপুরি সন্তুষ্ট হ’তে পারিনি। তাই একটু আপত্তি তুলেছি, সবিনয়ে : ‘কিন্তু আমরা যদি হঠাৎ গুম হ’য়েই যাই, তাতেও তো ঐ একই প্রতিক্রিয়া হবে!’
‘তা ঠিক,’ হ্যারি কিলার এতক্ষণে একটু কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিয়েছে। ‘সেইজন্যেই আমি চেয়েছিলাম আপনারা যাতে সফরের পরিকল্পনাটাই বাতিল করে দেন। শুধু আপনাদের এই অবুঝ গোঁয়ার্তুমিই আপনাদের এভাবে ধ’রে আনতে বাধ্য করেছে আমায়।’
সে যেহেতু একটু সুযোগ দিয়েছ আমায়, আমি সেটা অমনি সজোরে আঁকড়ে ধরেছি। ‘তাহ’লে তো চমৎকার একটা বোঝাপড়া ক’রে ফেলা যায়। আপনি নিশ্চয়ই এখন বুঝতে পেরেছেন যে আমরা বাস্তবিকই নাইজারের দিকে যেতে চাই না—আপনাকে শুধু আবার আমাদের ওখানটায় পৌঁছে দিতে হবে, ঐ কুবোর কাছে, তাহ’লেই কোথাও কেউ কোনো প্রশ্ন তুলবে না…’
‘যাতে গিয়ে পরমানন্দে ইওরোপে খবরটা ছড়িয়ে দেয়া যায় এখানে আপনারা কী দেখেছেন? যাতে কেউ যার নামও শোনেনি, সেই শহরটার কথা সবাই জেনে যায়?’ হ্যারি কিলার হঠাৎ আবার চ’টে গিয়েছে। উঁহু, এখন বড্ড-দেরি হ’য়ে গেছে। যেই একবার ব্ল্যাকল্যান্ডে ঢুকেছে তারই আর-কোনোদিন এখান থেকে বেরিয়ে-যাওয়া হবে না।’
গলাটাকে অত কষ্ট দিচ্ছে কেন লোকটা? আমি তার এই ঝড়তুফানে ক্রমেই অভ্যস্ত হ’য়ে উঠছি। ফলে তার তর্জনগর্জনকে কোনো পাত্তা না-দিয়েই আবার বলেছি : ‘কিন্তু তদন্ত তো একটা হবেই!’
‘হবে নিশ্চয়ই,’ আবার তার মেজাজের পারা নেমে গিয়েছে, ‘কিন্তু আমার অবস্থা আগের চাইতেও আরো-ভালো হ’য়ে যাবে। যদি আমার কথা সবাই জেনে ফ্যালে, যদি আমাকে লড়তে হয়, তবে আপনাদের মৃতদেহগুলোর চাইতেও একটা ভালো জিনিশ থাকবে আমার দখলে।’
‘সেটা কী?’
‘জমানত। আপনারাই আমার কাছে জামানত হ’য়ে থাকবেন।
হ্যাঁ, সেটা খুবই জোরালো সুবিধে হবে তার। এ-লোকটা মোটেই বোকা নয়। সে জানে কীসে কী হয়। কিন্তু তাকে প্রশ্ন ক’রে আমিও ঠিকই করছি, বোঝাই তো যাচ্ছে এখন খামকা আমাদের প্রাণে মেরে ফেলবার কোনো মলব তার নেই। অনন্ত এ-তথ্যটা জানা সবসময়েই মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো।
হ্যারি কিলার আবার গিয়ে টেবিলের ওপাশে তার আরামকেদারাটায় ব’সে পড়েছে। দিব্বি শান্ত, সুবোধ, নিজের মেজাজটা এখন পুরোপুরি আয়ত্তে।
‘একটা জিনিশ স্পষ্ট হয়ে যাক,’ এবার নতুন-একটা হিমশীতল স্বরে সে বলেছে, ‘আপনারা এখন ব্ল্যাকল্যান্ডে আছেন, এবং আপনরা কোনোদিন এখান থেকে আর এক পাও বেরুতে পারবেন না, একজনও না। কী ধরনের জীবন যাপন করতে চান, সেটা পুরোপুরি আপনাদের ওপরই নির্ভর করবে। আমাকে কারু কাছেই কৈফিয়ৎ দেবার কিছু নেই। আমি আপনাদের বন্দী ক’রেও রাখতে পারি, আবার খতম ক’রেও দিতে পারি। যা ইচ্ছে হবে, তা-ই করতে পারি। আবার আমি এখানে যে-রকম ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে পারি, সেই অধিকারও আপনাদের দিয়ে দিতে পারি—অবশ্যই আমার এই সাম্রাজ্যের ভেতরেই এই অবাধ চলাফেরার সুযোগ আপনারা পাবেন।
আবার ঐ সাম্রাজ্যের কথা!
‘সেটা নির্ভর করবে, আপনাদেরই নিজেদের ওপর, আপনারা কী চান,’ আবার মঁসিয় বারজাককে লক্ষ্য ক’রে সে বলেছে। ‘হয় আপনারা জামানত হিশেবে এখানে থাকবেন, নয়তো…’
সে এমন-একটা ভঙ্গিতে তাকিয়েছে যে আমার মতোই মঁসিয় বারজাকও ভারি অবাক হ’য়ে গেছেন। জামানত ছাড়া আর কী-ই বা তবে হ’তে পারি আমরা? ‘অথবা আমার সহযোগী হ’য়ে উঠতে পারেন,’ ঠাণ্ডাগলায় বলেছে হ্যারি কিলার।
এই প্রস্তাব যে আমাদের বিস্মিত ক’রে দিয়েছিলো, এটা বললে কমিয়েই বলা হবে। আমরা যেন বজ্রাহতের মতো তাকিয়ে থেকেছি।
সে কিন্তু তেমনি ঠাণ্ডাস্বরে ব’লেই চলেছে’: ‘এটা ভাববেন না যে ফরাশি সেনাবাহিনীর ভাবগতিক বা অগ্রগতি সম্বন্ধে আমি কোনো খবর রাখি না। তারা যদি আমার অস্তিত্বের কথা এখনও না-জানে, তবে অদূর-ভবিষ্যতে কোনোদিন মোক্ষমভাবেই তার কথা জেনে যাবে। তখন হয় তার সঙ্গে আমার লড়াই করতে হবে, নয়তো আপোষ রফা নিয়ে দরাদরি করতে হবে। এটা ভাববেন না যে যুদ্ধ করতে আমি ভয় পাই।, নিজেকে রক্ষা করবার সব উপায়ই আমার আছে। কিন্তু যুদ্ধ তো আর একমাত্র সমাধান নয়। নাইজার নদীর বাঁকে উপনিবেশ স্থাপন করতে হ’লে ফরাশি বাহিনীকে এখনও অনেকদিনই ব্যতিব্যস্ত থাকতে হবে। পুবদিকে আরো এগিয়ে মরুভূমির দিকে যদি আসতে চায় আমার সঙ্গে তাদের যুদ্ধ অনিবার্য। কী লাভ এই ধূ-ধূ বালি দখল করবার চেষ্টা ক’রে, যদি তার জন্যে তাদের বেমক্কা বিচ্ছিরিভাবে হার স্বীকার ক’রে নিতে হয়? মরুভূমিটা তাদের কোনো কাজে লাগবে না, কিন্তু আমি তাতে সোনা ফলাতে পারবো। ঠিকমতো আলোচনা করলে আমাদের মধ্যে বরং একটা মৈত্রীই হ’তে পারে।’
লোকটা দেখছি অনেককিছুই ধ’রে নিয়েছে, যেন সে যা ভাবছে তার আর কোনো অন্যথা নেই। তার সর্বাঙ্গ থেকে দম্ভ চুঁইয়ে পড়ছে। এই ঘৃণিত স্বৈরাচারীর সঙ্গে ফরাশি সরকার কি কোনো আলোচনাসভায় বসতে রাজি হবে?
‘মৈত্রী? আপনার সঙ্গে!’ মঁসিয় বারজাক বিস্ময়ধ্বনি ক’রে উঠেছেন। আর ঐ কথাতেই আমাদের সবাইকার মনোভাবই ব্যক্ত হ’য়ে গেছে।
কিন্তু তুফান তোলবার জন্যে ঐ প্রশ্নটাই যথেষ্ট। সত্যি, তার ঠাণ্ডা মেজাজটা বড্ড-বেশিক্ষণই টিকেছে। বড্ড-একঘেয়ে হ’য়ে উঠছে এই শান্ত মেজাজ।
‘ভাবছেন যে আমি আদৌ তার যোগ্য নই?’ গর্জন ক’রে উঠেছে হ্যারি কিলার। ধ্বক ক’রে জ্ব’লে উঠেছে তার রক্ষচক্ষু, আবার সে নিরীহ টেবিলটার ওপর সজোরে ঘুষি কষিয়েছে। ‘না কি ভাবছেন যে এখান থেকে পালাতে পারবেন? আমার ক্ষমতা তাহ’লে আপনারা টের পাননি!
সে উঠে প’ড়ে হুমকি দিয়েছে : ‘বেশ। শিগগিরই তা জানতে পারেন।
তার ডাকে পাহারারা ঢুকে পড়েছে ঘরের মধ্যে। তারা পাকড়ে ধরেছে আমাদের, হিড়হিড় ক’রে টেনে নিয়ে গেছে সবাইকে। অন্তহীন সিঁড়ির ধাপ বেয়ে তারপর আমরা উঠেছি কেবল, তারপরে মস্ত-একটা অলিন্দ দিয়ে টেনে নিয়ে গেছে তারা আমাদের, তারপর আরো পইঠার পর পইঠা—সিঁড়ি। শেষটায় আমরা মিনারটার প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছি, আর পরক্ষণেই হ্যারি কিলারও এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
লোকটা অবিশ্রাম ঢেউয়ের মতো উঠছে নামছে। মাঝামাঝি-কিছুই নেই তার কাছে। একবার তপ্ত রোষে গর্জাচ্ছে তো পরক্ষণেই হিমজমাট হয়ে এসেছে স্বর। আপাতত তার-শেষ চোটপাটের কোনো হিহ্নই নেই তার ব্যবহারে।
‘এখানে চল্লিশ গজ ওপরে এসে আপনারা দাঁড়িয়েছেন,’ যেন কোনো ওস্তাদ গাইড দ্রষ্টব্যস্থান সম্বন্ধে মোলায়েম মন্তব্য করছে। ‘তার মানে দিগচক্রবাল প্রায় পনেরো মাইল দূরে এখান থেকে। যদ্দূর অব্দি চোখ যাবে দেখতে পাবেন মরুভূমির বদলে এখানে উর্বর একটা দেশ গজিয়ে উঠেছে। যে-সাম্রাজ্য আমি শাসন করি, তা ছশো বর্গমাইলের চেয়েও বেশি। না, না, ছশো কেন, বারোশোই হবে। আর এ-কাজটা আমরা হাঁশিল করেছি মাত্র দশ বৎসরে।’
হ্যারি কিলার একটু থেমে গিয়ে আমাদের অভিভূতবিস্ময় দেখে পরম সন্তোষ লাভ করেছে। যদি কেউ এই বারোশো বর্গ মাইলের মধ্যে পা দেবার চেষ্টা করে, আমি তাহ’লে তক্ষুনি মরুভূমিতে যে-তিনটে পাহারাবিতান বানিয়েছি সেখান থেকে খবর পেয়ে যাবো –টেলিফোনে—’
তাহ’লে সেদিন যে মরুদ্যান আর সারি-সারি খুঁটি দেখেছিলুম, তার অর্থটা এই? কিন্তু আপাতত বরং হ্যারি কিলারকেই শোনা যাক। সে আমাদের একটা আতশকাচে তৈরি মস্ত লণ্ঠন দেখাচ্ছে, অনেকটা কোনো বাতিঘরের লণ্ঠনেরই মতো। প্ল্যাটফর্মের ঠিক মাঝখানে একটা থামের ওপর সেটা বসানো।
তাও যদি যথেষ্ট না-হয়, তবু কেউ আমার অনুমতি বিনা এখানে ঢুকতে পারবে না। ব্ল্যাকল্যান্ডের দেয়ালের বাইরে পাঁচ ফার্লং দূরে আধমাইল চওড়া একটা সুরক্ষা অঞ্চল আছে—সারারাত জোরালো বাতি থেকে সন্ধানী আলো পড়ে সেখানে। এই বাতিটা কোনো চোখের মতো, সেইজন্যে আমি এই যন্ত্রকে সাইক্লোস্কোপ বলি, সেটা সরাসরি নিচে ঐ সুরক্ষা অঞ্চলের দিকে তাকায়, আর প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি ধরা প’ড়ে যায় তার চোখে –আতশকাচের মারফৎ, অনেকগুণ-বড়ো হ’য়ে। আসুন, এই সাইক্লোস্কোপের মধ্য দিয়ে তাকান-আমি আপনাদের অনুমতি দিচ্ছি—নিজেরাই তারপর বিচার ক’রে দেখুন।’
আমাদের কৌতূহল এতটাই উশকে উঠেছিলো যে আমরা সবাই এক-এক ক’রে তখন সাইক্লোস্কোপের পরকলা দিয়ে তাকিয়েছি : সোজাসুজি ঢুকে পড়েছি ঐ অতিকায় লণ্ঠনটার মধ্যে আর বিশাল-একটা পরকলার মধ্য দিয়ে তাকিয়েছি আমরা। ঐ লণ্ঠনের মধ্যে ঢোকবামাত্র বাইরের পৃথিবীটা অমূল বদলে গিয়েছে। যেদিকেই তাকিয়েছি, গোড়ায় একটা সটান-খাড়া দেয়াল ছাড়া আর-কিছুই চোখে পড়েনি- বড়ো-বড়ো শিক লাগানো কতগুলো চৌকো-চৌকো খোপে এই দেয়ালটা ভাগ করা।
দেয়ালটার ভিৎ ছায়ায় ঢাকা, কিন্তু তার ওপরটা মনে হয়েছে বিশাল-ওপর থেকে আমাদের মতো ক্ষুদ্র মনুষ্যের দিকে তাকিয়ে আছে-আর সেখানটা দুধশাদা আলোয় মাখামাখি। তারপরেই আস্তে-আস্তে টের পেয়েছি তার রং সবজায়গায় এরকম নয় মোটেই এবং যেন অগুনতি ভিন্ন-ভিন্ন শাদার রেশ, অস্পষ্ট-সব ঝাপসা রেখা। একটু মনোযোগ দিতেই বুঝতে পেরেছি ওগুলো সব হয় গাছপালা, নয়তো মাঠঘাট বা রাস্তা –সড়ক। কোথাও-বা দেখেছি মাঠে লোক খাটছে। সব আতশকাচের মধ্য দিয়ে এতটাই বড়ো হ’য়ে চোখের পটে পড়েছে যে, একটু পরে তাদের শনাক্ত করতে মোটেই অসুবিধে হয়নি!
‘ঐ নিগ্রোদের দেখতে পাচ্ছেন?’ হ্যারি কিলার জিগেস করেছে আমাদের। ‘ধরুন, যদি তারা কখনও পালাবার কথা ভাবে, তবুও বেশি দূরে যেতে পারবে না।’ ব’লেই সে তুলে নিয়েছে টেলিফোনের রীসিভার। বলেছে, ‘একশো এগারো নম্বর বৃত্ত। পনেরোশো আটাশ ব্যাসার্ধ।’ তারপর আরেকটা টেলিফোনে তুলে বলেছে : ‘চোদ্দ নম্বর বৃত্ত। পনেরোশো দুই ব্যাসার্ধ।’ তারপর আমাদের দিকে ঘুরে বলেছে : ‘এবারে ভালো ক’রে তাকিয়ে দেখুন।’
গোড়ায় কয়েক মিনিট কিছু দেখা যায়নি, তারপর ঐ ঝাপসা জায়গা আরো- অস্পষ্ট হ’য়ে গেছে ধোঁয়ায়। ধোঁয়া স’রে যেতেই দেখেছি, যেখানে ঐ ঝাপসা রেখাটা একটু আগেও ছিলো সেটা আর নেই।
‘যে-লোকটা ওখানে কাজ করেছিলো, তার কী হ’লো?’ মাদমোয়াজেল মোরনাসের গল। আবেগে কেঁপে উঠেছে!
‘সে মারা গেছে,’ ঠাণ্ডাগলায় জানিয়েছে হ্যারি কিলার।
‘মারা গেছে!..’ আমরা আঁৎকে উঠেছি : ‘অকারণে একটা লোককে এমনভাবে মেরে ফেললেন!’
‘ও নিয়ে ভাববেন না-ও-তো নেহাৎই এক নিগ্রো!’ অত্যন্ত সরলভাবেই বলেছে হ্যারি কিলার। তুচ্ছ আবর্জনা বৈ আর-কিছু না। একটা গেলে আরো অনেক কটা মিলবে। ও-লোকটা একটা উড়াল টরপেডোর ঘারে উড়ে গেছে। একটা হাউহই আসলে, রকেট, পনেরো মাইল তার পাল্লা। আর দেখেছেন তার গতি আর নিখুঁত লক্ষ্যভেদের ক্ষমতা!’
তার এই ব্যাখ্যা শুনেছি, আর লোকটার নিষ্ঠুরতায় শিউরে উঠেছি। পরক্ষণেই ঐ শাদা দেয়ালের গা বেয়ে আরো একটা উল্কাপিণ্ডের মতো কিছু ছুটে গিয়েছে— আর দ্বিতীয় ঝাপসা রেখাটাও মুছে গেছে।
‘ও-লোকটার কী হ’লো,’ মাদমোয়াজেল মোরনাসের গলা দিয়ে যেন স্বরই বেরুতে চাচ্ছিলো না। ‘সেও কি ম’রে গেছে?’
‘না। ও-লোকটা বেঁচে আছে। সবুর, এক্ষুনি তাকে দেখতে পাবেন।’
বলে সে লণ্ঠনঘর বা সাইক্লোস্কোপ থেকে বেরিয়ে গেছে, আর পাহারারাও আমাদের টেনে বের ক’রে দিয়েছে সেখান থেকে। আবার আমরা এসে মিনারের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছি। আর অমনি দেখতে পেয়েছি, উল্কার বেগে একটা বিমান এদিকে ধেয়ে আসছে। তার তলা থেকে কী যেন ঝুলছে শূন্যে।
‘এই-যে দেখুন, হেলিবিমান,’ এইভাবে হ্যারি কিলার তার আকাশযানের নামটা ফাঁস করেছে আমাদের কাছে। ‘এক মিনিটের মধ্যেই টের পেয়ে যাবেন আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ এখানে ঢুকতে অথবা এখান থেকে বেরুতে পারে কি না।’
হেলিবিমানটা, সত্যি, তীব্রগতিতে কাছে এগিয়ে এসেছে। আর আমরা শিউরে উঠে আবিষ্কার করেছি, তার তলায় শূন্যে যা ঝুলছে- সে এক নিগ্রো; তাকে বিমান থেকে যেন একটা চিমটে বেরিয়ে গিয়ে আঁকড়ে ধরে রেখেছে।
হেলিবিমানটা আরো-কাছে এসে পড়েছে, একেবারে আমাদের প্ল্যাটফর্মের ওপর। আর, বীভৎস…
চিমটে আলগা হ’য়ে গিয়েছে, সাঁড়াশির বাঁধন থেকে নিচে থুবড়ে পড়েছে ঐ নিগ্রো, তার দেহটা একেবারে থেঁৎলে গিয়েছে। ঠিক আমাদের পায়ের কাছে। আমাদের গায়ে ফিনকি দিয়ে ছিটকে এসে পড়েছে তার রক্ত।
ধিক্কারে আমরা চীৎকার ক’রে উঠেছি! কিন্তু মাদমোয়াজেল মোর্নাস শুধু চীৎকার ক’রেই ক্ষান্ত হননি, তাঁর চোখ জ্বলন্ত, মুখটা বিবর্ণ, ঠোট রক্তশূন্য—তিনি আচমকা পাহারাকে ঠেলে সরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন হ্যারি কিলারের ওপর।
‘খল! কাপুরুষ!…খুনে! তার মুখের ওপর চেঁচিয়ে বলেছেন তিনি, আর ছোটো হাত দুটি দিয়ে তার টুটি ধরেছেন।
সে অনায়াসেই একটা মাছি তাড়াবার ভঙ্গি ক’রে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে। আমরা এই মাথাগরম তরুণীর ইন্তেকাল এসেছে ভেবে আঁৎকে উঠেছি। কিন্তু কিছুই করবার উপায় ছিলো না আমাদের : পাহারারা আমাদের ততক্ষণে সজোরে জাপটে ধরেছে।
সৌভাগ্য বলতে হবে, এই স্বৈরাচারী একনায়ক আপাতত অন্তত এই তরুণীকে সাজা দেবার কথা ভাবেনি, শুধু দুজন শাস্ত্রী তাঁকে হিড়হিড় ক’রে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেছে। হ্যারি কিলারের মুখটা যদিও নিষ্ঠুর-শ্লেষে বেঁকানো, তার চোখে কেমন- একটা উল্লাসের দৃষ্টি। সে স্থিরভাবে তরুণীর দিকে তাকিয়ে বলেছে : ‘হুম! হুম! এর দেখছি সাহস আছে-ডরায় না যে!’ তারপর পা দিয়ে নিগ্রোটির থ্যাৎলানো দেহটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলেছে : ‘অত তুচ্ছ ব্যাপারে মাথাগরম করতে নেই, খুকি!’
সে মিনার থেকে নেমে গিয়েছে তারপরে, আমাদেরও পাহারা হিড়হিড় ক’রে টেনে নিয়ে গেছে পেছন-পেছন। আবার আমরা এসে পড়েছি হ্যারি কিলারের খাশ কামরাটায় – যেটা চমৎকারভাবে শুধু-একটা টেবিল আর শুধু-একটা আরামকেদারা দিয়েই সাজানো। হ্যারি কিলার তার মসনদে ব’সে প’ড়ে আমাদের দিকে তাকিয়েছে।
না, ভুল বলেছি…. শুধু একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেছে মাদমোয়াজেল মোরনাসের দিকে, আর তার ক্রূর-চোখে যেন হাসি ফুটে উঠেছে। ‘এখন আমার ক্ষমতা সম্বন্ধে একটু ধারণা হয়েছে তো? আমি শুধু এটাই দেখিয়েছি যে আমার প্রস্তাব অমন তাচ্ছিল্যভরে উড়িয়ে দেবার মতো নয়। এই-শেষবার আবারও প্রস্তাবটা রাখছি। আমি শুনেছি আপনাদের মধ্যে একজন রাজনীতিক, একজন ডাক্তার, একজন সাংবাদিক এবং দুটি আস্ত গর্ধব আছে…’
আস্ত গর্ধব! মঁসিয় পঁসা আর সাঁৎ-বেরা!
‘দরকার হ’লে ঐ রাজনৈতিক নেতা ফ্রান্সের সঙ্গে আলোচনা চালাতে পারবেন। আমি ডাক্তারের জন্যে একটা হাসপাতাল তৈরি ক’রে দেবো। সাংবাদিক কাজ করতে পারবেন ব্ল্যাকল্যান্ড থান্ডারবোল্টকাগজটায়, বাকি দুজনকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় পরে ভেবে দেখবো। বাকি রইলো এই খুকি! একে আমার ভারি মনে ধরেছে… আমি একে বিয়ে করবো।’
‘এর কোনোটাই হবে,’ দৃঢ়স্বরে মঁসিয় বারজাক বলেছেন। আমাদের চোখের সামনে ওভাবে নিরীহ লোকদের খুন ক’রে ভেবেছেন আমাদের ভয় দেখাবেন? উঁহু! গায়ের জোর খাটালে অন্য কথা—কিন্তু আমরা আপনার দাক্ষিণ্য চাই না। আর মাদমোয়াজেল মোর্নাস…’
‘ওহ্, আমার ভাবী বৌয়ের নাম বুঝি মোর্নাস?’
‘আমি নিজেকে মোর্নাসই বলি বা না-ই বলি,’ রেগে, আরক্তিম, আমাদের সঙ্গিনী বলেছেন, ‘এটা জেনে রেখো তোমাকে একটা বুনোজানোয়ার ছাড়া আর- কিছুই আমি ভাবি না। ভেবেছো, তোমার ঐ ঘৃণিত, ধিকৃত প্রস্তাবে…’
হ্যারি কিলার অমনি হো-হো ক’রে হেসে উঠেছে। ‘বাঃ, চমৎকার… চমৎকার! তবে তাড়া কিছু নেই! একমাস তুমি ভেবে দেখবার সময় পাবে, খুকি
কিন্তু তারপরেই পারা আবার চ’ড়ে গেছে। উঠে প’ড়ে সে পাহারাদের ডেকে বলেছে: ‘এদের সব কটাকে নিয়ে যা।’
কিন্তু যাবার আগে মঁসিয় বারজাক হ্যারি কিলারকে জিগেস করেছেন : ‘আর একমাস পরে আমাদের নিয়ে কী করবেন?’
হাওয়া কিন্তু সত্যি পালটে গেছে। এই একনায়ক তখন আর আমাদের কথা আদপেই ভাবছে না। তার কম্পিত হাত টেবিল থেকে মদের গেলাশটা তুলে নিয়েছে। গেলাশটা মুখে তুলতে গিয়ে একটু থেমে গিয়ে বলেছে : ‘সেটা ঠিক ভেবে দেখিনি। হয়তো ফাঁসিতেই লটকাবো!’