২.০৩ শিবনারায়ণ

শিবনারায়ণ

ক্লান্তপদে বারান্দা অতিক্রম করে সুব্রত মস্তবড় একটি হলঘরে প্রবেশ করে নায়েব শিবনারায়ণের পেছনে পেছনে।

সিলিং থেকে একটি বেলোয়ারী চোদ্দ বাতির ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে, তারই মধ্যে গোটা দুই বাতি জ্বলছে। এবং দুই বাতির আলোতেই ঘরে আলোর কমতি নেই। ঘরের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে খাট পাতা,তার উপরে ধবধবে পরিষ্কার ফরাস পাতা। একধারে খানকয়েক চেয়ার ও আরাম-কেদারাও আছে। দুপাশে দুটি বড় বড় কাঠের আলমারি ও র্যাক। র্যাকে মোটা খেরো-বাঁধানো সব খাতা সাজানো। সুব্রত ফরাসের ওপরে বসে পড়ল। অত্যন্ত ক্লান্তিবোধ করছিল সে।

আগাগোড়া সাইকেলে এলেন বুঝি? শিবনারায়ণ প্রশ্ন করলেন।

সুব্রত এতক্ষণে ভাল করে ঘরের আলোয় শিবনারায়ণের মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি তুলে তাকাল। লম্বা, অত্যন্ত বলিষ্ঠ চেহারা, বয়সের অনুপাতে শরীর এখনও এত মজবুত যে মনে হয়, শরীর যেন বয়সকে প্রতারণা করে ঠেকিয়ে রেখেছে, কোনোমতেই কাছে ঘেঁষতে দেবে না।

বাঁ চোখের স্থিরদৃষ্টি দেখেই বোঝা যায়, অক্ষিগোলকটি পাথরের তৈরী, কৃত্রিম।

খুব পরিশ্রান্ত হয়েছেন নিশ্চয়ই কল্যাণবাবু, চা আনতে বলি? না হাত-মুখ ধুয়েই একেবারে চা-পান করবেন?

আগে তো এখন এক কাপ হোক, তারপর হাত-মুখ ধুয়ে না হয় আবার হবে।

বেশ। হাসতে হাসতে শিবনারায়ণ তখুনি ভৃত্যকে চা আনতে আদেশ করলেন। তারপর আবার এক সময় সুব্রতর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, মাছ-মাংস চলে তো?

তা চলে। সুব্রত হাসতে হাসতে জবাব দেয়।

ফাউলের ব্যবস্থা করেছি। আমি ব্রহ্মচারী মানুষ, দুবেলা হবিষ্যান্ন করি, তবে অতিথি-অভ্যাগতদের কখনও বঞ্চিত করি না।

জায়গাটা আমি বিশেষ করে বেড়াতেই এসেছি চৌধুরী মশাই।

তা বেড়াবার মতই জায়গা বটে, চারিদিকের দৃশ্য খুবই মনোরম। আমি তো একুশটা বছর এখানেই কাটালাম কল্যাণবাবু। জায়গাটা সত্যি বড় ভালো লাগে। একটু পরেই চাঁদ উঠবে। প্রাসাদের ছাদের ওপরে দাঁড়ালে আশপাশের পাহাড়গুলো চমৎকার দেখায়।

***

আহারাদির পর দোতলার যে ঘরটিতে সুব্রতর শয়ন ও থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল, চৌধুরী নিজে সঙ্গে করে সুব্রতকে সেই ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেলেন।

উপরের তলায় প্রায় খানপাঁচেক ঘর, তারই একটি ঘর চৌধুরী নিজে ব্যবহার করেন। এবং অন্য একটিতে অতিথি অভ্যাগত কেউ এলে তার থাকবার ব্যবস্থা হয়। বাকি ঘরগুলো প্রায় বন্ধই থাকে। তিনতলায় খান-দুই ঘর আছে, রাজাবাহাদুর এলে তখন সেই ঘর দুইটি অধিকার করেন। একতলা হতে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই সর্বপ্রথম যে ঘরটি, চৌধুরী সেটি ব্যবহার করেন। লম্বাগোছের একটি বারান্দা, সেই বারান্দাতেই ঘরগুলি পর পর। বারান্দার শেষপ্রান্তে একটি প্রশস্ত ছাদ। চারিপাশে তার উঁচু প্রাচীর দেওয়া। ছাদের দক্ষিণদিকে বহুদিনকার পুরাতন একটি শাখাপ্রশাখাবহুল সুবৃহৎ বটবৃক্ষ। অনেকগুলো ডালপালা পত্রসমেত ছাদের ওপরে এসে নুয়ে পড়েছে। বারান্দার শেষপ্রান্তে ঠিক ছাদের সামনেই যে ঘরটি, সেইটিতেই সুব্রতর থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে।

সুব্রত অত্যন্ত পরিশ্রান্ত বোধ করছিল, তথাপি নতুন জায়গায় ঘুম কোনোদিনই সহজে তার আসতে চায় না। বাড়ির পিছনদিকে মুখ করে যে খোলা জানালাটা, সুব্রত তার সামনে এসে দাঁড়াল। কাঠের কারবারের জন্য এদের গোটাতিনেক হাতী আছে, খোলা জানালাপথে সেই হাতীশালা দেখা যায়।

বাইরে অস্পষ্ট চাঁদের আলো, ঝিরঝিরে একটা হাওয়া দিচ্ছে।

রাত্রি কটা হবে? হাতঘড়ির দিকে সুব্রত তাকিয়ে দেখল, রাত্রি প্রায় বারোটা। ঠিক এমনই সময় কাছারীর পেটা ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত্রি বারোটা ঘোষণা করলে। চারিদিক নিযুতি রাতের স্তব্ধতায় যেন থমথম করছে।

সুব্রত আনমনে শিবনারায়ণ চৌধুরীর কথাই ভাবছিল। একটিমাত্র চক্ষুও যে তার কতখানি সজাগ, প্রথম দর্শনেই সুতর তা বুঝতে এতটুকুও কষ্ট হয়নি।

আচমকা এমন সময় একটা অতি সুস্পষ্ট করুণ কান্নার ধ্বনি সুব্রতর কানে এসে বাজল।

সুব্রত চমকে ওঠে, কে কাঁদে! না তার শোনবার ভুল? না, শোনবার ভুল নয়। ঐ তো কে গুমরে গুমরে কাঁদছে! সুব্রতর শ্রবণেন্দ্রিয়-দুটি অতিমাত্রায় সজাগ হয়ে ওঠে। কে কাঁদে? এই নিশীথ রাত্রির নির্জনতায় কে অমন করে গুমরে গুমরে কাঁদে? কেন কাঁদে?… ভাল করে কান পেতে শুনেও যেন ও বুঝে উঠতে পারে না, কোথা থেকে সে কান্নার শব্দ আসছে! সুব্রত ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।

খাঁ খাঁ করছে বারান্দাটা, চাঁদের ম্লান আলো এসে বারান্দার ওপরে লুটিয়ে পড়ে যেন ঘুমিয়ে আছে। কোথাও এতটুকুও সাড়াশব্দ পর্যন্ত নেই।

কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে, বড় করুণ। পা টিপে টিপে সুব্রত বারান্দা দিয়ে সোজা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। এ বাড়ির কিছুই তো সুব্রত জানে না, কোথা থেকে কান্নার শব্দ আসছে, কেমন করেই বা তাও টের পাবে? সুব্রত স্থাণুর মতই সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে একান্ত অসহায়ভাবে কান্নার শব্দ শোনে। নানা প্রকারের এলোমেলো চিন্তা মনের কোণায় এসে উঁকিঝুঁকি দেয়। এই বাড়িরই কোনো এক ঘরে অদৃশ্য আততায়ীর হাতে শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিক ও সুধীনের হতভাগ্য পিতা নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছেন একদা। এ হয়ত তাঁদেরই অদেহী অতৃপ্ত আত্মার করুণ বিলাপধ্বনি। হয়ত এমনি করেই আজও তাঁরা এই প্রায়-পরিত্যক্ত প্রাসাদের ঘরে ঘরে কেঁদে কেঁদে ফেরেন মুক্তির জন্য। এখনও হয়ত যে ঘরে রাতের নিস্তব্ধ আঁধারে অসহায় ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তার লিমলিন মেঝের ওপর রক্তধারা শুকিয়ে জমাট বেঁধে আছে।

অন্ধকারে ছাতের কার্নিশে বোধ হয় একটা ইঁদুর সরসর করে হেঁটে যায়। ছাদের ওপাশে বটবৃক্ষের পাতায় পাতায় নিশীথ হাওয়ার মর্মরধ্বনি জাগায়। কোথায় একটা রাতজাগা পাখি উ-উ করে একটা বিশ্রী শব্দ করে ডেকেই আবার থৈমে যায়। সুব্রতর সর্বাঙ্গ যেন সহসা সিরসির করে কেঁপে ওঠে।

এ যেন এক অভিশপ্ত মৃত্যুপুরী। অন্ধকারের স্তব্ধ নির্জনতায় প্রেতাত্মার দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ভাসিয়ে আনে। চারিদিকে এর মৃত্যুর হাওয়া। বিষাক্ত মৃত্যুবিষ ছড়িয়ে আছে এর প্রতিধূলিকণায়।

বিদেহী আত্মারা এর ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে যেন। কিরীটী বলেছে, রায়পুরের রাজবংশে যে মৃত্যুবীজ সংক্রামিত হয়েছে, সে বীজ প্রথম রোপিত হয়েছিল এই প্রাসাদেরই কোনো কক্ষে।

কিসের যেন একটা সম্মোহন সুব্রতকে অদৃশ্য জন্তুর মত চারপাশ হতে জড়িয়ে ফেলেছে। কার পায়ের শব্দ না? হ্যাঁ, ঐ তো পায়ের শব্দ! কে যেন কোথায় অত্যন্ত অস্থির পদে কেবলই হেঁটে হেঁটে বেড়াচ্ছে আর বেড়াচ্ছে। কান্নার ধ্বনি আর শোনা যায় না। থেমে গেছে সেই কান্নার ধ্বনি। যে কাঁদছিল সে হয়ত ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু পায়ের শব্দটা—সেটা তো এখনও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে!

***

শিবনারায়ণের ডাকে যখন সুব্রতর ঘুম ভাঙল, তখন প্রায় সকাল সাড়ে আটটা হবে। খোলা জানালাপথে অজস্র রোদ এসে ঘরের মধ্যে যেন আলোর বন্যা জাগিয়ে তুলেছে।

খুব ঘুমিয়েছে সুব্রত। এত বেলা হয়ে গেছে! গতরাত্রের দুঃস্বপ্ন আর নেই। সকালের প্রসন্ন সূর্যালোকে চারিদিক যেন শান্ত, স্নিগ্ধ।

সামনেই দাঁড়িয়ে শিবনারায়ণ চৌধুরী। কিছুক্ষণ আগে হয়ত প্রাতঃস্নান শেষ করেছেন। মাথার বড় বড় বাবরী চুল অত্যন্ত পরিপাটী করে আঁচড়ানো। পরিধানে ধবধবে একখানি সাদা ধুতি। গায়ে বেনিয়ান। পায়ে বিদ্যাসাগরী খুঁড়তোলা চটিজুতো। প্রসন্ন হাসিতে মুখখানি যেন ঝলমল করছে।

ঘুম ভাঙল কল্যাণবাবু? রাতে বুঝি ভাল ঘুম হয়নি?

না, বেশ ঘুম হয়েছিল। অনেকটা পথ সাইকেল হাঁকিয়ে একটু বেশী পরিশ্রান্তই হয়েছিলাম কিনা। আপনার তো দেখছি স্নান পর্যন্ত হয়ে গেছে!

হ্যাঁ, দিনে আমি তিনবার স্নান করি—তা কি গ্রীষ্ম, কি শীত! আমাকে এখুনি একবার কাঠের কারখানায় যেতে হবে। কয়েক হাজার মণ কাঠের চালান আজকালের মধ্যেই যাবে, তার একটা ব্যবস্থা করতে হবে ফিরতে আমার বিকেল হবে, আজকের দিনটা আপনি বিশ্রাম নিন। কাল সকাল পর্যন্ত আমি এদিককার কাজ সেরে ফেলতে পারব, তখন কাগজপত্র দেখাব, কি বলেন?

বেশ তো। ব্যস্ততার কি এমন আছে! সুব্রত বলে।

না, তবে আপনি এলেন, একা একা থাকবেনযদি ইচ্ছে করেন, আমার সঙ্গে কারখানাতেও যেতে পারেন।

সুব্রত বুঝলে এ মস্ত সুযোগ। চৌধুরীর অবর্তমানে প্রচুর সময় পাওয়া যাবে বাড়ির চারপাশটা ভাল করে একবার দেখে নিতে। সুব্রত বলে, না, এখনও ক্লান্তিটা কাটেনি, আজকের দিনটাও বিশ্রাম নেব ভাবছি। আপনি কাজে যান চৌধুরী মশাই, ঘুমিয়েই আজকের দিনটা আমি কাটিয়ে দিতে পারব। ঘুমের আশ এখনও আমার ভাল করে মেটেনি।

বেশ, তবে আমি যাই। দুঃখীরাম ও সুখন রইল, তারাই আপনার সব দেখাশোনা করবেখন। কোন কষ্ট হবে না।

চৌধুরী ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

সুব্রত আবার শয্যার ওপরে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে চোখ বুজল। অনেকটা সময় হাতের মুঠোর মধ্যে পাওয়া গেছে। যথাসম্ভব এর মধ্যেই একটা মোটামুটি দেখাশোনা করে নিতে হবে। পুরনো আমলের বাড়ি, তাছাড়া দুঃখীরামও অনেকদিনকার লোক। গতরাত্রে কয়েকবার সাধারণভাবে দেখে লোকটাকে নেহাৎ খারাপ বলে মনে হয়নি। মনে হয় যেন লোকটা একটু সরল প্রকৃতির ও বোকা-বেকাই।