২.০২ ক্রাল
দুর্ভাগা লোকটির অতর্কিত সর্পাঘাত মৃত্যু আমাদের উপর একটা গভীর ছাপ ফেলে গেলো। একে তো এ-রকম মৃত্যু মাত্রেই ভয়ংকর, তার উপর একদিক থেকে সে কিনা মরলো সার এডওয়ার্ডকে বাঁচাতে গিয়ে।
সেই কালান্তক বিষে ততক্ষণে ভারতীয়টির দেহ নীল ও শক্ত হয়ে গিয়েছিলো। অন্যরা তাড়াতাড়ি একটা কবর খুঁড়ে সেখানেই তাকে সমাহিত করলে, যাতে তার মরদেহটা অন্তত বন্য জন্তুদের ক্ষুধিত গ্রাস থেকে রক্ষা পায়।
এই মন-খারাপ-করা অনুষ্ঠানটা শেষ হয়ে যাবার পর মাতিয়াস ফান খোইতের আমন্ত্রণে আমরা তার সঙ্গেই ক্রালের উদ্দেশে চললুম।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা ফান খোইতের ক্রাল-এ গিয়ে পৌঁছলুম। মস্ত একটা চওড়া জায়গা, বেড়া দিয়ে ঘেরা; ক্রালের দরজাটা বেশ প্রশস্ত, যাতে অনায়াসেই মোযটানা-গাড়ি ঢুকতে পারে। ভিতরে লম্বা একটা খোড়ো বাড়ি, গাছের ডাল ও তক্তা জুড়েজুড়ে তৈরি। ঘেরা জায়গাটার বাঁ প্রান্তে ছ-টা মস্ত খাঁচা, খাঁচাগুলো আবার কোঠাওলা, উপর তলায় চাকা রয়েছে, যাতে মোষ-টানা-গাড়ির সঙ্গে জুতে দিলেই খাঁচাগুলো নিয়ে রওনা হয়ে পড়া যায়। খাঁচার ভিতর থেকে যে-রকম গররর গর্জন উঠলো, তাতে স্পষ্টই বোঝা গেলো যে সেগুলো আদৌ প্রাণীবিবর্জিত নয়।
এ-ছাড়া রয়েছে গোটা-বারো মোষ, পাহাড়ের ঘাস খেয়েই তারা বেঁচে আছে। তারাই এই সচল পশুশালা নিয়ে স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়ায়। ছ-টি লোক আছে। এই মোষগুলোর তদারকি করা ও গাড়ি চালাবার জন্যে—আর জনাদশেক লোক রয়েছে। জন্তুগুলোকে গ্রেপ্তার করার জন্যে বাস, এই হলো ক্রাল-এর লোকজনদের তালিকা।
গাড়িওলাদের ভাড়া করা হয়েছে কেবল এই অভিযানের জন্যেই; কাছের রেলওয়ে স্টেশনে জন্তুগুলোকে পৌঁছে দিলেই তাদের ছুটি। সেখান থেকে রেলে করে এলাহাবাদ হয়ে এরা যাবে কলকাতা কি বম্বাই-সেখান থেকে ইওরোপ।
ফান খোইত তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে কয়েক মাস হলো এই ক্রাল-এই রয়েছেন। কেবল যে তরাইয়ের বন্য জন্তুদের ভয়ই রয়েছে এখানে, তা নয়—এখানকার ভীষণ কালান্তক জ্বরের ভয়ও রয়েছে প্রতি মুহূর্তে। স্যাঁৎসেঁতে ভেজা রাত্তির, মাটি থেকে ওঠা ভ্যাপশা ঠাণ্ডা গন্ধ, গাছের ডগায় ঝুলে থাকা ভিজে-ভিজে রোদুর—সবকিছু মিলে হিমালয়ের এখানটা ভীষণ অস্বাস্থ্যকর। একবার ম্যালেরিয়া ধরলে আর রক্ষে নেই। এই ম্যালেরিয়া এমনকী তরাইয়ের বাঘের বাচ্চাদের চেয়েও মারাত্মক। সুতরাং এই ক্রালএ এসে আশ্রয় নিয়ে আমাদের কোনোই লাভ নেই—হয়তো দু-এক রাত্তির কাটানো যেতে পারে, তাছাড়া বাকি সময়টা স্টীম হাউসে কাটানোই আমাদের পক্ষে শ্রেয়।
আমরা কাল দেখতে যাওয়াতে মাতিয়াস ফান খোইত খুব খুশি। ঘুরে-ঘুরে জীবজন্তুর সংগ্রহ দেখালেন তিনি আমাদের, অনর্গল কথা বললেন জহুজানোয়ার সম্বন্ধে–অনেক বৈজ্ঞানিক নাম ও লাতিন অভিধায় ভূষিত তার বক্তৃতা থেকে বোঝা যাচ্ছিলো। নিজের বিষয়টা তিনি ভালোই বোঝেন।
তবু ক্যাপ্টেন হুডের সঙ্গে তার কথাবার্তা হলো অতিশয় চিত্তাকর্ষক। সেই পুরোনো তর্কটা বারেবারে উত্থাপিত হলো—শিকার ভালো, না জন্তু-জনোয়ার ধরে পোষ মানানো ভালো। এবং বলাই বাহুল্য তর্কের কোনো স্পষ্ট মীমাংসা হলো না। শেষটায় দুজনেই যখন একযোগে নিজের-নিজের নেশা ও খেয়ালের গুণকীর্তন শুরু করে দিলেন, তখন ব্যাঙ্কস মাঝখানে পড়ে তাদের বাদ-প্রতিবাদ থামালে।
অবশেষে তর্কটা দাঁড়ালো এইরকম : বনের রাজা কোন জন্তু? সিংহ, না হাতি, বাঘ? লিবিয়ার জঙ্গল বেশি ভয়ংকর, না সুন্দরবন? ফান খোইত শেষটায় বাঘকেই বনের রাজা বলে ঘোষণা করলেন;-বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজাবাঘের হালুম নিনাদ—তিনি বললেন—অরণ্যের সবচেয়ে ভয়ংকরসুন্দর শব্দ। এ-বিষয়ে অবশ্য ক্যাপ্টেন হুডের সঙ্গে তার বিশেষ মতভেদ দেখা গেলো না। এবং জঙ্গলে সবচেয়ে ভীষণ জন্তু যে বাঘই হয়—বিশেষ করে সে যদি কখনও নরমাংসের স্বাদ পেয়ে থাকে–এ-বিষয়েও তারা অবশেষে একমত হলেন।মানুষখেকো বাঘের চেয়ে ভীষণ আরকিছু নেই, এটা সত্যি, অবশেষে ফান খোইত সিদ্ধান্ত জানালেন, তবে স্বভাবকে নামেনে তাদের উপায় কী? একটু হেসে আরো যোগ করলেন, তাদেরও তো খেয়ে বাঁচতে হবে।
তাঁর এই মন্তব্যের পরই আমরা কাল থেকে ফেরবার সময় হয়েছে বলে সাব্যস্ত করলুম। কেননা আমাদেরও খেয়ে বাঁচা দরকার ছিলো। বলাই বাহুল্য, ক্রাল থেকে বিদায় নেবার সময় ভাবভঙ্গি দেখে এমনিতে মনে হবার জো নেই যে ফান খোইত আর ক্যাপ্টেন হুডের মধ্যে কোনোদিন বন্ধুতা সম্ভব, অথচ হুড আর ফান খোইতের মধ্যে শেষ পর্যন্ত গলাগলি ভাব হয়ে গিয়েছিলো, যদিও দুজনের মতামত ছিলো একেবারেই বিপরীত। একজনের স্বপ্ন তরাই থেকে বন্যজন্তু নির্মূল করা, অন্যজনের জীবিকা তাদের ধরে দেশ-বিদেশে চালান দেয়া; তবু জঙ্গল সম্বন্ধে অন্য-অনেক বিষয়ে দুজনের মধ্যে বিশেষ মতভেদ দেখা গেলো না। বরং ঠিক হলো যে ক্রাল আর স্টীম হাউসের মধ্যে যোগাযোগ ছিন্ন করা চলবে না। ফান খোইত যেমন ক্যাপ্টেন হুডের অভিপ্রায় স্মরণে রাখবেন, তেমনি আমরাও কোনো চিত্তাকর্ষক জন্তু পেলে যেন তাকে খবর দিই। ফান খোইত তো তার সব শিকারিকেই ক্যাপ্টেন হুডের হাতে ছেড়ে দিলেন, বিশেষ করে কালোগনি, কারণ তারা এ-অঞ্চলের হালচাল ভালো করে জানে বলে সহজেই বন্য জন্তুদের হদিশ দিতে পারবে—আর কালোগনি এদেরই মধ্যে অত্যন্ত চালাকচতুর ও ক্ষিপ্র; ক্রাল-এর কাজে সদ্য নিযুক্ত হলেও তার উপরে অনায়াসে এসব বিষয়ে নির্ভর করা যায়। এর বদলে—হুড প্রতিশ্রুতি দিলে—সেও যথাসাধ্য চেষ্টা করবে যাতে ফান খোইত বাকি জন্তুগুলো শিগগিরই পাকড়ে ফেলে তার কোটা পূর্ণ করতে পারেন।
ক্রাল ছেড়ে আসার আগে সার এডওয়ার্ড আবার কালোগনিকে তার কৃতজ্ঞতা জানালেন; বললেন, যখনই সে স্টীম হাউসে যাবে, তখনই সে সেখানে স্বাগত হবে। শুনে কালোগনি ঠাণ্ডাভাবে তাকে একটা সেলাম করলে। লোকটা যেন পাথরে-খোদাই করা; বাইরেটা দেখে কিছুতেই বোঝবার উপায় নেই ভিতরে ভিতরে সে কী ভাবছে। নিশ্চয়ই সার এডওয়ার্ডের কৃতজ্ঞতায় ভিতরে ভিতরে সে খুশি হচ্ছিলো, কিন্তু তার মুখ দেখে সেটা বোঝার কোনো জো ছিলো না।