দ্বিতীয় পর্ব
ঠিক সাড়ে সাত বছর পর আমি আবার পা দিলাম মস্কো শহরে। এর মধ্যে কী চমকপ্রদ পালাবদল ঘটে গেছে এই পৃথিবীতে! ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এক মহা শক্তিশালী বিশাল সাম্রাজ্য। বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে এমন এক সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার মতন ঘটনা মানুষের ইতিহাসে কখনও ঘটেনি।
সাড়ে সাত বছর আগে এরকম পট পরিবর্তনের সামান্যতম সম্ভাবনাও ছিল না কারুর সুদূর কল্পনায়। মস্কো তখন সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার রাজধানী। অন্যান্য অনেক দরিদ্র দেশের বহু মানুষ, যারা সমাজ ও শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন চায়, তারা প্রেরণার জন্য তাকিয়ে থাকে মস্কোর দিকে। আমেরিকা পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা নিয়ে যেতে চাইছে মহাকাশে, সেখান থেকে পেশি আস্ফালন করবে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে আমেরিকা এক হাতে দান-খয়রাত করে, অন্য হাতটা যে-কোনও সময় থাপ্পড় মারার জন্য উদ্যত রাখে। মাও-এর পরবর্তী চিন অবশ্য ততদিনে আমেরিকার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফেলেছে। মার্কিন দেশের বড়-বড় ব্যবসায়ীরা ভারতের প্রতি নাক কুঁচকে চিনে গিয়ে কারখানা স্থাপনের উপযুক্ত স্থান খুঁজছে। চিনের বড়-বড় হোটেলের পরিচারকরা পর্যন্ত থ্যাংক ইউ এর বদলে ইউ আর ওয়েলকাম বলতে শিখে গেছে।
আমেরিকান ইগলকে তখন বাধা দিতে পারে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল পতাকা। ওয়াশিংটন থেকে কোনও হুঙ্কার উঠলে মস্কো থেকে পাল্টা হুঁশিয়ারি যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নতুন এক শব্দ তৈরি হয়েছে, কোলড ওয়র, ঠান্ডা যুদ্ধ। এক অদৃশ্য দাঁড়িপাল্লায় দু-দিকেই দু-পক্ষ নিযুত অর্বুদ টাকা দামের অস্ত্র বাড়িয়ে চলেছে। ঠান্ডা যুদ্ধ যে-কোনও সময়ে পরিণত হতে পারে সর্ব-বিধ্বংসী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে। সেরকম কোনও যুদ্ধ শুরু হলে আমি এবং আমার মতন অজস্র মানুষ নিশ্চয়ই সোভিয়েত পক্ষকেই সমর্থন করত। কারণ তখন পর্যন্ত আমাদের মনে হত, আমেরিকা নামের দেশটা চালায় বড়-বড় ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রিত এক স্বার্থপর সরকার আর সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা সমাজতান্ত্রিক জোট এক বৃহৎ আদর্শের প্রতিভু। ধনতান্ত্রিক দেশগুলি অস্ত্র বিক্রেতা, তাই তারা যুদ্ধের উস্কানিদাতা, আর সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া শান্তিবাদী।
রাজনীতি বা কূটনীতি অবশ্য এমন সরল অঙ্কের নিয়মে চলে না।
সাড়ে সাত বছর আগে আমি এসেছিলাম শক্তিশালী, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোটের রাজধানী মস্কোতে। সেবারে আমি ছিলাম সরকারি অতিথি। দলের সঙ্গে নয়, একা। আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল সেরগেই নামে এক যুবক। বেশ হাসিখুশি, সুন্দর স্বভাব, সে ছিল আমার দোভাষী, পথ প্রদর্শক ও সব কিছুর ব্যবস্থাপক। আমার ওপর নজরদারি করাও ছিল তা দায়িত্বের অঙ্গ, তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। আমি একটুক্ষণ তার চোখের আড়ালে গেলেই সে অতিশয় ব্যস্ত হয়ে উঠত। অবশ্য সোভিয়েত দেশের কোনও ছিদ্র অনুসন্ধান করার কোনও উদ্দেশ্যেই আমার ছিল না, আমি গিয়েছিলাম মুক্ত মন নিয়ে। তার আগে অনেকগুলি ধনতান্ত্রিক দেশ আমার ঘোরা হয়ে গেছে, সমাজতন্ত্রের বাস্তব প্রয়োগ নিজের চোখে দেখার আগ্রহ ছিল খুব।
সরকারি আমন্ত্রণের ভ্রমণসূচি সব আগে থেকে নির্দিষ্ট থাকে। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত সাক্ষাৎকার ও পরিদর্শনের প্রোগ্রামে ঠাসা। মস্কো, লেনিনগ্রাড, রিগা ও কিয়েভ এই চারটি শহরেই সেরগেই আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। পরে আমি চিনে গিয়ে দেখেছি, সেখানেও বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন সরকারি প্রতিনিধি নয়, একই দোভাষী গাইড সব ক’টি শহরে সঙ্গী। এর কারণ বোধ হয় এই যে, এক শহর থেকে অন্য শহরে যাতায়াতের পথে, ট্রেনে বা বিমানে সরকারি অতিথি যাতে হারিয়ে না যান, কিংবা অন্য লোকদের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় আড্ডা জুড়ে না দেন, সেটা দেখা।
সেবারে চারটি শহরেই যা যা আমাকে দেখানো হয়েছে, তা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। যা যা দেখানো হয়নি, সে বিষয়ে কিছু জানি না। লেনিনগ্রাড শহরটি অতি সুদৃশ্য, সেখানে রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত হারমিটেজ মিউজিয়াম, রিগা শহরের কোথাও কোথাও রয়েছে প্রায় অবিস্মৃত মধ্যযুগীয় রূপ, কিয়েভ শহরে সবুজের অপূর্ব সমারোহ, এসব দেখে কার না ভালো লাগবে! দেখেছি, উন্নত ধরনের যৌথ খামার, সারা দেশে নির্দিষ্ট ও সস্তা দামে খাদ্যদ্রব্য ও যানবাহন ব্যবস্থা, শুনেছি সমস্ত নাগরিকদের বাসস্থান ও জীবিকার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের কথা। ফিরে এসে ভ্রমণকাহিনিতে সেই সবই লিখেছি। কেউ-কেউ বলেছেন, এদেশে এবং মস্কোতেওঁ, এই ব্যবস্থার অনেক দুর্বলতা, গলদ ও অন্যায় আছে, সেসব আপনি কিছুই লেখেননি কেন? আমি বলেছি, যা দেখিনি, তা আমি লিখব কেন? আমি ভ্রমণকাহিনিতে উপন্যাস ঢোকাতে চাই না, অনুমান বা শোনা-কথা একপাশে সরিয়ে রাখি।
সেবারে সোভিয়েত দেশে সমাজতন্ত্রের বহিরঙ্গ দেখে আমি মুগ্ধই হয়েছিলাম। আমাদের মতন দরিদ্র দেশের পক্ষে তো আদর্শ বটেই! কয়েকটি ব্যাপারে শুধু খটকা লেগেছিল। যৌথ খামারটিকে মনে হয়েছিল মডেল খামার, বড় বেশি সাজানো, ওটা যেন বিদেশিদের দেখাবার জন্যই। সারা দেশে সমান দামে সমস্ত খাদ্য সরবরাহের প্রচারটাও বোধহয় ঠিক নয়। খাদ্যের বেশ অভাব আছে। সরকারি অতিথি হিসেবে আমাকে ভালোই খাওয়ানো দাওয়ানো হচ্ছে বটে, কিন্তু অনেক রেস্তোরাঁতেই একটু দেরি করে গেলেই কিছু পাওয়া যায় না, বাজারে তরিতরকারি ফলমূল বলতে শুধু কিছু আলু আর বিট-গাজর, মাখন আর মাংসের অভাবের কথা লোকের মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়। আর, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রত্যেক সাক্ষাৎকারেই যেন হুবহু এক কথা শুনতে হয়েছে, বন্ধুত্ব, শান্তি ও সাম্যের জয়গান, কথাগুলো যেন মুখস্থ করা, একেবারে বাঁধা ধরা সরকারি ভাষ্য, বলতে বলতে ওঁরা বারবার হাই-তোলা গোপন করেছেন। তার কারণ কি কে জি বি’র অদৃশ্য ছায়া?
আমেরিকাকে পৃথিবীর সব দেশ গালমন্দ করে। আমেরিকার মধ্যে বসেও সে দেশের সরকারের যদৃচ্ছ সমালোচনা করার কোনও বাধা নেই, এমনকি বিদেশিরাও তা পারে। ওদেশের রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে হাসি-মসকরা চলে অবাধে। কেনেডি হতার পর পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জনসনকে হত্যাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে একটা নাটকের অভিনয় আমি দেখেছিলাম ওদেশে, মার্কিন সরকার সে নাটকের মঞ্চানুষ্ঠান বন্ধ করতে পারেনি। সেরকম কোনও আইনের ক্ষমতা সরকারের নেই।
সোভিয়েত ইউনিয়ন, তথা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে সমালোচনার কোনও স্থানই ছিল না। ব্যবস্থার কোনওরকম ত্রুটি সম্পর্কে টু শব্দটি উচ্চারণ করার অধিকার ছিল না সাধারণ মানুষের। কেউ কিছু বলার চেষ্টা করলেই তাকে অদৃশ্য করে দেওয়া হত। স্টালিনের সময় এরকম কোটি কোটি মানুষকে যখন তখন মনুষ্য জন্ম শেষ করে চলে যেতে হয়েছে। বাড়ির মধ্যে বসে স্বামী-স্ত্রী সরকারের কোনও গলদ নিয়ে আলোচনা করতে পারবে না, ছেলেমেয়েদের দিয়ে তাদের ওপর নজর রাখার নজির আছে। সব মিলিয়ে একটা আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল।
ওইসব দেশের বাইরে যারা সমাজতন্ত্রের সমর্থক কিংবা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বা তথাকথিত কমিউনিস্ট বা আরামের জীবনযাপনে অভ্যস্ত, ক্ষমতাভোগী দলের কমিউনিস্ট, তারাও সহ্য করতে পারে না কোনও সমালোচনা। যারা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে কোনও বৈপরীত্য নির্দেশ করে কিংবা গোষ্ঠীচক্রের প্রতিবাদ জানায়, অমনি তাদের প্রতি বর্ষিত হয় অজস্র গালি-গালাজ, তারা সমাজতন্ত্রের শত্রু, তারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল, তারা ধনতন্ত্রের উচ্ছিষ্টভোজী, তারা স্বার্থপর ও লোভী ইত্যাদি। যুক্তি নয়, শুধু গর্জন। যারা প্রকৃত আদর্শবাদী, তারা সমালোচনাকে এত ভয় পাবে কেন, তাদের মুখের ভাষা এত খারাপ হবে কেন? শাখারভের মতন বৈজ্ঞানিক, পাস্তেরনাক কিংবা সোলঝেনিৎসিনের মতন লেখক, এঁদের বক্তব্য শোনা ও বোঝার বদলে যারা শুধু গালাগালি দেয়, তাদের মনুষ্যত্ব সম্পর্কেই সন্দেহ করা উচিত নয় কি?
যেসব শিল্পী বা লেখক নিজেদের দলভুক্ত নয়, কিংবা পার্টির নির্দেশে চলে না, কিংবা মানবতাবাদকেই একমাত্র অনুসরণযোগ্য মনে করে, তাদের একেবার নস্যাৎ করে দেওয়া হয়। তাদের রচনায় কোনও গুণই নেই বলে দেগে দেওয়া হয়। শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে এরকম অদ্ভুত বিচারবোধের ফলে এই সব গোঁড়াদের শিল্পসাহিত্যের বোধই নষ্ট হয়ে যায়।
যারা সমালোচনাকে এত ভয় পায় তাদের নিশ্চয়ই গোপন করার অনেক কিছু থাকে। সেই সব বহু গোপন কেলেঙ্কারি এখন ফাঁস হয়ে গেছে। যদি আগে থেকেই সাধারণ মানুষের সব কিছু জানার ও মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকবে, তা হলে এসব কেলেঙ্কারি হয়তো ঘটতেই পারত না। নিজ দেশবাসীর রক্তের সমুদ্রে স্নান করেছেন যে স্টালিন, তার দাপট খর্ব করে কিছু মানুষের প্রাণ বাঁচানো যেতে পারত, চাউসেস্কু হয়ে উঠতে পারত না সমাজতান্ত্রিক দেশে এক স্বৈরাচারী রাজা।
ব্যক্তি স্বাধীনতা ও বাক-স্বাধীনতা দিয়েও কেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, তা আমি আজও বুঝতে পারিনি। কেন মার্কসবাদীরা ব্যক্তি স্বাধীনতার এমন ঘোরতর বিরোধী? পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে গিয়ে আমি দেখেছি, সেই সব দেশগুলিতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের মূলে যে দুটি প্রধান কারণ, তার প্রথমটি অবশ্যই খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব, দ্বিতীয়টি ওই ব্যক্তি স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতার অনধিকার। এতদিন পর যেন মাথার ওপর থেকে বিরাট ঢাকনা তুলে নেওয়ার পর সকলের মুখে খই ফুটছে। কবি ইয়েফতুশেঙ্কো সেইজন্যই বলেছেন, বাক-স্বাধীনতার বদলে আমরা যেন পেয়ে গেছি বকবকানির স্বাধীনতা! প্রথম প্রথম তো এরকম হতেই পারে।
আধুনিক পৃথিবীতে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তির একটা বিস্ফোরণ ঘটেছে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত তো বটেই, এমনকি চাঁদের অভিযাত্রীদের সঙ্গেও টেলিফোনে কথা বলা যায়। বেতারে ও টেলিভিশনে শোনা ও দেখা যায় এক রাষ্ট্র থেকে অন্যান্য রাষ্ট্রের সংবাদ ও সমাজচিত্র। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে সাধারণ মানুষদের এই রকম যোগাযোগের তো সুযোগ দেওয়াই হয়নি, সবরকম যাতায়াতের পথ রুদ্ধ করে তুলে দেওয়া হয়েছে কঠিন দেওয়াল ও কাঁটাতারের বেড়া, যেখানে পাহারা দিয়েছে হিংস্র কুকুর ও মারাত্মক অস্ত্রধারী সৈনিকরা। দেশের মানুষকে সব সময় ভয় দেখিয়ে এ কীরকম সাম্যবাদ!
লেনিন নাকি বলেছিলেন, বাড়ির বাইরের কোনও দিক থেকে যদি দুর্গন্ধ আসে, তা হলে সেদিকের জানলাটা বন্ধ করে রাখতে হয়। মনে হয়, কথাটায় আপাত যুক্তি আছে, লেনিনের সময় সদ্যপ্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্রকে বহুরকম শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এরকমভাবে পশ্চিমের জানলা কিছুদিন বন্ধ করে রাখার প্রয়োজনীয়তাও হয়তো ছিল। কিন্তু সত্তর বছর ধরে কোনও জানলা বন্ধ রাখা যায়? সত্যিই দুর্গন্ধ আসছে কি না তা বাড়ির মালিক একবার জানলা খুলে দেখতে পারবে না? রাজধানী থেকে কয়েকজন নেতা তা ঠিক করে দেবে! হাঙ্গেরি কিংবা চেকোস্লোভাকিয়াতে কেউ জানলা খুলতে চাইলে মস্কোর নির্দেশে ট্যাংক পাঠিয়ে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে।
লেনিনের পরবর্তী নেতারা দেখলেন, এরকম জোর-জবরদস্তি করে দেশের সাধারণ মানুষকে কূপমণ্ডুক অবস্থায় রাখতে পারলে নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকা নির্বিঘ্ন হবে। স্টালিন যে অজস্র নরহত্যা করিয়েছিলেন, তা কি সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য, না ক্রেমলিনে নিজের আসনটি পাকা করার জন্য? দেশত্যাগী ট্রটস্কিকে নৃশংসভাবে খুন করাবার আর কী কারণ থাকতে পারে!
জানলা বন্ধ রাখার এতরকম কলাকৌশল যারা করেছিল, তারা অন্য দিকটা ভেবেও দেখেনি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি / সত্য বলে আমি তবে কোথা গিয়ে ঢুকি?’ কিংবা তারা আসলে সত্যকেই ভয় পেত?
পশ্চিমের দুর্গন্ধের অপর নাম ভোগ্যপণ্য। এই ভোগ্যপণ্য শব্দটি হচ্ছে ভাষার চাতুরি, মিথ্যেকে ঢাকার প্রয়াস। দাঁত মাজার টুথপেস্ট, গায়ে মাখার সাবান, পায়ে দেওয়ার জুতো, টয়লেটের কাগজ, এগুলি কি ভোগ্যপণ্য না নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস? সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি এগুলোও কেন ঠিকঠাক দিতে পারেনি সমস্ত নাগরিকদের? বড় বড় মার্কসবাদী তাত্বিকরা এই ত্রুটি লক্ষ করেননি! পাউরুটির সঙ্গে মাখন আমাদের মতন দেশে এখনও বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে বটে, কিন্তু ইউরোপে বহু যুগ ধরে এটা সাধারণ মানুষের অতি প্রয়োজনীয় জিনিস। তা থেকে তাদের বঞ্চিত করা যায় না। বরং বলা যেতে পারে যে মিসাইল, রকেট, মহাকাশযান এই সবগুলোই সমাজতান্ত্রিক দেশের শাসকদের ভোগ্যপণ্য, বিলাসিতার দ্রব্য।
পোল্যান্ডের সাধারণ মানুষ যদি জানতে পারে যে পাশের দেশ ফ্রান্স গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়েও সে দেশের সমস্ত মানুষই রুটির সঙ্গে মাখন মাংস খেতে পায়, তা হলে তারা সমাজতন্ত্রের ওপর শ্রদ্ধা রাখবে কী করে? মার্কসবাদ তো মানুষকে দুঃখে-কষ্টে-নিপীড়নের মধ্যে রাখার কথা বলেনি, মার্কসবাদ তো এক সুখী সমৃদ্ধ সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছে।
মাত্র দু-বছরের বিপরীত ধরনের ঘটনা ও ওলোটপালট দিয়ে ইতিহাসের বিচার করা যায় না। সমাজতন্ত্রকে নস্যাৎ করা যায় না। কিন্তু এইসব প্রশ্ন অবশ্যই তোলা যায়।
মনের মধ্যে এমন ধরনের অনেক প্রশ্ন নিয়েই আমি দ্বিতীয়বার উপস্থিত হলাম মস্কো শহরে। আগেরবার আমাকে রাখা হয়েছিল অতিকায় সুরম্য হোটেল ইউক্রানিয়ায়। এবারও উঠলাম সেই একই হোটেলে। আগেরবার বিমানের মধ্যেই সুবোধ রায় নামে এক যুবকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। এই সাড়ে সাত বছরে তার সঙ্গে আমার হৃদ্যতা জন্মে গেছে। এবারে বিমানবন্দরে কোনও সরকারি প্রতিনিধি নেই, কিন্তু উপস্থিত রয়েছে সুবোধ এবং তার ছোট ভাই সমর রায়।
খুব সম্ভবত সুবোধ রায়ই একমাত্র বাঙালি, যে গত অগাস্ট মাসের আড়াই দিনের ব্যর্থ অভ্যুত্থান, রাশিয়ার পার্লামেন্টের সামনে ট্যাংক বাহিনী, ইয়েলৎসিনের নেতৃত্বে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ সব কিছু নিজের চোখে দেখেছে। গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য দিনরাত পাহারা দিয়েছে যে অতন্দ্র জনতা, সুবোধ ছিল সেই জনতার একজন।