২. হুইল চেয়ারে যে বৃদ্ধ

একেবারে উলটো দিকের দোতলায় ঘরের ভিতর বারান্দায় হুইল চেয়ারে যে বৃদ্ধ বসে ছিলেন, তার চেহারা খুবই শীর্ণ। মাথায় হলদেটে কয়েকগাছি চুল। গায়ের চামড়া বৃদ্ধ বয়সেও দারুণ ফরসা। বৃদ্ধের পাশে দু’জন বয়স্কা মহিলা চেয়ারে বসে ছিলেন। বিষ্ণুদাসজির সঙ্গে অর্জুনকে ঢুকতে দেখে তারা ঘোমটা টানলেন মাথার মাঝবরাবর।

বিষ্ণুদাসজি বললেন, দাদা, পশ্চিমবাংলার জলপাইগুড়ি শহর থেকে এখানে আসার জন্যে তুমি যাকে নিমন্ত্রণ করেছ, তিনি এসেছেন।

তুলসীদাসজি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে চেষ্টা করতে অর্জুন তার সামনে এগিয়ে গিয়ে দু’হাত জড়ো করে বলল, নমস্কার। আমি অর্জুন।

তুলসীদাসজি প্রায় তিরিশ সেকেন্ড অর্জুনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ইশারায় বিষ্ণুদাসজিকে কাছে ডাকলেন। বিষ্ণুদাসজি তার মুখের কাছে মাথা নিয়ে গেলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কেন ডেকেছিলাম বলো তো?

বিষ্ণুদাসজি বললেন, উনি প্রাইভেট গোয়েন্দা, ওঁকে নিয়ে লেখা বই পড়ে তুমি আগ্রহী হয়েছিলে আলাপ করতে।

কথাগুলো যত নিচু স্বরেই হোক, অর্জুনের কান এড়াল না। সে মৃদু প্রতিবাদ করল, আমি গোয়েন্দা নই, সত্যসন্ধানী।

ডান হাত তুললেন তুলসীদাসজি, স্বাগতম! মনে পড়েছে। বসুন।

তুলসীদাসজির সামনে রাখা চেয়ারে বসল অর্জুন। বসে জিজ্ঞেস করল, আপনার শরীর এখন কেমন আছে?

হাত নাড়লেন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে। যার অর্থ হল, এটা কোনও সমস্যাই নয়। এখানে আসতে নিশ্চয়ই আপনার খুব কষ্ট হয়েছে? আসার দিন ঠিক করে জানালে আমি আমার ভাগনে হরিরামকে স্টেশনে থাকতে বলতাম।

না না। আমার কোনও কষ্ট হয়নি।

রাতের ট্রেনে এসেছেন। তুলসীদাসজি তাকালেন।

অর্জুন জবাব দিল না। হাসল একটু। তুলসীদাসজির পিছনে দাঁড়ানো বিষ্ণুদাসজি মাথাটা একটু দোলালেন।

আপনার বয়স বেশি নয় বলে শুনেছিলাম, কিন্তু এত কম ভাবিনি। বলে সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করে ডাকলেন গলা তুলে, বংশী! চা কোথায়?

মিনিটখানেকের মধ্যে চা-বিস্কুট নিয়ে হাজির হল বংশী।

বিষ্ণুদাসজি বললেন, আপনারা গল্প করুন। আমি একটু কাজ সেরে আসি।

আমরা নিরামিষ খাই। কিন্তু অর্জুনবাবুর জন্য মাছ-মাংসের ব্যবস্থা করবে।

কোনও দরকার হবে না। অর্জুন বলল, আমি নিরামিষ পছন্দ করি।

বাঃ। উত্তম। ও হ্যাঁ। এরা আমার দু’বোন। বড়টি আমার কাছেই থাকে, ছোট আমার অসুখের খবর পেয়ে দেখতে এসেছে। তুলসীদাসজি পরিচয় করিয়ে দিলেন।

অর্জুন দুই মহিলাকে নমস্কার করল। কিন্তু তারা কোনও প্রতিক্রিয়া জানালেন না।

চা খেতে খেতে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি লিখেছিলেন, যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি এখানে চলে আসতে। কী ব্যাপার?

বলব। সব বলব। আপনি যখন এখানে এসে গিয়েছেন তখন আর কোনও চিন্তা নেই। চা শেষ করে আমার বাড়িটা দেখুন। এই বাড়ি তৈরি হয় প্রায় দেড়শো বছর আগে। তখন থেকে একটু একটু করে বড় হয়েছে। আমার পিতামহ বাড়ির বাগানের চারপাশে দেওয়াল তুলেছিলেন। ভারতবর্ষে যত ফল পাওয়া যায়, তার সব তিনি এই বাগানে পেতে চেয়েছিলেন। পাহাড়ি গাছগুলো ওঁর বাসনা পূর্ণ করেনি। আমার তো যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। বিয়ে-থা করিনি, বংশরক্ষা সম্ভব হবে না। আমার একমাত্র দুশ্চিন্তা ভাইকে নিয়ে। বিষ্ণুদাস দীর্ঘকাল বাইরে ছিল। শুনেছি, সেখানে সে বিবাহ করেছিল, সন্তানও হয়েছিল। কোনও কারণে মতপার্থক্য হওয়ায় বিবাহবিচ্ছেদ করে এখানে ফিরে এসেছে। আমি যখন থাকব না, তখন ওকেই তো সব সামলাতে হবে। একনাগাড়ে কথা বলে একটু জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে মহিলা দু’জন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। একজন ভিতরে গিয়ে চটপট ইনহেলার নিয়ে এলেন। সেটা পাম্প করে কিছুটা স্বস্তি পেলেন তুলসীদাসজি।

আপনার দেখছি পূর্বপুরুষের অনেক কাহিনি ঠিকঠাক মনে আছে? অর্জুন উঠে দাঁড়াল।

একটু ধাতস্থ হয়ে তুলসীদাসজি বললেন, এই নিয়েই তো আছি।

কিন্তু আপনি আমাকে কেন ডেকেছেন তা বললেন না।

বলব, নিশ্চয়ই বলব। কাল রাতে বলতে চাইনি, এখনও বলছি না, তবে বলব। বৃদ্ধ হাসলেন। চমকে উঠল অর্জুন। কিন্তু নিজেকে সামলে উঠে এল সে।

.

নীচে নামার সিঁড়ির বাঁকে বংশীকে দেখতে পেল অর্জুন। লম্বা একটা ঝাঁটা হাতে উঠে আসছে। তাকে জায়গা দিতে একপাশে সরে দাঁড়াল সে। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, নীচে কি রামঅবতারকে পাওয়া যাবে?

হ্যাঁ। কোনও দরকার আছে?

ওই বাগানটা একটু ঘুরে দেখব।

বংশী হাসল, আপনার জন্যে ওঁরা দাঁড়িয়ে আছেন। বলে উপরে চলে গেল সে। চলে যাওয়ার আগে ওর ঠোঁটে যে হাসি চলকে উঠল, তা বেশ অর্থবহ বলে মনে হল অর্জুনের।

ধীরে ধীরে নীচে নামতেই খানিকটা দূরে গাছের নীচে বিষ্ণুদাসজিকে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে দেখল সে। বিষ্ণুদাসজি বলছেন, তাঁর দাদার স্মৃতি মাঝে মাঝেই লোপ পেয়ে যায়। গত রাতে ওর আসার কথা অথচ ভদ্রলোকের মনে নেই। তাই বলতে হবে যে, আজ সকালে এখানে পৌঁছেছেন।

কিন্তু তুলসীদাসজি স্পষ্ট জিজ্ঞেস করেছিলেন, রাতের ট্রেনে এসেছেন? স্মৃতি লোপ পাওয়ার কোনও লক্ষণ তো দেখা গেল না!

গল্প হল? বিষ্ণুদাসজি জিজ্ঞেস করলেন।

সামান্য। কিন্তু কথা বলে তো মনে হল না ওঁর স্মৃতিতে গোলমাল। হচ্ছে।

চট করে বুঝতে পারবেন না। ডাক্তার, বুঝিয়ে দিন।

ডাক্তার বললেন, এসব পেশেন্টরা তাঁদের অল্প বয়সের, ধরুন তিরিশ চল্লিশ বছর আগেকার কথা বিশদভাবে মনে রাখতে পারেন। কিন্তু গত কাল কী হয়েছে, তা মাঝে মাঝেই ভুলে যান। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার।

অর্জুন বলল, তা হলে জিজ্ঞেস করলেন কী করে, কাল রাতের ট্রেনে এসেছেন?

বিষ্ণুদাসজি হাসলেন, তাই তো করবেন। যে ট্রেন এখানে ভোরবেলায় এসে পৌঁছোয় তাকে সবাই ‘রাতের ট্রেন’ বলি।

ও! অর্জুন হাসল, ভাবছি, আপনাদের বাগানটা একটু ঘুরে দেখব।

বেশ তো, চলুন। ডাক্তার, আমরা একটু ঘুরে আসি?

বাগানটা বেশ বড়। বড়-ছোট গাছে ভরা। এক দিকে শৌখিন ফুলের গাছ, অন্য দিকে বিশাল গাছের ভিড়। বিষ্ণুদাসজি বললেন, আপনি তো নর্থ বেঙ্গলের মানুষ, ওই গাছটাকে চিনতে পারছেন? নর্থ বেঙ্গলের গাছ।

অর্জুন গাছটাকে দেখল। মাঝারি লম্বা ওই ধরনের গাছ প্রচুর পরিমাণে জলদাপাড়ায় অথবা তোর্ষা নদীর দু’ পারে দেখা যায়। সে মাথা নাড়ল, খয়ের গাছ।

গুড। দাদা গাছটাকে লাগাবার সময় ভেবেছিলেন, ওটা বাঁচবে না। কিন্তু এই মাটিতে দিব্যি বড় হয়ে গিয়েছে।

বাগানটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পূর্ব কোণে পাঁচিলের একটা অংশের ইট ভেঙে গর্ত হয়ে আছে। বিষ্ণুদাসজি বিরক্ত হলেন, মালি কী অপদার্থ দেখুন। পাঁচিল খসে গিয়েছে, কিন্তু আমাদের জানায়নি। অবশ্য কাল বিকেলেও ওখানে গর্তটা ছিল না। হয়তো ও ঘুরে যাওয়ার পরে ইট খসে পড়েছে।

ওঁরা গর্তের কাছাকাছি চলে এসেছিলেন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ দিব্যি ওই গর্ত দিয়ে যাতায়াত করতে পারে। কিন্তু অর্জুনের মনে হল, ওই গর্ত কখনওই আজ-কালের মধ্যে তৈরি হয়নি। পড়ে থাকা ইটের উপর শ্যাওলা জন্মাত না তা হলে। অর্জুন কিছু বলল না।

বিষ্ণুদাসজি একটার পর-একটা গাছের নাম বলে যাচ্ছিলেন। অমলতাস, ময়না, নাগেশ্বর, জামরুল, চালতা, ডুমুর, বনকাঁপাস, শিমুল, বহেড়া, গাছগুলোর যেন সকাল এখনও কাটেনি। আর-একটুহাঁটতেইব্যারাকবাড়িটাকে দেখতে পেল সে। লম্বা টানা বাড়ি। সামনে-পিছনে দুটো দরজা গাছগুলোর আড়ালে রয়েছে।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ওই বাড়িতে কেউ থাকে?

বিষ্ণুদাসজি হো হো শব্দে হাসলেন। তারপর বললেন, না না, ওটা বাবার আমলে তৈরি। তিনি দেশপ্রেমিক ছিলেন। গাঁধীজির ডাকে লবণ আন্দোলনে নেমেছিলেন। বিদেশি লবণ কেনা বন্ধ করতে হবে। তাই সমুদ্রের জল তুলে তা থেকে লবণ বের করে বস্তায় বস্তায় ভরে এই গুদামে জমা করা হত। তারপর এখান থেকে লরিতে চাপিয়ে সেই লবণ গ্রামেগঞ্জে পাঠানো হত। আমি তখন সদ্য জন্মাই, পরে এসব গল্প শুনেছি।

এখন কি ঘর ভোলা হয় না?

বছরে এক-আধদিন ঝাড়পোঁছ হয়। এই যে, ওদিকে দেখুন।

অর্জুনরা যেখানে এসে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই জমিটা বেশ উঁচু। ফলে সামনের পাঁচিল ডিঙিয়ে বাইরে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে। বিষ্ণুদাসজি যেদিকে আঙুল তুললেন, সেদিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে জল, দিঘি বলা যেতে পারে। জল কত গভীর তা বোঝা যাচ্ছে না। অর্জুন দেখল, কয়েকটা মাছরাঙা পাখি জলে ডুবছে আর উঠছে।

পাখিগুলোর নাম জানেন? বিষ্ণুদাসজি জিজ্ঞেস করলেন।

মাছরাঙা।

আজ্ঞে না। দিশি নাম জানি না, ইংরেজিতে ওদের বলে, হুইসলিং টিল। সারাদিন ঝিলেই থাকে, ডিম পাড়ে উঁচু জমির ঘাসের জঙ্গলে।

এই ঝিল নিশ্চয়ই আপনাদের নয়। পাঁচিলের ওপাশে রয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।

না। যাঁর ঝিল তিনি ভুবনেশ্বরে থাকেন। আশপাশের মানুষরা ওই ঝিলের জল ব্যবহার করা দূরের কথা, কাছাকাছি যায় না।

কারণ?

কুসংস্কার! ওদের ধারণা, এই ঝিলে প্রেতাত্মারা বাস করেন।

অর্জুন মাথা নাড়ল, নিশ্চয়ই কেউ-না-কেউ তাদের দেখেছে।

আপনি, আপনি প্রেতাত্মা বিশ্বাস করেন? বিষ্ণুদাসজি যেন অবাক হলেন।

অর্জুন বলল, আমি বিশ্বাস করি না বললে কি আপনাদের গ্রামের লোক রাত-দুপুরে ঝিলে নামতে পারবে?

ওরা কেউ কিছু দ্যাখেনি, রশিকে সাপ ভেবে নিয়েছে।

আচ্ছা, আপনার পরিচিত বা অপরিচিত কোনও মানুষ কি ভগবানকে দেখেছেন? দ্যাখেননি। তাঁরা প্রচলিত মূর্তিকে ভগবান ভেবে নিয়ে মন্দির বানিয়েছেন।

কিছুক্ষণ হাঁটার পর বিষ্ণুদাসজি নিচু গলায় বললেন, আপনি যখন অবিশ্বাস করছেন না, তখন একটা কথা বলি। ক্রমশ আমার মনে হচ্ছে, তেনারা আছেন। যাকগে, কেমন লাগল আমাদের বাগানটা?

খুউব ভাল। কিন্তু বিষ্ণুদাসজি, আমি এখনও বুঝতে পারছি না আপনার দাদা অত ব্যস্ত হয়ে আমাকে এখানে নিয়ে এলেন কেন?

যখন দেখা করতে গেলেন তখন কিছু বলেননি?

না। আপনি বললেন, ওঁর স্মৃতি কাজ করে না, হয়তো ভুলেই গিয়েছেন।

অস্বাভাবিক নয়। সকালে যখন ওঁকে আপনার কথা বললাম, তখন প্রথামতো চিনতেই পারছিলেন না। আমি অনেক বুঝিয়ে বলতে হয়তো আবছা আবছা মনে পড়ে গিয়েছিল। ওই যে বললাম, চল্লিশ বছর আগের ঘটনা পরিষ্কার মনে আছে ওঁর। অথচ গত কাল যদি কারও সঙ্গে আলাপ হয়, তা হলে আজ তাকে মনে রাখতে পারেন না। বিষ্ণুদাসজি হাসলেন, থাকুন দিন দুয়েক। বাই চান্স যদি মনে পড়ে যায়…।

উনি তো অবিবাহিত?

হ্যাঁ।

ওঁর পাশে যে মহিলাদের দেখলাম, তাঁরা আত্মীয়া?

না বলি কী করে? সারাক্ষণ ওরা দাদাকে আগলে রাখে।

কেন?

যদ্দিন দাদা বেঁচে থাকবেন, তদ্দিন ওরা আরামে থাকবে।

বুঝলাম। কিন্তু ওঁর বয়স হয়েছে, ওঁর মৃত্যুর পর আপনিই তো মালিক হবেন। এই বাড়ি, বাগান, আর যা-যা আছে সব আপনার হয়ে যাবে।

কে বলল? বিষ্ণুদাসজি দাঁড়িয়ে গেলেন।

আপনার দাদাই আজ আমাকে বলেছেন।

ওঃ। কাঁধ নাচালেন বিষ্ণুদাসজি, আজ বলেছেন? এখন গিয়ে আবার প্রসঙ্গ তুলুন, দেখবেন, সব ভুলে গিয়েছেন।

মুশকিল ব্যাপার।

হ্যাঁ। তবে আমার কোনও আগ্রহ নেই। দাদার সম্পত্তি, উনি যাকে ইচ্ছে তাকে দিয়ে যেতে পারেন। উদাস গলায় বললেন বিষ্ণুদাসজি।

আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না, আপনি বলছেন, এসব আপনার দাদার সম্পত্তি। অথচ এগুলো পৈতৃক সূত্রে পেয়েছেন আপনারা। দেড়শো বছর আগে এই বাড়ি তৈরি হয়েছিল। আপনার ঠাকুরদা বাড়ির চারপাশে পাঁচিল দিয়েছিলেন। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পত্তিতে আপনার দাদার যেমন অধিকার আছে, তেমনি আপনারও আছে। অথচ আপনি বলছেন, এসব দাদার সম্পত্তি। কী করে সম্ভব?

বিষ্ণুদাসজি মাথা নাড়লেন, আপাতদৃষ্টিতে তাই হওয়া উচিত। কিন্তু জীবন তো সব সময় একই নিয়মে চলে না।

এই সময় ডাক্তারকে বিরক্ত মুখে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। কাছে এসে তিনি বললেন, আমি যদি চিকিৎসা করার সুযোগ না পাই, তা হলে এখানে– থেকে কী করব?

বিষ্ণুদাসজি বললেন, আপনাকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে?

আশ্চর্য! আমি কী ওষুধ বা ইঞ্জেকশন দেব, তা ওই মহিলারা ঠিক করবেন?

বুঝিয়ে বলুন।

আপনাদের হরিরামইঞ্জেকশন কিনেনা আসাপর্যন্ত আমি পেশেন্টকে ফেলে রাখতে পারি না। গত রাতে যেটা দিয়েছিলাম, তার কিছুটা রেখে দিয়েছিলাম। এখন সেটাই দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পেশেন্ট বায়না করলেন তিনি ইঞ্জেকশন নেবেন না। নিলেই নাকি তাঁর ঘুম পেয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ওই মহিলারাও মাথা নাড়তে থাকলেন, ওই ইঞ্জেকশন দিতে হবে না, চব্বিশ ঘণ্টা উনি ঘুমিয়ে থাকুন তা তাঁরা চান না। এঁরা বুঝতেই পারছেন না, এখন ওঁর যতটা সময় সম্ভব ঘুমিয়ে থাকা উচিত। তা হলে নার্ভগুলো টেন্সড় হয়ে থাকবে না।

বিষ্ণুদাসজি বললেন, ওদের উচিত হয়নি বাধা দেওয়া। তবে গত রাতের লেক্ট ওভার তো বেশিক্ষণ কাজ করবে না। ছেড়ে দিন। হরিরাম ফিরলে আবার চিকিৎসা শুরু করবেন।

বিষ্ণুদাসজির কথা শেষ হতেই বাড়ির সামনে কিছু লোকের কথাবার্তা শোনা গেল। তিনি কী হচ্ছে দেখার জন্যে এগিয়ে যেতেই অর্জুন ডাক্তারকে বলল, আপনার মতো ডাক্তার এখন সচরাচর দেখা যায় না।

কেন? ডাক্তারের চোখে সন্দেহ।

নিজস্ব চেম্বার ছেড়ে এই অজ পাড়াগাঁয়ে একজন পেশেন্টের জন্যে থেকে গিয়েছেন, এটাকে মহানুভবতা ছাড়া কী বলব? অর্জুন হাসল।

ওসব আমি বুঝি না। আমি প্রফেশনাল লোক। এঁরা টাকা দিচ্ছেন বলে থেকে গিয়েছি। কিন্তু আমাকে যদি চিকিৎসা করতে বাধা দেওয়া হয়, তা হলে থাকা সম্ভব নয়। কথাগুলো বলে ডাক্তার আবার বাড়ির ভিতর চলে গেলেন।

অর্জুন অলস পায়ে বাইরে এল। বিষ্ণুদাসজির সঙ্গে যাদের কথা হচ্ছে, তারা বিদ্যুৎ দপ্তরের লোক। বিষ্ণুদাসজি বলছিলেন, এ কী বলছেন? আমাদের পক্ষে রাত জেগে কি পাহারা দেওয়া সম্ভব?।

ওদের যিনি প্রধান, তিনি বললেন, আমাদের পক্ষেও রোজ-রোজ এসে কাটা তার জোড়া দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আশ্চর্য ব্যাপার, গোটা গ্রামের ইলেকট্রিক কানেকশন কেটে দেওয়া হচ্ছে, অথচ কেউ দেখতে পাচ্ছে না। ভোর হতে না-হতেই ফোন যাচ্ছে দপ্তরে, লাইন জুড়ে দিন। এটা যেন খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ শেষবার, বলে দিলাম।

লোকগুলো কাজ শুরু করলে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ব্যাপারটা কী?

আর বলবেন না! সন্ধের পরেই কারা এসে ইলেকট্রিকের তার কেটে দেয়।

কারা?

মাথা নাড়লেন বিষ্ণুদাসজি, বোঝা যাচ্ছে না।

আপনারা গ্রামের ছেলেদের নিয়ে পাহারাদারির দল তৈরি করছেন না কেন?

গ্রামে ছেলে কোথায়? ষোলো বছর হলেই সবাই কাজ খুঁজতে কলকাতা বা ভুবনেশ্বর চলে যায়। বিষ্ণুদাসজি ঘুরে দাঁড়ালেন।

আমি একটু গ্রামখানা ঘুরে দেখে আসি? অর্জুন পা বাড়াল।

তাড়াতাড়ি ফিরবেন। দাদা আবার কথা বলার জন্যে ব্যস্ত হতে পারেন! অর্জুন দেখল গ্রামটা। ভারতবর্ষের বেশিরভাগ গ্রামের মতো এখানে অধিকাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন। জলপাইগুড়িতে বেশ কয়েকটা দোকান চালায় ওড়িশার লোক। রান্নার ঠাকুর এবং তাদের হেলপাররাও তাই। বেঁচে থাকার জন্যে তাদের কোথায়-না-কোথায় যেতে হয়েছে। হঠাৎ সামনে একগাদা বাচ্চাকে হইহই করে ছুটে যেতে দেখল সে। খানিকটা দূরে একটি পাগল চিৎকার করছে, তার হাতে পাথর।

বোঝা গেল, বাচ্চারা পাগলটাকে উত্যক্ত করছিল বলে সে খেপে পাথর তুলেছে। অর্জুন ছেলেগুলোকে ধমক দিতেই রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একটা লোক হেসে বলল, পাগলটা পাথর তোলে কিন্তু ছুঁড়ে মারে না।

যেদিন মারবে সেদিন এদের মাথা ফাটবে। বাচ্চাদের নিষেধ করেন না কেন?

নিষেধ করলে শুনবে নাকি! আপনি নতুন লোক বলে কিছু বলল না। এখান থেকে সরে গেল। কোন বাড়িতে এসেছেন?

তুলসীদাসজির বাড়িতে।

সঙ্গে সঙ্গে লোকটি দুটো হাত জড়ো করে মাথায় ঠেকাল, উনি কেমন আছেন?

ভাল।

তা হলে তো ভালই। লোকটি পাশের বাড়িতে ঢুকে গেল।

একটু অবাক হল অর্জুন। গ্রামের নির্জন পথে হাঁটতে হাঁটতে সে পুরো ব্যাপারটা ভেবে বুঝতেই পারছিল না, কেন তাকে এত দূরে ডেকে আনলেন তুলসীদাসজি। এখন পর্যন্ত তার কাছে এমন কোনও সমস্যা আনা হয়নি, যা এঁদের বিচলিত করছে। রাতের রাস্তায় কিছু রহস্যময় মানুষ এবং বিদ্যুতের তার কাটা ছাড়া আর কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা চোখে পড়ছে না। তুলসীদাসজি গত হলে তাঁর এই সম্পত্তির মালিক হবেন বিষ্ণুদাসজি। একথা তুলসীদাসজির মুখেই শুনেছে সে। আবার বিষ্ণুদাসজি বলেছেন, একই পিতার দুই সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তিনি সম্পত্তির অধিকার হারিয়েছেন। যদি পান তা হলে তুলসীদাসজির দয়ায় পাবেন। এজন্য তিনি অবশ্যই দাদার কাছে কৃতজ্ঞ। অতএব তাঁকে অপরাধী হিসেবে ভাবা যাচ্ছে না। অবশ্য আদৌ যদি এ বাড়িতে কোনও অপরাধ হয়ে থাকে। অর্জুনের শুধুই মনে হচ্ছিল, সে অনর্থক এখানে এসেছে!

হাঁটতে হাঁটতে সে অবাক হয়ে দেখল, সামনেই একটা ছোট্ট নদী। নদীর পারে বুনো গাছের ঝোঁপ, কিছুটা জঙ্গল। একটা সরু পায়েচলা পথ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নদীর গায়ে চলে গিয়েছে। সেই পথ দিয়ে এগিয়ে অর্জুন দেখল, নদীর জল প্রায় স্থির। স্রোত নেই বললেই চলে। চওড়াও বেশি নয়। তার উপর কচুরিপানায় ছেয়ে গিয়েছে ওধারটা। গ্রামের মানুষরা যে নদীকে অবহেলা করে, তা বুঝতে অসুবিধে হল না। অর্জুন একটা বড় গাছের ছায়ায় বসল। বসার পরেই সে একটা মাছরাঙাকে ছোঁ মেরে জল থেকে মাছ তুলে নিতে দেখল। পাখিটা উড়ে গেল ওপাশে। মাঝে মাঝে পাখি ডাকছে, এ ছাড়া কোনও শব্দ নেই। এই যে সে বসে আছে, খুব কাছে না এলে কেউ তাকে দেখতে পাবে না। হঠাৎ জলে শব্দ শুরু হল। সে মুখ বাড়িয়ে নদীর দিকে তাকাতেই দেখতে পেল, একটা মাঝারি সাইজের মাছ পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার মুখে বঁড়শি গেঁথে থাকায় সে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল। মাছটাকে যে ছিপ দিয়ে ধরল, সে তুলে নেওয়ায় জল আবার স্থির হল। কাছাকাছি কেউ মাছ ধরছে সে বুঝতেই পারেনি। মাছধরা দেখতে তার সব সময় ভাল লাগে। অর্জুন উঠে বুনো ঝোঁপ এড়িয়ে খানিকটা যেতেই অবাক হয়ে গেল। মাছের মুখ থেকে বঁড়শিটা খুলে নিচ্ছে সেই পাগলটা, যার পিছনে গ্রামের বাচ্চাগুলো লেগেছিল। যে মানুষ পাগল হয়ে গিয়েছে তার পক্ষে কি মাছ ধরা সম্ভব?

অর্জুন দেখল, লোকটি মাছটাকে মেরে ফেলল। তারপর ছিপের সুতো গুটিয়ে সেটাকে একটা ঝোঁপের মধ্যে এমনভাবে লুকিয়ে রাখল, যাতে কারও চোখে না পড়ে। এবার একটা বস্তা থেকে ছুরি বের করে আঁশ ছাড়িয়ে, পেট থেকে নাড়িভুড়ি বের করে নিল। তারপর চারটে পাথরের মাঝখানে শুকনো পাতা, শুকনো ডাল গুঁজে দিয়ে তার উপর লম্বা তিনটে ডাল দিয়ে মাচা তৈরি করে আগুন জ্বেলে দিল দেশলাই ঠুকে। এবার মাছটার দুটো টুকরো উপরের ডালে ঝুলিয়ে দেওয়ামাত্র আগুনের শিখা তাদের স্পর্শ করল। অর্জুন চুপচাপ দেখছিল। বারবিকিউ-এর এমন সহজ ব্যবস্থা যে লোক জানে, সে কখনওই পাগল হতে পারে না।

মাছ ঝলসে নিয়ে একটা পাতার উপর রেখে ঝোলা থেকে কৌটো বের করে লোকটি মাথা নাড়ল। তারপর কৌটো খুলে একচিমটে নুন নিয়ে ঝলসে যাওয়া মাছের উপর ছড়িয়ে দিল। অর্জুন লক্ষ করল, একেবারে কাছে না এলে এই ঝোঁপের আড়াল ভেদ করে ওকে দেখা সম্ভব নয়।

লোকটি যখন মাছের টুকরো থেকে কাঁটা বেছে মুখে পুরেছে তখন ওর চোখ বুজে গেল। বোঝা গেল, অনেকক্ষণ সে অভুক্ত রয়েছে। অর্জুন হাঁটু মুড়ে বসে খুব নিচু গলায় বলল, আপনার সঙ্গে আলাপ করতে পারি?

লোকটি চমকে এমনভাবে তাকাল যেন ভূত দেখেছে। অর্জুন হাসল, ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। আমি এখানে থাকি না। ক’দিনের জন্যে এসেছি। কিন্তু আপনি এখানে পাগলের ভান করে আছেন কেন?

লোকটি মুখ ঘুরিয়ে দ্রুত মুখে পোরা মাছ চিবিয়ে গিলে ফেলল। সম্ভবত সে ভাবতে চেষ্টা করছিল তার কী করণীয়!

অর্জুন বলল, আমি আপনার কোনও ক্ষতি করব না। কিন্তু আপনি এখানে ছদ্মবেশে আছেন। যেভাবে মাছ ধরে আগুন জ্বেলে সেঁকে নিলেন, তা কোনও পাগল কখনওই করতে পারে না।

এবার লোকটি ধীরেসুস্থে দ্বিতীয় টুকরোটা তুলে জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?

আমার নাম অর্জুন। পশ্চিমবাংলার জলপাইগুড়ি শহরে থাকি।

বাঙালি?

হ্যাঁ।

এখানে কার কাছে এসেছেন?

তুলসীদাসজির বাড়িতে। উনিই অনুরোধ করেছিলেন আসার জন্যে।

কবে এসেছেন?

গতকাল।

অসত্য বলছেন। গত কাল সন্ধের আগে কোনও নতুন মানুষ গ্রামে আসেনি।

আমি সন্ধের পরে এসেছিলাম। তখন খুব ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল।

আচ্ছা! কেউ আপনাকে বলেনি সন্ধের পর গ্রামে না ঢুকতে?

স্টেশনমাস্টার বলেছিলেন। কিন্তু কারণটা বলেননি।

লোকটি শেষ টুকরোটা খেয়ে নিয়ে বলল, আপনাকে অনুরোধ করছি, আজই ফিরে যান। এখানে থাকলে বিপদে পড়বেন। যেভাবে আপনি বুনন ঝোঁপের জঙ্গলে এসে আমার সঙ্গে কথা বলছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে, কৌতূহল একটু বেশি। এখানকার পরিস্থিতি কৌতূহলীদের পক্ষে বিপদজনক।

আমার মনে হচ্ছে আপনি এই গ্রামের বাসিন্দা নন?

পাগলদের কোনও ঘর থাকে না।

কিন্তু আমার পক্ষে চট করে যাওয়া সম্ভব নয়। তুলসীদাসজি আমার সাহায্য চেয়েছেন বলে আমি এখানে এসেছি। অর্জুন বলল।

আপনার সাহায্য? আপনি কীভাবে এখানে ওঁকে সাহায্য করবেন?

সত্যি কথা বলছি, আমি এখনও ওঁর সমস্যা কী তা জানি না। উনি বলার সুযোগ পাননি। সেটা জানার পর আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, থাকব না চলে যাব।

আপনার প্রফেশন কী?

অর্জুন হাসল, আপনি আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানলেন, আমি আপনার সম্পর্কে কিছুই জানি না। তাই বিশ্বাস করে বলব কী করে?

লোকটি উঠে দাঁড়াল। ঝোলাটাকে পিঠে তুলে নিয়ে বলল, দয়া করে পিছন পিছন আসবেন না। আর আমার সঙ্গে যে কথা বলেছেন, তা কাউকে জানাবেন না।

ঠিক আছে। কিন্তু আপনার কাছে কিছু জানতে চাই।

বলুন।

কাল রাতে আমি যখন গ্রামে ঢুকছিলাম, তখন চারটে লোক বৃষ্টির মধ্যে বর্ষাতি পরে প্রায় ভৌতিক কাহিনির চরিত্রের মতো গ্রামে ঢুকেছিল। যদি ভুল না দেখে থাকি, তারা তুলসীদাসজির বাড়ির ভিতরে চলে গিয়েছিল। লোকগুলো কারা, কী করে, তা আপনি জানেন?

না। সন্ধের পরে আমি রাধাকৃষ্ণের মন্দিরের ভোগ খেয়ে সেখানেই শুয়ে থাকি। আর অত রাতে তো জোর বৃষ্টি হচ্ছিল। মন্দিরের চাতাল থেকে বের হইনি।

প্রতি রাতে গ্রামের ইলেকট্রিক লাইন কারা কেটে দেয়?

পুরো গ্রামের নয়। একটা দিকের রাস্তায় বাড়িতে আলো জ্বলুক যারা চায়, তারাই লাইন কেটে দেয়।

তাদের আপনি চেনেন?

সেই চেষ্টাই তো করছি। লোকটি আর দাঁড়াল না।

অর্জুন চুপচাপনদীর দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। যারা কোনও অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকে, তারা কখনও নিজেদের কষ্ট দেয় না। অপরাধী কি, ভয়ে সারাদিন পাগল সেজে থাকবে? তারা ভাল খাবার না খেয়ে নদী থেকে মাছ ধরে পুড়িয়ে খাবে না। এমন হতে পারে, ওড়িশা সরকার তাদের গোয়েন্দা দপ্তরের কোনও অফিসারকে কি এখানে পাঠিয়েছেন?

বাড়ি ফিরে এল অর্জুন। ফিরেই বংশীর মুখে শুনতে পেল, তুলসীদাসজি ঘুমিয়ে আছেন। বিষ্ণুদাসজি এবং ডাক্তার পাশের গ্রামে গিয়েছেন। উপরে উঠে নিজের ঘরে যাওয়ার মুখে অর্জুন অবাক হল। যে দুই মহিলাকে তুলসীদাসজির পাশে সকালে বসে থাকতে সে দেখেছিল, তাঁদের একজন প্যাসেজের একপাশে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। অর্জুন নমস্কার জানালে মহিলা ইশারায় তাঁকে অনুসরণ করতে বললেন। ওঁর পিছনে হেঁটে সে চলে এল তুলসীদাসজির শোওয়ার ঘরে। ভিতরে ঢুকে দেখল, তিনি খাটের উপর বাবু হয়ে বসে মন দিয়ে একটা চিঠি পড়ছেন। অর্জুনকে দেখে একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ঘুরতে বেরিয়েছিলেন শুনলাম।

অর্জুন একটা চেয়ার টেনে বসল, হ্যাঁ, ওই নদীর দিকটায় গিয়েছিলাম।

নদীর দিকে? এখানে নদী আছে তা কে বলল আপনাকে?

না না, কেউ বলেনি। হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম। দেখে খারাপ লাগল। এত সুন্দর নদীটাকে অযত্নে ফেলে রাখা হয়েছে। অর্জুন বলল।

ওই নদীকে স্থানীয় মানুষ ‘বিষনদী’ বলে মনে করে। কেউ ওর জল ব্যবহার করে না, মাছ পর্যন্ত ধরে না। তাই যত্ন নেওয়ার কথাও ভাবে না।

বিষনদী কেন?

চোখ বন্ধ করলেন তুলসীদাসজি, তা ধরুন, বছর পঞ্চাশেক আগের কথা। তখন নদীর জল মানুষ ব্যবহার করত, মাছ ধরত। পরিষ্কার রাখা হত নদীকে। হঠাৎ এক ভোরে দেখা গেল, নদীর জল লাল হয়ে গিয়েছে। রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে জলের সঙ্গে মিশে। পুলিশ এসেও রহস্যের সমাধান করতে পারল না। এই গ্রামের মাইল আড়াই দূরে একটা গভীর জঙ্গল আছে। নদীটা তার ভিতর দিয়ে বয়ে আসে। ওই জঙ্গলে হিংস্র পশু ছাড়াও জলে কুমিরের বাস বলে মানুষ কাঠ কাটতেও ভিতরে ঢুকত না। পুলিশ গিয়ে সাতটা মৃতদেহ বের করে নিয়ে এল। তাদের কুপিয়ে খুন করে শেষ রক্তের ফোঁটা জলে। মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারা খুন করেছে পুলিশ জানতে পারেনি। কিন্তু পরের বছর ওই একই সময়ে রক্ত ভাসল জলে। তবে পরিমাণে অল্প। পুলিশ গিয়ে দুটো মৃতদেহ নিয়ে এল। তাদের শরীরের আঘাত আগের বছরের মতোই। তার পরের বছর আবার একই কাণ্ড। এই মৃতদেহগুলোর পরিচয় জানা নেই। সেই থেকে আর এমন ঘটনা ঘটেনি বটে, কিন্তু যে নদীর জলে রক্ত মিশে থাকে তা বর্জন করেছে এই গ্রামের মানুষ। এখানে সবাই কৃষ্ণের পূজারি। পূর্বপুরুষদের মুখে শুনেছি যে, স্বয়ং চৈতন্যদেব এই গ্রামে পদার্পণ করেছিলেন। আমরা সবাই খুব শান্তিতে ছিলাম। একটানা কথাগুলো বলে হাঁপাতে লাগলেন বৃদ্ধ। পাশে দাঁড়ানো একজন মহিলা তাঁর পিঠে চাপ দিয়ে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এতদিন শান্তি ছিল, এখন নেই কেন?

দ্বিতীয় মহিলা নিচু স্বরে বললেন, আজ অনেক কথা বলা হয়েছে। বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে না হয় কথা বলা যেতে পারে।

তুলসীদাসজি মাথা নাড়লেন, না। ইনি সেই উত্তরবাংলা থেকে আমার ডাকে এত দূরে এসেছেন। কথা তো বলতেই হবে। তোমরা চিন্তা কোরো না, আমি ঠিক আছি।

অর্জুন বলল, ঠিক আছে, আমরা বিকেলে কথা বললে এমন কিছু অসুবিধে হবে না।

হবে। এখন এই বাড়িতে আমরা ছাড়া কেউ নেই। আমি চাই না পঞ্চম ব্যক্তি আমার কথা শুনুক। একটু বসুন। তুলসীদাসজি ইশারা করতেই একজন মহিলা টেবিল থেকে ইনহেলার এনে দিলেন। সেটা গলায় ঢুকিয়ে কয়েকবার পাম্প করে জোরে শ্বাস ফেলে ভদ্রলোক বললেন, বাঃ, বেশ ভাল লাগছে।

দুই মহিলার একজন অন্যজনকে ইশারা করতে তিনি ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন। তুলসীদাসজি খুশি হলেন, ঠিক করেছ। কেউ এলে ও জানান দিতে পারবে।

খানিকটা সময় চুপ করে থেকে তুলসীদাসজি বললেন, আমার বয়স হয়েছে। প্রত্যেক মানুষকে একসময় মরতে হয়, আমিও মরব, একথা আমার জানা। কিন্তু আমি অপঘাতে মরতে চাই না।

আপনার কি ভয় হচ্ছে সেরকম কিছু হতে পারে?

হ্যাঁ। আমি অ্যাজমার পেশেন্ট। কিন্তু আমার পূর্বপুরুষেব কারও অ্যাজমা ছিল না। আমার ভাইয়েরও না। বছর পাঁচেক আগে আমার দুটো হাতে একজিমা হয়েছিল। কীভাবে হল জানি না। ডাক্তার প্রথমে ভেবেছিলেন অ্যালার্জি। কিছুতেই সারছিল না। বছর দুয়েক ভুগলাম। তখন হাতের চেহারা এমন যে, বাইরের লোককে দেখাতে লজ্জা হয়। তখন বিষ্ণু ফিরে এসেছে। ও আমাকে ভুবনেশ্বরে এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। তিনি সব দেখেশুনে ওষুধ দিলেন। দশদিনের মাথায় সব একজিমা উধাও হয়ে গেল। হাত একদম .. পরিষ্কার। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতে শ্বাসের কষ্ট শুরু হল। লোকাল ডাক্তার দেখে বললেন, আপনার অ্যাজমা হয়েছে। ভুবনেশ্বরে গেলাম। সেখানেও তাই শুনলাম। এই যে ডাক্তার দয়া করে এখানে এসেছেন, তিনি দেখে বললেন, অতিরিক্ত স্টেরয়েড খাওয়ার জন্যে আমার অ্যাজমা হয়েছে। নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে, শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে ইনহেলার ব্যবহার করতে হবে। তখন থেকে ওঁর চিকিৎসায় আছি। একটা অসুখ আর-একটা অসুখকে টেনে নিয়ে আসে। আমার শরীর এখন অসুখে অসুখে জীর্ণ।

আমি শুনেছি ডাক্তাররা সচরাচর বাধ্য না হলে স্টেরয়েড দিতে চান না। কিন্তু এর সঙ্গে অপঘাতে মৃত্যুর তো সম্পর্ক নেই। অর্জুন বলল।

আপাতদৃষ্টিতে নেই। বিষ্ণু এখানে আসার আগে সেরকম ভাবনা আমার মনে ছিল না। ক্রমশ মনে হচ্ছে, তার উপস্থিতি কারও বা কাদের পছন্দ হচ্ছে না। সে এখানে ফিরে আসার পর এবাড়ি তো বটেই, এই গ্রামের আবহাওয়া বদলে গিয়েছে। সন্ধে নামলেই মনে হয়, মৃত্যু থাবা বাড়াচ্ছে। গ্রামের মানুষজন ভূত-পেতনিতে বিশ্বাস করে। তাদের অনেকেই নাকি রাতে ভৌতিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে। তারপর থেকে কেউ রাত নামলে আর বাড়ির বাইরে ভয়ে বের হয় না। কিন্তু ভূত আর যাই পারুক, ইলেকট্রিকের তার কাটতে পারবে না। আমার বিশ্বাস, কোনও একটি দল বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এই গ্রামকে দখল করতে চাইছে। এখনও তারা দিনেরবেলায় দেখা দেয়নি। আমার এই বাড়ির বাগানে তাদের রাতে আসা-যাওয়া আছে। কী চাইছে তারা আমি জানতে চাই। তাদের উদ্দেশ্য কি আমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া? তাই যদি হয়, যে-কোনও রাতেই তারা সেটা করতে পারত। তা হলে তাদের উদ্দেশ্য কী? তাকালেন তুলসীদাসজি।

আপনি কি সেই কারণেই আমাকে এখানে এনেছেন?

হ্যাঁ।

ঠিক আছে। আমাকে কয়েকটা দিন সময় দিলে…! অর্জুন অন্য কথায় গেল, আপনার বাবা বিষ্ণুদাসজিকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। অথচ আপনি তাকে এতদিন পর ফিরিয়ে এনেছেন? ব্যাপারটা জানতে পারি?

তুলসীদাসজি আবার ইনহেলার ব্যবহার করলেন। ইশারায় পাশে দাঁড়ানো। মহিলাকে বললেন কথা বলতে। মহিলা বললেন, অল্প বয়সে কুসংসর্গে পড়েছিল বিষ্ণু। ভুবনেশ্বরে পড়তে গিয়ে যাদের সঙ্গে মিশত, তারা মোটেই ভাল ছেলে ছিল না। এসব কথা এ বাড়িতে কেউ জানত না। জানল, যখন পুলিশ এল। তারা দু’জন অপরাধীকে খুঁজছে, যাদের বন্ধু হল বিষ্ণু। বিষ্ণুকেও পাওয়া যাচ্ছে না। সে হস্টেলে নেই। খোঁজার কারণ হল, বিষ্ণুর দুই বন্ধু একজন বড় ব্যবসায়ীকে খুন করে অনেক টাকা লুঠ করেছে। পুলিশ চলে যেতে কর্তাবাবা গুম হয়ে রইলেন। কারও সঙ্গে কথা বললেন না। ঠিক তিন রাত পর বিষ্ণু ওই দুই বন্ধুকে নিয়ে হাজির হল এখানে। দাদার হাতে-পায়ে ধরে বাগানের পিছনে গুদামঘরে গিয়ে লুকিয়ে থাকল। কর্তাবাবা এই খবর পাননি। তিনি বাগানের ওদিকটায় যেতেন না। দরোয়ান, কাজের লোকদের দাদা নিষেধ করে দিলেন, তাঁকে বিষ্ণুর খবর দিতে। লুকিয়ে দু’বেলা খাবার দেওয়া হত ওদের। কিন্তু দু’জন খুনি অপরাধী এই বাড়িতে লুকিয়ে থাকবে তাও দাদা মেনে নিতে পারছিলেন না। ওঁর চাপেই বিষ্ণু ছেলে দুটোকে এখান থেকে চলে যেতে বলল। তারা চলে যায় বাধ্য হয়ে। বিষ্ণু রাতে বাড়ির বাইরে যেত। তখন এখানকার স্টেশনমাস্টার ছিলেন একজন তামিল ভদ্রলোক। তিনি পুলিশকে খবর দিয়ে ওকে ধরিয়ে দেন। বিষ্ণু এই গ্রামের স্টেশন থেকেই ধরা পড়েছে জেনে কর্তাবাবা খেপে গেলেন। তিনি ওকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করলেন। শুধু তাই নয়, ভুবনেশ্বরে গিয়ে উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে ঘোষণাটাকে আইনগত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মুশকিল হল, যেহেতু এসব সম্পত্তি কর্তাবাবা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন, তাই তিনি চাইলেও তাঁর ছেলেমেয়েদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারেন না। তা ছাড়া ত্যাজ্যপুত্র ব্যাপারটা আইন ঠিকঠাক মেনে নেবে বলে উকিলবাবুর মনে হল না। কর্তাবাবা খুব ভেঙে পড়লেন। দাদা তখন উকিল দিয়ে বিষ্ণুর হয়ে মামলা লড়ে শেষ পর্যন্ত ছাড়িয়ে আনতে পারলেন। দাদা কর্তাবাবাকে অনেক বোঝানোর পর তিনি বিষ্ণুকে থাকতে দিলেন একটা শর্তে। বিষ্ণুকে স্ট্যাম্পপেপারে লিখে দিতে হবে, এই পরিবারের সম্পত্তির উপর তার যাবতীয় অধিকার সে স্বেচ্ছায় ত্যাগ করছে। কোনওদিন সে সামান্য অংশ দাবি করবে না। বিষ্ণু রাজি হল। কর্তাবাবা বিষ্ণুর সঙ্গে কথা বলতেন না। দাদা তাকে পড়াশুনো আবার শুরু করার জন্যে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। সেখানকার কলেজে ভরতি হয় সে। দাদাই টাকা পাঠাতেন মানিঅর্ডার করে। একবার গ্রামের একজন কলকাতায় যাচ্ছে জেনে তার হাতে দাদা টাকা পাঠান বিষ্ণুকে দেওয়ার জন্যে। সে ওখান থেকে ফোন করে জানায়, বিষ্ণু হস্টেলে থাকে না। প্রতি মাসের প্রথমে এসে মানিঅর্ডারের টাকা নিয়ে যায়। খবর নিয়ে জানা গেল যে, বিষ্ণু খিদিরপুর অঞ্চলে থাকে। একটা বস্তিতে। সেখানে সে বিয়ে করে সংসার করছে। খবর শোনামাত্র দাদা কলকাতায় যান। হস্টেলের দরোয়ানের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে বিষ্ণুর বাড়িতে গিয়ে আবিষ্কার করেন, ওর স্ত্রী তেলুগু। ধরা পড়ে বিষ্ণু মুখ নিচু করে বসে থাকে। দাদা ফিরে আসেন, কিন্তু খবরটা কর্তাবাবাকে জানালেন না। তারপর বেশ কিছুকাল ওর কোনও খবর এখানে আসেনি। কর্তাবাবা দেহ রাখলেন। তিনি অনেক চেষ্টা করেও দাদাকে বিয়ে করতে রাজি করাতে পারেননি। আমি বিধবা হওয়ার পর বাবা আমাকে এখানে এনেছিলেন। দিদিকেও দাদা নিয়ে এলেন ওর স্বামী চলে যাওয়ার পর। ভদ্রমহিলা কথা শেষ করলেন।

কিন্তু বিষ্ণুদাসজিকে আবার খুঁজে পেলেন কী করে? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

তুলসীদাসজি বোনের দিকে তাকালেন। ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন, ও হায়দরাবাদের জেলে ছিল। আমার শ্বশুরবাড়ির গ্রামের একজন ওই জেলে রাঁধুনির কাজ করত। বিষ্ণুর কথা জানতে পেরে সে আমাদের জানায়। খোঁজখবর নিয়ে দাদা জানতে পারেন, খবরটা সত্যি। ছ’মাসের জেল হয়েছিল তার। মেয়াদ শেষ হতে দু’সপ্তাহ দেরি ছিল। দাদা হায়দরাবাদে চলে যান। দাদাকে দেখে ভেঙে পড়ে বিষ্ণু। বলে, তিনি যদি আশ্রয় দেন তা হলে সে বাকি জীবন সৎপথে থাকবে। মেয়াদ শেষ হলে দাদা বিষ্ণুকে এখানে নিয়ে আসেন।

এখানে আসার পর উনি কি কখনও বাইরে গিয়েছেন?

একা যায়নি। দাদাকে নিয়ে চিকিৎসার জন্যে ভুবনেশ্বরে গিয়েছে। ও যে পুরোপুরি বদলে গিয়েছে, তাতে আমাদের কারও সন্দেহ নেই।

অর্জুন মাথা নাড়ল, ওঁর স্ত্রী সঙ্গে আসেননি?

ওদের নাকি ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে।

আইনসম্মতভাবে?

তা জানি না। ও বলেছে, আর কোনও সম্পর্ক নেই।

এবার তুলসীদাসজি বললেন, এই হল এ বাড়ির ইতিহাস। আমরা খুব শান্তিপ্রিয় মানুষ। কিছুদিন হল যে ভৌতিক কাণ্ড এই গ্রামে ঘটছে, তার সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। আমার শুধুই মনে হচ্ছে, আয়ু আর বেশিদিন নেই। কিন্তু আমি অপঘাতে মারা যেতে চাই না।

অর্জুন সোজা হয়ে বসল, এবার আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?

স্বচ্ছন্দে করতে পারেন।

আপনি ডাক্তারকে ভুল বোঝাতে চেষ্টা করছেন কেন?

আমি কী ভুল বোঝাব?

ডাক্তারের বিশ্বাস, আপনি অতীতের কিছু কথা স্পষ্ট মনে করতে পারেন, কিন্তু গত কাল কী বলেছিলেন বা করেছিলেন তা আজ কিছুতেই মনে করতে পারেন না। এটা একটা ভয়ংকর অসুখ। এরকম পেশেন্টকে সুস্থ করা প্রায় অসম্ভব। এরকম পেশেন্টরা ধীরে ধীরে কথা বলা বন্ধ করেন। বললেও, খুব কাছের মানুষকে চিনতে পারেন না। আপনার ক্ষেত্রে এরকম হলে আপনি ওঁর নামও ভুলে যাবেন, উনি কে তা নিয়ে একটুও ভাববেন না। ডাক্তার মনে করছেন আপনি সেদিকে এগোচ্ছেন। তাঁর এই মনে করাটা সম্ভব হয়েছে। আপনার আচরণের জন্যে। আপনি নিশ্চয়ই ওঁকে বিভ্রান্ত করতে অভিনয় করছেন। আমি যে গত রাতে এই বাড়িতে এসেছি, তা আপনার বেমালুম ভুলে যাওয়ার কথা। কিন্তু আজ সকালে আপনি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন যে, ভুলে যাননি। আপনার অসুখের অন্যতম কারণ নাকি টেনশন। আমি এসেছি খবর পেয়ে এক মুহূর্তে টেনশন এত লোপ পেয়ে গেল যে, কাল রাতে ঘুমের ওষুধ ছাড়াই আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ওঁরা খুশি হয়েছেন খবরটা শুনে। কিন্তু এটা তো সত্যি নয়!

মাথা নাড়লেন তুলসীদাসজি, ঠিক। একদম ঠিক। আসলে আমি এখন আমার বোনদের ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি যত বলি ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ো না, ওরা কানেই তুলছে না।

হয়তো ঘুমের ইঞ্জেকশনই আপনাকে সাহায্য করতে পারে। আপনি যদি ভুল সিম্পটম বলে ডাক্তারকে বিভ্রান্ত করেন, তা হলে…! কথা শেষ করল না অর্জুন।

এতে কিন্তু ক্ষতি হচ্ছে না। উলটে মজাই পাচ্ছি।

কীরকম?

ডাক্তার, ভাই, কাজের লোকজন মনে করছে যে, সকালের কথা বিকেলে ভুলে গিয়েছি। তাই যে-যার ইচ্ছেমতো আমাকে বোঝাচ্ছে। হাসলেন তুলসীদাসজি।

ভদ্রমহিলা বললেন, আসল কথাটা বলা হয়নি…!

তুমি বলো। তুলসীদাসজি বললেন।

এই যে ঘটনাগুলো গ্রামে ঘটছে, সেগুলো কি ভৌতিক কাণ্ড বলে মনে হয়? ভদ্রমহিলা অর্জুনের দিকে তাকালেন।

দেখুন, ইলেকট্রিকের লাইন কেটে ফেলা আর রাতবিরেতে রাস্তায় রহস্যজনক কিছু মানুষের চলাফেরা ছাড়া তো অন্য কোনও ঘটনার কথা আমি শুনিনি। কোনও খুনখারাপি অথবা মারধরের মতো ঘটনা কি ঘটেছে? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

না।

ঠিক আছে। আমাকে একটু ভাবতে হবে। অর্জুন উঠে দাঁড়াল।

এই সময় দ্বিতীয় মহিলা ঘরে ফিরে এলেন, হরিরাম ফিরে এসেছে।

তুলসীদাসজির মুখে হাসি ফুটল, ওষুধ পেয়েছে?

গেট পেরিয়ে ঢুকতে দেখলাম। নিশ্চয়ই পেয়েছে।

তুলসীদাসজি বললেন, আপনাকে যেসব কথা বললাম, তা যেন গোপন থাকে।

নিশ্চয়ই, এটা আমার পেশা।

আপনার কোনও অসুবিধে হলে বংশীকে বলবেন।

আপনি চিন্তা করবেন না।

হরিরাম ঢুকল। তাকে খুব পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছিল। দ্বিতীয় মহিলা একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললেন, বোস। ওষুধ পেয়েছিস?

হ্যাঁ, পেয়েই একটা লরি ধরে চলে এলাম। কেমন আছেন?

প্রশ্নটা তুলসীদাসজিকে। তিনি জবাব দিলেন না। গম্ভীর মুখে অন্য দিকে তাকালেন।

দ্বিতীয় মহিলা একটু জোরে তুলসীদাসজিকে বললেন, হরিরাম ভুবনেশ্বর থেকে আপনার ওষুধ এনে দিয়েছে।

কেন? ওষুধ কেন? কী হয়েছে ওর?

দ্বিতীয় মহিলা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, হরিরাম হাত তুলে তাঁকে থামিয়ে বলল, থাক। ভুলে গিয়েছেন এর মধ্যেই।

প্রথম মহিলা বললেন, তুই যা। হাতে-মুখে জল দিয়ে কিছু খেয়ে বিশ্রাম কর। কাল থেকে অনেক ধকল গিয়েছে তোর।

হরিরাম উঠল। অর্জুনও ওর সঙ্গে বেরিয়ে এল। হরিরাম হাসল, তা হলে আপনি ওই দুর্যোগের মধ্যে বাড়ি খুঁজে পেয়েছেন?

হাঁটতে হাঁটতে অর্জুন বলল, আপনি যেভাবে ডিরেকশন দিয়েছিলেন, তাতে ভুল করার কোনও সুযোগ ছিল না।

ওরা সিঁড়ির কাছে চলে এসেছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল বংশী। বলল, আপনার জলখাবার ঠান্ডা হয়ে আসছে। ঘরে দিয়ে দেব?

দাও। অর্জুন বলল।

আমাকেও দাও। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। পরে হাত-মুখ ধোব।

তা হলে তুমি নতুনবাবুর ঘরে গিয়ে বসো। বংশী নীচে নেমে গেল।

হরিরাম অর্জুনের সঙ্গে ঘরে ঢুকল। টেবিলের পাশে চেয়ার টেনে নিয়ে বসে হরিরাম জিজ্ঞেস করল, রাস্তায় নিশ্চয়ই ঝড়-বৃষ্টি পেয়েছিলেন? কোনও মানুষের দেখা পাওয়ার কথা নয়। আপনি দেখছি বেশ লাকি লোক।

ভুবনেশ্বরে কখন পৌঁছোলেন?

ভোররাতে। একটা দোকান চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। সেখানেই ওষুধ পেলাম।

আপনি কিন্তু তুলসীদাসজিকে ওষুধ দিতে ভুলে গিয়েছেন?

কী করে দেব? ওষুধ তো আমার কাছে নেই।

বুঝলাম না। আপনি বললেন ওষুধ এনেছেন।

হ্যাঁ। গ্রামে ঢুকতেই ডাক্তারবাবু আর ছোটমামার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ওষুধ পেয়েছি শুনে ডাক্তারবাবু দেখতে চাইলেন। আমি প্যাকেটটা ওঁকে দিতে উনি নিজের কাছে রেখে দিলেন। হরিরাম বলল।

ও। উনি ওখানে কী করছিলেন?

বোধহয় বেড়াতে বেড়াতে ওদিকে গিয়েছিলেন।

ওষুধের নাম আপনার মনে আছে?

নাম? না। খটোমটো শব্দ। ওষুধ মানে ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল নয়, ইঞ্জেকশন। ও হো, দাঁড়ান, যে কাগজে ডাক্তারবাবু প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছিলেন সেটা আমার কাছেই আছে। হরিরাম পকেট থেকে একটা পার্স বের করে তার ভিতর থেকে প্রেসক্রিপশনের কাগজটা তুলে এগিয়ে ধরল।

ওটা নিয়ে ভাঁজ খুলল অর্জুন। ডাক্তারের প্যাডে তুলসীদাসজির নাম লেখা। ইঞ্জেকশনের নাম পড়তে গিয়ে হিমশিম খেল সে। এত জড়ানো লেখা যে অক্ষরগুলো স্পষ্ট হচ্ছিল না। ডাক্তারদের হাতের লেখা একমাত্র ওষুধবিক্রেতারাই পড়তে পারে। অনেক চেষ্টায় প্রথম অক্ষরটা ‘এন’ বলে মনে হতে অর্জুন অনুমান করল, ওটা নিওরো জাতীয় কোনও শব্দ। সে জিজ্ঞেস করল, ক্যাশমেমো নেই?

ও হ্যাঁ। আছে। বুকপকেট থেকে সেটা বের করে দিল হরিরাম।

ক্যাশ মেমোতেও জড়ানো লেখা, তবু তার অনুমানই ঠিক। নিওরো পড়তে অসুবিধে হচ্ছে না। কদমতলার চৌধুরী মেডিক্যাল স্টোর্সে বসে রামদার সঙ্গে আড্ডা মারতে মারতে অনেক ওষুধের নাম সে শুনেছে। নার্ভের অসুখে বোধহয় এই ধরনের ট্যাবলেট বা ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়।

বংশী এল ট্রে-তে দুটো প্লেটে লুচি এবং তরকারিতে সাজিয়ে। বলল, ক্ষীর আনছি। চা খাবেন তো?

অর্জুন মাথা নাড়ল, চা খাব। কিন্তু আমার জন্যে ক্ষীর আনতে হবে না।

হরিরাম হেসে ফেলল, আমি কিন্তু না বলব না।

হরিরামকে পছন্দ হল অর্জুনের। আপাতদৃষ্টিতে ওকে বেশ সহজ-সরল বলে মনে হচ্ছিল। খেতে খেতে অর্জুন আচমকা প্রশ্ন করল, আপনি ভূত আছে বলে মনে করেন?

নেই ভাবলে খারাপ লাগত। যেমন, ভগবান নেই বললে মায়ের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। কিন্তু এখন এই গ্রামে যা হচ্ছে, তাতে রাত নামলেই মনে হয় ভূত আছে।

মনে হয়? হরিরাম জিজ্ঞাসা করল, কাল এ বাড়িতে আসার সময় দ্যাখেননি, চারপাশ কীরকম ভয়ংকর ভৌতিক হয়ে উঠেছিল। তার উপর কাল তো বৃষ্টি পড়ছিল।

আপনি অল্প বয়সে এই বাড়িতে এসেছেন?

অনেকবার। প্রত্যেক গরমের ছুটিতে মায়ের সঙ্গে চলে আসতাম।

তখন এখানকার রাতগুলোকে ভৌতিক বলে মনে হত?

দুর! তখন সব কিছু স্বাভাবিক ছিল।

খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। হরিরাম ক্ষীর নিল বলে চা ফিরিয়ে দিল। অর্জুন চা খেয়ে উঠে দাঁড়াল, আপনি বিশ্রাম করুন, আমি একটু ঘুরে আসি।

আপনি যদি চান আমি সঙ্গে যেতে পারি!

না, থাক।