২. হাবু দাসের মাথাটি ভারী পরিষ্কার

রাত থেকেই হাবু দাসের মাথাটি ভারী পরিষ্কার লাগছে। একদম ঝকঝকে পরিষ্কার। কোথাও কোনও দাগ বা আঁচড় অবধি নেই। এই যেমন সে একটা ঘরে একটা বিছানায় শুয়ে আছে, কিন্তু এটা কার ঘর, কার বিছানা এসব কিছুই তার মনে পড়ছে না। এমনকী এটা কোন জায়গা, তার নিজের নামটাই বা কী, বা তার বাবার নামই বা কী ছিল এ সবই মাথা থেকে বেমালুম মুছে গেছে। তাতে অবশ্য হাবুর বেশ আনন্দই হচ্ছে। তার সারা শরীরে কে বা কারা যেন নানারকম পট্টি, পুলটিশ আর ব্যান্ডেজ লাগিয়েছে। সেটাও হাবুর খুব একটা খারাপ লাগছে না। ব্যাপারটা সাজগোজ বলেই মনে হচ্ছে তার। হাত পা মাথা ব্যথায় যে টনটন করছে সেটাও তেমন অপছন্দ করতে পারছে না হাবু। টনটন না করা কি ভাল? হাত পা আছে অথচ টনটন করছে না, সেটা তো ভাল কথা নয়! টনটন না করলে হাত পা যে আছে তা বোঝাই বা যাবে কী করে? তাই হাবুর বেশ ফুর্তিই হচ্ছিল। ফুর্তির চোটে রাতে ঘুমই হল না মোটে।

সকালে খুব আহ্লাদের সঙ্গে বিছানায় বসে ছিল হাবু। আলো ফুটেছে, পাখি ডাকছে, চারদিকে একটা হাসিখুশি ভাব। জায়গাটা ভারী নতুননতুন লাগছে। নিজেকেও ভারী নতুন লাগছে তার। তবে নামটা মনে পড়ছে না। তাতে অবশ্য ভালই হয়েছে। নতুন একটা নাম ঠিক করে নিলেই হবে।

নিজের কী নাম রাখা যায় তা খুব ভাবতে লাগল হাবু। আচ্ছা, সকাল সরকার নামটা কেমন? মন্দ নয়, তবে কোকিল কাহার নামটা কি আরও একটু ভাল? আচ্ছা, জানালা পাল কি খুব খারাপ নাম? কিংবা ভোরের আলো সেন? পাশের আতাগাছে বসে একটা কাক খুব ডাকাডাকি করছে। কানখাড়া করে শুনে খুশি হল হাবু, হ্যাঁ বায়স বসু নামটাও তো খারাপ শোনাচ্ছে না!

এমন সময় দরজা ঠেলে একটা লোক ঘরে ঢুকল। বেশ লোক। পরনে হেটো ধুতি, গায়ে ফতুয়া, কাঁধে গামছা, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি।

হাবু লোকটাকে ডেকে বলল, “ওহে বাপু, বলল তো কোন নামটা আমাকে মানাবে! বেশ ভেবেচিন্তে বোলো কিন্তু। সকাল সরকার, কোকিল কাহার, জানালা পাল, ভোরের আলো সেন, বায়স বসু।”

লোকটা অবাক হয়ে বলে, “সে কী গো হাবুদাদা, পিতৃদত্ত নামটা থাকতে আবার নতুন নাম রাখতে যাবে কেন? হাবু নামটা তো খারাপ নয়। দিব্যি নাম।”

হাবু নাক সিঁটকে বলল, “এঃ, আমার নাম হাবু নাকি?”

“তবে! এ নামেই তো সবাই তোমাকে চেনে!” হাবু ভাবল, এ লোকটা বোধ হয় অনেক খবর রাখে, এর কাছ থেকেই কায়দা করে সব জেনে নিতে হবে।

হাবু চোখ কুঁচকে বলল, “আচ্ছা, আমার নাম যদি হাবু হয়, তা হলে তোমার নামটা কী হবে?”

লোকটা ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “কাল কদম ওস্তাদের অমন আছাড়টা খেয়েও তোমার মশকরা করতে ইচ্ছে যাচ্ছে? ধন্যি মানুষ বটে তুমি? কাল অমন কুরুক্ষেত্তর হল, তায় সারারাত আমাদের কারও চোখে ঘুম নেই। ওই কালাপাহাড় বিভীষণ এখন কাকে ধরে, কাকে খায় সেই চিন্তাতেই ভয়ে মরছি।

এ সময়ে কি মশকরা ভাল লাগে গো হাবুদাদা?”

হাবু খিকখিক করে হেসে বলল, “পারলে না তো!”

“কী পারলুম না?”

“বলতে পারলে না তো যে, আমার নাম যদি হাবু হয় তা হলে তোমার নাম কী হবে? বলতে পারলে বুঝব তুমি বাহাদুর বটে।”

“আর বাহাদুর হয়ে কাজ নেই বাপু। যা কাল দেখলুম তাতে বাপের নাম ভুলে যাওয়ার জোগাড় তো নিজের নাম।”

হাবু মিটমিট করে চেয়ে বলল, “ভুলে গেছ তো! তা হলে বাপু, ভাল দেখে নিজের একটা নাম রাখলেই তো হয়। আচ্ছা, পাঁচকড়ি নামটা কেমন বলো তো!”

লোকটা ভারী করুণ মুখ করে বলল, “আহা, কতকাল ও নামে কেউ ডাকেনি আমাকে! পিতৃদত্ত নাম, কিন্তু তার ব্যবহারই হয় না। সবাই ‘পাঁচু পাঁচু’ বলে ডেকে ডেকে ও নামটা বিস্মরণই করিয়ে দিয়েছে। তাও ভাল, নামটা মনে করিয়ে দিলে। কিন্তু তুমি জানলে

কী করে বলো তো! এ নাম তো কারও জানার কথা নয়।”

হাবু খুব খিকখিক করে হাসতে লাগল। বলল, “আচ্ছা, এবার তোমাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করছি। খুব ভেবেচিন্তে বলবে কিন্তু! আচ্ছা, বলো তো, আমার নাম হাবু আর তোমার নাম পাঁচু হলে এ বাড়িটা কার?”

পাঁচু হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, “এ আবার কোনদিশি ধাঁধা গো হাবুদাদা? এ হল কর্তাবাবুদের সাতপুরুষের ভিটে। বাচ্চা ছেলেও জানে। রাঘব চৌধুরীর বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলে রাস্তার গোরুটাও পথ দেখিয়ে দেবে।”

হাবু হাততালি দিয়ে বলল, “বাঃ, এই তো পেরেছ। এবার একটা খুব শক্ত ধাঁধা জিজ্ঞেস করছি কিন্তু। ঘাবড়ে যেও না, মাথা ঠাণ্ডা রেখে জবাব দিও। আচ্ছা বলো তো আমার নাম হাবু, তোমার নাম

পাঁচু আর বাড়িটা রাঘববাবুর হলে এ গাঁয়ের নামটা কী?”

“বলি, তোমার মাথাটাই গেছে নাকি? গত দেড় বছর ধরে তো হাট গোবিন্দপুরে থানা গেড়ে আছে, রাতারাতি কি গাঁয়ের নাম পালটে যাবে?”

একগাল হেসে হাবু বলল, “না হে, তোমাকে মেডেল দেওয়া উচিত। তুমি তো দেখছি ধাঁধার ধন্বন্তরি!”

“এখন রসিকতা রেখে খাবারটা খেয়ে নাও। রোজ তোমার বরাদ্দ সকালে কুড়িখানা রুটি। আজ মোটে পনেরোখানার বেশি হল না, ওই যক্ষটাই তো সকালে সত্তরখানা রুটি সাবাড় করল। আমরা ভয়ে কেউ রাটি কাড়িনি।”

কিন্তু খাবারের কথা শুনেও মোটেই চঞ্চল হল না হাবু। খাবে কী, আজ তার এত ফুর্তি হচ্ছে যে, ফুর্তির চোটে খিদেই উধাও। পাঁচু চলে যাওয়ার পর সে উঠে পড়ল। মাজায় ব্যথা, ঘাড় টনটন, হাত পা ঝনঝন, তবু হাবুর গ্রাহ্য নেই। এই নতুন জায়গাটা ভাল করে চিনে নিতে হবে। লোকজনের সঙ্গেও আলাপ সংলাপ করতে হবে। ভাব-ভালবাসা করাটা খুবই দরকার। তার যে বড়ই আনন্দ হচ্ছে।

বাইরে বেরিয়েই সামনে একজন লোককে পেয়ে তাকে একেবারে বুকে টেনে নিয়ে হাবু বলল, “এই যে ভায়া, কতকাল পরে দেখা! আচ্ছা, একটা ভারী মজার প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে? খুব হুঁশিয়ার হয়ে দেবে কিন্তু। ভুল হলেই নম্বর কাটা যাবে। আচ্ছা, বলো তো, আমার নাম যদি হাবু হয়, পাঁচুর নাম যদি হয় পাঁচু, আর এটা যদি রাঘববাবুর বাড়ি হয় আর গাঁয়ের নাম যদি হয় হাট গোবিন্দপুর, তাহলে তোমার নামটা কী হবে! বেশ শক্ত প্রশ্ন কিন্তু।”

লোকটা খুব গম্ভীর হয়ে কর গুনে গুনে অনেকক্ষণ ধরে হিসেব করল। একবার যেন তোর ঘরের নামতাও বলল। এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারের কথাও বিড় বিড় করে নিল। একবার মাথা ঝাঁকাল, দুবার ঘাড় চুলকে তারপর হঠাৎ উজ্জ্বল মুখে বলল, “হয়েছে! তোমার নাম হাবু, পাঁচুর নাম পাঁচু, এটা রাঘববাবুর বাড়ি আর গায়ের নাম হাট গোবিন্দপুর হলে আমার নামটা দাঁড়াচ্ছে গোলাপ রায়।”

“বাঃ বাঃ! দশে তোমাকে দশ দিলুম। বুঝলে! দশে দশ।”

গুণেন জানত, একদিন তার গলায় সুর খেলবেই। তার ভিতরে সুরের বারুদ একেবারে ঠাসা। শুধু একটা ফুলিঙ্গের অপেক্ষা ছিল। ওই স্ফুলিঙ্গের অভাবেই তার গলার কামানটা কিছুতেই গর্জে উঠতে পারছিল না। গান সে গাইত বটে, কিন্তু ভিতরে যে সুরের ঠাসাঠাসি তা বেরিয়ে আসতে পারল কই? এই নিয়ে ভারী দুঃখ ছিল গুণেনের কিন্তু বিশ্বাস ছিল একদিন ভগবানের আশীর্বাদ ঠিকই নেমে আসবে তার ওপর। তখন সুরসপ্তক বেরিয়ে এসে চারদিক কাঁপিয়ে দেবে।

কখন যে কার ভাগ্য খোলে তার কিছু ঠিক নেই। ভগবানকে দোষ দিয়ে তো লাভ নেই। তাঁর পাঁচটা কাজ আছে। ব্যস্ত মানুষ। একটা সেরে তবে তো আর একটায় হাত দেবেন! তাই আশায় আশায় অপেক্ষা করছিল গুণেন। কবে ভগবানের হাত খালি হয়, কবে তিনি গুণেনের দিকে তাকান।

গতকাল সন্ধেবেলাতেই ভগবান তাঁর দিকে তাকালেন। আর সে কী তাকানো বাপ রে! রক্ত জল হয়ে যায়। তাঁর আশীর্বাদটাও নামল একেবারে বজ্রের মতো। ঠিক বটে আশীর্বাদের ধরনটা তখন ঠিক পছন্দ হয়নি গুণেনের। কিন্তু পৃথিবীর উপকারী জিনিসগুলোর বেশির ভাগেরই স্বাদ মোটেই ভাল হয় না। এই যেমন নিমপাতা, গ্যাঁদাল, উচ্ছে, হিঞ্চে, কাঁচকলা, কবিরাজি পাঁচন কি কুইনাইন কিংবা ইনজেকশন। তাই আশীর্বাদটা যখন গুণেনের ওপর এসে পড়ল তখন গুণেনও ওটা আশীর্বাদ বলে বুঝতেই পারেনি। পাছে আর পাঁচজনে টের পায় এবং তাদের চোখ টাটায়, সেইজন্যই বোধ হয় ভগবান আশীর্বাদটাকে একটা ঠোকনার মতো করে দিলেন।

কাল জ্যোৎস্না রাত্তির ছিল। সন্ধেবেলা ছাদে উঠে গুণেন গুগুন করে খানিকক্ষণ গলাটলা খেলিয়ে একটা চেঁচামেচি আর ধুপধাপ শব্দ শুনে নীচে নেমে এসে দেখে, হাবু পালোয়ানের ঘরে দক্ষযজ্ঞ হচ্ছে। হাবু মেঝের ওপর চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে, লোকজন সব কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা আর অন্যধারে স্বয়ং শিব দাঁড়িয়ে। সত্যি কথা বলতে কী, শিবের সঙ্গে এঁর কিছু কিছু তফাত ছিল। যেমন জটা ছিল না, বাঘছাল ছিল না, মাথায় সাপ ছিল না, গায়ে ভস্ম মাখা ছিল না। দেবতারা তো আর স্বমূর্তিতে দেখা দেন না। তাই গুণেনও চিনতে পারেনি। উটকো একটা লোক এসে ঝামেলা পাকাচ্ছে মনে করে সে তেড়ে গিয়ে লোকটাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “কে হে তুমি, গুণ্ডামি করতে এসেছ? এ তো তোমার ভারী অন্যায় হে?”

তখনই আশীর্বাদটা এল। একটা ঠোকর ছদ্মবেশেই এল। এসে লাগল গুণেনের চোয়ালে। তারপর কিছুক্ষণ আর গুণেনের জ্ঞান ছিল না। যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে নিজের ঘরে, বিছানায় শুয়ে আছে। চোয়াল আর মাথা ছিঁড়ে পড়ছে ব্যথায়।

ব্যাপারটা যে আশীর্বাদ, তা তখনও বুঝতে পারেনি বটে। বুঝল একটু রাতের দিকে। যতবার ব্যথায় ককিয়ে উঠছে, ততবারই মনে হচ্ছে তার আর্তনাদেও যেন সুর লেগে যাচ্ছে। কখনও পূরবীতে “বাবা গো, মা গো” করে উঠছে, কখনও মালকোষ লেগে যাচ্ছে “মরে গেলুম রে, আর রক্ষে নেই রে” চেঁচানিতে। শেষে যখন “ওরে, তোরা কোথায়, আমাকে ধরে তোল” বলে চেঁচাতে গিয়ে গলায় বেহাগ লেগে গেল, তখন আর থাকতে না পেরে গুণেন উঠে পড়ল। তাই তো! গলায় এত সুর আসছে কোথা থেকে? তবে কি বারুদে আগুন লেগেছে? ঘুমন্ত কামান কি জাগল?

তানপুরাটা নামিয়ে বসে গেল গুণেন। দরবারি কানাড়া। আহা, সুর যেন রাধধনু ছড়াতে ছড়াতে বেরিয়ে আসতে লাগল। কী গলা, কী গিটকিরি! কুকুরগুলো অবধি ঘেউ ঘেউ না করে জানালার বাইরে বসে ল্যাজ নেড়ে নেড়ে শুনতে লাগল। তারপর মালকোষ। সুরের মায়াজালে যেন প্রকৃতির চোখে জল ঝরতে লাগল শিশিরবিন্দু হয়ে। নিজের গলাকে মোটেই চিনতে পারছিল না গুণেন। ভোরের দিকে সে ধরল আহির ভৈরোঁ। ধরামাত্রই গোয়াল থেকে রাঘববাবুর বারোটা গোরু একসঙ্গে জেগে উঠে গম্ভীর নিনাদে তাকে অভিনন্দন জানাল। আর সুরের ঠেলায় শিউলিফুল ছিটকে ছিটকে পড়তে লাগল ঘাসে। আর সূর্যদেব থাকতে না পেরে দশ মিনিট আগে উদয় হয়ে পড়লেন।

রাগরাগিণী ঠিকমতো গাইতে পারলে নানারকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়, প্রদীপের সলতে জ্বলে ওঠে, মেঘ করে বৃষ্টি হয়, আরও কত কী শুনেছে গুণেন।

তানপুরাটা রেখে গুণেন প্রথমে চোখের আনন্দাশ্রু মুছল। তারপর চারদিক চেয়ে ভারী অবাক হয়ে দেখল, মেঝেতে একটা টিকটিকি আর তার পাশে দুটো মাকড়সা মরে পড়ে আছে। আরও একটু খুঁজতেই দেখল শুদ্ধ সুরের হস্কায় পাঁচ-পাঁচটা আরশোলাও অক্কা পেয়েছে। আসল গান যে কী জিনিস তা আজ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারল গুণেন।

কিন্তু সুর দিয়ে প্রাণী-হত্যা করাটা কি ঠিক? এই ভেবে মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল তার।

বাইরে কোকিল ডাকছে না? হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। এই শরৎকালে তো কোকিলের ডাকার কথাই নয়! তবে কি সুরের খোঁচা খেয়ে ওদের গলাতেও গান এসে গেল!

সে তাড়াতাড়ি বাইরে এসে কান খাড়া করে কোকিলের ডাক শুনল। সামনেই পরাণ মালি বাগানের মাটি কোপাচ্ছে।

গুণেন গিয়ে তাকে বলল, “পরাণভাই, কোকিল ডাকছে কেন বলো তো!”

পরাণ নির্বিকার মুখে বলল, “এখানে সব বারোমেসে কোকিল মশাই, যখন-তখন ডাকে।”

কথাটা মোটেই সত্যি নয়। কোকিল কোথাও বারোমাস ডাকে না, বারোমেসে কোকিল বলেও কিছু নেই। কিন্তু এ নিয়ে পরাণ মালির

সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। ওরা একটা বুঝতে আর-একটা বোঝে।

তবু হাসি-হাসি মুখ করে সে পরাণকে জিজ্ঞেস করল, “গান শুনলে বুঝি? শরীরটা বেশ তরতাজা, ঝরঝরে লাগছে না?”

পরাণ অবাক হয়ে বলল, “গান! গান হচ্ছিল নাকি? কই, গান শুনেছি বলে তো মনে হচ্ছে না! একটা চেঁচানি শুনছিলুম বটে। ওই চেঁচানির ঠেলায় গান আর কানে এসে পৌঁছয়নি।”

একটু দমে গেল গুণেন। গানটা চেঁচিয়েই গাইতে হয় বটে, কিন্তু সেটাকে চেঁচানি বলাটা কি একটু বাড়াবাড়ি নয়? তা যাকগে, সমঝদার ছাড়া এ জিনিস তো আর কেউ বুঝবে না।

গোয়ালঘরের উঠোনে গেনু গয়লা দুধ দোয়াচ্ছিল। গুণেন শুনেছে, ভাল গান শোনালে গোরু নাকি বেশি দুধ দেয়। সে গিয়ে কিছুক্ষণ দুধ দোয়ানো দেখল। তারপর মুরুব্বির মতো জিজ্ঞেস

করল, “ওরে গেনু, দুধটা যেন একটু বেশি বেশি মনে হচ্ছে।”

“হাঁ হাঁ, কাহে নেহি? গোরুকে ঠিকমতো দেখভাল করলে জেয়াদা দুধ কাহে নাহি দিবে? হামি রোজ গোরুকে ঘাস বিচালি, লালি গুড়, খইল খিলাচ্ছি, উসি লিয়ে তো দুধ ভি জেয়াদা দিচ্ছে।”

“ওরে না। সে কথা নয়। সেসব তো রোজই খায়। তবু যেন আজ দুধটা একটু বেশিই দিয়ে ফেলছে!”

“কিউ নেহি বাবু? মুলতানি গাই আছে, যত খিলাবেন তত দুধ বাড়িয়ে যাবে। কাল রাঘববাবু তো ইসকো দো সের রসগুল্লা ভি খাইয়েছেন। উসি লিয়ে দুধ জেয়াদা দিচ্ছে।”

কথাটা মোটেই মনঃপূত হল না গুণেনের। ও ব্যাটা আসল ব্যাপারটা বুঝতেই পারেনি। কিন্তু গুণেন গোরুটাকে ভাল করে লক্ষ করে দেখল, মুখটা বেশ হাসি-হাসি। আর চোখে কেমন একটা বিভোর ভাব। অবোলা জীব, কথা তো আর কইতে পারে না, কিন্তু গুণমুগ্ধ চোখে গুণেনের দিকে চেয়ে আছে।

“হ্যাঁ রে গেনু, তুই গানবাজনা ভালবাসিস?”

“হাঁ হাঁ, জরুর। গান বাজনা তো হামার বহুত পসন্দ আছে। রোজ রাতে তো আমি ঢোল বাজাই আর রামা হো, রামা হো গানা ভি গাই।”

“ও গান নয় রে। এই যে একটু আগে আমি আলাহিয়া বিলাওল গাইলাম, শুনিসনি?”

“কাহে নেহি শুনবে বাবু? জরুর শুনেছে। উ তো বহুৎ উমদা গানা আছে বাবুজী। শুনে আমার দাদিমার কথা ইয়াদ হল।”

“কেন রে, তোর দিদিমার কথা মনে পড়ল কেন? তোর দিদিমা গান গাইত বুঝি?”

“নেহি বাবু, দাদিমা থোড়াই গান গাইবে। লেকিন হামার দাদিমা রোতা থা। কুছু হলেই দাদিমা কাঁদতে বইসে যেত। গরম পড়লে কাঁদত, শীত পড়লে কাঁদত, বরখ হলে কাঁদত। কাক বক মরলে কাঁদত। এইসন কাঁদত যে আশপাশ গাঁওমে কোই মারাটারা গেলে দাদিমাকে ভাড়া করে কাঁদবার জন্য নিয়ে যেত। আপনার গান শুনে হামার খুব দাদিমার কথা ইয়াদ হচ্ছে।”

ধুস! ব্যাটা গানের কিছুই বোঝে না। সমঝদার না হলে এইসব উচ্চাঙ্গের জিনিস বুঝবেই বা কে?

তবে খানিকটা দমে গেলেও আশার আলোও যে দেখা গেল না তা নয়। বুড়ো খাজাঞ্চি খগেন দফাদার তো গুণেনকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, “আহা, কী গানই না গাইলে হে গুণেন! কোনওকালে আমি কালোয়াতি গান পছন্দ করিনি। বরাবর মনে হয়েছে ও হল গলাবাজি করে সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করা। তা বাপু, তোমার গান শুনে দেখলুম এ গান খুবই উপকারী জিনিস।”

গুণেন সোৎসাহে বলল, “বটে! তা কী হল খাজাঞ্চিমশাই!”

“কাল পুকুরে চান করতে গিয়ে ডান কানে জল ঢুকে গিয়েছিল। কিছুতেই বেরোয় না। সারাদিন কান টনটন করেছে। খড়কে দিয়ে খুঁচিয়ে, তুলোর ঢিপলি ঠেসেও জল বের করা যায়নি। তারপর রাত্তিরে তোমার গান শুনে কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠে বসে যখন তোমাকে শাপ শাপান্ত করছি, তখনই অবাক কাণ্ড হে! গানের ধাক্কায় কানের জল সুড়সুড় করে বেরিয়ে এল। সে যে কী আরাম, তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। চালিয়ে যাও হে, তোমার হবে।”

আনন্দে ডগমগ হয়ে গুণেন তার গানের আর কী কী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হল তা দেখতে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল।

“এই যে ভাইটি!”

সামনে পর্বতপ্রমাণ হাবুদাসকে দেখে গুণেন হাসি-হাসি মুখ করে দাঁড়াল। হাবু দাসের চোখমুখে ভাবের খেলা দেখেই সে বুঝেছে গানের সম্মোহনে হাবু সমাচ্ছন্ন।

হাবু দাস ফিচিক করে হেসে বলল, “তোমাকে একটা মজার ধাঁধা জিজ্ঞেস করছি। ভেবেচিন্তে বলো তো দেখি। এই আমার নাম যদি হাবু হয়, পাঁচুর নাম যদি হয় পাঁচু, গোলাপ রায়ের নাম যদি হয় গোলাপ রায়, এবাড়িটা যদি রাঘববাবুর হয়, আর এ গাঁয়ের নাম যদি হয় হাট গোবিন্দপুর, তা হলে তোমার নামটা কী হবে?”

“অ্যাঁ।”

“হ্যাঁ, খুব সোজা অঙ্ক। যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করলেই বেরিয়ে পড়বে। তাড়া নেই, ভেবেচিন্তে বলল তো!”

গুণেন হাঁ হয়ে গেল। বলল, “তার মানে?” খিকখিক করে হেসে হাবু বলল, “পারলে না তো! দুয়ো, দুয়ো।”

বলেই হনহন করে হেঁটে চলে গেল। তার গানের প্রভাবে যে চারদিকে নানারকমের পরিবর্তন হয়েছে সে বিষয়ে গুণেনের সন্দেহ রইল না। কিন্তু দুনিয়াটা এতটা বদলে যাওয়া কি ভাল?

গুণেন হঠাৎ থমকে গেল। তাই তো! হাবু তো কিছু ভুল বলেনি। বাস্তবিক হঠাৎ এখন খেয়াল হল, নিজের নামটা তো সত্যিই মনে পড়ছে না! কী যেন নামটা তার!