হরিপুরের জঙ্গলে পৌঁছতে বেশি সময় লাগল না। বিকেলের শুরুতেই পৌঁছে গেল তারা।
ফটিক একটু ইতস্তত করে বলল, “ঢুকব রে নিতাই?”
“না ঢুকলে জঙ্গল পেরোবি কী করে? আয় তো।”
জঙ্গল খুব একটা ঘন নয়। ভেতরে দিব্যি একটা শুড়িপথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে। দু’জনে ঢুকে পড়ল।
নির্বিঘ্নেই হাঁটছিল তারা। বনটা যেখানে একটু ঘন হয়ে এল সেখানে একটা মস্ত গাছ। গাছের তলায় পা দিতেই হঠাৎ সামনে ঝুপ করে কে একটা লাফিয়ে নামল। দুজনে চমকে উঠে ভয় খেয়ে থমকে দাঁড়াল। লাফ-দেওয়া লোকটার পরনে খাটো মালকোঁচা মারা ধুতি, গায়ে একটা বেনিয়ান, মুখটা লাল একটা গামছায় ঢাকা, হাতে একখানা ছোরা। লোকটা উবু হয়ে বসে তাদের দিকে জ্বলজ্বল করে চেয়ে দেখছিল। হঠাৎ একটু ককিয়ে উঠে বলল, “উঃ, মাজাটা গেছে বাপ। এই বয়সে কি আর লাফঝাঁপ সয়। বলি হাঁ করে দেখছিস কী আহাম্মকেরা? ধরে একটু তুলবি তো!”
নিতাই আর ফটিক চোখাচোখি করে নিয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে লোকটাকে দাঁড় করাল। লোকটা নিতান্তই ছোটখাটো, বয়সও সত্তরের ওপর। নিতাই বলল, “এই জঙ্গলের মধ্যে ছোরা নিয়ে কী করছিলেন?”
লোকটা মুখ বিকৃত করে বলল, “গুষ্টির পিণ্ডি চটকাচ্ছিলাম রে বাপ। নে, আর কথা বাড়িয়ে কাজ নেই, সঙ্গে যা আছে সব দিয়ে এখন মানে মানে কেটে পড়।”
নিতাই অবাক হয়ে বলল, “তার মানে! আপনি কি ডাকাত নাকি?”
মুখের গামছাটা সরিয়ে লোকটা খিঁচিয়ে উঠল, “ডাকাত না তো কী? সঙ নাকি?”
নিতাই হেসে ফেলে বলল, “আমাদের কাছে কিছু নেই। আমরা দু’জনেই গরিব মানুষ।”
লোকটা ভারী হতাশ হয়ে গামছা দিয়ে মুখ মুছে বলল, “সবাই যদি ওই কথা বলে তা হলে আমার চলে কীসে বলতে পারিস? যাকেই ধরি সেই বলে, কিছু নেই, আমরা গরিব। আবার কেউ বলে, পরে দিয়ে যাব। ওরে বাবা, চুরি-ডাকাতিতে কি আর ধারবাকি চলে? এ হল নগদানগদির কারবার।”
ফটিক হাঁ করে লোকটাকে দেখছিল। এবার সাহস করে বলল, “আপনিই কি কালু ডাকাত?”
রোগা লোকটা বুক চিতিয়ে বলল, “তবে?”
“তা আপনাকে তো একা দেখছি! আপনার শাগরেদরা সব কোথায়?”
কালু ডাকাত ভারী বিরক্ত হয়ে মুখোনা বিকৃত করে বলল, “তাদের কথা আর বলিসনি৷ বুড়ো হয়ে কয়েকটা মরেছে, যারা আছে তাদের কতক ঘরগেরস্থালি চাষবাস নিয়ে আছে, কতক আবার বুড়ো বয়সে ধম্মকম্ম নিয়ে মেতে আছে। তাদের অধঃপতন দেখলে চোখের জল চাপতে পারবি না। আমি এখন একাই এই হরিপুরের জঙ্গল সামলাচ্ছি। তা যাকগে সেসব দুঃখের কথা। সঙ্গে একশো দুশো যা আছে দিয়ে ফেল তো, তারপর হালকা হয়ে যেখানে যাচ্ছিস চলে যা। গায়ে আঁচড়টিও পড়বে না।”
নিতাই জিভ কেটে বলল, “ছিঃ ছিঃ, কী যে বলেন কালু ওস্তাদ।
আপনার মতো মান্যগণ্য ডাকাতের কি আমাদের মতো এলেবেলে লোকের ওপর চড়াও হওয়া শোভা পায়! আমাদের বেচলেও একশো দুশো টাকা হবে না।”
“তবে তো মুশকিলে ফেললি। আজ এখন অবধি বউনিটাই হয়নি যে! বিশ পঞ্চাশটা টাকা হয় কিনা বাক্সপ্যাটরা হাতড়ে একটু দেখ দিকি বাপু।”
ফটিক মুখোনা মলিন করে বলে, “বিশ পঞ্চাশ! সে যে অনেক টাকা দাদু!”
কালু করুণ মুখ করে বলল, “আজ মনসাপোঁতায় হাটবার। গিন্নি একটা ফর্দ ধরিয়ে দিয়েছে। তা সেসব আর হবে না দেখছি। তা না হোক, অন্তত বউনিটা করিয়ে দে তো বাপ। পাঁচ দশ যা হোক দে দিকি। এই হাত বাড়িয়ে মুখটা ফিরিয়ে রাখছি। ছুঁচো মেরে হাত গন্ধই হচ্ছে বটে, কিন্তু বউনিটা যে না হলেই নয়।”
নিতাই ব্ল্যাক থেকে একখানা সিকি বের করে কালু ডাকাতের হাতে দিতেই হাতটা মুঠো করে কালু বলল, “কী দিলি? কিছু তো টেরই পাচ্ছি না।”
নিতাই ভারী লাজুক গলায় বলল, “ও আর দেখবার দরকার নেই। পকেটে পুরে ফেলুন।”
“কিছু দিয়েছিস তো সত্যিই?”
“দিয়েছি।”
কালু চোখ না খুলেই বলল, “বড্ড ছোট জিনিস দিয়েছিস রে। এ কি সিকি নাকি?”
নিতাই বলল, “আর লজ্জা দেবেন না। সিকি ছোট জিনিস বটে, কিন্তু আমাদের কাছে সিকিও অনেক পয়সা। আপনার বউনি হয়নি বলেই দেওয়া।”
কালু সিকিটা পকেটে পুরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “দেশে এত গরিব কোত্থেকে আসছে বল ত! গরিবে গরিবে যে গাঁ-গঞ্জ ভরে গেল! এ তো মোটেই ভাল লক্ষণ নয়।”
ফটিক বলল, “আজ্ঞে, দেশের খুবই দুরবস্থা। এবার আমাদের ছেড়ে দিন, অনেকদূরে যাব।”
কালু ডাকাত ফের গাছে উঠতে উঠতে বলল, “যাবি তো যা। তবে লোককে সিকির কথাটা বলিস না। তা হলে ওটাই রেট ধরে নেবে সবাই।”
নিতাই বলে, “আজ্ঞে না। ওসব গুহ্য কথা কি কেউ ফাঁস করে?”
কালু ডাকাতের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে দু’জনে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল।
জঙ্গল পেরিয়েই একটা ফাঁকা জায়গা। বাঁ ধারে নাবাল জমি, ডানে ধানখেত। মাঝখান দিয়ে রাস্তা।
ফটিক একটু ভয়-খাওয়া গলায় বলল, “এটাই কি গনা ডাইনির জলা নাকি রে নিতাই?”
নিতাই জবাব দেওয়ার আগেই বাঁ ধার থেকে খোনা সুরে জবাবটা এল, “হ্যাঁ গো ভালমানুষের পো, এটাই গনা ডাইনির জলা। তা তোমরা দুটিতে চললে কোথায়? আহা রে, মুখ যে একেবারে শুকিয়ে গেছে! আয় বাছারা, বসে দুটি ফলার খেয়ে যা।”
ফটিক চমকে উঠে বলল, “বাপ রে! বাঁ ধারে তাকাস না নিতাই, দৌড়ো!”
নিতাই কিছু সাহসী। সে বলল, “দাঁড়া না, রগড়টা দেখেই যাই।”
ফটিক দৌড়ে পালাল বটে, কিন্তু নিতাই পালাল না। সে বাঁ ধারে চেয়ে দেখল, একখানা খোড়ো ঘরের সামনে একজন খুনখুনে বুড়ি লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের চালে দিব্যি লাউডগা উঠেছে, ফলন্ত গাছগাছালি, কলার ঝাড়ও দেখা যাচ্ছে।
নিতাই হেঁকে বলল, “তা কী খাওয়াবে গো ঠাকুমা? আমাদের বড্ড খিদে পেয়েছে।”
বুড়ি বাঁ হাত তুলে লম্বা লম্বা আঙুলে হাতছানি দিয়ে বলল, “আয় বাছা আয়! কত খাবি খেয়ে যা।”
নিতাইয়ের বুকটা একটু দুরুদুরু করল বটে, তবে সে এগিয়েও গেল। এত খিদে পেয়েছে যে, ফলারের লোভ সামলানো মুশকিল। সামনে দিব্যি নিকোনো উঠোন। উঠোনের মাঝখানে একখানা কদম গাছ। চারদিকে গোরু, ছাগল, ভেড়া, কুকুর, বেড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে।
নিতাই বলল, “তা আপনিই কি গনা ডাইনি ঠাকুমা?”
“তাই তো সবাই বলে রে বাপ, ভয়ে কেউ ধারেকাছে আসে না।”
“তা লোকে ভয়ই বা পায় কেন?”
গনা ডাইনি দুঃখ করে বলল, “খামোখা ভয় পায় বাপ, খামোখা ভয় পায়। চেয়ে দেখ দিকি, কাউকে কি আমি খারাপ রেখেছি! ওই যে দেখছিস ধাড়ি ছাগলটা, ও হল নবগ্রামের পটু নস্কর। এক নম্বরের সুদখোর, ছ্যাঁচড়া, পাজি লোক। দেখ তো এখন কেমন দিব্যি আছে। ঘাসপাতা খায়, চরায় বরায় ঘুরে বেড়ায়। আর ওই যে গোরুটা দেখছিস, ছাই-ছাই রঙা, ও হল গোবিন্দপুরের অতসী মণ্ডল। এমন ঝগড়ুটে ছিল যে, পাড়ায় লোক তিষ্ঠোতে পারত না। ওর স্বামীটা সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে গেছে। এখন দ্যাখ তো, অতসী কেমন ধীরস্থির ঠাণ্ডা মেরে গেছে। সাত চড়ে রা কাড়বে না। আর ওই কেলে কুকুরটা কে বল তো! ও হল চরণগঙ্গার হরিপদ দাস। সবাই বলত, খুনে হরিপদ। কত খুনখারাপি যে করেছে তার হিসেব নেই। এখন দ্যাখ, কেমন মিলেমিশে আছে সবার সঙ্গে। কারও খারাপ কিছু করেছি কি, তুই-ই বল। আর ওই জলায় যাদের পুঁতে রেখেছি তাদেরও তো প্রাণে মারিনি রে বাপু। ওই দ্যাখ, গদাই নস্কর কেমন চুরি করা ছেড়ে বকুল গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছে। ওই যে শিমুলগাছটা দেখছিস ও হল হাড়কেপ্পন গণেশ হাওলাদার। আর ওই যে দেখছিস…”
নিতাইয়ের মাথাটা ঝিমঝিম করছিল, ধপ করে কদমগাছটার তলায় বসে পড়ে চোখ বুজে ফেলল। অতি-সাহস দেখাতে গিয়ে বড় ভুল করে ফেলেছে তা বুঝতে পারছে হাড়ে হাড়ে। কিন্তু এখন হাত পা এমন অবশ যে, পালানোর শক্তিও নেই।
গনা ডাইনি খলখল করে হেসে বলল, “মুচ্ছো গেলি নাকি বাপ? তা ভয়টা কীসের? তোর জন্য আমি খুব ভাল ব্যবস্থা করছি। মন্তর পড়ে এই ধুলোপড়া যে-ই গায়ে ছুঁড়ে মারব সেই তুই একটা চনমনে টগবগে সাদা ঘোড়া হয়ে যাবি। ঘোড়া হওয়া কি খারাপ বল! সাদা ঘোড়ার দেমাকই আলাদা।”
নিতাই আধবোজা চোখে চেয়ে দেখল, গনা ডাইনি উঠোন থেকে একমুঠো ধুলো তুলে নিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছে। নিতাই অবশ শরীরে বসে ঘোড়া হওয়ার বিবিধ অসুবিধের কথা ভেবে নিচ্ছিল। প্রথম অসুবিধে, ঘোড়া হলে তার চারটে পা গজাবে বটে কিন্তু হাত দুটো গায়েব হয়ে যাবে। হাত না থাকলে লেখাপড়া করা যাবে না, একটু ছবি আঁকার শখ ছিল তার, তা সেটারও বারোটা বাজল, কালী নন্দীর কাছে তবলার মহড়া নিচ্ছিল, তারও হয়ে গেল। উপরন্তু হাত দিয়ে মেখে ভাতের গরাস মুখে তোলাও ভুলতে হবে। ঘাসপাতা খেতে কেমন লাগে সে জানে না। ওসব তার সইবে কি? পোস্ত চচ্চড়ি, পোড়ের ভাজা, মুগের ডাল বা মাছের ঝোলের কথাও ভুলতে হবে। অসুবিধে আরও আছে। সে শুনেছে ঘোড়ারা দাঁড়িয়ে ঘুমোয়। সে কস্মিনকালে দাঁড়িয়ে ঘুমোয়নি, এখন পেরে উঠবে কী?”
গনা ডাইনি মন্ত্র পড়া শেষ করে মুঠোভর ধুলো তার গায়ে ছুঁড়ে মেরে একগাল হেসে বলল, “নে বাপ, এবার ঘোড়া হয়ে আনন্দে থাক। কোনও ঝায় ঝামেলা আর রইল না।”
নিতাই চিঁ হিঁ হিঁ বলে একটা ডাক ছেড়ে গা-সাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল। ঘোড়া হয়ে তার অন্যরকম কিছু লাগছে না তো! নিজেকে এখনও নিতাই-নিতাই বলেই মনে হচ্ছে যে!
গনা ডাইনি গোল গোল চোখ করে তাকে দেখছিল। এবার ভারী হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “নাঃ, মন্তরে কাজ হচ্ছে না তো! আর হবেই বা কী করে? পাঁচ কুড়ি সাত বচ্ছর বয়স হল বাপ, মাথাটার কি কিছু আছে! সব কেমন ভুল হয়ে যায়। অর্ধেক মন্তর বলার পর কেমন যেন ঢুলুনি এসে পড়ে, তারপর আর বাকি মন্তরটা মনেই পড়ে না। মাথাটা বেভুল হয়ে পড়েছে বড্ড।”
নিতাই গা ঝাড়া দিয়ে বসল। তার ভয়ডর কেটে গেছে। সে বেশ চেঁচিয়েই বলে উঠল, “তা বললে হবে কেন ঠাকুমা? আমার যে অনেকদিন ধরে ঘোড়া হওয়ার বড় শখ! আপনি ঘোড়া বানিয়ে দেবেন বলে কত আশা করে বসে ছিলাম। কিন্তু এ তো দেখছি জোচ্চুরি! আঁ! এ যে দিনে ডাকাতি! এ যে সাঙ্ঘাতিক লোকঠকানো কারবার!”
গনা ডাইনি আকুল হয়ে বলল, “ওরে চুপ! চুপ! লোকে শুনতে পেলে যে গনা ডাইনির বাজার নষ্ট হবে! চুপ কর ভাই, যা চাস দেব।”
নিতাই মাথা নেড়ে বলল, “না না, আমি কিছু চাই না, আমি শুধু ঘোড়া হতে চাই। ঘোড়া হব বলে সেই কতদূর থেকে আসা! এত নামডাক শুনেছিলুম আপনার, এখন তো দেখছি পুরোটাই ফাঁকিবাজি।”
“চেঁচাসনি বাপ, চেঁচাসনি। লোকে শুনলে দুয়ো দেবে যে আমাকে! তা কী খাবি বাপ, বল তো! ভাল চিড়ে, মুড়কি, ঝোলা গুড়, পাকা কাঁঠাল আর তালের বড়া হলে হবে? সঙ্গে বিচেকলাও দেব’খন।”
নিতাই একটু নরম হয়ে বলল, “এ তো নাকের বদলে নরুন হল গো ঠাকুমা! তা কী আর করা যাবে, তাই আনুন দেখি।”
ওদিকে ফটিক পালালেও বেশিদূর যায়নি। নিতাই আসছে না দেখে সেও গুটিগুটি ফিরে এল। তারপর আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখল, নিতাই কদমগাছের তলায় পিড়িতে বসে বিরাট ফলার সাঁটাচ্ছে। খিদে ফটিকেরও পেয়েছে। সুতরাং ভয়ডর ঝেড়ে ফেলে সেও গিয়ে নিতাইয়ের পাশে বসে পড়ল।
গনা ডাইনি ঘর থেকে বিচেকলা নিয়ে বেরিয়ে এসে ফটিককে দেখে বলল, “ওমা! এ আবার কে রে?”
নিতাই একটু হেসে বলল, “আমিও একটু-আধটু মন্তর জানি গো ঠাকুমা। তোমার বাড়ি ছাগলটাকে মন্তর দিয়ে পটু নস্কর বানিয়ে দিয়েছি ফের। দাও, ওকেও ফলার দাও। আহা বেচারা কতকাল ঘাসপাতা খেয়ে আছে।”
গনা ডাইনি উচ্চবাচ্য না করে ফটিককেও দিল।
খুব খেল দু’জনে। খেয়ে খেয়ে টান হয়ে গেল। তারপর জল খেয়ে উঠে পড়ল, “চলি গো ঠাকুমা।”
গনা ডাইনি বলল, “আয় বাছা, আজকের বৃত্তান্তটা যেন পাঁচকান করিসনি।”
“পাগল! এসব গুহ্য কথা কি কাউকে বলতে হয়?”
রাস্তায় এসে হাঁটতে হাঁটতে ফটিক বলল, “তোর কি দুর্জয় সাহস? ডাইনির ডেরায় কোন সাহসে ঢুকলি, যদি পাঁকে পুঁতে ফেলত বা গোরু ভেড়া করে দিত?”
“ধুস! গোরু ভেড়া হতে যাব কেন? আমি একটা সাদা ঘোড়া হয়ে যাচ্ছিলাম। সেসব কথা পরে হবে। ওই দ্যাখ, অষ্টভুজার মন্দির।”
ফটিক বলল, “ওখানে আর দাঁড়ানোর দরকার নেই। চল দৌড়ে পেরিয়ে যাই।”
নিতাইয়ের এখন সাহস খুব বেড়ে গেছে। বলল, “পালাব কেন? সব দেখেশুনে নেওয়া ভাল, অভিজ্ঞতায় জ্ঞান বাড়ে।”
অষ্টভুজার মন্দির হেসেখেলে এক-দেড়শো বছরের পুরনো হবে। চারদিকে মস্ত মস্ত বটগাছ। বটের ঝুরি নেমে জায়গাটা এই বিকেলবেলাতেও অন্ধকার করে রেখেছে। মন্দিরের চত্বরে ঢুকতেই তারা শুনতে পেল একটা গুরুগম্ভীর গলা মন্দিরের ভেতর থেকে বলছে, “মা! মা! নররক্ত চাই মা করালবদনী? নরবলি চাস মা? আজ অমাবস্যার রাতেই নরবলি দেব মা!”
ফটিকের মুখ শুকিয়ে গেল। কাঁপা গলায় বলল, “শুনছিস?”
নিতাই বলল, “শুনছি, কিন্তু ভয় খাস নে। লোকটাকে একটু বাজিয়ে দেখতে হবে।”
এই বলে নিতাই হঠাৎ বিকট একটা হাঁক মারল, “ঠাকুরমশাই আছেন নাকি? ঠাকুরমশাই!”
ভেতরে গুরুগম্ভীর গলাটা হঠাৎ থেমে গেল। একটু বাদে যে লোকটা মন্দির থেকে বেরিয়ে এল তাকে দেখে ফটিকের মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। ঘাড়ে গর্দানে বিশাল চেহারা, পরনে টকটকে লাল রক্তাম্বর, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে তেল সিঁদুরের ত্রিশূল আঁকা, চোখ দুখানা ভাঁটার মতো জ্বলছে।
বজ্রগম্ভীর স্বরে লোকটা জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কারা? কী চাও?”
নিতাই বেশ গলা তুলে বলে উঠল, “পেন্নাম হই ঠাকুরমশাই! তা অনেকদূর থেকে আসছি। শুনলুম এই অষ্টভুজার মন্দিরে নিয়মিত নরবলি হয়। সেই শুনেই আসা।”
লোকটা বলল “অত চেঁচামেচি করার দরকার নেই। ওতে মায়ের বিশ্রামের ব্যাঘাত হয়।”
নিতাই গলা একটুও না নামিয়ে ফের চেঁচিয়ে বলল, “বড় আশা করে এসেছি যে ঠাকুরমশাই। এসেই শুনতে পেলুম আপনি আজ রাতেই মায়ের সামনে নরবলি দেবেন। আমাদের ভাগ্যটা ভালই, কী বলেন!”
লোকটা অস্বস্তি বোধ করে চারদিকে চেয়ে নিয়ে চাপা গলায় বলল, “তোমরা ভুল শুনেছ।”
নিতাই দুঃখের গলায় বলল, “এঃহেঃ, এতবড় একটা ভুল খবর পেয়ে এতদুর এলাম। নরবলি দেখার যে খুব সাধ ছিল মশাই!”
লোকটার চোখ হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে উঠল, বজ্রনির্ঘোষে বলে উঠল, “দেখতে চাও?”
নিতাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ কোথা থেকে দুটো মুশকো লোক এসে দু’দিক থেকে ধরে তাকে পেড়ে ফেলল। তারপর চোখের পলকে হাত দুটো পিছমোড়া করে আর পা দুটোও বেঁধে তাকে হাড়িকাঠে উপুড় করে ফেলে গলার কাছে খিলটা আটকে দিল।
জবরদস্ত লোকটা চেঁচাচ্ছিল, “ওরে তাড়াতাড়ি কর! তাড়াতাড়ি কর! সতীশ দারোগা এসে পড়বে।”
দুটো মুশকো লোক, একজন দৌড়ে গিয়ে একটা ঢাক নিয়ে এসে ট্যাং ট্যাং করে বাজাতে লাগল, অন্যজন একখানা চকচকে খাঁড়া এনে বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে “জয় মা, জয় মা অষ্টভুজা! জয় মা নৃমুণ্ড-মালিনী” বলে নিতাইয়ের চারদিকে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরতে লাগল।
ঠাকুরমশাই উচ্চস্বরে বলির মন্ত্র পড়ছেন আর মাঝে-মাঝে বলে উঠছেন, “নররক্ত চাই মা? নরবলি চাই মা? তোর ইচ্ছেই পূর্ণ হোক।”
মন্ত্র পড়া শেষ করে ঠাকুরমশাই বলে উঠলেন, “তাড়াতাড়ি কেটে ফেল বাবা, সতীশ দারোগা কখন হানা দেয় তার ঠিক নেই।”
যে ঢাক বাজাচ্ছিল সে দৌড়ে গিয়ে একটা মাটির সরা এনে নিতাইয়ের মুখের নীচে পেতে দিল, বোধ হয় এতে করেই কাটা মুণ্ডুটা নিয়ে গিয়ে অষ্টভুজাকে ভোগ দেবে।
দ্রিমি দ্রিমি করে ঢাক বাজতে লাগল। নিতাইয়ের মনে পড়ল, বলির সময়ে এরকম বাজনাই বাজে বটে। ভয়ে সে চোখ বুজে ফেলল। নাঃ, অষ্টভুজার মন্দিরের কাঁপালিককে চটানোটা বড্ড আহাম্মকিই হয়ে গেছে।
ঠাকুরমশাই জলদগম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, “জয় মা! এবার ঘ্যাচাং করে দাও হে গদাইচাঁদ।”
“আজ্ঞে বাবা।” বলেই খাঁড়াটা ওপরে তুলল বলাই।
খাঁড়াটা নেমেও এল বটে, তবৈ বেশ আস্তে। নিতাই ঘাড়ে একটু চিনচিনে ব্যথা টের পেল। তার গলা বেয়ে দু’ফোঁটা রক্তও পড়ল সরায়।
লোকটা খাঁড়াটা ফেলে হাড়িকাঠের খিল খুলে দিয়ে হাত পায়ের বাঁধন আলগা করে নিতাইকে দাঁড় করিয়ে একগাল হেসে বলল, “তোর বড় ভাগ্য, মায়ের কাছে বলি হলি, তোর চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার পেয়ে গেল।”
ঠাকুরমশাই সরাটা তুলে নিয়ে ভক্তিগদগদ গলায় “জয় মা, এই যে নররক্ত এনেছি মা, নে মা …. নে মা …” বলতে বলতে মন্দিরে ঢুকে গেল।
নিতাই ঘাড়ে হাত বুলিয়ে বলল, “বলি হয়ে গেলুম নাকি? কিন্তু ঘাড়টা তো আস্তই আছে।”
বলাই একটু হেসে বলল, “এর বেশি বলি দেওয়ার কি উপায় আছে রে? সতীশ দারোগা নিয়ে গিয়ে ফাটকে পুরবে যে। তারপর ফাঁসিতে ঝোলাবে। আসলে বলি হত ঠাকুরমশাইয়ের পিতামহের আমলে। এখন যা হয় তাকে কী একটা বলে যেন, পতিক না পরীক কী যেন।”
“প্রতীক নয় তো!”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওইটেই। বলিও হল, ঘাড়ও আস্ত রইল, মাও নররক্ত পেয়ে খুশি হয়ে গেলেন।”
ঢাকি লোকটা একটু তুলোয় করে আয়োডিন এনে তার ঘাড়ের কাটা জায়গাটায় লাগিয়ে বলল, “এবার কেটে পড়ো তো বাপু, সতীশ দারোগা এসে পড়লে কিন্তু সবাইকে থানায় নিয়ে যাবে।”
হতবুদ্ধি নিতাই তাড়াতাড়ি রওনা হল। বাঁশবনের মধ্যে ফটিকের সঙ্গে দেখা। ভয়ে কাঁপছে।
“তুই যে বলি হলি? ভূত নোস তো৷”
“তাও বলতে পারিস।”
“ওরে বাবা–“
হঠাৎ একটা বাঁশের ডগা মটমট করে দুলে উঠল, ওপর থেকে কে একজন হেঁড়ে গলায় বলে উঠল, “কে রে, কোন ভূত ঢুকেছিস আমাদের বাঁশবনে?”
দু’জনেই ভয়ে হিম হয়ে গেল। নিতাই কাঁপা গলায় কোনও রকমে বলল, “আমরা ভূতটুত নই, নিতান্তই মনিষ্যি।”
বাঁশের ডগাটা আবার নড়ল। হেঁড়েগলা বলল, “অ, তুই তো একটু আগে অষ্টভুজার মন্দিরে বলি হলি।”
“যে আজ্ঞে।”
“তা তোর কপালটা ভাল, আমাদের কপাল তত ভাল ছিল না। ওই হরু ঠাকুরের ঠাকুর্দা বীরু কাঁপালিকের হাতে আমরা সত্যিই বলি হয়েছিলাম। সেই থেকে কবন্ধ হয়ে এই বাঁশবনে থানা গেড়েছি।”
নিতাই সভয়ে জিজ্ঞেস করল, “হা-ডু-ডু খেলতে হবে নাকি? শুনেছি, আপনারা মানুষ পেলে হা-ডু-ডু খেলেন।”
“সে খেলতুম রে। মনসাপোতার জয়নাথ পণ্ডিত আমাদের একটা দাবা আর খুঁটি কিনে দিয়েছে। খেলাটাও শিখে নিয়েছি। আহা, দাবার মতো খেলা নেই। হা-ডু-ডু আবার একটা খেলা? যা, তোরা, আমার মন্ত্রী এখন ঘোড়ার মুখে পড়েছে।”
দু’জনে হুড়মুড় করে বাঁশবনটা পেরিয়ে করালেশ্বরীর খালের ধারে এসে পড়ল। কিন্তু কোথায় খাল! শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে আছে। খালের ভেতর দিয়ে পায়েচলার রাস্তা। ফটিক হাঁফ ছেড়ে বলল, “যাক বাবা, দড়িতে ঝুলে পেরোতে তো হবে না।”
সন্ধে হয়ে আসছে। ওপারেই দোগেছে।
খালটা যখন প্রায় পেরিয়ে এসেছে তখন দেখা গেল একটা লোক উবুহয়ে বসে আছে। তার পায়ের কাছে অনেক গোদা গোদা টিকটিকি, লোকটা একটা খালুই থেকে চুনোমাছ বের করে টিকটিকিদের খাওয়াচ্ছে। আর তারাও মহানন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে খাচ্ছে।
দৃশ্যটা দেখে দাঁড়িয়ে গেল দুজন।
ফটিক বলল, “লোকটার বড্ড দয়ার শরীর, টিকটিকিদের মাছ খাওয়াচ্ছে দ্যাখ।”
লোকটা মুখ তুলে বলল, “টিকটিকি নয় গো, টিকটিকি নয়।”
“তবে?”
“এরা সব হল করালেশ্বরীর বিখ্যাত কুমির। একসময়ে দশ বিশ হাত লম্বা ছিল। আস্ত আস্ত গোরু মোষ ছাগল কপাত কপাত করে গিলে ফেলত। তা করালেশ্বরীর খাল হেজেমজে গেল, আর কুমিরগুলোও না খেতে পেয়ে শুকিয়ে শুকিয়ে সব একটুখানি হয়ে গেল। তাদের বাচ্চাগুলোও ছোট ঘোট হতে লাগল। তস্য বাচ্চাগুলো আরও ছোট হতে লাগল। হতে হতে এই দশা।
“কুমির?” বলে ফটিক এক লাফে উঁচু ডাঙায় উঠে গেল।
লোকটা বলল, “ভয় নেই গো, ওদের কি আর সেই দিন আছে? এখন চুনোমাছের চেয়ে বড় কিছু খেতেই পারে না। আর তাই বা ওদের দেয় কে বলল! এই আমারই একটু মায়া হয় বলে বিকেলের দিকে এসে খাইয়ে যাই।”
নিতাই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে বলল, “মনে হচ্ছে এ হল কুমিরের বনসাই।”
সন্ধে হয়ে আসছে বলে দু’জনে আর দাঁড়াল না। করালেশ্বরীর মরা খাত পেরিয়ে দোগেছের মাটিতে পা দিয়েই তারা বুঝল,এ এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। অনেক পাকা বাড়ি, বাঁধানো রাস্তা আর দোকানপাট দেখা যাচ্ছে।